শ্যামল চক্রবর্তী
পরিবেশ সম্মেলন শুরু হয়েছিল কেমন করে
এ কথা সবাই জানে যে পৃথিবীতে মানুষ এসেছে সকলের শেষে। মানুষের পর আর কোনো প্রজাতি আসছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার আগে বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, পৃথিবী ছেড়ে অন্য গ্রহে মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা উচিত। এমন বিজ্ঞানীদের শীর্ষে রয়েছেন স্টিফেন হকিং, বিজ্ঞান জগতে যাঁর অনন্যতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জন-বিস্ফোরণের সংকটের কথা বলেছেন হকিং। জন-আধিক্য জীবনের অনেক ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনে। প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা দেখা দেয়। খাদ্যশস্যের অভাব ঘটে। সব মিলিয়ে বলা যায়, জন-বিস্ফোরণে সমাজ ও পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়ে।
মানুষ পরিবেশ নিয়ে বহুকাল মাথা ঘামায়নি। একসময় বিখ্যাত শিকারির নামে আমরা গর্ব বোধ করতাম। এখন ‘শিকারি’ নিজেই বিপন্ন প্রজাতি হয়ে পড়েছে। হওয়াই ভালো। সবকিছুর বিপন্নতা আমরা সহ্য করতে পারি না। তবে শিকারি যত কমে আমাদের ততই মঙ্গল।
মানুষ পরিবেশ নিয়ে মাথা ঘামাল কখন? যখন এর বিপদ এসে মানুষের ঘাড়ে পড়ল। বেশিরভাগ মানুষই তো তাই। ঘাড়ে এসে বিপদে পড়লে টনক নড়ে। নইলে ‘দূরদ্রষ্টা’ শব্দের সমাদর অভিধান থেকে লোপ পেয়ে যেত। কেউ কেউ ‘দূরদ্রষ্টা’, সকলে নন।
কোন্ সালে এখানে-ওখানে বইয়ের পাতায় পরিবেশ নিয়ে দূরদ্রষ্টারা কী বলেছেন আমরা সেদিকে আপাতত বেশি নজর দেব না। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ একসঙ্গে পরিবেশ নিয়ে প্রথম নজর দিলেন ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে। যে সংকট আজ পৃথিবীর শীর্ষে তাকে নিয়ে সম্মিলিত পদক্ষেপ মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে শুরু হয়েছে। শুরুটা মন্দ ছিল না। ধনী দেশ ও গরিব দেশ উভয়েই পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব পালনের কথা বলেছে। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। যখন দায়িত্ব পালনের কথা উঠল, বিপদ শুরু হল তখনই। প্রতিনিধিরা বলাবলি করতে লাগলেন, ধনী দেশ ও গরিব দেশের মানুষের দায়িত্ব কখনও এক হতে পারেনা! প্রাকৃতিক সম্পদ অধিগত করে জীবনযাত্রার মান বাড়িয়েছে যারা, তাদের সঙ্গে গরিব দেশের মানুষের দায়িত্ব কেমন করে একরকম হতে পারে? চলেছেন সবাই মিলে পরিবেশ বাঁচানোর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে, প্রতিনিধিরা ভেতরে হয়ে যাচ্ছেন দু-ভাগ।
ভাগাভাগির কথায় যাব পরে। প্রথমে আমরা ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের সম্মেলন বিষয়ে দু-একটা কথা বলে নিই। সম্মেলনের শিরোনাম ছিল ‘কনফারেন্স অন হিউম্যান এনভায়রনমেন্ট’। ঠিকানা স্টকহোম, সুইডেন। তারিখ ৫-১৬ জুন, ১৯৭২। একটানা বারো দিনের সম্মেলন। সম্মেলন শেষে ‘স্টকহোম ঘোষণা’ তৈরি হল। সকল প্রতিনিধিরা তাকে সমর্থন করলেন। পরিবেশ বাঁচাতে হবে, উন্নয়নও করতে হবে। কেমন করে তা সম্ভব? ১০৯টি সুপারিশ লেখা হল। সকলে কথা দিলেন, মেনে চলবেন।
পঞ্চাশ বছর পর আজ বোঝা যায়, অনেক সুপারিশ অনেক দেশের কাছে কথার কথাই থেকে গিয়েছে। পরিবেশ যদি বাঁচাতে হয় দুটো জিনিস চাই-ই-চাই। অর্থকড়ির সংস্থান চাই। সেই অর্থকড়ি পরিবেশ রক্ষার কাজে কেমন করে খরচ হবে তার একটা সাংগঠনিক পরিকাঠামো চাই। ঠিক হল, একটা আন্তঃরাষ্ট্র পরিচালন পরিষদ তৈরি করা হবে। এরা নীতি তৈরি করবে। দেশে দেশে নীতি পালন করার নির্দেশ (বা অনুরোধ) দান করবে। অর্থকড়ি যা সংগ্রহ হবে তা দিয়ে গড়ে তোলা হবে ‘পরিবেশ তহবিল’। পৃথিবীর কোথায় কেমন পরিবেশ থাকছে তার সমীক্ষার কাজ চলবে। সমীক্ষায় বিপদ সংকেত পাওয়া গেলে যারা যে কারণে দূষণ ঘটাচ্ছে তাদের সে কারণগুলো জানিয়ে দিয়ে প্রয়োজনীয় সর্তকতা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হবে। মানুষকে সচেতন না করে এ-কাজ সম্ভব নয়। এমনকি তেমন তেমন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত পরিবেশকর্মী গড়ে তোলারও দরকার হতে পারে। যাকে প্রধান করা হল তাঁর নাম মরিস ফ্রেডরিক স্ট্রং (১৯২৯-২০১৫)।
ভদ্রলোক কানাডার একজন তেল ও খনিজব্যবসায়ী। প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়েই তাঁর বাণিজ্য। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কানাডার পাওয়ার কর্পোরেশনের সভাপতি ছিলেন। সত্তর দশকের গোড়ায় রাষ্ট্রসংঘে যোগ দেন। পরিবেশ বিষয়ক ভাবনা তাঁর হাতেই ন্যস্ত করা হয়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্টকহোম সম্মেলনের আগের বছর তিনি পরিবেশ নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। তার শিরোনাম ছিল, ‘একটাই পৃথিবী : ছোট্ট একটি গ্রহের যত্ন ও সংরক্ষণ’। এই কাজ একা কারোর নয়। আটান্নটি দেশের একশো বাহান্ন জন শীর্ষস্থানীয় পরিবেশবিদ একসঙ্গে কাজ করেছেন। তার ওপর দাঁড়িয়েই ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের সম্মেলন হয়েছিল। পৃথিবীর পরিবেশ কেমন, এই নিয়ে এটিই ছিল প্রথম বড়ো মাপের কাজ।
যাইহোক পরিবেশ সম্মেলন শেষ হল ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুন। মাস ছয়েক সময় লাগল। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কেনিয়ার নাইরোবিতে তৈরি হয় ‘ইউনাইটেড নেশন্স এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম’। জাতিসংঘ পরিবেশ কার্যক্রম। এর শীর্ষে রইলেন মরিস স্ট্রং। মনে রাখা ভালো, রাষ্ট্রসংঘের এই প্রথম একটি কার্যক্রমের মূল দপ্তর তৃতীয় বিশ্বের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। কথা প্রসঙ্গে জানানো যেতে পারে, ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে রিও ডি জেনেরিও-তে যে ‘বসুন্ধরা বৈঠক’ হয়েছে তার প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনিই। স্টকহোম সম্মেলনের মতো এই বসুন্ধরা বৈঠক-ও বারো দিন ধরে চলেছে (৩-১৪ জুন)। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ‘খাদ্যের জন্য তেল কার্যক্রম’ পরিচালনায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। তদন্তে সরাসরি তাঁর কোনো যোগাযোগ মেলেনি। অবসরের পর তিনি বেজিং শহরে থেকেছেন। চিনের অনেক পরিবেশ প্রকল্পে উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেছেন। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে স্ট্রং কানাডার রাজধানী ওটাওয়ায় মারা যান। তাঁকে নিয়ে শুরু থেকেই কোনো-না-কোনো মহলে বিতর্ক ছিল। সে বিতর্কের প্রধান কারণ একজন তেল ও খনিজ ধনকুবের কেন রাষ্ট্রসংঘের পরিবেশ ভাবনা দেখাশোনার দায়িত্বে থাকবেন। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ। তখন সোভিয়েত দেশের পতন সাঙ্গ হয়ে গিয়েছে, সেই ভাঙনের প্রধান রূপকার মিখাইল গর্বাচেভ ‘মূল্যবোধ ও নীতি সমৃদ্ধ’ পৃথিবীর লক্ষ্যে ওই বছর স্ট্রং-কে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘আর্থ চার্টার’। তাঁরা দু’জনেই বললেন, মানবাধিকার রক্ষা, মানবোন্নয়ন ও শান্তির কথা মাথায় রেখে তাঁরা পরিবেশ সংরক্ষণের কাজ করে যেতে চান। পৃথিবীতে সন্দেহের ঊর্ধ্বে কোনো ব্যক্তিত্ব নন। স্বভাবতই রাষ্ট্রসংঘের পরিবেশ সংরক্ষণ পরিকল্পনা প্রথম পর্ব থেকেই বিতর্কের জটাজাল ছাড়াতে পারেনি।
আরও কয়েক বছর পিছিয়ে যাই। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে সুইডেন পরিবেশ নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করার প্রস্তাব দিয়েছিল। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদ এমন প্রস্তাবে সাধুবাদ জানায়। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে ইউনেস্কো প্যারিস শহরে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সম্মেলন করে। তাদের সুপারিশ গ্রহণ করে রাষ্ট্রসংঘ। সেখানেই ঠিক হল, আগামী সম্মেলনের জন্য একটি ঘোষণাপত্র চাই। একটি আন্ত:রাষ্ট্রীয় ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি হল। প্রথমে ওরা কতগুলো বিষয় ঠিক করে নিল। এক, ঘোষণাপত্র হবে আকারে ছোটো। বয়ান হবে অনুপ্রেরণামূলক। এমন ভাষায় লিখতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন। নইলে মানুষ পরিবেশ রক্ষায় কাজ করবেন কেমন করে? কেউ কেউ বললেন, করণীয় কাজ ঘোষণাপত্রে যোগ করা হোক। অনেকে তখন বললেন, তা সঠিক হবে না। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকুক। কর্মপন্থা সম্মেলনে বসে প্রতিনিধিরা ঠিক করবেন। করণীয় কাজ গোড়াতেই বলে দিলে অনেকে তাকে নির্দেশ বলে মনে করতে পারেন। এছাড়া আলোচনার পরিসর সংকীর্ণ হয়ে পড়বে। এমন অভিমত-ই গ্রাহ্য হল। ঘোষণাপত্র তৈরি করতে গিয়ে কেউ কেউ ভেবেছেন, ‘পরিবেশ ও উন্নয়ন’ বিষয়টি উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে খুব জরুরি এক জিজ্ঞাসা। কাজেই ঘোষণাপত্র এমনভাবে লিখতে হবে যেন এই প্রশ্নে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির স্বার্থ রক্ষা হয়। তা সত্ত্বেও কেউ কেউ বলেছেন, উন্নয়ন বিরোধী অতি সংরক্ষণবাদী ভাবনা দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি রাষ্ট্রকে তার নিজের মতো করে পরিবেশ আইন রচনার অধিকার দিতে হবে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত।
‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ ঘোষণাপত্রের যে ভাষ্য রচনা করেছিল তার ভেতরে মোট ২৩টি নীতি ছিল। বলা দরকার, সম্মেলনে তার যে খসড়া পেশ করা হয়েছিল, প্রতিনিধিদের আলোচনার মধ্য দিয়ে তা অনেকটা সমৃদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে চিনের প্রতিনিধিরা অনেকগুলি সংশোধনী দিয়েছিলেন। সে সকল সংশোধনীর বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। একটা বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। ওয়ার্কিং গ্রুপের তৈরি করা নীতিতে নিউক্লীয় অস্ত্রের কথা ছিল। চিন বলেছে, এর সঙ্গে জীবাণু অস্ত্র ও রাসায়নিক অস্ত্রের বিষয়টি যোগ হওয়া প্রয়োজন। আমরা নিশ্চয়ই এমন প্রস্তাবে আপত্তিকর কিছু দেখছি না। ভারতের প্রতিনিধিরা নীতিসনদের উচ্চ প্রশংসা করেন। ভারত বলেছিল, ‘the Declaration represented an important milestone in the history of the human race.’ আমাদের গ্রহকে ভাবী প্রজন্মের কাছে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার প্রস্তুতি শুরু হল। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সম্মেলনে সোভিয়েত দেশ ও কিউবা উপস্থিত ছিল না। চিলি প্রশংসা করেছে। কানাডা এক ধাপ এগিয়ে বলেছিল, আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন রচনার প্রথম পদক্ষেপ সূচিত হয়েছে। মরিস স্ট্রং খুব খুশি হয়ে জানিয়েছিলেন, ‘অনেকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন এই নীতিসনদ। কিন্তু একথা তো সত্যি বলে প্রমাণিত হল যে রাজনীতি, আদর্শ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বহু ফারাক থাকা সত্ত্বেও সকলে মিলে একটা দলিল প্রস্তুত করতে পেরেছেন’। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন ও পরিবেশ বিষয়টি উপেক্ষিত হয়নি, একথা বলে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন ঘানার প্রতিনিধি। চিলি প্রশংসা করেছে, একথা আমরা আগেই বলেছি। তবে একটি সমালোচনা ছিল। এই নীতিসনদে মতাদর্শগত ভারসাম্যের অভাব নজরে পড়েছে তাদের। এর পুনর্বিবেচনার দাবি তুলেছিল চিলি। স্টকহোম ঘোষণাপত্র রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যখন আলোচনা হচ্ছে, সোভিয়েত প্রতিনিধি উঠে দাঁড়িয়ে জানালেন, জার্মান গণপ্রজাতন্ত্রকে স্টকহোম সম্মেলনে যোগদানের অনুমতি না দেওয়া সঠিক কাজ হয়নি। তবে সোভিয়েত দেশ গৃহীত এই নীতিসনদকে অশ্রদ্ধার চোখে দেখছে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপের একাধিক সমাজতান্ত্রিক দেশের স্টকহোম সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার কারণ ছিল একটাই। গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মানিকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ করা হচ্ছে না। ধনতন্ত্রের আধিপত্য যে স্টকহোম সম্মেলন পরিচালনায় সামান্যতমও ছিল না, এ কথা বলি আমরা কেমন করে? দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় নীতি সেসময় বর্ণবৈষম্যের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, তার সমালোচনা হয়েছিল সম্মেলনে। স্বভাবতই দক্ষিণ আফ্রিকা জানাল, তারা এই নীতিসনদকে সমর্থন করছে না। সর্বসম্মত নীতিসমূহ বলে যে কথা উচ্চারিত হচ্ছে তা বাতিল করার দাবি জানায় দক্ষিণ আফ্রিকা। নীতিসনদকে তাই ভোটাভুটিতে যেতে হয়। একশো তিনটি রাষ্ট্র সমর্থন জানায়; সোভিয়েত ইউনিয়ন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ সহ মোট বারোটি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।
গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মানির কাহিনি খানিকটা এপ্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো। গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মানি পৃথিবীর মানচিত্রে বেঁচে ছিল ১৯৪৯ থেকে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সোভিয়েত দেশ সহায়তা করেছে। জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি শাসনভার গ্রহণ করেছে। জার্মানদের ছিল দুখানা দেশ। পূর্ব জার্মানি আর পশ্চিম জার্মানি। গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মান পূর্ব জার্মানি হিসাবে পরিচিত ছিল। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে দুই জার্মানির মাঝে দেওয়াল তৈরি হয়। কয়েক দশক পরে আবার ভেঙ্গেও যায়। আমেরিকা প্রথম থেকেই গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মানিকে স্বীকৃতি জানাতে রাজি হয় নি। এদিকে পূর্ব জার্মানি পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করেছে। কিউবা, অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, কঙ্গো, ইয়েমেন, লিবিয়া ও বেনিনের সঙ্গে সংহতি তৈরি হয়। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে দেওয়াল ভাঙার সময় দুই দেশের মানুষের উৎসাহ ছিল। আজ পূর্ব জার্মানির পূর্ব এলাকা সুখে নেই।
২০০২ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার মিশিগান ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে লিওনিয়ে নাফটনের লেখা ‘দ্যাট ওয়াজ দি ওয়াইল্ড ইস্ট’ নামে একটি বই বেরিয়েছে। সেখানে লেখক জানিয়েছেন, অল্প কয়েক বছরেই পূর্ব জার্মানির নাগরিকদের আশাভঙ্গ হয়েছে। ভয়ংকর রকমের বেকারত্ব। যারা আগে পূর্ব জার্মানির নাগরিক ছিলেন তাঁদের শতকরা আশি জন মনে করেন যে, তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে পূর্ব জার্মানি এলাকায় জাতীয় আয়ের গড় সবচেয়ে কম। সত্তর ভাগ মানুষ মনে করছেন, জার্মানির সরকার তাদের প্রয়োজনীয় কাজ করছে না। পূর্ব জার্মানির এলাকায় আজও বড়ো বড়ো ব্যবসা বাণিজ্য করছে পশ্চিম জার্মানির বাসিন্দারা। দেশ একটা। পূর্বভাগ যেন পশ্চিম ভাগের উপনিবেশ হয়ে বেঁচে আছে।
মার্কিন মতাদর্শের আধিপত্য স্টকহোম সম্মেলনে পূর্ব জার্মানিকে আসতে দেয়নি। নীতিসনদ রচিত হয়েছে, কিন্তু পৃথিবীর সকল মানুষকে আসতে যে দেবে না, তার একটা পূর্বপ্রস্তুতি মার্কিন দেশে চলছিলই। তেমন একটা গোপন নথি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, যা আমরা দেখতে পারি। আমেরিকার ‘ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ শাখা থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট এই নোট লেখা হয়। নোটের সারসংক্ষেপ আমরা বাংলায় অনুবাদ করব। কিন্তু শিরোনামটি ইংরেজিতেই থাকবে যা থেকে মার্কিন ভারসাম্যহীনতা প্রকাশ পাবে, ‘Soviets Pushing GDR Participation in Stockholm Environment Conference’। এখানে ‘Pushing’ শব্দটি যে নিরপেক্ষ নয়, তা নিশ্চয়ই পাঠক-বন্ধুরা জানেন। নোটের সারমর্ম ছিল এরকম :
“গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মানির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ইউএসএসআর পরিবেশ বিষয়টিকে রাজনৈতিক ফুটবল খেলার বিষয় করে তুলেছে। মস্কো আপ্রাণ চেষ্টা করছে, স্টকহোমের পরিবেশ সম্মেলনে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে যাতে জিডিআর অংশগ্রহণ করতে পারে। এমনকি এরা সম্মেলন বয়কটের হুমকিও দিয়েছে। এটা সোভিয়েত দেশের দীর্ঘকালীন নীতির প্রতিফলন। আন্তর্জাতিক সংস্থায় যাতে জিডিআর নাম লেখাতে পারে তার জন্যই এদের এই উদ্যোগ। নিউইয়র্কে ১৩ সেপ্টেম্বর সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সভা হবে। সোভিয়েত বিষয়টি তুলবে বলেই মনে হয়। সেখানে যুদ্ধ করতে হবে”।
এপ্রিল মাসে যখন প্রাগে সভা হয়েছিল, সেখানে সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপ বিষয়টি তুলেছিল। জুন মাসে রাষ্ট্রসংঘে সোভিয়েত আধিকারিকেরা ইতালির প্রতিনিধিদের বলেছেন, জিডিআর যেন স্টকহোম সম্মেলনে জায়গা পায়, তার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করবে।
এক মাস পর জেনেভাতে রাষ্ট্রদূত বুশকে সোভিয়েত প্রতিনিধির নেস্তোরোঙ্কো বলেছিলেন, পরিবেশ প্রশ্নে আমেরিকার অধিক উৎসাহ তার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে না। সোভিয়েতের পক্ষে নেস্তোরোঙ্কো জানান, পরিবেশ সম্মেলনে সকল দেশের অংশগ্রহণের অধিকার থাকা উচিত। জিডিআর জায়গা না পেলে সোভিয়েত থাকবে কী থাকবে না, বিবেচনা করে দেখবে।
সুইডিশ প্রতিনিধিদের সঙ্গেও নেস্তোরোঙ্কো কথা বলেছেন। সুইডিশ প্রতিনিধির কাছে নাকি নেস্তোরোঙ্কো একটি বিবৃতি পড়েছেন (লিখিত আকারে পাওয়া যায়নি)। সেখানে সোভিয়েত প্রতিনিধির বলার ধরন(!) দেখে সুইডিশ প্রতিনিধির মনে হয়েছিল, কিউবা, উত্তর কোরিয়া, ও উত্তর ভিয়েতনামকে না ডাকলে ওরা বিশেষ কিছু বলবে না। জিডিআর-কে আমন্ত্রণ করতেই হবে। নইলে নাকি ‘হুমকি’ দিয়েছেন, পরিবেশের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ভেস্তে দিয়ে সোভিয়েত তাকে সিম্পোজিয়ামে বদলে দেবেন। কেমন করে? সুইডিশ প্রতিনিধি সে-কথা জানাতে পারেননি।
মার্কিন গোয়েন্দাদের গোপন নোটে লেখা ছিল, সুইডেনের প্রতিনিধি ওলফ্ পাল্মে (তিনি তখন প্রধানমন্ত্রী) নাকি পশ্চিম জার্মানিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করাবেন যাতে জিডিআর সম্মেলনে যোগ দিতে পারে, নইলে সুইডেনের সাধারণ মানুষ ও বেশ কয়েকটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ তার ওপর ক্ষুব্ধ হবে। এছাড়া আয়োজক দেশ হিসেবে সুইডেন চাইবে না, একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন নেমে গিয়ে সিম্পোজিয়ামে পরিণত হোক।
পশ্চিম জার্মানি তার আশঙ্কার কথা ন্যাটো দেশের বন্ধুদের জানিয়েছে। তাদের মনে হয়েছে আগে যারা জিডিআর-এর অন্তর্ভুক্তির তীব্র বিরোধিতা করত তারা আজকাল আর তেমনটা করছে না। কাজেই জিডিআর অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থায় ঢুকে পড়বে বলেই পশ্চিম জার্মানির মনে হচ্ছে।
আমেরিকার অস্বস্তির ধরন দেখলে মাঝে মাঝে অবাক লাগে। সামনে অপেক্ষা করছে পূর্ব-পশ্চিম জার্মানির আলোচনা। জিডিআর যদি সম্মেলনে আসে, পশ্চিম জার্মানির গুরুত্ব নাকি কমে যাবে।
নীতিসনদ গ্রহণে কোনো দেশ বিরোধিতা করেনি, বৈষম্যে ভরা পৃথিবীতে তা ছিল এক পরম স্বস্তির বিষয়। মোট ছাব্বিশটি নীতি শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়েছিল নীতি সনদে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের পর যেসব পরিবেশ সম্মেলন হয়েছে তার সংঘাত ও সংহতি বুঝতে চাইলে নীতিকথাগুলি আমাদের একবার দেখে নেওয়া দরকার।
শুরুর কথা
পৃথিবীর বয়স সাড়ে চারশো কোটি বছর। জন্ম থেকেই পৃথিবীতে জীবন দেখা যায়নি। বিজ্ঞানীদের অনুমান, তিনশো চল্লিশ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম জীবন এসেছে। তারপর এক দীর্ঘ ইতিহাস। বিবর্তনের হাত ধরে আণুবীক্ষণিক জীবন থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবীতে এসেছে এক এক জীবন প্রজাতি। এসেছে গাছপালা। তৈরি হয়েছে বন-জঙ্গল। এসেছে পোকামাকড়, পশুপাখি। চোখে দেখা যায় না এমন জীবন যেমন পৃথিবীতে এসেছে, ডাইনোসরের মত বৃহদাকার প্রাণীও এই পৃথিবীতে এককালে এসেছিল।
বিবর্তনের শেষ ফসল মানুষ। জীববিজ্ঞানীরা আমাদের নাম দিয়েছেন হোমো সেপিয়েন্স। পৃথিবীতে আদিম মানুষের দেখা মিলেছে কখন? তিন লক্ষ বছর আগে আফ্রিকায়। দু লক্ষ বছর আগে ‘আধুনিক’ মানুষ। ‘মস্তিষ্ক’ খাটিয়ে মানুষ বেঁচে বর্তে আছে অন্তত এক লক্ষ বছর আগে থেকে। ‘আদিম’ থেকে ‘আধুনিক’ হতে এক লক্ষ বছর। কথাগুলো একটু অতিমোটা দাগের হল। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দিকে যাওয়া হল না।
শুরুর দিকে বহু বছর ‘পরিবেশ’ নিয়ে মানুষের বিন্দুমাত্র ভাবনা ছিল না। থাকবার কথাও নয়। যে সংখ্যায় মানুষ, তার চেয়ে অন্য প্রজাতির সংখ্যা বহুগুণ বেশি। পশু শিকার তখন যেমন ক্ষুন্নিবৃত্তির উপায়, আনন্দেরও সামগ্রী। এর সামাজিক মান্যতা ছিল। বীরত্বের স্বীকৃতি ছিল। বাঘ মেরে মৃত বাঘের শরীরে পা রেখে ‘বীরোচিত আলোকচিত্র’ আজকালও আমরা দেখতে পাই। এখন অবিশ্যি নিয়ম ভিন্ন। সেলিব্রিটিদেরও এমন অপরাধে কিছুকাল অন্তত কারাবন্দি থাকতে হয়।
বন-জঙ্গল থেকে ফলমূল খেয়ে, পশু শিকার করে তার মাংস খেয়ে, এককালে একরকমের জীবন কাটিয়েছে মানুষ। আগুন আবিষ্কারের পর পুরো ছবিটাই বদলে গিয়েছে। আগে যেমন নানা প্রাকৃতিক সম্পদকে মানুষ সরাসরি কোনো প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই নিজেদের জীবন যাপনের কাজে লাগাত, এখন আর তা হয় না। প্রাকৃতিক সম্পদ আহরিত হয়। নানা ধাপে তার প্রক্রিয়াকরণ সম্পন্ন হয়। শিল্প বিপ্লবের পর এই পুরো প্রক্রিয়াকরণের উদ্দেশ্যটাই পালটে গিয়েছে। মহাজনের হাতে পড়েছে প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা। ঝুলি ভরে উঠেছে মোটা মুনাফায়। আর তখনই প্রকৃতির সম্পদ লুণ্ঠনে শুরু হয়েছে নীতি-নৈতিকতাহীন ব্যভিচার। স্বল্পায়ু ব্যভিচার প্রকৃতি সইতে পারে। নিরবিচ্ছিন্ন ব্যভিচার সইবে কেমন করে?
পরিবেশ বিষয়ে প্রথম সম্মেলন
পরিবেশ ভাবনার ইতিহাসে বর্তমান বছরটিকে আমাদের আলাদা করে মনে রাখতে হয়। কেননা ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৫-১৬ জুন সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল। সময়ের বিচারে পঞ্চাশ বছর পার হল। সকল দেশ সমান আগ্রহ নিয়ে এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল, এমনটা বলা যায় না। সম্মেলনে পূর্ব জার্মানি আমন্ত্রিত ছিল না। এই প্রতিবাদে আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোলান্ড, রুমানিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যোগ দেয়নি। সম্মেলন চলাকালীন খবর পাওয়া না গেলেও সম্মেলনের তিরিশ বছর পর ২০০২ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞান জার্নাল ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’-এ একটা চাঞ্চল্যকর খবর বেরিয়েছিল। স্টকহোম সম্মেলনের এক বছর আগে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে এক গোপন বৈঠকে বসেছিল পৃথিবীর সাতটি দেশ। দেশ গুলি হল— ব্রিটেন, আমেরিকা, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস্ ও ফ্রান্স। এককথায় আগের দেশগুলিকে যেমন ‘ওয়ারশ চুক্তির দেশ’ বলা হয়, এই দেশগুলিকে বলা হয় ‘ব্রাসেলস গ্রুপের দেশ’। সে যাই হোক, কেন বসেছিল ওরা গোপন বৈঠকে? ধনী দেশগুলির কাঁধে পা রেখে গরিব দেশগুলি যেন বেশি দূর এগোতে না পারে। যথারীতি অভিযোগ উঠল, বাণিজ্যের পায়ে শেকল পরাতে চাইছে স্টকহোম সম্মেলন। গোপন নথিতে লেখা ছিল, এই বৈঠকের কথা যেন কোথাও না যায় (‘It will have to remain informal and confidential’)। এরা নিজেদের ভাবমূর্তি বিষয়ে ছিল সচেতন। নইলে নথিতে লেখা থাকত না, সুইডিশ ও অন্যদের কাছ থেকে আমাদের সমালোচনা শুনতে হতে পারে। আমাদের গ্রুপের সদস্য বাড়ানোর বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, awkward bedfellows-দের কিছুতেই নেওয়া চলবে না। নথিতে এমন কথাও লেখা রয়েছে, ‘ব্রিটেন স্টকহোম সম্মেলনে নানা রকম ভাবে চাপ তৈরি করবে। বেশি প্রস্তাব যেন গৃহীত হতে না পারে, তার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। নতুন কোনো আন্তর্জাতিক সংগঠন তৈরির কথা উঠলে সাধ্যমত বাদ সাধতে হবে। নিয়ন্ত্রণমূলক কোনো অভিপ্রায় দেখলে বাধা দিতে হবে। তবু সম্ভবত হয়তো ঠেকানো যাবে না। সত্যিই ঠেকানো যায়নি। বারো দিনের সম্মেলন শেষে ‘United Nations Environment Programme’ (UNEP) নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে। ৫ জুন যেহেতু সম্মেলন শুরু হয়েছিল, প্রতি বছর ওই দিনটিতে ‘আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আর একগুচ্ছ অঙ্গীকার নিয়ে ঘোষিত হয়েছে ‘স্টকহোম ঘোষণাপত্র’। যেহেতু এই সম্মেলন পৃথিবীর প্রথম পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন, গৃহীত ঘোষণাগুলি আমরা এখানে লিখব।
স্টকহোম ঘোষণাপত্র
১. মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বর্ণবৈষম্য ও উপনিবেশবাদের অবসান ঘটাতে হবে।
২. প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষিত করতে হবে।
৩. পৃথিবীর পুনর্নবীকরণযোগ্য সম্পদের উৎপাদন সক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।
৪. বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষিত করতে হবে।
৫. নবীকরণযোগ্য নয় এমন সম্পদের অংশিদারিত্ব আবশ্যিক এবং এমন সম্পদের নিঃশেষ প্রতিহত করতে হবে।
৬. পরিবেশের দূষণ নিঃসরণ ক্ষমতার বাইরে যেন দূষণ না ঘটে তা দেখতে হবে।
৭.. সামুদ্রিক দূষণ রোধ করতে হবে।
৮. পরিবেশের অগ্রগতির জন্য উন্নয়ন চাই।
৯. উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সহযোগিতা করতে হবে।
১০. পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নশীল দেশগুলিকে উপযুক্ত অর্থ দিতে হবে।
১১. পরিবেশ নীতি নেন উন্নয়ন ব্যাহত না করে।
১২. পরিবেশ সুরক্ষা উন্নত করার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থের প্রয়োজন।
১৩. সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন।
১৪. পরিবেশ ও উন্নয়নের সংঘাত রোধে যুক্তিগ্রাহ্য পরিকল্পনা প্রয়োজন।
১৫. মনুষ্যবসতি সুপরিকল্পিত হওয়া চাই যেন পরিবেশজনিত সংকট দূর হয়।
১৬. সরকারগুলিকে জনসংখ্যা নীতি গ্রহণের সঠিক পরিকল্পনা নিতে হবে।
১৭. দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের উন্নয়নে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
১৮. পরিবেশ উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাজে লাগাতে হবে।
১৯. পরিবেশবিদ্যা আবশ্যিক করতে হবে।
২০. পরিবেশ গবেষণা, বিশেষত উন্নতশীল দেশে বৃদ্ধি করতে হবে।
২১. কোনো দেশ চাইলে সম্পদ ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু অন্যদের বিপদে ফেলবে না।
এই ঘোষণাপত্রের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি, আগামীদিনে পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে উন্নতদেশের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশের সংঘাত অনিবার্য। উন্নয়নশীল দেশের পরিবেশ উন্নয়নে উন্নত দেশগুলি বিনা বাধায় আর্থিক সাহায্যদানের পথে এগিয়ে যাবে, এমন মনে করবারও কোনো কারণ ঘটেনি। সাত উন্নত দেশের গোপন অভিসন্ধির কথা আমরা খানিকটা আগেই তো উল্লেখ করেছি। পরিবেশ নীতি তৈরি করতে গিয়ে ‘উত্তরের দেশ’ আর ‘দক্ষিণের দেশ’-এর লড়াই দেখা যায়। ‘উত্তরের দেশ’ হল সেইসব দেশ যাদের খাদ্য-বস্ত্র- শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থানের অভাব দেখা যায় না কিন্তু দেশের ভৌগোলিক মানচিত্রে জীববৈচিত্র্যের চেহারা অত্যন্ত ক্ষীণ। ‘দক্ষিণের দেশ’গুলি তার বিপরীত। সেখানে খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান সকলের হাতে পৌঁছোয়নি কিন্তু তাদের রয়েছে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের সম্পদ। এই বৈপরীত্যই পরিবেশের আইনকানুন নির্মাণের বেলায় সংঘাত ডেকে আনে।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সম্মেলন
যেহেতু আমাদের নিবন্ধের মূল আলোচনার বিষয় গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন, আমরা অন্যান্য সম্মেলনের কথায় বেশি সময় ব্যয় করব না। দু-একটি কথা নিশ্চয়ই বলব আমরা। বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, ওজোন স্তরে গর্ত তৈরি হলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি বিনা বাধায় পৃথিবীতে নেমে আসবে। তার ফলে আমাদের উপরে তো বটেই, সকল জীবসম্পদের উপরেই ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। বায়ুমণ্ডলের নানা জায়গায় ওজোন স্তরে গর্ত তৈরি হচ্ছে বলে সতর্ক করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। নানা দেশের তখন টনক নড়ল। চুক্তি তৈরি হল। বহুজাতিকেরা তো এমন অভিযোগ মানতেই চায় না। ঝগড়াঝাঁটি হল অনেক। শেষে ‘মন্ট্রিল চুক্তি’ হল। ১৯৭টি দেশ এখনও পর্যন্ত এই চুক্তিতে সই করেছে। যে যে কারণে ওজোন স্তরে গর্ত হতে পারে তা কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি সকল দেশ-ই দিয়েছে। এমনটা চালু থাকলে ওজোন স্তর ২০৫০ থেকে ২০৭০ সালের মধ্যে ১৯৮০ সালের চেহারায় ফিরে আসবে।
গোড়ায় আমেরিকার সরকারি মুখপাত্ররা যতোই ধানাইপানাই করুক, বিশ্ব উষ্ণায়ন যে আজ পৃথিবীর ভয়ঙ্কর রকমের বিপদ, এই নিয়ে বিতর্ক নেই। বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধি। যে কটি গ্রিন হাউস গ্যাস আছে তাঁর মধ্যে ‘কার্বন ডাই অক্সাইড’ গ্যাস আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ও কলকারখানা থেকে এই গ্যাস তৈরি হয়। ‘দক্ষিণের দেশ’ (গরিব দেশ)গুলির সকল মানুষ বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে পারে না। আধ-পেটা খাবার তৈরিতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করতেই হয়। অন্যদিকে ‘উত্তরের দেশ’গুলি (ধনী দেশ) বিলাসি জীবনযাত্রা বাঁচিয়ে রাখতে যথেচ্ছভাবে শক্তি ব্যয় করে। কলকারখানার ভেতর থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করে। স্বল্প জনসংখ্যা নিয়েও আমেরিকার একজন নাগরিক পৃথিবীর যে কোনো দেশের নাগরিকের চেয়ে বহুগুণ বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করে। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে আমরা যাচ্ছি না। চিনের জনসংখ্যা সর্বোচ্চ। আমরাও জনসংখ্যার বিচারে চিনের পেছনেই আছি। দুই দেশের বেলাতেই মাথা পিছু কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ আমেরিকার মাধাপিছু কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণের চেয়ে অনেক কম। কার্বন ডাই অক্সাইড কমাতে বললে উত্তরের দেশগুলিকে কলকারখানা কমাতে হবে। এতে বাণিজ্যের প্রসারে বাধা আসবে। মুনাফা কম হবে। এর জন্যেই তো সাতদেশ গোপন বৈঠকে বসেছিল। তবু যাই হোক, অনেক বাকবিতণ্ডা শেষে ‘কিয়োটো চুক্তি’ হয়েছে। ১৯৯৭ সালে তৈরি হয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে লাগু হয়েছে। ২০১২ সালে পুনর্বিবেচনা হয়েছে। মোদ্দা কথা, এই চুক্তির একটা সদর্থক প্রভাব পড়েছে নিশ্চয়ই। তবে বারাক ওবামার আগে এই চুক্তিতে আমেরিকা সহমত জানায়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে আবার হাত তুলে নিয়েছে। বাইডেন খানিকটা ওবামার পথে হেঁটেছে।
১৯৭২ সালের পর বলতে গেলে সবচেয়ে বড়ো পরিবেশ সম্মেলন হয়েছে ১৯৯২ সালে। ১৯৯২ সালের ৩-১৪ জুন বারোদিন ধরে রিও ডি জেনেরিও-তে হয়েছে ‘বসুন্ধরা সম্মেলন’। প্রথম সম্মেলনের (১৯৭২) দুই দশক পরে এই সম্মেলন বসেছে। স্টকহোম ঘোষণাপত্রের মতোই এই সম্মেলন থেকেও ‘রিও ঘোষণাপত্র’ তৈরি হয়। আর তৈরি হয়েছিল একটি ‘কর্ম পরিকল্পনা’ যার পোশাকি নাম ‘অ্যাজেন্ডা ২১’। একুশ শতকে পরিবেশ রক্ষায় কী হবে মানুষের কর্তব্যকর্ম। কেমন দায়ভাগ নেবে উন্নত দেশ ইত্যাদি ইত্যাদি। ১৭৮টি দেশ এই নথিতে সম্মতি জানিয়েছে। বিশ্বে তখন ‘ভুবনায়ন’ গরিবগুর্বোর জীবনযাত্রায় থাবা বসাচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পদানত হতে বাধ্য হচ্ছে দেশের পর দেশ। বছর পাঁচ পরে (১৯৯৭) রাষ্ট্রসংঘ যখন ‘অ্যাজেন্ডা ২১’-এর অগ্রগতি নিয়ে হিসেব করতে বসল, দেখতে পেল, গরিব আর ধনীর আয়ের ব্যবধান বাড়ছে দ্রুত হারে। পরিবেশের উন্নতির বদলে অধোগতি দেখা যাচ্ছে। আবার লিখিত আকারে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হল। পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতেই হবে। সবটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য আরও পাঁচবছর পরে, প্রথম বসুন্ধরা বৈঠকের এক দশক পরে, আফ্রিকার জোহানেসবার্গে বসল দ্বিতীয় বসুন্ধরা বৈঠক। ২০০২ সালের ২৬ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর দশদিন ধরে চলেছে এই বৈঠক। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ বৈঠকে গেলেন না। কলিন পাওয়েল গেলেন যদিও, তাড়াহুড়ো করে দু-চার কথা বললেন। বিমান বন্দরের রানওয়েতে তার বিমান দাঁড় করানো ছিল। বক্তৃতা শেষ করেই ফিরে চলে গেলেন। এই সম্মেলনে পৃথিবীতে টেকসই উন্নয়নের উপর জোর দেওয়া হল। দারিদ্র্য থেকে জলবায়ু পরিবর্তন – সব বিষয়ই আলোচনায় এল। ক্ষুধা ও সন্ত্রাসবাদ নিয়েও কথা হয়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। বহুজাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের আধিক্য নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। বেশ খানিকটা অর্থ ওদের ঝুলি থেকেই এসেছে। ফলে প্রভাব খাটানোর বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। সত্যি বলতে কি, রিও-তে যে উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল জোহানেসবার্গের বৈঠকে তা দেখা যায়নি।
সি.ও.পি. আখ্যান
দুখানা বসুন্ধরা বৈঠকের পর আমরা যাব ‘কনফারেন্স অফ পার্টিজ’ (COP) আয়োজিত নানা সম্মেলনের আলোচনায়। এই সম্মেলনের আয়োজক ‘ইউনাইটেড নেশন্স ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (UNFCCC)। এদের আয়োজিত সম্মেলনকেই সি.ও.পি. (COP) বলা হয়। আজ পর্যন্ত মোট ২৬টি সি.ও.পি. হয়েছে। কোথায় কবে হয়েছে, দেখা যেতে পারে।


২০২০ সালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে কোডিভ-১৯ মহামারির কারণে COP-২৬ সংগঠিত হতে পারেনি। এই সম্মেলন সংগঠিত হয়েছে ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর। প্রায় চল্লিশ হাজার প্রতিনিধির জমায়েত হয়েছে। আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধির জমায়েত। বহু রাষ্ট্রপ্রধান গিয়েছেন সেখানে। ‘প্যারিস চুক্তি’ সম্পাদিত হয়েছিল ২০১৫ সালে। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যারা, কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে সকল দেশ, পর্যালোচনা হল। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের চেহারা খারাপ। উন্নত দেশ প্রতিশ্রুতি থেকে বহুদূরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রযুক্তি হস্তান্তরেরও কোনো সচেতন উদ্যোগ নেই। এই সময় আই পি সি সি-এর ষষ্ঠ রিপোর্টের খানিকটা অংশ বেরিয়ে গেল। ভয়ঙ্কর সব বার্তা রয়েছে সেখানে। এক্ষুনি গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে না পারলে পৃথিবীর উপকূল সন্নিহিত বহু দেশ চরম বিপদে পড়বে। ভারতের বহু শহর নিকট ভবিষ্যতে জলমগ্ন হয়ে যাবে। কলকাতার গার্ডেনরিচ এলাকা সেই তালিকায় রয়েছে। গ্যাস নিঃসরণ না কমলে ২০৪০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫⁰C-এর বেশি হবে। ‘প্যারিস চুক্তি’র সময়ে আমরা তার সীমানা বেঁধে রাখব কথা দিয়েছিলাম। আগে পরিবেশের নিয়মকানুন মেনে চলা ছিল আইনিভাবে স্বীকৃত। এখন সব স্বেচ্ছা আচরণের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যে লড়াই ওই মঞ্চে দাঁড়িয়ে এককালে করেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো নয়তো উগো সাভেজ, আজকাল আর তেমন ছবি দেখা যাচ্ছে না। যাইহোক, ‘গ্লাসগো ক্লাইমেট প্যাক্ট’ তৈরি হয়েছে। যে বিষয়টি সব মহলেই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে তা হল জীবাশ্ম জ্বালানি হ্রাস বিষয়ক প্রস্তাবনা। ঠিক হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ২০১০ সালের চেয়ে ৪৫ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস তৈরি কমাতে হবে। ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ‘নেট জিরো’তে নামিয়ে আনতে হবে। ‘নেট জিরো’ মানে যতটা তৈরি করলাম ততটাই হজম করে নিলাম। অবশিষ্ট কিছু রইল না। ‘তহবিল’ নিয়ে আলোচনা হল। উন্নত দেশগুলি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না। স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে পরিবেশের। বাস্তুতন্ত্রকে চাইলেও আগের জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ হবে, এমন একটা কথা সম্মেলনে ঘোরা ফেরা করেছে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ভারত ও চিন ভিন্ন কথা বলেছে। তারা এখনও জীবাশ্ম জ্বালানি পূর্ণ পরিহারের কথা ভাবতে পারে না। তাই ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১৫১টি দেশ নিজেরা কী করবে তার খতিয়ান জমা দিয়েছে। ইংরেজিতে বলা হয় ‘Nationally determined contributions’ (NDC)। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেখানে কথা দিয়েছেন, ভারত ‘নেট জিরো’ ২০৭০ সালে কার্যকর করবে। ২০৩০ সালের মধ্যে পুনর্নবীকৃত শক্তি ব্যবহার করবে। কয়লা এখনও ভারতের চাই। তাই সম্মেলনের খসড়ায় বদল করতে হল। ‘phase out’ এর বদলে ‘phase down’ লেখা হল। অনেকে এতে খুশি হননি। সেই তালিকায় যাচ্ছি না। সব মিলিয়ে বলা চলে, একটা ‘মন্দের ভালো’ জলবায়ু সম্মেলনের রিপোর্ট পাওয়া গেছে। ভবিষ্যত-ই আমাদের কাছে বাকি কথা বলবে।
২০২২ সালে COP-২৭ অনুষ্ঠিত হবে ইজিপ্ট-এ। ২০২৩ সালে COP-২৮ অনুষ্ঠিত হবে সংযুক্ত আরবে। কী ঘটবে সেখানে, আমাদের দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।