পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি : খোঁজ চলছে

কুমারজিৎ মণ্ডল

বিগত তিন-চার দশকের প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানীরা আমাদের এটুকু বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে আমাদের পৃথিবী ভালো নেই। পৃথিবী ভালো না থাকলে মানুষও ভালো থাকতে পারে না। তাই মানুষ আজ নড়েচড়ে বসছে। পৃথিবীর পরিবেশ নিয়ে চারদিকে আলোচনা চলছে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় অনুসন্ধান চলছে। কিন্তু বুঝতে পারা যাচ্ছে যে সমাধান সহজলভ্য নয়। 

এই যে পৃথিবীর ভালো থাকা না-থাকা নিয়ে টানাপোড়েন — এর কিছুটা প্রাকৃতিক, আর কিছুটা মানুষের সৃষ্টি। যদিও বিজ্ঞানীদের মধ্যে অমিমাংসিত তর্ক আছে কোন ভাগটা বেশি সেই নিয়ে। সেই তর্কে না প্রবেশ করে বলা যায় যে মানুষের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ যেটুকু সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তার সমাধান খোঁজার দায় মানুষের থেকে যায়। 

অর্থনীতিবিদরাও এই সমস্যার সমাধান খুঁজে চলেছেন। তাই পরিবেশ অর্থনীতির চর্চা এখন সর্বত্র প্রসার লাভ করছে। এই চর্চার যে নীতিগত দিকটা প্রাধান্য পায় সেটা হল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিষ্ক্রমণের মাত্রা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই নিয়ে কিয়টো প্রোটোকল থেকে পথ হাঁটা শুরু করে অনেক দূর যাওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে যে এটুকু যথেষ্ট নয়। পথ চলা অনেক বাকি।

সম্প্রতি জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্দেশীয় প্যানেল তাদের ষষ্ঠ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এই রিপোর্টে সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তত্ত্বের নিরিখে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা আলোচনা করা হয়েছে। আগামী আরও দুটো রিপোর্টে মানব সমাজ কীভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে পারে তার দিকনির্দেশ করার প্রতিশ্রুতি আছে। যদিও সেই মোকাবিলা করার পন্থা আয়াসসাধ্য হবে না, তার যথেষ্ট ইঙ্গিত আছে বর্তমান রিপোর্টে। বিগত চার দশকে বিশ্বের জলবায়ু বিপর্যয়ের এক কিনারে পৌঁছে গেছে। জাতিসংঘের অভিধায় “রেড কোড” তকমা পেয়েছে জলবায়ুর সংকটের গভীরতা।

এই রিপোর্ট পৃথিবীর বুকে আধুনিক মানুষের কর্মকাণ্ডকে দায়ী করেছে এই “রেড কোড” তকমার কারণ হিসাবে। বর্তমান পৃথিবীর জলবায়ুতে যে পরিমাণ কার্বন জমা হয়েছে তা বিগত কুড়ি লক্ষ বছরের হিসাব ছাড়িয়ে গেছে। সমুদ্রের জলস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি অস্বাভাবিক দ্রুততায় বেড়েছে গত তিন হাজার বছরে। হিমবাহের ক্ষয় হচ্ছে উদ্বেগজনক বেগে। বারংবার ঘূর্ণি ঝড়, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বনে বনে দাবদাহ চলেছে পৃথিবী জুড়ে। বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড জলে দ্রবীভূত হয়ে জলজ প্রাণীদের প্রাণঘাতক হয়ে উঠছে। জীববিজ্ঞানীরা বলছেন উদ্ভিদ ও প্রাণীর বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাদের ভাষায় পৃথিবীতে বিলুপ্তির ষষ্ঠ চক্র চলছে। মানুষ প্রথম এমন বিলুপ্তির সাক্ষী হতে যাচ্ছে। আগের চক্রগুলির কার্যক্রম পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের আগেই শেষ হয়ে গেছে।

এই বিলুপ্তির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় জলবায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের নিষ্ক্রমণ অতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু বিশ্বের বড়ো বড়ো দেশগুলি এব্যাপারে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। আজকের ধনী দেশগুলি শিল্পবিপ্লবের ফসল ঘরে তুলেছিল পরিবেশকে দূষিত করে, কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে বিপুল পরিমাণে জমা করে। যে দেশগুলি আজ শিল্পোন্নয়নের পথে দৌড় শুরু করেছে তাদের স্বাভাবিকভাবেই তাড়া বেশি। তাই তাদের কলকারখানার চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়ার পরিমাণ অনেক বেশি। এতে রাশ টানার অর্থ উন্নয়নের গতিকে কিছুটা পরিমাণে হলেও শ্লথ করা। ভারত ও চিনের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি তাই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাবি জানিয়ে আসছে যে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের বোঝার বেশিরভাগটা ধনী দেশগুলিকে বহন করতে হবে। এই টানাপোড়েনে পরিবেশ শুদ্ধিকরণ কর্মসূচি বারবার বিঘ্নিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই বছর ইজিপ্টে যে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কনফারেন্স (কপ ২৭) অনুষ্ঠিত হল সেখানেও এই দ্বন্দ্ব দেখা গিয়েছিল। ধরা হয়েছিল বিশ্ব উষ্ণায়নের হার ২ ডিগ্রির নীচে বেঁধে রাখতে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হবে। এই বিপুল পরিমাণ খরচ মূলত ধনী দেশগুলিকে বহন করতে হবে। কিন্তু ধনী দেশগুলি এই খরচের ব্যাপারে কোনও উৎসাহ দেখায়নি। উক্ত কনফারেন্সের প্রকাশিত দলিলে বলা হয়েছে যে এই বিশাল পরিমাণ অর্থের সংস্থানের জন্য বিবিধ উৎসের ওপর নির্ভর করতে হবে। যেহেতু ব্যক্তিগত মূলধন এই ব্যাপারে নিয়োজিত হবার সম্ভাবনা কম, তাই ভরসা হল আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক সংস্থা। যদিও তারা কীভাবে এই বিশাল অর্থের দাবি পূরণ করবে তা স্পষ্ট নয়। তবে কপ ২৭ থেকে সবচেয়ে বড়ো পাওনা এটাই যে, ধনী দেশগুলি স্বীকার করেছে দরিদ্র দেশগুলি জলবায়ুর বিষাক্তকরণে খুব সামান্য ভূমিকা নিলেও তাদেরকে এর বিষময় ফল সবচেয়ে বেশি ভোগ করতে হয়। তাই তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত। যদিও সেই ক্ষতিপূরণ কেমনভাবে দেশগুলির হাতে তুলে দেওয়া হবে সে ব্যাপারে ঐকমত্য হয়নি। 

জলবায়ু দূষণ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? অনেক সময় সমস্যার সমাধান হিসাবে গণতন্ত্রের কথা ভাবা হয়। যেহেতু এই ব্যবস্থায় বহু মতের এবং পথের সমাগম হয় তাই একবগ্গা উন্নয়নের মন্ত্রের সঙ্গে পরিবেশ ভাবনার বিষয়টি গুরুত্ব পাবার সম্ভাবনা বেশি। এটা দেখাও গেছে যে একনায়কতন্ত্রী শাসকদের সময়কালে বিভিন্ন দেশে পরিবেশ ভাবনার গুরুত্ব শিকেয় উঠেছে। সাম্প্রতিককালে ট্রাম্পের শাসনকালে আমেরিকা পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারগুলি পালনে অসম্মতি জানিয়েছিল। তারপর ডেমোক্রাটিক পার্টি ক্ষমতায় আসার পর আমেরিকা পুনরায় অঙ্গীকার পালনে সম্মতি জানিয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রকে সমাধান হিসাবে ভাবার একটা বিরাট অসুবিধা আছে। পরিবেশ দূষণে সবচেয়ে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা হবে অনাগত পরবর্তী প্রজন্ম। এই অনাগত প্রজন্ম এখনও ভোট দেবার অধিকার অর্জন করেনি। তাই তাদের চাহিদার কথা ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠীর কাছে পর্যাপ্ত গুরুত্ব পায় না। কিন্তু তাদের চাহিদার কথা ক্ষমতাবানদের কাছে পৌঁছানো দরকার। গ্রেটা থুনবার্গের ফুঁসে ওঠা এবং তার সঙ্গে দেশে দেশে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাইমেট স্ট্রাইক আন্দোলনে শামিল হওয়া — এই চাহিদার কথা ক্ষমতাবানদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটা জোরালো প্রচেষ্টা।

যখন দেশ সমূহের সমষ্টিগত প্রচেষ্টা খুব শ্লথ গতিতে এগোচ্ছে তখন ব্যক্তিগত স্তরে কী পরিবর্তনের কথা ভাবা যেতে পারে? এ ব্যাপারে পথ দেখিয়েছে ভুটান। তারা জাতীয় সম্পদের নিরিখে আমেরিকা বা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির তুলনায় অনেক পিছিয়ে। কিন্তু সুখী দেশ হিসাবে তারা অনেক ধনী দেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। বিগত এক দশক ধরে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্স প্রকাশিত হচ্ছে। এই ইনডেক্সের মূল বার্তা হল যে মানুষের সুখ শুধুমাত্র জাগতিক সামগ্রীর উৎপাদন এবং ভোগের ওপর নির্ভর করে না। ব্যাপারটা অনেকটা আধ্যাত্মিক শোনাচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা এর মাপজোখের পন্থা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। মূলত মাথাপিছু আয়, গড় প্রত্যাশিত আয়ু, সামাজিক সুরক্ষা, প্রতিষ্ঠানের ওপর বিশ্বাস, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং ঔদার্য — এই ছয়টি নির্ণায়কের ওপর নির্ভর করে এই ইনডেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। তারপর রাশিবিজ্ঞানের নীতি অনুসরণ করে পৃথিবী জোড়া সার্ভে করা হয়। যাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় ওপরের নির্ণায়কগুলির ভিত্তিতে তার নিজের সুখ সম্বন্ধে মূল্যায়ন কী। এই ভাবে প্রাপ্ত তথ্যগুলিকে সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে একত্রিত করে তৈরি হয় দেশের হ্যাপিনেস ইনডেক্স। সেই ইনডেক্সের নিরিখে ভুটান অনেক এগিয়ে তার আর্থিক সম্পদের তুলনায়। আর এর জন্য ভুটানকে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করতে হয়নি। সুতরাং বিভিন্ন দেশের কর্ণধাররা যদি দেশের উন্নতির জন্য জাতীয় আয়কে পাখির চোখ না করে হ্যাপিনেস ইনডেক্সে নজর দেয় সমস্যার বিপুলতা বহুল পরিমাণে লাঘব হয়।    

আজ থেকে কয়েক দশক আগে শুমেকার এমন নিদান দিয়েছিলেন। তাঁর বহুপঠিত বই স্মল ইজ বিউটিফুল-এ তিনি বলেছিলেন বর্তমানে প্রচলিত বৃহৎ মাত্রায় উৎপাদনের বাজারকেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। ভোগমুখী উৎপাদন ব্যবস্থার বদলে সৃজনমুখী উৎপাদন ব্যবস্থা প্রয়োজন। স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে স্থানীয় উৎপাদন— এটাই হবে অর্থনৈতিক সংগঠনের মূল কথা। দেশের মানুষদের অনুধাবন করতে হবে প্রাকৃতিক সম্পদ জাতীয় মূলধন। তার অহেতুক ক্ষয় মূলধনের অপচয়। এ পর্যন্ত শুনে মনে হতে পারে এসব যেন আধ্যাত্মিক প্রবচন, কোনও ধর্মগুরুর মুখনিঃসৃত বাণী। কিন্তু শুমেকার বলতে চেয়েছেন যে এটা কোনও অলীক বিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। যে উৎপাদন ব্যবস্থা আজকের পৃথিবীতে বিরাজ করছে তা পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের চল্লিশ শতাংশ ধ্বংস করে মাত্র ছয় শতাংশ মানুষের বস্তুকেন্দ্রিক চাহিদার দাবি পূরণ করতে পারে। কিন্তু তাতে বৃহৎ মানব গোষ্ঠীর আত্মিক সুখ, প্রশান্তি ও সার্বিক সমৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ করতে পারে না। কিন্তু যে কোনও জাগতিক উন্নতির শেষ কথা হওয়া উচিত মানুষের সুখ ও প্রশান্তি। ভুটান এটা উপলব্ধি করেছে এবং সেই লক্ষে এগিয়ে চলেছে। সেই লক্ষে এগিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক শর্ত হল দেশের উৎপাদন ব্যবস্থাকে বৃহৎ আয়তনমুখী না করে তোলা। বড়ো বড়ো কলকারখানা, বড়ো বড়ো মেশিন, প্রচুর নিয়োজিত শ্রমিক, প্রচুর বিক্রিবাটা-কেনাকাটা— এই বৃহৎ আয়তনের প্রতি তীব্র আসক্তি থেকে মানুষকে বেরোতে হবে। কীভাবে এই আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব? এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর এখনও অধরা।

তবে ‘স্যাপিয়েন্স’-এর লেখক হারারি বিশ্বাস করেন যে উত্তরটা লুকিয়ে আছে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও অগ্রগতির মধ্যে। প্রযুক্তির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে মানুষ উত্তরোত্তর শক্তির ব্যবহারে মিতব্যয়ী হয়েছে। আগে কারখানার মেশিনগুলি যত শক্তি ক্ষয় করত আজ তার থেকে অনেক কম শক্তি ক্ষয় করে। তাঁর মতে মানুষ নতুন নতুন শক্তির উৎস খুঁজে বের করে চলেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হাবারের আবিষ্কৃত রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাতাসকে কাজে লাগিয়ে বারুদ তৈরি এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। হারারি আশা রাখেন যে মানুষ অদূর ভবিষ্যতে এমন প্রযুক্তি আবিষ্কার করবে যে ফসিল পুড়িয়ে শক্তির অভাব পূরণ করতে হবে না। তাতে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের সমস্যা আর থাকবে না। শুমেকারও সমস্যা নিরসনে প্রযুক্তির ভূমিকায় আস্থা রেখেছেন। তবে তিনি মনে করেন যে মানুষকে উপযুক্ত প্রযুক্তির সন্ধানে বেরোতে হবে। সেই প্রযুক্তি বৃহৎ আয়তনের উৎপাদনের উপযোগী নয়, সৃজনমুখী উৎপাদনের যেন উপযোগী হয়। তাই পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি এবং বিজ্ঞানের চর্চা যদিও পরিবেশ দূষণের সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করতে পেরেছে কিন্তু সেই সমস্যা থেকে মুক্তির পথ বাতলে দিতে পারেনি। তবে পরিবেশ সংক্রান্ত গবেষণা, আলোচনা, আন্দোলন থেকে রসদ সংগ্রহ করে পরিবেশ বিজ্ঞান সমৃদ্ধ হচ্ছে। এই সমৃদ্ধি একদিন তাকে সাফল্যের চাবিকাঠি এনে দেবে এই আশায় আমরা আপাতত বুক বাঁধি। 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান