ভারতীয় ভাবনায় মন : দার্শনিক বিশ্লেষণ

উমা চট্টোপাধ্যায়

চিন্তার জগতে ‘মন’ সর্বজনবিদিত। সাধারণ জীবনেও আমরা তো মন শব্দের ব্যবহার করেই থাকি। অমুক মানুষের মন অনেক বড়ো, কত দান-ধ্যান করেন; তমুকে আবার ততটাই ছোটো মনের, এতটুকু কারুর প্রতি মন নেই। শুধু নিজের তালে আছেন। এসব কথা আমরা বলি, ভাষা ব্যবহার চলতেই থাকে, যথাযথ ভাবে মন শব্দের অর্থ না বুঝলেও আমাদের ব্যবহার চলেই। আবার লক্ষণীয়, সাহিত্যে, সংগীতে এই মন শব্দের কী খেলা! কতরকম ভাবে স্রষ্টারা এই মন শব্দের ব্যবহার করেছেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন — “কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে …..”। অর্থাৎ মন ছুটে চলে যেতে পারে যেমন তেমন ভাবে, দূর-দূরান্তে, গ্রহ-গ্রহান্তরে। সীমাহীন তার গতি ও দিশা। প্রশ্ন থাকে, সত্যই কি মন এমন গতিশীল? কবি আবার অন্যত্র বলেছেন — 

                              মনেরে আজ কহো যে,                                                                                                                                          
                             ভালো মন্দ যাহাই আসুক                                                                                                                                   
                               সত্যেরে লও সহজে।

অর্থাৎ, মন শ্রোতা, আমি বক্তা। শুধু তাই নয়, মন সমস্যা জর্জরিত, তাই মনকে বলছি — যা সত্য তা তুমি সহজে গ্রহণ করো, দুঃখ-যন্ত্রণার বিড়ম্বনায় থাকার প্রয়োজন নেই, যা কিছুর সম্মুখীন, সেটাই সত্য, সেটাই গ্রহণ করো। ‘আমি’ নই আমার মন ‘সত্য’ গ্রহণ করার কর্তা, সমস্ত জ্ঞানের কর্তা। এই জাতীয় কথা অনেক দার্শনিক প্রশ্নের অবকাশ রাখেন, যেমন সত্যটা কী? সত্যকে কে গ্রহণ করবে? মন নাকি আত্মা? আবার প্রশ্ন ওঠে, হঠাৎ করে চাকরি যাওয়া সত্য নাকি চাকরি থাকা সত্য — প্রশ্ন থাকে সেখানে, কিন্তু যেখানে কিছু করবার থাকে না; ব্যক্তি শুধু সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় থাকেন, তাকে হয়তো নিরুপায় হয়ে যাওয়াটাকেই সত্য বলে ধরে শান্ত থাকতে বাধ্য হতে হয়। কিন্তু তাতেও প্রশ্ন, এমন ভাবে শান্ত থাকলে তো আমাদের দেশ বিপ্লবীদের দ্বারা কখনোই স্বাধীনতা অর্জিত হত না। বদ্ধ দশাই যদি সত্য হয়, তাহলে মুক্তির সন্ধান কেন? কেনই বা তাঁরা বদ্ধদশাকে সত্য বলে গ্রহণ না-করে স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে উদ্যত হয়েছিলেন? মূর্খ তো সকলে ছিলেন না। সে কারণে সত্য কী তা নিয়ে প্রশ্ন। 

আবার সংগীতের সাহিত্যে যখন দেখি অন্য কবির এমন ব্যবহার — 

                            মন রে কৃষিকাজ জানো না                                                                                                                                   
                          এমন মানব জমিন রইলো পতিত                                                                                                                         
                            আবাদ করলে ফলতো সোনা

এখানেও তো মনকে এক ব্যক্তি স্বরূপে বুঝে জিজ্ঞাসা! মানবজনম কর্ষণ করে সফল করার দায়িত্ব মনে হয় মনেরই। মনেরই যেন দায়িত্ব জীবনকে সফল করার। তাই তো গীতিকার মনকেই জিজ্ঞাসা করেছেন সংগীতে। জীবনকে কর্ষণ করার দায়িত্ব মনেরই তো।

আবার রজনীকান্ত সেন দেখি তাঁর সংগীতের কাব্যে বলেছেন — ‘মন তুই ভুল করেছিস মূলে — বাজে গাছ বাড়তে দিলি, এখন কেমনে ফেলবি শিকড় তুলে?’ এখানেও সেই মনেরই কর্তৃত্ব। ভালো মন্দ সবকিছুর দায় মনেতেই বর্তায়। মনের ভুলেতেই জীবন দুঃখের পথে এগিয়ে যায়, তখন আর কিছু করার থাকে না — এমনই আক্ষেপ যেন কবি প্রকাশ করেছেন মনরূপ কর্তার কাছে। তাই ভারতীয় কাব্য সাহিত্যে মনের এক বিশেষ স্থান। ভারতীয় দর্শনে এই জাতীয় ভাবনারই বিচারমূলক আলোচনা।

লক্ষণীয়, নানা স্বরূপে আমরা মন নিয়ে চলি। কখনও মন খারাপ হলে বলে উঠি ‘মনটা বড্ড খারাপ’। কখনও মন এমনই আনন্দে ভরপুর যে তা নেচে ওঠে। গেয়ে উঠি, ‘হৃদয় (মন) আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে।’ অর্থাৎ, তখন আমার প্রফুল্ল হৃদয়। সে হৃদয় বা মন কর্তা না অন্য কিছু, তা স্পষ্ট নয়। আমার হৃদয় বা মন যখন তখন ‘সে’, আমি থেকে ভিন্ন। ‘আমি’-র একটি হৃদয় বা মন আছে যা আনন্দে ভরপুর। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই মন প্রকৃতপক্ষে কী? তার স্বরূপ, অবস্থান ইত্যাদি বিষয় জানবার আগ্রহ আসে। এমন প্রশ্নও আমাদের কোনও কোনও ঘটনার প্রেক্ষিতে মনে হয় — মন বলে কি আদৌ কিছু আছে? সমাজে, বর্তমানে যা দেখছি মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষগুলোর কি মন বলে কিছু ছিল না। তাদের কর্তৃত্ব, চৌর্যবৃত্তিতে উৎসাহিত করেছে, কিন্তু মন কখনও নিরস্ত করতে পারল না, এমন কথা বলে — এমন কঠিন কাজের পরিণতি আরও কঠিন। অসহনীয় কঠিন।

তাহলে বুঝতে পারা যায়, ‘মন’ শব্দ আমরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে ব্যবহার করি, ভিন্ন ভিন্ন অর্থেও ব্যবহার করি। কিন্তু লক্ষ করার বিষয়, ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যবহার করলেও সমস্ত ভাবনার মধ্যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য কিছু আছে। প্রথমত, মন ঘট বা বৃক্ষের মতন, কোনো মধ্যম পরিমাণ পদার্থ নয় যা আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। বলি না কখনও মন দাঁড়িয়ে আছে, বা রাস্তা দিয়ে চলেছে। আবার পরমাণুর সদৃশ্য কিনা, সে বিষয়েও তো সংশয়। ক্ষিতি, অপ্ ইত্যাদি পরমাণু অনুমেয়, তেমনি কী মন? মন পরমাণু সদৃশ্য এবং তা অনুমানের দ্বারাই জানা যায়? এমন ভাবনা ভারতীয় শাস্ত্রে সিদ্ধও বটে। নৈয়ায়িক বা মীমাংসকরা তো মনকে অনুমেয় বলেছেন। কেউ যদি বলেন প্রত্যক্ষ সিদ্ধ মন নয়, যেমন ভারতবর্ষে চার্বাক দার্শনিকরাই বলেছেন তথাকথিত মন অপ্রত্যক্ষ, তাই অসিদ্ধ। কিন্তু এই যুক্তি অত্যন্ত দুর্বল। কারণ, আমাদের জীবন মাত্র প্রত্যক্ষ জ্ঞান নির্ভরশীল নয়; আনুমানাদি ব্যতীত আমাদের ব্যবহার সম্ভব নয়। বিশেষত, আনুমান ব্যতিরেকে বিজ্ঞান অসম্ভব। তাহলে অনুমান-এর দ্বারা মনকে স্বীকার করতে বাধা নেই। পাশ্চাত্য দর্শনে মন, আত্মা শেষপর্যন্ত সমপর্যায়ভুক্ত রূপে স্বীকৃত। কিন্তু মন অনুমানের দ্বারা স্বীকৃত হলেও ভারতীয় সংস্কৃতিতে আত্মা ও মন স্বতন্ত্রভাবে স্বীকৃত। আত্মার দুঃখের বোধ মন ব্যতীত হবে না, ফলে মন ব্যতীত দুঃখ থেকে মুক্তিও সম্ভব নয়।

এই মন পদার্থকে পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদরা বলেন Mind। কর্তা বা আত্মা হল Self। কেউ কেউ তাকে (আত্মাকে) চেতনা বা consciousness বলে বুঝেছেন, অন্য অনেকে এই চেতনাকে জড় দ্রব্যের ধর্ম, চেতন ধর্ম বলে বুঝেছেন। এ কথার অর্থ হল, আত্মা হলেন চৈতন্য বিশিষ্ট দ্রব্য, ঘটাদি দ্রব্য, চৈতন্যরহিত দ্রব্য, সুতরাং তারা আত্মপদবাচ্য নয়। কিন্তু মন তাহলে কী? মন শব্দের দ্বারা পাশ্চাত্যে মানসিক অবস্থা (mental state) রক্ষিত আর আত্মা চেতনা— এ বিষয়ে গবেষণায় অনেক কিছু কিন্তু স্পষ্ট নয়, মন শব্দের ব্যবহার আমরা যেমন প্রসঙ্গ হয় সেখানে মনকে তেমনভাবে বুঝে থাকি এবং আনন্দে বা নিরানন্দে থাকি। কখনো এমনও হয়, প্রাণের বন্ধু বলে বোঝে সে মনের কথা। মন দিয়ে কারুর কথা ভাবলে দেখি সেই যোগাযোগ করছে, বলে থাকি মনের ডাক মন শোনে, তাই এমন হল। এ তো পরীক্ষিত সত্য, কল্পনামাত্র নয়। অনেকেই অবশ্য বলেন এই ঘটনা কাকতালীয় বা আকস্মিক। সে যাই হোক, তাহলে মন কী? কী তার বৈশিষ্ট্য ও কী বিচিত্র লীলা! এই মনের ভারতীয় চিন্তায় আত্মা ও মন স্বতন্ত্র ভাবে স্বীকৃত আমাদের সকল ব্যবহারের মূল রূপে। আমাদের প্রবন্ধের নামকরণ বুঝিয়েছে সমগ্র প্রাচ্যের ধারণাকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে লেখাটি বোধ করি গ্রন্থাকার নেবে, তাই ভারতীয় দর্শনের দৃষ্টি আমরা অনুসরণ করব। সমগ্র প্রাচ্যের আলোচনা করতে হলে চিন, জাপান, ইসলাম, ইত্যাদি আরও অনেক দেশের প্রসঙ্গ আনতে হয়, কিন্তু তা অন্যত্র আলোচনার অবকাশ রাখাই সমীচীন। আত্মা শব্দটি পাশ্চাত্যে অনেক পরে এসেছে, Philosophy of Mind, Philosophical Psychology নামে। আরও পরে, অর্থাৎ অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতক থেকে এল Self শব্দের ব্যবহার, আরও এল Mind-body আলোচনা। এর পরেই পাশ্চাত্যে আসছে আত্মা ও মনকে কেন্দ্র করে Cognitive Science এবং Consciousness Studies। কিন্তু ভারতীয় চিন্তাতে প্রথমাবধি আত্মা এবং মন উভয়ই স্বতন্ত্র ভাবে আলোচিত হয়েছে। আত্মা যেমন আলোচনার বিষয়, তেমনি কৃষ্টির অন্যতম চিন্তা ‘মন’-কে নিয়ে। স্বতন্ত্রভাবে মন নিয়ে বিস্তর আলোচনা প্রাচীন গ্রিক দর্শন সাহিত্য থেকে আধুনিক দর্শনেও আলোচিত। কখনও চেতনা, কখনও চেতনা বিশিষ্ট দ্রব্য। কিন্তু তিনি হলেন আত্মা, এভাবেই পাশ্চাত্যে আলোচিত। এই আত্মাই আবার ‘মন’ শব্দ বা Mind বলে স্বীকৃত হয়েছে। আত্মা বা মন সমার্থক বলেই বহুদিন পাশ্চাত্যে আলোচিত। কিন্তু, ভারতীয় ভাবনায় বেদ উপনিষদ থেকেই, পরবর্তীকালে সমস্ত দার্শনিক সম্প্রদায়ের গ্রন্থাদিতেই আত্মা ও মন স্বতন্ত্র ভাবে স্বীকৃত। আত্মা মনকে উপায় হিসেবে গ্রহণ করে বা সাহায্য নিয়েই কর্তা নতুবা তার কর্তৃত্বের দায় নেয়। আমরা তাই ভারতীয় চিন্তায় আত্মা ও মনকে স্বতন্ত্র ভাবে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই চিন্তা করা সমীচীন বলে মনে করি। এই প্রবন্ধে আমরা ভারতীয় দর্শনে মনকে কীভাবে দেখি তাই আলোচনা করতে চাই। সেই প্রসঙ্গে ভারতীয় চিন্তার একটি সম্যক ধারণা এবং মন ও আত্মা কীভাবে আমাদের সাথে সম্পৃক্ত, তা স্পষ্ট হবে।

এই প্রসঙ্গে পাশ্চাত্যে এই মনকে কীভাবে দেখা হয়েছে বা হয় তা একটু বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে ভারতীয় চিন্তাধারার ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ কতটা পৃথক। আমাদের আত্মপ্রশংসা বা আত্মসমালোচনার বিশেষ সুবিধা হবে। ইংরেজি শব্দ Mind ল্যাটিন শব্দ Mens থেকে যা গ্রিক শব্দ Menos থেকে বিবর্তিত। এই শব্দ Life force-কে বোঝায়, যা desire বা crave-কে বোঝায়। অন্যদিকে Soul বা Self Latin বা Greek সাহিত্যে অনুপস্থিত, কিন্তু প্রাচীন ইংরেজি সাহিত্যে পাই। ফলে Soul বা Self পরবর্তীকালে সংযোজিত কিন্তু প্রাচ্যের সভ্যতায় ভারতীয় চিন্তায় আত্মা ও মন কাছাকাছি রূপে সমাদৃত। কোনও চিন্তকদের কাছে আত্মা স্বীকৃত কিন্তু মন স্বীকৃত নয় অথবা মন স্বীকৃত কিন্তু আত্মা স্বীকৃত নয়, এমন নয়। সর্বত্রই উভয়ই স্বীকৃত। 

আত্মা ও মন উভয়কেই স্বীকার করা হয়েছে ভারতের দর্শনে। ‘অহং’ বা আমি বলতে আমরা শেষ পর্যন্ত সেই আত্মাকেই বুঝি। আবার ‘আমি খুব সুখে আছি’ তা আমরা হাত-পা বা চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝি না, নিজের মন দিয়েই বুঝি। সুখে আছি আমি, অর্থাৎ আত্মা ‘আমি’। এই আত্মা কী— তার যথার্থ স্বরূপ ব্যাখ্যার জন্য সমস্ত ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায় তৎপর। কারণ শেষ পর্যন্ত, আত্মাই কর্তা তার সুখ দুঃখ তাবৎ কিছু। সে দুঃখে থাকতে চায় না। সর্বদা দুঃখ থেকে নিবৃত্তি চায়, তার জন্য সে তার মতন করে তৎপর হয়। সেক্ষেত্রে সুখ দুঃখ বুঝতেই তো মন আবশ্যক। কিন্তু প্রশ্ন হল মন কী, মনের কার্যকারিতা কোথায়? এই মন সকলে স্বীকার করলেও নানা নামে তাকে স্বীকার করেছেন — অন্তঃকরণ, চিত্ত, বুদ্ধি, মন ইত্যাদি শব্দের দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে। আমাদের শরীর নামক রথটির রথী হলেন আত্মা, বুদ্ধি হল সারথি আর মন হল লাগাম। আত্মা জ্ঞান বা বুদ্ধি দিয়েই মনের লাগাম ধরে রাখেন। মনের লাগাম না ধরলে মন বেসামাল হয়ে ছুটোছুটি করে।

আত্মা মনের সাথে যুক্ত হলে, মন ইন্দ্রিয়-র সাথে যুক্ত হলে, ইন্দ্রিয় বিষয়ের সাথে যুক্ত হলে আমরা বিষয়কে প্রত্যক্ষ করি বা জানি। নৈয়ায়িক বা মীমাংসকরা এমন কথাই স্বীকার করেন। জৈনরাও এমনই বলেন। সুতরাং বিষয় যতই থাকুক, আত্মা মনের সাথে যুক্ত না হলে সে বিষয়গুলো আমার জ্ঞানগ্রাহ্য হবে না, অর্থাৎ, আমি জানব না। তা যদি না জানি, বহু যন্ত্রণাময় ঘটনার জ্ঞান থেকে আমাদের কষ্ট পেতে হত না। কিন্তু তা তো সম্ভব হয় না। আমরা জানি কষ্ট, দুঃখ বা আনন্দ সবই আমরা পেয়ে থাকি এই আত্মমনসংযোগ থাকলে। এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট জানবার যে জ্ঞান বা অনুভবের ক্ষেত্রে মন কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায় বা মীমাংসা মতে, মন বিযুক্ত হয়ে আত্মা জ্ঞাতা হতে পারেন না, অর্থাৎ কিছু জানতে পারেন না। ন্যায় মতে, এই মনই আবার সুখ দুঃখ বোধের ক্ষেত্রে করণ। আত্মা মনের দ্বারা আত্মনিষ্ঠ সুখ-দুঃখকেও জানেন। তাহলে মন সুখ-দুঃখকে ইন্দ্রিয় রূপে জানতে পারে; আবার অন্যান্য সমস্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে অন্যতম সাধারণ কারণ রূপে আত্মার সাথে যুক্ত হয়ে থাকেন ও জ্ঞান হয়। 

এখানে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, প্রাচ্যের দৃষ্টিতে বা ভারতীয় দৃষ্টিতে আমরা যখন মন-এর পর্যালোচনা করছি তখন প্রথমেই ন্যায়, মীমাংসা, বৌদ্ধ বা জৈনের কথায় কেন প্রবেশ করলাম। কারণ হল এই যে, এঁদের যে ব্যাখ্যা তা অত্যন্ত বস্তুবাদী, ব্যাবহারিক ব্যাখ্যা। লেখার শুরুতেই বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ থেকে অথবা ব্যাবহারিক জীবন থেকে যেসব দৃষ্টান্ত দিয়েছি তার সবই এই দর্শন সম্প্রদায়গুলির ভাবনায় বিধৃত। আত্মা মনের দ্বারা সুখ-দুঃখকে জানে, আত্মার মনের সহযোগিতায় প্রত্যক্ষ, অনুমান ইত্যাদি সমস্ত রকমের জ্ঞান হয়। সে কারণে জৈন, মীমাংসা ও ন্যায় মতে মন কী, তা আরও একটু স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়া আবশ্যক হয়। 

জৈন মতে, মন সর্ব অর্থের জ্ঞানের জন্য আত্মার সহায়ক, কিন্তু ইন্দ্রিয় বলে স্বীকৃত নয়। মানস প্রত্যক্ষ অর্থাৎ সুখ-দুঃখের জ্ঞান যে সব প্রত্যক্ষ হয় তা দ্রব্যস্বরূপ মনের দ্বারা হয়। এই যে দ্রব্য রূপ মন তাকে অন্তঃকরণ বলা হয়। লক্ষ করার বিষয়, মনকে অস্বীকার করতে পারেন না জৈনরা। বৌদ্ধ দার্শনিকেরাও এই মনকে স্বীকার করেছেন। ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা ইন্দ্রিয়যুক্ত বিষয়কে গ্রহণ করি, কিন্তু মন দ্বারা আমরা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-কে জানি। এবং ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে নিয়ম থাকলেও মনের কোনও বিষয়ে নিয়ম নেই। মন সবকিছু জানতে পারে। 

ন্যায়-বৈশেষিক মতে, মন আন্তর পদার্থ ও দ্রব্য বিশেষ। এঁরাও মীমাংসক বা জৈন ও বৌদ্ধের মতো প্রতি আত্মার সাথে একটি মন-ই যুক্ত থাকে বলে স্বীকার করেন। অর্থাৎ, প্রতি দেহে একটি মন। এই মন মানসিক জ্ঞানের জন্য ইন্দ্রিয়, অপরপক্ষে সমস্ত জ্ঞানের জন্য সাধারণ কারণ। 

ভাট্ট মীমাংসকরাও মনকে আন্তর দ্রব্য রূপে স্বীকার করেছেন। কিন্তু মন একইভাবে সর্ববিষয়গ্রাহী বলে ইন্দ্রিয় নয়, কিন্তু জ্ঞানের সহায়ক কারণ। মনের স্বরূপ নিয়ে অর্থাৎ মন অণু পরিমাণ না বিভু পরিমাণ তা নিয়ে আবার প্রভাকর ও ভাট্টদের মধ্যে মতভেদ আছে। নৈয়ায়িকরা মনকে অণু পরিমাণ বলে স্বীকার করেছেন। মন অণু পরিমাণ বলেই আমরা যুগপৎ অনেক জ্ঞান লাভ করি না। 

লক্ষণীয় সাংখ্য বা যোগ দর্শনেও মন স্বীকৃত, কিন্তু ভিন্ন রূপে। মন, বুদ্ধি ও অহংকার — এই তিনটি একত্রে অন্তঃকরণ রূপে স্বীকৃত। এই তিনটির ভিন্ন ভিন্ন কাজ। মনই সকল সময়ে করণ বা ইন্দ্রিয় রূপে কাজ করে। এই মন, সাংখ্য মতে, জড় পদার্থ, প্রকৃতির পরিণাম — এক বিশেষ অবস্থা। প্রকৃতি জড়, ফলে তার পরিণাম মনও জড় পদার্থই হবে। প্রকৃতি থেকে বুদ্ধি, বুদ্ধি থেকে অহংকার। এই অহংকার-এর সাত্ত্বিক ভাব থেকে উৎপন্ন এবং একাদশ ইন্দ্রিয়ের অন্যতম মন। মন ইন্দ্রিয় বটে, কিন্তু জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের পরিচালক। সেই কারণেই তো আমরা মনের দ্বারা পরিচালিত হয়ে ছুটোছুটি করে অস্থির হই। মনের লাগাম ধরা থাকলে অসুবিধা কম। বেদান্তে বা উপনিষদেও মন স্বীকৃত ভূতজাত, অতি সূক্ষ্ম জড় পদার্থ রূপে। এই মন ধর্মাধর্ম ও সংস্কারের আশ্রয় রূপে জীবের সংসার অবস্থায় স্থায়ী হয়। 

শংকরাচার্য তাঁর ভাষ্যে আত্মার উপাধি রূপে আত্মার অন্তঃকরণকে মন, বুদ্ধি, বিজ্ঞান, চিত্ত ইত্যাদি নানা শব্দে বিভূষিত করেছেন। অন্তঃকরণ বা মন অদ্বৈতচৈতন্যবাদী দর্শন, অদ্বৈতবেদান্ত তা স্বীকার করেছেন একান্ত প্রয়োজনেই। চৈতন্য শেষ পর্যন্ত একমাত্র সত্তা রূপে স্বীকৃত হলেও আমাদের ব্যাবহারিক জীবনে লোকব্যবহার নিষ্পন্ন করার জন্য সাধারণ যে জ্ঞান সেখানে অন্তঃকরণ বা মন স্বীকার ব্যতীত উপায় নেই। শেষপর্যন্ত চৈতন্য একমাত্র সত্য বস্তু সন্দেহ নেই, কিন্তু বেদান্ত মতে ব্যাবহারিক জীবন-ও তো স্বীকৃত, সেখানে তাবৎ ব্যবহারের জন্য মন আবশ্যক। কিন্তু মন জড়াত্মক, সেই কারণে তাও লয়প্রাপ্ত হয়। এই মন, অন্তঃকরণ বা চিত্তের বৃত্তি বা পরিণাম আছে। এই পরিণামের ব্যবস্থাকে রুদ্ধ করাই মানুষের কৃত্য। 

যোগদর্শনে যে অষ্টাঙ্গ যোগের কথা বিস্তৃতভাবে আলোচিত তার-ও এই মন প্রসঙ্গেই গুরুত্বপূর্ণ। চিত্ত বা মনের স্বরূপ যেরকম-ই হোক সূক্ষ্ম অথবা বিভু কিংবা মধ্যম পরিমাণ সেই মন সর্বদর্শন তথা সমগ্র ভারতীয় সংস্কৃতিতে স্বীকার করা হয়েছে। সেই মনের গতি বা ব্যবহারের জন্য আমাদের সজাগ থাকা প্রয়োজন। অষ্টাঙ্গযোগ দ্বারা শরীরের উন্নতি যেমন হবে, তেমনি মনের উন্নতি। মন চিত্ত রূপে যে বৃত্তিপ্রাপ্ত হয় সেই বৃত্তি নিরুদ্ধ হওয়ারই প্রচেষ্টা মনুষ্য জীবনের কাম্য। চিত্ত বা মন সংযত রাখার সাধনাই ভারতীয় সংস্কৃতির বা কৃষ্টির মূল। তার দ্বারাই ভোগবাদী আধুনিক জীবনেও আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারব যথার্থ মানুষ রূপে। মন ছোটো বা বড়ো, মনের তড়িৎ গতি, বা মন যে জ্ঞাতা বা কর্তা সবই নষ্ট হবে। আত্মাই প্রধান হবে। আত্মাই দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাবেন এই মনের সাহায্য নিয়ে। 

গ্রন্থপঞ্জি :

) ‘ন্যায়দর্শন’, গৌতম, ফণিভূষণ তর্কবাগীশের ব্যাখ্যা সহ, কলকাতা।

) ‘ভাষা পরিচ্ছেদ ও সিদ্ধান্ত মুক্তাবলী’, বিশ্বনাথ ন্যায় পঞ্চানন, পঞ্চানন ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যা সহ, কলকাতা।  

) ‘বেদান্ত পরিভাষা’, ধর্মরাজাধ্বিরীন্দ্র, পঞ্চানন ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যা সহ, কলকাতা।

) ‘বৃহদারণ্যক উপনিষৎ’

) ‘কঠোপনিষৎ’

) ‘সাংখ্যকারিকা’, ঈশ্বরকৃষ্ণ বিরচিত, নারায়ন চন্দ্র গোস্বামী কৃত অধ্যাপনা ও ব্যাখ্যা সহ, কলকাতা। 

) ‘যোগসূত্র’, মহর্ষি পতঞ্জলিকৃত, শ্রীমৎ হরিহরানন্দ আরণ্যক দ্বারা আলোচিত। 

) ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ সায়নমাধবকৃত, বিশেষত বৌদ্ধ দর্শনম্ ও চার্বাক দর্শনম্, শ্রীপঞ্চানন শাস্ত্রী ব্যাখ্যাত ও সম্পাদিত। 

) ‘প্রমেয়কমল মার্তন্ড’, প্রভাচন্দ্র। 

১০) ‘ভারতীয় দর্শনে মন’, রূপা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, Jadavpur Journal of 

Philosophy,  2007।

১১) ‘Essays in Analytical Philosophy’, Gopinath Bhattacharya, EKokata. 

(Particularly the chapter on Some Basic Tenets of Advaita Vedanta.)

১২) ‘History of the Concept of Mind’, Paul S. MacDonald, Routledge, 2003.

১৩) ‘Life, Mind and Consciousness’, Anthology ed. by Ramakrishna Mission Institute of Culture, Kolkata.

১৪) ‘Study in the History of Philosophy of Mind’, vol. 12, eds. Sima Knuuttila, Juha, Sihovla, Springer Publications.

১৫) ‘সঞ্চয়িতা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৬) ‘গীতবিতান’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  

১৭) ‘কাব্যগ্রন্থ’, রজনীকান্ত সেন

১৮) শ্যামা সংগীত 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান