শিল্পে দূষণ, বিপন্ন শ্রমিক

বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়

মাথার ওপর নিঃসঙ্গ সূর্য। বর্শার ফলকের মতো তীব্র দাবদাহ ছড়িয়ে পড়ছে প্রান্তর জুড়ে। প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণ যোজনার কাজ শুরু হয়েছে। মাঠ চিরে কালো রাস্তা তৈরি হচ্ছে কারণ উন্নয়নের রথ ছুটবে। উন্নয়নের ভারবাহী একদল রমণী পিচের রাস্তায় কাজ করছে। পায়ে চট বাঁধা। পিচের গরম বাঁচাতে পায়ে চটের আচ্ছাদনই ওদের একমাত্র সম্বল। গরম পিচ আর পাথর গলে তপ্ত মাটিতে ঝরে পড়ছে। ওরা হাতে লাঠির সঙ্গে কাঁটা লাগিয়ে তাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে অনেক সুখী মানুষের গাড়ি। তাদের মুখে রুমাল, চাপা ধুলো এড়াবার জন্য। মাঝে মাঝে তপ্ত হাওয়া আশেপাশের বালি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুখী মানুষের গায়ে তপ্ত বালি পড়লে ফোস্কা পড়ে যেতে পারে। কিন্তু সাঁওতাল রমণীরা নির্বিকার। ওরা মেশিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছে। ওরা দূষণ নামক শব্দটি উচ্চারণ করতে শেখেনি। ওদের জীবনে একটিই জ্বালা – পেটের জ্বালা। প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণ যোজনার রাস্তা তৈরির জন্য তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই জমা হয়েছে ইতস্তত ভাবে। আর তা হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আশেপাশের এলাকাতে। একদল সুখী মানুষের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অভিযোগ পত্র পাঠাল প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণ যোজনার রাস্তা তৈরির সময় তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই উড়ে যাতায়াত করা মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে, তাই কিছু করতে হবে। অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকজন সরকারি পরিদর্শক হাজির হলেন পরিদর্শনের জন্য। পরিদর্শনের সময় ওই সাঁওতাল রমণীদের জিজ্ঞাসা করা হল গরম পিচে যে আপনারা কাজ করেন এতে কষ্ট হয় না? আর এই ধুলোবালিতে কাজ করার জন্য আপনারা কোনো ব্যবস্থা নেন না? ওরা হতবাক। এই প্রশ্নের উত্তর ওদের জানা নেই। শীর্ণকায়া, গায়ের চামড়া জ্বলে যাওয়া রমণীরা নিরুত্তাপ। ওদের জীবনে দূষণ অনুপস্থিত। ওরা কেবল পিচ গলানো মেশিনের সঙ্গে পাল্লা দেয় পেটের জ্বালা মেটাতে। ভারতবর্ষ জুড়ে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণ যোজনার সমস্ত রাস্তা তৈরিই একদিন হয়তো শেষ হবে, কিন্তু এই ইতিহাসে সাঁওতাল রমণীরা থেকে যাবে এক উপেক্ষিত অধ্যায়ের শেষ পর্বে। 

বয়স খুব বেশি হলে ঊনিশ কি কুড়ি। চুলগুলো খোঁচা খোঁচা। তবে ওর বেশির ভাগ সময়টাই কাটে গাড়ির তলার অন্ধকারে। বিশাল মোটর গ্যারেজ। ১৮ থেকে ৩০ বছরের অনেকগুলি ছেলে কাজ করছে। প্রত্যেকের পরনে বড়জোর একটি গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট। কয়েকজন ফুলপ্যান্ট পরলেও সেগুলো আয়তনে একটু ছোটো। সকালবেলা এসেই ওদের ঢুকে পড়তে হয় গাড়ির তলায় মেশিন সারাতে। গাড়ির মেশিন সারাতে হবে, যন্ত্রাংশ খুলে দেখতে হবে, তেলে ভেজাতে হবে, পরিষ্কার করে আবার গাড়িতে লাগাতে হবে। এসব কিছুর মধ্যেও একটা রেডিও ওদের ওখানে চলে। তাতে ক্রমাগত এফ এমে গান হয়। সুন্দর লোভনীয় জিনিসের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। কিন্তু কেউ গান শোনে বলে কারখানায় ঢুকলে মনে হয় না। গানটা একটানা বেজেই যায়। আর ব্যাটারি ফুরোলে থেমে যায়। ছেলেগুলির সর্বাঙ্গ কালিতে ভরে গেছে। কাজের শেষে ওরা হাত ধোয়। কিন্তু সে হাত থেকে কালো রং আর ওঠে না। এতে ওরা একেবারেই চিন্তিত নয় কারণ তেলকালির কালো ওদের জীবনসঙ্গী। তেলকালিতে ওদের নখগুলো ক্ষয়ে গেছে। স্কুলের ছাত্ররা ঢুকে কয়েকজন শ্রমিককে যখন জিজ্ঞাস করল যে এই বদ্ধ পরিবেশে আপনারা তেলকালি নিয়ে যে কাজ করেন তাতে দূষণে আক্রান্ত হন না? ছেলেগুলির এখনও প্রাণশক্তি ফুরিয়ে যায়নি। ওরা হেসে উত্তর দেয় — ও সমস্ত কিছু ব্যপারই নয়। এই তেলকালিই আমাদের ভাত জোটায়। তোমাদের মতো লেখাপড়া আমরা শিখিনি। আর শেখারও সুযোগ হয়নি। স্কুলের ছেলেরা ওদের মতো করে দূষণ সংক্রান্ত সাবধান বাণী বলার চেষ্টা যখন শুরু করেছে তখনই হঠাৎ কারখানার অধিকর্তা ধবধবে জামা পরে এসে স্কুলের ছেলেদের বকুনি দেয়। কারখানা থেকে বার করে দেয়। কারখানার সব থেকে বয়স্ক মানুষ নীরেনদা আস্তে আস্তে কারখানা থেকে বেরিয়ে এসে স্কুলের ছেলেদের বলে —তোমরা বাবা ফিরে যাও। এসব প্রশ্ন করে আর আমদের বিব্রত কোরো না। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তোমাদের কাউকে যেন একাজ করতে না হয়। এ কথা বলে চলে যেতে যেতে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে নীরেনদা ছাত্রদের বলল পনেরো বছর বয়েসে বাবা মারা যাবার পর এ কাজে লেগেছি। প্রথমে কষ্ট হত। বাড়িতে গিয়ে ভাত খেতে পারতাম না। ক্রমাগত তেলকালির গন্ধ নাকে লেগে থাকত। বছর খানেকেই ব্যাপারটা সয়ে গেল। দূষণ আমাদের জন্য নয়। এটা বাবুদের ব্যাপার। ছাত্রগুলি কেন জানিনা হঠাৎ করে নীরেনদাকে হাতজোড় করে নমস্কার করে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওদের সবুজ মন এখনও দূষণে আক্রান্ত হয়নি। তাই নীরেনদার কথা ওদের বিচলিত করে।

হাতভর্তি নকশা কাটা নানান কাচের চুড়ি। দেখলেও ভালো লাগে। ছোটো থেকে বৃদ্ধা কাচের চুড়ি দেখলেই আকৃষ্ট হয়। পছন্দমতো দু-এক গাছা কিনেও ফেলে। হাওড়ার জগাছা-তে মেয়েদের অতি প্রিয় এই কাচের চুড়ির ছোটো ছোটো অনেক কারখানা। ছোটো ছোটো টালির চাল। কয়লার ঘাঁটি। খাঁ খাঁ করে আগুন জ্বলছে। তার পাশেই অ্যাসিডের চৌবাচ্চা। নানারঙের হরেক সমারোহ। চুড়ি থেকে শুরু করে বহু জিনিসই সেখানে অ্যানোডাইজিং হচ্ছে। অ্যাসিডের গন্ধে ভরপুর চারিদিক। পরিবেশ আইনের ভাষায় বিপজ্জনক তরল পদার্থ নিয়ে কারখানাগুলোতে কাজ হয়। ফলে ব্যাপক দূষণ সৃষ্টি হয়। পরিবেশের কেতাবি ভাষায় বলতে গেলে অন্যতম দূষণ সৃষ্টিকারী কারখানা। গায়ে ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি। হাতে নেই দস্তানা। দূষণ থেকে কোনো রকম রক্ষা পাবার নেই ব্যবস্থা। কিন্তু নির্বিকার কয়েকটি মানুষ কাজ করে যাচ্ছে। রোজ পায় ৪০-৫০ টাকা। নেই কোনো সুরক্ষা। নেই কোনো দূষণের দুশ্চিন্তা। এসব কারখানার পাশে এক হোমরা চোমরা ভদ্রলোক বাড়ি করলেন। করার কয়েকদিনের মধ্যেই অভিযোগ দূষণ ছড়ানোর। শ্রমিকরা দূষণের কথা শুনে তো হতবাক। ওদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে। কারখানা এবার বন্ধ হবে। কিন্তু ওরা কিছু বুঝতেই পারছেনা কোথায় দূষণ। আর কেনই বা কারখানা বন্ধ হবে। কারখানার শ্রমিকরা ওদের বড়ো মিস্ত্রি গোবিন্দের হাত ধরে হোমরা চোমড়া বাবুর কাছে গিয়েছিল ব্যাপারটা জানতে। অনড় পরিবেশপ্রেমী বাবু সাফ জানালেন তোমরা দূষণের কিছু বোঝ না। তোমাদের শরীর দূষণ সইতে পারলেও আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। শ্রমিকদের কাকুতি মিনতি অনেকক্ষণ চলছে। বাবুর দশ বছরের মেয়ে কাচের চুড়ি হাতে এসে দাঁড়ায়। কারণ সে-ও জেনেছে যে এই মানুষরাই কাচের চুড়িতে রঙ করতে পারে। সামনেই সরস্বতী পুজো। বাসন্তী রঙের চুড়ির ফরমাশ বাবুর মেয়ে করে বসল।  শ্রমিকরা নিশ্চুপ। বাবু তখনও অনড়। ওরা গোবিন্দের সঙ্গে পায়ে পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। তবে সরস্বতী পুজোর আগে বাবুর বাড়িতে বাসন্তী রঙের চুড়ি পৌঁছেছিল যদি বাবুর মন ভেজে। কিন্তু কিছুই হয়নি। ওরা হারিয়ে গেছে। কারণ কারখানা আর চলছে না। মালিক মনে করছে কারখানা ভেঙে বহুতল বাড়ি করলে তার সাশ্রয় অনেক বেশি। গোবিন্দের দল হারিয়ে যায়। ওরা হয়তো খুঁজে নেবে আরও একটা টালির চাল যেখানে তৈরি করবে সুদৃশ্য চুড়ি যা সুখী মানুষের ঘরে রিমঝিম করে বাজবে।

বাবার দেওয়া নামটা সম্ভবত ও নিজেও ভুলে গেছে। ছোটবেলা থেকেই মিষ্টির দোকানে কাজ করত। পাড়ার ছেলেরা আর দোকানের মালিক সবাই ওকে ছানা বলে ডাকত। যে বয়েসে কাজে লেগেছিল, বয়েসটা ছোটো বলেই হয়তো সবাই ওকে ছানা বলত। মিষ্টির দোকানের ছানার সংগে ওর নামটা মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন আগে ছানাকে হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখলাম। ওর সঙ্গে আমার পরিচিতি দীর্ঘকালের। আমার এক বন্ধুর আত্মীয়া অসুস্থ হয়ে ভরতি হয়েছিল হাসপাতালে। তাকে দেখতে গিয়েই ছানার সঙ্গে দেখা হল। হাসপাতালের মেঝেতে নিসঙ্গ ছানা পড়ে আছে। আমায় দেখে ডুবন্ত মানুষের মতো খড়কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করল। খোঁজ নিয়ে জানলাম দীর্ঘ সময় রসগোল্লা তৈরি করতে করতে উনুনের উত্তাপে ওর হাতের স্নায়ু শুকিয়ে গেছে। ডাক্তারের সংগে কথাবার্তা হল। ওঁরা বিজ্ঞের মতো বললেন যে পেশাগত রোগ। কিছুই করার নেই। ছানা বাঁচবে কিনা জানি না। বাঁচলেও ও কাজ করে খেতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। পৃথিবীর উত্তাপ প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটিয়ে কতটা সংকট থেকে আনবে আমার মতো অ-পণ্ডিতের তা ভাবার যোগ্যতা নেই। তবে এটুকু বুঝি উনুনের উত্তাপ ছানার মতো একটি মানুষের জীবন শুষে নিয়েছে। ছানা যে কদিন বাঁচবে ভিক্ষাবৃত্তিই হয়তো ওর শেষ সম্বল হবে। 

কলকাতা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার আর হুগলি জেলার সদর থেকে ২-৩ কিলোমিটারের মধ্যে বহতা গঙ্গার উপর চলছে কর্মকাণ্ডের জোয়ার, ইট তৈরির কারখানা। গঙ্গার পলি দিয়ে চলছে হাজার হাজার ইট তৈরি। ইট তৈরির কাঁচামাল -মাটি, বালি আর জলের অফুরন্ত জোগান। গঙ্গার দু’পাশে পলি দিয়ে ইট তৈরির ইতিহাস বহু শতাব্দীর। নীল নদের অববাহিকাতেও পলিমাটি নিয়ে ইট তৈরি হত। বাসস্থান গড়ে তোলার সর্বজনীন জোগান মেটাতে ইটের থেকে প্রয়োজনীয় এবং কম খরচের উপাদান মানুষ আজও সৃষ্টি করতে পারেনি। যেখানে মাটি নেই, সেখানে পাথর ভাঙা হয়েছে। যেখানে পাথর নেই, সেখানে মানুষ ব্যবহার করছে নদীর পলিকে। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করার এক ছন্দ আছে। সেই ছন্দ কেটে গেলে বিপদ। প্রাকৃতিক ভাবে চন্দননগরের শেষ প্রান্ত থেকে ব্যান্ডেল পর্যন্ত চর জেগে উঠেছে। চর থেকে মাটি নিতে গেলে সময় সাপেক্ষ ও কিছুটা ব্যয় সাপেক্ষ। ফলে ইটখোলার মালিকরা বেছে নিলেন এক সহজ পদ্ধতি। গঙ্গার জল আটকে দাও। মাটি ফেলে চর আর পাড়ের তফাত মুছে ফেলো। গঙ্গা বুজে যায় যাক। কিন্তু আর্থিক লাভ অনেক।

এখানেই শেষ নয়। এপ্রিল মাসের সূর্যকে মাথায় নিয়ে ইটখোলায় ঘুরতে গিয়ে দেখা গেল নিরন্ন মানুষের সারি। বেশির ভাগ মানুষের গায়ে সামান্য লজ্জা নিবারণের মতো একটু কাপড় জড়ানো। তারা বসে আছে। শুনেছে সরকারি বাবুরা আসবেন। ইটখোলা ঘুরে দেখবেন। ওরা আসে বিহার থেকে, ঝাড়খণ্ড থেকে। ওরা ‘নেই রাজ্যের’ মানুষ। ফি বছর ষণ্ডামার্কা বড় গোঁফগুলা দালাল হাজির হয় গ্রামে। আশ্বাস দেয়, খেতে পাবে, থাকার জায়গা পাবে আর সাত মাস কাজ করার পরে হাতে পাবে নগদ টাকা। ওরা পাড়ি দেয় দালালের সঙ্গে। প্রত্যেকে নির্বাক। কথা বলতেই চায় না। সম্ভবত ওরা আমাদের ঘৃণা করে। ওরা জানে ওদের অসহায় ভবিতব্য, অপুষ্টিতে মৃত্যু আর আত্মমর্যাদাহীন, সম্ভ্রমহীন এক নিরুপায় জীবন। ওদের একটি অদ্ভুত রোগ আছে। শতকরা আশি ভাগেরও বেশি মানুষ রাতকানা। চোখে দেখে না। মালিকের কথায়, ওরা মদ খায়, তাই রাতের বেলায় চোখে দেখতে পায় না। ওরাও সেটা বিশ্বাস করে। তবুও মদ খায়। সর্বাঙ্গে অপুষ্টি। সঙ্গে মেয়েরাও আসে। ওরা ব্যবহৃত হয় নানাভাবে। তবুও আসে। কারণ দুটো খেতে পাবে। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা।

এই ইতিহাস ব্যান্ডেল বা চন্দননগরের ইট খোলার ইতিহাস নয়। এ ইতিহাস ভারতের সর্বত্র। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিছু চাদর আর কাপড় জোগাড় করে ইটখোলার শ্রমিকদের মধ্যে বিলি করতে গেল। সেটুকু পাবার জন্যে কী হুড়োহুড়ি, একজনকে জিজ্ঞাসা করা হল, চাদর পেয়ে কেমন লাগছে? সে খানিকটা অবাক হল, বলল আর একটা চাদর দিবি? তোর বাড়িতে খেটে দেব। ওরা মনে করে, ওদের একমাত্র সম্বল ওদের কালো শরীর। ওরাও ভারতের নাগরিক। কিন্তু ওরা জানে না, শ্রম দফতর আছে কি না বা ওদের জীবনের গ্লানি মোছাবার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে কি না। ওরা বিপন্ন মানুষের দল। ওরা কেবল সূর্যের আলো পায় কোনো শ্রম না দিয়ে।

দুর্গাপুর থেকে সামান্য দূরে গেলেই দেখা যাবে জায়গায় জায়গায় কুণ্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়া নীল আকাশটাকে যেন মুছে দিচ্ছে। দুর্গাপুরের আকাশের রং নীল এটা বহু দিন আগেই হারিয়ে গেছে। অন্তত দুর্গাপুর ছাড়লে আকাশটার রং নীল বোঝা যেত। কিন্তু ক্রমাগত সেটি হারিয়ে যেতে বসেছে। গর্বিত শিল্পায়ন মাথাচাড়া দিয়েছে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার আকাশেও আজ কালো রঙের নিরন্তর খেলা। বাঁকুড়ার মাঠ দিয়ে একদল বিষণ্ণ মানুষ হেঁটে যাচ্ছিল। তাদের জিজ্ঞাসা করা হল, এই কালো ধোঁয়া কীসের থেকে? ওরা উত্তর দেয় না। খানিকটা এগোনোর পরে একটি অল্প বয়সের ছেলে হঠাৎ বলল, লোহা গলানোর কারখানা। খানিকটা এগিয়ে কারখানার অবয়ব ফুটে উঠল। গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা হল। ওরা হতাশ। কারখানা তৈরির সময় ওরা আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ওদের আশা নিভে গিয়েছে, মাঠের ফসল হয়েছে কালো, গ্রামের ছাগলগুলো ঘাসের উপর পড়ে থাকা কালো আন্তরণ ঘাসের সঙ্গে খেয়েছে। ফলে ওরা আর বাঁচতে পারেনি। অতীতে ঘাসের আগায় শিশিরবিন্দু ছিল আজ আর শিশির নেই, রয়েছে কালো গুঁড়ো। এখানেই শেষ নয়। শ্রমিকেরা আসে বিহার, ঝাড়খণ্ডের প্রান্ত থেকে। দিনভর কাজ। আট ঘন্টার কাজের ইতিহাস ওখানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ওরা কাজ করে। তার পর ক্লান্ত শরীরটাকে কোনক্রমে টেনে নিয়ে যায়। কারখানার কোণে। সেখানেই রাত্রি যাপন।

সেই চোরা কুঠুরি থেকে বেরিয়ে আসে আর একদল মানুষ, যারা সারাদিন শুয়েছিল। রাত জেগে তারা কাজ করে, ওদের চোখের পলক পড়ে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয় তপ্ত গলিত লোহার দিকে। একটু অন্যমনস্ক হলেই গলিত লোহা ওদের সামান্য বেঁচে থাকার প্রচেষ্টাকে মুহূর্তে শেষ করে দেবে। ওদের গা দিয়ে ঘামও ঝরে না। তপ্ত লোহা ওদের ঘাম আর রক্ত শুষে নেয়।

এরকম একটি কারখানাতে শীতের রাতে কুঁকড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে তিন জন শ্রমিক কারখানার চিমনির পাশে শুয়েছিল। নাম তাদের অরবিন্দ সাউ, সঞ্জীব সিংহ আর মনু রাওয়ানি। কনকনে ঠান্ডার রাতে ওরা কম্বল পায়নি। ঠান্ডাকে উপেক্ষা করার জন্য বা জীবনটাকে ভোলার জন্য একটু সুরা পান করছিল। কিন্তু এই সুরা ওদের দেহকে সেই দিন গরম করতে পারেনি। শ্রমিক তিনজন পরেরদিন আর চোখ মেলেনি। কারখানার দূষিত গ্যাস ওদের বিষণ্ণ জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছিল। কয়েক দিন হইহই। তারপর সব শান্ত। মালিক জানিয়েছিল, ওরা আমার শ্রমিক নয়। ওদের ব্যাপারে আমার কোনও দায়িত্ব নেই, ওরা কামচোর। ওরা ঠান্ডার রাতে লুকিয়ে মদ খেয়ে চুরি করতে এসেছিল। নেশার ঘোরে মৃত্যু ঘটেছে। শিল্পের মহোৎসবে তিনটি দেহাতি মানুষের মৃত্যু এমন কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়। স্থানীয় শ্রমিক সংগঠন কিছুটা চেষ্টা করেছিল। মালিক মৃত্যুর জন্য মূল্য ধরে নিয়েছিল। অশান্তি শেষ। নতুন লোক পেতে অসুবিধা হয়নি। মালিক ঘোঘণা করেছে : কোনও চিন্তা নেই। শিল্পে শান্তি বিরাজমান, তবে মাঝে মাঝে দেহাতি মানুষগুলো বাড়াবাড়ি করে। ওদের সহবৎ শেখানো দরকার। রাষ্ট্রীয় উর্দি প্রস্তুত।

ভারতবর্ষে শিল্পায়নের পত্তন মূলত ইংরাজ রাজশক্তির হাত ধরে। অতীতে ভারতের বুকে কৃষি ভিত্তিক শিল্পায়নের বিকাশ হয়। অধুনা ইটভাটা বা পাথরের খাদান ও তৎসহ পাথর ভাঙা কল হচ্ছে আদিম শিল্পায়নের প্রথম ধাপ। অনেকে মনে করেন পাথর কেটে নগর গড়ার সময় পাথরের গুঁড়ো মানুষের শরীরে প্রবেশ করে মারাত্মক দূষণ ঘটাতেই পাথর খাদান থেকে পেশাগত রোগ হয়। শিল্পজনিত প্রথম পেশাগত রোগ এই পাথর খাদান থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। নাম সিলিকোসিস। বিকশিত শিল্পায়ন প্রথম দিকে কৃষির সহযোগী শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। রেল লাইনের সূচনা ভারতের বুকে আধুনিক শিল্পায়নের প্রথম পর্ব। ভারত থেকে লোহা কয়লা সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ নিজের দেশে নিয়ে যাবার জন্য ইংরাজ রাজশক্তি খনি শিল্পের সূচনা করে এবং এই খনি শিল্পের হাত ধরে ভারতের বুকে শিল্পায়নের অগ্রগতি ও শ্রমজীবী শ্রেণির জন্ম হল যারা মূলত বিশাল কৃষককুল থেকে শিল্পে নিজেদের নিয়োজিত করল। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উৎপাদন ব্যবস্থারও নতুনভাবে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছিল এবং বিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে নতুন রাসায়নিক উৎপাদন প্রক্রিয়া দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, শিল্পায়ন পৃথিবীর বুকে কালো আস্তরণ সৃষ্টি করেছে, জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহারে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়তে শুরু করেছে, নদীর জল দূষণে আক্রান্ত হয়েছে, এমনকী বহু জলাশয়ও শিল্পের বর্জ্যতে ভরে গেছে। শিল্পায়ন থেকে দূষণের এই চেহারা কেবল ইওরোপ নয়, তৃতীয় বিশ্বেও অনুপ্রবেশ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে যে সমস্ত বৃহদায়তন শিল্প ছিল, যেমন — লৌহ ইস্পাত শিল্প, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিভিন্ন রাসায়নিক কারখানা সহ যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কারখানা থেকে দূষণের প্রাদুর্ভাব নিয়ে ইউরোপের বুকে কিছুটা চিন্তাভাবনা শুরু হলেও অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বে তার কোনো বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। তার কারণ তৃতীয় বিশ্বে খনিজ সম্পদ আহরণ করাই ছিল উন্নত দেশগুলোর একমাত্র কাজ। কিন্তু খনিজ সম্পদ থেকে বৃহদায়তন শিল্প ব্যবস্থা মূলত গড়ে ওঠে ছিল ইওরোপ ও আমেরিকার বুকে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইওরোপের বুকে যুদ্ধের কারণে তৃতীয় বিশ্বে লৌহ ইস্পাত শিল্প ইউরোপীয় দেশগুলির প্রয়োজন মেটাতে সৃষ্টি করা হয়েছিল। ভারতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশির ভাগ বৃহদায়তন শিল্পের সূচনা হয়। তবে পাট শিল্পের জন্ম ভারতেই, কারণ পাট কেবলমাত্র ভারত ও বাংলাদেশের মাটিতেই প্রাকৃতিক কারণে জন্ম নেয়।

স্বাধীনতার পর ৭৫ বৎসর অতিক্রান্ত। বিভিন্ন রাজ্যে শিল্পায়ন এবং তার সঙ্গে জন্ম নিচ্ছে বিপুল পরিমানে শ্রমজীবী মানুষ। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে কারখানা অভ্যন্তরে শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য আইন প্রনয়ন হয়। ১৯৪৮ সালের কারখানা আইনে মূলত বৃহদায়তন শিল্পে শ্রমিকদের সুরক্ষার কথা উচ্চারিত হল। কিন্তু ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্পে শ্রমজীবী মানুষদের সুরক্ষার কথা অনুচ্চারিত থেকে গেল। ১৯৪৮ সালের পর ১৯৫১ সালে দি প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট, দি মাইনস্ অ্যাক্ট ১৯৫২ সহ বিভিন্ন ধরনের আইন তৈরি হল মূলত কারখানা বা খনি শিল্পে যুক্ত শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য। এই সমস্ত আইনে মহিলা বা শিশু শ্রমিকদের নানাবিধ সুরক্ষার কথা উচ্চারিত হল। কিন্তু আইনগুলির কার্যকারিতা প্রকৃতপক্ষে উপেক্ষিত থেকে গেল। বিশেষ করে ১৯৪৮ সালের কারখানা আইনে দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত নানাবিধ শর্ত আরোপ করা হলেও তার কার্যকারিতা শ্রমজীবী মানুষের কাছে ব্রাত্য থেকে গেল, তার অন্যতম কারণ মালিকদের উদাসীনতা, সরকারি দপ্তরের অপদার্থতা ও শ্রমজীবী মানুষের সচেতনতার অভাব। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন মূলত মজুরি বৃদ্ধি বা অবসর গ্রহণের সময় সুযোগ সুবিধার বিষয় নিয়েই কেন্দ্রীভূত হয়েছে। ক্রমাগত কারখানার বন্ধ বা লক আউটের ভয় শ্রমিকদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কারখানার অভ্যন্তরে দূষণ জনিত কারণে তাদের শারিরীক ক্ষয়ক্ষতির বিষয় ভাবার অবসর পায়নি। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও স্বভাবতই কেবলমাত্র আর্থিক বিষয়টির মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছে। ভারতের শ্রমজীবী মানুষ দূষণে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হওয়া বা পেশারোগে আক্রান্ত হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে মেনে নিয়েছে। সরকারি ব্যবস্থার চূড়ান্ত উদাসীনতা আর নীতিহীনতার ফলে কোনো সময় শ্রমজীবী মানুষের সুরক্ষার জন্য নির্মিত আইনের সুফল শ্রমিকরা ভোগ করতে পারেনি। কারখানার অভ্যন্তরে দূষণ শ্রমজীবী মানুষের বিপন্নতা বৃদ্ধি করেছে আর অসুস্থ শ্রমিক কারখানা থেকে বিদায় নিয়েছে আর তার জায়গায় যুক্ত হয়েছে নতুন শ্রমিক। কারণ ভারতে শ্রমজীবী মানুষের অভাব নেই। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে পরিবেশ ভারসাম্যের বিষয় আলোচিত হতে আরম্ভ করে। ১৯৭২ সালের জুন মাসে সুইডেনের স্টকহোমে মানব পরিবেশ বিষয়ে রাষ্ট্রসংঘের যে সম্মেলন হয় তার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারীদের অন্যতম ছিল ভারতবর্ষ। এই সম্মেলনের ফলে পরিবেশ রক্ষার্থে একাধিক আইন প্রণয়ন করা হয় যার মধ্যে সর্বপ্রথম হল (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন, ১৯৭৪। ১৯৭৪ সালের আগে পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে আইনগত বাধ্যবাধকতা প্রায় কিছুই ছিল না। ১৯৭৪ সালে জল (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণীত হওয়ার পর এর পরিপুরক হিসবে ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গঠিত হয়। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ স্বাস্থ্য বিভাগের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। পরবর্তীকালে ১৯৮২ সালের জুন মাসে এই পর্ষদ নবগঠিত পরিবেশ বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আসে।

পরিবেশ সংক্রান্ত নিম্নলিখিত আইন, নিয়মাবলি ও প্রজ্ঞাপন কার্যকর হয়েছে এবং পরিবেশ বিভাগ ও পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এগুলি রূপায়ণের জন্য সচেষ্ট হয়েছে।

  • জল (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন, ১৯৭৪
  • জল (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) উপকার আইন, ১৯৭৭
  • বায়ু (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন, ১৯৮১
  • পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন, ১৯৮৬
  • গণ দায়বদ্ধতামূলক বিমা আইন, ১৯৯১
  • জাতীয় পরিবেশ ট্রাইবুনাল আইন, ১৯৯৫

নিয়মাবলি

  • জল (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) নিয়মাবলি, ১৯৭৪
  • বায়ু (দূষণ নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ) নিয়মাবলি, ১৯৮১
  • পরিবেশ (সংরক্ষণ) নিয়মাবলি, ১৯৮৬
  • ক্ষতিকর বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা) নিয়মাবলি, ১৯৮৯
  • ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদন, মজুতকরণ এবং আমদানিকরণ নিয়মাবলি, ১৯৮৯
  • চিকিৎসাজনিত জৈব বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা) নিয়মাবলি, ১৯৯৮
  • রাসায়নিক দুর্ঘটনা (জরুরিকালীন পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিকরণ এবং প্রতিক্রিয়া) নিয়মাবলি, ১৯৯৬
  • পৌরবিষয়ক কঠিন বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবহার) নিয়মাবলি, ২০০০

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, কোন পরিবেশ বিষয়ক আইনগুলিতে কারখানা অভ্যন্তরে শ্রমজীবী মানুষের পরিবেশ বিষয়ক সুরক্ষার কথা সুস্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত হয়নি। সমস্ত আইনগুলি কারখানা বাইরের বসবাসকারী নাগরিকদের সমস্যার কথা চিন্তা করেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট ঝাড়গ্রামে অবস্থিত সুরেন্দ্র খনিজ নামক একটি পাথর কলের বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালে আনীত জনস্বার্থ মামলার রায় দানের সময় অত্যন্ত দ্বিধাহীন ভাষায় ব্যক্ত করেছেন, কারখানার ভিতরে সুস্থ পরিবেশ শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক অধিকার। সুরেন্দ্র খনিজ নামক একটি পাথর কলের দূষণে কমবেশি ১৮ জন শ্রমিক ‘সিলোকোসিস’ নামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এবং প্রায় ৩০ জন শ্রমিক পেশাগত রোগে আক্রান্ত হন। মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট কারখানার মালিকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে শ্রমজীবী মানুষের ক্ষতিপূরণের বন্দোবস্ত করেন। তারপর অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু আজও ভারতবর্ষের শ্রমজীবী মানুষ ক্রমাগত পেশারোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করছেন কিন্তু বিচারের বাণী বা ১৯৪৮ সালের কারখানা আইন কোনো কার্যকরি ভূমিকা নিতে পারেনি তার অন্যতম কারণ শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের বিষয়বস্তুর মধ্যে পরিবেশ ভাবনা ব্রাত্য থেকে গেছে। মালিকপক্ষ কখনই পরিবেশ নিয়ে চিন্তা করে না কারণ তারা মনে করে দূষণের মধ্যে কাজ করাটা শ্রমজীবী মানুষের ভবিতব্য। একথা বলতে দ্বিধা নেই কারখানার মালিকরা শ্রমিকের অর্থনৈতিক নায্য পাওনা দিতে যেমন দ্বিধা করেন ঠিক একইভাবে তারা পরিবেশ বিষয়ক আইন কার্যকর করতে কোনোরকম উদ্যোগ গ্রহণ করেন না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট পরিবেশ বিষয়ক একটি মামলার রায় দানের সময় উল্লেখ করেন যে, কোনো মালিক শ্রমজীবী মানুষকে সঠিক বেতন প্রদান থেকে যেমন বিরত থাকতে পারেন না ঠিক তেমনিভাবে পরিবেশ বিষয়ক আইন কার্যকর না করে কারখানা চালাতে পারবেন না। বর্তমান পরিস্থিতি দাবি করছে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনে পরিবেশ ভাবনার অন্তর্ভুক্তি ও তাদের পরিবেশ চেতনার উন্মেষ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে পরিবেশ আইনে দূষণের অপরাধে কারখানা বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। এমনকি দূষণ সৃষ্টিকারি শিল্প সংস্থার আলো ও জলের জোগান আইনগত ভাবে বন্ধ করে দেওয়া যায়। শিল্পের মালিক কারখানা বন্ধ হলে যে সমস্যার মুখোমুখি হন তার থেকে অনেক বেশি সমস্যায় আক্রান্ত হন শ্রমজীবী মানুষ যদিও শিল্পে দূষণ সৃষ্টির ব্যাপারে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। শিল্পে দূষণ হলে প্রথম আক্রান্ত হন শ্রমিকরা আবার দূষণের অপরাধে কারখানা বন্ধ হলে আর্থিক সংকটে আক্রান্ত হন প্রথমে শ্রমিকরাই। পরিবেশ আইনে এই সমস্যার সমাধানের কথা উচ্চারিত হয়নি। ১৯৯৬ সালে ডানলপ কারখানা দূষণের অপরাধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায়। তৎকালীন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আধিকারিকরা কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকদের সমস্যার কথা মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে তুলে ধরে এবং মাননীয় বিচারপতি অত্যন্ত সঠিকভাবেই শ্রমিকদের সমস্যা অনুধাবন করে নির্দেশ দেন দূষণের অপরাধে কারখানা বন্ধ থাকাকালীন অবস্থায় প্রত্যেক শ্রমিককে তার বেতন কারখানা মালিককে প্রদান করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশনামা যথাক্রমে :

The West Bengal Pollution Control Board has placed on record its report regarding the Dunlop India Ltd. Since the pollution control devices are not set up before 31.5.96, the Board closed the Industry on 7.6.1996. Mr. Mohan, learned counsel appearing for the Board, states that Industry has now installed pollution control devices. To inspect the devices in working condition, it is necessary to suspend the closure order. We suspend the closure order for eight weeks to enable the Board to inspect the Industry and place the report before this court.

We further direct that during the period when the industry remain closed, the industry shall pay to the workers their full wages to which they were entitled prior to the closure. (Supreme Court Matter No. Writ Petition (C) No. 3727 of 1985 order dated 15.7.96)

দুর্ভাগ্যের হলেও একথা সত্যি আজও কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের ভাবনাকে পরিবেশ আইনের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন বোধ করেনি। ফলত শিল্প দূষণে সামগ্রিক ভাবে শ্রমজীবী মানুষ বারবার আক্রান্ত হচ্ছেন।

সমগ্র মানব জাতির ইতিহাস এক অর্থে প্রাকৃতিক সম্পদকে নব নব প্রক্রিয়াতে ব্যবহারের ইতিহাস। কিন্তু মুষ্টিমেয় মানুষই অর্থনৈতিক উন্নতির নামে উৎপাদনের মানবিক ও প্রাকৃতিক অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি ঘটায়। আক্রান্ত হয় শ্রমজীবী মানুষ, প্রকৃতি আর পরিবেশ। অতিরিক্ত মুনাফা সঞ্চয়ের দুর্বার গতি প্রাকৃতিক জনন প্রক্রিয়াকে আক্রান্ত করে আর শ্রমজীবী মানুষকে করে নিঃস্ব, পুঁজির দস্যুবৃত্তি আসলে প্রকৃতিকে করে রিক্ত আর মানুষকে ঠেলে দেয় এক লাঞ্ছিত জীবনের অভিমুখে। যে সমস্ত লাঞ্ছিত মানুষের মৃত্যুর দীর্ঘশ্বাস টেনে নেবার জন্য মাটি বা আকাশ উদার হস্তে দাঁড়িয়ে থাকে, তারাও বেঁচে থাকার চেষ্টা আরম্ভ করেছে। এরা জানতে পেরেছে, বুকের পাঁজরের মধ্যে এক অদম্য শক্তি লুকিয়ে আছে, যে শক্তি আঁধার বিনাশ করে ইতিহাস রচনা করতে পারে। দিকচক্রবালে কান পাতলে শোনা যায় নতুন উত্থিত ভবিষ্যতের পদধ্বনি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতবর্ষের পরিবেশ আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষের অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশ আন্দোলন আজকের দিনে নিছক একটি প্রতিবাদ নয়। পৃথিবী জুড়ে একটি নতুন তত্ত্ব বা ধারণা মানুষের কাছে উপস্থাপিত হয়েছে যাকে এক কথায় পরিবেশবাদ বলা যায়। পরিবেশবাদ দাবি করে পৃথিবী জুড়ে যে অপ্রতিহত বঞ্চনা শ্রমজীবী মানুষরা ভোগ করছেন তার পরিসমাপ্তি আর সমস্ত মানুষের জন্য নির্মল পরিবেশ। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের বার্তার মধ্যে সূচিত হয়েছে পরিবেশ ভারসাম্যের সমাধান সূত্র। দারিদ্র্য দূরীকরণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করা, শান্তি ও বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য গাছ লাগানোর অভিযান-সহ নানা কর্মসূচি। এই কর্মসূচিতে জায়গা করে নিয়েছে ধ্বংস নয় প্রগতির বার্তা, মানুষের ন্যূনতম বেঁচে থাকার অধিকার।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান