সুন্দরবনের সংকট : একটি সম্ভাব্য নীল নকশা

সুগত হাজরা

ইয়াস সাইক্লোন আর পরবর্তী জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবন বসতি ও বনভূমি অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় আবার এই প্রশ্নটাকে সামনে আনল — সুন্দরবনের এই মানবিক সংকটের কি কোনও স্থায়ী সমাধান সম্ভব? বিদেশি শাসক আর দেশি জমিদারদের তত্বাবধানে ২০০ বছর ধরে ম্যানগ্রোভ বনভূমি ধ্বংস করে, নদীগুলিকে বেঁধে মেরে ফেলে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, স্বাধীনতার পরে লাফিয়ে বাড়তে থাকা জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে যে সমস্যা ক্রমাগত বেড়েছে, তা কি একদিনে সমাধান হতে পারে?

কিন্তু শুরু তো করতে হবে কখনও, আর সেটা আমাদেরই করতে হবে। আর তার জন্য শুধু বাঁধ নিয়ে নয়, সুন্দরবনের মানুষ, জল জঙ্গল আর জমি নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা করতে হবে।

সমুদ্র আর নদী বিধৃত সুন্দরবনের দ্বীপমালার অর্ধেক এখন মানুষের আর বাকি নোনা নদী আর ম্যানগ্রোভ অরণ্যের। প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ৩৫০০ কিলোমিটারের বেশি নদী বাঁধ (ডাইক) দিয়ে ঘেরা ১০৩১টি গ্রামে মূলত চাষবাস করেন, মাছ ধরেন, জঙ্গল আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

২০০ বছরের আগে যে অষ্ট-মাসি বা দশ (মাসি) ঘেরির সাময়িক মাটির বাঁধ দিয়ে আবাদের শুরু সুন্দরবনে, জনবসতি বাড়ার সাথে সাথে সেই বাঁধই এখন হয়ে উঠেছে সুন্দরবনের মানব জমিনের স্থায়িত্বের প্রধান শর্ত। প্রতিদিন জোয়ারের জল ১২-১৫ ফুট ওঠে নামে, বাঁধ জল আটকায়, মানুষ বাঁচে কিন্তু নদী মরতে থাকে। জোয়ারের পলিকে ছড়িয়ে দিতে পারে না দ্বীপের বুকে, পলি পড়ে নদীর মধ্যেই, চরা পড়ে, নদী অগভীর হয়ে যেতে থাকে, জলতল বাড়ে। গোসাবার পাশ দিয়ে নৌকা করে গেলে দেখা যায়, আমাদের নৌকা নিয়ে জোয়ারের জল গ্রামের বাড়ি ঘরের থেকে উঁচু দিয়ে বইছে। ম্যানগ্রোভ কেটে, নদীর পাড় ঘেঁষে বেহুন্দি জাল টেনে বাড়ে ভূমি ক্ষয়, বাড়ে বাঁধ ভাঙা নোনা বন্যার প্রবণতা। তাই সুন্দরবনের বসত-আবাদে এখন নানা ধরনের বাঁধ— সমুদ্রের সামনে বোল্ডার আর উঁচু কংক্রিটের ঢালাই, দ্বীপের গায়ে কাদা মাটি আর ইটের, আর দ্বীপের ভিতরে খাঁড়ির ধারে মাটির বাঁধ।

এমনই চলতে পারত, কখনও নোনা বন্যায় কখনও আনন্দে আবাদে, যদি না সারা পৃথিবীর জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন শুরু হত। বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই অপরিমিত খনিজ তেল কয়লার ব্যবহার, বনসংহার, অপরিসীম লোভ ও ভোগবাদী সভ্যতার দাপটে দ্রুত বাড়তে লাগল বাতাসের কার্বন আর পৃথিবীর তাপমাত্রা। বাড়তে লাগল সাগরের তাপমাত্রা, ফুলে উঁচু হতে লাগল সমুদ্রের জল, আরও বাড়তে লাগল গ্রিনল্যান্ড অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলা জলে।বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা এমন হারে বাড়তে লেগেছে যে ২০৫০ এর মধ্যেই সেখানে ১ ডিগ্রির বেশি বেড়ে যাবে সমুদ্রের তাপমান। ২০১৯-এ এসে ভারত সরকার লোকসভায় স্বীকার করে নিলেন গত পঞ্চাশ বছরে দেশের মধ্যে সুন্দরবনেই (ডায়মন্ড হারবার) সমুদ্রের জলতল বাড়ার হার সবচেয়ে বেশি, বছরে ৫ মিমি-র বেশি। বিশ্ব উষ্ণায়ন আর জলবায়ু পরিবর্তনের আঁচ লেগেছে ঘরের কাছে সুন্দরবনে। আগে আমরা গা করিনি। ভেবেছি আমাদের এখানে এসব হবে না। লোহাচরা দ্বীপ ডুবে গেল, ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে পূর্বাশা দ্বীপ ডুবে গেল, ঘোড়ামারা দ্বীপ অর্ধেক, জম্বুদ্বীপ অর্ধেকের ও কম, মৌসুনি, জি প্লট, সাগর দিকের দক্ষিণ ভাগ দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে — ভেবেছি ব-দ্বীপে তো ভাঙা গড়া চলতেই থাকে। কিছু চরা উঠল নদীর উজানে উত্তরে — বাঁকের মুখে, জোয়ার যেখানে শ্রান্ত হয় — আমরা ভাবলাম এই তো, কে বলেছে সমুদ্রের জল বেড়ে দ্বীপ ডুবে যাবে। দিব্যি চরা জাগছে। কোভিড হানা দেবার সময় এমনকি দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগেও আমরা এমন ভেবেছি। ভোটের মিছিল মিটিং করেছি। অক্সিজেনের জোগান আর প্রতিষেধক টিকে দেওয়ায় গা করিনি। আমরা লড়াইয়ের দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে ভুল করি। বারে বারে।

২০০৯ সালে আইলা সাইক্লোন সুন্দরবনের মানুষদের জীবনে এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। যত না ঝড় তার চেয়ে বেশি সমুদ্র প্লাবন। প্রায় ৭৭৮ কিমি নদীবাঁধ ভেঙে নোনা জল ঢুকে পড়ল আবাদে গেরস্থালিতে। একদিনের বেশিই চলল জলের তাণ্ডব, আর বেশ কিছুদিন লাগল জল সরতে, চাষের জমির নোনা কমতে আরও ১,২ বছর। ২৩ লক্ষ মানুষ দুর্গত হয়ে ছিলেন, প্রায় ৫০ হাজার উদ্বাস্তু। ঠিক হল আরও উঁচু করে, কংক্রিটের ঢালাই করে বাঁধ হবে। আইলা বাঁধ। কিন্তু পাঁচ-সাত মিটার উঁচু করলে তো ২০/৩০ মিটার চওড়া চাই বাঁধের ভিত, দ্বীপভূমির থেকে জমি লাগবে প্রায় ৬০০০ একরের মত। জমিদাতারা ইচ্ছুক না অনিচ্ছুক? এই দোলাচলে জমি পাওয়া গেল ২৭০০ একরের মতো। টাকা এল ৫০০০ কোটি। কিন্তু জমির অভাবে মাত্র ১০০ কিমির বেশি বাঁধ করা গেল না। ৪০০০ কোটির কাজ বাকি রয়ে গেল। অনেক মানুষকে বাঁচানোর কাজ বাকি রয়ে গেল।

যেটুকু আইলা-বাঁধ হয়েছিল, এবারেও ইয়াসের জলোচ্ছ্বাসে কিন্তু তারা টিকে আছে, ভেসে যায়নি। টপকে গেছে শুধু কয়েক জায়গায়। 

তাহলে কংক্রিটই কি একমাত্র সমাধান? সুন্দরবনের বিষয়ে শুধু কী দিয়ে বাঁধ বাঁধব তাই নিয়ে আলোচনা হবে? জল জঙ্গল মানব-জমিনের কী হবে?

বঙ্গোপসাগরের উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশই বাড়ছে বিপজ্জনক সাইক্লোন। সমুদ্রের তাপমাত্রা প্রায় সারা বছরই ২৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বঙ্গোপসাগরে। সমুদ্রের গভীরে প্রায় সাতশো মিটারের বেশি জল এতটাই গরম হয়ে আছে যে ছোটোখাটো নিম্নচাপ তৈরি হয়ে গেলেই তা অল্প সময়ের মধ্যেই সাইক্লোন, তীব্র সাইক্লোন এমনকি সুপার সাইক্লোনে পরিণত হতে পারছে। দশ বছরে ২/৩টি সাইক্লোনের বদলে এখন ৪/৫টা হচ্ছে। এই সংখ্যাটা বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।

একদিকে সমুদ্রের জলতলের বৃদ্ধি, সাইক্লোনের ক্রমবর্ধমান প্রতাপ অন্য দিকে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের হ্রাস গত কয়েক দশক ধরে ব-দ্বীপ, তার মানুষজন, তার বাঘ-কুমির-শামুক-শুশুক-কচ্ছপ-মাছের জীববৈচিত্র্যকে ক্রমেই বিপন্ন করে তুলছে। গত কুড়ি বছরে সুন্দরবনের জাতীয় উদ্যানের কোর ও বাফার অঞ্চল থেকে প্রায় ১১০০০ হেক্টর (৭৭৫০০ বিঘার মতো) ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধ্বংস হয়ে গেছে মূলত ভূমিক্ষয় আর সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধির কারণে। আমরা যে সুন্দরী গাছের নামে সুন্দরবনকে চিনি, সজনেখালির মতো দু-একটা লোক দেখানো জায়গায় ছাড়া তাদের অস্তিত্ব প্রায় নেই বলেই চলে। ইছামতীর পাড়ে ছাড়া তেমনি নেই গোল পাতার বন, চাক কেওড়ার বন, আমুর-ধুঁদুলের বন। ওদের জন্য তো নদীতে মিষ্টি জল চাই। 

সপ্তমুখী, মাতলা, যমুনা, আদিগঙ্গা , সুতি নোয়াই, বিদ্যাধরী, পিয়ালি, ঠাকুরান ইছামতীর মতো নদীগুলি, যারা মিষ্টি জলের সঙ্গে সুন্দরবনে বয়ে আনত দ্বীপ বাঁচানোর পলিমাটি, তারাও আজ মৃত। তাদের শরীরে আজ শুধু জোয়ার ভাঁটার নোনা স্রোত।

মিষ্টি জলের বদলে নোনা জলের আধিক্যের জন্য, খানিকটা আবার দায়ী ধানের বদলে বা ম্যানগ্রোভ বনের বদলে চিংড়ি চাষের বাড় বাড়ন্তের জন্য। গত কুড়ি বছরে সুন্দরবন বাস্তুজগতের (বায়োস্ফিয়ার) এক হাজার হেক্টর ম্যানগ্রোভ বন, দুহাজার হেক্টরেরও বেশি পলিতট, আর চব্বিশ হাজার হেক্টরের মতো চাষের জমি চিংড়ি-ভেড়িতে পরিবর্তিত হয়েছে। গত দশ বছরে সাঁইত্রিশ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে ভেড়ি চাষ এখন দখল করেছে একান্ন হাজার হেক্টরেরও বেশি। দ্রুত কমেছে ম্যানগ্রোভ আর চাষ জমি। 

কিন্তু জমি লবণাক্ত হওয়াই যে চিংড়ি চাষের প্রধান কারণ নয়, তার প্রমাণ— বহু ভেড়ি কলকাতার কাছাকাছি, সমুদ্র থেকে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। হাড়োয়া, মিনাখা,  সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ জুড়ে ভেড়িগুলি বিস্তৃত। বাড়তি লাভের আশাতেই চিংড়ি চাষ বাড়ছে — প্রতি হেক্টর জমিতে দেড় লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা লাভ, প্রতি বছর। কিন্তু এই ভেড়িগুলিকে চালু রাখতে চাই নোনা জলের যথেষ্ট জোগান। তাই কখনো মাটির বাঁধ কেটে নোনা জল ঢোকানো, কখনো বাঁধের গায়ে চাষের / বা বাদাবনের জমি কেটে নোনা জলের মাছ চাষ। আশেপাশের জমির উর্বরতা কমে, নোনা বাড়ে।

ফারাক্কা বাঁধের দয়ায় একদিকে যেমন হুগলি নদীর জলে ও প্লাবনভূমিতে নোনার ভাব কমেছে, কিন্তু মাতলা-ঠাকুরান সংলগ্ন প্লাবনভূমিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। আর পুবের দিকে বাঘের ডেরায় তার মান আরও বেশি। বর্ষার সময়েই নদীতে জলের লবণাক্ততা ১৩ ভাগ ছাড়িয়ে যায় (স্বাদু জলে ১ ভাগেরও কম নুন থাকে), বর্ষার পরে শীতে গ্রীষ্মে তা আরও বেশি, প্রায় ২৮ ভাগ। বেশি নুন আর কম পুষ্টি পেয়ে আমাদের দিকের ম্যানগ্রোভগুলিও হয়ে যাচ্ছে বেঁটেখাটো, সরু, দুর্বল। অথচ এরাই আগে ছিল প্রায় তিরিশ ফুটের বেশি উঁচু, ঝাঁকড়া,তাগড়া— সমুদ্রের গ্রাস থেকে দ্বীপগুলিকে রক্ষা করার এক সবুজ সেনাবাহিনী যেন। বাংলাদেশের সুন্দরবনে গেলে এখনও এমন বলিষ্ঠ সুন্দরী, কেওড়া, ধুন্দুল পশুর গরান গর্জন সেনার দেখা মিলবে। সারা বছর ব্রহ্মপুত্রের অঢেল মিষ্টি জল পায় যে। তাই সেখানে নদীতে নুনের ভাগ তুলনায় অনেক কম, পুষ্টিও বেশি। 

নদীর কিছুটা জল আর পলি পেয়ে বাংলাদেশের দিকে এই ব-দ্বীপটা এখনও এগোচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের অংশটা পিছোচ্ছে। পশ্চিম থেকে পুবে, সমুদ্রমুখী সবকটা দ্বীপই পিছোচ্ছে, ছোটো হচ্ছে জম্বুদ্বীপ, সাগর, মৌসুনি, বকখালি, জি-প্লট গোবর্ধনপুর, ধঞ্চি, বুলচেরি, ডালহৌসি, ভাঙ্গাদুনি — সমুদ্র ভিতরে আসছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাইক্লোনের সংখ্যা বাড়লে ম্যানগ্রোভের বেশ ক্ষতি হচ্ছে। ঝড়ের ভাঙচুর, পাতা ঝরা, উপড়ে পড়া, নুনের ঝাপটা সামলে নিয়ে ম্যানগ্রোভের সেরে উঠতে সময় লাগে প্রায় ৫/৬ বছর। এখন প্রতি বছরেই সাইক্লোন, যেমন — ২০১৯ (বুলবুল), ২০২০(আম্ফান), ২০২১(ইয়াস) আর খানিকটা অশনি (২০২২) — যে দিকের ম্যানগ্রোভ বার-বার আক্রান্ত হচ্ছে, তারা সেই সময়টা আর পাচ্ছে না। রুগ্ন ক্ষতবিক্ষত এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে আমরা আগ্রাসী সমুদ্রের বিরদ্ধে বেশিদিন লড়াই চালাব কী করে? 

আমাদের এখন একটা উপলব্ধি হয়েছে, আর ম্যানগ্রোভ কেটে নয়, ম্যানগ্রোভ লাগিয়ে আমরা দ্বীপ বাঁচাব, বাঁধ বাঁচাব, ঝড়ের হাত থেকে বাঁচব। খুব ভালো। গত কুড়ি বছরে বায়োস্ফিয়ার অঞ্চলে প্রায় ৮১০০ হেক্টর নতুন ম্যানগ্রোভ বন সৃজন হয়েছে। এটা আরও আগে থেকে করতে পারলে আরও ভালো হত। কারণ অন্তত ১০/১৫ ফুট উঁচু শক্তিশালী হয়ে ঝড়ের হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে তার সময় লাগবে কমবেশি দশ পনেরো বছর। ততদিন ম্যানগ্রোভগুলিকেই আমাদের বাঁচাতে হবে। আরও বাঁচাতে হবে যেগুলি ম্যানগ্রোভ দ্বীপ, যেমন — জম্বু, বুলচেরি, ভাঙ্গাদুনি — সেগুলিকে। এমন একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে — ম্যানগ্রোভ দ্বীপগুলি যদি নিজেদেরই না বাঁচাতে পারে তাহলে আমাদের বাঁচাবে কেমন করে? 

আমরা যদি ম্যানগ্রোভদের সুস্থভাবে বাঁচার পরিবেশ তৈরি করতে না পারি, তবে ম্যানগ্রোভও বাঁচবে না, আমরাও না।

সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ তবে কেমন করে বাঁচবে?

ম্যানগ্রোভগুলিকে সুস্থ সবল ভাবে বেড়ে উঠতে আমাদের নদীতে জল চাই, আর চাই পলিমাটির জোগান। জল-জোগানের মুখ থেকে বাধা কাটিয়ে, একটু গভীর করে নদীগুলিকে আর-একবার নাব্য করে তুলতে হবে। আর-একবার বাঁচিয়ে তুলতে হবে মুখে স্বাদু জলের আঁজলা দিয়ে। মাঝদিয়ার মুখবন্ধ সরিয়ে সামান্য সাত কিলোমিটার নদীখাত খনন করলেই ইছামতী নদীকে বাঁচিয়ে তোলা যাবে। চাই পড়শি দেশের সঙ্গে একসঙ্গে নদীটির দেখভাল। যে সুন্দরবনের যৌথ অংশিদার আমরা দুই পড়শি, সেই সুন্দরবনের স্বার্থেই আমাদের এই কাজ করতে হবে। আগামী জলচুক্তির আলোচনায় দুটি দেশ মিলে যদি একটা নদীকে বাঁচানোর শপথ নেয় বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো অনন্য ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্রের স্বার্থে— জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড়ো কাজ আর কী হতে পারে। বাস্তুতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন। 

এই ব-দ্বীপ আর তার মানুষগুলিকে বাঁচাতে, চাষবাসের জলের সমস্যা সুরাহা করতেও এই নদীগুলির পুনরুজ্জীবন দরকার। একটাই নদী পশ্চিম থেকে পুব বাহিনী — যমুনা। হুগলির উপর ত্রিবেণীর কাছে ধারাটিকে আর-একবার মুক্ত করলে, আর ত্রিবেণীর থেকে টিপ্পি অবধি গতিপথের ছোটখাটো সারাই খোঁড়াইয়ের কাজ করে নিতে পারলে সুন্দরবন ব-দ্বীপের মাঝ বরাবর একটা স্বাদু জলের সুরাহা হয়। সঙ্গে থাকুক মনি সুতি নোয়াই নদীকে বাঁচিয়ে তোলার নকশা। জলের সুরাহা হয় যদি ইছাপুর-গুমা-বামুনিয়ার আগলগুলি খুলে দিয়ে বিদ্যাধরীকে আর-একবার মর্ত্যে ফিরিয়ে আনলে। আদিগঙ্গাকেও বাঁচানোর কথা শোনা যাচ্ছিল কিছুদিন। বড্ড তাড়াতাড়ি সব ভুলে যাচ্ছি আমরা। গড়িয়ার কাছে খানিকটা খুঁড়ে আবার সূর্যপুর থেকে পিয়ালির দিকে নিয়ে গিয়ে যোগ করি বরং। হেস্টিংস থেকে কালীঘাট টালিগঞ্জের গতিপথটিকে তীরবাসীদের সাহায্য নিয়েই দূষণমুক্ত করা যাবে।

এমনই জল জঙ্গল জমিন নিয়ে একটা সুসংহত ব-দ্বীপ পরিকল্পনা চাই। ডেল্টা প্ল্যান। মাস্টার প্ল্যান। যে নামেই ডাকি। মানুষজনকে একসঙ্গে নিয়ে বসলে খুব বেশি সময় লাগবে না বানাতে। তবে পরিকল্পনা রূপায়ণ করতে অবশ্যই টাকা লাগবে। কিন্তু বিজ্ঞানকে ঠিক ঠিক ব্যবহার করতে পারলে অনেকটাই কমানো যাবে খরচ। যেমন বায়োস্ফিয়ারে ১০৩১টি গ্রাম আছে, সবাইকেই বন্যামুক্ত করার খরচ অনেক। কিন্তু মাত্র ৬০ থেকে ১৫০টা গ্রাম আছে যেখানে আইলা, আম্ফান বা ইয়াশ — তিনটিতেই জল ঢুকে ছিল। তাহলে তাদের আগে বাঁচাই। খরচ ৮৫ শতাংশ কমবে। ডাঙার উপর বাঁধ দিয়ে সমুদ্রকে আটকানোর অনেক চেষ্টা হচ্ছে। একবার সমুদ্রের দিক থেকে আটকানোর চেষ্টা করে দেখা দরকার, বিশেষত পুবের দিকে, বাঘের মুল্লুকে — বুলচেরি, ডালহৌসি, ভাঙ্গাদুনি — ম্যানগ্রোভ দ্বীপগুলির বাইরে জলের দিক থেকে আমরা যদি ডোবা- প্রাচীর তৈরি করতে পারি — বড়ো ঝিনুকের (অয়েস্টার) খোল দিয়ে — তাহলে তা ঢেউয়ের ঝাপটাও আটকাবে আবার দ্বীপলগ্ন এলাকায় ভূমিক্ষয় আটকাবে পলি সঞ্চয় করে। কিছুদিনের মধ্যেই সেই নতুন পলির উপর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল জন্ম নিতে থাকবে, নতুন ঝিনুক এসে পাথরের উপর ডেরা বাঁধবে — ডোবা-প্রাচীরটাকে মজবুত করবে, উঁচু করবে। ম্যানগ্রোভের বাইরে সজীব বাঁধ। বিদেশে যেমন ফ্লরিডায় হয়েছে, তেমনি হয়েছে বাংলাদেশের কুতুবদিয়ায়। আমাদের এখানে চেষ্টা করতে ক্ষতি কি। সবাই ভাবে প্রচুর টাকা লাগবে। বছর বছর কংক্রিটের বাঁধ আর ম্যানগ্রোভ লাগাতেও তো শুনি বেশ টাকা লাগে। কিন্তু এমন বাঁধ যা প্রযুক্তি আর বাস্তুতন্ত্রের সমন্বয়ে তৈরি — তার টিকে থাকার ক্ষমতাও বেশি। সাগর দ্বীপে বেগুয়াখালি — গঙ্গাসাগর – ধবলাটের বাইরের দিকে এমন ডোবা প্রাচীর তৈরি করতে পারলে ভালো হয়, দ্বীপটাও বাঁচে, ম্যানগ্রোভও বাঁচে — মন্দিরটাও আবার সরাতে হয় না।

কিন্তু এই নীল নকশার বাস্তবায়ন করতে যদি অনেকদিন লাগে?

বড়ো নকশাটাকে ছোটো ছোটো ভাগে ভেঙে নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে, টাকার ব্যবস্থা করতে হবে বিভিন্ন দেশি বিদেশি সরকারি বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে। আর এই ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্রের প্রতি, জল জঙ্গল-জমির প্রতি একটু সংবেদনশীল ভাবে বাঁচতে শিখতে হবে। পুকুরে বৃষ্টির জল ধরে সাগর পাড়ে জি-প্লটের বাসিন্দারা কি সুন্দর দুই-ফসলি তিন-ফসলি চাষ করছে। শিখতে হবে। কেমন ভাবে গোসাবার লাহিড়িপুরে, হিঙ্গলগঞ্জের যুবকেরা নিজেরাই ম্যানগ্রোভ নার্সারি বানিয়ে কোনও অনুদান ছাড়াই বন বাঁচাচ্ছে, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। ফসল বিমা-বন্যা বিমা–বরজের বিমা পৌঁছে দিতে হবে সবার কাছে। ঝড়বন্যার অঞ্চলে শেল্টারের সঙ্গে জোর দিতে হবে পাকা বাড়ি তৈরিতে। সরকারের কাছে চাইতে হবে সবার জন্য পাকা বাড়ি। গরিব পরিবারগুলির জন্য ন্যূনতম খাদ্যসুরক্ষা আর সামান্য আর্থিক সহায়তার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। এটাকে কাজে লাগিয়ে যে চাষের জমিটুকু রয়েছে, সেখানে জৈব চাষ শুরু করি না কেন! দেশি ধান, জৈব সার, জৈব কীটনাশক। মাটির নীচ থেকে জল তুলে চাষ না থাকায় আর্সেনিকের সমস্যাও নেই, সুন্দরবন হোক জৈব ফসলের এক বিরাট ভান্ডার। শহরের লোক অনেক বেশি দামে এই জৈব ফসল কিনতে চাইবে। সরকারি বেসরকারি নানা সংস্থা আছে সাহায্যের হাত বাড়াতে। নোনা সহা দেশি ধান — দুধেরসর, লাল স্বর্ণ, তাল মারি, লাল ঘেঁটু, মাতলা, হ্যামিলটন, জামাই নাড়ুর বীজ গোলা হোক প্রতিটি পঞ্চায়েতে। পাশাপাশি বাড়ুক সুগন্ধী ধানের চাষ— গন্ধ মালতি, কনকচূড়, বাদশা ভোগ, গোবিন্দ ভোগ। লাগোয়া ছোটো ছোটো জমিগুলিকে জুড়ে কো-অপারেটিভ তৈরি করে সমবায় ভিত্তিতে চাষ করা যাবে কি? সুন্দরবন পথ দেখাক না। তাহলে কম খরচে চাষ করে কৃষিকে লাভজনক করে তোলা যাবে। চাষির থেকে ন্যায্য মূল্যে জিনিস কিনে ব্লক-মান্ডিতে, শহরে পাঠানোর জন্য থাক সচল বাজার। আর চাষের জন্য জলধরার মিষ্টি পুকুরে থাকুক মাছ, বাড়িতে গোরু, হাস মুরগি, ভেড়া ছাগল। বন্ধ করতে হবে নদী বা বাঁধের পাড় ধরে চিংড়ির চাষের জন্য মীন ধরার টানা জাল, বরং নোনা নদীর মধ্যে ঘের বা খাঁচা-জালের মধ্যে ভেটকি ভাঙ্গর পারশে চাষ শুরু করা যায়। লাভও বেশি, ঝড়ে বন্যায় ক্ষতিও কম। ৩৬০০০ এর বেশি পুকুর আর ১৮০০০ হেক্টার ক্যানেল, খাড়ি, জলায় মাছ চাষ করতে পারলে সুন্দরবনে একটা রুপোলি বিপ্লব করে ফেলা যাবে। 

তবু বাঁধ, ম্যানগ্রোভ, নানান রকম মানুষ, জীববৈচিত্র্য, শিক্ষা, চাকরি, বিদ্যুৎ সব কিছুর মধ্যেই একটা প্রশ্ন বারবার আসতে থাকে। বাঁচবে তো সব কটা দ্বীপ! এই আশঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে যে প্রশ্নটা অবধারিত ভাবেই ওঠে, বাস্তুহারা মানুষগুলির তাহলে কী হবে? প্রশ্নটা আগেও উঠেছে — ঘোড়ামারা থেকে, মৌসুনি থেকে, ধবলাট বেগুয়া খালি থেকে, গোবর্ধনপুর থেকে — এই উদ্বাস্তু মানুষেরা,পরিবেশ-পরিযায়ীরা কি কোনও পুনর্বাসন পাবে? ন্যায়সঙ্গত পুনর্বাসন? 

বাস্তুহারা হওয়া, পরিযান বা মাইগ্রেশন এবং পরিকল্পিত পুনর্বাসন — এই নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কাঙ্কুন সম্মেলনের পর থেকেই কিন্তু সারা বিশ্বে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের বা পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে দেশের মধ্যে বড়তে থাকা এই অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের বিষয়ে গত ১০ বছরেও কোনও সুনির্দিষ্ট নীতি গ্রহন করা হয়নি। ঝড় বন্যার মতো কিছু তাৎক্ষণিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকলেও, প্রয়োজনের তুলনায় তা সামান্য। আর সমুদ্রের জল বাড়া, তীরভূমির ক্ষয়, অনাবৃষ্টি,খরার মতো মন্থর বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে উদ্বাস্তুদের জন্য কোনও ব্যাবস্থাই নেই। অথচ গত ২০২০ সালেই শুধু ভারতবর্ষে ৩৪ লক্ষের উপরে পরিবেশ-উদ্বাস্তুদের হিসেব পাওয়া যায়।

সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস বা উপকূলের ক্ষয়ের কারণে বাস্তুহারাদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কিন্তু খানিক অপরিকল্পিতভাবে হলেও, আগেও কয়েকবার হয়েছে। সুন্দরবনের সাগর দ্বীপে, বা ওড়িশার সাতভায়ায়, গতশতকে। তখন হয়তো তা জলবায়ু সংক্রান্ত ন্যায়বিচারের প্রশ্নটিকে মাথায় রেখে সবটা হয়নি। কিন্তু তার পর থেকে জলবায়ু বিপর্যয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও পরিবেশ পরিযানের বিষয়ে, পরিবেশ উদ্বাস্তুদের ক্ষতিপূরণ-পুনর্বাসনের পরিকল্পনায়-প্রস্তুতিতে আমরা খুবই কম এগিয়েছি বলা চলে।

এই নীল নকশা না হলেও সুন্দরবন নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক, জাতীয় সামগ্রিক পরিকল্পনাকে রাজ্যস্তরে খুব দ্রুত বাস্তবায়ন না করতে পারলে আমাদের আবার দেরি হয়ে যাবে — তখন হয়তো এই দাবি সমস্বরে জোরালো হয়ে উঠতে পারে — হয় দ্বীপ বাঁচাও, নয় পুনর্বাসন দাও।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান