পার্থ সারথি বণিক
“Fair is foul and foul is fair Hover through the mist and filthy air”.[১]
ভাষা সমাজের মনকে প্রকাশ করে, সমাজ-মনের পরিবর্তনের নথি হয়ে থাকে। না, শুধুমাত্র নথিই নয়, যখন রাজনীতি, অর্থ- নীতি, সমাজ নীতি পাল্টায়, জীবনচর্যায় পরিচ্ছন্ন (fair), অপরিচ্ছন্ন (foul)-এর ধারণাগুলো যখন স্থান পাল্টে ফেলতে শুরু করে, ভাষা সেই পরিবর্তিত অবস্থানগুলোকে বাঙময় শরীর দেয়। বিষয়টা এটুকুতেই থেমে থাকে না, আরও কিছু হয়। যা কিছু অপরিচ্ছন্ন, যা-ই কলুষ, তা যদি সামাজিক চেতনায় স্বীকৃত আচরণের ছাড়পত্র পেয়ে গিয়ে থাকে তবে শিষ্ট বা পরিচ্ছন্নের তকমা পেয়ে আসা শব্দগুলো পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতিতে কলুষ কে প্রকাশ করার মাধ্যম (agent) হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়ে যায়। ভাষা তখন নিজেই কলুষের কার্বনকে নিজের শরীরে বহন করে দূষিত হতে থাকে।
একটু খেয়াল,করলেই আমরা দেখব, নৈতিক গুরুত্বের নিরিখে যে শব্দের বিচরণ হয়ত ছিল উচ্চ মার্গে, পরিবর্তিত সামাজিক প্রেক্ষিতে তা ধুলোয় লুটোচ্ছে। অথবা, আপাত নিরীহ কোন শব্দকে যখন কোন অনৈতিক কাজে ব্যবহার করে মনের ভাব প্রকাশ করাটাই পরবর্তী সময়ের আদত হয়ে দাঁড়ায় তখন বোঝা যায়, সেই সমাজের অনৈতিকতার দূষণ তার ভাষাটাকেও কালিঝুলি মাখিয়ে বিকল্প ব্যবহারের যোগ্য করে নিচ্ছে। দূষিত মানব-পরিবেশে অশালীন (foul) যা, তা-ই হয়ে যায় শালীন (fair), তা-ই মান্যতা পায়; শালীন-অশালীনের ভেদরেখা মুছে যায়। ভাষার দূষণ তাই সমাজ-মানসিকতার দূষণ।
আজকের দিনে এই বিশ্বায়িত বঙ্গে মান্য চলিত বাংলায় ব্যবহার করা ‘‘সম্পর্ক’ শব্দটার অর্থ-চরিত্রে যে লঘুতা এসেছে তা সমাজের মানসিকতার পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি মাত্র! বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী মানব- পরিবেশের কথা মাথায় রাখলে ‘সম্পর্ক’ শব্দটা আজ কতটা আবেগের অভিঘাত তৈরি করে? যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গেছে অনেকদিন, ইঁদুর দৌড়ে সামিল অণু পরিবারও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের মোহে বিচ্ছিন্নপ্রায়; ‘সম্পর্ক’ শব্দটার মধ্যে আজকের দিনে আর গাঢ় নৈকট্যের ইঙ্গিত নেই। শব্দটার গুরুত্বহীনতা আজকের বাংলা সাহিত্যে বারবার প্রকাশিত হয়েছে। গত শতাব্দী থেকেই মানুষের সামাজিক সম্পর্কে যেমন বৈধ- অবৈধের সীমারেখা ঝাপসা হতে শুরু করেছে, খেয়াল করলে দেখা যাবে, ‘সম্পর্ক’ শব্দটার অর্থের মধ্যেও আজ কেমন একটা শীতল নৈর্ব্যক্তিক (clinical ) আবহ তৈরি হয়ে গেছে। বিশ্বযুদ্ধ কেন, মানব-সম্পর্কে লক্ষণীয় পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল তারও আগে, সেই শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে। কবিরা তাঁদের রোম্যান্টিক বেদনায় হয়ত দূষিত হতে থাকা মানব সম্পর্ককেই প্রকৃতির মধ্যে আবার উদ্ধার করার বার্তা দিয়েছিলেন[২]। কল- সমৃদ্ধ এই কলি যুগে ‘সম্পর্ক’ শব্দটার অর্থ কতটা লঘু হয়ে গেছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ বোধহয় চারিদিকে গজিয়ে ওঠা বৃদ্ধাশ্রমগুলো! সমাজ- সম্পর্কের এই পরিবর্তিত, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য, ‘সম্পর্ক’ শব্দটাকেই ভঙ্গুর করে তুলেছে। ভাষায় এটাকেই আমরা দূষণ বলব।
যে সমাজ শুধুমাত্র পার্থিব সম্পদকেই গুরুত্ব দিতে শেখায়, সেখানে মানব সম্পর্কের সমীকরণগুলো কেমন হবে তা ইংরেজ নাট্যকার বেন জনসন ১৬০৬ সালে লেখা তাঁর ‘ভলপোনে’ নাটকে দেখিয়েছেন। তারও আগে, খ্রিষ্টীয় পনেরোশ শতকে আমাদের ভারতীয় সমাজে সায়ণ-মাধবের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ বলছেঃ
“যাবজ্ জীবেৎ সুখং জীবেদ্ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ।।”[৩]
“যতদিন বাঁচবে, সুখে বাঁচবে; ধার করে ঘি খাবে। ছাই- হয়ে- যাওয়া দেহ কোথায় (বা কোথা থেকে ) আবার ফিরে আসে?”
এমন একটা দর্শন ভাববাদ- সমৃদ্ধ ভারতীয় সমাজে বেশ জনপ্রিয়, সন্দেহ নেই। এমন একটা সমাজে ‘প্রেম’ শব্দটার অর্থ কী হবে? স্বামী বিবেকানন্দ বলছেনঃ ‘যথার্থ প্রেম সর্বস্ব-ত্যাগে’(৪)। কিন্তু এই দর্শণ কী সায়ন-মাধবের উল্লেখ করা বক্তব্যে প্রকাশিত দর্শনের সঙ্গে মেলে ? মেলে না বলেই হয়ত বিবেকানন্দ ‘প্রেম’ শব্দটার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া একটা ধন-মুখী সমাজের দূষণকে দূর করতে চেয়েছিলেন! সমাজ চেতনায় যে দূষণ এসেছে, তা তো ভাষার গায়ে লেগেই প্রকাশিত হবে, কারণ, উৎপত্তি আর ব্যুৎপত্তিকে ছাপিয়ে শব্দের অর্থ-বিপত্তিই তো সমসাময়িক সমাজের মনোভাবকে ব্যক্ত করে! আর এই অর্থ- বিপত্তিই ভাষাকে দূষিত করে।
শব্দ তার ওজন হারাচ্ছে, ভাষা লঘু হচ্ছে। সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণে বিভিন্ন শব্দের যে অর্থ- বিপর্যয় ঘটতে থাকে প্রজন্মান্তরে সেই বিপর্যস্থ অর্থ কী চেহারা নেয় বাংলা ভাষায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ত ‘গুরু’ এবং ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দ দুটো। এই শব্দ দুটো আজকের দিনে যে অর্থ অনুষঙ্গ নিয়ে আসে, তাতে মূল অর্থের বিপরীতধর্মী অনুষঙ্গ তৈরি হয়। এরা উভয়েই শুধু যে ‘স্ল্যাং’ এর দিকে ঝুঁকে পড়ছে তা ই নয়, সাধারণ বাঙ্গালী সমাজ এখন শব্দ দুটোকে ব্যবহার করতে গেলে সতর্ক হয়, আর যাদের উদ্দেশে ব্যবহার করা হয় বহু ক্ষেত্রেই তারা নিশ্চিত ভাবে অস্বস্তিতে পড়েন।
শব্দের অবনমিত গুরুত্বই ‘রেকর্ড’ করে রেখেছে আজকের বাঙ্গালী সমাজে চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কের অবনতিকে। ‘ভাড়াটে উচ্ছেদ’[৫]-এর মত সমাজ- সম্পর্ক প্রকাশ করা শব্দ যখন অবৈধ গর্ভকে নষ্ট করার প্রেক্ষিতে চিকিৎসকদের একটা অংশ আকছার ব্যবহার করেন তখন ‘ভাড়াটে’ এবং ‘উচ্ছেদ’ শব্দ দুটোর মধ্যে যে কত অপমান, কত অবৈধতা, অশ্লীলতা মিশিয়ে দেওয়া হয় তা কী আমরা খেয়াল করার প্রয়োজনই বোধ করি? এখানেই ভাষা দূষিত হয়ে যায়। আমরা উচ্চশিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে যখন নারীকে উল্লেখ করি ‘মাল’ শব্দটা দিয়ে তখন কী একবারও ভেবে দেখি দূষণ আমাদের অবচেতনে কতটা ছড়ালে বাজারি পণ্যের ভাষায় নারীকে উল্লেখ করা যায়, আজও? শুধু নারীই নয়, পুরুষের সম্মানের অবনমন ঘটাতে চাইলেও আমরা শব্দটাকে অনায়াসেই ব্যবহার করি। ‘মাল’ তাই নিতান্তই একটা ‘স্ল্যাং’, এটুকু বলে থেমে যেতে আমরা রাজি নই; ‘মাল’ সমাজের চেতনাকে দুষিত করে রাখা একটা বিপজ্জনক শব্দ, সমাজ যাকে বাজার- অর্থনীতির মোড়কে লুকিয়ে রেখেছে।
সমাজের অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীগুলো যে বাংলা শব্দ ব্যবহার করে তার মধ্যে এমন কিছু যৌনতাসূচক শব্দ থাকে যাকে তথাকথিত শিক্ষিত বাঙ্গালি ‘গালাগালি’ নামে অভিহিত করে। এই শব্দ গুলোর মধ্যে অবৈধ যৌন সম্পর্কের ইঙ্গিতও থাকে। এই সব শব্দের ব্যবহারকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি সুস্থ সংস্কৃতির পরিপন্থী বলে মনে করে। মনে করে, শব্দগুলোর ব্যবহার ভাষাকে দূষিত করছে। আমাদের তৈরি করা ভারতীয় মধ্যবিত্ত তথাকথিত সুস্থ সংস্কৃতি যেহেতু যৌনতাকে শুধু লুকোতেই নয়, অবদমিত করতে শেখায়, আর যৌনতায় বৈধ- অবৈধের ধারণা যেহেতু যৌন অধিকারের রাজনীতিকেই কায়েম রাখতে চায়, তাই আমরা মনে করি ‘যৌনতা’ এবং ‘অবৈধ যৌনতা’সূচক শব্দগুলো ভাষাকে যতটা না দূষিত করে তার চেয়ে ঢের বেশি উলটেপালটে দেয় মধ্যবিত্তের যত্নে গড়ে তোলা তথাকথিত সুস্থ সংস্কৃতির তাসের ঘরটাকে।
একটা সময় তো ছিল যখন তৎসম শব্দের তুমুল প্রভাব থেকে বাংলা ভাষাকে উদ্ধার করার জন্য প্রয়োজনীয় সওয়াল করা হয়েছিল, যাতে বাংলা ভাষা একটা নিজস্ব স্বাধীন পরিচিতি পায়। সেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এই বঙ্গে একটা সময় আমাদের এতটাই অস্থির করল যে পরবর্তীকালে সংস্কৃতকে ‘মৃত ভাষা’ আখ্যা দিয়ে শিক্ষাসূচী থেকে সংস্কৃতের আবশ্যিক পাঠ আমরা বাদ দিয়ে দিলাম। এর ফল কী হল? সংস্কৃত- চর্চাহীন আজকের ভাষা শিক্ষা- পরিবেশে তদ্ভব শব্দগুলোর ধাতুরূপটাকে আমরা, সংস্কৃত না জানা বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীরা, আর চিনতেই পারি না। তাই, শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ [৬] খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে আমরা এতটাই পঙ্গু হয়ে পড়েছি যে একটা ধাতু কত বিচিত্র শব্দ এবং অর্থ তৈরি করে আমাদের ভাষাকে উপহার দিয়েছে, এবং এখনো দিতে পারে, সে বিষয়ে আমাদের কোন ধারণাই তৈরি হয় না। একটা বাংলা শব্দের বিচিত্র অর্থগুলো কেন, কীভাবে তৈরি হল আমরা জানতে পারি না। এর ফলে বিশেষ কোন ভাব প্রকাশের প্রয়োজন হয়ে পড়লে আমরা সংস্কৃত জ্ঞান ব্যবহার করে নতুন শব্দ তৈরি করতে তো পারিই না, উপরন্তু অন্য ভাষার শব্দের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠি। হাতের কাছে আছে ইংরেজি ভাষা; আমরা ইংরেজির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। নিন্দুকেরা বলেন খিচুড়ি ভাষা তৈরি হচ্ছে; ভাষায় দূষণ হচ্ছে।
অনুবাদের সময়ও আমরা বাংলা শব্দ হাতড়ে মরি, এবং অনেক সময়ই এমন সব শব্দকে চটজলদি ব্যবহার করে ফেলি যা বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে চাওয়া মূল ভাষার (source language) অর্থ, ভাব, অনুভূতি কোনটাকেই প্রকাশ করতে তো পারেই না, বরঞ্চ বাংলায় ব্যবহার করা শব্দগুলোকেই হাস্যকর স্তরে নামিয়ে আনে। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হিন্দি ‘কিঁউ কী’ এর বাংলা অনুবাদ ‘কেন কী’ প্রথমেই মাথায় আসে। এ প্রসঙ্গে বলতেই হয়, ভাব, অথবা বক্তব্য, প্রকাশের প্রয়োজনে বাংলা ভাষায় অনেক অচেনা ভঙ্গি, বিশেষ করে হিন্দি থেকে, ঢুকে পড়ছে। তার একটা অংশ হয়ত ব্যবহারকারীদের পরিশীলনের অভাবেই ঘটছে। সমালোচকেরা বলবেন, বেনোজল। আমাদের কৌতূহল, এমন সব অচেনা ভঙ্গির বাড়বাড়ন্ত হলে কী বাংলাভাষীর চিন্তা-কাঠামোয় ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন আঞ্চলিক সংস্কৃতির প্রভাব পড়ার আশংকা এতটাই তৈরি হবে, যে এর ফলে বাংলাভাষী তার স্বতন্ত্র পরিচয় একদিন হারাবে? এমন হাঁসজারু শব্দভাণ্ডারকে বাংলা ভাষা কী আত্মস্থ করে নেবে, নাকি ‘সময়’ এদেরকে স্বাভাবিক ভাবেই বাতিল করবে? নাকি, ভারতীয় জাতীয়তাবাদে আস্থা রেখেও, শুধুমাত্র বাঙালি অস্মিতায় আঘাত দিচ্ছে বলে অন্য ভারতীয় ভাষা থেকে ধার করা শব্দকে আমরা অসংস্কৃত, দুষিত ইত্যাদি লেবেল এঁটে প্রকাশভঙ্গীর কথ্যরূপ থেকে জোর করে বাদ দেওয়ার জন্য সওয়াল করব?
এ প্রসঙ্গে এ কথাও বলতে হয়, ‘সমাজভাষা’য় (সোশিওলেক্ট) [৭] যে বৈচিত্র্য আছে তার অনেক কিছুকেই বাংলা ভাষা আজকের দিনে হয়ত আত্মস্থ করে নিয়েছে । ভারতের ঔপনিবেশিক অতীত যেহেতু ইংরেজিকে শিক্ষিত ভারতবাসীর মনে প্রোথিত করে ফেলেছে তাই বাংলা কথায় যে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার মিশতে থাকবে তা অস্বাভাবিক নয়। আরবি ফারসি এক সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষায় অনায়াসে মিশেছে। আর, বাংলা ভাষার উৎপত্তির সঙ্গে তো পালি, মাগধি, অর্ধ মাগধি ইত্যাদি জড়িয়েই আছে। আমাদের মনে হতে পারে, আজকালকার শিক্ষিত বাঙালি কথা বলার সময় যখন বাংলা শব্দ ব্যবহারের কথা চিন্তা না করেই,তার ইংরেজি প্রতিশব্দ ব্যবহার করে বসেন, সেটা অস্বাস্থ্যের লক্ষণ। কিন্তু, আমরা বিশ্বাস করি, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ইংরেজিকে আমরা যেমন এড়াতে পারি নি, তেমনই ইংরেজি ইতিমধ্যেই একটা নিজস্ব ভারতীয় রূপ পেয়ে গেছে। বাংলা কথায় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার তাই একটা স্বাভাবিক ভাব প্রকাশের প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল বাংলা শব্দটা চটজলদি মাথায় না আসলে, ইংরেজি প্রতিশব্দটাকে দিয়েই কাজ চালানো হয়; আজকের দিনে বৈদ্যুতিন মাধ্যমেও একই প্রক্রিয়া ‘মান্য চলিত বাংলা’য় ব্যবহার করা হচ্ছে । এতে বাংলা ভাষার দূষণের বা সংকটের কোন কারণ দেখি না।
আজকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বাংলা ভাষার যে শৈলীকে শ্রেণীকক্ষে চর্চা করা হয় তা আজকের চেহারা পেতে যে চড়াই উৎরাইগুলো পেরিয়ে এসেছে তাতে তো বাংলার তাবৎ লেখককুলের অবদান আছেই, এ ছাড়াও আছে শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় [৮] বা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মত আরও বহু বিদ্যৎজনের চিন্তাস্রোতের প্রভাব। তাঁরা হয়ত আক্ষরিক অর্থে ভাষাবিদ ছিলেন না, কিন্তু তাঁরা সাধারণ মানুষের বোধগম্য ও ব্যবহারযোগ্য ভাষা ব্যবহারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তার ফলশ্রুতিতে বাংলা ভাষা আজকের শৈলী ও প্রকাশভঙ্গী পেয়েছে। বহমান বাংলা ভাষায় নতুন ঢেউ আসতেই থাকবে; স্রোত কোনো পাড় ভাঙ্গবে, কোনোটা আবার গড়বে। সেটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অন্য ভাষার শব্দেরা অনধিকার প্রবেশ করে বাংলা ভাষায় পলি আর পাথর জমিয়ে স্রোত আটকে দিচ্ছে এমন কথা ভাবার বোধহয় সময় আসেনি।
তা সত্ত্বেও পরিভাষা গঠনের দায় স্বাধীন শৈলী ব্যবহারের আকাঙ্ক্ষার সাথে থেকেই যায়। শৈলীকে সুললিত করে সুর। সেই উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধেই সেই সুর বেজেছিল মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ব্যবহার করা বাংলায়। যদিও তিনি তৎসম শব্দের উপর নির্ভরশীল থেকেছেন, তবুও, তাঁর বাংলা ভাষা ব্যবহারে আধুনিকতার চিহ্নগুলো এতটাই প্রকাশ্য যে তা কমল কুমার মজুমদারের শৈলীর সঙ্গে তুলনীয় হয়ে উঠছে [৯]। ভাষা যদি হয় একটা নদী, তবে শৈলী তার স্রোত। নদী আর স্রোত তখনই মজে দুষিত পানা পুকুর হয় যখন রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক কারণে একটা ভাষার বিস্তার আর ব্যবহার কমতে থাকে, ব্যবহারকারীরা বাণিজ্যে পিছু হঠতে থাকে, এবং সেই রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক কারণেই সমাজ-মন সংকুচিত হতে থাকে। তাই বাংলা ভাষায় কোথাও যদি দূষণ হচ্ছে বলে মনে হয়, তবে আমাদের ঐ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কারণগুলোকেই খুঁজে দেখতে হবে, সে পথেই দূষণ মুক্তির সূত্রগুলোকে পাওয়া যাবে।
তথ্যসূত্রঃ
১। ‘Macbeth’, William Shakespeare, (1.1.11-12);
২। “… The sea of faith
Was, once, too, at the full, and round earth’s shore
Lay like the folds of a bright girdle furled.
But now I only hear
Its melancholy, long, withdrawing roar…
Ah, love, let us be true
To one another! For the world which seems
To lie before us like a land of dreams,
So various, so beautiful, so new
Hath really neither joy, nor love, nor light,
Nor certitude, nor peace, nor help for pain…”
(‘Dover Beach’, Matthew Arnold)
৩। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য (‘চার্বাকচর্চা’, অধ্যায় ৩১, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড) জানাচ্ছেন, সর্বদর্শনসংগ্রহের হাজার বছর আগে খ্রিষ্টীয় পাঁচ শতকের রচনা ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর মহাপুরাণে’ সর্বপ্রথম শ্লোকটির চেহারা পাওয়া গেছে এই ভাবেঃ
“…যাবজ্ জীবং সুখং জীবেন্ নাস্তি মৃত্যোর্ অগোচরম্
ভস্মীভূতস্য শান্তস্য পুনাগমনং কুতঃ…”
“যতদিন বাঁচবে, সুখে বাঁচবে; মৃত্যুর অগোচর কিছুই নেই। ছাই- হয়ে- যাওয়া প্রাণহীন দেহ কোথায় (বা কোথা থেকে ) আবার ফিরে আসে?” পরবর্তী অন্যান্য সূত্রে ঐ ‘মৃত্যোর্ অগোচরম্’-ই আছে। শ্লোকটির বিকৃতি বারো শতক থেকে শুরু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
৪। ‘স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা’, উদ্বোধন, চতুর্থ খণ্ড, প্রেমের ধর্ম।
৫। ‘বাংলা অকথ্য ভাষা ও শব্দকোষ’, সত্রাজিৎ গোস্বামী, একবিংশ।
৬। শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ নির্দেশ করেছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে, এবং কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী তাঁদের ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ অভিধানে বিষয়টাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
৭। সমাজভাষা নিয়ে আলোচনা করেছেন পবিত্র সরকার তাঁর ‘ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ’, দে’জ পাবলিশিং, বইয়ে।
৮। ‘ভাষা মননঃ বাঙ্গালী মনীষা’, পবিত্র সরকার, পুনশ্চ ।
৯। ১৮১৫ তে রামমোহনের প্রথম বই প্রকাশেরও আগে, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের অনুবাদ গ্রন্থ এবং মৌলিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে ১৮০২, ১৮০৮, ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে। দ্রষ্টব্য — পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রবন্ধাবলী, সঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়; মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, বাংলা গদ্যের আধুনিক রীতির অগ্রজ সহোদর, বিমল কুমার মুখোপাধ্যায়; দি এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা।