দেবরাজ গোস্বামী
এই লেখাটা হয়তো একটু অন্যরকম ভাবেও শুরু হতে পারত, অথবা বলা ভালো অন্য ভাবেই শুরু করার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা বিষয়টাকে অনেকটাই ওলটপালট করে দিয়েছে। এটা এমনই একটা ঘটনা, যা হয়তো আমার এই লেখার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠবার কথাই ছিল না। গত পনেরোই অক্টোবর লন্ডনের ন্যাশানাল গ্যালারিতে কয়েকজন পরিবেশ কর্মী বা বলা ভালো এনভায়রনমেন্টাল এক্টিভিস্ট জমায়েত হন। এঁদের মধ্যে দুইজন আন্দোলনকারী শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের আঁকা বিখ্যাত সূর্যমুখী ফুল বা সানফ্লাওয়ার ছবিটির ওপরে টম্যাটো স্যুপ ঢেলে দেন। এরপরে তাঁরা যে বিবৃতি দেন তা এইরকম যে — “মিউজিয়ামের দেওয়ালে কোনও শিল্পবস্তুকে সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখার থেকে ঢের বেশি প্রয়োজনীয় কাজ হল এই গ্রহটিকে এবং তার পরিবেশকে সংরক্ষণ করা।” বলাবাহুল্য যে, ভ্যান গঘের আঁকা অন্যতম এই মাস্টারপিস ছবির ওপরে আক্রমনের দরুন এই ঘটনাটি নিমেষের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী প্রচারের আলোয় এসে যায় এবং সম্পূর্ণ এক নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। পরিবেশ এবং প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণআন্দলনের সপক্ষে দাঁড়ানো লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবাদের পন্থা হিসেবে শিল্পের ওপর এই আক্রমণ এবং ভ্যান্ডালিজমের তীব্র নিন্দা করেছেন। কিন্তু মূল প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। সভ্য মানুষের যে শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলি আমাদের জীবনের মূল্যবান সম্পদ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে, শিল্পকলা নিঃসন্দেহে তার মধ্যে অন্যতম। “দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর” মানে কি জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম করা? পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলন কি তবে মানব সভ্যতায় অর্জিত যাবতীয় সম্পদকে নির্দ্বিধায় বাতিল করে আদিমতায় ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়া? বলাবাহুল্য যে এই প্রশ্নের এক এবং একমাত্র উত্তর হচ্ছে ‘না’। আমার প্রিয় এক মাস্টারমশাই বলতেন — আসলে প্রকৃতিকে বাঁচাও, পৃথিবীকে বাঁচাও এইসব নিতান্তই বাজে কথা। পৃথিবী কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে হবে সেকথা ভালোই জানে। মানুষের মতো একটা সামান্য প্রজাতির সাধ্য কী যে সে এই গ্রহটিকে বাঁচাবে। এই গ্রহের বুকে মানুষ আসার অনেক আগে কয়েক কোটি বছর ধরে রাজত্ব করে গেছে অতিকায় সরীসৃপের দল। তারা কেউই শেষ পর্যন্ত টেকেনি। পৃথিবী যখনই বুঝতে পারবে যে এই মানুষ নামক প্রজাতিটি তার এবং অন্যান্য জীবজগতের অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, তখন সে নিজস্ব প্রাকৃতিক নিয়মে সেই প্রজাতিকে চিরতরে বিলুপ্ত করে ফেলতে দ্বিধা করবে না। আমরা আসলে এখন প্রায় সেইরকমই একটা পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছি। কাজেই কথাটা পরিবেশ অথবা প্রকৃতিকে বাঁচানো নয়, বরং মানুষ নামক প্রজাতিটির ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ এই বিষয়ে। মানুষকে যদি এই গ্রহের বুকে টিকে থাকতে হয় তাহলে স্রেফ নিজেদের জীবনের স্বার্থে পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি এবং জীবজগতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। এই ভারসাম্য রক্ষার কাজ সময়ের থেকে পিছিয়ে গিয়ে করা সম্ভব নয়। সময়ের কাঁটা পিছনের দিকে ঘোরে না। তাই শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদিকে মুছে ফেলে আদিম যুগে ফিরে গেলেই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষিত হতে পারে এটি একটি অবাস্তব এবং ইউটোপিয়ান ধারণা। এই মুহূর্তের পৃথিবীতে যদি মানুষের সত্যিকারের সভ্য হওয়ার কিছু বাকি থেকে থাকে তা হল প্রকৃতির সংরক্ষণের প্রতি যত্নবান হওয়া, শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং সংবেদনশীল হওয়া। সুতরাং পরিবেশ সংক্রান্ত কোনও রকম কর্মকাণ্ডই গিমিক বা চমক নির্ভর হতে পারে না বলেই আমার বিশ্বাস। ভ্যান গঘের আঁকা ছবিটিতে টম্যাটোর স্যুপ ছিটিয়ে দিয়ে যে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে তাতে চমক থাকলেও ভুল বার্তা প্রচারিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
আমি সত্যিই ঠিক জানি না যে পরিবেশ ও শিল্পকলার সম্পর্কের বিষয়ে কেন আমাকে লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে। আমি পেশায় চিত্রকর। শিল্পতাত্ত্বিক বা শিল্প ঐতিহাসিক কোনোটাই নই। ফলে ‘এনভায়রনমেন্টাল আর্ট’ সম্পর্কে বিভিন্ন বইপত্র বা অন্য সোর্স থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে, একত্রিত করে বিব্লিওগ্রাফি সমেত একটি একাডেমিক প্রবন্ধ রচনা করা আমার কাজ নয়। একজন শিল্পী হিসেবে প্রতি মুহূর্তেই আমার নিজস্ব চিন্তা ভাবনা, ধ্যান ধারণা ইত্যাদির প্রতিফলন আমার লেখার মধ্যে পড়তে থাকে। এই ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হওয়ার সম্ভাবনা বিশেষ নেই। কাজেই আমার এই লেখাটিকে একজন শিল্পীর ব্যক্তিগত বয়ান হিসেবে দেখলেই বোধহয় এর প্রতি সুবিচার করা হবে। এই সময়ের যে কোনও পেশায় নিয়োজিত একজন সংবেদনশীল মানুষের মতোই আমিও প্রকৃতি এবং পরিবেশের গভীরতর সংকট নিয়ে চিন্তিত। এই কারণেই শিল্পী হিসেবে খুঁজে দেখবার চেষ্টা করেছি শিল্পকলার ইতিহাসে এই বিষয়টিকে নিয়ে কীভাবে অতীত শিল্পীরা কাজ করেছেন। কিন্তু খুব সত্যি কথা বলতে কি প্রকৃতির সংকট নিয়ে গভীরতর শৈল্পিক চিন্তা ভাবনা শুরু হওয়ার সময়কাল খুব একটা প্রাচীন নয় বরং বেশ সাম্প্রতিক। এর মধ্যেও আবার শিল্প এবং অ্যাক্টিভিজমগত বিভিন্ন তফাত রয়েছে। অর্থাৎ বিশেষ কোনও পরিবেশ আন্দলনের প্রচারের স্বার্থে নির্মিত শিল্পবস্তু আর শিল্পীর একেবারে নিজস্ব তাগিদে সৃষ্টি করা শিল্পের মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য থাকে সেটা এক্ষেত্রে বেশ প্রবল। শিল্পের উৎকর্ষ না শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতা, কোনটা এক্ষেত্রে সার্থক শিল্প বিচারের মাপকাঠি এই চিরকালীন বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়বার আগ্রহ বা উদ্দেশ্য আমার নেই। তাই আমি চাইব শিল্পকলা ইতিহাসের এমন কিছু উদাহরণ নিয়ে ভাবতে যেখানে হয়তো কিছুটা শিল্পীর অজান্তেই পরিবেশ ও প্রকৃতির আজকের যে সংকট তার কোনও কোনও আগাম ইঙ্গিত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এইসব শিল্পের উদ্দেশ্য কখনোই পরিবেশ বা তার সংরক্ষণের বিষয়ে ছিল না, বা সেটা সম্ভবও ছিল না। কিন্তু কীভাবে ধীরে ধীরে প্রকৃতি এবং পরিবেশের মধ্যে আজকের ধংসের বীজ বোনা হয়ে যাচ্ছিল তার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত এইসব শিল্পের মধ্যে পাওয়া যায় ।

বিখ্যাত ইংরেজ শিল্পী উইলিয়াম টারনারের ১৮৪৪ সালে আঁকা ‘রেইন স্টিম অ্যান্ড স্পিড’ ছবিটির কথা প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে। এটা সেই সময়ের একটা দলিল যখন ক্রমশ বাষ্পীয় শক্তির ব্যাপকতর ব্যবহার শুরু হচ্ছে। কুয়াশাছন্ন বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে প্রবল গতিতে এগিয়ে আসা একটি স্টিম ইঞ্জিন চালিত রেলগাড়ির ছবি এটি। শিল্পী এখানে ওই বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ছবি এঁকে হয়তো সভ্যতার অগ্রগতিরই ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বায়োফুয়েলের ব্যাপকতর ব্যবহারের এইই তো সূত্রপাত। আবার টারনারের আঁকা সবথেকে বিখ্যাত ছবিটির মধ্যেও এই একই ইঙ্গিত রয়েছে। ১৮৩৮ সালে আঁকা এই ছবির নাম ‘দ্য ফাইটিং টেমেরেয়ার’। টেমেরেয়ার নামক একটি পালতোলা পুরোনো যুদ্ধ জাহাজের শেষযাত্রার ছবি এটি। একটি বাষ্পশক্তি চালিত বোটের সাহায্যে তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে। নতুন প্রযুক্তির যুগে আর তার কোনও প্রয়োজন নেই, তাই তাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলা হবে। আকাশে সূর্যাস্ত হচ্ছে আর বাষ্পীয় বোটের চিমনি থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়া আচ্ছন্ন করছে টেমেরেয়ারকে। এই পালতোলা যুদ্ধ জাহাজ একদা বহু গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে, কিন্তু বদলে যাওয়া প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে তার দিনও শেষ হয়ে গেছে। আজ থেকে প্রায় একশো আশি বছর আগে যখন এই ছবি আঁকা হয়েছিল তখন শিল্পী হয়তো বদলে যাওয়া যুগের প্রযুক্তির কথাই বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আজ যখন আমরা এই ছবি দেখি তখন মনে হয় আজকের পরিবেশ সংকটের সূত্রপাতের একটা ঐতিহাসিক দলিল দেখতে পাচ্ছি। যদিও শিল্পী এমন কোনও সচেতন উদ্দেশ্য নিয়ে ছবিটি আঁকেননি। এর অর্ধ-শতাব্দী পরে একই ঘটনা ঘটতে দেখছি ডাচ শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের ছবিতেও। তাঁর আঁকা বিখ্যাত অনেক পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট ল্যান্ডস্কেপ ছবিতে একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে দিগন্ত বিস্তারী প্রকৃতির মধ্যে কোথাও কালো ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যাচ্ছে বাষ্পচালিত রেলগাড়ি। এ ছাড়াও ভ্যান গঘের আঁকা কতগুলি অসাধারণ ড্রয়িং রয়েছে বরিনেজের কয়লা খনি অঞ্চলের শ্রমিকদের জীবনের দৈনন্দিন দুর্দশা নিয়ে। এটা জৈব জ্বালানি ব্যবহারের এবং উত্তোলনের সেই যুগ যখন খনি শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা প্রায় ছিল না বললেই চলে। প্রাকৃতিক সম্পদকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে যে শুধু পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে এমন নয়, একই সঙ্গে দুর্ঘটনায়, দুরারোগ্য ব্যাধিতে প্রাণ গেছে হাজার হাজার শ্রমিকের। এই ক্ষতিও মানবিকতার মূল্যে কিছু কম নয়। সেই সময়ের এক জীবন্ত দলিল হচ্ছে ভ্যান গঘের আঁকা কয়লাখনি সিরিজের ছবিগুলো। আসলে প্রকৃতির সঙ্গে শিল্পকলার সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। পৃথিবীর অধিকাংশ মহৎ শিল্পীই প্রকৃতিকে শিল্প শিক্ষার শ্রেষ্ঠ পাঠশালা বলে মনে করেছেন এবং সেই প্রকৃতির সৌন্দর্যের পুনঃনির্মাণে যত্নবান হয়েছেন। ইউরোপ থেকে শুরু করে ভারতবর্ষ এবং দূরপ্রাচ্য পর্যন্ত এই ধারা বহমান। আবার প্রাচীন ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসের একটা বড়ো অংশই স্থাপত্যকলার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত। অজন্তার চিত্রকলা বা ইলোরার ভাস্কর্য কলার সঙ্গে তার প্রাকৃতিক অবস্থানের বিশেষ সম্পর্ক আছে। আধুনিক কালে একেই ‘সাইট স্পেসিফিক আর্ট’ বলে উল্লেখ করা হয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে একটি মাত্র পাহাড় এবং পাথর কেটে ইলোরার কৈলাস মন্দিরের যে মনোলিথিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে তার উদাহরণ সারা পৃথিবীতে খুঁজলেও খুব কম পাওয়া যাবে। প্রাচীন ভারতীয় শিল্পের সঙ্গে যে পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক অবস্থানের একটা নিশ্চিত উপাদানগত যোগাযোগ ছিল একথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। ভারতবর্ষ থেকেই শিল্প ও প্রকৃতির এই আন্তঃসম্পর্কের ধারণা কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দূরপ্রাচ্যের দেশগুলিতে বিস্তার লাভ করেছিল। নব্বইয়ের দশকে যখন এনভায়রনমেন্টাল আর্টের আন্দোলন শুরু হয়, সেখানে শিল্পকর্ম নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার এবং পরিবেশ সংকটের বিষয়টিকে সচেতন ভাবে শিল্পকলার বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপনা করার প্রয়াস চালানো হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহারে শিল্পসৃষ্টির প্রক্রিয়া অন্তত ভারতবর্ষে বহুকাল আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। অবশ্যই তখন এই পরিবেশ সংকটের কোনও ধারণা মানবজাতির মধ্যে ছিল না, তাই শিল্পীদের মধ্যেও তা থাকা সম্ভব ছিল না, কিন্তু প্রকৃতি এবং পরিবেশের প্রতি যে সংবেদনশীলতা এবং এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় ।
আমি খুব সচেতন ভাবেই ‘এনভায়রনমেন্টাল আর্ট’ বিষয়ে প্রচুর তথ্যের সমাহার ঘটিয়ে এই লেখাটিকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। কারণ প্রথমত একজন শিল্পী হিসেবে আমার মনে সবসময়েই এমন কিছু খুঁজে দেখার আগ্রহ কাজ করে যা আমার সৃজনশীল মনের কোনও নতুন জানলা খুলে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত এই সময়ে দাঁড়িয়ে ইন্টারনেটের দৌলতে তথ্যের অনুসন্ধান এবং তার একত্রীকরণ করা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেইসব সংগৃহীত তথ্য নিয়ে কী করা হবে বা কীভাবে তথ্যকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়ে তাকে অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব হবে সেটাই এই মুহূর্তে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এইসব কারনেই আমি এই লেখায় বিখ্যাত শিল্পী ক্রিস্টোর কাজ নিয়ে কিছুই বলব না, উল্লেখ করব না মার্ক কাসাগ্রান্দের প্রকাণ্ড এনভায়রনমেন্টাল ইন্সটলেশনের কথা। কারণ এনভায়রনমেন্টাল আর্ট প্রসঙ্গে যে কোনও আলোচনায় এইসব শিল্পীদের সম্পর্কে ঝুড়ি ঝুড়ি তথ্য পাওয়া যায়। আমি সেইসব শিল্পীদের কাজকে আবার করে ফিরে দেখার চেষ্টা করব যারা সেই অর্থে শিল্পী হিসেবে তেমন কোনও আন্দলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, কিন্তু নিজেদের তাগিদে, নিজের সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে থেকে পরিবেশ এবং প্রকৃতির সঙ্গে শিল্পের আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটাতে পেরেছিলেন। এদেশে তো বটেই, আমি মনে করি সারা বিশ্বের শিল্পকলার ইতিহাসেই এই ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হলেন রামকিঙ্কর বেজ। শান্তিনিকেতনে প্রকৃতিকে গভীর সংবেদনশীলতার সঙ্গে জানা এবং তাকে সার্থক ভাবে কাজের মধ্যে প্রয়োগ করবার যে চর্চা রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল রামকিঙ্কর নিঃসন্দেহে তার সফলতম শিল্পীদের একজন। বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে প্রকৃতিকে চেনার মধ্যে দিয়েই তাঁর শিল্পীসত্তার জন্ম। তাই যখন যাই-ই করেছেন তার মধ্যে অন্তঃসলিলা হয়ে থেকে গেছে প্রকৃতির প্রতি গভীরতর সংবেদনশীলতার বোধ। ১৯৩৫ সালে যখন কালো বাড়ি আর সংগীতভবনের মাঝখানের ফাঁকা জমিতে সুজাতার ভাস্কর্য তৈরি করলেন, তখন মাধ্যম হিসেবে সিমেন্টের সঙ্গে মিশিয়ে নিলেন বীরভূমের মাটির লাল কাঁকর। সুজাতার পরিধানের শাড়ির নীচের অংশটিকে করে তুললেন একটি গাছের কাণ্ডর মতো। ফলে সুজাতার মূর্তিটি দেখে মনে হল সেটি যেন মাটির বুক থেকে জন্ম নেওয়া একটি প্রাকৃতিক বস্তু। মানুষের হাতে গড়া ভাস্কর্য নয়। মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু বুঝেছিলেন এই মূর্তির গুরুত্ব, তাই রামকিঙ্করকে বলেছিলেন সুজাতার চারপাশে গাছ লাগিয়ে দিতে। আজ সেইসব গাছ বড়ো হয়ে যখন শিকড় বিস্তার করেছে মাটির গভীরে তখন তার ভেতরে সুজাতার মূর্তিটি দেখলে মনে হয় সেটিও একটি গাছ, হয়তো রামকিঙ্কর তাকে চারা গাছ হিসেবে রোপণ করেছিলেন যা কালক্রমে মাটির রস টেনে বড়ো হয়ে উঠে আজকের এই চেহারায় এসে পৌঁছেছে। আধুনিক কালে নির্মিত আর কোনও ভাস্কর্যের মধ্যে এই গভীর প্রকৃতি চেতনা আছে বলে আমি মনে করতে পারছি না। প্রায় একই সময়ে গড়ে ওঠে কলাভবনের ছাত্রাবাস ‘কালো বাড়ি’ (১৯৩৬)। মাটি, খড়, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি এই বাড়ির স্থাপত্য ছিল সম্পূর্ণ দেশীয়। একালে যাকে এনভায়রনমেন্ট ফ্রেন্ডলি মাড হাউস বলে উল্লেখ করা হয়, কালো বাড়ির স্থাপত্য তেমনই ছিল। আবার মাস্টারমশাই নন্দলালের নির্দেশে এবং নেতৃত্বে রামকিঙ্কর সহ কলাভবনের অন্য ছাত্ররা (অন্যতম শিল্পী সুধীর খাস্তগীর, যার কন্যা শামলী খাস্তগীর পরিবেশ আন্দলনের এক অক্লান্ত কর্মী ছিলেন) কালোবাড়ির দেওয়ালে নির্মাণ করেন বিভিন্ন রিলিফ ভাস্কর্য যার উপাদান ছিল মাটি, গোবর ইত্যাদি। এই কাজ করতে গিয়ে রামকিঙ্কর ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উপাদানের গুরুত্বকে সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই আমার বিশ্বাস। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৩৮ সালে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর বিখ্যাত পরিবেশ ভাস্কর্য ‘সাঁওতাল পরিবার’।

‘সাঁওতাল পরিবার’ ভাস্কর্যটির গুরুত্ব আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে কতখানি এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার কোনও প্রয়োজন এখানে নেই। কিন্তু অন্য দিক থেকেও এই কাজটির বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। প্রথমেই মাধ্যমের উল্লেখ করা জরুরি। সুজাতা ভাস্কর্যে যে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন রামকিঙ্কর, সাঁওতাল পরিবার ভাস্কর্যে এসে তার চূড়ান্ত প্রকাশ এবং সাফল্য আমরা দেখতে পাই। বীরভূমের মাটির বালি এবং কাঁকরকে মূর্তির টেক্সচার হিসেবে এত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে যে তা মাটি থেকে উঠে আসা একটি প্রাকৃতিক নির্মাণ বলেই মনে হয়। ঠিক যেরকম উত্থান পতন দেখা যায় খোয়াইয়ের রুক্ষ প্রান্তরে মাটি বা উইয়ের ঢিবির মধ্যে। ইদানীং কালে রামকিঙ্করকৃত পরিবেশ ভাস্কর্যগুলিকে জাল দিয়ে ঘিরে ফেলায় এবং মাথার ওপরে ছাউনি নির্মাণ করে দেওয়ার কারণে তার প্রাকৃতিক আবেদন অনেকটাই ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কিন্তু পুরোনো শান্তিনিকেতনের চল্লিশের দশকে তোলা ফটোগ্রাফ দেখলে বোঝা যায় বড়ো বড়ো ঘাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সাঁওতাল পরিবার মূর্তির আসল রূপ। এই মূর্তি দেখলে মনে হয় এটি চিরকালই হয়তো এইখানে ছিল, হয়তো একে উপড়ে ফেললে দেখা যাবে যে মাটির গভীরে বহুদূর পর্যন্ত এর শিকড় বিস্তার লাভ করেছে। প্রাচীন ভারতীয় শিল্পের ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার এমন অসামান্য মেলবন্ধনের উদাহরণ এদেশ তো বটেই বিশ্বশিল্পকলার ইতিহাসেও খুব একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু এ তো গেল মূর্তিটির নির্মাণ কৌশলের প্রসঙ্গ। বিষয়বস্তুর দিক থেকেও সাঁওতাল পরিবার মূর্তির গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতবর্ষের প্রকৃতির সঙ্গে এদেশের প্রাচীন আদিবাসী সমাজ ও জীবনযাত্রার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এই আদিম আদিবাসী সমাজ প্রকৃতিকেই তাদের আরাধ্য বলে বিশ্বাস করে এসেছে সেই আদিকাল থেকে। তাই প্রকৃতি এবং পরিবেশকে রক্ষা করা ভারতীয় আদিবাসী সমাজের কাছে পবিত্র ধর্মাচরণ। এরাই যুগ যুগ ধরে পরম যত্নে প্রকৃতিকে রক্ষা করে এসেছে। আর তথাকথিত উন্নয়নের অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে যখন প্রকৃতিকে নির্বিচারে ধ্বংস করে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হল, তখন সবথেকে আগে এই আদিবাসীরাই হাজার হাজার বছরের জল-জঙ্গলের অধিকার হারালেন। নিজস্ব বাসভূমি থেকে তাঁদের নির্বাসিত হতে হল। আমরা আজ যখন দেখতে পাই উন্নয়নের দোহাই দিয়ে লক্ষ লক্ষ ভূমিপুত্রদের উৎখাত করে পাহাড়, নদী, জঙ্গল সমেত বিরাট বিরাট ভূখণ্ড নির্লজ্জের মত বড়ো বড়ো কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তখন বুঝতে পারি আজ থেকে চুরাশি বছর আগে তৈরি উৎখাত হওয়া, ডিসপ্লেসড হওয়া, চিরনির্বাসনে চলে যাওয়া সাঁওতাল পরিবারের মূর্তি আসলে আজকের এই নির্বিচারে পরিবেশ লুঠের আদিপর্বের জীবন্ত দলিল।
১৯৪০ সালে ‘সানাই’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—
“ওদিকে ধানের কল দিগন্তে কালিমাধূম্র হাত
ঊর্ধ্বে তুলি, কলঙ্কিত করিছে প্রভাত।
ধান পচানির গন্ধে
বাতাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে
মিশাইছে বিষ।”
এই কবিতা লেখার কয়েক বছর পরেই রামকিঙ্কর তৈরি করেন তাঁর আর একটি বিখ্যাত পরিবেশ ভাস্কর্য যার নাম ‘সাঁওতাল পরিবার’। কেউ কেউ এই মূর্তিটিকে ‘মিল কল’ নামেও অভিহিত করে থাকেন। যে ধানের কলের কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় লিখেছেন সেই কলের বাঁশি শুনে স্নান করে কাপড় শুকোতে শুকোতে দৌড়ে চলেছে দুটি সাঁওতাল যুবতি, আর তাদের পিছনে ছুটে চলেছে একটি বালক। এই সাঁওতাল যুবতিরা জল জঙ্গলের অধিকার হারানো সেই জাতির প্রতিনিধি যারা আজ নিজের হাজার বছরের ভূমি ছেড়ে অন্য জায়গায় এসে ধান কলের মজুরের চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছে। এই সেই ধান কল, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যা বাতাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে। এ যেন এক আশ্চর্য আয়রনি। প্রাকৃতিক উপাদানে, বীরভূমের বালি কাঁকরের প্রয়োগে নির্মিত এক পরিবেশ ভাস্কর্য, যা কিনা আক্ষরিক অর্থেই একেবারে ‘মাটি থেকে উঠে আসা’ একটি শিল্পকর্ম, তুলে ধরেছে এমন এক বাস্তব সত্যকে, যেখানে একদা জল, জঙ্গল ও প্রকৃতির রক্ষকের উত্তরপুরুষেরা সর্বস্ব হারিয়ে জীবিকার সন্ধানে এমন কাজে যুক্ত হয়ে রয়েছে যা একাধারে প্রকৃতি ও তাদের জীবন দুটিকেই তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। রামকিঙ্কর যখন এই ভাস্কর্য তৈরি করেন তখন গ্লোবাল ওয়ার্মিং, গ্রিনহাউস গ্যাস, ওজোন লেয়ার ইত্যাদি শব্দবন্ধের সঙ্গে সাধারন মানুষের তেমন কোনও পরিচয় ছিল না। ফলে সচেতন ভাবে শিল্পীদের পক্ষেও এই বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট শিল্পবস্তু নির্মাণ করবার প্রশ্ন ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথকে আমি এই আলোচনা থেকে বাদ রাখছি, কারণ তিনি নিজের সময়ের থেকে বহু বহু এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু রামকিঙ্করের মতো যে শিল্পীরা সংবেদনশীলতা এবং সততার সঙ্গে নিজের সময়কে কাজের মধ্যে ধরে রাখবার প্রয়াস চালিয়েছেন, তাঁদের কাজে আপনাথেকেই সময়ের এমন কিছু লক্ষণ ধরা পড়ে গেছে যা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কীভাবে ধীরে ধীরে আমরা আজকের এই পরিবেশ বিপন্নতার সম্মুখীন হলাম।

শিল্পকলা বিষয়টাকে অনেকেই কেবলমাত্র প্রোপ্যাগান্ডা করবার একটা মাধ্যম ছাড়া বিশেষ কিছুই ভেবে উঠতে পারেন না। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গণ-আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা চিরকালই মনে করেছেন তাঁরা তাঁদের বক্তব্যের স্বপক্ষে কোনও একটি ধারণা বা থিয়োরি দিয়ে দেবেন এবং শিল্পীরা তারই ভিত্তিতে ছবি এঁকে, মূর্তি গড়ে আন্দোলনের প্রোপ্যাগান্ডা করবার কাজকে শক্তিশালী করে তুলবেন। রাজনৈতিক আন্দোলন হোক অথবা পরিবেশ আন্দোলন, শিল্পীদের কাছে এইটুকুই চাহিদা। অপর পক্ষে শিল্পীরা আসলে কেবলমাত্র প্রগতিশীল এবং বুদ্ধিমান মানুষই নন, স্বাধীনচেতাও বটে। ফলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের দিয়ে কখনোই প্রোপ্যাগান্ডা মেশিনারির কাজ করানো যায়নি। শিল্পীরা যখনই কোনও আন্দোলনে শামিল হয়েছেন, সেটা হয়েছেন তাঁদের অন্তরের তাগিদে, শুভবুদ্ধির সপক্ষে দাঁড়ানোর মানসিকতা থেকে। কোনও নেতার থিয়োরিকে জাস্টিফাই করে যাওয়া বা তার হুকুম তামিল করে যাওয়ার জন্য সত্যিকারের শিল্পীদের কখনও পাওয়া যায়নি, যাবেও না। ঠিক এই কারণে পরিবেশের সংকট নিয়ে সেইসব শিল্পীদের কাজই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যারা কারোর হুকুম তামিল করতে বা কোনও থিয়োরিকে প্রতিষ্ঠা করতে শিল্প সৃষ্টি করেননি। এইসমস্ত শিল্পীদের কাজের মধ্যে পরিবেশের সংকটই একমাত্র বিষয় নয়। যে বিশেষ রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক কারণে আমাদের প্রকৃতি আজ ধ্বংসের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে তার সামগ্রিক একটা ডকুমেন্টেশন নিজের তাগিদেই শিল্পীরা তাদের কাজের মধ্যে করে গিয়েছেন। কী কারণে, কেন, কাদের কায়েমি স্বার্থ রক্ষা করতে আজ কয়েক দশক ধরে চলা বিশ্বব্যাপী পরিবেশ আন্দোলনগুলো বার বার ভেস্তে যাচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে যে নির্বোধের দল ভ্যান গঘের আঁকা ছবির ওপরে টোম্যাটো স্যুপ ঢেলে দিচ্ছে তারা আসলে শেষ পর্যন্ত কোনও আন্দোলনেরই পক্ষে নয়। তাদের এই গিমিকসর্বস্বতা এবং হঠকারিতা আসলে পরিবেশ সংকটের মতো একটা জীবনমরণ সমস্যার গুরুত্বকে অকারণে লঘু করে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে যদি আমি আমার উত্তরপুরুষের টিকে থাকার স্বার্থে পরিবেশ সংরক্ষণের কথা বলি তার মানে আমি এনভায়রনমেন্টাল অ্যাক্টিভিস্ট নই। শিল্পী, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, মোক্তার, ইঞ্জিনিয়ার নির্বিশেষে পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল হওয়াটা এই সময়ের সভ্য জগতের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। আমরা যে যেভাবে পারব এই কাজে অংশগ্রহণ করব এইটাই মূল কথা। রামকিঙ্করের অর্ধশতাব্দী পরে শিল্পী হিসেবে আমার যাত্রা শুরু হয়েছে। এই বিশ্বব্যাপী বয়ে চলা ইনফরমেশনের সুনামির মধ্যে বসে নিজের অবস্থান নির্ণয় করাটা আমার অন্যতম প্রধান কাজ বলে আমি মনে করি। আমার নিজের কাজের মধ্যে যখন পরিবেশ সংকটের ইঙ্গিত উঠে আসে তখন সেটা কারোর হুকুম তামিল করবার জন্য নয়। ২০১৩ সালে আঁকা আমার একটা ছবি আছে যার নাম ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’। সেখানে আমি দেখিয়েছি মাথায় হেলমেট, হাতে দস্তানা এবং শরীরে তাপ নিরোধক স্যুট পরা এক শ্রমিক বেলচা দিয়ে মাটি কাটার কাজ করছে। কিন্তু সে সবুজ ঘাস এবং মাটি সমেত সেইটুকু ভূখণ্ডের ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে যতটুকু তার দুটি পা রাখার উপযুক্ত। এর বাইরে সমস্ত পৃথিবীকে সে ধ্বংস করে ফেলেছে। এই সামান্য জমিটুকু শূন্যে ভাসমান কিন্তু সেটাকেও সে কেটে ফেলতে উদ্যত। এই ছবি কারোর ফরমায়েশে আঁকা নয়, এই সময়ে দাঁড়িয়ে যে প্রাকৃতিক সংকট, বিপন্নতা এবং মানুষের নির্বুদ্ধিতার বিবিধ পরিচয় আমি পেয়ে চলেছি, আমার সময়ের একটা সৎ ডকুমেন্টেশনের তাগিদে তাকেই ধরে রাখার জন্য এই ছবি আঁকা। শিল্পী হিসেবে আমি এতেই বিশ্বাস করি। তাই আমার লেখায় সচেতন ভাবেই পরিবেশ বিষয়ক যাবতীয় প্রোপ্যাগান্ডা আর্টের উদাহরণকে বাদ দিয়ে এমন কিছু শিল্পকর্মের কথা বলার চেষ্টা করলাম যেখানে পরিবেশ, প্রকৃতি এবং মানবজীবনের ওপরে ঘনিয়ে ওঠা সংকট ও তার পূর্বাভাস বহুকাল আগে থেকেই সংবেদনশীল শিল্পীদের কাজের উপজীব্য হয়ে উঠেছে। এইজন্য তাঁদের কাউকেই কোনও বিশেষ মতাদর্শ বা প্রচারযন্ত্রের অংশ হতে হয়নি। আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আর দশরকম অন্য পেশার মানুষদের মতোই শিল্পীরাও পরিবেশ সচেতনতার অংশিদার হবেন, নিজের মতো করে নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে তার কথা বলবেন, এইটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ বলে আমার মনে হয়। এর বেশি আর কিছুই বলবার নেই।
