সাধন চট্টোপাধ্যায়
‘পুঁজিনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ চেতনা : বাংলা কথাসাহিত্যে প্রতিফলন’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লেখায় অনুরুদ্ধ হয়েছি। বুঝিনি তখন, প্রকৃতপক্ষে একটি হেঁয়ালির আবরণ সরাতে গিয়ে টের পেলাম, বিষয়টি বিচিত্র এবং যুক্তি ও তথ্যের পরিকাঠামো হিসেবে গড়ে তোলা আয়াসসাধ্য কাজ। বাঙালি সমাজ কোনো কালেই সৌন্দর্যবোধ, পরিবেশ চেতনা, গণস্বাস্থ্য কিংবা অর্থনৈতিকভাবে সমবায়িক চিন্তায় অভ্যস্ত ছিল না। সম্ভবত এর কারণ, বাংলা প্রেসিডেন্সিকে কেন্দ্র করেই, নতুন ভূমিব্যবস্থাপনায়, সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই; তাকে না ভেঙে, উপনিবেশিক শক্তি একটি সামঞ্জস্য কায়েম করে নিয়েছিল, যার এপিসেন্টার কলিকাতা। ঊনবিংশ শতাব্দীর যা কিছু সংস্কার আন্দোলন — পশ্চিমি শিক্ষা, ধর্ম ও যুক্তিবাদিতা — সবই আবর্তিত কলকাতাকে কেন্দ্র করে। এমনকি, রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী দেশ স্বাধীন বা ইংরেজ তাড়ানোর পক্ষে যতখানি সক্রিয় ও আত্মত্যাগ করেছিল, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জীবনযাপনের মানোন্নয়নের দিকে ছিটেফোঁটাও নজর দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ খেদ ও দুঃখে এরকমের মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন, কালের নিয়মে ইংরেজ একদিন এ দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে, কিন্তু কোন দেশটা তারা রেখে যাবে? অশিক্ষিত, নিরন্ন পশ্চাৎপদ চিন্তার বিপুল সংখ্যক ভারতবাসী।
ভাবা যায়, দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উজ্বল আত্মত্যাগের মধ্যেও, ঘন ঘন মন্বন্তর, মারিতে – কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া থেকে নানা প্রকারের ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া বাহিত রোগে গ্রামকে গ্রাম উজার হয়ে যেত। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ত ভূতের নানা কল্পকাহিনি। নারীদের তো ‘কুড়িতেই বুড়ি’ দেগে দেয়া হত, অতি সন্তান প্রসবের ভারে নানা প্রকারের রোগ-ব্যাধির কথা (সূতিকা, ভূতে ধরা নানা প্রকার জটিল স্ত্রী-রোগ), স্বল্পায়ু, পুরুষের বহুবিবাহ ইত্যাকার ব্যবস্থার কথা সেকালের সাহিত্যে উল্লেখ পাই।
আজ, সে সব সামাজিক ব্যবস্থা নিয়ে ভাবলে, মনে হয় পরিবেশকে নিয়ে, পরিবেশচেতনাকে আশ্রয় করে, আমাদের আদিবাসী সমাজ তাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে যতখানি সচেতন, আমরা তার ভগ্নাংশ ঐতিহ্যও বহন করিনি।
এই কলোনিয়াল শাসিত চেহারাটা নিয়ে আমরা শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরাও সচেতন ছিলাম না। তাই সত্যেন দত্তের ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি’ কবিতাটিকে কবির অন্তর্ব্যঙ্গের ব্যাপারটা ভুলে, এটিকে বাঙালির গৌরবগাথা হিসেবে গ্রহণ করি। অনুপস্থিত জমিদাররা, নায়েব-গোমস্তাদের হাতে জমিদারি শাসনের ভার ছেড়ে দিয়ে, কলকাতার বাবু কালচারকে পুষ্ট করেছিল, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ও কিছুটা আর্থিক সচ্ছল বা গ্রামের ঘর-বাড়ি কারও জিম্মায় রেখে, কলকাতাকে আশ্রয় করত আর গ্রামগুলো হয়ে থাকত নির্জীব, মৃতপ্রায়। রোগ-ব্যাধি, অকালমৃত্যু ও স্বল্পপরমায়ু নিয়ে তাঁদের জীবনযাপন হত মলিনতার মধ্যে চাপা, চাঞ্চল্যে ভরা। পরিবেশের এই অদ্ভুত সবের ছবি পাই; শরৎচন্দ্র বা বিভূতিভূষণের সাহিত্যে। রাজা, মহারাজা, জমিদার বা বাবুরা শিকারের নামে নির্বিকারে পাখি, পশু হত্যা করত। কোন প্রজাতি কীভাবে বিলুপ্ত হচ্ছে — এসব ভাবনাচিন্তা ছিল সুদূর পরাহত। বরং, বীরত্ব, ও রোমাঞ্চকর হিসেবে শিকার কাহিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় শাখা হয়ে উঠেছিল।
অন্যদিকে, ঔপনিবেশিক পুঁজির অনুপ্রবেশে, চা-বট-খনিশিল্পের রমরমায়, রেললাইন পত্তন, বন্দর নির্মাণ, কাঁচামালের রপ্তানির সুবিধার্থে নির্বিচারে সংগঠিত হল বনধ্বংস ও আদিবাসী উচ্ছেদ। ভারতের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চলে চলেছিল নির্বিচারে ফ্লোরা ও ফণা ধ্বংসের মুনাফার খেলা।
স্বাধীনতার পর সরকারিভাবে জমিদারি উচ্ছেদ, খনি, ব্যাংক জাতীয়করণের পর, আইনগতভাবে বন্যপ্রাণী রক্ষা, বন সংরক্ষণ যে কোনো শিকারকে অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণার মধ্য দিয়ে কিছু কিছু সরকারি উদ্যোগে পরিবেশ চেতনা রক্ষার প্রচেষ্টা দেখা গেল। পাশাপাশি, সরকারের উদ্যোগে কিংবা তাদের সহায়তায় চলতে থাকল নদীতে বাঁধ দেওয়া, পাহাড় ও বন কেটে জলবিদ্যুৎ নির্মান কেন্দ্রস্থাপন, আদিবাসী উচ্ছেদ, রেলপথ ও সড়ক নির্মাণে জলাভূমি ভরাট করা বা নির্বিকারে বৃক্ষছেদন। যদিও আমরা জানি, ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইড বা কার্বন মনোক্সাইড-এর আধিক্য ঘটায়, ব্যক্তিগতভাবে নানা প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছিল। বলতে গেলে, ব্যক্তিস্তরে পরিবেশ সচেনতা সে-কাল থেকেই।
সরকারি তরফে বন্যপ্রাণী রক্ষা, গাছ কাটা বন্ধ করা, জলাভূমি সংরক্ষণ, পরিবেশ দপ্তর পরিচালনা, বৃক্ষরোপন, অরণ্য আইন প্রয়োগ ইত্যাদি উদ্যোগকেই সম্ভবত বলা যেতে পারে পুঁজিনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ চেতনা। এ নিয়ে, বিশিষ্ট পরিবেশকর্মী জয়া মিত্র তাঁর শাস্ত্র বিকল্পিত গ্রন্থ ‘সহস্র ধারা’-তে (লালমাটি) চমৎকার একটি মতামত রেখেছেন।
আজকের ভোগবাদী, বাজার সর্বস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা বা দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রনীতি নির্ধারক বা শাসকের পছন্দ হতে পারে না। এই সুন্দর সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলার দৃষ্টিভঙ্গি তাদের স্বার্থের পরিপন্থী। অথচ ‘গ্রিন্স’ ‘গ্রিনপিস’ থেকে ‘নর্মদা বাঁচাও’ ‘চিপকো’ বা তেহরি বাঁধ বিরোধী আন্দোলন সারা পৃথিবীতে আজকে এতবড়ো একটা শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছে যে একে একেবারে অগ্রাহ্য করাও যায় না। এই সব আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে মুখোমুখি সংগ্রাম অপরিহার্য। তাই, পরিবেশ দূষণ-এর দৃষ্টিভঙ্গিতেও দুটি আলাদা আলাদা চিন্তাধারা গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, যুগযুগান্তরের সঞ্চিত বরফ গলে উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্র-নদীর জল স্তর বৃদ্ধি, সুন্দরবন সহ তীরবর্তী এলাকা ডুবে যাওয়া, আকাশের ওজোনস্তর ফুটো হয়ে পৃথিবীর বুকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি প্রবেশ থেকে কৃষি-চাষ-ধান-জিনপরিবর্তন-কীটনাশক ইত্যাদির অবাধ ব্যবহারে ফ্লোরা ফণা ধ্বংস হয়ে পৃথিবী নামক গ্রহটির অস্তিত্বই বিপন্ন। মাটির তলা থেকে অবাধে সম্পদ লুণ্ঠন, বনজাতি গোষ্ঠীর উচ্ছেদ, ভূগর্ভস্থ জলস্তরের নিম্নগতি, আর্সেনিক আক্রান্ত হওয়া, মরু অঞ্চল বা উষর ভূমির ক্রমশ বিস্তৃতি, আবহাওয়া বিপর্যয়, ধ্বংস, বন্যা — পরিবেশ দূষণ বা প্রকৃতির ভারসাম্য ছিন্ন হয়ে পড়ার পেছনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, শাসকশ্রেণি এবং গ্লোবায়িত পুঁজির একটি যৌথ যোগসাজুয্য বনাম জনগণের লড়াই।
জয়া মিত্র উক্ত গ্রন্থে, তাই বলতে চাইছেন, “… সুতরাং শাসকরা তৈরি করে তুলেছেন নিজেদের সুবিধামতো এক পরিবেশবাদী আন্দোলনও। সেই আন্দোলনের নেতা বা ‘কর্মা’-রা পশু মাংস বর্জন করেন, হার্বল উৎপাদনে সৌন্দর্যচর্চা করেন, যেগুলো তৈরি করতে হিমালয় পাহাড় বা আফ্রিকার অরণ্যের কোনো বুনো গাছের বংশ নিঃশেষ হয়ে যায়। সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠানে চারাগাছ রোপণ করেন (যেগুলো মালিরা দেখাশুনা করবে)। ভাল্লুকওলা, বাঁদরওয়ালা, বাজিকর, গরুর গাড়ির গাড়োয়ানদের মতো লোকেরাই এদের প্রায় প্রধান শত্রু। এঁরা কিন্তু কিছু বলেন না যখন বহুজাতিক কোম্পানির দেওয়া কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় ফসল, সাপ, ব্যাং, ছোটোমাছ, পাখি প্রজাতি যন্ত্রণায় ছটফট করে মরে যাচ্ছে।” সারা পৃথিবী জুড়ে এইসব রাসায়নিক কীটনাশক ওষুধগুলো তৈরি করে বহুজাতিক সংস্থাগুলো। দেশেদেশে এদের বিস্তৃত শাখা। বিশেষত কৃষিপ্রধান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। এই সব কীটনাশকের ব্যবহারে মাটি উর্বরা শক্তি হারাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ক্রমাগত। তবু, সরকারের তরফ থেকে কড়া কোনো বিধিনিষেধ তো নেই-ই, গণস্বাস্থ্যের ওপর প্রবল বিষাক্ত প্রভাবকে উপেক্ষা করে, সরকার এদের আইনি সাহায্য দিচ্ছে। মনে করুন, ১৯৮৪ সালের ভূপাল গ্যাস লিক কাণ্ডের কথা। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে, বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে আরও বেশি — তবু কেন্দ্রীয় সরকার তৎকালে কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা-তো নেয়ই-নি, উপরন্তু কর্মকর্তাদের দেশ থেকে পালিয়ে যাবার পথ করে দিয়েছে।
নর্মদা নদীর ওপর বাঁধ দিলে, পরিবেশের বিপর্যয় রুখতে জনগণ আন্দোলনে নামলে, সরকার নেতা-নেত্রী এবং অন্যান্যদের পেছনে পুলিশ লেলিয়ে নানা অত্যাচার চালালেও, ক্ষমতাবানরা রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় বাঁধ নির্মাণ করেন। তাহলে এটা পরিষ্কার, পরিবেশচেতনাকে ঘিরে আন্তর্জাতিকভাবে দুই বিপরীত শক্তি ক্রিয়াশীল। পুঁজি ও মুনাফা একদিকে, অন্য পক্ষে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য, গড় পরমায়ু বৃদ্ধি এবং পৃথিবীর গড় উষ্ণতাকে না-বাড়তে দেয়া।
দ্বিতীয় ধারার পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তি ও পুঁজির দ্বন্দ্বের জন্যই ১৯৭২ সাল থেকে পরিবেশ বিপর্যয় রুখতে যে বসুন্ধরা সম্মেলনগুলো হচ্ছে তা কোনো মিলিত প্রচেষ্টার সর্বসম্মতিতে পৌঁছাতে পারছে না। বার বার ধনী দেশগুলো আপন আপন পুঁজিওয়ালাদের স্বার্থরক্ষায় গরিব ও তৃতীয় বিশ্বের ঘাড়ে কালনেমির লঙ্কা ভাগ করতে চাচ্ছে। গ্রিন হাউস গ্যাস কমানোর জন্য যে খরচ, তাতো শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই বেশিরভাগটা বহন করতে হবে।
এ-ছাড়াও, গ্লোবায়ন বা বিশ্বপুঁজির চরিত্র বদলে যাওয়ায়, বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলো অদ্ভুত দাদাগিরি করতে থাকলে, বসুন্ধরা সম্মেলনগুলো নিছকই ঢক্কানিনাদে পরিবর্তিত হচ্ছে। একটি উদাহরণ তুলে দিচ্ছি :
“… সর্বশেষ বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন (COP) অনুষ্ঠিত হল ইংল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর। যার পোশাকি নাম — কনফারেন্স অফ পার্টিজ। ২০৩০-২০৫০ সালের মধ্যে কীভাবে কার্বন নিঃসরণ ‘শূন্যে’ নামানো যায় তার পরিকল্পনা গ্রহণ ও শপথ (?) নেওয়ার লক্ষ্যে বিশ্বের ২০০ টি দেশ এই জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিল। কি পেলাম আমরা? বাতাসে গ্রিন হাউস গ্যাস জমা করার ক্ষেত্রে আমেরিকা ও চিনের পর ভারত হল তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। এই সম্মেলনে বিশ্বের ৮০ টি দেশের রাষ্ট্রনেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন— ‘২০৩০ সালের পর আর গাছ কাটা বন্ধে এবং বাতাসের মিথেনের (যে গ্যাসের দূষিত করণের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি, তবে স্থায়িত্ব কম) নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা হবে’। অর্থাৎ খনিজ সম্পদ উত্তোলন, তথাকথিত ছিন্নমস্তা উন্নয়ন ও নগরায়নণের নামে নির্বিকারে বৃহৎ বনানী সহ অরণ্য ধ্বংস চলতেই থাকবে ২০৩০ পর্যন্ত? তারপর আমি আপনি টিকে থাকব তো নীল গ্রহে? আরও চমক আছে। পরিবেশ দূষণকারী তিন বৃহৎ দেশ— রাশিয়া, চিন ও ভারত এই প্রসঙ্গে কোনো উচ্চবাচ্যও করল না।” ( সন্তোষ সেন, ‘এবং অন্য সখ্য’, অগাস্ট, ২২)
দ্বিতীয় একটি উদাহরণ, মার্কিনি মুদ্রা ডলার-এর আধিপত্য সম্পর্কে :
“সোনা থেকে ডলারকে বিচ্ছিন্ন করা হল তেল অর্থনীতির স্বার্থে, ডলার দুর্বল হলেই ক্রুড অয়েলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এবং মুক্ত বাণিজ্যের সুযোগ নিয়ে ডলার বেগবান হওয়ায় তেল অর্থনীতির বিকাশ ঘটল সারা বিশ্ব জুড়ে, ডলার সাম্রাজ্যের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। পেট্রোলিয়াম বাইপ্রোডাক্টের হরেক কিসিমের ব্যবসা ছড়িয়ে দেয়া হল বিশ্বজুড়ে। প্রতি দেশের কোনায় কোনায় প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যের কারখানা গড়ে উঠল অবাধ গতিতে। তেল অর্থনীতির বাড়বাড়ন্তের সাথে পুরো পৃথিবীটাই জড়িয়ে পড়ল কার্বনের জালে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ল ভূ-উষ্ণায়ন, বায়ুর ও জলের দূষণ। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল স্থলভাগ ও সমুদ্রের মধ্যে বায়ু চলাচলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তাপ বিকিরণ করতে না পেরে অনেক রাত পর্যন্ত সমুদ্রের জল আর ঠান্ডা হতে পারল না। এর ফলে কী ঘটল! এর আগে আমাদের মতো দেশগুলোর স্থলভাগ ও সমুদ্রের জল তাপ বিকিরণ করে দিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রায় একটা ভারসাম্য রক্ষা করত; কিন্তু ব্যাঘাত ঘটল এই প্রক্রিয়ায়। … উদার অর্থনীতির সুযোগে ফিনান্সপুঁজি খুলে-ফেঁপে উঠল এবং বড়ো বড়ো শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কারখানা গুলোকে ভেঙে টুকরো করে উৎপাদন সামগ্রী ও প্রক্রিয়া ছড়িয়ে দেওয়া হল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে।” (প্রাগুক্ত)
তাই, যখন মাঝেমধ্যে আমরা সরকারি নোটিশ পাই বাজারে প্লাস্টিক বন্ধ এবং দু-চার দিন প্রশাসনের তরফ থেকে ধর-পাকড়ও চালানো হয়, প্লাস্টিক লবির বিশ্বজোড়া ক্ষমতার কথা যাদের জানা আছে, তারা মিটিমিটি হাসেন। এ-নাটক কত দিন চালাতে পারবে সরকার? তাই দেখি, আমরা চারপাশে প্লাস্টিকের ফাঁদে আটকে পড়ছি এবং আমাদের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যও প্লাস্টিক পেটে চালান দিয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
এইসব গভীর সংকট থেকে মুক্তির পথ কোথায়? অবশ্যই এর অন্যতম নিয়ামক শক্তি জনগণের সচেতনতা ও সক্রিয় আন্দোলন। এখানেই বিষয়টি সমাপ্তি টানলে, অতি সরল কিছু দায়সারা ধোঁয়াশা থেকে যায়। অনেকেই প্রশ্ন করেন ‘সক্রিয় আন্দোলন’ বলতে — কী তার পরিকাঠামো! তাই, পরিবেশ আন্দোলন যাঁরা করছেন, বা পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ভাবনা ধার করে বলছি, ‘এর সমাধানে প্রকৃতির পুনরুদ্ধারের জন্য প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রেখে ন্যূনতম উৎপাদনের প্রয়োজনে সহযোগিতামূলক এক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এখন থেকেই মাঠে নেমে পড়ব?’ কৃৎকৌশল বা প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, গ্রিন টেকনোলজি, টেকসই উন্নয়নের নামে পুঁজির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের মধ্যে ঘুরপাক খেলে কেবলই নতুন নতুন জায়গায় বিনিয়োগ করে প্রাকৃতিক সম্পদ যথেষ্ট লুট করে চলতে থাকবে পুঁজির সঞ্চয়ন ও বাড়তে থাকবে মুনাফা বৃদ্ধির হার, পরিবেশ সমস্যার কোনও সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই বিপাকীয় ফাটলের সমাধানে ‘প্রোডাকশন অ্যান্ড রিপ্রোডাকশন অফ রিয়েল লাইফ’ এই স্লোগানকে সামনে আনতে হবে অত্যন্ত জোরের সঙ্গে সফল রাজনৈতিক দল ও প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষকে। কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাঁদের শিল্পকর্ম, নাটক, গান ও কবিতার সুর-লয়-ছন্দে তুলে আনুন পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়ানক চালচিত্রকে; পরিবেশ বাঁচানোর লড়াইকে ছড়িয়ে দিন দিক-দিগন্তে। তবেই বাঁচবে তামাম বাস্তুতন্ত্র ও বাঁচবে মানব সভ্যতা।
আমাদের বাঙালি সমাজে আগেই উল্লেখ করেছি, গণস্বাস্থ্য ও পরিবেশচেতনা সম্পর্কে ধ্রুপদী ধারণা ছিল না। লেখক-কবিরা তো সমাজমানসকেই বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেন। তাই, স্বাধীনতার পূর্বে, এমনকী উত্তর কালের ষাট-সত্তর দশক অবধি পরিবেশ সংক্রান্ত কোনো সার্বিক সচেতন লেখা বিশেষ পড়িনি। আজ যেমন কোভিড-১৯ নিয়ে গল্প, কবিতা — এমনকি নানা বিশ্লেষণাত্মক লেখা চোখে পড়ছে, প্রায় একশো বছর আগের স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে তৎকালীন কবি-লেখকরা তেমন কিছু সাক্ষ্য রেখে যাননি। শুধু, ‘জীবনস্মৃতি’-তে উল্লেখ পাই, কলকাতায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবে ঠাকুরবাড়ির পরিবার কিছু দিনের জন্য শহর ছেড়ে মফস্সলে বাস করতে চলে গেছল। একদল কোন্নগরের বাগানবাড়িতে, দ্বিতীয় দল গেছল পেনেটির বাগানবাড়িতে। এগারো বছরের বালক রবীন্দ্রনাথ টানা আটচল্লিশ দিন ছিলেন সেখানে।
তবে অরণ্য, বৃক্ষ, সবুজের মধ্যে যে অব্যক্ত প্রাণ — তাকে ভালোবাসা, বাঁচিয়ে রাখা নিয়ে দার্শনিক লেখা রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর বা পল্লিকবি হিসেবে খ্যাত বেশ কিছু স্রষ্টার কলমে রচনার ফ্লোরা ও ফণাকে চিহ্নিতকরণ ও ভালোবাসার প্রসঙ্গ এসেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘বলাই’ গল্প, বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ উপন্যাস কিংবা ‘বুধির ঘরে ফেরা’, ‘মাকাল লতা’ গল্পের মধ্য দিয়ে মানুষ, পশু, অরণ্য বা বৃহৎ একটি জীবনলীলার কথা বলা হয়েছে। এমনকী, কিছু কিছু গ্রুপ থিয়েটারও দু-চারটে প্রযোজনা করেছে, যেখানে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ বিপর্যস্ত পরিবেশের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। মনে পড়ছে, বহুরূপী করেছিল উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের একটি নাটক ‘ধৃতবানসি’। তবে সত্তর-আশির দশক থেকে যেখানে পরিবেশ রক্ষা ও পুঁজির অনুপ্রবেশের দ্বন্দ্ব সোচ্চার হয়েছে, কৃষি, নদীবাঁধ, বায়ু ও জলদূষণ, পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বৃদ্ধি, কৃষিতে গ্রিন রেভলিউশনের ঢক্কা নিনাদের মধ্য দিয়ে যেভাবে ঘটনার কার্যকারণের সম্পর্কগুলো বিশ্বরঙ্গমঞ্চে একটি রাষ্ট্র ও বিশেষ শ্রেণির স্বার্থদ্বন্দ্বের রূপ পেল, বাংলা সাহিত্যে ভিন্নধারার কিছু লেখক এগিয়ে এসেছেন তাদের সৃষ্টিতে সে-সবের প্রতিফলন ঘটাতে।
আশি-নব্বইয়ের দশকেই, আর্সেনিক সমস্যা ও ধান, সেচ ইত্যাদিতে কর্পোরেট পুঁজির সমস্যা ও সাধারণ মানুষের আতঙ্ক, মৃত্যু ও লড়াই নিয়ে বর্তমানের নিবন্ধকার লিখেছিলেন ‘জলতিমির’ উপন্যাস। পাঠকের কাছে খুবই আদৃত হয়েছিল যা। আর্সেনিক নিয়ে বিশ্ব পুঁজির ভূমিকাকে ‘জলতিমির’ নির্দেশ করেছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এবং মুনাফার লোভে বনধ্বংস ও পাহাড় পর্বত খোঁড়াখুঁড়ির ফলে, বন্যপ্রাণীদের আশ্রয় সংকট ও স্বভাবরীতির পরিবর্তনে জনপদে দেখা দিচ্ছে নানা সংকট। সম্প্রতি, কয়েক দশক ধরে দলমার হাতির দল বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর অঞ্চলের জনপদ এলাকায় ঢুকে ঘরবাড়ি ভাঙা, ফসলের খেত নষ্ট, এমনকী দাঁতালের হাতে প্রাণ পর্যন্ত হারাতে হচ্ছে মানুষজনের। এর অন্যতম কারণ, দলমা পাহাড়ে মিনারেলের সন্ধান ও ইউরেনিয়াম খননের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া। এ নিয়ে কিন্নর রায়-এর উপন্যাস ‘মেঘপাতাল’ ও বাঁকুড়ার লেখক নন্দ চৌধুরীর ‘বৃংহণ’ উপন্যাসে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে।
এছাড়াও পরিবেশদূষণ সংক্রান্ত তথ্য সম্বলিত বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশ পাচ্ছে ইদানীং। এমনকী, বেশ কিছু লিটিল ম্যাগাজিনের পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে, ক্রোড়পত্র বা বিশেষ সংখ্যা আমাদের হাতে আসছে। এছাড়াও ১৯৭২ সালের প্রথম বসুন্ধরা আন্দোলন থেকে সাম্প্রতিক গ্লাসগোয় অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনের খবর ও বিশ্লেষণ নিয়ে আমাদের ভারত রাষ্ট্রের জলবায়ু ও পরিবেশনীতিরও খোঁজখবর পাচ্ছি। তাতে, আশান্বিত হওয়ার চাইতে বেশিরভাগটাই দুর্ভাবনার কথা। আমাদের দেশের পরিবেশ আন্দোলন ব্যাপক জনগণের সমর্থনে এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি, যাতে রাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। অর্থনীতিবিদ থেকে বিজ্ঞানকর্মী — নানা বিশেষজ্ঞদের সাবধানবাণীকে শাসক শ্রেণি বা রাজনৈতিক সমাজ সযত্নে গুরুত্ব দিতে নারাজ। পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের পীঠস্থান লোকসভা ও রাজ্যসভার অধিবেশনগুলোয় জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রীদের ক্রিয়াকলাপ শুধু সস্তা সার্কাসকে মনে করায়। হই-হট্টগোল, ওয়েলে নেমে আসা এবং অধিবেশনে মুলতুবি রাখার মতো ব্যতিক্রমগুলোই এখন নিয়মে রূপান্তরিত হয়েছে। অথচ, দেশের মিলিয়নপতিদের কোনও খামতি ঘটছে না। ইন্টার গভর্নমেন্টোল প্যানেল অফ ক্লাইমেট চেঞ্জ বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য অদিতি মুখোপাধ্যায় তাঁর এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে লিখেছেন : “বিজ্ঞানীরা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, আমরা যদি ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ অন্তত ৪.৫ শতাংশ কমাতে না পারি, তাহলে আমরা বিশ্ব উষ্ণায়ন রুখে দেওয়ার নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারব না। উন্নত দেশগুলির ওপর কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানোর নৈতিক দায় বেশি। এ কথা ঠিক। কিন্তু এও পরিষ্কার যে ভারতে জলবায়ু বিপর্যয় শিয়রে সংক্রান্তি হয়ে দেখা দিয়েছে, তাই আস্তে ধীরে কম নিঃসরণের পথে হাঁটার দিন আর নেই। তাতে দরিদ্রের ঝুঁকি আরও বাড়বে।”
ভারত আজ অদ্ভুত মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে ভারত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণের নিরিখে আমেরিকা আর চিনের পরে, তৃতীয় স্থানে রয়েছে। … আমেরিকা চিনও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর দাবিকে প্রতিরোধ করে এসেছে— গ্লাসগোতেও করেছে। অন্যদিকে, ভারতের স্থান সবচাইতে ঝুঁকিগ্রস্ত দেশগুলির সঙ্গে। তার কারণ দুটো। এক, কর্কটক্রান্তি রেখার কাছাকাছি ভারতের অবস্থান, যার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল — ঝঞ্জা, বন্যা, উচ্চ আর্দ্রতা, প্রখর গ্রীষ্ম — ভারতের মানুষকেই ভোগ করতে হয়। দুই, অন্য দেশগুলির তুলনায় দারিদ্র্য বেশি; অন্যান্য আর্থ-সামাজিক ঝুঁকিও বেশি। তাই অধিক দূষণকারী উন্নত দেশগুলির তুলনায় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ভারতের ঝুঁকি বেশি।
সত্যি বলতে, আমাদের সাহিত্য আজও গভীর এইসব সংকট ও তথ্যগুলিকে আখ্যানে ধারণ করতে অক্ষম থেকেছে। আজ নিছক বৃক্ষরোপণ, অরণ্যের শোভা কিংবা নিছক পশু-পাখিদের স্বভাবগত পরিবর্তনের কথা বললেই হবে না, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে জলবায়ু ও পরিবেশ সংক্রান্ত স্বার্থ-দ্বন্দ্ব ও জটিলতাকে আখ্যানে ফুটিয়ে তোলা দরকার। বাঙালি লেখক অমিতাভ ঘোষ ইংরিজি মাধ্যমে কিছু দায়িত্ব পালন করছেন। ইতিবাচক ব্যাপার হয়তো আমাদের নতুন প্রজন্মের লেখায় কেউ কেউ এতে উদ্বুদ্ধ হবেন।