অরুণাভ মিশ্র
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে দুটি লাইন না লিখে কী করে শুরু করতে পারি? মূল্যায়নের সে বাক্যবন্ধ আমার হলে আপনারা পড়বেন কেন। তাই শোনাই বুদ্ধদেব বসুর অনুভব :
“যেন এক দৈব আবির্ভাব — অপর্যাপ্ত, চেষ্টাহীন, ভাস্কর, পৃথিবীর মহত্তম কবিদের অন্যতম : আমার কাছে, এবং আমার মতো আরও অনেকের কাছে, এই হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর তুল্য ক্ষমতা ও উদ্যম ভাষার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে, এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল : এবং ভাষা ব্যবহারের দক্ষতায়, কবিতা ও গদ্যরচনার যুগপৎ অনুশীলনে, বহু ভিন্ন ভিন্ন বিষয় ও রুপকল্পের সার্থক প্রযোজনায় — সব মিলিয়ে, অন্য দেশে বা কালে তাঁর সমকক্ষ ক-জন আছে, বা কেউ আছেন কিনা, তা আমি অন্তত গবেষণার বিষয় ব’লে মনে করি।”[১]
এই রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’ লিখেছেন, আর সে লেখায় শৈশবে পারিবারিক শাসনের ঘেরাটোপের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও বাইরের প্রকৃতির প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ বিম্বিত হয়েছে। তাঁর কলম লিখেছে :
“বাড়ির বাহিরে আমাদের যাওয়া বারণ ছিল, এমনকি বাড়ির ভিতরেও সর্বত্র যেমন খুশি যাওয়া-আসা করিতে পারিতাম না। সেইজন্য বিশ্বপ্রকৃতিকে আড়াল আবডাল হইতে দেখিতাম। বাহির বলিয়া একটা অনন্ত প্রসারিত পদার্থ ছিল যাহা আমার অতীত, অথচ যাহার রূপ, শব্দ, গন্ধ দ্বার জানালার নানা ফাঁক ফুকর দিয়া এদিক ওদিক হইতে আমাকে ছুঁইয়া যাইত। সে যেন গরাদের ব্যবধান দিয়া নানা ইশারায় আমার সঙ্গে খেলা করিবার নানা চেষ্টা করিত। … তখন এক একদিন মধ্যাহ্নে ছাদে আসিয়া উপস্থিত হইতাম। সেই নির্জন অবকাশে প্রাচীরে রন্ধ্রের ভিতর হইতে এই খাঁচার পাখির সঙ্গে ওই বনের পাখির চঞ্চুতে চঞ্চুতে পরিচয় চলিত। দাঁড়াইয়া চাহিয়া দেখিতাম — চোখে পড়িত আমাদের বাড়ির ভিতরের বাগান প্রান্তের নারিকেলশ্রেণী; তাহারই ফাঁক দিয়া দেখা যাইত সিঙ্গিরবাগান-পল্লীর একটা পুকুর, এবং সেই পুকুরের ধারে যে তারা গয়লানী আমাদের দুধ দিত তাহারই গোয়ালঘর; আরও দূরে দেখা যাইত তরুচূড়ার সঙ্গে মিশিয়া কলিকাতা শহরের নানা আকারের ও নানা আয়তনের উচ্চনিচ ছাদের শ্রেণী মধ্যাহ্নরৌদ্রে প্রখর শুভ্রতা বিচ্ছুরিত করিয়া পূর্ব দিগন্তের পান্ডুবর্ণ নীলিমার মধ্যে উধাও হইয়া চলিয়া গিয়াছে।”[২]
প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ হাঁফিয়ে উঠতেন এই পরিবেশে। ইঁট কাঠ পাথরের ঘেরাটোপে নিজেকে নিঃসঙ্গ একাকী একজন ভাবতেন। তাই জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন :
“সবার মাঝে আমি ফিরি একেলা।
কেমন করে কাটে সারাটা বেলা।
ইঁটের ’পরে ইঁট, মাঝে মানুষ-কীট —
নাইকো ভালোবাসা, নাইকো খেলা।”
বাড়ির ভিতরের বাগানে শরৎকালের ভোরে ঘুম ভাঙলেই চলে আসতেন রবীন্দ্রনাথ। আর তখন, “একটি শিশির মাখা ঘাস পাতার গন্ধ ছুটিয়া আসিত এবং স্নিগ্ধ নবীন রৌদ্রটি লইয়া আমাদের পুবদিকের প্রাচীরের উপর নারিকেল পাতার কম্পমান ঝালরগুলির তলে প্রভাত আসিয়া মুখ বাড়াইয়া দিত।”[৩]
প্রথম আলোর আনন্দধ্বনি শুনবেন বলেই ভোরের এই মায়াবী সংগীতে যোগ দিতেন কবি। তাঁর কবিতার মধ্যে সে কথা অনন্য রূপে ফুটে উঠেছে।
“আজ প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখানি, তাই ভরে উঠেছি
আজ শুনতে পাবো প্রথম আলোর বাণী।”
‘প্রভাত সঙ্গীত’ এর মধ্য দিয়ে তাঁর প্রকৃতির সঙ্গে এই যে পথ চলা শুরু হয়েছিল, কবিতায় গানে গল্পে নিবন্ধে সর্বত্র সুরভি ছড়িয়ে আজীবন সেই ধারা বহতা রয়েছে। প্রকৃতির অন্তরঙ্গতা, রূপমুগ্ধতা আর রোম্যান্টিকতা রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যের এক অন্যতম চিত্র।
দুই
‘জীবনস্মৃতি’-তে আর-এক জায়গায় তিনি লিখছেন, “সদর স্ট্রিটের রাস্তাটা যেখানে গিয়ে শেষ হইয়াছে সেইখানে বোধকরি ফ্রী-ইস্কুলের বাগানের গাছ দেখা যায়। একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেই দিকে চাহিলাম। তখন সেই গাছগুলির পল্লবান্তরাল হইতে সূর্যোদয় হইতেছিল। তাকিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল। দেখিলাম, একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমেষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল।”[৪]
নিজের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির এক অবিচ্ছিন্ন আত্মীয়তা রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ভাবনার আর এক অন্যতম দিক। সে নমুনা তাঁর নানা লেখায়। নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে লীন করে দিয়ে তাঁর বাসনাকলম লেখে :
“তোমার মৃত্তিকা-সনে
আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে
অশ্রান্তচরণে করিয়াছ প্রদক্ষিণ
সবিতৃমণ্ডল”[৫]
অথবা
“আমারে ফিরায়ে লহ, অয়ি বসুন্ধরে,
কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে
বিপুল অঞ্চলতলে। ওগো মা মৃন্ময়ি
তোমার মৃত্তিকা-মাঝে ব্যাপ্ত হয়ে রই;
দিগবিদিকে আপনারে দিই বিস্তারিয়া
বসন্তের আনন্দের মতো।”[৬]
বিশ্বপ্রকৃতির মাতৃরূপ অন্তরে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাকে ভালোবেসেছেন। নিজেকে গরিমময় করার দম্ভ না দেখিয়ে প্রকৃতির এক ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে সেখানেই আসন নিতে চেয়েছেন।
“মানব-আত্মার দম্ভ আর নাহি মোর
চেয়ে তোর স্নিগ্ধশ্যাম মাতৃমুখ-পানে
ভালোবাসিয়াছি আমি ধূলিমাটি তোর।”[৭]
তিন
“লোকে অনেক সময়ই আমার সম্বন্ধে সমালোচনা করে ঘরগড়া মত নিয়ে বলে, ‘উনি তো ধনী-ঘরের ছেলে। ইংরেজিতে যাকে বলে রুপোর চামচে মুখে নিয়ে জন্মেছেন। পল্লীগ্রামের কথা উনি কি জানেন।’ আমি বলতে পারি, আমার থেকে কম জানেন তাঁরা যাঁরা এমন কথা বলেন। কী দিয়ে জানেন তাঁরা। অভ্যাসের জড়তার ভিতর দিয়ে জানা কি যায়? যথার্থ জানায় ভালোবাসা। কুঁড়ির মধ্যে যে কীট জন্মেছে সে জানে না ফুলকে। জানে, বাইরে থেকে যে পেয়েছে আনন্দ। আমার যে নিরন্তর ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে আমি পল্লীগ্রামকে দেখেছি তাতেই তার হৃদয়ের দ্বার খুলে গিয়েছে। আজ বললে অহংকারের মত শোনাবে, তবু বলব আমাদের দেশের খুব অল্প লেখকই এই রসবোধের চোখে বাংলাদেশকে দেখেছেন। আমার রচনাতে পল্লীপরিচয়ের যে অন্তরঙ্গতা আছে, কোন বাঁধাবুলি দিয়ে তার সত্যতাকে উপেক্ষা করলে চলবে না। সেই পল্লীর প্রতি যে একটা আনন্দময় আকর্ষণ আমার যৌবনের মুখে জাগ্রত হয়ে উঠেছিল আজও তা যায় নি।”[৮]
এই আত্মকথনে আর এক রবীন্দ্রনাথ ধরা দেন আমাদের কাছে। তিনি প্রকৃতির রসমুগ্ধ, প্রকৃতির অনন্দগন্ধ বিভোর আমোদিত রবীন্দ্রনাথ। এমন প্রকৃতির মাঝে এসে আনন্দ-মাতাল হতে দেখা যায় না সব সাহিত্যিকদের। এই মুগ্ধতা ও অনন্দময়তা এবং প্রকৃতির সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন আত্মীয়তা দুই মন্দিরা সমান তালে বেজেছে তাঁর হাতে। বসন্তযাপন প্রবন্ধে এই কথা আরও স্পষ্ট। কবি বলেন —
“আজ আমাদের সেই যুগান্তরের বড়োদিদি বনলক্ষীর ঘরে ভাইফোঁটার নিমন্ত্রণ। সেখানে আজ তরুলতার সঙ্গে নিতান্ত ঘরের লোকের মত মিশিতে হইবে — আজ ছায়ায় পড়িয়া সমস্ত দিন কাটিবে, মাটিকে আজ দুই হাত ছড়াইয়া আঁকড়াইয়া ধরিতে হইবে, বসন্তের হাওয়া যখন বহিবে তখন তাহার আনন্দকে যেন আমার বুকের পাঁজরগুলার মধ্য দিয়ে অনায়াসে হু হু করিয়া বহিয়া যাইতে দিই।”[৯]
সব সাহিত্যিকদেরই যে প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা একই হৃদয়ানুরাগ নিয়ে থাকে না তা অনেক উদাহরণ দিয়ে দেখানো যায়। মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এ আদি মানব মানবীর যে বিশ্রাম কুটির তাতে পশুপাখি আর কীট পতঙ্গের ‘প্রবেশ নিষেধ’ ছিল। মিলটন লিখেছেন,
“Beast, bird, insect or worm dust enter none;
such was their awe of Man…”
শেক্সপিয়ারের অনেক নাটকে বন একটা বড়ো জায়গা নিয়ে রয়েছে। তার ‘As you like it’ এবং ‘A Midsummer Night’s Dream’ দুটিই বনের পটভূমিকায়। কিন্তু অরণ্য সেখানে অবিচ্ছিন্ন আত্মীয় হয়ে ওঠেনি। চরিত্রগুলির সঙ্গে তাদের বিচ্ছিন্নতা স্পষ্ট।
চার
১৮৮৯ সালের নভেম্বরে জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে পূর্ববঙ্গে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখন তাঁর বয়স আঠাশ বছর। ছিন্নপত্রাবলীতে সে যাত্রার বর্ণনায় উঠে এসেছে প্রকৃতি। তার বিশালতা, তার অসীমতা, বৈচিত্র্যময়তা কবির মনে যুগপৎ মুগ্ধতা আর বিস্ময় আনে। লেখা হয় :
“শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর — ধূ ধূ করছে — কোথাও শেষ দেখা যায় না — কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায় — আবার অনেক সময় বালিকে নদী বলে ভ্রম হয় — গ্রাম নেই, লোক নেই, শুরু নেই, তৃণ নেই — বৈচিত্র্যের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদা বালি — পূর্ব দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে দেখা যায় উপরে অনন্ত নীলিমা আর নিচে অনন্ত পাণ্ডুরতা, আকাশ শূন্য এবং ধরণীও শূন্য, নিচে দরিদ্র শুষ্ক কঠিন শূন্যতা আর উপরে অশরীরী উদার শূন্যতা।”[১০]
১৮৮৮ থেকে ১৯১৫ পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছর জমিদারিতে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। জমিদারির কাজ যতটা না দেখেছেন তার দশগুণ দুচোখ ভরে দেখেছেন বাংলার প্রকৃতিকে। দেখেছেন শিলাইদহ, পদ্মা, শাহজাদপুর, যমুনা, পতিসর, আত্রাই, চলনবিল। বিচিত্র প্রকৃতির সদর আর অন্দরের পূর্ণ জলছবিতে অবগাহন করেছেন আনন্দে। অসীম তৃপ্তিতে একাত্ম হয়েছেন সে সঙ্গসুখে। পূর্ববঙ্গের প্রকৃতি ও জীবন সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধির সে ছবি ধরা আছে ছিন্নপত্রের পাতায়।
“… দেখতে দেখতে কোথায় এক জায়গায় দুই ধারের ডাঙা উঁচু হয়ে উঠল, জলে স্থলে ভাগ হয়ে গেল — মাঝখানে নদী, দুই ধারে তীর, তীরে অঘ্রাণ মাসের হলদে ধানের ক্ষেত, উঁচু পাড়ের উপর এক মনে ঘাড় হেঁট করে গরু চরছে এবং তাদেরই মুখের গ্রাসের কাছাকাছি শালিখ পাখি নৃত্য করতে করতে কীট শিকারে প্রবৃত্ত — দ্বীপের মতো এক-এক খণ্ড উচ্চভূমির উপর গুটিকতক কলাগাছ এবং কুলগাছের মধ্যে কুষ্মাণ্ডলতার সমাকীর্ণ গুটি — দুই-তিন খোড়ো ঘর, তারই অঙ্গনে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ দুই শিশু এবং কৌতূহলী বধূগণ বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার বোট নিরীক্ষণ করছে — সাদা-কালো রঙের পাতিহাঁস জলের ধারে দল বেঁধে ঠোঁটের খোঁচা দিয়ে শশব্যস্তে পিঠের পালকগুলি পরিষ্কার করছে — দূরে বাঁশঝাড় এবং ঘন তরুশ্রেণী দিগন্ত অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে — খানিকটা দূরে দুই ধারে শূন্য মাঠ — আবার হঠাৎ এক জায়গায় ছেলেদের চেঁচামেচি, স্নানার্থিনী মেয়েদের কলহাস্যালাপ, শোকাতুরা প্রৌঢ়ার বিলাপধ্বনি, কাপড় কাচার ছপছপ — স্নানাভিহত জলের ছল্ ছল্ শব্দ শুনে মুখ তুলে দেখি ঘনচ্ছায়া গ্রামের ধারে একটি ঘাট এসেছে। গোটা দুয়েক নৌকো বাঁধা আছে এবং অনিচ্ছুক রোরুদ্যমান ছেলের নড়া ধরে তার মা জোর করে স্নান করাচ্ছে।”[১১]
বাংলার পরিবেশ ও প্রতিবেশের এক নির্মল কর্মমুখর চিত্র উপরের বর্ণনায় মূর্ত হয়েছে। পল্লি প্রকৃতির এমন অপরূপ রূপ-মাধুরী মূর্ত হতে দেখি ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায়। উপেনের চোখ দিয়ে দেখা বঙ্গভূমির সেই রূপে মায়ের স্নেহাঞ্চলের পরশ।
“নমোনমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ,
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল — নিশীথশীতল স্নেহ।”[১২]
স্নেহশীলা প্রকৃতির মধ্যে এই মাতৃরূপের কল্পনা James Lovelock এর ‘গাইয়া হাইপোথিসিস’-কে মনে করায়। এই তত্ত্ব বলে, ধরিত্রী মায়ের মতো সকল উদ্ভিদ ও জীবকে সন্তান হিসেবে পালন করছে। সেই মাতৃবন্দনায় তো রবীন্দ্রকণ্ঠ গায়,
“না চাহিতে মোরে যা করেছ দান
আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ
দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায়,
সে মহাদানেরই যোগ্য করে।”[১৩]
পৃথিবীকে এমন মাতৃরূপে কল্পনা রবীন্দ্রসাহিত্যে বহুবিস্তৃত। ‘ছিন্নপত্রে’-ই এর অসংখ্য প্রকাশ রয়েছে। অথচ ছিন্নপত্রের রচনাকাল আজ থেকে অন্তত ১৩০ বছর আগে। কিন্তু গাইয়া তত্ত্ব ১৯৭০ সালের। তাই প্রকৃতিকে মাতৃরূপে দেখার ভাবনা লাভলকের বহু আগে রবীন্দ্রনাথে মূর্ত ছিল তা যেন ভুলে না যাই। ছিন্নপত্র থেকে একটিমাত্র উদাহরণ টেনে এ প্রসঙ্গ শেষ করি।
“এই পৃথিবীটি আমার অনেকদিনকার এবং অনেক জন্মকার ভালোবাসার লোকের মত আমার কাছে চিরকাল নতুন; আমাদের দুজনকার মধ্যে একটা খুব গভীর এবং সুদূরব্যাপী চেনাশোনা আছে। আমি বেশ মনে করতে পারি, বহুযুগ পূর্বে যখন তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে মাথা তুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করছেন, তখন আমি এই পৃথিবীর নতুন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলুম। তখন পৃথিবীতে জীবজন্তু কিছুই ছিল না, বৃহৎ সমুদ্র দিনরাত্রি দুলছে এবং অবোধ মাতার মতো আপনার নবজাতক ক্ষুদ্র ভূমিকে মাঝে মাঝে উন্মত্ত আলিঙ্গনে একেবারে আবৃত করে ফেলছে। তখন আমি এই পৃথিবীতে আমার সমস্ত সর্বাঙ্গ দিয়ে প্রথম সূর্যালোক পান করেছিলুম, শিশুর মতো একটা অন্ধজীবনের পুলকে নীলাম্বরতলে আন্দোলিত হয়ে উঠেছিলুম, এই আমার মাটির মাতাকে আমার সমস্ত শিকড়গুলি দিয়ে জড়িয়ে এর স্তন্যরস পান করেছিলুম।”[১৪]
পাঁচ
পরিবেশ বলতে আমরা বুঝি আমাদের চারপাশের সপ্রাণ ও অপ্রাণ জগৎ। তার মধ্যে মাটি, পাথর, জল, বাতাস, উদ্ভিদ, প্রাণী, কীট, পতঙ্গ, জ্যোতিষ্ক, শূন্যতা সবই রয়েছে। আর মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সামগ্রিক পরিবেশের সঙ্গে তার মিথস্ক্রিয়া সহ যে জগৎ তা আমার প্রতিবেশ। এই পরিবেশ ও প্রতিবেশ ঘিরে রবীন্দ্রভাবনার সুরটি ধরার চেষ্টায় আমরা মনে রেখেছি পরিবেশ সচেতনতা আর সে বিষয়ে সমাজকে আন্দোলিত করার কালাকাল। পরিবেশচর্চার শুরু ১৮৮৬ সালে আর্নেস্ট হেকেলের কাজের মধ্যে দিয়ে ধরা হয়। ১৯১৩ সালে এডুইন রে ল্যাঙ্কেস্টারের ‘The Effacement of Nature by Man’ প্রকাশের ঘটনা দেখায় একাজ চলছিল। তবে আন্দোলন হিসেবে পরিবেশ এল ১৯৬২ সালে রেচেল কার্সন-এর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। কৃষিজমিতে বিষ পিঁপড়ে মারতে আকাশ থেকে যথেচ্ছ ডি ডি টি প্রয়োগের কুফলের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ ছিল এই বই। এই বই প্রকাশের আগে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এই বইয়ের যা মূলসুর, অর্থাৎ মানুষ যে আমাদের বৃহত্তর প্রতিবেশের অঙ্গ, প্রকৃতিরই এক অংশ, আর প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে তুলেই যে মানবকুলকে আমরা রক্ষা করতে পারব, তার অজস্র পরিচয় রবীন্দ্রসাহিত্যে রয়েছে।
শ্যামলিনী বঙ্গদেশে বর্ষাগমের আকুতি কি প্রাণভরণ তা সকলের উপলব্ধিতেই আছে। গ্রামের ভেতরে সেই বর্ষা যখন মহাসমারোহে এসে উপস্থিত হয় তখন তা স্বভাবতই হয় প্রীতিপ্রদ। ‘অতিথি’ গল্প সেই বর্ষা আসার বর্ণনাতে কবির প্রকৃতি-অনুরাগ আর মানবিক আনন্দ এক অক্ষয় পারস্পরিক নির্ভরতার সেতুস্তম্ভ তৈরি করে।
“আকাশে নববর্ষার মেঘ উঠিল। গ্রামের নদী এতদিন শুষ্কপ্রায় ছিল, মাঝে মাঝে কেবল এক একটা ডোবায় জল বাধিয়া থাকিত; ছোটো ছোটো নৌকা সেই পঙ্কিল জলে ডোবানো ছিল এবং শুষ্ক নদীপথে গরুর গাড়ি চলাচলের সুগভীর চক্রচিহ্ন খোদিত হইতেছিল — এমন সময় একদিন পিতৃগৃহ-প্রত্যাগত পার্বতীর মতো, কোথা হইতে দ্রুতগামিনী জলধারা উচ্চৈস্বরে নৃত্য করিতে লাগিল। অতৃপ্ত আনন্দে বারম্বার জলে ঝাঁপ দিয়া দিয়া নদীকে যেন আলিঙ্গন করিয়া ধরিতে লাগিল। কুটিরবাসিনীরা তাহাদের পরিচিত প্রিয়সঙ্গিনীকে দেখিবার জন্য বাহির হইয়া আসিল — শুষ্ক নির্জীব গ্রামের মধ্যে কোথা হইতে এক প্রবল বিপুল প্রাণহিল্লোল আসিয়া প্রবেশ করিল।”[১৫]
প্রকৃতি প্রেমিক, প্রকৃতির রূপমাধুরীতে মুগ্ধ, তার আনাচে কানাচে কী আছে তা জানায় চরম কুতূহলী মানুষটিই রবীন্দ্রনাথ। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম প্রকৃতির এই উপাদানগুলো নিয়ে কাব্য রচিত হয় তাঁর কলমে। সে কলমে নীলমনিলতা থেকে কুরচি, আমবন-শাল-দেবদারু, চামেলিবিতান আর মধুমঞ্জরী মাথা তোলে। বনবাণীতে শোনায় বৃক্ষবন্দনা গান। তাঁর সংবেদনশীল মন তরুগুল্মলতার কথা উপলব্ধি করতে পারে। সৌন্দর্য আর সুরের পূজারি রবীন্দ্রনাথ সেই রূপছন্দে মাতেন। অবগাহন করেন সেই সুরে, সেই প্রাণসাগরে।
প্রকৃতির এই মহাসঙ্গীতের মর্ম হৃদয়ের তন্ত্রিতে তন্ত্রিতে গেঁথে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গেয়ে উঠেছিলেন “বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে”। অসীম কালের যে হিল্লোল তার চিত্তে দোলন দিয়েছিল তার সত্যকে চিনেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন, “আকাশ এবং কালকে পরিপূর্ণ করে অহোরাত্র সংগীত বেজে উঠেছে। বাতাসে যখন ঢেউয়ের সঙ্গে ঢেউ সুন্দর করে খেলিয়ে ওঠে তখন তাদের সেই আশ্চর্য মিলন এবং সৌন্দর্য আমাদের চোখ দেখতে পায় না, আমাদের কানের মধ্যে সেই লীলা গান হয়ে প্রকাশ পায়। ….এই প্রকাণ্ড বিপুল বিশ্ব-গানের বন্যা যখন সমস্ত আকাশ ছাপিয়ে আমাদের চিত্তের অভিমুখে ছুটে আসে তখন তাকে এক পথ দিয়ে গ্রহণ করতেই পারিনে, নানা দ্বার খুলে দিতে হয়। চোখ দিয়ে, কান দিয়ে, নাক দিয়ে, স্পর্শেন্দ্রিয় দিয়ে, নানা দিক দিয়ে তাকে নানা রকম করে নিই। এই ঐকতান মহাসংগীত কে আমরা দেখি, শুনি, ছুঁই, শুঁকি, আস্বাদন করি।”[১৬]
প্রকৃতি ও মানবের এই অবিচ্ছিন্ন আত্মীয়তা রবীন্দ্রমননের এক অন্তর্লীন সুর। এই সুর যেন কোথাও মিশে যায় মার্কসের মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক ভাবনার সঙ্গে। তাঁর ‘Paris Manuscripts’-এ মার্কস এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,
“The universality of man appears in practice precisely in the universality which makes all nature his inorganic body – both in as much as nature is (1) his direct means of life, and (2) the material, the object, and the instrument of his life activity. Nature is man’s inorganic body – nature, that is, in so far as it is not itself human body. Man lives on nature – means that nature is his body, with which he must remain in continuous interchange if he is not to die. That man’s physical and spiritual life is linked to nature means simply that nature is linked to itself, for man is a part of nature.”[১৭]
একই অনুভূতি তো রবীন্দ্রনাথেরও। সেই বোধ থেকেই তো গেয়ে ওঠেন —
“আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান
অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার-ভাঁটায় ভুবন দোলে
নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান।”[১৮]
বলেন, “জগৎ, তোমারে ছেড়ে পারিনে যেতে, মহা আকর্ষণে সবে বাঁধা আছি মোরা।”
ছয়
বিবর্তনের ধারণা স্পষ্ট ছিল রবীন্দ্রনাথের। কেমন করে ধীরে ধীরে তপ্ত আর পাষাণী পৃথিবী মাটির কন্যা হয়ে উঠল, তৃণ বল্কলে সাজাল নিজেকে, নিয়ে এল লতাগুল্ম বৃক্ষ আর ক্ষুদ্র কীটদল থেকে বিচিত্র প্রাণীকুল। তারপর এল মানুষ। কিন্তু তারপর? কী করল মানুষ? লিখেছেন তাও রবীন্দ্রনাথ,
“সৃষ্টির প্রথম পর্বে পৃথিবী ছিল পাষাণী, বন্ধ্যা, জীবের প্রতি তার করুণার কোন লক্ষণ সেদিন প্রকাশ পায় নি। চারি দিকে অগ্নি-উদগীরণ চলেছিল, পৃথিবী ছিল ভূমিকম্পে বিচলিত। এমন সময় কোন সুযোগে বনলক্ষ্মী তাঁর দূতীগুলিকে প্রেরণ করলেন পৃথিবীর এই অঙ্গনে, চারিদিকে তৃণশষ্পের অঞ্চল বিস্তীর্ণ হল, নগ্ন পৃথিবীর লজ্জা রক্ষা হল। ক্রমে ক্রমে এল তরুলতা প্রাণের আতিথ্য বহন করে। তখনো জীবের আগমন হয়নি; তরুলতা জীবের আতিথ্যের আয়োজনে প্রবৃত্ত হয়ে তার ক্ষুধার জন্য এনেছিল অন্ন, বাসের জন্য দিয়েছিল ছায়া। সকলের চেয়ে তার বড় দান অগ্নি; সূর্যতেজ থেকে অরণ্য অগ্নিকে বহন করেছে, তাকে দান করেছে মানুষের ব্যবহারে। আজও সভ্যতা অগ্নি কে নিয়েই অগ্রসর হয়ে চলেছে।
মানুষ অমিতাচারী যতদিন সে অরণ্যচর ছিল ততদিন অরণ্যের সঙ্গে পরিপূর্ণ ছিল তার আদানপ্রদান; ক্রমে সে যখন নগরবাসী হল তখন অরণ্যের প্রতি মমত্ববোধ সে হারালো; যে তার প্রথম সুহৃদ, দেবতার আতিথ্য যে তাকে প্রথম বহন করে এনে দিয়েছিল, সেই তরুলতা কে নির্মমভাবে নির্বিচারে আক্রমণ করলে ইট-কাঠের বাসস্থান তৈরি করবার জন্য। আশীর্বাদ নিয়ে এসেছিলেন যে শ্যামলা বনলক্ষ্মী তাকে অবহেলা করে মানুষ অভিসম্পাত বিস্তার করলে।
এ সমস্যা আজ শুধু এখানে নয়, মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্যসম্পদকে রক্ষা করা সর্বত্রই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।….. আজ অনুতাপ করবার সময় হয়েছে আমাদের যা সামান্য শক্তি আছে তাই দিয়ে আমাদের প্রতিবেশে মানুষের কল্যাণকারী বনদেবতার বেদী নির্মাণ করব এই পণ আমরা নিয়েছি।… ধরনীর প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য, তার ক্ষতবেদনা নিবারণ করবার জন্য আমাদের বৃক্ষরোপণের এই আয়োজন। কামনা করি, এই অনুষ্ঠানের ফলে চারিদিকে তরুচ্ছায়া বিস্তীর্ণ হোক, ফলে শস্যে এই প্রতিবেশ শোভিত আনন্দিত হোক।”[১৯]
সূর্য থেকে বৃক্ষ থেকে মানবে বহমান জীবন ও শক্তি স্রোতের বর্ণনাও বৈজ্ঞানিক সত্যতা সহ এভাবেই উঠে এসেছে রবীন্দ্র কলমে। এমনকি নক্ষত্র চক্রবর্তী সূর্য ও তার গ্রহদের পাক খেয়ে চলার গতির কথাও। সেই প্রকৃতিকে অবহেলা আর তার ওপর যথেচ্ছ আক্রমণ পরিবেশে অভিসম্পাত বয়ে আনে বলে অনুভব করছেন রবীন্দ্রনাথ। তার সেই অনুভবের সঙ্গে কোথাও কি কোনো সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায় এঙ্গেলসের প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব করার মনোবাঞ্ছা থেকে ঘটে যাওয়া ক্ষতির? প্রিয় পাঠক, চলুন দেখে নিই।
বিবর্তনের এই গতিধারা এবং প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপের ফলাফল ‘বানর থেকে মানুষে উত্তরণে শ্রমের ভূমিকা’ নিবন্ধে স্পষ্ট করেছেন ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস। লিখেছেন,
“আমাদের পূর্বপুরুষেরা য়ূথবদ্ধ হয়ে থাকত। প্রাণীদের মধ্যে সবচাইতে সামাজিক যে প্রাণী, সেই মানুষের উৎপত্তি কোনও যূথ-বিমুখ পূর্ব পুরুষদের মধ্যে অনুসন্ধান করা স্বভাবতই অবাস্তব। হাতের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, শ্রমের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির উপরে যে প্রভুত্ব শুরু হল তার প্রতিটি নতুন অগ্রগতিতেই মানুষের দিগন্তরেখাকে প্রসারিত করে দিল।” সেইসঙ্গে এঙ্গেলসের সতর্কবার্তা, “প্রকৃতির উপর মানুষের এই জয়লাভে আমরা যেন খুব বেশি আত্মপ্রসাদ লাভ না করি। কারণ ঐরকম প্রতিটি জয়লাভের জন্যই প্রকৃতি আমাদের উপর প্রতিহিংসা গ্রহণ করে। একথা সত্য যে প্রত্যেকটি জয়ের ফলাফল সর্বাগ্রে আমাদেরই ধারণানুসারী। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্ষেত্রে এর ফলাফল হয় সম্পূর্ণ পৃথক এবং অভাবিতপূর্ব, আর প্রায়ই তা প্রথম কে ব্যর্থ করে দেয়। মেসোপটেমিয়া এশিয়া মাইনর এবং অন্যান্য জায়গায় যে মানুষ কৃষি উপযোগী জমি পাবার জন্য অরণ্যকে নির্মূল করে দিয়েছিল, তারা স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবতে পারেনি যে, অরণ্যের সঙ্গে সঙ্গে এইভাবে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ ও ধারণ করার কেন্দ্রগুলিও নিঃশেষিত করে তারা এই দেশগুলির বর্তমান বিধ্বস্ত অবস্থায় ভিত্তি স্থাপন করে যাচ্ছিল। উত্তরের ঢালু জমিতে যে পাইন অরণ্যগুলিকে এত যত্নে রক্ষা করা হয়েছে, আল্পসের ইতালীয়রা যখন দক্ষিণ ঢালুতে সেই পাইন অরণ্যগুলিকেই নিঃশেষ করে ফেলল, তখন তাদের একটুও ধারণা ছিল না যে তারা এই ভাবে তাদের পার্বত্য পশুপালনের মূলেই কুঠারাঘাত করছে; এতো করে যে তারা বছরের বেশিরভাগ সমযের জন্য তাদের পার্বত্য ঝোরাগুলির জল অপহরণ করছে ও বর্ষাকালের সময় সমতলভূমিতে তাদের আরও উন্মত্ত জলস্রোত সম্ভব করে তুলছে, এ ধারণা তাদের ছিল আরও কম। ইউরোপে যারা আলু ছড়িয়েছিল তাদের মনেও আসেনি যে, শ্বেতসার জাতীয় এই আলুর সঙ্গে সঙ্গে তারা গ্রন্থিস্ফীতি (scrofula) রোগের বীজাণুও ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে এইভাবে আমাদের স্মরণ রাখতে হয় যে, বিজেতা যেমন বিজিত জাতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে, আমরা কোনো অর্থেই সেভাবে প্রকৃতির বাইরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করি না। বরং রক্ত, মাংস আর মস্তিষ্ক নিয়ে আমরা প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত, প্রকৃতির মধ্যে আমাদের অস্তিত্ব।”[২০]
রবীন্দ্রভাষ্যে যা “এই সমস্তের সঙ্গে আমাদের নাড়ির রক্ত চলাচলের যোগাযোগ” এঙ্গেলসে তা “রক্ত, মাংস আর মস্তিষ্ক নিয়ে আমরা প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত, প্রকৃতির মধ্যে আমাদের অস্তিত্ব”। ভাষা আলাদা, কিন্তু বক্তব্য কি ভীষণ রকম এক!
সাত
“ওরে পলাশ, ওরে পলাশ
রাঙা রঙের শিখায় শিখায়
দিকে দিকে আগুন জ্বলাস
আমার মনের রাগরাগিনী
রাঙা হলো রঙিন তানে
দখিন হাওয়ায় কুসুমবনের
বুকের কাঁপন থামে না যে।
নীল আকাশে সোনার আলোয়
কচি পাতার নূপুর বাজে।
ওরে শিরীষ, ওরে শিরীষ,
মৃদু হাসির অন্তরালে
গন্ধজালে শূন্য ঘিরিস।
তোমার কন্ঠ আমার কন্ঠে
আমার হৃদয় টেনে আনে।।”[২১]
এটি ‘ফাল্গুনী’ নাটকে ‘পাখির নীড়ের গান’। ‘বেণুবন এর গান’ ‘ফুলন্ত গাছের গানে’-র সঙ্গে এই গানের তালে হৃদয় মিলিয়ে নাটকের সূচনা। সারা নাটক জুড়ে চলে যৌবনের কলধ্বনি। খ্যাপামির নেশায় মেতে ওঠার মন্ত্রোচ্চারণ। অযাত্রাতে নৌকা ভাসিয়ে প্রকৃতির মাঝে অনিশ্চিত ভেসে চলাতেই মেলে জাদুভেরির আলোকধ্বনি। প্রকৃতি আর মানবহৃদয়ের সুর তাল একসাথে মিলে যায়। নতুন করে হারিয়ে পাওয়ার মাঝে চিরন্তন যৌবনের গতিময় জয়গাথা লেখা হয় নবীন প্রাণের বসন্তে। প্রকৃতির সাথে এই একাত্মতা আর প্রকৃতির ও জীবনের এই গতিময়তার মেলবন্ধন রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ চিন্তার এক অন্যতম দিক।
‘রক্তকরবী’ নাটকে রাজা মকররাজর যক্ষপুরীতে চলে ‘মরা ধনের শবসাধনা’। খোদাইকারের দল পৃথিবীর বুক চিরে ‘দরকারের বোঝা মাথায় কীটের মতো’ সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে উপরে উঠে আসে। মাটির নীচ থেকে শ্রমিকরা তোলে সোনা। সেই সোনার শক্তির লোভ মকররাজকে করে তুলেছে প্রকৃতি ও প্রাণ বিমুখ, দুর্বল আর মানবিক গুণহারা। ধনবাদী সভ্যতার প্রতীক যেন এই যক্ষপুরী। নন্দিনী সেখানে রাজাকে বলে, “সোনার পিণ্ড কি তোমার হাতের আশ্চর্য ছন্দে সাড়া দেয় যেমন সাড়া দিতে পারে ধানের খেত?” তাকে বলে, “পৃথিবী আপনার প্রাণের জিনিস আপনি খুশি হয়ে দেয়। কিন্তু যখন তার বুক চিরে মরা হাড় গুলোকে ঐশ্বর্য বলে ছিনিয়ে নিয়ে আস তখন অন্ধকার থেকে একটা কানা রাক্ষসের অভিসম্পাত নিয়ে আস।”
রাজার লোভের আগুনে পুড়ে প্রতিদিন মরে তারই সোনার খনির শ্রমিকরা। মাটির নীচের সোনার সঙ্গে রোদের সোনার বিপ্রতীপ লড়াইয়ের সুর বাধা হয় সেখানে। যক্ষপুরীর নিষ্প্রাণ প্রতিবেশে সে সুর ছড়ায় —
“…হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে
দিগবধূরা ধানের খেতে
রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে —
মরি, হায় হায় হায়।
মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল —
ঘরেতে আজকে রবে গো। খোলো দুয়ার খোলো।”[২২]
মকররাজ ও সর্দারদের লোভের সোনার প্রতিস্পর্ধী হয়ে সেখানকার প্রকৃতির বুকে অলক্ষ্যে বেড়ে একটিমাত্র রক্তকরবী গাছের ফুলের মতো নন্দিনীও যক্ষপুরীর মানুষের মনে জাগিয়ে তুলতে চায় মানবিকতার ও মনুষ্যত্বের ফুল। তার ভালোবাসার শক্তিতে রং ধরে কিশোর, অধ্যাপক আর ফাগুলালের মনে। গানের টানে সে রং ছুঁয়ে যায় রাজার মনও। নন্দিনী এখানে যেন ecofeminist। মাতৃরূপে ধরিত্রীর ধাত্রী।
“…women in various movements — ecology, peace, feminist … rediscovered the interdependence and connectedness of everything, … sometimes called spirituality … The ecological relevance of this emphasis on ‘spirituality’ lies in the rediscovery of the sacredness of life, according to which life on earth can be preserved only if people again begin to perceive all life forms as sacred — and respect them as such.”[২৩]
‘রক্তকরবী’-র বিবেকী অধ্যাপক নন্দিনীকে পরামর্শ দেন “যেখানকার লোকে দস্যুবৃত্তি করে মা বসুন্ধরার আঁচলকে টুকরো টুকরো করে ছেঁড়ে না সেইখানে রঞ্জন কে নিয়ে সুখে থাক গে।” কারণ অধ্যাপক জানেন নন্দিনী ‘ধুলোর সোনা’ নয়, ‘আলোর সোনা’। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের নামে প্রকৃতি ধ্বংসের এই স্বরূপ অনেক আগেই উপলব্ধিতে এসেছিল রবীন্দ্রনাথের। নাটকের শেষে ধনবাদী সভ্যতার প্রতীকী ধ্বজা দণ্ড ভেঙে, কেতন ছিঁড়ে, মকররাজের প্রকৃতির কাছে, প্রাণের কাছে ফিরে আসার আত্মোপলব্ধি হয়েছে দেখতে পাই। তাই আজ সর্দারের বাহিনীর হাতে নিহত নন্দিনীর মতো তারও প্রাণ দিতে পিছুটান নেই।
যন্ত্র শক্তির উদ্দাম অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের আর একটি বলিষ্ঠ প্রতিবাদ তার ‘মুক্তধারা’ নাটক। সেখানে যন্ত্ররাজ বিভূতিকে দেখি উত্তরকূটের বাঁধ দিয়ে মুক্তধারা ঝরনার জলধারাকে বেঁধে ফেলে যুগপৎ প্রযুক্তির কেরামতি ও প্রগতির ঊর্দ্ধনিশান উড়ানোর অহংকার দেখতে। সেই বাঁধ বাঁধতে গিয়ে জনাই গাঁয়ের অম্বার মতো বহু মায়ের কোলের সুমনরা প্রাণ দেয়। প্রকৃতির উপরে যন্ত্রের এই বাইরে থেকে করা প্রভুত্ব অসহনীয় হয়ে ওঠে। প্রকৃতির অঙ্গীভূত না হয়ে, প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা না নিয়ে, চাপিয়ে দেওয়া এই প্রযুক্তির ফলে শিবতরাইয়ের প্রজাদের চাষের মাঠ জলের অভাবে শুকিয়ে যায়। তাদের মাঠের ফসল ও ক্ষুধার অন্নের সমস্যা তৈরি হয়। সেখানে তখন প্রকৃতির দূত হয়ে আসেন উত্তরকূটের যুবরাজ অভিজিতের দূত। বিভূতির যন্ত্রের অহংকারের প্রতিস্পর্ধী অভিজিৎ প্রেম-প্রকৃতি-প্রাণ ও ভালোবাসার ঐশ্বর্যে বলীয়ান। নিজের জীবন দিয়ে তৃষ্ণা-র জলকে যন্ত্রের বাঁধন মুক্ত করে সে। বিভূতি ও যুবরাজের দূতের কথোপকথনটি এখানে চমৎকার।
“দূত — যন্ত্ররাজ বিভূতি, যুবরাজ আমাকে পাঠিয়ে দিলেন।
বিভূতি — কী তাঁর আদেশ?
দূত — এতকাল ধরে তুমি আমাদের মুক্তধারার ঝরনাকে বাঁধ দিয়ে বাঁধতে লেগেছ। বার বার ভেঙে গেল। কত লোক ধুলোবালি চাপা পড়ল, কত লোক বন্যায় ভেসে গেল। আজ শেষে —
বিভূতি — তাদের প্রাণ দেওয়া ব্যর্থ হয় নি। আমার বাঁধ সম্পূর্ণ হয়েছে।
দূত — শিবতরাইয়ের প্রজারা এখন এ খবর জানে না। তারা বিশ্বাস করতেই পারে না যে, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন কোন মানুষ তা বন্ধ করতে পারে।
বিভূতি — দেবতা তাদের কেবল জলই দিয়েছেন, আমাকে দিয়েছেন জলকে বাঁধবার শক্তি।
দূত — তারা নিশ্চিন্ত আছে, জানে না আর সপ্তাহ পরেই তাদের চাষের খেত —
বিভূতি — চাষের খেতের কথা কি বলছ?
দূত — সেই খেত শুকিয়ে মারাই কি তোমার বাঁধ বাঁধার উদ্দেশ্য ছিল না?
বিভূতি — বালি-পাথর-জলের ষড়যন্ত্র ভেদ করে মানুষের বুদ্ধি হবে জয়ী, এই ছিল উদ্দেশ্য। কোন চাষীর কোন ভুট্টার খেত মারা যাবে সে কথা ভাববার সময় ছিল না।….”[২৪]
যুবরাজ অভিজিৎ এর কাছে উত্তরকূটের সিংহাসনই তার জীবনস্রোতের বাঁধ। সে পথ খুলে সে যেমন জীবনস্রোতে ভেসে যেতে চায়, তেমনি “ধরনীর সংগীত রোধ করে দিয়ে আকাশে লোহার দাঁত মেলে অট্টহাস্য করছে” যে যন্ত্র সেই দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করে ‘স্বর্গের’ পথ খুলে দিতে চায়। তাই তো দাদামশাই বিশ্বজিতের মোহনগড়ে যাওয়ার আহ্বান ফিরিয়ে দিয়ে বলে তার ‘অবকাশ’ নেই।
“বিশ্বজিৎ — কেন ভাই কী তোমার কাজ?
অভিজিৎ — জন্মকালের ঋণ শোধ করতে হবে। স্রোতের পথ আমার ধাত্রী, তার বন্ধন মোচন করবো।”[২৫]
সেই বাঁধতৈরির ত্রুটি খুঁজে ভাঙার কাজ করতে গিয়েই মুক্তধারার স্রোতে ভেসে যায় অভিজিৎ। তৃষ্ণা রাক্ষসীকে প্রতিষ্ঠার আয়োজন ব্যর্থ করে দিয়ে যায় সে, কিন্তু মুক্ত করে মাতৃরূপা মুক্তধারাকে। আর রবীন্দ্রনাথ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, আমাদের প্রতিটি খাণ্ডবদহনে এক একটি ইন্দ্রপ্রস্থ গড়ে তোলাতেই থেকে যায় অন্তর্নিহিত ত্রুটি। সে ত্রুটি ততটুকুই ভালো যতটা প্রকৃতি নিজে মেরামত করে নিতে পারে। অন্যথায় ঘটে পরিবেশ বিপর্যয়! আর সেই ত্রুটি ধরেই আসে ভাঙন।
আট
রবীন্দ্রনাথের ‘বলাই’ গল্পে বলাই ছেলেটির প্রকৃতিতে গাছপালা ও তার প্রতিবেশের মূল সুরগুলোই প্রধান হয়ে উঠেছে। তার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার বন্ধন। আকাশে কালো মেঘ জমার সাথে সাথে ওর মনেও যেন ভিজে হাওয়ার গন্ধ ঘনিয়ে ওঠে। বৃষ্টি এলে সারা শরীর দিয়ে ও যেন শুনতে পায় বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দ। পড়ন্ত রোদ্দুর মাখা আকাশ থেকে, মাঘের শেষের আমের বোল থেকে, ফাল্গুনের পুষ্পিত শালবন থেকে আনন্দ নিয়ে অন্তর রাঙ্গিয়ে তোলে বলাই। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ বলাইয়ের অনুভূতিটুকু তুলে ধরতে ছোট্ট একটা ঘটনার আশ্রয় নেন। সে ঘটনায় আমরা শুনি —
“ওকে একবার পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিলুম। আমাদের বাড়ীর সামনে ঘন সবুজ ঘাস পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে পর্যন্ত নেবে গিয়েছে, সেইটে দেখে আর ওর মন ভারি খুশি হয়ে ওঠে। ঘাসের আস্তরণটা একটা স্থির পদার্থ তা ওর মনে হয় না; ওর বোধ হয়, যেন ওই ঘাসের পুঞ্জ একটা গড়িয়ে-চলা খেলা, কেবলই গড়াচ্ছে। প্রায়ই তারই সেই ঢালু বেয়ে ও নিজেও গড়াত — সমস্ত দেহ দিয়ে ঘাস হয়ে উঠত — গড়াতে গড়াতেই ঘাসের আগায় ওর ঘাড়ের কাছে সুড়সুড়ি লাগতো আর ও খিলখিল করে হেসে উঠত।”[২৬]
বলাই চরিত্রের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের অনুভব কোথায় যেন কিটসের ‘To Autumn’ কবিতাটির অনুভবে। প্রকৃতির আশ্চর্য রূপবদল ঘিরে সেখানেও কবির বিপুল বিস্ময়!
“...To bend with apples the moss'd cottage-trees,
And fill all fruit with ripeness to the core;
To swell the gourd, and plump the hazel shells
With a sweet kernel; to set budding more,
And still more, later flowers for the bees,
Until they think warm days will never cease,..”
বলাই-এর প্রকৃতিবোধ শুধু নিজের গাছপালাকে ভালোবাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অন্যের প্রকৃতি-পীড়ন তাকেও পীড়া দেয়। প্রকৃতিকে আত্মার আত্মীয় করে না তুললে এ অনুভূতি অসম্ভব। তাইতো দেখি —
“কেউ গাছের ফুল তোলে এইটে ওর বড় বাজে। আর-কারও কাছে ওর এই সংকোচের কোনো মানে নেই, এটাও সে বুঝেছে। এইজন্য ব্যথাটা লুকোতে চেষ্টা করে। ওর বয়সের ছেলেগুলো গাছে ঢিল মেরে মেরে আমলকি পাড়ে; ও কিছু বলতে পারে না, সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। ওর সঙ্গীরা ওকে খ্যাপাবার জন্য বাগানের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে ছড়ি দিয়ে দু’পাশের গাছগুলোকে মারতে মারতে চলে, ফস ক’রে বকুল গাছের একটা ডাল ভেঙে নেয় — ওর কাঁদতে লজ্জা করে, পাছে সেটাকে কেউ পাগলামি মনে করে। ওর সবচেয়ে বিপদের দিন, যেদিন ঘাসিয়াড়া ঘাস কাটতে আসে। কেননা ঘাসের ভিতরে ভিতরে ও প্রত্যহ দেখে দেখে বেড়িয়েছে এতটুকু-টুকু লতা, বেগনি হলদে নামহারা ফুল, অতি ছোট ছোট; মাঝে মাঝে কন্টিকারি গাছ, তার নীল নীল ফুলের বুকের মাঝখানটিতে ছোট্ট একটুখানি সোনার ফোঁটা; বেড়ার কাছে কাছে কোথাও বা কালমেঘের লতা, কোথাও বা অনন্তমূল; পাখিতে খাওয়া নিম ফলের বিচি প’ড়ে প’ড়ে ছোটো ছোটো চারা বেরিয়েছে, কি সুন্দর তার পাতা — সমস্তই নিষ্ঠুর নিড়নি দিয়ে দিয়ে নিড়িয়ে ফেলা হয়। তারা বাগানের শৌখিন গাছ নয়, তাদের নালিশ শোনবার কেউ নেই।”[২৭]
বলাই-এর ব্যথা সবার মধ্যে চারায় না। তা ওর একার হয়ে থাকে। তাই রাস্তার মাঝের শিমুলচারাকে মূল সমেত উপড়ে ফেলার কথায় তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। কাকির সাহায্য নিয়ে যে গাছ সে বাঁচালো তা বলাইয়ের অবর্তমানে কবে যে কাকির কাছে বলাইয়ের প্রতিরূপ হয়ে উঠলো তা কেউ বোঝেনি। যে শিমুল গাছটির সঙ্গে বলাইয়ের সখ্য ছিল তার ছবি চেয়ে পাঠালো বলাই দূরে পাড়ি দেওয়ার সময়। প্রিয় বন্ধুর ছবি সঙ্গে রাখবে। কিন্তু ততদিনে গাছটি কেটে ফেলায় তা তাকে দেওয়া গেল না। গাছ কাটার বিষয়টি কাকিকেও গোপন রাখা হয়েছিল। ওই শোক কাকির বুকে তীব্র বেদনা নিয়ে এলো। কারণ গাছটির মধ্য দিয়েই যে কাকির পাশে ছিল তাঁর বলাই। গাছের মধ্যে এভাবে মানবীয়তা আরোপ রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কে করেছেন জানি না!
গণচিনের কবি Lim Boon King ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে প্রকৃতির সঙ্গে হৃদয়ের অন্তরমিলনকে চমৎকার ধরেছেন ক’টি লাইনে। বলেছেন —
“His soul seems at once to vibrate in full harmony with the orchestra of melodies and echoes reflected from the sound of rushing waters, from the songs of birds, from the rustling of leaves..”
নয়
ঘর আর বাহিরের, গতিময়তা আর স্থবিরতার, প্ৰাকৃতিকতা ও কৃত্রিমতার দ্বন্দ্ব রবীন্দ্রনাথ অপূর্বভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ‘দুই পাখি’ কবিতাটিতে। খাঁচার পাখি আর বনের পাখির ‘চঞ্চুতে চঞ্চুতে পরিচয়’-পিপাসা এখানে যেমন দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় তাদের মিলন পথে হরেক প্রতিবন্ধকতা। মিলন-বিরহের এই দ্বন্দ্ব কবিতাটিতে এক চিরায়ত মাত্রা যোগ করেছে। বিপুলা এ প্রকৃতির অনন্ত আকাশের উদার আহ্বান, প্রসারিত ডানায় সে ডাকে সাড়া দেওয়া, বিচিত্র নতুন নতুন সুরে জীবনের পাতা সাজিয়ে তোলা, বনের পাখির গতিময় জীবনের দর্শন। আর খাঁচার পাখি প্রত্যহিকতার নিয়মের শিকলে অসহায়, গতিহীন, দুর্বল ও আড়ষ্ট। সুখ সাজাতে গিয়ে আমরা প্রতিদিন যেভাবে প্রকৃতিকে রিক্ত করে কৃত্রিম যন্ত্র প্রসাধন ও সংস্কৃতির কাছে নিজেদের বন্দি করে ফেলছি, তার বিরুদ্ধে অমোঘ উচ্চারণ রয়েছে এই কবিতায়।
“বনের পাখি বলে, ‘আকাশ ঘননীল
কোথাও বাধা নাহি তার’
খাঁচার পাখি বলে — ‘খাঁচাটি পরিপাটি
কেমন ঢাকা চারি ধার’
বনের পাখি বলে, ‘আপনা ছাড়ি দাও
মেঘের মাঝে একেবারে’
খাঁচার পাখি বলে, ‘নিরালা সুখকোণে
বাঁধিয়া রাখো আপনারে।’”[২৮]
এই গতিময়তাতেই ‘নদী আপন বেগে পাগলপারা’। এখানেই ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’। ঋতুবৈচিত্র্যে, ‘অযাত্রাতে যাত্রা শুরু-র আগ্রহেও সে ছবি।
টেনিসন তাঁর ‘The Eagle’ কবিতায় বাহিরের পাখি ইগলের এই তীক্ষ্ণতা, ক্ষিপ্রতা আর দুর্দমনীয় গতির এক মনোজ্ঞ ছবি এঁকেছেন।
“He clasps the crag with crooked hands;
Close to the sun in lonely lands,
Ring'd with the azure world, he stands.
The wrinkled sea beneath him crawls;
He watches from his mountain walls,
And like a thunderbolt he falls.”
গতিময় আর চির পরিবর্তনশীল প্রকৃতির এই ছবি একইভাবে মূর্ত রবার্ট ফ্রস্টের ‘Nothing gold can stay’ কবিতায়। ছোট্ট কবিতাটির নিহিত গভীরতায় ধরা পড়ে প্রকৃতির পরিবর্তনশীলতার এক চিরায়ত সত্য।
“Nature’s first green is gold,
Her hardest hue to hold.
Her early leaf’s a flower;
But only for an hour.
Then leaf subsides to leaf.
So Eden sank to grief,
So dawn goes down to day.
Nothing gold can stay.”
দশ
খণ্ডিত জগৎ নয় অন্বিত বিশ্বের holism রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি ভাবনার দর্শন ছিল। ‘বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহার’। ‘এই পৃথিবীর যাহা সম্বল, বাসে ভরা ফুল রসে ভরা ফল’… তার পুণ্যতা বিশুদ্ধতা কামনা করেন তিনি। ইকোসেন্ট্রিসম যেমন তাঁর নেই তেমনি মানবতাবাদী হয়েও নেই আনথ্রোপোসেট্রিসম। বরং তাঁর কাছে আলো হওয়া জল মাটি তরুলতা ফুল কীট পতঙ্গ প্রাণীকুল, জ্যোতিষ্কসকল, আর মানব এই সবের সম্মিলিত রূপই প্রকৃতি। এই ‘জীবনে জীবন যোগ’ করায় পাওয়া পূর্ণতা ও সমগ্রতার এক ছবি তাঁর ‘সাধনা’ গ্রন্থেও এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। উৎসর্গ কবিতায় একই সুরে লিখেছেন :
“হই যদি মাটি হই যদি জল
হই যদি তৃণ, ফুল, ফল
জীব সাথে যদি ফিরি ধরাতল
কিছুতেই নাই ভাবনা।
যেথা যাব সেথা অসীম বাঁধনে
অন্তবিহীন আপনা।।”[২৯]
বলেছেন —
“বিশাল বিশ্বে চারিদিক হতে প্রতিকণা মোরে টানিছে।
আমার দুয়ারে নিখিল জগৎ শতকোটি কর হানিছে।
ওরে মাটি, তুই আমারে কি চাস?
মোড় তরে, জল, দুহাত বাড়াস?
নিঃশ্বাসে বুকে পশিয়া বাতাস চির-আহ্বান আনিছে”[৩০]
এই অখণ্ড বিশ্বসত্তার প্রকাশে সনিষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ ‘তপোবন’ প্রবন্ধে স্পষ্ট লেখেন :
“সমগ্রের সামঞ্জস্য নষ্ট করে প্রবলতা নিজেকে স্বতন্ত্র করে দেখায় বলেই তাকে বড়ো মনে হয়, কিন্তু আসলে সে ক্ষুদ্র।”
সজীব আর অজীব, মানুষী আর না-মানুষী সমগ্রতার সন্নিবেশ ঘটে যেখানে সেই পরিবেশের একজন হয়ে বিরাজ করেন রবীন্দ্রনাথ। বিরাজ করি আমরা মানুষরাও। সেই পরিবেশের এক অচ্ছেদ্য আর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে। এমন ভাবনা পরিবেশ ছাড়িয়ে প্রতিবেশে এসে খাপ খায়। জল, হাওয়া, মাটি, গাছ, প্রাণীর প্রকৃতিতে মানুষের উপস্থিতি তাকে যে পারিপার্শ্বিকে বদলে নিয়ে যায় তাই হল প্রতিবেশ। বাস্তুবিদ্যা বা ecology হল গ্রিক ‘ঐকোস’ অর্থাৎ ‘বাড়ি’ এবং ‘লোগোস’ অর্থাৎ ‘বাণী’র সম্মিলিত রূপ। অর্থাৎ ইকোলজির অর্থ দাঁড়াল ‘আবাস বানী’। প্রতিবেশে প্রত্যেকের আবাস আলাদা আলাদা। কিন্তু মানুষ ও অন্য সকলে মিলেমিশে বাঁচলে তবেই সার্থক পরিবেশ সংগীত বেজে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় এই সমন্বয়ী ভাবনা স্পষ্ট ছিল।
এ ভাবনা কোথায় যেন মার্কসের ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। যেখানে তিনি বলেন :
“Even an entire society, a nation, or all simultaneously existing societies taken together, are not owners of the earth. They are simply its possessors, its beneficiaries, and have to bequeath it in an improved state to succeeding generations as boni patres familias [good heads of the household].”[৩১]
এগারো
মানুষ প্রকৃতির উপর পূর্ণ নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক উপাদানের উপর শ্রমকে ধাপে ধাপে কাজে লাগিয়ে সে তৈরি করে নানান জিনিস। বনের গাছ প্রাকৃতিক উপাদান। ডাঙ্গা জমিতে লাগানো গাছের ক্ষেত্রে মাটি, জল, হাওয়া হল প্রাকৃতিক উপাদান। মানুষের শ্রম দিয়ে তার পরিচর্যা হয়, ফলে গাছ বড়ো হয়। বনের বা লাগানো গাছের উপর শ্রম প্রয়োগ করে তক্তা পাই। তক্তা একটি জিনিস। তার উপর আরও শ্রম প্রয়োগ করে আমরা অন্য জিনিস যেমন চেয়ার-টেবিল-আলনা ইত্যাদি পণ্য পাই। পণ্য হল সেই জিনিস যা মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারে। একইভাবে মাটি চষে তুলোর বীজ বুনে, গাছের পরিচর্যা করে তুলো গাছ থেকে পাওয়া যাবে তুলো। তুলোর উপর শ্রম প্রয়োগে পাওয়া যাবে নতুন জিনিস সুতো। সুতোর উপর আরও শ্রম লাগিয়ে পাব গামছা বা কাপড়ের মতো পণ্য। প্রাকৃতিক উপাদান ছাড়া কোনো পণ্য হয়না। পণ্য তৈরির সময় উপজাত বর্জ্যও তৈরি হয়। আর হয় প্রাকৃতিক উপাদানের ক্ষয়। অনিয়ন্ত্রিত সেই ক্ষয় আর অপর্যাপ্ত বর্জ্যের বোঝা থেকেই বিপর্যয় নেমে আসে প্রকৃতিতে, পরিবেশে। পণ্য সম্পর্কে এই ব্যাখ্যা দিয়ে ক্যাপিটালে কার্ল মার্কস লিখেছিলেন —
“পুঁজিবাদী উৎপাদন জনসংখ্যাকে কতকগুলি বৃহৎ কেন্দ্রে একত্র করে এবং শহরবাসী জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান প্রাধান্য সংগঠিত করে একদিকে সমাজের ঐতিহাসিক চালিকাশক্তি কেন্দ্রীভূত করে, অপরদিকে মানুষ ও মাটির মধ্যে বস্তুর সঞ্চলনকে সে ব্যাহত করে, অর্থাৎ মানুষ মাটির যেসব উপাদান খাদ্য ও পরিধেয় রূপে গ্রাস করে, সেগুলি আবার মাটিতে ফিরিয়ে দেওয়ার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে; সুতরাং জমির স্থায়ী উর্বরতার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী লঙ্ঘন করে। এই কাজের দ্বারা তা একই সঙ্গে শহরের শ্রমিকের স্বাস্থ্য এবং গ্রামীণ শ্রমিকের বুদ্ধিগত জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু সেই বস্তু সঞ্চালন প্রক্রিয়া রক্ষণের স্বাভাবিক শর্তগুলিকে ওলটপালট করার মধ্য দিয়েই সে সেই প্রক্রিয়াকে একটা সুসংবদ্ধ ব্যবস্থা হিসেবে, সামাজিক উৎপাদনের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে, এবং মানবজাতির পূর্ণ বিকাশ এর উপযোগী রূপে তার পুনঃসংস্থাপনের জন্য গর্বিত প্রভুসুলভ দাবি জানায়।”[৩২]
প্রকৃতি বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে লিবিগ আধুনিক কৃষির এই নেতিবাচক তথা ধ্বংসাত্মক দিকটি তুলে ধরেছিলেন তার বইতে। অথচ রিকার্ডোর তত্ত্বে এর উলটো কথা ছিল। মার্কস সেকথা এঙ্গেলসকে ১৮৫১ সালের ১৭ জানুয়ারির চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন —
“…The law of rent, as laid down by Ricardo in its simplest form, apart from its elaboration, does not assume the diminishing fertility of the soil”.
শস্য উৎপাদনের ফলে মাটির পুষ্টির বিষয়টি পুঁজিবাদী কৃষির কাছে বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৩৭ সালে ‘ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দি এডভান্সমেন্ট অফ সাইন্স’ এই বিষয়টিতে আলোকপাত করার জন্য জার্মান রসায়নবিদ জাস্টাস ভন লিবিগকে অনুরোধ করেন। তিনি বিষয়টি অনুসন্ধান করে তার ‘Organic Chemistry in its application to agriculture and physiology’ বইতে ১৮৪০ সালে বলেন, কৃষির ফলে মাটিতে নাইট্রোজেন ফসফরাস ও পটাশ এর অভাব ঘটে যায়, কারণ এগুলি গাছের বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয়। মাটির স্বাস্থ্য কৃষকের শ্রম এইসবের বিনিময়ে হয় উৎপাদন। সামাজিক ক্ষেত্রে এই সমস্যাটির যথাযথ মূল্যায়ন করেন কার্ল মার্কস। তিনি বলেন পুঁজিবাদী উৎপাদন মানুষ ও মাটির বিপাকীয় ক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, — এর মধ্য দিয়ে মুখ্য মূল্যবান সম্পদ শ্রমিক ও মাটির পুষ্টি দুই-ই হারায়। মার্কসের ভাষ্য —
“Capitalist production…disturbs the metabolic interaction between man and the earth, i.e. it prevents the return to the soil of its constituent elements consumed by man in the form of food and clothing; hence it hinders the operation of the eternal natural condition for the fertility of the soil….All progress in capitalist agriculture is a progress in the art, not only of robbing the worker, but of robbing the soil; all progress in increasing the fertility of the soil for a given time is a progress towards ruining the more long-lasting sources of that fertility…Capitalist production, therefore, only develops the techniques and degree of combination of the social process of production by simultaneously undermining the original sources of all wealth — the soil and the worker.”[৩৩]
এই বিষয় নিয়ে একসময় গোটা বিশ্ব আলোড়িত হয়েছিল। সত্যিই তো, যদি কৃষি মাটির পুষ্টি তুলে নেয় তবে একই জমিতে পুনঃ পুনঃ কৃষির কী হবে? কী হবে খাদ্যশস্যের? কী হবে মানব সভ্যতার? প্রশ্নটি সমাজবিজ্ঞানীদের তালে তাল মিলিয়ে ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার অভিভাষণ পড়লে আমরা বুঝতে পারব এ যেন ভিন্ন ভাবে মার্কসের কথাই শুনছি। রবীন্দ্রনাথ যে জীবনের চক্রগুলোর কথাও জানতেন, জানতেন সেই চক্রগতি রূদ্ধ হলে পরিবেশে বিপর্যয় নেমে আসে তা পরিষ্কার তাঁর লেখায়।
“আমরা মাটি থেকে উৎপন্ন আমাদের যা কিছু প্রয়োজনীয় পদার্থ যে পরিমাণে লাভ করছি মাটিকে সে পরিমাণে ফিরিয়ে না দিয়ে তাকে দরিদ্র করে দিচ্ছি। আমাদের দেশে একটা কথা আছে যে সংসারটা একটা চক্রের মতো। আমাদের জীবনের, আমাদের সংসারের গতি চক্র পথে চলে। মাটি থেকে যে প্রাণের উৎস উৎসারিত হচ্ছে তা যদি চক্র পথে মাটিতে না ফেরে তবে তাতে প্রাণকে আঘাত করা হয়। পৃথিবীর নদী বা সমুদ্র থেকে জল বাষ্পাকারে উপরে উঠে, তার পর আকাশে তা মেঘের আকার ধারণ করে বৃষ্টিরূপে আবার নিচে নেমে আসে। যদি প্রকৃতির এই জলবাতাসের গতি বাধা পায় তবে চক্র সম্পূর্ণ হয় না, আর অনাবৃষ্টি দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি উৎপাত এসে জোটে। মাটিতে ফসল ফলানো সম্বন্ধে এই চক্ররেখা পূর্ণ হচ্ছে না বলে আমাদের চাষের মাটির দারিদ্র্য বেড়ে চলেছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি যে কতদিন থেকে চলছে তা আমরা জানি না। গাছপালা জীবজন্তু প্রকৃতির কাছ থেকে যে সম্পদ পাচ্ছে তা তারা ফিরিয়ে দিয়ে আবর্তন-গতি কে সম্পূর্ণতা দান করছে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মানুষকে নিয়ে। মানুষ তার ও প্রকৃতির মাঝখানে আর-একটি জগৎকে সৃষ্টি করেছে যাতে প্রকৃতির সঙ্গে তার আদান ও প্রদানের যোগ-প্রতিযোগে বিঘ্ন ঘটছে। সে ইঁটকাঠের প্রকাণ্ড ব্যবধান তুলে দিয়ে মাটির সঙ্গে আপনার বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। মানুষের মতো বুদ্ধিজীবী প্রাণীর পক্ষে এই-সকল আয়োজন উপকরণ অনিবার্য সে কথা মানি; তবুও এ কথা তাকে ভুললে চলবে না যে, মাটির প্রাণ থেকে যে তার প্রাণমন সত্তার উদ্ভব হয়েছে, গোড়াকার এই সত্যকে লঙ্ঘন করলে সে দীর্ঘকাল টিকতে পারেনা। মানুষ প্রাণের উপকরণ যদি মাটিকে ফিরিয়ে দেয় তবেই মাটির সঙ্গে তার প্রাণের কারবার ঠিক মত চলে, তাকে ফাঁকি দিতে গেলেই নিজেকে ফাঁকি দেওয়া হয়। মাটির খাতায় যখন দীর্ঘকাল কেবল খরচের অঙ্কই দেখি আর জমার বড়ো-একটা দেখতে পাই নে তখন বুঝতে পারি দেউলে হতে আর বড়ো বেশি বাকি নেই।”[৩৪]
বারো
আসুন, প্রিয় পাঠক, তিরিশ বছর আগের একটা ছবি দেখি।
“The forests are disappearing. The deserts are expanding. Billions of tons of fertile soil are washed every year into the sea. Numerous species are becoming extinct. Population pressures and poverty lead to desperate efforts to survive, even at the expense of nature. Third World countries, yesterday’s colonies and today’s nations exploited and plundered by an unjust economic order, cannot be blamed for all this. The solution cannot be to prevent the development of those who need it the most. Because today, everything that contributes to underdevelopment and poverty is a flagrant rape of the environment.”[৩৫]
আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৯২ সালের বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে একথা শুনিয়েছিলেন। আর আজ সমস্যা নিরসন হওয়া দূরে থাকুক তিরিশ বছর পর তা বহুগুণ বেড়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন আর আবহাওয়ার বদল আজ প্রধানতম সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে। তার সঙ্গে আরও হাজারো সমস্যা মাথা তুলেছে। অরণ্য ধ্বংস, সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, বাতাস ও মৃত্তিকা দূষণ, ভূমিক্ষয়, পানীয় জলের সংকট, পতঙ্গবাহিত রোগবৃদ্ধি, ক্ষুধা ও দরিদ্রতা প্রভৃতি সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কাস্ত্রো বলেছিলেন এখনও সময় আছে। তিরিশ বছর আগে বলেছিলেন একথা। স্পষ্ট করেছিলেন, অন্যথায় কী ভয়ংকর বিপদের সামনে আমরা পড়তে যাচ্ছি সেকথা। উচ্চারণ করেছিলেন —
“Humanity can still stop and reverse the destruction of the environment. It nevertheless seems appropriate to ask how much time it has to do so. If present trends continue, in 40 years the earth’s population will have doubled, the climate will have suffered deep and irreversible changes, the tropical rain forests will have practically disappeared; immense deserts, sterile and degraded lands will have replaced a large part of the lands that are now used for crops and livestock raising; clean water will be very hard or impossible to find in entire regions; and hunger will spread uncontrollably and irremediably.”[৩৬]
পণ্যসভ্যতা আমাদের জন্য আজ এই উপহার সাজিয়ে দিয়েছে।
তেরো
‘জাপান-যাত্রী’ রবীন্দ্রনাথের জাপান যাত্রার ডায়ারি। তাঁর ‘যুরোপ যাত্রীর ডায়েরি’-র মতো এটিও জাপান যাত্রাপথে জাহাজের মধ্যে বন্দি রবীন্দ্রনাথের আত্মকথন। এখানের প্রকৃতির রূপ বর্ণনা যেমন আছে তেমনি আছে সামাজিক বিষয়ে গভীর পদচারণ। প্রকৃতির রূপের দার্শনিক অনুভবের প্রকাশ হতে পারে নীচের কয়েকটি লাইন।
“এই কয়দিন আকাশ এবং সমুদ্রের দিকে চোখ ভরে দেখছি আর মনে হচ্ছে, অনন্তের রঙ তো শুভ্র নয়, তা কালো কিংবা নীল। এই আকাশ খানিক দূর পর্যন্ত আকাশ অর্থাৎ প্রকাশ, ততটা সে সাদা। তারপরে সে অব্যক্ত, সেইখান থেকে সে নীল। আলো যতদূর সীমার রাজ্য সেই পর্যন্ত; তারপরেই অসীম অন্ধকার। সেই অসীম অন্ধকারের বুকের উপরে এই পৃথিবীর আলোকময় দিনটুকু যেন কৌস্তভমণির হার দুলছে।”[৩৭]
কিন্তু প্রসঙ্গ বদলায়। আসে পণ্যসভ্যতার বিষময় রূপ ধরে দূষণ প্রসঙ্গ। কবি লেখেন, “এমনি খারাপ লেগেছিল এডেনের বন্দরে। সেখানে মানুষের হাতে বন্দি হয়ে সমুদ্রও কলুষিত। জলের উপরে তেল ভাসছে, মানুষের আবর্জনাকে স্বয়ং সমুদ্রও বিলুপ্ত করতে পারছে না।”[৩৮]
শুধুমাত্র সমস্যার চরিত্র তো এটুকুই না। যন্ত্র ও পণ্য সভ্যতার বজ্রনিনাদ তাঁকে বিষণ্ণ করে তুলেছিল। কবি আশ্চর্য হয়েছিলেন তার মধ্যে মনুষ্যত্বকে অবজ্ঞা করার বিপুল উৎসাহ দেখে। লিখেছিলেন —
“পৃথিবীর সকল সভ্য জাতই বর্তমান কালের ছাঁচে ঢালাই হয়ে একই রকম চেহারা অথবা চেহারার অভাব ধারণ করেছে। আমার এই জানালায় বসে কোবে শহরের দিকে তাকিয়ে এই যা দেখছি এ তো লোহার জাপান, এ তো রক্তমাংসের নয়। একদিকে আমার জানালা, আর একদিকে সমুদ্র, এর মাঝখানে শহর। চিনেরা যেরকম বিকটমূর্তির ড্রাগন আঁকে — সেইরকম। আঁকাবাঁকা বিপুল দেহ নিয়ে সে যেন সবুজ পৃথিবীটাকে খেয়ে ফেলেছে। গায়ে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি লোহার চালগুলো ঠিক যেন তারই পিঠের আঁশের মতো রৌদ্রে ঝকঝক করছে। বড়ো কঠিন বড়ো কুৎসিত — এই দরকার-নামক দৈত্যটা। প্রকৃতির মধ্যে মানুষের যে অন্ন আছে তা ফলে শস্যে বিচিত্র এবং সুন্দর; কিন্তু সেই অন্নকে যখন গ্রাস করতে যাই তখন তাকে তাল পাকিয়ে একটা পিণ্ড করে তুলি, তখন বিশেষত্বকে দরকারের চাপে পিষে ফেলি। কোবে শহরের পিঠের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি মানুষের দরকার পদার্থটা স্বভাবের বিচিত্রতাকে একাকার করে দিয়েছে। মানুষের দরকার আছে এই কথাটাই ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে, হাঁ করতে করতে, পৃথিবীর অধিকাংশকে গ্রাস করে ফেলছে। প্রকৃতিও কেবল দরকারের সামগ্রী, মানুষও কেবল দরকারের মানুষ হয়ে আসছে।….. ঘাটে ঘাটে দেশে দেশে এইটেই খুব বড় করে দেখতে পাচ্ছি। মানুষের দরকার মানুষের পূর্ণতাকে যে কতখানি ছাড়িয়ে যাচ্ছে এর আগে কোনদিন আমি সেটা এমন স্পষ্ট করে দেখতে পাই নি।…. একসময় যে মানুষ মনুষ্যত্বের খাতিরে টাকাকে অবজ্ঞা করতে জানতো এখন সে টাকার খাতিরে মনুষ্যত্বকে অবজ্ঞা করছে। রাজতন্ত্রে, সমাজতন্ত্রে ঘরে-বাইরে, সর্বত্রই তার পরিচয় কুৎসিত হয়ে উঠছে। কিন্তু বীভৎসতাকে দেখতে পাচ্ছি নে, কেননা, লোভে দুই চোখ আচ্ছন্ন।”[৩৯]
এই লোভের কারবারিদের উদ্দেশ্য করে প্রকৃতি মায়ের আর তার সন্তানদের কাছে কবির অমোঘ উচ্চারণ ছিল —
“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছো ভালো?”
চোদ্দো
তবে কি বিকল্প হিসেবে আমরা বলব —
“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কল বসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন
মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব —
চাই স্বাধীনতা চাই পক্ষের বিস্তার
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,
পরান স্পর্শিতে চাই — ছিঁড়িয়া বন্ধন —
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।”[৪০]
এই কাব্যকথার প্রথম লাইনটা উচ্চারণ করে আমরা আধুনিক সভ্যতার সবটুকুকে এক লহমায় নিশ্চিহ্ন করে দিই। সমগ্র কবিতাটির বার্তা তা নয়। পাষাণ পিঞ্জরে নিরাপদে থাকার বদলে প্রকৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার আহ্বানের সুর এখানে। জগতের হৃদয় স্পন্দন স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত হওয়ার সুরই বেজেছে।
এই সুর না শুনলে আমরা আজকের সমস্যার আজকের সমাধান পাব না। অনেকেই আবহাওয়া বদলের সমস্যাটাকে বুঝতেই চান না। আবার মানুষের কার্যকলাপই যে এজন্য দায়ী তাও অনেকে স্বীকার করেন না। এই বিষয়টিকে রেচেল কার্সন সুন্দর ধরেছেন। তিনি বলেছেন আগে একইভাবে অনেকে বিবর্তনবাদকে স্বীকার করতে চাইত না। এখন সকলেই একে স্বীকার করে। তেমনিভাবে মানুষের কার্যকলাপই যে বহু জীবের সুস্থ ভাবে জীবনধারণের অন্তরায় হয়ে উঠেছে, আর তার ফলে মানুষের টিকে থাকাই যে সমস্যাসংকুল হয়ে দাঁড়াবে তাও কিছুদিনেই সকলের মালুম হবে। রেচেলের ভাষ্য —
“As I look back through history I find a parallel. l ask you to recall the uproar that followed Charles Darwin’s announcement of his theories of evolution. The concept of man’s origin from pre-existing forms was hotly and emotionally denied, and the denials came not only from the lay public, but from Darwin’s peers in science. Only after many years did the concepts set forth in The Origin of Species become firmly established. Today, it would be hard to find any person of education who would deny the facts of evolution. Yet so many of us deny the obvious corollary: that man is affected by the same environmental influences that control the lives of all the many thousands of other species to which he is related by evolutionary ties.”[৪১]
রেচেলের ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ প্রকাশের প্রায় ১০০ বছর আগে ‘ফ্রাস’ কৃষির মধ্য দিয়ে মানুষ কীভাবে প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ করে চলেছেন তা তুলে ধরেছিলেন। বারংবার কৃষি যে কৃষকের কাঙ্ক্ষিত আর্দ্রতার বড়ো রকম ক্ষয় ঘটিয়ে দেয় তা তুলে ধরেছিলেন ফ্রাস। এর ফলেই দক্ষিণ থেকে উত্তরে ক্রমে কৃষির সঞ্চরণ ঘটেছিল। তাছাড়া কৃষির প্রয়োজনে বন ধ্বংসের বিষয়টি তো ছিলই। এভাবে ধনবাদী কৃষি ক্রমে সঞ্চারিত হয়েছিল এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়, আর পেছনে ফেলে যাচ্ছিল ঊষর মরু। সেকথাই মার্কস লিখেছেন এঙ্গেলসকে একটি চিঠিতে।
“Climate and the Vegetable World Throughout the Ages, a History of Both, by Frass (1847), is very interesting, especially as proving that climate and flora have changed in historic times. He is a Darwinist before Darwin and makes even the species arise in historic times. But he is also an agronomist. He maintains that as a result of cultivation and in proportion to its degree, the “moisture” so much beloved by the peasant is lost (hence plants migrate from south to north) and eventually the formation of steppes begins. The first effects of cultivation are useful but in the end it turns the land into wastes owing to deforestation, etc. This man is both a thoroughly learned philologist (he has written books in Greek) and a chemist, agronomist, etc. The conclusion is that cultivation when it progresses spontaneously and is not consciously controlled (as a bourgeois he of course does not arrive at this), leaves deserts behind it — Persia, Mesopotamia, etc., Greece. Hence again an unconscious socialist tendency!…”[৪২]
রবীন্দ্রনাথে আমরা শুনি সেই মরুপ্রসাররোধী বিজয়ের সুর —
“মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে।
হে প্রবল প্রাণ।
ধুলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে।
হে কোমলপ্রাণ।
মৌনী-মাটির-মর্মর-গান কবে
উঠিবে ধ্বনিয়া মর্মর তব রবে,
মাধুরী ভরিবে ফুলে ফলে পল্লবে
হে মোহন প্রাণ।”[৪৩]
কৃষি আর শিল্পের আগ্রাসী আস্ফালন থেকে প্রতিবেশকে রক্ষার একমাত্র মহৌষধ যে প্রকৃতি আর মানবের প্রাণপ্রবাহের মিলনে এক সমন্বয়ের সুর সাজানো তা বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ছিন্নপত্রে’ এসে দেখি এই প্রসঙ্গ সরল ও স্পষ্ট করেছেন তিনি। সেখানে প্রকৃতি সংসার ও মানব সংসারের নিগূঢ় যোগ তাঁর কলমে স্পষ্ট। প্রকৃতির প্রাণপ্রবাহের সাথে নিজের হৃদয়ের প্রাণপ্রবাহের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে মিল ঘটানো ছিল তাঁর চিরকালীন অনুভব। কবিকথায় —
“আমি একদিন সমুদ্রস্নানে সিক্ত তরুণ পৃথিবীতে গাছ হইয়া পল্লবিত হইয়া উঠিয়াছিলাম।…আমার মধ্যে যে গাছের প্রাণের স্মৃতি আছে, আজ মানুষ হইয়াছি বলিয়াই এ কথা কবুল করিতে পারিতেছি। শুধু গাছ কেন সমস্ত জড়জগতের স্মৃতি আমার মধ্যে নিহিত আছে। বিশ্বের সমস্ত স্পন্দন আমার সর্বাঙ্গে আত্মীয়তার পুলক সঞ্চার করিতেছে। আমার প্রাণের মধ্যে তরুলতার বহুযুগের মূক আনন্দ আজ ভাষা পাইয়াছে,… আমার মধ্যে একটা বিপুল আনন্দ আছে, সেই জল, স্থল, গাছপালা, পশুপাখির আনন্দ। — প্রকৃতির মধ্যে যে এমন একটা গূঢ় গভীর আনন্দ পাওয়া যায়, কেবল তার সঙ্গে আমাদের একটা সুবৃহৎ আত্মীয়তার সাদৃশ্য অনুভব করে — এই নিত্য সঞ্জীবিত সবুজ সরল তৃণলতা-তরুগুল্ম, এই জলধারা, এই বায়ুপ্রবাহ, এই সতত ছায়ালোকের আবর্তন, এই ঋতুচক্র, এই অনন্ত আকাশপূর্ণ জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর প্রবহমান স্রোত, পৃথিবীর অনন্ত প্রাণী পর্যায়, এই সমস্তের সঙ্গে আমাদের নাড়ির রক্ত চলাচলের যোগাযোগ রয়েছে।”[৪৪]
এমন প্রকৃতিপ্রেমিকই তো মিলনের সুরে সুরে মিলিয়ে গাইতে পারেন —
“যুক্ত করহে সবার সঙ্গে,
মুক্ত করহে বন্ধ
সঞ্চার কর সকল কর্মে
শান্ত তোমার ছন্দ।”
আলতো চোখ ঘুরিয়ে, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘ড্যাফোডিল’ রচনার দিকে চোখ রাখতে পারি আমরা। একই অন্তরঙ্গতা এখানেও।
“I wandered lonely as a cloud
That floats on high o'er vales and hills,
When all at once I saw a crowd,
A host, of golden daffodils;
Beside the lake, beneath the trees,
Fluttering and dancing in the breeze.
………
And then my heart with pleasure fills,
And dances with the daffodils.”
পনেরো
প্রকৃতির উপর প্রভুত্বের এই প্রবণতাকে রবীন্দ্রনাথ সুচারু ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ‘উপেক্ষিতা পল্লী’ অভিভাষণে। স্পষ্ট করেছেন ‘সীমার নিয়মের পরিমিতির’ কথা।
“বর্তমানে আমরা সভ্যতার যে প্রবণতা দেখি তাতে বোঝা যায় সে ক্রমশই প্রকৃতির সহজ নিয়ম পেরিয়ে বহু দূরে চলে যাচ্ছে। মানুষের শক্তি জয়ী হয়েছে প্রকৃতির শক্তির উপরে, তাতে লুঠের মাল যা জমে উঠলো তা প্রভূত। এই জয়ের ব্যাপারে প্রথম গৌরব পেল মানুষের বুদ্ধিতীর্থ, কিন্তু তার পিছন পিছন এলো দুর্বাসনা।…..মানুষ আপন সভ্যতাকে যখন অভ্রভেদী করে তুলতে থাকে তখন জয়ের স্পর্ধায় বস্তুলোভে ভুলতে থাকে যে সীমার নিয়মের দ্বারা তার অভ্যুত্থান পরিমিত। সেই সীমায় সৌন্দর্য সেই সীমায় কল্যান। সেই যথোচিত সীমার বিরুদ্ধে নিরতিশয় ঔদ্ধত্যকে বিশ্ববিধান কখনোই ক্ষমা করে না। প্রায় সকল সভ্যতায় অবশেষে এসে পড়ে এই ঔদ্ধত্য আর নিয়ে আসে বিনাশ। প্রকৃতির নিয়ম সীমায় যে সহজ স্বাস্থ্য ও আরোগ্যতত্ত্ব আছে তাকে উপেক্ষা করেও কি করে মানুষ স্বরচিত প্রকাণ্ড জটিলতার মধ্যে কৃত্রিম প্রণালীতে জীবনযাত্রার সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে এই হয়েছে আধুনিক সভ্যতার দুরূহ সমস্যা। …একধারে সব কিছু আছে, আর এক ধারে কোন কিছুই নেই, এই ভার সামঞ্জস্যের ব্যাখ্যাতেই সভ্যতার নৌকা কাত হয়ে পড়ে। একান্ত অসাম্য আনে প্রলয়। সেই প্রলয়ের গর্জন সর্বত্রই শোনা যাচ্ছে।”[৪৫]
বানর থেকে মানুষের উত্তরণে শ্রমের ভূমিকা লিখতে গিয়ে এঙ্গেলস একই প্রসঙ্গে বলেছেন —
“প্রাণীরা শুধু বহিঃপ্রকৃতিকে ব্যবহার করে এবং কেবলমাত্র নিজের উপস্থিতি দ্বারা প্রকৃতির মধ্যে পরিবর্তন আনে; মানুষ কিন্তু তার পরিবর্তন দ্বারা প্রকৃতিকে তার উদ্দেশ্য সাধনে লাগায়, প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করে। …প্রকৃতির উপর আমাদের সমস্ত প্রভুত্ব এইখানে যে, অন্য সকল জীবের চেয়ে আমাদের এই সুবিধা যে, আমরা প্রকৃতির নিয়ম আয়ত্ব করতে এবং নির্ভুল ভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম। …প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতির ফলে আমরা ক্রমশ এমন একটা অবস্থায় এসে পৌঁছচ্ছি যে, অন্ততপক্ষে আমাদের সাধারণতম উৎপাদনী কার্যাবলীর অধিকতর পরোক্ষ প্রাকৃতিক ফলগুলি জানতে এবং সেইহেতু নিয়ন্ত্রিত করতে পারি।”[৪৬]
রবীন্দ্রনাথ এই নিয়ন্ত্রণবোধকেই বলেছেন, সীমার মধ্যে থাকার পরিমিতিবোধ। প্রকৃতির বাইরে থেকে প্রভুত্বকারীর এ বোধ ঘুঁচে যায়। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিবোধ এখানে মার্কসীয় দর্শনের সঙ্গে পরস্পর মিলে যায়।
ষোলো
সর্বশেষ গ্লাসগো পরিবেশ বৈঠক, যা Cop 26 হিসেবে পরিচিত, তা বিশ্বের পরিবেশগত অবস্থা পর্যালোচনা করেছে। কাজের কাজ খুব বেশি হয়েছে বলতে পারি না। উষ্ণায়ন, যা বর্তমানে অন্যতম পরিবেশ সমস্যা, তাকে রুখতে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিনিয়ম লাগু করা হয়নি। ধনবাদী দেশগুলো তাদের এতদিনের পরিবেশ হন্তারক ভূমিকার জন্য বাড়তি দায়িত্ব নিতে কাঁধ বাড়িয়ে দেননি। সাধারণভাবে সকলকে গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। ১০০ বিলিয়ন ডলারের যে তহবিল এই আবহাওয়ার বদল রুখতে কাজে লাগানোর কথা, তা শুধু উন্নত দেশ নয় উন্নয়নশীল দেশগুলোও দেবে। এই শতকের শেষে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে বেঁধে রাখতে কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কমানোর কথা বলা হয়েছে। তবে স্বেচ্ছা পালনীয় এই কাজগুলো কতটা সত্যি হবে তা বলা যাবে না। তাই ব্যবস্থা বদলের ডাক দিয়েছিল যে গ্রেটা থুনবার্গ আর তার সংগঠন, তারা এবার বলছে ‘Uproot the System’। যে ব্যবস্থা পরিবেশ ক্ষয় রুখতে পারে না, তাকে উৎখাত করো।
জন বেলামি ফস্টার ধনবাদী লোভ আর তার পরিণতি জনিত পরিবেশ বিপর্যয় রুখতে বলেছেন রবীন্দ্রনাথের মতোই প্রকৃতি ও মানব সভ্যতার সমছন্দে বিকাশের কথা। লিখেছেন —
“We are faced with a stark choice: either reject “the gods of profit” as holding out the solution to our ecological problems, and look instead to a more harmonious co-evolution of nature and human society, as an essential element in building a more just and egalitarian social order or face the natural consequence of ecological and social crisis that will rapidly spin out of control, with irreversible and devastating consequences for human beings and those for numerous other species with which we are linked.” [৪৭]
একাজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সম্ভব নয়। তাই পুঁজিবাদী সভ্যতাকে হঠিয়ে দিতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় সে লড়াইতে সামিল করতে হবে সকলকে।
“… ডাকিয়া বলিতে হবে —
মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে,
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে,
যখনই জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে;..।”[৪৮]
‘সাইলেন্ট স্প্রিং’-এ শেষে এসে রেচেল বুঝিয়েছিলেন, প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব করা এক ‘ঔদ্ধত্বের দর্শন’। কারণ প্রকৃতি তো মানুষের জন্যই। মার্কসও ছিলেন সেখানেই। আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরঙ্গতা, রূপমুগ্ধতা, রোমান্টিকতা, একাত্মতা, ধাত্রী ও মাতৃরূপময়তা, গতিময়তা, অসীমতা ঘিরে মুগ্ধতায় দেখেছেন প্রকৃতিকে। ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রকৃতি ও মানবের প্রতিবেশে holism-এর সমন্বয়ী বার্তা। মার্কস এঙ্গেলসের মতোই প্রকৃতির উপর প্রভুত্বকে নস্যাৎ করে চেয়েছেন ‘সীমার মধ্যে থাকার পরিমিতিবোধ’। আমরা সেসবে মূল্য দিচ্ছি কই!
সূত্র :
১. ‘রবীন্দ্রনাথ: বিশ্বকবি ও বাঙালি’, বুদ্ধদেব বসু, প্রবন্ধ সংকলন, দেজ পাবলিশিং, ১৯৯১, পৃ – ১১
২. ‘জীবনস্মৃতি’, রবীন্দ্র রচনাবলী ১৩খণ্ড, প. বঙ্গ সরকার, ১৯৯০, পৃ- ৮
৩. ‘জীবনস্মৃতি’, রবীন্দ্র রচনাবলী ১৩খণ্ড, প. বঙ্গ সরকার, ১৯৯০, পৃ – ৯
৪. ‘জীবনস্মৃতি’, রবীন্দ্র রচনাবলী, নবম খণ্ড, বিশ্বভারতী, পৃ- ৪৯২
৫. ‘আত্মপরিচয়’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১১খণ্ড, প. বঙ্গ সরকার,১৯৮৯, পৃ-১৩১
৬. ‘আত্মপরিচয়’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১১খণ্ড, প. বঙ্গ সরকার, ১৯৮৯, পৃ-১৩১
৭. ‘আত্মপরিচয়’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১১খণ্ড, ১৯৮৯, পৃ – ১৩২
৮. ‘বাঁকুড়ার জনসভায় কথিত অভিভাষণ’, ‘পল্লীপ্রকৃতি’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১৩ খণ্ড, ১৯৯০, পৃ – ৮১৪
৯. ‘বসন্তযাপন’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১৫ খণ্ড, পৃ – ১৬৯
১০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ছিন্নপত্রাবলী’, নূতন সংস্করণ, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, চৈত্র ১৩৯৯, পৃ-১৭
১১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ছিন্নপত্রাবলী’, নূতন সংস্করণ, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, চৈত্র ১৩৯৯,পৃ- ৩৪৩-৩৪৪
১২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘সঞ্চয়িতা’, বিশ্বভারতী, ১৯৭৫, পৃ- ২৩৯
১৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘গীতাঞ্জলি’, কবিতা ২
১৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ৬৭ নং চিঠি, ‘ছিন্নপত্র’, কামিনী প্রকাশালয়, কলকাতা, ২০০২, পৃ – ৬২
১৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘গল্পগুচ্ছ’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, শ্রাবণ ১৩৭৫, পৃ- ৩৪০
১৬. ‘শোনা’, ‘শান্তিনিকেতন’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ৭ম খণ্ড, বিশ্বভারতী, পৃ – ৫৪৫-৫৪৬
১৭. ‘Marx. Economic and Philosophical Manuscripts of 1844’, Progress Publishers, Moscow 1959; p – 31
১৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘গীতবিতান’, দ্বিতীয় খণ্ড, বিশ্বভারতী, ফাল্গুন ১৩৯৭, পৃ – ৪৩০
১৯. ‘অরণ্যদেবতা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘পল্লীপ্রকৃতি’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১৩ খণ্ড, প. বঙ্গ সরকার, ১৯৯০, পৃ – ৭৮১-৭৮২
২০. ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, ‘বানর থেকে মানুষে উত্তরণে শ্রমের ভূমিকা’, মার্কস এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী, ৯ম খণ্ড, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, পৃ- ৮৮, ৯৭
২১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ফাল্গুনী’, রবীন্দ্র নাট্য সংগ্রহ, বিশ্বভারতী ২য় খণ্ড, ১৪০৬, পৃ – ৮৮৪
২২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘রক্তকরবী’, রবীন্দ্র নাট্য সংগ্রহ, বিশ্বভারতী ২য় খণ্ড, ১৪০৬, পৃ – ৭৫
২৩. Vandana Shiva and Maria Mies, ‘Ecofeminism’, p – 16-18
২৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘মুক্তধারা’, রবীন্দ্র নাট্য সংগ্রহ, বিশ্বভারতী ২য় খণ্ড, ১৪০৬, পৃ – ১২-১৩
২৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘মুক্তধারা’, রবীন্দ্র নাট্য সংগ্রহ, বিশ্বভারতী ২য় খণ্ড, ১৪০৬, পৃ – ৩৭
২৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বলাই’, ‘গল্পগুচ্ছ’, বিশ্বভারতী, বৈশাখ ১৪০১, পৃ – ৬৫০
২৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বলাই’, ‘গল্পগুচ্ছ’, বিশ্বভারতী, বৈশাখ ১৪০১, পৃ – ৬৫১
২৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘দুই পাখি’, ‘সঞ্চয়িতা’, বিশ্বভারতী ১৯৭৫, পৃ – ১২৫
২৯. ‘আত্মপরিচয়’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১১খণ্ড, প. বঙ্গ সরকার, ১৯৮৯, পৃ-১৩১
৩০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘প্রবাসী’, ‘সঞ্চয়িতা’, বিশ্বভারতী, ১৯৭৫, পৃ – ৪৬৬
৩১. Karl Marx, ‘Capital’, Vol. III; International Publishers, New York.1959, p – 530
৩২. কার্ল মার্কস, ‘ক্যাপিটেল’, বাংলা অনুবাদ, প্রগতি প্রকাশন, সম্পাদনা – প্রফুল্ল রায়, পৃ – ৬১২-৬১৩
৩৩. Karl Marx, ‘Capital’, vol 1 , New York 1976, p – 637-638
৩৪. ‘অভিভাষণ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘পল্লীপ্রকৃতি’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১৩খণ্ড, প. বঙ্গ সরকার, ১৯৯০, পৃ – ৭৯৩
৩৫. Fidel Castro, ‘Tomorrow is too late’, NBA 1994, p- 3-4
৩৬. Fidel Castro, ‘Tomorrow is too late’, NBA 1994, p- 53
৩৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘জাপান-যাত্রী’, রবীন্দ্র রচনাবলী, প. বঙ্গ সরকার, ১২খণ্ড, পৃ – ১৬২
৩৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘জাপান-যাত্রী’, রবীন্দ্র রচনাবলী, প. বঙ্গ সরকার, ১২খণ্ড, পৃ – ১৫০
৩৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘জাপান-যাত্রী’, রবীন্দ্র রচনাবলী, প. বঙ্গ সরকার, ১২খণ্ড, পৃ – ১৭৬
৪০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘সভ্যতার প্রতি’, ‘চৈতালি’, বিশ্বভারতী, ১৯৪৭, উইকি সংকলন, পৃ – ৩৬
৪১. ‘Lost Woods’: The Discovered Writing of Rachel Carson, p -244-245
৪২. ‘Letter of Marx to Engels’, Marx-Engels selected correspondence, Foreign language publishing house, p – 243-244
৪৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘গীতবিতান’, দ্বিতীয় খণ্ড, বিশ্বভারতী, ফাল্গুন ১৩৯৭, পৃ – ৬১১
৪৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ছিন্নপত্র’
৪৫. ‘উপেক্ষিতা পল্লী’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘পল্লীপ্রকৃতি’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১৩খণ্ড, প. বঙ্গ সরকার, ১৯৯০, পৃ – ৭৭৭-৭৭৯
৪৬. ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, ‘বানর থেকে মানুষে উত্তরণে শ্রমের ভূমিকা’, মার্কস এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী, ৯ম খণ্ড, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, পৃ- ৯৬-৯৮
৪৭. John Bellamy Foster, ‘Ecology Against Capitalism’, Cornerstone Publication, Kharagpur, 2003, p- 25
৪৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘এবার ফিরাও মোরে’, ‘সঞ্চয়িতা’, বিশ্বভারতী, ১৯৭৫, পৃ – ২২০