পরিবেশ-বিচ্ছিন্নতা ও তার ভবিষ্যৎ : আস্তিত্বিক ট্র‍্যাজেডির যাত্রাপথ

(কার্ল মার্কসের অ্যালিয়েনেশন তত্ত্বের আলোকে)

সাহাবুদ্দিন

এক

মানুষ? সে তো নক্ষত্রের সন্তান। সে কারণেই কি বিচ্ছিন্নতা (alienation) তার  সহজাত? আর সেই  বিচ্ছিন্নতা কি অনিবার্য, অমোঘ? তার চেয়েও বড়ো কথা, এ কি প্রকৃত অর্থে আদৌ কোনো বিচ্ছিন্নতা, না কি প্রহেলিকা? লক্ষ কোটি বছরের আলোকাভিসারের যাত্রাপথে চলতে চলতে আজ কোথায় দাঁড়িয়ে মানুষ?  মাতৃস্বরূপা নক্ষত্র থেকে তার এই (আপাত) বিচ্ছিন্নতা প্রকৃত অর্থেই যদি বিচ্ছিন্নতা হত, তাহলে  মহাজাগতিক নিয়মের নিগড়ে বাঁধা থাকত কি মানুষের অস্তিত্ব? কোন সে মহাচ্ছন্দ যাতে মানুষ তথা সমগ্র জীবজগৎকে সঙ্গে নিয়ে ‘বন্দী হল যুগ-যুগ-যুগ-যুগান্তর / অসীম জগৎ চরাচর’?[১] কেন ‘অস্তিত্বের চক্রতলে / একবার বাঁধা পলে’[২]  মানুষের  নিস্তার নেই?  কণা-পদার্থবিদদের ভাষায় এ কী কোনো  কোয়ান্টাম প্রহেলিকা, কোনো  অমোঘ  এনট্যাঙ্গলমেন্ট, যা বিজ্ঞানদীপ্ত কবির মরমি উপলব্ধিতে অবিনশ্বরতার সাংগীতিক মূর্ছনায় বাজে আর বলে ‘… কোথাও মৃত্যু কোথা বিচ্ছেদ নাই’?[৩] যে আস্তিত্বিক অনিবার্যতা মাতৃস্বরূপা নক্ষত্র থেকে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করেও সেই নক্ষত্রকেই আবর্তন করে লাট্টুর মতো পাক খাইয়ে চলেছে অন্তহীন, তাকে অস্বীকারে মূঢ়তা দেখায় যে মানুষ, সে তো তার আপাত বিচ্ছিন্নতার গল্প শোনাবেই, দেখাবেই তার জগৎ তথা পরিবেশ-বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিসত্তার তথাকথিত উদবোধন তথা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ফানুস। কিন্তু ব্যক্তিসত্তার বিকাশের দোহাই দিয়ে প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ (অন্যান্য মানুষ) তথা বিশ্বচরাচর থেকে  বিচ্ছিন্ন হতে হতে  শেষপর্যন্ত  কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে? 

প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন মানুষ কি জানে যে একলা হওয়ার গৌরব আর একাকিত্বের দৈন্য এক নয়? নিজের সঙ্গে দেখা করার যে আর্তি, নিজের সঙ্গে কথা বলার যে আত্মসমাহিত নিভৃতি, যে অন্তর্লীন আনন্দ-যাপন, সে তো সঙ্গী করে এক ইতিবাচক বিচ্ছিন্নতার সৃজনশীল মাহাত্ম্যকে, যা মানুষের মহার্ঘ অর্জন। ইট-কাঠ-পাথর আর কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে  চূড়ান্ত দূষণের কুয়াশায় ক্লান্ত প্রাণের মুক্তির নিবিড় আকুতি  শিল্প-বিপ্লবোত্তর পৃথিবীতে প্রসব করেছিল যে রোমান্টিক মুভমেন্টের অন্তরশায়ী স্লোগান — ‘Return to Nature’, প্রকৃতি-সম্পৃক্তির লক্ষ্যে  সেই  ‘romantic escapism’ অবশ্যই  এক ইতিবাচক বিচ্ছিন্নতা, যা মানুষের আত্মনিমগ্ন সত্তার অমূল্য উপহার। এমনকি, রবীন্দ্রনাথ যে অমোঘ বিচ্ছিন্নতার স্বরূপ তুলে ধরে আমাদের মনে করিয়ে দেন ঔপনিষদিক ত্যাগের মাহাত্ম্য, তাকেও কুর্নিশ না করে উপায় নেই। কিন্তু বিচ্ছিন্নতা যদি নেতিবাচক হয় তবে তার ভবিষ্যৎ অবশ্যই একাকিত্বের অন্ধকার।

কেমন সে নেতিবাচক বিচ্ছিন্নতার স্বরূপ? সে বিচ্ছিন্নতা মানুষের সহজাত  নয়, সে বিচ্ছিন্নতা সমাজ-আরোপিত, সে বিচ্ছিন্নতা সভ্যতার তথাকথিত অগ্রগতির নামে সামন্ততান্ত্রিক মনোবিকার, পুঁজিতান্ত্রিক শ্রেণি-বৈষম্য, জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠীগত বিভাজন  এবং লিঙ্গবৈষম্যকে আশ্রয় করে  মানুষকে মানুষের থেকে দূরে ঠেলে ডেকে আনে একাকিত্বের মহামারি। ডেকে আনে প্রকৃতি-পরিজন তথা কৌম জীবনের যূথবদ্ধতা দিয়ে তৈরি  বৃহত্তর পরিবেশ  সম্পর্কে  অসীম ঔদাসীন্য  —চূড়ান্ত  নির্লিপ্তি। সমাজ তথা বৃহত্তর পরিবেশে  আত্মকেন্দ্রিক  এই  বিচ্ছিন্নতার অভিঘাত ভয়ংকর। আত্মধ্বংসী এই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে জগৎ জুড়ে কম আলোচনা হয়নি। কম কাগজ কালি খরচ হয়নি এ নিয়ে গবেষণায়। হেগেল, মার্কস, সার্ত্রে, হেইদেগার, কামু, জ্যাসপার, মারসেল,  ব্রেখট — কে নেই এই সারিতে!  ব্রেখটের ‘এপিক থিয়েটার’-যে দ্বৈত বিচ্ছিন্নতা (double distancing)-এর হিমশীতল নির্লিপ্তিকে সামনে আনে তার অভিঘাত সমাজে কত মারাত্মক তা এ বিশ্ব মার্কসীয় ঘরানার থিয়েটার কর্মীদের দৌলতে দেখে ফেলেছে। এমনকি, সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ একবার বেড়িয়ে এলেই উৎপল দত্তের অভিনয়ের শৈলী এই ‘দ্বৈত বিচ্ছিন্নতা’র হিমশীতল নির্লিপ্তির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।

অ্যালিয়েনেশনের স্বরূপ নিয়ে যেহেতু নানা মুনির নানা মত, তাই তা পৃথক আলোচনার পরিসর দাবি করে, যা এখানে স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। সেসব তাত্ত্বিকতা নিয়ে কাঁটাছেড়া করা এ আলোচোনার অভীষ্ট নয়। এখানে শুধু বলার এটাই যে  বিচ্ছিন্নতা যদি হয়  প্রকৃতি তথা পরিবেশ থেকে  তাহলে তার অভিঘাত আরও ভয়ংকর। এখন প্রশ্ন হল, পরিবেশ  মানে কি শুধু গাছপালা-লতাগুল্ম-ফুল-ফলে ঢাকা মনোরম বনানী আর নদীনালা-খালবিল-পাহাড় ঝরনা কিংবা চরাচর-বিস্তৃত উদার আকাশের অনন্ত আহ্বান? মাতৃস্বরূপা প্রকৃতির এই অবারিত দাক্ষিণ্য অবশ্যই পরিবেশের মুখ্য উপাদান। কিন্তু সেই পরিবেশের বৃহত্তর পরিসরে সন্দেহাতীতভাবে ধরা পড়ে আমাদের পরিচিত-অপরিচিত মানুষজন, তাদের সঙ্গে আমাদের আন্তঃসম্পর্ক, আর্থ-সামাজিক অভিঘাত, সাংস্কৃতিক দোলাচল, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সংশ্লেষ, ও সহাবস্থানের মিথস্ক্রিয়া — যা থেকে ইতিহাসের নিয়মেই জন্ম নেয় সমাজচেতনা তথা সমাজবিপ্লবের ধারা।  আর সেই বিজ্ঞানসিদ্ধ সমাজবিপ্লবের ধারায় চলতে চলতে বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত মানুষ ইতিহাসের নিয়মেই খুঁজে নেয় বিচ্ছিন্নতা-মুক্তির পথ। সামনে আসে বিচ্ছিন্নতা-মুক্তির নিত্যনতুন অভিজ্ঞান। এ নিয়ে যত আলোচনা, যত গবেষণাই হোক না কেন কোনো অভিজ্ঞানপত্রই চিরস্থায়ী চরম সমাধান নয়। পরিবর্তনশীল সমাজ তথা বৃহত্তর পরিবেশে সংশ্লিষ্ট সময়ের দাবি মোতাবেক পরিবর্তনকে মান্যতা দেওয়াই যুগধর্ম। এটা ইতিহাস-সিদ্ধ। তাকে অস্বীকার মূঢ়তা। কারণ, ‘শেষ নাহি যে,  শেষ কথা কে বলবে’?[৪]

দুই

শেষ কথা বলার ধৃষ্টতাকে সম্পূর্ণ সরিয়ে রেখেও তো কিছু বলা যায়। হয়তো বা সেটাই বলার অভিপ্রায় নিয়ে মানুষের  বিচ্ছিন্নতার স্বরূপ, বিচ্ছিন্নতার কারণ ও বিচ্ছিন্নতামুক্তির পথ দেখাতে যুগের দাবিতেই পথে নেমেছিলেন মহামতি কার্ল মার্কস। কারণ, মার্কস বিশ্বাস করতেন ‘মানুষের বিচ্ছিন্নতা একটি ঐতিহাসিক যোজনা, বিশেষ স্থানকাল নির্ভর এই বিচ্ছিন্নতা। ……. বিচ্ছিন্নতা যেমন সর্বজনীন নয়, তেমনি সর্বকালের নয়’।[৫]  আর এই  কারণেই পুঁজিবাদ-আশ্রিত ধনতন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ের ইতিহাস যদিও  সামন্ততন্ত্রের অভিশাপ মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ‘ব্যক্তি-স্বাধীনতা, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র‍্য ও আত্মোপলব্ধির ইতিহাস’,[৬]  তবু এই পর্ব থেকেই শুরু তার আত্মকেন্দ্রিকতা তথা নতুনতর বিচ্ছিন্নতার ইতিহাসও। ব্যক্তিসত্তার বিকাশ আর মানুষের বিচ্ছিন্নতার তীব্রতা যেন সমানুপাতিক। কিন্তু ইতিহাসের নিয়মেই বিচ্ছিন্নতার অভিঘাত যতই তীব্র হোক, মানুষ কখনোই চাইতে পারে না তার ব্যক্তিসত্তা তথা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যের বিনাশ হোক। আর এই ঐতিহাসিক সত্য সম্পর্কে মার্কস সজাগ ছিলেন বলেই তিনি তাঁর সময়ের নিরিখেই বিচ্ছিন্নতামুক্তির পথের সন্ধান করেছেন। কে বলতে পারে আজকের ডিজিটাল মাধ্যমের যুগের ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে জন্মালে তাঁর অ্যালিয়েনেশনের তত্ত্বের পরিভাষা বদলে যেত না (অবশ্যই মূল ভিত্তি ও অভিমুখকে অবিকৃত রেখে)? দুর্ভাগ্য, রক্ষণশীল অতিবাম মার্কসবাদীরা এই সহজ সত্যটা অনেক সময় বুঝতে চান না। তাই মার্কসের অ্যালিয়েনেশ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় মেসজারোস (Meszaros) আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে মার্কসের মতে  “…historicity is a condition of the humanan predicament. He wants to account for every aspect of the analysed phenomena in inherently historical terms, which means that nothing can be taken for granted and simply assumed as an ultimate datum. On the contrary, the whole theory hinges on the proof of the historical genesis of all its basic constituents. Accordingly, Marx pictures the relationship between “man” (M), “nature” (N), and “industry” (I) in the form of a threefold interaction between its constituent parts”.[৭] অবশ্য, আমরা তাঁর ‘অ্যালিয়েনশন তত্ত্ব’-এর গূঢ়তা থেকে  সচেতনভাবেই দূরত্ব বজায় রেখে শুধু তাঁর তত্ত্বের আলোকে (এখানে যেটুকু প্রাসঙ্গিক) বৃহত্তর পরিবেশ সংক্রান্ত কিছু ভাবনাকে ভাগ ক’রে নেওয়ার চেষ্টা থেকেই এ আলোচনায় এগোব। 

মার্কস বললেন নেতিবাচক  বিচ্ছিন্নতার কথা, যার উৎস  শ্রম-বিচ্ছিন্নতা  এবং যা সমাজ-সৃষ্ট, সহজাত নয়। আর সে শ্রম-বিচ্ছিন্নতার উৎস হল পুঁজিবাদী সমাজের ভোগসর্বস্ব আত্মকেন্দ্রিক স্বাচ্ছন্দ্য-অভিলাষ, যা ডেকে  আনে সমাজ-দূষণ। এই দূষণ বৃহত্তর পরিবেশ-দূষণেরই নামান্তর। এর চিকিৎসা তথা প্রতিষেধক  কোথায়?  চিকিৎসার নিদান দিতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিচ্ছিন্নতার কারণ অনুসন্ধান। আসলে মানুষ তো শুধু মাতৃরূপা নক্ষত্র থেকেই (আপাতভাবে) বিচ্ছিন্ন নয়, সে বিচ্ছিন্ন যেমন তার পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি-পরিবেশ থেকে, তেমনি  তার প্রতিবেশ (অন্যান্য মানুষ) থেকেও। সর্বোপরি,  বিচ্ছিন্ন তার নিজের সত্তা থেকেই। এ প্রসঙ্গে মার্কসের বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে মানুষের দ্বৈত সত্তা — “natural essence of man”[৮] এবং “human essence of nature”।[৯] তাহলে মানুষের আস্তিত্বিক বাস্তবের রুক্ষ জমিতে প্রোথিত যে “real nature”[১০]–এর কথা তিনি বলছেন সেটা কী? সেটা হল মানুষের  “anthropological nature”[১১] বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, যার টিকি বাঁধা আছে ইতিহাস তথা যুক্তিসিদ্ধ সত্যের কাছে, কোনো ভাববাদীর কল্পিত সত্তার কাছে নয়। ইতিহাস তথা যুগধর্মের নিয়মেই  বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পায়ন, নগরায়ণ — এসবকে সঙ্গে নিয়েই যেহেতু মানুষের অন্তহীন অভিযাত্রা, তাই তার এই “anthropological nature” বা “real nature”-এর সঙ্গে “biological nature”[১২]-এ তফাত আছে। প্রথমটির সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক “three dimensional”[১৩], কিন্তু দ্বিতীয়টির সঙ্গে “two dimensional”[১৪], কারণ  ঐতিহাসিক তথা নৃতাত্ত্বিক সত্য হল, “man” is not only the creator of industry but also its product.”[১৫] আর যেহেতু মানুষ তার অস্তিত্বের স্বার্থেই “productive activity”[১৬]—এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে বাধ্য, তাই  প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতা তথা পরিবেশ দূষণ  নাগরিক সভ্যতার অনিবার্য পরিণতি। কারণ, মানুষের পক্ষে প্রযুক্তি-নির্ভর আধুনিক যাপন পুরোপুরি ছেড়ে নতুন করে অরণ্যচারী হওয়া কিংবা তপোবনে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। বস্তুত, আগুন আর চাকা আবিষ্কারের মুহূর্ত সভ্যতার সর্বাপেক্ষা প্যারাডক্সিকাল মুহূর্ত। উন্নতির উলটোপিঠে দূষণের বীজও ঐ মুহূর্তেই বোনা হয়ে গেছে। তাহলে তা থেকে মুক্তির নিদান কী? বলা ভালো, পুরোপুরি মুক্তি না মিললেও তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার নিদান অবশ্যই আছে। তার জন্য প্রয়োজন পরিমিতিবোধ নিয়ে সভ্যতার ‘sustainable development’[১৭], যা প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এ নিয়ে ভাবনার যথেষ্ট অবকাশ আছে। কিন্তু  তার আগে দেখা যাক এই ভাবনা থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতার কারণ কী।  

আগেই বলেছি, এর নেপত্থ্যের কারণ হিসেবে কার্ল মার্কস চিহ্নিত করছেন মানুষের শ্রম-বিচ্ছিন্নতা তথা আত্ম-বিচ্ছিন্নতাকে। প্রযুক্তি-নির্ভর সভ্যতায় যন্ত্রের হাতে মানুষের দাসত্ব যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে স্বাচ্ছন্দ্য-প্রিয় মানুষের শ্রম-বিচ্ছিন্নতা। আর শ্রম-বিচ্ছিন্নতা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে তার প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতা। যন্ত্র-নির্ভর সভ্যতার কৃত্রিম স্বাচ্ছন্দ্যের অনুগ্রহে বাঁচতে বাঁচতে নির্মল, নিরাভরণ, অকৃত্রিম স্ফূর্তির বাঁচাটাই আর হয়ে উঠছে না। শরীর ও মনের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশ থেকে যাচ্ছে অধরা, অস্তিত্ব আর ব্যক্তিসত্তার মধ্যে তৈরি হচ্ছে আসমান-জমিন বিচ্ছিন্নতা। ব্যক্তিসত্তাহীন অস্তিত্ব নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবিলাসী, শ্রমবিচ্ছিন্ন মানুষ যেন হয়ে উঠছে মানবিক অনুভূতিহীন মানুষের জীর্ণ কঙ্কাল।

আর যারা শ্রম-সম্পৃক্ত বা শ্রমজীবী, তারা তাদেরই শ্রমোৎপাদিত ফসল থেকে বঞ্চিত হয়ে শোষকের হুকুম তালিম করাকেই ভবিতব্য ভাবতে ভাবতে ভুলে গেছে তারা নিজেরাও মানুষ। মেসজারোস (Meszaros) তাই লিখছেন, “… labour’s self-alienation manifest in a mode of production characterised by Marx and Engels as “the unconscious condition of mankind”.[১৮] তাই মার্কসের কাছে শ্রম-বিচ্ছিন্নতা মানুষকে একদিকে যেমন  প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন করে, তেমনি তাকে করে তোলে আত্ম-বিচ্ছিন্নও। এই আত্ম-বিচ্ছিন্নতা তাকে নিজের অজান্তেই নিজের সত্তা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। আর আপন সত্তা-বিস্মৃত যে মানুষের নিজের প্রতিই কোনো দায়বদ্ধতা নেই, তার কাছে প্রকৃতি, সমাজ, সভ্যতা তথা বৃহত্তর পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা আশা করাও মূঢ়তা। তাই মার্কস মানুষের পরিবেশ-বিষয়ে অসচেতনতা তথা দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ নিয়ে বলতে গিয়ে শুধু তার প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতাকে তুলে ধরেই ক্ষান্ত নন, তিনি বিষয়টির আরও গভীরে আলোকপাত করে প্রকৃতির প্রতি মানুষের এই উদাসীনতার কারণ অনুসন্ধান করতে মানুষের আত্ম-বিচ্ছিন্নতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন৷। আর এখানেই মার্কসের চিন্তার স্বকীয়তা, যা লক্ষ করে মেসজারোস (Meszaros) লিখছেন : 

“Marx’s approach is radically different. He is not talking simply about man’s alienation from “nature” as such, but about man’s alienation from his own nature, from “anthropological nature” (both within and outside man). 

This very concept of “man’s own nature” necessarily implies the ontologically fundamental self-mediation of man with nature through his own productive (and self-producing) activity. Consequently “industry” (or “productive activity”) as such, acquires an essentially positive connotation in the Marxian conception, rescuing man from the theological dilemma of “the fall of man”.”[১৯] 

যে শ্রমবিচ্ছিন্ন শোষক নিজেদের মনুষ্যত্ববর্জিত জৈবিক স্বাচ্ছন্দ্যের স্বার্থে শ্রম-সম্পৃক্ত মানুষকে করছে বঞ্চনার শিকার, সেই শোষকের সারসত্তাহীন অস্তিত্বের স্বরূপ কেমন? সে তো পশুত্ব । বলা বাহুল্য, চেহারায় মানুষ হলেও অন্তরে এই সারসত্তাবিহীন অস্তিত্ব তথা পশুত্ব নিয়েই বাঁচতে চাইছে এই যন্ত্রযুগের অটোমেশন-নির্ভর মানুষ। পুঁজিবাদের ভোগসর্বস্ব আত্মকেন্দ্রিক আবহে মানুষ মানবিক সত্তাকে বন্ধক রেখে জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য হিসেবে প্রথম থেকেই স্থির করে নিচ্ছে যেকোনো মূল্যে আত্মসুখ। তাতে জঙ্গল কাটতে হলে কাটো, জলাশয় ভরাট করে বহুতল বানাতে হলে বানাও, বহুমূল্যের বিলাসবহুল যানবাহন, এসি, ফ্রিজ, যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করতে হলে করে, তাতে বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড কিংবা ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের মাত্রতিরিক্ত নিঃসরণে পরিবেশের দফারফা হয় হোক, গ্লোবাল ওয়ার্মিং কেড়ে নিক পুরাতন পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপমাত্রা, গলে যাক আদিম হিমবাহের মহার্ঘ স্তর, সমুদ্রপৃষ্ঠের জলস্তর অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়ে কেড়ে নিক উপকূলীয় জনপদ, ভূ-গর্ভস্থ জলের যথেচ্ছ ব্যবহার নামিয়ে দিক প্রাকৃতিক জলস্তর, বাড়তি কৃষিক্ষেত্র তৈরির লোভ কিংবা নতুন নগরায়ণের স্বপপূরণের উত্তাপ দাবানল হয়ে পুড়িয়ে দিক পৃথিবীর ফুসফুস (আমাজন রেইন ফরেস্ট), অরণ্যচারী লক্ষ লক্ষ জীব পুড়ে ঝলসে মরে যায় যাক, বাস্তুতন্ত্রের দফারফা হয় হোক, তাতে কার কী? 

এ সব তো প্রকৃতি-দূষণের বৃহত্তর ক্ষেত্র। এছাড়াও আমাদের প্রাত্যহিক যাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন অনেক ছোটো ছোটো ক্ষেত্র আছে, যাদের সমষ্টিগত অভিঘাত মারাত্মক। গৃহস্থালির কাজে জলের যথেচ্ছ ব্যবহার, খুব প্রয়োজন ছাড়াও এসি, ফ্রিজ, কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের দেখনদারি — সবকিছুই পুঁজিসর্বস্ব ভোগবাদী প্রবণতা তথা শ্রম-বিচ্ছিন্নতারই ফলশ্রুতি। আর যে ট্রাফিক সার্জেন্ট তাঁর পাশ দিয়ে অনর্গল ধোঁয়া নিঃসরণের ভ্রাম্যমাণ দানব (দূষণের ছাড়পত্রহীন মান্ধাতা আমলের যাত্রীবাহী  কিংবা পণ্যবাহী যান)-কে দেখেও না-দেখার ভান করেন অর্থশক্তি, পেশিশক্তি আর রাজনৈতিক শক্তির আঁতাতের কাছে সংশ্লিষ্ট গাড়ি-মালিকের টিকি বাঁধা থাকে বলে, অথচ নিরীহ বাইক-আরোহীকে তার সদ্য-কেনা বাইকে মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কোনো সম্ভাবনা না থাকা সত্বেও শুধু pollution certificate সঙ্গে রাখতে ভুলে যাওয়ার খেসারত দিতে (অবশ্যই তার ভুলে যাওয়াকে বৈধতা দিচ্ছি না) বাধ্য করেন (চড়া আর্থিক দণ্ড কিংবা সংশ্লিষ্ট সার্জেন্টকে ঘুষের বিনিময়ে) তাঁকে কি পরিবেশ-সচেতন কর্তব্যনিষ্ঠ পরিবেশ-বন্ধু বলা যাবে? বলা বাহুল্য, তাঁর  স্ববিরোধী সুবিধাবাদী অবস্থান তথা অসাধুতার উৎসও  শ্রমবিচ্ছিন্ন সহজলভ্য পুঁজির ভোগের মনস্তত্ত্ব, যা মানুষকে বৃহত্তর সমাজ তথা পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আত্মসুখের দাসত্ব করতে শেখায়। ভোগসর্বস্ব পুঁজিবাদের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া এমনই সব মনস্তাত্ত্বিক বিকৃতির উদাহরণ দেখি ভুরি ভুরি। আমাদের পরিচিত-অপরিচিত কোটি কোটি এমন মানুষ ছড়িয়ে আছে আমাদেরই রোজনামচার আনাচে কানাচে। তা না হলে সেমিনারে পরিবেশ-বিষয়ক তাত্ত্বিক বক্তৃতা দিয়ে, কিংবা তথাকথিত পরিবেশ-কর্মীর নিশান উড়িয়ে বাড়ি ফেরার পথে ইতিউতি উঁকি মেরে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগে বাজার সেরে গুটি গুটি চম্পট দেওয়ার মতো ঘটনা আকছার ঘটত কি? 

আর রাষ্ট্রের তরফের স্ববিরোধ তো রীতিমতো সদম্ভ। তার প্রকৃষ্ট নমুনা প্লাস্টিক ক্যারিব্যগের বিরুদ্ধে নামমাত্র প্রশাসনিক  অভিযান চলে অথচ নিষিদ্ধ প্লাস্টিক উৎপাদনের  কারখানা রমরমিয়ে চলে। প্রশাসন সজাগ ও আন্তরিক হলে তার নাকের ডগায় কলকারখানা, হাসপাতাল, নার্সিংহোমের ক্ষতিকারক বর্জ্য লোকালয়ে দিনের পর দিন পড়ে থাকে কীভাবে?  কীভাবেই বা আধমরা নদী ও অন্যান্য জলাশয় ঐসব বর্জ্য পদার্থকে গিলতে বাধ্য হয় আর কোটি কোটি জলজ প্রাণীর লাশ নিজের অপাপবিদ্ধ বুকে ধারণ করতে করতে একদিন নিজেও  লাশ হয়ে যায় ?  আর সেই নদী কিংবা জলাভূমির লাশের উপর সদম্ভে গজিয়ে ওঠে যে অপরিকল্পিত বহুতলের সারি তাদের ছাড়পত্রই বা জোটে কোন যুক্তিতে? প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তর অজানাই। 

তিন 

পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত পরিবেশ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে তার বেশিরভাগকেই বিনাশ করতে উদ্যত শ্রমজীবীর শ্রমশোষক জনবিচ্ছিন্ন পুঁজিবাদ। সে সবসময় চায় তার বিশ্বগ্রাসী লোভকে চরিতার্থ করতে। তার আকাশচুম্বী লোভের অতল গহ্বরে সে গিলে নিতে চায় অনন্ত-বিস্তৃত বনভূমি, জল-টল-টল জলাশয়, আদিগন্ত খোলা মাঠ — সবকিছু। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের লোভাতুর থাবা এই পুঁজিবাদী আগ্রাসনের ভোগবাদী প্রবণতারই ফলশ্রুতি। এক্ষেত্রে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে রাষ্ট্রশক্তিও নির্লজ্জের মতো ব্যবহৃত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ায় রাষ্ট্রশক্তি ও পুঁজিপতিদের অশুভ আঁতাতকে বলা হত ‘অলিগার্কি’। এই গ্রিক শব্দের ব্যবহার আজ বিশ্বের সবদেশেই প্রচলিত, কারণ রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদের সম্মিলিত কোরাস সর্বত্র বেজে চলেছে। নানাস্থানে মাঝে মাঝেই পরিবেশকর্মীদের উপর অত্যাচারের খড়্গ নেমে আসার খবর রীতিমতো দুশ্চিন্তার। সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নানান জনজাতি  স্থানিক কৃষ্টি ও সংস্কার থেকে তাদের জীবিকার উৎস অরণ্যকে মাতৃজ্ঞানে নিজের সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করলেও আজ তারা প্রমাদ গুনছে কর্পোরেট পুঁজির করাল গ্রাসে। কারণ, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রশ্রয় ও আশ্রয়ে  তারা কেড়ে নিতে উদ্যত জনজাতির অরণ্যের অধিকার।

ভারতে সম্প্রতি (২৮ জুন, ২০২২) বন সুরক্ষা আইন ১৯৮০-র নতুন সংশোধনীতে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ সুরক্ষা মন্ত্রক জানিয়ে দিয়েছে ‘উন্নয়ন’-এর স্বার্থে খনন ও অরণ্য সংহারে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের গ্রামসভা ও আদিবাসীদের অনুমতির আর প্রয়োজন নেই । স্বভাবতই এখন জঙ্গল কেটে তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পে বেসরকারি লগ্নির পোয়াবারো । আর এই ‘উন্নয়ন’-এর স্বার্থে বনাঞ্চল হস্তান্তর হলে Compensatory Afforestation Act 2016 মোতাবেক সংশ্লিষ্ট বনাঞ্চলের বাইরে বিকল্প অরণ্যসৃজন বাধ্যতামূলক। কিন্তু সেই বিকল্প বনসৃজনের হাল দেখলে চমকে যেতে হয়। সিএজি রিপোর্ট বলছে, ২০০৬ থেকে ২০১২-র মধ্যে সারাদেশে হস্তান্তরিত ১,১৪,৮৭৭.২৬ হেক্টর বনাঞ্চলের জন্য বিকল্প বনসৃজনের জমি পাওয়া গেছে মাত্র ২০,০৮৫.২৬ হেক্টর (২৭ শতাংশ)। আর তার মধ্যে বনসৃজন হয়েছে মাত্র ৭,২৮০ হেক্টর (৭শতাংশ)। এ তো গেল বনসৃজনের  দিক। এর সঙ্গে চিরতরে নষ্ট হয়ে যাওয়া জীববৈচিত্র্য, জলবায়ুর স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি, এবং সর্বোপরি, লক্ষ লক্ষ মানুষের অরণ্য-বিচ্ছিন্নতা ও জীবিকার অনিশ্চয়তার কথা  ভাবলে শিউরে উঠতে হয় । অবশ্য নতুন আইন অনুযায়ী অরণ্য ও জীববৈচিত্র্যের ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। ক্ষতিপূরণের আর্থিক মূল্য ধার্য হয়েছে প্রতি হেক্টরে ১১ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ১৬ লক্ষ টাকা।  কিন্তু বনাঞ্চল, জীববৈচিত্র্য ও আদিবাসীদের নিয়ে তৈরি যে চিরায়ত বাস্তুতন্ত্র তার ক্ষতির মূল্য অর্থ দিয়ে মাপা যে কত বড়ো মূর্খামি, তা বুঝতে যে সামান্যতম বোধটুকু লাগে তা-ও  রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদের অসুস্থ কোরাসে হারিয়ে গেছে।  

সম্প্রতি অতিমারির প্রকোপ (২০১৯-২০২২) চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদের সম্মিলিত কোরাস গাইতে অভ্যস্ত  ভোগসর্বস্ব, আত্মকেন্দ্রিক  মানুষ  (যে নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে বড়াই করে)  আসলে কত তুচ্ছ, কত অসহায়। সেই সঙ্গে এটাও প্রমাণ হয়ে গেছে যে এই একটিমাত্র প্রাণীর  ঘরবন্দী থাকার বাধ্যবাধকতা আকাশ-বাতাস-পারিপার্শ্বিকতাকে কত কালিমাহীন, কত নির্মল রাখে। প্রমাণ হয়ে গেছে ধোঁয়া-ধূলি-কালিমামুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়ালে আরও কত দূর থেকে দুচোখ জুড়িয়ে দেয় পুরাতন পৃথিবীর তুষার-শৃঙ্গের অকৃত্রিম চাহনি। অথচ  স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপাধারী এই একটিমাত্র প্রাণী ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর জীবনে কোনো লকডাউন ঘোষণা হয়নি। স্বভাবতই, বুঝতে অসুবিধা হয় না এ যাবৎ প্রকৃতি তথা পরিবেশের যেটুকু ক্ষতিসাধন হয়েছে তা এই তথাকথিত বুদ্ধিমান প্রাণীটির দৌলতেই। তাই যতই সে নিজেকে যন্ত্র তথা প্রযুক্তির উদ্ভাবনী শক্তি নিয়ে প্রকৃতিকে পদানত করার কৃতিত্ব জাহির করে নিজের বুদ্ধিমত্তার ফানুস ওড়াক, আসলে সে নির্বোধ। আসলে সে র‍্যাল্ফ হজসন (Ralf Hodgson)-এর বিখ্যাত কবিতা ‘Stupidity Street’-এর বাসিন্দা। তা না হলে অতিমারির প্রকোপ একটু কমতেই তার পুরোনো অভ্যেসে সামান্য হলেও বদল আসত। তা তো আসেইনি, উলটে আরও বেড়েছে তার দৌরাত্ম্য । প্রকৃতির প্রতি তার ধর্ষকামী মনোভাব যেন আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেছে । ভাবখানা এমন যেন যথেচ্ছ ভোগের ভাগ থেকে অতিমারি কেড়ে নিয়েছে দুদুটো মহার্ঘ বছর, তাই ভোগের উন্মুক্ত ক্ষেত্রে নেমে পড়ে দ্বিগুণ বিক্রমে। আর প্রতিক্রিয়াও মিলে গেছে হাতে হাতে। নজিরবিহীন তাপপ্রবাহে পুড়ছে ইউরোপের সিংহভাগ। হাঁসফাঁস করছে ইংল্যান্ড, দাবানলে জ্বলছে ফ্রান্স। অস্ট্রেলিয়াও ব্যতিক্রম নয়। পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। 

আসলে শ্রমবিচ্ছিন্ন, স্বাচ্ছন্দ্যবিলাসী, পুঁজিবাদী সমাজের আত্মসর্বস্ব ভোগবাদী প্রবণতা আর প্রযুক্তি-নির্ভর অটোমেশনের বাড়বাড়ন্তে যন্ত্রনির্ভর মানব তার অজান্তেই আজ যন্ত্রদানব। আর সে যন্ত্রদানব পুঁজিবাদী আগ্রাসনকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে ডেকে আনছে সামন্ততান্ত্রিক মনোবিকার। পুঁজিবাদ-আশ্রিত এই নব্য-সামন্ততান্ত্রিক মনোবিকারের আগ্রাসী রূপই ফ্যাসিবাদ। পশ্চিমি দুনিয়া এক্ষেত্রে চিরকাল এগিয়ে থাকলেও অবশিষ্ট বিশ্বও পিছিয়ে নেই। বরং এ বলে আমায় দ্যাখ  তো ও বলে আমায়। অতিমারি যেতে না যেতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিবেশের বুকে তৈরি করল যে বিপুল ক্ষত তার হিসেব কে করবে?  মানুষের অপরিণামদর্শিতার শেষ কি এখানেই? তাইওয়ান নিয়ে চিনের হুংকার ও সামরিক মহড়া এবং তার প্রতিক্রিয়ায় জাপান ও আমেরিকা যেভাবে যৌথভাবে হুংকার ছাড়ছে তাতে কে বলবে মাত্র সাত দশক আগেই এই জাপানের মাটিতেই তার আজকের তথাকথিত মিত্র আমেরিকা রচনা করেছিল হিরোশিমা-নাগাসাকির নির্মম চিতাশয্যা? ওদিকে গাজা ভূখণ্ড নিয়ে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন দ্বন্দ্ব, কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ, ইত্যাদি ক্রনিক বিষফোড়া তো আছেই, যেখানে বারুদের গন্ধের মধ্যেই নবজাতকের জন্ম হয়, বারুদের গন্ধেই ঘনিয়ে আসে তার মৃত্যু। আর মধ্যপ্রাচ্য (সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, যেখানে স্বপ্নের মধ্যেও ভেসে আসে গোলাগুলির শব্দ)-এর কথা নাই বা বললাম। কিন্তু বলি বা না বলি এসবের প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক ঘূর্ণাবর্ত ডেকে আনছে রাতারাতি স্বদেশহীন উদবাস্তু মানুষের বিচ্ছিন্নতা-সমস্যা। আর সেইসঙ্গে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবে তৈরি হচ্ছে যে ভয়ংকর প্রকৃতি-দূষণ তার মাত্রা ভয়াবহ। 

চার

আমরা মার্কসের অ্যালিয়েনেশন তত্ত্বের শ্রম-বিচ্ছিন্নতাকে স্বীকার করেও বলব বিচ্ছিন্নতার রং অর্থাৎ স্বরূপ যেমন এক নয়, বিচ্ছিন্নতার কারণও বহুমাত্রিক।  কিন্তু তা থেকে মুক্তির নিদান একটাই — প্রকৃতি-সম্পৃক্তি তথা পরিবেশ-প্রতিবেশে সৎ অভিনিবেশ। আর প্রতিবেশ বলতে যদি বুঝি পরিজন তথা কৌম জীবনের যূথবদ্ধ যাপনের সমবায়িক আনন্দ, তাহলে সামন্ততান্ত্রিক মনোবিকার তো বটেই, পুঁজিবাদী সমাজের ভোগসর্বস্ব আত্মকেন্দ্রিকতা ও ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়ে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকেই শিরোধার্য করতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই সমাজতন্ত্র স্তালিনীয় একরোখা সমাজতন্ত্র নয়, যেখানে ব্যষ্টির বিকাশকে অস্বীকার করে সমষ্টি-উন্নয়নের স্ববিরোধ মাথা তোলে। বিচ্ছিন্নতা-মুক্তির প্রকৃত পথ সেই নয়া- সমাজতন্ত্র, যা মনে করে ব্যষ্টি আর সমষ্টির মধ্যে কোনো বিরোধ তো নেই-ই, বরং তারা একে অন্যের পরিপূরক। কিন্তু এই পরিপূরকতার প্রগতিশীল সমীকরণ সম্ভব তখনই যখন নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করা এই মানুষ নামক প্রাণীটি তাঁর ভোগসর্বস্বতা ও আত্মকেন্ত্রিকতা তথা সকল প্রকার নেতিবাচক বিচ্ছিন্নতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে’[২০] দাঁড়ানোর দায়িত্বটুকু পালন করবে। 

‘আপন হতে বাহির হয়ে’ বাইরে দাঁড়ানোর কথা ছিল যে মানুষের, সে কি তা করেছে? সে ‘বুকের মাঝে বিশ্বলোকের সাড়া’[২১] পেয়েছে আজও?  শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষ ‘আপন হতে বাইরে’ দাঁড়ানোর অভ্যেসটুকুই আজও রপ্ত করতে পারলো না তো ‘বিশ্বলোকের সাড়া’ পাবে কোত্থেকে? তার চেয়েও বড়ো কথা হল, বিশ্বলোকের সাড়া পাওয়ার ইচ্ছে সে আদৌ পোষণ করে কি? ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ কি শুধু তার আপ্তবাক্য? এতে কি সত্যিই সে অন্তর থেকে বিশ্বাস করে? যদি করে তাহলে বুঝতে হবে আত্মকেন্দ্রিকতার অভিশাপ মুক্তির জন্য সামান্য হলেও তার আর্তি আজও অটুট। কিন্তু আসল সত্য হল, আত্মকেন্দ্রিকতার  অন্ধকার ঘিরে আছে এ বিশ্বের সিংহভাগ মানুষকে। শুধু নিজেরটুকু গুছিয়ে নিতে, শুধু নিজের কথা বলতে, নিজেকে নিয়ে ভাবতে তার স্বার্থান্বেষী সত্তার আকাশছোঁয়া ব্যস্ততা। 

তাই সে আত্মসর্বস্ব মানুষের মাথার উপরে যে খণ্ডিত আকাশ, সেখানে চাঁদ উঠলেও তা ঢেকে যাচ্ছে বিপন্নতার মেঘে, সেখানে তারা ফুটলেও তার আলো এসে পড়ছে না নিজেকেই দেখতে ব্যস্ত থাকা আত্মকেন্দ্রিক মানুষের চোখে। আর সূর্য? সে নিজে সমদর্শী হলে কী হবে? যে মানুষের প্রতি ছড়ানো তার মাতৃপ্রতিম নাক্ষত্রিক আলোর সমদর্শিতা, সেই স্বার্থসবর্স্ব মানুষের নিজেরই সৃষ্ট দূষণের কুয়াশায় সে সূর্য এতটাই ঢেকে থাকছে যে মেঘে মেঘে কতবেলা হল তা বোঝার আগেই হঠাৎ যখন সে সামনে আসে তখন ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে’[২২] চিত্ত ঝলমলিয়ে ওঠা তো দূরের কথা, বরং তা ঝলসে যায়। কোন চিত্ত? যে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু নিজেকে নিয়েই থাকতে চায়। বাঁচতে চায় তথাকথিত ব্যক্তিসত্তা তথা ঠুনকো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উগ্র অহমিকা নিয়ে। হায় রে ব্যক্তিসত্তা! ঝলমল করা চিত্ত-র রোমান্টিক এপিফ্যানি নিয়ে বাঁচার কথা যে মানুষের, তার আত্মসুখের এমন করুণ সমাধি! এমন ট্র‍্যাজেডিতে কি কোনো ‘poetic justice’ প্রত্যাশা করা আদৌ সমীচীন? নিশ্চয় নয়। কারণ,  জেনেশুনে বিষপানের এই আত্মধ্বংসী প্রবণতা তথা নেতিবাচক বিচ্ছিন্নতা এমন পরিণতিই ডেকে আনে। এটাই অ্যালিয়েনেশনের ভবিষ্যৎ ।  

একদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা আর অন্যদিকে কৌমজীবনের যূথবদ্ধ যাপন নিয়ে বিতর্ক বড়ো পুরোনো। কিছুটা আদিমও। আদিম এই কারণেই যে সেই বিতর্কে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিশীলন দূর অস্ত, সুস্থতাই থাকে না। অথচ একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায়, যে দুটো বিষয় নিয়ে এই বিতর্ক  তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তাদের একটাকে নিয়েই আর-একটার অস্তিত্ব। ব্যষ্টি-বিচ্ছিন্ন সমষ্টির কল্পনা করাও যে মূঢ়তা তা আগেই বলেছি। প্রকৃত বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক মানসিকতা এই মূঢ়তা থেকে দূরে থাকে বলেই সেখানে সুস্থ ব্যক্তিসত্তার বিকাশের স্বার্থেই ব্যষ্টি থাকে সমষ্টির প্রতি দায়বদ্ধ। বলা বাহুল্য, এই দায়বদ্ধতা থেকেই জন্ম হয় প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রতি বৃহত্তর দায়বদ্ধতা। এই দায়বদ্ধতা থেকে মানুষ নিজেকে সমাজ তথা জগৎ-বিচ্ছিন্ন না ভেবে ভাবতে শেখে সে এই সমাজ তথা বৃহত্তর  পরিবেশেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এমন ভাবনার মধ্যে আছে এক প্রচ্ছন্ন গর্ব, আছে সমবায়িক বাঁচার আনন্দ। একে কেউ অতীন্দ্রিয় আনন্দ বলে শান্তি পেলে পেতেই পারেন। রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ যিনি আজীবন প্রকৃতি ও মানুষের নিবিড় সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তায় শুধু বিশ্বাস রেখেই দায়িত্ব সারেননি, রীতিমতো প্রকৃতিসম্পৃক্ত সমবায়িক যাপনের দৃষ্টান্ত ও দিশা রেখে গেছেন, তাঁকে তো ব্যষ্টি জীবনের ইতিবাচক বিচ্ছিন্নতার সৃজনশীল নিভৃতিকে অস্বীকার করতে হয়নি। একই মানুষের মধ্যে ব্যষ্টি-বিকাশ ও সমবায়িক চেতনার এমন সমুন্নত সহাবস্থান  চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে এটা মানুষের পক্ষেই সম্ভব। 

রবীন্দ্রনাথের ‘সর্বমানব’-এর সার্বত্রিক চেতনা কিংবা অধ্যাত্মতত্ত্ব-আশ্রিত সমবায়ের ধারণার সঙ্গে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী মার্কসের ‘কম্যিউন’-কেন্দ্রিক যূথবদ্ধ কর্মকাণ্ডের তত্ত্বগত প্রভেদকে স্বীকার করেও বলা যায়, নিজের প্রতি সৎ থাকলে তবেই অন্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা যায়। আর সেই সততার জন্য যেমন ধর্মীয় দীক্ষা আবশ্যক নয়, তেমনি কেউ বন্ধু না হলেই তাকে শত্রু বলে দেগে দেওয়ার অতিবাম সমীকরণ যে তথাকথিত ‘শ্রেণি শত্রু’-র ধারণাকে সামনে আনে তাকে আশ্রয় করে কোনো চটজলদি বিপ্লবকে হাতিয়ার করারও দরকার নেই। কারণ, প্রকারান্তরে দুটি রাস্তাতেই মৌলবাদী মানসিকতা ছাড়পত্র পেয়ে যায়। আর নতুন করে জন্ম নেয় মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা।  

তাহলে ব্যষ্টি ও সমষ্টির প্রতি উভমুখী সততা আসবে কীভাবে? এই মহার্ঘ সততা তথা দায়বদ্ধতা তখনই আসে যখন নেতিবাচক বিচ্ছিন্নতার করুণ পরিণতি সম্পর্কে শিক্ষা ও সচেতনতা থাকে। সেই শিক্ষা আসে প্রকৃতি-সম্পৃক্ত মানবিক সত্তার সমবায়িক দীক্ষা থেকে। সে দীক্ষার জন্য যেমন কোনো ধর্মমন্দিরের আবশ্যকতা নেই, তেমনি  প্রয়োজন নেই শুধু ‘শ্রেণি শত্রু’ চিহ্নিতকরণের কোনো অভ্যাস। অবশ্য  যদি কোনো সংস্কার থেকে মানুষ অরণ্যকে বনদেবী ভেবে তার বন্দনা করে, কিন্তু সে বন্দনাতে যদি না থাকে ধূপ-ধুনো পুড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ার হিড়িক, যদি না থাকে বনদেবীকে প্রসাদপুষ্ট করার সংস্কার থেকে গাছের গায়ে খাদ্যদ্রব্য লেপন করে তার বল্কলের স্বাভাবিকতা নষ্ট করার মনোবিকার, কিংবা তথাকথিত নান্দনিক সৌন্দর্যায়নের নামে যদি গাছের গায়ে না লাগানো হয় রাসায়নিক-মেশানো ক্ষতিকর রং, তাহলে সেই ‘কাঁটা বনবিহারিণী’[২৩]-র ভজনা করাতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ, এমন বিজ্ঞানঋদ্ধ নির্ভেজাল অরণ্য-ভক্তি শেখায় যে ধর্মমন্দির তার সঙ্গে বিজ্ঞানমন্দিরের কোনো বিরোধ নেই। 

এক কথায়, ধর্মমন্দিরকে বিজ্ঞানমন্দিরের সমার্থক হতে হলে প্রয়োজন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্টি-শ্রেণি-লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার বৈজ্ঞানিক দীক্ষা, যার ভিত্তি বিজ্ঞান-মনষ্কতা। নক্ষত্রের সন্তান যে মানুষ তার একটিই সহজাত পরিচয় — সে মানুষ। এই বৈজ্ঞানিক সত্যের অপলাপ করে যে অশিক্ষা তার জন্ম যেখানেই হোক তা মানুষকে মানুষ থেকেই শুধু বিচ্ছিন্ন করে না, বিচ্ছিন্ন করে তার আস্তিত্বিক সত্য থেকে, বিচ্ছিন্ন করে বৃহত্তর সমাজ, পরিবেশ-প্রকৃতি তথা বিশ্বচরাচর থেকে। 

বস্তুত, ব্যষ্টি-বিচ্ছিন্ন সমষ্টির কল্যাণচিন্তা কাঁঠালের আমসত্ত্ব। রবীন্দ্রনাথের মতো অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন তথা দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব এই ইউটোপিয় আমসত্ত্বের গন্ধ বহু আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন, যার আভাস তিনি তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’-তে রেখে গেছেন। একই গন্ধ এ বিশ্ব পেয়েছিল পোল্যান্ডের তথাকথিত সমাজতন্ত্রে, যেখানে ব্যক্তিসত্তাকে গুরুত্ব না দিয়ে সমাজতন্ত্রের খোয়াব দেখা হয়েছিল। আসলে রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষের মরমি সত্তার অনাবিল আনন্দের  শিকড়ও লুকিয়ে ছিল বাস্তবের রুক্ষ জমিতেই। পঞ্চইন্দ্রিয়ের বস্তুগত অস্তিত্বকে বাদ দিয়ে কী অন্তরিন্দ্রিয়ের অনুভূতির কল্পনা করা যায়? তাই ব্যক্তিসত্তার বিকাশে ইতিবাচক বিচ্ছিন্নতার সৃজনশীল নিভৃতিকে সঙ্গে নিয়েও সমস্ত নেতিবাচক বিচ্ছিন্নতার শিকড় সমূলে উৎপাটনের সামূহিক উদ্যোগ নেওয়া শুধু  জরুরি নয়, আবশ্যক। আর এই উদ্যোগ নেওয়াতে কৃতিত্ব জাহির করার কিছু নেই। কারণ, প্রকৃতি-সৃষ্ট জীববৈচিত্র্যকে সঙ্গে নিয়ে  সুস্থভাবে বাঁচার এটাই প্রাথমিক শর্ত। 

হে নক্ষত্রের অবাধ্য সন্তান, তুমি যুক্তিগ্রাহ্য বাস্তবের রুক্ষ জমিতে দাঁড়িয়ে  প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশে সার্বিক অভিনিবেশ রেখে তোমার নেতিবাচক বিচ্ছিন্নতার সর্বনাশা শিকড় উৎপাটনের মহতি উদ্যোগ আর কবে নেবে? সময় যে থেমে নেই, সে যে বড়ো নির্দয়, বড়ো পরিহাসপ্রিয়। 

তথ্যসূত্র :

১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবিতা ‘সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়’

২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘চিত্রা’-র অন্তর্গত কবিতা ‘মৃত্যুর পরে’

৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পূজা পর্যায়ের গান ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে’

৪) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পূজা পর্যায়ের গান  ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে’ 

৫) ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ‘বিচ্ছিন্নতার ভবিষ্যৎ’, পাভলভ , পৃঃ ৬৫

৬) তদেব, পৃঃ, ৬৫

৭) Istvan Meszaros, ‘Marx’s Theory of Alienation’, 1970, p.51

৮) Ibid 

৯) Ibid 

১০) Ibid 

১১) Ibid 

১২) Ibid 

১৩) Ibid

১৪)  Ibid

১৫)  Ibid

১৬) Ibid

১৭) Amartya Sen & Jean Dreze, ‘Consequences of Environment Plunder’ 

১৮) Istvan Meszaros, p.51

১৯) Ibid, p.54

২০) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পূজা পর্যায়ের গান ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া’ 

২১) তদেব

২২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘মহুয়া’-র অন্তর্গত  ‘পথের বাঁধন’ 

২৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিচিত্র পর্যায়ের গান ‘কাঁটা বনবিহারিনী’

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান