সুকান্ত সরকার
ভাগ্যদুল পারা। বয়স ৪২। নিবাস পয়লা ঘেরী, মৌসুনি দ্বীপ। জেলে পরিবারের সন্তান। ছেলেবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে কখনও সাগরে কখনও বা সুন্দরবনের খাঁড়িতে মাছ ধরতে যাওয়ার শুরু। তারমধ্যেই ক্লাস টেন লেখাপড়া। মাধ্যমিক দেওয়া হয়নি। প্রথমে ঘর ছিল মুড়িগঙ্গার কিনারে। সাগরে জল বাড়ছে বহুদিন ধরেই। সেবার হলো কি রাতারাতি মুড়িগঙ্গা ঢুকে পড়ল ভাগ্যদুলদের ঘরে। বইপত্তর, বাসন-কোসন, মায় বিছানা সব গেল জলের তলায়। ঠাকুরদার আমলের মাটির ঘর ধুয়েমুছে সাফ। তারপর? “তারপর আর কি! আমরা পিছনের দিকে এগিয়ে দ্বীপের আরও ভিতরে এসে কোনও রকমে সামান্য জমি কিনে ফের মাটির ঘর তুললাম। সেখানেই এখনও থাকি।” ভাগ্যদুলের তখন বয়স ১৫-১৬। লেখাপড়া শিকেয় তুলে বাবার সঙ্গে রোজ তখন থেকেই মাছ ধরতে যাওয়া। তবু, সংসার সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ল। আগে মুড়িগঙ্গার পাড়ে শুধু ঘরই ছিল না, ছিল লাগোয়া কয়েক বিঘে জমিও। সেখানে চাষাবাদ মন্দ হত না। নিজেরা খেয়েও হাটে বেচে দুটো পয়সাও ঘরে আনত ভাদ্যদুলের বাবা-কাকারা। ঘর যাওয়ার অনেক আগেই সে সব জমি মুড়িগঙ্গার পেটে গেছে। বাবার বয়স বাড়লে ভাগ্যদুল তার কাকাদের সঙ্গে মাছ ধরতে যেত। কিন্তু, সংসার চালানো দিন দিন কষ্টকর হয়ে উঠতে শুরু করল। বছর বারো-তেরো আগের কথা। দ্বীপের কয়েকজন মাছ ধরতে কেরলে গিয়েছিল। তারা ছুটিতে দ্বীপে ফিরল। তাদের মুখে কেরলে বড়ো ট্রলারে আরব সাগরে মাছ ধরার কথা শুনে আর পারিশ্রমিকের পরিমাণ জেনে ভাগ্যদুল ঠিক করে ফেলল সেও কেরলে যাবে। সেই থেকে ভাগ্যদুল কেরলে। বছরে একবার দিন পনেরোর জন্য ঘরে ফেরে। প্রতি মাসে বাড়িতে টাকা পাঠায়। এখন অনলাইনে। চলছিল মন্দ নয়। ইতিমধ্যে এই দ্বীপের আরও অনেকেই ভাগ্যদুলের মতো কেরল বা তামিলনাড়ুতে মাছ ধরার কাজে বা অন্য কাজে চলে গিয়েছে। বছর দুই আগে করোনার প্রকোপ বাড়তেই কেরল থেকে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে মৌসুনি দ্বীপের আরও জনা বিশেক পরিযায়ী মৎস্যজীবীর সঙ্গে ঘরে ফেরে ভাগ্যদুল। ফেরার পথেই ঠিক করে, যা সামান্য সঞ্চয় রয়েছে তা দিয়ে নিজের একটা নৌকো বানিয়ে আরব সাগরে নয় বঙ্গোপসাগরেই মাছ ধরে বাকি জীবনটা এই দ্বীপেই কাটিয়ে দেবে। দ্বীপে ফিরে কয়েক দিন কাটানোর পর সবে যখন নৌকো তৈরির তোড়জোর শুরু করল ভাগ্যদুলরা তখনই খবর এল, ঝড় আসছে। উম্পুন। নিজেরা গ্রামের পাকা স্কুল বাড়িতে গিয়ে রক্ষা পেলেও ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে একাকার। ঘরের টিনের চাল কোথায় উড়ে গেল তার হদিস পাওয়া যায়নি। ঝড়ের দাপটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির আর সাগরের নোনাজল দ্বীপে ঢুকে সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেল। ঝড় থামার পর ভাগ্যদুলের পরিবারের সকলের অবস্থা দ্বীপের আরও কয়েক হাজার হতভাগ্য বাসিন্দার মতোই হল। কয়েক দিন বাদে ভাগ্যদুল তার জমানো টাকা দিয়ে নৌকো নয় ঘর বানাতে শুরু করল। এর মাস তিনেক পরে ভাগ্যদুল একদিন কেরলে ট্রলার মালিকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে ফের কেরল যাওয়া পাকা করে ফেলে।
ভাগ্যদুল একা নয়, ওর মতো হাজার ১০-১২ পরিযায়ী মৎস্যজীবী বা পরিযায়ী শ্রমিক মৌসুনি দ্বীপ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। বলা ভালো, বাধ্য হচ্ছে প্রতিদিন। ওরা বঙ্গোপসাগরের কোলে এই মৌসুনি দ্বীপের সন্তান। আজন্ম দেখা এবং চেনা-জানা সাগরই আজ ওদের গিলতে আসছে তা যেন ভাগ্যদুলদের বিশ্বাসই হয় না। “জমি গেছে। ঘর ভেঙেছে। তবু, আরব সাগরে মাছ ধরার ট্রলারে কাজের ফাঁকে ঘরের কথা বলতে তো এই দ্বীপের কথাই বারবার মনে হয়” — স্বগতোক্তি ভাগ্যদুলের।
সম্প্রতি মৌসুনি দ্বীপে গিয়েছিলাম। আগেও বেশ কয়েকবার গিয়েছি। একাধিক দ্বীপবাসীর সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের সুবাদে এই দ্বীপের সঙ্গে একটা সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। এবারে গিয়েছিলাম লকডাউনে মৌসুনিতে ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের খোঁজখবর নিতে। মৌসুনি ডুবছে — এ কথা জানি। অনেক দিন ধরেই জানি। অনেকেই জানে। আগে কম হলেও ইদানীং প্রায়ই খবরের কাগজে বা টিভির পর্দায় ডুবন্ত মৌসুনি নিয়ে ঘনঘন প্রতিবেদনও নজরে পড়ে। মৌসুনির বাসিন্দারাও জানে, দ্বীপ ডুবছে। মৌসুনি বেশ বড়ো দ্বীপ। দ্বীপের সমুদ্রের দিকের লোকজন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। মূলত তারাই দ্বীপ ছেড়ে যাচ্ছে। তাদের ঘরের ছেলেরাই কাজের খোঁজে পাড়ি জমাচ্ছে ভিন রাজ্যে। বংশ পরম্পরার পেশা ছেড়ে নতুন নতুন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তবে, এখনও তাদের নিজের ঠিকানা এই ডুবন্ত দ্বীপই। তারা মনে করে, এত বড়ো দ্বীপের খানিকটা ডুবলেও বাকি অংশে মাথা গোঁজার মতো এক চিলতে জমি ঠিকই পাওয়া যাবে। তাই, যেখানেই কাজে যাক না কেন ভাগ্যদুলরা ফিরে আসতে চায় এই মৌসুনিতেই।
এই দ্বীপের মানুষেরা কেন পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে যাচ্ছে তা জানার তাগিদেই দ্বীপের সামগ্রিক অবস্থার দিকে একটু নজর দেওয়া যেতে পারে। সমুদ্রে জলস্ফীতি বৃদ্ধির দরুন দ্বীপটি দ্রুত ডুবছে। ঝড়-বৃষ্টির দাপটে সমুদ্রের নোনাজল দ্বীপের ভিতর ঢুকে চাষের জমি নষ্ট করছে। নষ্ট করছে পুকুরের মিষ্টি জলের মাছ। সমুদ্রের কাছে জমি, বাড়ি হারিয়ে এক রকম উদ্বাস্তু হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। এই উদ্বাস্তু মানুষজনের অনেকেই দ্বীপের ভিতরে আপাত নিরাপদ জায়গায় কোনও রকমে টালির বা টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘর করার এক চিলতে জমি পেলেও আবাদ করার মতো জমি বা দ্বীপে অন্য কোনও নতুন জীবীকার কিছু খুঁজে পায় না। তাই, বাধ্য হয়েই তারা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। বেশির ভাগই কাজের জন্য দক্ষিণ ভারতে বিশেষ করে কেরল, তামিলনাড়ু বা অন্ধ্রপ্রদেশে যেতে পছন্দ করে মূলত বেশি মজুরির কারণে। দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন রাজ্যে যে পরিযায়ী শ্রমিকরা, সে মৎস্যজীবীই হোক বা নির্মাণ শ্রমিকই হোক বা অন্য কোনও পেশার হোক, কেউই তাদের কাজের জায়গায় পাকাপাকি ভাবে থাকার কথা চিন্তা করে না। প্রায় প্রত্যেকেই কিছু টাকা সঞ্চয় করে ফিরে আসতে চায় এখানেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, দ্বীপ ডুবছে জেনেও এই পরিযায়ী শ্রমিকরা কিছু সঞ্চয় করে ফের এই দ্বীপেই ফিরে ঘর বাঁধতে চায়, এখানেই ‘ছোটোখাটো’ ব্যবসা বা কারাবার করার পরিকল্পনা করে বা স্বপ্ন দেখে আজও। কিন্তু, মৌসুনির বাস্তবতা অন্য কথা বলে।আজও এই দ্বীপের প্রধান পরিবহণ বলতে মোটর চালিত নৌকো বা ভুটভুটি। দ্বীপের ভিতরে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এখন অবশ্য বিস্তর টোটো চলাচল করে। ইদানীং দ্বীপের সাগর-লাগোয়া মৌজা বালিয়াড়ায় বৈধ-অবৈধ ভাবে খান সত্তর রিসর্ট তৈরি হওয়ায় ওই এলাকার বেশ কিছু মানুষের আয়ের নতুন পথ খুলেছে। তবে, বেশির ভাগ যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়েছে। এরই মধ্যে পর্যটকের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় কিছু মানুষ ছোটোখাটো ব্যবসা করার যে সুযোগ পাচ্ছে তা অস্বীকার করা যায় না। তবে, পর্যটন এখনও দ্বীপের সামগ্রিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। পর্যটন চলছে বটে, কলকাতা থেকেও পর্যটকরা যাচ্ছে। কিন্তু, মৌসুনি দ্বীপে পর্যটন শিল্পের তেমন কোনও ভবিষ্যৎ যে নেই তা বলাই বাহুল্য। কারণ, সমুদ্রে জলস্তর বাড়ছে, মৌসুনি ডুবছে এবং মৌসুনি ডুববেই বলে সমুদ্র-বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে পরিবেশবিদরা স্পষ্ট জানাচ্ছেন।
“এই দ্বীপ ডুবতে আরও অন্তত ৫০-৬০ বছর কিংবা তারও বেশি দিন লাগবে” বেশ স্বস্তি প্রকাশ পায় চিনার নদীর পাড় লাগোয়া বাগডাঙার বাসিন্দা এবং মৌসুনি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মধ্য পঞ্চাশের রামকৃষ্ণ মণ্ডলের কথায়। পাশাপাশি, তিনি স্বীকার করেন, দ্বীপের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁদের সীমাবদ্ধতার কথাও। কিছুটা আফসোস করেই বলেন, ‘আসলে সকলেই তো জানে এ দ্বীপ একদিন থাকবে না তাই, কেউই, কোনও স্তরেই আমাদের জন্য কোনও দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা করতে এগিয়ে আসে না।’ এই দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ মৎস্যজীবী হলেও এখানে মৎস্যজীবীদের জন্য কোনও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা কেউ কোনও দিন ভাবেনি। যেমন, ভাবেনি মৎস্য শিকারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরির জন্য কোনও শিল্প, তা সমবায়ের মাধ্যমেই হোক বা ছোটোখাটো উদ্যোগেই হোক গড়ে তোলা বা তুলতে উৎসাহিত করার কথা। উলটোদিকে, দ্বীপ প্রতিদিন জমি হারাচ্ছে সাগরের কাছে। সাগরের নোনাজল ঢুকে চাষের জমিকে বাঁজা করে দিচ্ছে বেশ কয়েক বছরের জন্য। লোকসংখ্যাও বাড়ছে দ্বীপে। মৌসুনিতে রোজগার নেই। তাই, প্রতিদিন দ্বীপ ছাড়ছে মানুষ। পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে যাচ্ছে এ দ্বীপের মৎস্যজীবী থেকে কৃষিজীবীরা। সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি রাজ্যের প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘কোনও জোয়ান ছেলে আর সুন্দরবনে নেই। সবাই পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে।’ গত দু-বছরে করোনাকালের লকডাউনে যত পরিযায়ী শ্রমিক মৌসুনিতে, তাদের পাকা ঠিকানায় ফিরে এসেছিল এখন তারা ফের ভিন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে আরও নতুন নতুন পরিযায়ী শ্রমিক। কেননা, এখানে কাজ নেই, ভাত নেই !
দুই
কেন পরিযায়ী হতে হয় ভাগ্যদুলকে
শুধু মৌসুনিই নয়, লোহাচরা, সুপারিভাঙ্গা দ্বীপ দুটি ইতিমধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। ঘোড়ামারা এবং সাগর দ্বীপের পরিস্থিতিও অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দ্বীপ দুটি প্রতিদিন ডুবছে। ১৯৭৫ সালে ঘোড়ামারার আয়তন ছিল ৮.৫১ বর্গ কিলোমিটার। ২০১২ সালে তা দাঁড়ায় ৪.৪৩ বর্গ কিলোমিটারে। সমুদ্রে জলস্ফীতির ফলে বর্তমানে ঘোড়ামারার তিন-চতুর্থাংশই জলের তলায়। বস্তুত, প্রতি বছরই দ্বীপের ঘর-বাড়ি-সহ একরের পর একর জমি যাচ্ছে জলের পেটে। ৩০ বছর আগে ওই দ্বীপের লোকসংখ্যা ছিল ৪০ হাজার, বর্তমানে তা মেরেকেটে হাজার পাঁচেক। জমি, ঘর হারিয়ে বাসিন্দারা বিশেষ করে যুবকরা চলে যাচ্ছে কেরলের মতো রাজ্যে, যেখানে দিন মজুরির কাজে মজুরি অন্যান্য জায়গার থেকে বেশি। পরিবারের বাকিরা নামখানা, কাকদ্বীপ, গড়িয়ার মতো জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। দ্বীপ তাদের ছাড়তেই হবে এটা জানে ঘোড়ামারার বর্তমান বাসিন্দারাও। প্রতিদিন ভোরে মৌসুনি দ্বীপের বাগডাঙ্গা বা বালিয়ারা ফেরিঘাটে কিংবা ঘোড়ামারার ফেরিঘাটে দেখা যায় অন্যান্য যাত্রীদের ভিড়ে মিশে রয়েছে এমন অন্তত ১০-১২ জন যুবক যারা ভিন রাজ্যে যাচ্ছে কাজের খোঁজে। এ রকমই এক যুবক ঘোড়ামারার অজয় পাখিরা এক রাশ হতাশা উগড়ে দিয়ে বললেন, “এ দ্বীপে আর কিছু নেই। যে জমি রয়েছে তাতে ফসল হয় না। ‘আমফান’ আর ‘ইয়াস’ নোনাজল ঢুকিয়ে জমি বাঁজা করে দিয়েছে। ছোটোখাটো ব্যবসা করার মতো সামান্য টাকাও মানুষের হাতে নেই। পঞ্চায়েতের হাতেও মানুষকে দেওয়ার মতো কিছু নেই। এখানে কিছু করার নেই। আর আমাদের দ্বীপ প্রতিদিন ডুবছে। তাই, দ্বীপ ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের কাছে অন্য কোনও উপায় নেই। একদিন সবাইকেই এই দ্বীপ ছেড়ে যেতেই হবে।”
ঘোড়ামারার কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে সাগর দ্বীপ। বেশ বড়ো দ্বীপ। সাগর দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার একটি ব্লক। এই দ্বীপে লোহাচরার এবং ঘোড়ামারার উদ্বাস্তুদের অনেককে সাগরে পুনর্বাসনও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, বঙ্গোপসাগরে জলস্ফীতির দরুন এই দ্বীপও ডুবতে শুরু করেছে। সাগর সুন্দরবনের অন্যান্য দ্বীপের চাইতে কিছুটা উঁচুতে থাকায় ধরে নেওয়া হয়েছিল যে এই দ্বীপের জলের তলায় যাওয়ার সম্ভাবনা কম এবং বেশ বড়ো দ্বীপ হওয়ায় ও ব্লক হওয়াতে এখানে কাজকর্মের সুযোগ বেশি থাকায় ডুবন্ত দ্বীপগুলির উদ্বাস্তুদের একাংশকে এই দ্বীপে পুনর্বাসন দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু, ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা গেল, সাগরের জনসংখ্যা ২০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই দ্বীপের অর্থনীতি-সহ বিভিন্ন দিকের উপর চাপ বাড়ছে। এরপর সাম্প্রতিক ‘ইয়াস’ ঘূর্ণিঝড়ের পর দেখা গেল, সাগরদ্বীপও ডুবতে শুরু করেছে। সুতরাং, সাগরদ্বীপও আর নিরাপদ নয়। এই দ্বীপও আজ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার।
সুন্দরবন। ভারত এবং বাংলাদেশ, দু-দেশ মিলিয়ে আয়তন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভারতে রয়েছে ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার। অখণ্ড সুন্দরবনের মোট লোকসংখ্যা কম বেশি ৮০ লক্ষ। ভারতীয় সুন্দরবনের লোকসংখ্যা ৪৬ লক্ষেরও বেশি। বিশ্ব ব্যাংকের ২০২০ সালের একটি রিপোর্ট-এ দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় সুন্দরবনের বাসিন্দাদের অধিকাংশই প্রান্তজীবী। তাদের দৈনিক জীবনযাপনের ব্যয় ১.৯০ ডলার। তুলনায় বাংলাদেশের সুন্দরবনের বাসিন্দাদের জীবনযাপনের ব্যয় কিছুটা বেশি। বোঝাই যাচ্ছে, এমনিতেই অধিকাংশ সুন্দরবনবাসী (ভারতীয় অংশের) চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। দারিদ্র্যের কারণে বহুদিন ধরেই সুন্দরবন থেকে মানুষ মূলভূমিতে অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় জীবন-জীবিকার তাগিদে চলে যাওয়া শুরু করেছে। যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে তা হলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এশিয়ার মধ্যেই শুধু নয়, বিশ্বের মধ্যে ভারতীয় সুন্দরবন থেকেই সবচেয়ে বেশি মানুষ পরিযায়ী হবে বলে বিশ্ব ব্যাংকের ওই রিপোর্ট-এ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। জীবিকার খোঁজে সুন্দরবন থেকে মানুষের অন্যত্র যাওয়া নতুন কোনও ঘটনা নয়। কিন্তু, ঠিক কবে থেকে সুন্দরবনের মানুষ পরিযায়ী হতে শুরু করে তার কোনও রেকর্ড নেই। তবে, কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, ষাটের দশকের প্রথম দিক থেকেই এই পরিযানের শুরু। শুরুতে সুন্দরবন থেকে বেরিয়ে মানুষ প্রধানত কলকাতা এবং তার আশপাশে গেলেও পরবর্তীকালে গন্তব্যের তালিকায় যোগ হয় উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাডু, কেরল, মুম্বই, রাজস্থান, দিল্লি। এ ছাড়া, সংখ্যায় কম হলেও অসম-সহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিও সুন্দরবনের পরিযায়ীদের গন্তব্যের তালিকায় ঢুকে পড়ে। নানা কারণে সুন্দরবনের মানুষ দেশান্তরী হলেও আজকের সুন্দরবনের মানুষের কাছে ভিটে-মাটি ছাড়ার সবচেয়ে বড়ো কারণ জলবায়ু পরিবর্তন । সুন্দরবনের একেবারে দক্ষিণের দ্বীপ মৌসুনি, সাগর, ঘোড়ামারা বা বসতি-শূন্য জম্বুতে গত কয়েক দশক ধরে যা ঘটে চলেছে তা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই যে ঘটছে তা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না। পাশাপাশি, এ কথাও মনে রাখা দরকার, যা আজ ঘোড়ামারা বা মৌসুনি দ্বীপে ঘটছে তা গোটা সুন্দরবনের জন্য অশনি সংকেত । চার-পাঁচ দশক আগে যখন লোহাচরা বা তারও আগে সুপারিভাঙ্গা দ্বীপ নিশ্চিহ্ন হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় সেই সময় কেউ ভেবেই উঠতে পারেনি যে, সুন্দরবনের অন্য কোনও দ্বীপেরও ভবিষ্যতে জলেরতলায় বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ! সেই সময় পরিবেশ নিয়ে আজকের সচেতনতা তো ছিলই না এবং জলবায়ুর পরিবর্তন হেতু যে অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবনকে গুনাগার দিতে হবে সেই সতর্ক বার্তাও দেশের সরকার বা কোনও গবেষণা প্রতিষ্ঠান শুনিয়েছিল বলে জানা নেই। সেদিন একটু একটু করে জলের তলায় দ্বীপ চলে যাওয়ার সময় সুন্দরবনের সাধারণ মানুষের মতোই সকলেই ধরে নিয়েছিল নদীর স্বাভাবিক নিয়মেই ভাঙাগড়ার প্রক্রিয়া চলছে! আজ কিন্তু, পরিস্থিতি অন্য দাবি করছে। কোনও সরলীকরণ নয়। সুন্দরবন নিয়ে সমুদ্র-বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা দু-তিন দশক ধরে ক্রমাগত সতর্ক করে আসছে। কিন্তু, সরকারি বা রাজনৈতিক স্তরে এখনও সুন্দরবনকে এবং সুন্দরবনের মানুষকে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে বাঁচানোর তেমন কোনও কার্যকারী পদক্ষেপ করতে দেখা যাচ্ছে না। সরকারি উদ্যোগে বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু কাঁচাবাঁধ দিয়ে বা কিছু কিছু দ্বীপে সাইক্লোন শেলটার নির্মাণ করে এই সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এ জন্য চাই, সমুদ্র-বিজ্ঞানী এবং নির্মাণ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে রচিত বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক পরিকল্পনা। সরকার যা গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়িত করলে এই সমস্যার অনেকটাই মোকাবিলা করা সম্ভব। সমুদ্রে শুধু জলস্তর বৃদ্ধি পেয়ে অঘটন ঘটে চলেছে এমনটা ভাবাই যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে সুন্দরবনের ক্ষেত্রে। সুন্দরবনের বিশ্ব-বন্দিত ম্যানগ্রোভ। যে ম্যানগ্রোভ প্রাচীর শুধু সুন্দরবনকেই নয়, বড়ো ধরনের প্রাকৃতিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা-সহ কলকাতাকে রক্ষা করে বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন। সেই ম্যানগ্রোভ-এর জঙ্গল ধ্বংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর জন্য এক শ্রেণির মানুষ যেমন দায়ী, পাশাপাশি দায়ী ঘনঘন ঘূর্ণিঝড়ও। যা গত কয়েক বছর ধরে বেড়েই চলেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রকৃতির এই খামখেয়ালি আচরণের পিছনেও রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। তাই, জলবায়ু পরিবর্তনে উদ্ভূত পরিস্থিতির ঠিকঠাক মোকাবিলা করতে না পারলে শুধু সুন্দরবনেরই নয় সমূহ বিপদ গোটা দক্ষিণবঙ্গেরই।