দেবনারায়ণ মোদক
প্রকৃতি, পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কে গান্ধি-ভাবনার অনুশীলনে প্রথমেই মনে রাখতে হয় যে, গান্ধিজির জীবনকালে (১৮৬৯-১৯৪৮) আধুনিক পরিবেশ-বিষয়ক আলাপ-আলোচনা তেমন ভাবে বিকশিত হয়ে ওঠেনি। এতদ্সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহে তাঁর মৌলিক ভাবনার প্রেক্ষিতে সামগ্রিক বিচারে তাঁকে পরিবেশ-চিন্তার অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। নানা মহলেই ‘World’s early environmentalist in vision and practice’ হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উল্লেখ্য যে, গান্ধিজির জীবনব্যাপী সুবিশাল কর্মকাণ্ড ও লেখাপত্রে যেমন তাঁর পরিবেশ-বিষয়ক অভিজ্ঞানটি প্রতিফলিত; তেমনই গান্ধি-পরবর্তী সময়কালের পরিবেশ আন্দোলন সমূহে তাঁর প্রেরণা ও প্রভাবও তেমনি উল্লেখযোগ্য। সে কারণে, ভারতে তো বটেই, সারা পৃথিবীতেই প্রকৃতি, পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক আলোচনায় গান্ধি-প্রসঙ্গ যেন অবধারিত ভাবেই উঠে আসে। বর্তমান নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাই পরিবেশ-সম্পর্কে গান্ধি-ভাবনার একটি রূপরেখা নির্মাণের এক বিনম্র উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে।
এক
পরিবেশ-প্রসঙ্গে গান্ধি ভাবনা অনুধাবনের প্রথম এবং প্রধান সমস্যা এই যে, পরিবেশ বিষয়ে গান্ধিজি কোথাও তাঁর অভিমত সুনির্দিষ্ট ভাবে লিপিবদ্ধ করেননি। বস্তুতপক্ষে, তা ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর সামগ্রিক ভাবনার বিবিধ প্রকাশে; সর্বোদয়, সত্যাগ্রহ ও অহিংসা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞানে; শিল্পায়ন, নগরায়ণ তথা সার্বিক উন্নয়ন ভাবনায়; সর্বোপরি তাঁর গ্রাম স্বরাজ ও গঠনমূলক কর্মসূচি এবং আরও কতকিছুতে। তাই, গান্ধিজির পরিবেশ ভাবনাকে বুঝে নিতে হয় তাঁর সামগ্রিক জীবনবোধে ও কর্মকাণ্ডের নিরিখে – এক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে। এক্ষেত্রে আবার মনে রাখতে হয় যে, প্রথাগত অর্থে গান্ধিজি কোনও ‘বাস্তুদার্শনিক’ ছিলেন না, বা সেই অর্থে ‘গান্ধিবাদ’ বলেও কিছু হয় না। গান্ধিজি নিজেই এ-বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তা সত্ত্বেও গান্ধিজির জীবনকালেই ‘গান্ধিবাদ’ কথাটি বহুল পরিচিতি লাভ করেছে।[১] এ সব নিয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়েও এক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে, বেশ সুবিন্যস্ত না হলেও প্রথমাবধিই গান্ধিজি এত ধরনের চিন্তাপ্রণালী গড়ে তুলেছেন, যা কালপ্রবাহে একটি সামগ্রিক ‘জীবন বোধ’ হিসেবে রূপ পরিগ্রহ করেছে। গান্ধিজির পরিবেশ ভাবনা তাঁর এই বৃহত্তর জীবনবোধের নিরিখেই অনুধাবন করতে হয়।
প্রসঙ্গত বলি যে, গান্ধিজির পরিবেশ ভাবনা অনুশীলনে তেমন কোনও প্রতিনিধি স্থানীয় রচনার অভাব থাকলেও তাঁর Hind Swaraj-কে এক্ষেত্রে আলোচনার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে, ১৯০৮ সালে লন্ডন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাত্রা পথে জাহাজে বসে মাত্র দশদিনে গুজরাটি ভাষায় তিনি এটি রচনা করেন। তাঁর জীবনের শেষ পর্বে এসেও এই পুস্তিকায় বিবৃত মতামত গুলির প্রতি তিনি আস্থাশীল ছিলেন।[২] Hind Swaraj তাই এ বিষয়ে বিশেষ সহায়ক হতে পারে। গান্ধিজির অন্যান্য লেখাপত্রের মধ্যে তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘The Story of My Experiments with Truth’-এর কথাও এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এছাড়াও আমাদের নজর দিতে হয় সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে তাঁর অসংখ্য লেখাপত্র ও কর্মকাণ্ডের কথায়।
এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় সমস্যা হিসেবে বলি যে, গান্ধিজির সময়কালে পরিবেশ বিষয়ে সুসংবদ্ধ আলাপ-আলোচনার পরিসরটিই তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি; আধুনিক পরিবেশ চেতনাও সেরকম বিকশিত হয়ে ওঠেনি। সেই সময়ের পরিবেশ-ভাবনা ছিল প্রধানত কিছু ‘স্বপ্ন-সন্ধানী’ ও ‘আদর্শবাদী’ মানুষের বিচরণ ক্ষেত্র অথবা বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চায় বা জ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবেও তা আত্মপ্রকাশ করেনি। এমনতরো বাস্তব পরিস্তিতিতে গান্ধিজির রচনায় পরিবেশ-ভাবনার সুসংবদ্ধ উপস্থাপন আশা করা যায় না। তা সত্ত্বেও ভাবতে অবাক লাগে যে, আধুনিক পৃথিবীতে পরিবেশ চেতনার বিকাশের বহু পূর্বেই আপন দূরদৃষ্টিতে গান্ধিজি সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং নিজের মতো করে আগামীর জন্য বিপদ সংকেত জারি করেছিলেন।
প্রসঙ্গত বলি যে, উনিশ শতকের শেষ ভাগে জার্মান প্রাণী বিজ্ঞানী আর্নেস্ট হেকেলের হাত ধরে Ecology শব্দটি জনপ্রিয় হতে থাকে এবং বিশ শতকের গোঁড়ায় ব্রিটিশ পরিবেশবিদ ট্রান্সলের সৌজন্যে Eco-system শব্দটির ব্যবহার লক্ষণীয় হয়। বস্তুতপক্ষে, ইউরোপে শিল্প বিপ্লব-উত্তর বিশ্বব্যবস্থার গতি প্রকৃতি, দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতা ও পরিণতি অনিবার্যভাবেই পরিবেশের বিপদ সম্পর্কে আমাদের কমবেশি সচেতন করে তুলেছে। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয় রেচেল কার্সন-এর যুগান্তকারী রচনা ‘Silent Spring’ (নিরব বসন্ত) শীর্ষক গ্রন্থটির কথা, যা পৃথিবীর ‘পশ্চিমদিগন্ত’-এর পরিবেশ ভাবনায় এক নতুনতর মাত্রা সংযোজন করেছে এবং কালক্রমে তা বিশ্বময় প্রসারিত হয়েছে। এই বইতে কার্সন দেখিয়েছেন যে, উৎপাদন-বৃদ্ধি তথা উন্নয়নের নামে যেভাবে পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়ে চলেছে, তাতে গোটা পৃথিবীতে অচিরেই নেমে আসবে এক ‘নীরব বসন্ত’, যখন ‘পাখির কূজন’ আমাদের আর কর্ণগোচর হবে না । কার্যত এই সময়কাল থেকেই পরিবেশ সমস্যার নানা দিক আমাদের গভীর আলাপ-আলোচনার বিষয়ীভূত হয় এবং বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হতে থাকে। অন্যভাবে বলি যে, পূর্বে যা ছিল কতিপয় ‘স্বপ্নসন্ধানী’ ও ‘আদর্শবাদী’ মানুষের বিচরণ ক্ষেত্র অথবা বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়; কাল প্রবাহে আমাদের ‘আধুনিকতা’ ও তৎসংশ্লিষ্ট বিকাশের দাবি সত্ত্বেও তা ব্যাপক মানুষের আলোচনা ও উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে পরিবেশ ভাবনা আর শুধুমাত্র আমাদের শিল্পক্ষেত্র অথবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক থাকার আচরণকেই প্রভাবিত করে না; তা আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেরও গুরুত্বপূর্ণ নির্মায়ক হয়ে উঠেছে ।
উল্লেখ্য যে, আমাদের পরিবেশ-চেতনা সময়ের হাত ধরে রাষ্ট্রীয় সীমানা-অতিক্রান্ত বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং তা আমাদের ‘মানবজাতির সাধারণ সমস্যা’ (Common concern for humanity) হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছে। এই প্রক্রিয়াতেই ১৯৭২ সালে স্টকহোমে আয়োজিত হয়েছে পরিবেশ-বিষয়ক প্রথম বিশ্ব সম্মেলন, যার পোশাকী নাম ছিল United Nations Conference on Human Environment (UNCHE)। স্টকহোম-পরবর্তী সময়ে অসংখ্য আলাপ-আলোচনা ও কর্ম প্রক্রিয়ার পথ পেরিয়ে ১৯৯২ সালে রিও-তে অনুষ্ঠিত হয়েছে মানব জাতির ইতিহাসে সর্ববৃহৎ পরিবেশ সম্মেলন, United Nations Conference on Environment and Development (UNCED) – যা ‘বসুন্ধরা সম্মেলন’ নামে পরিচিত। এখানে ‘পরিবেশ’-এর সঙ্গে ‘উন্নয়ন’-এর ধারণার যে যোগসূত্রটি রচিত হয়েছিল, তা যে যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রিও সম্মেলনের পরবর্তী সময়ে একদিকে যেমন বিশ্ব পরিবেশ চেতনার আরও অগ্রগমন ঘটেছে; তেমনই আবার পরিবেশ-বিতর্কে যুক্ত হয়েছে নতুনতর মাত্রা। সেই পথেই ২০০২ তে জোহানবার্গে আহুত হয়েছে ‘স্থিতিশীল উন্নয়ন’ বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন (World Summit on Sustainable Development)। এখানেই শেষ নয়; আমাদের পরিবেশ চেতনা আরও এগিয়েছে; পরিবেশের বিপদ ও তার গভীরতা সম্পর্কে আমরা যেমন কমবেশি ঐক্যমত হয়েছি; পরিবেশ রক্ষার ‘যৌথ দায়িত্ব’-এর তত্ত্বগত অবস্থান আমরা মেনে নিয়েছি; কিন্তু এ-বিষয়ে কার দায় কতখানি – তা নিয়ে পারস্পরিক মতবিরোধেই আমরা যেন আটকে রয়েছি।[৩]
পরিবেশ বিষয়ে গান্ধি-ভাবনা অনুসরণে এসব কথার অবতারণা এ-কারণেই যে, সুসংবদ্ধভাবে না হলেও আধুনিক কালের পরিবেশ সম্পর্কিত আলোচনায় উত্থাপিত বিষয় সমূহের মধ্যেকার অনেক কিছুই গান্ধি-চেতনায় অনেক আগেই ধরা পড়েছিল, যেগুলির মধ্যে একাধিক বিষয়ে তাকে পথিকৃতের মর্যাদাও দেওয়া যেতে পারে। সেসব কথায় আমরা পড়ে আসবো। আপাতত সমস্যার কথায় ফিরে এসে বলি যে, ‘গান্ধি-যুগ’-এর পরিবেশ চেতনার সঙ্গে বর্তমান পরিবেশ ভাবনার সাযুজ্য বিধানে প্রেক্ষিতগত পার্থক্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গান্ধিজি প্রধানত তাঁর পরিবেশ সম্পর্কিত ধ্যানধারণাগুলি গড়ে তুলেছেন ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রেক্ষাপটে এবং এ দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রবাহে। ঔপনিবেশিক সরকারের হস্তক্ষেপে সংগঠিত আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের প্রক্রিয়া– যা বস্তুগত পরিবেশকে বিঘ্নিত করেছিল তা তাঁর এড়ায় নি।[৪] তার পরিবেশ-ভাবনা স্বাভাবিক ভাবেই তৎকালীন পরিস্থিতি নির্ভর। আবার, বর্তমানে যেমন পরিবেশ আলোচনায় যে শব্দবন্ধগুলি বহুল ব্যবহৃত, সে-সময়ে সেগুলি আমাদের কাছে প্রায় অপরিচিত ছিল। এ ছাড়াও, পরিবেশ-সমস্যাকে ‘বিশ্বজনীন সমস্যা’ (Common concern for humanity) হিসেবে দেখার প্রবণতাও তেমনভাবে গড়ে ওঠে নি। এ-সব পার্থক্য সত্ত্বেও এ-কথা অনস্বীকার্য যে, গান্ধিজি পরিবেশ সমস্যাকে মানব উন্নয়নের বৃহত্তর প্রেক্ষিতেই বিচার করেছিলেন; শব্দ প্রয়োগে বা ধারণাগত ক্ষেত্রে ব্যত্যয় বা ব্যতিক্রম সত্ত্বেও বেশ কিছু বিষয়ে তিনি ‘সময়ের চেয়ে এগিয়ে’ (ahead of his times) ছিলেন একথা আমাদের মনে রাখতে হয়।
দুই
“The Earth has enough resources for our need, but not for our greed” – পরিবেশ সম্পর্কে গান্ধী ভাবনায় এই বাক্যবন্ধটি যে কেবল বহু-উদ্ধৃত তাই নয়; এটিই বোধ করি এ-বিষয়ে গান্ধি ভাবনার মূলসূত্র। এই সূত্রটি ধরে অগ্রসর হলেই গান্ধিজির প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কিত ভাবনার সঙ্গে তার জীবনবোধের যোগসূত্রটি কম বেশি অনুধাবন করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে। তাঁর অর্থনীতি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিটিও যে এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সেটিও একইসঙ্গে পরিস্ফুট হবে। বস্তুতপক্ষে, ভোগবাদী অর্থনীতির প্রতিস্পর্ধী এই ভাবনায় ব্যক্তি মানুষের লোভ ও লাভের সীমাহীন আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে তিনি এমন এক বিকল্পের সন্ধান করেছেন যেখানে ঐশ্বর্যের মাপকাঠিতে নয়; মানুষের ‘আত্মিক মুক্তি’-র নিরিখেই অর্থনীতির বিকাশ তাঁর কাম্য হয়ে উঠেছে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, গান্ধিজির পরিবেশ ভাবনার কেন্দ্রীয় বিষয় হলো মানব কল্যাণ সম্পর্কে তাঁর ধারণা যার ভিত্তিভূমিতে রয়েছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পরিবর্তে সাযুজ্য বিধানের প্রেরণা। ১৯০৮ সালে রচিত ‘Hind Swaraj’ শীর্ষক পুস্তিকাতেই তিনি ‘Conquer nature’ বা প্রকৃতিকে জয় করার ভাবনার মধ্যে যে অন্তর্নিহিত বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে সে বিষয়ে আমাদের সতর্ক করেছেন এবং সেক্ষেত্রে মানুষের কর্তৃত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের পরিবর্তে মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক নির্ভরতার বিবেচনায় সংরক্ষণ ও প্রতিপালনের ভাবনায় গুরুত্ব আরোপ করেছেন । এ-ভাবেই গান্ধি ভাবনায় ‘unity of man and nature’-এর প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এ-ভাবেই, গান্ধি-চেতনায় ভোগবাদের সূত্র ধরেই উঠে এসেছে শিল্পায়ন, নগরায়ণ তথা সামগ্রিক উন্নয়ন ভাবনার কথা এবং তাঁর সামগ্রিক জীবন বোধের কথা। এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে রামজি সিং তাই মন্তব্য করেছেন যে, “Gandhi’s Hind Swaraj was a warning against growing consumption, materialism and wrong model of development”।[৫]
প্রসঙ্গত বলতেই হয় যে, প্রকৃতি-পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কে গান্ধি-ভাবনার উৎসভূমি হিসেবে তাঁর জীবনবোধের আলোচনা যেহেতু অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেহেতু নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা প্রসঙ্গে দু-চারটি কথা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে। প্রকৃতির মধ্যেই তিনি ‘ঈশ্বরের প্রকাশ’ (Manifestation of God’s creation) লক্ষ করেছিলেন। বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আত্যন্তিক যোগসূত্রের কথা; ‘ঈশ্বর-সৃষ্ট’ জীব-জগতের প্রতি ভালোবাসার কথা, জীবন সম্পর্কে তাঁর মূল্যবোধের কথা, অহিংসা ও সর্বোদয় সম্পর্কে তাঁর ভাবনার কথা; সর্বোপরি উন্নত চিন্তিত সহজ সরল জীবন যাপনের কথা (simple living and high thinking) – সব কিছুই যেন এখানে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। সেকারণেই পরিবেশ বিষয়ে গান্ধী-ভাবনাকে অনেকেই এক ধরনের ‘eco-spirituality’ আখ্যা দেওয়ার পক্ষে মত-পোষণ করেন। মঞ্জুলা উপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন : “his thoughts related to nature can be termed as eco-spirituality which is defined as a manifestation of The spiritual connection between human beings and the environment”. [৬]
এই সূত্র ধরেই বলা যেতে পারে যে, গান্ধি ভাবনায় জন রাসকিনের প্রভাব সম্পর্কে আমরা সকলেই কমবেশি অবহিত রয়েছি। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Unto This Last’ গ্রন্থের সারাংশ রচনা করতে গিয়ে গান্ধিজি ‘নীতিশূন্য অর্থনীতি’-র বিড়ম্বনা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এমন একটি বিকল্প অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন যা দীর্ঘস্থায়ী ‘ঐশ্বর্যের মাদকতা’ থেকে মানুষকে মুক্ত করে আমাদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী সুফলকে নিশ্চিত করতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে গান্ধি অনুরাগী অর্থনীতিবিদ J.C. Kumarappa-র বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Economy of permanence’-এর কথা, যা গান্ধি-কর্তৃক অনুমোদিত ও উচ্চ প্রশংসিত।[৭] বইটির নামকরণই যেন এক অর্থে আমাদের ‘স্থিতিশীল উন্নয়ন’ (Sustainable Development)-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। একইভাবে বলা চলে Adolph Just -এর ‘Return to Nature’ শীর্ষক বইটির কথা, যা মানুষের জীবন সম্পর্কে ‘সামগ্রিক বোধ’-এর দুয়ারকে গান্ধিজির কাছে আরও উন্মুক্ত করেছে বলে মনে করা হয়। এখানে জীবন বলতে কেবলমাত্র মানুষ বা প্রাণীকুলকে না বুঝিয়ে সামগ্রিক ভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং তাদের পরস্পর নির্ভরতা কে বোঝানো হয়েছে। হরিজন পত্রিকায় গান্ধিজি তাই লিখেছেন : “I do believe that all God’s creatures have the right to live as much as we have.” (1937)
প্রসঙ্গক্রমে এসেই পড়ে গান্ধিজির স্বরাজ ভাবনা তথা স্বরাজ সাধনার কথা। উল্লেখ্য যে, ‘স্বরাজ’ বলতে তিনি কেবলমাত্র ব্রিটিশ শাসনের অবসান বা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনকেই বোঝান নি – এর মধ্যে দিয়ে তিনি ব্যক্ত করেছেন ব্যাপক অর্থে স্বশাসন (self-government)-এর ধারণা। কেবল মাত্র রাষ্ট্র-বিষয়ে গান্ধি ভাবনা অনুধাবনেই এটি যে গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, Anthony J. Parel যথার্থই বলেছেন যে, “… The concept of Swaraj holds the key of Mahatma Gandhi’s political philosophy”. এখানে সে সব নিয়ে বিস্তারিত কথনে না গিয়েও বলি যে, গান্ধিজির স্বরাজ ভাবনার মধ্যেই তাঁর সত্যাগ্রহ, সর্বোদয় ও অহিংসার ধারণা নিহিত রয়েছে; এমনকি তাঁর ‘নৈতিকতা’ সম্পর্কিত মূল সূত্রটিও এখানে যেন অন্তঃসলিলা। বস্তুতঃপক্ষে, গান্ধিজির স্বরাজ ভাবনার দুটি দিক রয়েছে, যার প্রথমটি অবশ্যই স্বশাসন (self-rule), যেটি ব্যক্তির নিজেকে বিকশিত করে তোলার সঙ্গে সম্পর্কিত। আর, দ্বিতীয়টি হল ‘সমষ্টিগত স্বশাসন’ (collective self-rule), যাকে self-government বলা যেতে পারে। এ-সব নিয়ে গভীর আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, গান্ধিজির দৃষ্টিতে ‘স্বরাজ’ হল যথার্থ অর্থে ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণ (self-control) বা ‘স্ব-শাসন’ এবং আত্ম-অনুধাবন (self-realisation) বা ‘আত্ম-উপলব্ধি’।[৮] ‘Hind Swaraj’-এ গান্ধিজি এ-বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন। এ’ক্ষেত্রে এ-কথাটা বলা বিশেষ প্রয়োজন যে, প্রতিটি ব্যক্তিরই ‘স্বরাজ’ অনুশীলন অত্যন্ত জরুরী তার নিজের ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার জন্য। একইভাবে গান্ধীজীর ‘সর্বোদয়’ ভাবনার পুনরুল্লেখ করে বলি যে, তার কেন্দ্রবিন্দুতেও রয়েছে সর্বাঙ্গীণ বিকাশের ধারণা। সর্ব + উদয় = সর্বোদয়। প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে নয়; প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য বিধানের মাধ্যমেই সর্বোদয়ের লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। গান্ধিজির ‘অহিংসা’ সম্পর্কিত ধারণাও এরকমই এক বিস্তৃত প্রেক্ষিতে বিবেচনা করা যেতে পারে।
তিন
গান্ধি-ভাবনার বৃহত্তর দার্শনিক প্রেক্ষিতটি মনে রেখে প্রকৃতি, পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কে তার অভিমতগুলিকে কম বেশি সূত্রায়িত করা সম্ভবপর হতে পারে। এ’ক্ষেত্রে মনে রাখতে হয় যে, গান্ধি-ভাবনা ও কর্মপ্রবাহের বিশিষ্টতা এখানেই যে কোনও কিছুই তিনি খন্ডিত দৃষ্টিতে না দেখে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখার পক্ষপাতী ছিলেন। অন্যদিকে আবার সব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট উপস্থাপনও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে নি। সে কারণে প্রয়োজন হল সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহের সুচারু চয়নের মাধ্যমে সামগ্রিকতার আধারে সেগুলিকে বুঝে নেওয়ার ধৈর্যশীল প্রয়াস। এক্ষেত্রে আমরা সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হতে গিয়ে প্রথমেই বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত করতে পারি আধুনিক সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি (Gandhi on modern civilization)-র কথা। এধরনের আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে আসে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ সম্পর্কে গান্ধি-ভাবনার কথা। গান্ধিজির প্রস্তাবিত বিকল্প পথ (Gandhian alternatives)-এর আলোচনা এক্ষেত্রে যে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেখানেই তাঁর ‘স্বদেশ’ ও ‘স্বরাজ’ সম্পর্কিত ধ্যান ধারণার ভিত্তিভূমিতে গ্রামোন্নয়ন তথা ‘গ্রাম-স্বরাজ’-এর কথা অবধারিত ভাবেই এসে পড়ে। পরিবেশ সম্পর্কিত আলোচনায় এসব কিছুই আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে যখন আমরা জল, জমি, বনভূমি, জীবজগৎ ও বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে দেখতে পারি। গান্ধিজির দার্শনিক অবস্থানের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আলোচনার সম্পর্ক-বিন্যাসে আমরা আরেকটু বেশি অগ্রসর হতে পারি যদি তাঁর অহিংস নীতির সঙ্গে সম্পদ সংরক্ষণের ভাবনার যোগসূত্রটি চিহ্নিত করতে পারি; অথবা জীববৈচিত্র রক্ষায় তার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারি। অনুরূপভাবে বলতে পারি যে, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক নিরূপণের প্রক্রিয়ায় তিনি যেভাবে আপন ধর্মবোধ তথা জীবনবোধকে মেলানোর চেষ্টা করেছেন, সেগুলিও এ’ক্ষেত্রে আমাদের সহায়ক হতে পারে।
পরিবেশ সম্পর্কে গান্ধিজির অবস্থান নিরূপণে এধরনের আলোচনা অত্যন্ত ব্যাপক ও দুরুহ সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহের মধ্যে কয়েকটি সম্পর্কে সুত্রাকারে আলোকপাতে নিজেদের সীমায়িত রাখবো। সেগুলির মধ্যে মানুষ ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্ককেই তিনি সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। আগেই বলে দিই যে, প্রকৃতি জয় করা নয়; প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য বিধানেই তিনি আগ্রহী ছিলেন। প্রকৃতির মধ্যে তিনি ঈশ্বরের প্রকাশ লক্ষ করেছেন। আজকের পরিবেশবিদরা যাকে ‘Human ecology’ বা মানবিক বাস্তুতন্ত্র বলেন, তার আদি রূপ বোধ করি গান্ধিজির মধ্যে আমরা কমবেশি দেখতে পাই। প্রকৃতি তাঁর কাছে ‘প্রেরণা’-র আধার; তা কখনও ‘শোষণ’-এর উপাদান হতে পারে না। তিনি বলেছেন : “I need no inspiration other than Nature’s. She has never failed me as yet. She mystifies me, bewilders me, sends me to ecstasies.”[৯] তাঁর এই অনুভাবের সামাজিক ভিত্তিভূমিটি লক্ষ্যণীয়। তিনি মনে করতেন যে, প্রতিটি জনগোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে এবং তার সঙ্গে প্রতিনিয়ত মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি। ভিখু পারেখ তাই যথার্থই বলেছেন যে, গান্ধিজি একটি জনগোষ্ঠীর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তথা সংস্কৃতিকে দেখেছেন ‘আত্মা’ (Soul/Spirit) হিসেবে এবং তাঁর ‘প্রাকৃতিক বাস্তু’ (Natural Habitat)-কে দেখেছেন ‘শরীর’ হিসেবে। এই দুই মিলেই তৈরি হয়েছে এক সমগ্র – ‘An indissoluble unity’.[১০]
আধুনিক সভ্যতা সম্পর্কে গান্ধিজির অবস্থান সুবিদিত। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে বলি যে, ‘হিন্দ স্বরাজ’ পুস্তিকাতেই তিনি সবিস্তারে জানিয়েছেন যে, অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন এবং ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মানব সভ্যতার ক্ষেত্রে বিপদজনক বলে প্রতিয়মান হতে পারে। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকেও বিষয়টি দেখতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন যে, কেবলমাত্র ঐশ্বর্যবৃদ্ধিই তার একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। নীতিশূন্য অর্থনীতি কীভাবে মানব সভ্যতায় বিড়ম্বনা সৃষ্টি করতে পারে সেদিকে তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন; বেপরোয়া উৎপাদন ও ভোগবাদের কুপ্রভাব সম্পর্কে তিনি আমাদের সতর্ক করেছেন; এবং পরিবেশের বিপদ সম্পর্কেও আমাদের সচেতন করতে প্রয়াসী হয়েছেন। অবশ্য সে সময়ে এসব বিষয়ে আজকের দিনে ব্যবহৃত বাক্যবন্ধগুলি প্রচলিত ছিল না। গান্ধিজি নিজের মতো করে শব্দ চয়ন করে আপন অভিমান ব্যক্ত করেছেন– সেগুলি ব্যাখ্যা করলে তার মধ্যে এমনকি ‘স্থিতিশীল উন্নয়ন’ (Sustainable Development) -এর ধারণাও খুঁজে পাওয়া যাবে।
প্রসঙ্গত এসেই পড়ে এ বিষয়ে গান্ধিজির প্রস্তাবিত বিকল্প অর্থনীতির কথা, যা নিশ্চিত ভাবেই তাঁর গ্রামীণ পুনর্গঠনের ভাবনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে যুক্ত। সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন বিকেন্দ্রীভূত স্বায়ত্তশাসিত বিকাশের রূপরেখা তিনি অঙ্কন করেছেন; অন্যদিকে তেমনই পরিবেশ-বান্ধব শিল্পায়নের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন। কৃষি ও শিল্পে প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিতর্কের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তবে, এক্ষেত্রে বোধ করি নির্বাচনের বিষয়টিই তাঁর কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। বস্তুতপক্ষে, যথেচ্ছ উৎপাদন বৃদ্ধির ভাবনার বিকল্প হিসেবে তিনি শ্রম নিবিড় উৎপাদন পদ্ধতি (Production by the masses instead of man production)-র সুপারিশ করেন। একইভাবে, নগরায়ণের প্রশ্নেও এক্ষেত্রে গান্ধিজির বক্তব্য প্রণিধান যোগ্য। তাঁর বিচারে এটা হল ‘a process of double drain from the villages’. ভারতের মতো দেশে এই প্রক্রিয়া গ্রাম-জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে বলে তিনি অভিমত জানিয়েছেন (‘Harijan’, 07.09.1934)। উল্লেখ্য যে, গান্ধিজির পরিবেশ ভাবনার মধ্যেই নগর সভ্যতার প্রতি এক ধরনের বিরূপতা লক্ষণীয় ছিল। ‘ভারতবর্ষ গ্রামে বাস করে’ (India lives in the villages)-এমনতরো ভাবনা একদিকে যেমন গান্ধিজির অর্থনীতি ভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ; তেমনই আবার তাঁর পরিবেশ-চিন্তার ক্ষেত্রেও নির্ণায়ক বলেই মনে হয়।
গান্ধিজির সামগ্রিক জীবনবোধের সঙ্গে তাঁর পরিবেশ-চিন্তার শৃঙ্খলা কথা আমরা আগেই বলেছি। সে কথা মনে রেখেই প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ (Conservation of natural resources) এবং অহিংসার নীতির পারস্পরিক যোগসূত্রটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়। একথা সুবিদিত যে, গান্ধিজি সর্বদাই প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেন। মানুষ ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে এটির সুদূরপ্রসারী গুরুত্বের কথা ব্যাখ্যার অবদান রাখে না। গান্ধিজির অহিংস-নীতির অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা আমাদের ভোগবাদী জীবনচর্যা থেকে নিভৃত করতে সহায়তা করে এবং তা একদিকে যেমন সম্পদ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; অন্যদিকে তেমনিই নানা প্রকারের দূষণ প্রতিরোধেও কার্যকরী প্রতিষেধক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হয়। একই ভাবে, গান্ধিজির সত্য ও অহিংসা সম্পর্কে ধারণা জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণেও সহায়ক হতে পারে। বলা হয় যে, জৈন ধর্মের কমবেশি প্রভাব গান্ধিজির জীবনে লক্ষণীয় ছিল, যেখানে প্রকৃতিকে এক ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে দেখার প্রবণতা বিদ্যমান। তদনুসারে জীবনের বিবিধ রূপ (diverse forms of life)-কে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ‘আত্মশুদ্ধি’-র এক প্রকরণ সেখানে স্বীকৃত। গান্ধিজির সত্য ও অহিংসা সম্পর্কিত অভিজ্ঞানের সঙ্গে জীববৈচিত্র্য রক্ষার এক আদি রূপ যেন পরিস্ফুত হয়ে ওঠে।
এ-সব কিছুর পাশাপাশি জন-বিস্ফোরণ, ব্যাপক দারিদ্র, পুনর্নবীকরণযোগ্য সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার, কৃত্রিম বা রাসায়নিক সারের প্রয়োগ, ব্যাপক শিল্পায়ন, অরণ্য ধ্বংস, জলদূষণ বা বায়ু দূষণের মতো যে সব সমস্যার কথা বর্তমানে পরিবেশ চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, গান্ধি ভাবনায় নানা প্রসঙ্গে সে সব কথা ভিন্ন ভাষায় হলেও কমবেশি উঠে এসেছে। সবটা মিলিয়ে পরিবেশ-বান্ধব এক বিকল্প উৎপাদন-পদ্ধতি এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাপনাই এ ক্ষেত্রে গান্ধি-ভাবনার মূল প্রেরণা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে।
চার
উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে পরিবেশ বিষয়ে গান্ধিজির অবস্থান ব্যাখ্যায় বা তাঁর অবদান নিরূপণের প্রয়াসে স্বাভাবিকভাবেই পরিবেশ চেতনার বর্তমান সময়ের হাল-হকিকত কম-বেশি নির্ধায়ক হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে প্রেক্ষাপটগত ভিন্নতার দিকটি অনেক সময় চাপা পড়ে যায়। কিন্তু এর ফলে একদিকে যেমন গান্ধিজি সম্পর্কে সুবিচার বাধা প্রাপ্ত হয়; তেমনিই অসম্ভব হয়ে পড়ে এ-বিষয়ে কোনও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা। আমাদের মনে রাখতে হয় যে, পরিবেশ বিষয়ে গান্ধি ভাবনার বিকাশ ঘটেছিল এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে, যখন গোটা পৃথিবীতেই এ-সব নিয়ে তেমন কোনও গভীর আলোচনার সূত্রপাত ঘটেনি। এ’ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় সংযোজনী এটাই যে, আমাদের দেশের বিচারে সেটি ছিল ঔপনিবেশিক শাসনকাল এবং তার প্রতিক্রিয়া সজ্ঞাত ভাবনার প্রতিফলন গান্ধি-চেতনায় সবিশেষ লক্ষণীয় ছিল। একই সঙ্গে মনে রাখতে হয় এ’দেশে জাতীয় আন্দোলনের প্রেক্ষাপটটি, যা আমাদের বিকল্প ভাবনা গড়ে তুলতেও বেশ কিছুটা প্রণোদিত করেছিল। বলা বাহুল্য যে, এ-সব নিয়েই পরিবেশ সম্পর্কে গান্ধি ভাবনার কলেবরটি নির্মিত হয়েছিল, যেখানে আধুনিক পরিবেশ চিন্তায় ব্যবহৃত শব্দবন্ধগুলি (terminologies) সেভাবে না এলেও বেশ কিছু অগ্রগামী ভাবনার স্ফুরণ লক্ষণীয় ছিল।
পরিবেশ সম্পর্কে গান্ধি ভাবনার অনুশীলনে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল তার সামগ্রিকতার দিকটি; যার মূল কথা এই যে, পরিবেশের সঙ্গে সংপৃক্ত যে-কোনও বিষয়ে তাঁর অবস্থানকে বিচার করতে হয় তাঁর সামগ্রিক জীবন দর্শনের আলোকে – কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় হিসেবে নয়। স্বাভাবিকভাবেই গান্ধি ও গান্ধিবাদ, সর্বোদয়, সত্যাগ্রহ, অহিংসা, স্বরাজ ইত্যাদি বিষয়ে গান্ধিজির অভিজ্ঞান পরিবেশ সম্পর্কিত আলোচনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। পরিবেশ-ভাবনায় ‘গান্ধিজির-বিকল্প’ (Gandhian alternative)-এর আলোচনায় একই ভাবে ‘গ্ৰাম স্বরাজ’ বা গ্রামোন্নয়ন সম্পর্কিত ভাবনাগুলির কথা এসেই পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই আলোচনার পরিসরটি অনেকটাই বিস্তৃত হয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে গান্ধিজির অহিংস নীতির কথা বলা যেতে পারে। গান্ধি-ভাবনায় এটি কেবলমাত্র রাজনীতি ক্ষেত্রের বিষয় নয়; সামগ্রিক বিচারে তা পরিবেশ-বান্ধবও। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বর্তমান সময়ের ‘উন্নয়ন ও উচ্ছেদ’ (Development and displacement) সম্পর্কিত বিতর্কের নানা খুঁটিনাটি; যেখানে জল, জঙ্গল, ভূমি ধ্বংস করা নয়; পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ তো বটেই, সামগ্রিকভাবে প্রতিটি প্রাণের স্পন্দনকে অনুভব করে, সংশ্লিষ্ট সকলের বাঁচার অধিকার ও বিকাশের দাবিকে স্বীকার করে এগিয়ে চলার কথা বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে, এসে পড়ে তাঁর বিকল্প উন্নয়ন ভাবনার কথা, যেখানে উন্নয়ন বলতে ব্যাপকভাবে সবুজের ধ্বংস সাধন করে বৃহদায়তন কলকারখানা স্থাপন, সুউচ্চ ইমারত নির্মাণ বা রাস্তাঘাট-গাড়িঘোড়া ইত্যাদিকেই না বুঝিয়ে আগামীর লক্ষ্য স্থির দেখে এগিয়ে চলার যে লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছে তা বর্তমানের ‘স্থিতিশীল উন্নয়ন’-সম্পর্কিত ধারণারই আদি রূপ বলে মনে করা হয়। এখানেই এসে পড়ে ভোগবাদের বিরুদ্ধে তাঁর জেহাদের কথা; আধুনিক শিল্পভিত্তিক ব্যবস্থার প্রতি তাঁর বিরাগের কথা এবং সর্বোপরি পরিবেশ-বান্ধব গ্রাম-সমাজ গড়ে তোলার প্রতি তাঁর আকুতির কথা।
প্রসঙ্গত বলি যে, ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে কুমারাপ্পার নেতৃত্বে পরিবেশ সম্পর্কে গান্ধিতত্ত্ব যেন রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। তিনি এবং মিরা বেন বলার চেষ্টা করেন যে, বড় বড় বাঁধের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণের উদ্যোগের তুলনায় ছোটো প্রকল্প গুলি নানা দিক থেকে অনেক বেশি কার্যকরী; রাসায়নিক সারের তুলনায় জৈব সারের ব্যবহার অধিকতর কাম্য; অরণ্য সম্পদ সংরক্ষণ তাৎক্ষণিক লাভের তুলনায় অনেক বেশি জরুরী। উল্লেখ্য যে, ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ কুমারাপ্পাকে ‘The Green Gandhian’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, আধুনিক ভারতে পরিবেশ সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনায় তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ। কুমারাপ্পার পরবর্তী সময়কালেও পরিবেশ সম্পর্কিত গান্ধি ভাবনার অনুশীলনে যাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ তাঁদের মধ্যে অনিল আগরওয়াল, প্রধান শেঠ, বন্ধনা বা, রামচন্দ্র গুহ, ডেভিড আর্নন্ড প্রমুখদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[১১]
পরিশেষে বলি যে, পরিবেশ সম্পর্কে গান্ধি ভাবনার ব্যাপকতা সত্বেও গান্ধিজিকে সেই অর্থে পরিবেশবাদী বা পরিবেশবিদ হিসেবে চিহ্নিত করার কিছু সমস্যা রয়েছে। সুসংবদ্ধ ভাবে পরিবেশ সমস্যা নিয়ে তিনি কখনই তেমনভাবে আলোচনা করেননি; তাঁর সময়কালে তেমন কোনও প্রেক্ষিতও রচিত হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই, পরিবেশ আলোচনায় ব্যবহৃত শব্দবন্ধগুলি (terminologies) ও তাঁর আলোচনায় লক্ষনীয় হয়নি। পরিবেশের কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে। পরিবেশ প্রসঙ্গে তাঁর আলোচনায় অনেক সময়ই বৈজ্ঞানিকতা বা যুক্তিবোধ প্রাধান্য পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এতদসত্ত্বেও, তাঁর কাছেই আমরা পেয়েছি ‘পরিবেশ চেতনা’-র প্রথম পাঠ; স্থিতিশীল উন্নয়নের ধারণারও তিনিই যেন পথিকৃৎ। ভারতে পরিবেশ আন্দোলনগুলি– তা সে চিপকো বা নর্মদা বাঁচাও যাই হোক না কেন – তার অনুপ্রেরণাও এসেছে গান্ধি-ভাবনা থেকেই। তাই সময় এসেছে পরিবেশ সম্পর্কে গান্ধি-ভাবনার সুগভীর অনুশীলন এবং বর্তমান সময়ের উপযোগী গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে পথের নিশানা অনুসন্ধানের।
সূত্র নির্দেশ :
১. এ-বিষয়ে বিশদ আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য : দেবনারায়ণ মোদক, ‘সার্ধশতবর্ষে গান্ধিজি : প্রাসঙ্গিক ভাবনা’, কথাকৃতি, (পরিবেশক : একুশ শতক, কলকাতা), ২০২১, পৃষ্ঠা : ১৩-২০
২. পূর্বোক্ত : ১৩-২০
৩. বিশদে আলোচনার জন্য দেখুন : দেবনারায়ণ মোদক, ‘বিশ্ব পরিবেশ ভাবনা : স্টকহোম থেকে রিও এবং জোহানেশবার্গ’, বিনয় চন্দ্, তপন মিশ্র ও সুদীপ্ত মাইতি (সম্পাদিত), পরিবেশ প্রসঙ্গ, প্রথম খন্ড, IDEA, ২০০৬, পৃষ্ঠা : ৩২৭-৩২ (সংকলনে অন্তর্ভুক্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লেখকের আরও দুটি লেখাও এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হতে পারে।
৪. অম্বরীষ মুখোপাধ্যায়, ‘গান্ধি ভাবনায় প্রতিবেশ প্রসঙ্গ একটি প্রাথমিক অনুসন্ধান’, সুজিত সেন (সম্পাদিত), গান্ধিজি : অন্তহীন অন্বেষণ , দেশ প্রকাশন, কলকাতা, ২০১৪ পৃষ্ঠা : ২২০-২১
৫. Ramjee Singh, ‘Gandhian vision’, Manak publication, Delhi, 1998, p-129
৬. Manjula Upadhaya, ‘Mahatma Gandhi’s perspective on environment’, International Journal and Scientific and Innovative Research Studies, vol. 6, issue 3, March 2018 (online edition)
৭. J.C. Kumarappa, ‘Economy of Permanence’ (with a forward by M.K. Gandhi), Sarva Seva Sangh Prakashan, Vanarasi, 1997 (first published : 1945).
৮. বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : Antony J. Parel, ‘The Doctrine of Swaraj in Gandhi’s Philosophy’ in Bhikhu Parekh and Upendra Baxi. (ed.), Crisis and Change in Contemporary India, Sage, New Delhi, 1995, p-57-58 ( আরও দেখুন : দেবনারায়ণ মোদক, প্রাগুক্ত, পৃ : ২১-২২
৯. Quoted in Rajnarayan Tiwari, ‘Gandhi as Environmentalist’, Indian Journal of Medical Research, April 23, 2019 (online edition).
১০. Bhikhu Parekh, ‘Gandhiji: Political Philosophy’, Macmillan, London, 1989 (উদ্ধৃত অম্বরীষ মুখোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, , পৃ : ২২৬
১১. কুমারাপ্পার বইটির কথা আমরা আগেই বলেছি। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ-র পরিবেশ প্রসঙ্গে একাধিক বইএর কথাও সুবিদিত। বর্তমান প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ‘Anthropologist among the Marxists and other Essays’, Oriaent Blackswan, New Delhi, 2001, p-81-86
পরিবেশ প্রসঙ্গে উল্লিখিত অন্যান্য লেখকদের রচনাগুলিও এক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।