চিত্তভ্রংশ, উত্তরাধুনিকতা, লিওতার ও কান্ট : একটি বিতর্ক

শীর্ষাঙ্কর বসু

সারাংশ

অষ্টাদশ শতাব্দীর খ্যাতনামা দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant)-এর মতবাদ অনুযায়ী মানবমনের অন্তঃপুরে এক অসীম সমাধান-অসাধ্য অভ্যন্তরীণ (internal) স্ববিরোধের (contradictions) ইঙ্গিত বা বসবাস আছে। এই অভ্যন্তরীণ স্ববিরোধী অনির্ণনীয়তা উত্তর-আধুনিক দর্শনের ইতিহাসে; বরং বলা ভালো উত্তর-আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানতত্ত্বে চিহ্নিত রয়েছে ‘paralogy’ নামক শব্দটির চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে। এখন ‘প্যারালজি’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে যে অর্থটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেটি হলো এই যে ‘প্যারালজি’ হলো একধরনের ‘উপ-যুক্তি’ বা ‘অব-যুক্তি’; অন্যার্থে ‘ছদ্ম-যুক্তি’। জাঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার-এর মতে উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বের নির্মিতি অনেকাংশেই ব্যাখ্যাত হয়েছে এই উপ-যৌক্তিক বা অব-যৌক্তিক চিন্তন কাঠামোর মধ্য দিয়ে। তাই এই প্রবন্ধে ‘প্যারালজি’ সম্পর্কিত এই পর্যালোচনা ধ্রুপদী বোধ বিজ্ঞানের ‘নিশ্চয়তা প্রস্তাবনার’ (certainty thesis) বিরুদ্ধে; একধরনের ‘বিরুদ্ধ-অবয়ব’ (anti-model) বা ‘বিরুদ্ধ-বিগ্রহ’-এর নির্মাণের মধ্যে। উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বের প্রতি গুরুত্ব আরোপন করে তাই বলা যায় এই পর্যালোচনা আধুনিক বোধ বিজ্ঞানের বিষয়িতা (subjectivity) নিরূপণের ক্ষেত্রে এক ধরনের ছেদ (rupture) বা অনবচ্ছিন্নতা’র (discontinuity) কথা বলে। ‘প্যারালজিকাল’ বা উপ-যৌক্তিক চিন্তন কাঠামো অনুসরণ করে, আমরা দেখিয়েছি যে, এই ছেদ আসলে ‘আমি’ বা আমার যৌক্তিক ‘আত্মা’ বা ‘মন’ বলতে যা বোঝায় তার ‘একত্ববোধ’-এর উপর ঘনিয়ে আসা ছেদ বা অনবচ্ছিন্নতা। উপরোক্ত উদ্দেশ্য চরিতার্থে, অর্থাৎ মানবীয় মনের ‘একত্ববোধ’ (perception of unity)-এর অনবচ্ছিন্নতা প্রতিষ্ঠার্থে এই প্রবন্ধে যা দেখানো হয়েছে তা হলো লিওতারীয় ‘ভাষাখেলা’র প্রাতর্কিক প্রকরণ (discursive species) ও কান্টীয় নরত্ব-আরোপিত (anthropomorphic), নৃকেন্দ্রিক অনুপস্থাপনীয়তা (unpresentability) বা ‘আমূল’ উপস্থাপন-অযোগ্যতার, মধ্যে এক প্রকারের অনুবর্তী (correlative) সম্পর্ক কিংবা পারস্পরিকতা। তাই আমরা এই তত্ত্ববিগ্রহের শেষ দেখিয়েছি এইভাবে যে লিওতার ও কান্টের মধ্যেকার এই অনুবর্তী উত্তরাধুনিক সংলাপ’ই আমাদের তত্ত্ববিগ্রহ’কে (theorization-model) নিয়ে যায় সেই আদ্যন্ত গুণগত সমাজতত্ত্বায়ন-এর দিকে যা খুব সহজেই, বোধীয় স্নায়ুবিজ্ঞানের জ্ঞানীয় পরিমণ্ডলে, মানবীয় স্নায়ুবৈকল্যে’র (neuropathology) উদাহরণ হিসেবে ‘চিত্তভ্রংশ’কে (schizophrenia) আলোচনার প্রাতর্কিক পরিসরের মধ্যে অধিষ্ঠিত করতে পারে।

Keywords : মানবমন; চিত্তবিভ্রম; বৈকল্য; চিত্তভ্রংশী বাতুলতা; উত্তর-আধুনিকতা; প্রতর্ক; ভাষা-খেলা; উপ-যুক্তি; sublime; লিওতার; কান্ট

প্রাক্‌কথন

প্রবন্ধের শুরু থেকে শুরু করা যাক। আমরা এই তত্ত্ববিগ্রহে উত্তরাধুনিকতা এবং চিত্তভ্রংশের মধ্যেকার প্রাতর্কিক সম্পর্ক নিরূপণে লিওতার এবং কান্ট-এর তত্ত্ববিগ্রহের মধ্যে এক প্রকারের প্রাতর্কিক সম্পর্ক বা এক ধরনের প্রতর্ক উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। অবশ্যই বোধ বিজ্ঞানের জ্ঞানীয় পরিক্ষেত্রে থেকে। আমরা আবারো নিজেদের প্রশ্ন করব, যে মন কী? ‘আমি’ এবং আমার মনের ঠিক কেমন সম্পর্ক? বোধ বিজ্ঞানের কীরূপ জ্ঞানতত্ত্বায়ন (epistemologization) সম্ভবপর হলে, ঠিক কোন আঙ্গিকে মানবমন’কে ব্যাখ্যা করলে, আমরা চিত্তভ্রংশী বাতুলতা এবং মানসিক পীড়নভ্রম সংক্রান্ত ব্যাধিগ্রস্ততাকে বিজ্ঞানের গুণগত ব্যাখ্যানির্মিতির মধ্যে নিয়ে আসতে পারব? আমরা জানি যে মানবমন নিজে দেখতে বা শুনতে বা কথা বলতে পারে না; কিন্তু মানবমন-এর অন্তঃকরণ, এক ধরনের যৌক্তিক তন্ত্র অনুসরণ করে, সহায়ক যন্ত্র হিসেবে কাজ করে মানুষকে কথা বলতে, বাক্য বিনিময় করতে; কোনো বস্তুকে দেখতে বা শুনতে সাহায্য করে; বা যেমন করে মানবমন মানুষকে কোনো কিছু হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখতে সাহায্য করে। মানুষ যাকে দেখে, তাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করে অনুভব করে বলেই মানুষ জানে বা বোঝে যে সে যা দেখছে, যা শুনছে বা স্পর্শ করছে বা যার সম্বন্ধে কথা বলছে; অর্থাৎ তার দর্শনক্রিয়া, শ্রবণক্রিয়া এবং স্পর্শ ক্রিয়ার মধ্যে এক ধরনের ‘একত্ববোধ’ [১] আছে বা এক ধরনের একরূপী, সমসত্তীয় এককত্ব আছে। এই এককত্ব আছে বলেই মানুষের ব্যক্তিসত্তা (identity) তৈরি হয়।মানবীয় মনের এই অন্তঃপ্রত্যক্ষণের জগতে এক ধরনের এককত্ব বিরাজ করে বলেই, আমরা শেষ-মেষ ‘উন্মাদ’ হয়ে যাই না। এবং অন্তঃপ্রত্যক্ষণ-এর এই একত্ববোধ-এর ফলস্বরূপ মানব মন সুস্থ বা অসুস্থ; ‘স্বাভাবিক’ বা ‘অ-স্বাভাবিক’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে থাকে।

কিন্তু, কী হবে যদি আমাদের অন্তঃপ্রত্যক্ষণ-এককত্ব-এর এই বোধ বিঘ্নিত বা লঙঘিত হয়? আধুনিক মূলস্রোতীয়/ধ্রুপদী দৃষ্টবাদী বোধ বিজ্ঞান যা পরিগণনাত্মক প্রকল্পের উপর আধারিত, তা কী পারে আমিত্বের মধ্যেকার এই অবভাসতাত্ত্বিক অনৈক্য’কে (phenomenological disunity of self) যৌক্তিক-গাণিতিক সূত্রাবলীর সহায়তায় পরিমাপ করতে? এই মর্মেই আমাদের প্রতর্কে, এবং তজ্জনিত প্রাতর্কিক ভাষা-খেলায় প্রবেশ করে আধুনিকোত্তর জ্ঞানতত্ত্বের আধিবিদ্যক গতিময়তা। অবভাসতাত্ত্বিক বিষয়িতা (বি)নির্মাণে এই ‘ছেদ’, বা আমিত্ত্বের ধারণার মধ্যে এই অনবচ্ছিন্নতার অস্তিত্ত্ব ব্যাখ্যার্থে’ই, আমরা এই প্রবন্ধে ‘চিত্তভ্রংশ, উত্তরাধুনিকতা, লিওতার ও কান্ট’-এর মধ্যেকার ভাষা-খেলা’কে উপস্থাপন করার চেষ্টা করব।

উপ-যুক্তি কী?

আমরা শুরু করব ‘প্যারালজি’ (paralogy) দিয়ে। আমরা এই প্রবন্ধে দেখিয়েছি ‘প্যারালজি’ই সেই যুক্তি বা যৌক্তিকতার উপমণ্ডল যার দ্বারা আমিত্ত্বের মধ্যেকার এই একত্ববোধ-এর ‘ছেদ’কে; অর্থাৎ, যৌক্তিক আত্মা বা ‘rational self’-এর ধারণার মধ্যেকার অনবচ্ছিন্নতা’র চলন কে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে, যাকে সাধারণতঃ, মনোবৈকল্যদর্শনে — ‘ipseity disorder model of self’ [২] নাম দিয়ে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এই ‘ipseity disorder model of self’, বৈকল্যতত্ত্বের ইতিহাসে, মানবীয় আত্ম-অভিজ্ঞতার (self-experience) সেই দিকগুলিকে তুলে ধরে যেগুলি সমাজের চোখে ব্যতিক্রমী আত্ম-অভিজ্ঞতা বা ব্যত্যয়ী আত্ম-অভিজ্ঞতা হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকে। তাই অনুমান করা যেতে পারে যে দ্বি-মানক ধ্রুপদী যুক্তিবিজ্ঞানের আওতায় থেকে, আমরা এই ব্যত্যয়ী আত্ম-অভিজ্ঞতা বা ব্যত্যয়ী বিষয়ী-সাপেক্ষতা’কে আমাদের চিন্তন তন্ত্রে ঠাঁই দিতে পারব না। কারণ এই বোধীয় ব্যতিক্রম বা স্নায়ু-ব্যত্যয়’কে অনুধাবন করার জন্য চাই এক বিশেষ ধরনের যৌক্তিকতা বা যুক্তির পরিমণ্ডল যাকে উত্তর-কান্টীয় প্রেক্ষিত থেকে জাঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার-এর মতন দার্শনিকেরা বলেছেন ‘প্যারালজি’ বা উপ-যুক্তি। আলোকায়নের যুক্তির উন্নাসিকতায় উন্নীত যুক্তিপট থেকে যেহেতু এই ‘paralogical thought model’ খানিকটা নীচে রয়েছে, তাই ‘প্যারালজি’কে আমরা ‘অব-যৌক্তিক’ (infra-logical) বা ‘ছদ্ম-যৌক্তিক’ (pseudo-logical)-ও বলতে পারি। অর্থাৎ, প্রেক্ষিত ভেদে ‘প্যারালজি’ কখনো উপ-যুক্তি, কখনো অব-যুক্তি; আবার কখনোবা ছদ্ম-যুক্তি কিংবা শুধুই ভ্রম।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে লিওতার-এর তত্ত্ববিগ্রহে, অর্থাৎ যাকে আমরা লিওতার-এর ‘ভাষাখেলা’ জনিত তত্ত্ববিগ্রহ হিসেবে ভাবতে পারি, তাতে উপ-যৌক্তিক চিন্তনকাঠামোর গুরুত্ব বহুমাত্রিক। আরও সংক্ষিপ্তাকারে বললে লিওতার-এর ভাষা-খেলার প্রাতর্কিক প্রকরণ যা হ্বিটগেনস্টাইনীয় দার্শনিক প্রাতর্কিকতা থেকে উদ্বুদ্ধ, কয়েকটি ফর্মাল বা যৌক্তিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা গঠিত। এই ফর্মাল বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ :

(১) অনির্দেশ্যতা; (২) অনিশ্চয়তা; (৩) জটিলতা; (৪) অনির্ণনীয়তা; (৫) কূটাভাস; (৬) অনবচ্ছিন্নতা; (৭) বিখণ্ডিত গাঠনিকতা; (৮) সামঞ্জস্যহীনতা; (৯) স্ববিরোধ; (১০) আংশিক সুসংগতি; (১১) দ্বান্দ্বিকতাবাদিতা; (১২) বহুত্ব; (১৩) অস্বচ্ছতা; (১৪) অসমন্বীয়তা বা অসংসক্তি। উপরোক্ত উপ-যৌক্তিক বৈশিষ্ট্যগুলি লিওতার কর্ত্তৃক ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে রচিত ‘দ্য পোস্টমডার্ন কণ্ডিশন’-এ বর্ণিত উপ-যৌক্তিক বৈশিষ্ট্যগুলির থেকে খানিকটা পৃথক ও পরিমার্জিত। যদিও লিওতার, প্রতর্কের অন্তর্লীন অর্থতাত্ত্বিক অনির্দেশ্যতা বোঝাতে, উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে মূলত — অসম্পূর্ণতা, প্রায়োগিক কূটাভাস, বিপর্যয়, বহুধাবিভক্তি, অনবচ্ছিন্নতা ও অনির্ণনীয়তার প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করেছিলেন।[৩]

এই উপ-যৌক্তিক চিন্তন কাঠামোই একমাত্র সেই যুক্তিযন্ত্র যার দ্বারা ভাষা, মন ও সমাজের মধ্যে এক প্রকারের প্রাতর্কিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে, ভাষার দৈশীকরণ (spatialization) বা প্রতর্কায়ন (discursivization) সম্ভব। লিওতার মনে করতেন যে ভাষা-খেলার মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ গতিময়তাই বাক্যাংশ-বিশ্বের (‘phrase-universes’) মধ্যে এক প্রকারের সামাজিক সংযোগ বা যোগাযোগ’কে (social linkage) সূচিত করতে পারে।[৪] আমরা জানি মনুষ্যসমাজে বাক্যাংশ-বিশ্ব অণুস্তরে মূলত তিন ধরনের প্রাতর্কিক সম্পর্ক (discursive relations) দ্বারা সূচিত হয়ে থাকে। (১) সম্বোধক (addresser), সম্বোধিত (addressed), নির্দেশক (referent), অর্থ (meaning); (২) উক্তক(/কথক) (narrator), উক্ত(/কথিত) (narrated/narratee), নির্দেশক (referent), অর্থ (meaning), (৩) চিহ্নক(signifier), চিহ্নিত(signified), নির্দেশক, অর্থ। অর্থাৎ যে কথা বলছে বা সম্বোধন করছে বা যে কারুর বা কিছুর প্রতি উক্তি করছে বা কোনো কিছুকে চিহ্নায়িত করছে, সে হলো সম্বোধক বা কথক বা উক্তক বা চিহ্নক; আর যা সম্বোধিত বা কথিত বা উক্ত বা চিহ্নিত হচ্ছে সেটি হলো সম্বোধিত বা কথিত বা উক্ত বা চিহ্নিত। লিওতার-এর মতে এদের মধ্যেকার সম্পর্ক সবসময় ‘one-to-one correspondence’-হিসেবে বিবেচিত হয় না। লিওতার তাঁর ভাষা-খেলায় এই ‘primacy of the symbolic’-এর বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন। ফরাসী সামাজিক চিন্তনে, নীৎশীয় প্রভাব বিস্তার লাভ করার অনেক আগেই, লিওতার তাঁর প্রতিভাসবাদী চিন্তাপ্রস্থানের মধ্য দিয়ে মনে করতেন যে প্রতিভাসবাদী বা অবভাসতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মূল বিষয় কোনো নির্মাণ বা পুননির্মাণ নয়, বরং প্রতিভাসবাদী চিন্তনের মূল ভিত রয়েছে বিষয়টি যেমন তাকে তেমনভাবে তুলে ধরার মধ্যে — ‘back to things themselves’। এইভাবে বিষয়টি যেমন তাকে তেমনভাবে তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে, প্রতিভাসবাদ, ভাষার দ্বান্দ্বিক পরিক্ষেত্রের মধ্যে থেকে যা লাভ করে তা হলো এক ধরনের মৌলিকত্ব (originary-ness)।তাই প্রতিভাসবাদী চিন্তনে ভাষার পূর্বে কিছু নেই; ‘pre-linguistic’ বা প্রাক্‌ভাষিক বা প্রাক্-ভাষাতাত্ত্বিক বলতে আমরা যা বুঝি তা সর্বদা ইতোমধ্যেই ভাষিক বা ভাষাতাত্ত্বিক। এমন কিছু প্রতিভাসবাদী চিন্তনে ভেসে ওঠে না যা অর্থসম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে কোনো প্রকারের প্রাক্‌যৌক্তিক (pre-logical) চিহ্নিতকরণের (signification) মধ্য দিয়ে। তাই হয়তো দেরিদা বলেছিলেন যে ভাষাকে বাদ দিয়ে, ব্যাতিরেকে জগৎ-কে অনুধাবনের চেষ্টা করা সম্ভব নয়। ‘L’Ecriture et la différence’ [‘The Writing and Difference’]-এ দেরিদা বলছেন যে আমাদের জগতে সেই মৌলিক সত্যের (originary truth) উদঘাটন সম্ভব নয় যা চিহ্নের নিয়ম’কে (‘order of the sign’) অতিক্রম করে যায়।লিওতার বলছেন যে যা মৌলিক, তা এক বার বর্ণিত হয়ে গেলে আর মৌলিক থাকে না — ‘the originary is no longer originary in so far as it is described.’।[৫] তাই লিওতার ভাষা’কে ব্যাখ্যা করেন বা ভাষাকে বোঝেন বিভিন্ন চিহ্নকের সমষ্টি দিয়ে তৈরি কোনোরূপ চিহ্নতাত্ত্বিক আবেষ্টনীর ধারণা বা ‘closed system of signifiers’-এর ধারণার মধ্য দিয়ে নয়; বরং এমন এক ভাষাতাত্ত্বিক তন্ত্রের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে যা বিভিন্ন বহুরূপী ভিন্নতার আন্তঃসম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়ে সূচিত — ‘… dialectical account of language’ ‘… as a system of differential relations’।[৬] এখন এই চিহ্নক/চিহ্নিত কিংবা সম্বোধক/সম্বোধিত কিংবা উক্তক/উক্ত-এর মধ্যেকার সম্পর্কই দৃশ্যত ভাষা-খেলার সূত্রগুলিকে নির্ধারণ করতে পারে। যখন এই সম্পর্ক আর ‘one-to-one correspondence’-হিসেবে বিবেচিত হয় না, তখনি ভাষা-খেলায় উপ-যৌক্তিকতা সূচিত হয়ে থাকে যা যুক্তিপটে এক প্রকারের যুক্তি-চ্যুতি বা পট পরিবর্তনের ইঙ্গিত নিয়ে আসে। বরং এটি বলা যেতে পারে যে এই সম্বোধক/কথক/চিহ্নক, সম্বোধিত/কথিত/চিহ্নিত, নির্দেশক ও অর্থের মধ্যে সম্পর্ক এমন হতে পারে যা ভাষা ও সমাজ, অর্থাৎ ভাষাতাত্ত্বিক ও সামাজিক’কে একসূত্রে গেঁথে বিভিন্ন বিষমসত্তীয় প্রতর্কের সূচনা করতে পারে।

কী হতে পারে এই উপ-যৌক্তিকতার পদ্ধতিতন্ত্র

এই প্রবন্ধে আমরা এক প্রকারের গুণাত্মক সমাজবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করেছি। আমরা বোধবিজ্ঞানের উত্তর-আধুনিকায়ন প্রসঙ্গে লিওতার ও কান্টের মধ্যেকার সেই অনুস্যূত সম্পর্ক উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি যা উপ-যৌক্তিক পরিকাঠামো’কে আমাদের আলোচিত যুক্তি-তন্ত্রের অভ্যন্তরে অধিষ্ঠিত করতে পারে।এই উপ-যৌক্তিক বৈশিষ্ট্যগুলি হলো সেই ফর্মাল বৈশিষ্ট্য (যেগুলির সম্পর্কে উপরোক্ত অংশে আমরা আলোচনা করেছি) যার দ্বারা লিওতার ‘আধুনিকোত্তর বিজ্ঞান’কে ‘দ্য পোস্টমডার্ন কণ্ডিশন’-এ চিহ্নিত করেছিলেন। লিওতার-এর এই চিন্তা-বিগ্রহ’কে অনুসরণ করে, যাকে আমরা চিন্তনের এক ধরনের বিরুদ্ধ-অবয়ব (anti-model) বা বিরুদ্ধ-বিগ্রহ বলতে পারি, আমরা ভাষা-খেলা জনিত এক ধরনের প্রাতর্কিক বিগ্রহ (discursive model of language-games) তৈরি করেছি যা লিওতার ও কাণ্টের মধ্যেকার প্রাতর্কিক যোগাযোগে প্রতিস্থাপিত।অত:পর আমরা প্রবন্ধটি শেষ করেছি আধুকিকোত্তর উপ-যৌক্তিকতা’কে এক ধরনের আদর্শ স্নায়ু-প্রতিভাস হিসেবে দেখিয়ে, ‘চিত্তভ্রংশী বাতুলতা’ সম্বলিত স্নায়ুবৈকল্যের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে।

অনির্দেশ্যতার সূত্র

উপ-যুক্তি বা উপ-যৌক্তিকতাবাদ হলো সেই বিরুদ্ধ-যৌক্তিক পদ্ধতিতন্ত্র, যার দ্বারা দর্শনের পরাতাত্ত্বিক পরিসরে, উত্তরাধুনিকতা এক ধরনের বহুরূপিতা বা বিষমসত্ততা’কে অনুসন্ধান বা অন্বেষণ করতে পারে। বিষমসত্ততার প্রতি এই অন্বেষণ-ই আধুনিকোত্তর দর্শন’কে সেই রাজনৈতিক পরিসরের দিকে নিয়ে যায় যেখানে এক ধরনের আমূল বহুত্ববাদ (radical pluralism) এবং এক ধরনের কৌশলাত্মক নৈরাজ্যবাদিতার (strategic anarchism) রাজনীতি’ই তাত্ত্বিক পরিসরে মুখ্য হয়ে ওঠে।যদিও লিওতার মনে করেন যে আমাদের সমাজ ও সমাজজ্ঞানীয় ব্যাখ্যার মূলে সবসময়ই সম্বোধক, সম্বোধিত, নির্দেশক ও অর্থের মধ্যেকার এই অণুস্তরীয় পারস্পরিক সম্পর্ক নিহিত থাকে; কিন্তু এতৎসত্ত্বেও আমরা ভাষাতাত্ত্বিক সমগ্রায়নের কথা ভাবতে পারি না। কারণ আমরা জানি লিওতার ও উত্তরাধুনিকতার প্রাথমিক তত্ত্বসূত্রানুযায়ী মনুষ্য সমাজের ঐতিহাসিক, সামাজিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক সমগ্রায়ন বা সামগ্রিকীকরণ সম্ভব নয়। লিওতার মনে করেন যে উত্তরাধুনিক যুক্তি হলো প্রকৃতপক্ষে ধ্রুপদী বা আধুনিক যুক্তিবিগ্রহের বিপর্যস্ত রূপ যা মূলতঃ ইঙ্গিত করে প্রাকৃতিক তথা যৌক্তিক বাক্যতত্ত্বের বিপর্যয়’কে। বাহ্যত দেখলে মনে হতে পারে যে উত্তরাধুনিকতা যুক্তি’কে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে; কিন্তু এই বচন সত্য নয়। কারণ উত্তরাধুনিকতা যুক্তির অবয়ব’কে সম্পূর্ণ পরিবর্জন না করে, যুক্তিকে এক প্রকারের অসরলীকৃত বা অবিজারীয় বহুত্বের (irreducible plurality) আঙ্গিকে বিপরীতায়িত (‘invert’) [৭] করে থাকে যার দরুণ উত্তরাধুনিকতা তার যৌক্তিক সীমার অভ্যন্তরে উপ-যৌক্তিকতা’কে ঠাঁই দিতে পারে। এইভাবে বলা যেতে পারে যে উত্তরাধুনিক যুক্তি হলো প্রকৃতপক্ষেই সেই বহুত্ববাদিতার যুক্তিক্রম, সেই অনির্ণনীয়তা’র ও অনির্দেশ্যতার যুক্তিক্রম যা ধ্রুপদী যুক্তিপটে সমসম্ভাব্যতা (randomness), অসমাঙ্গতা (irregularities), সীমাহীনতা (boundlessness) ও বিধিবিহীনতার (formlessness) আঙ্গিকে এক প্রকারের পটপরিবর্ত্তন’কে সূচিত করতে পারে। বস্তুতপক্ষে যুক্তিপটে এইরূপ পটপরিবর্তন-এর মধ্য দিয়ে লিওতার যা সুনিশ্চিৎ করেন তা হলো জ্ঞানের এক প্রকারের অজ্ঞেয়বাদী (agonistic) রূপ বা মাত্রা যা ভাষা-খেলার তত্ত্ববিগ্রহটিকে এক প্রকারের অজ্ঞেয়বাদী প্রয়োগে (agonistic pragmatics) পর্যবসিত করে।

বৈধতার নির্ণায়ক হিসেবে উপ-যৌক্তিকতা

এই অনুচ্ছেদে আমরা আসবো সেই প্রতর্কে যেখানে লিওতার উপ-যুক্তিবাদ’কে এক নতুন বিজ্ঞানের পরিচায়ক হিসেবে তুলে ধরেন। যার ভিত কোনো প্রকারের সর্বজনাত্মক (universalistic) সচেতন ঐক্যমত্য (consensus) নিরূপণে নেই; বরং রয়েছে তারতম্য ও ভিন্নতা অণ্বেষণকারী এক প্রকারের মতানৈক্য-এর পরিস্থাপনের মধ্যে। কিন্তু উপ-যুক্তিবাদিতার এই দুই রূপ — মতানৈক্য-অণ্বেষণকারী (dissension-seeking) রূপ এবং বিরুদ্ধ-বিগ্রহ ধারণকারী রূপের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক’টি ঠিক কীরকম? যদি আমরা বিজ্ঞানের এই মতানৈক্য অণ্বেষণকারী তথা ভিন্নতা-অণ্বেষণকারী বৈশিষ্ট্যটির প্রতি মনোনিবেশ করি, তাহলে যে উদাহরণটি আমাদের বি-জ্ঞানচক্ষুতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেটি বিশেষভাবে হলো চিত্তভ্রংশী মননের বিজ্ঞান ও তার দর্শন। শাদা চোখে যেটি আমাদের কাছে স্পষ্ট সেটি হলো চিত্তভ্রংশী মনের বোধবিজ্ঞান সর্বদা ইতোমধ্যেই নিহিত থাকে এক ধরনের ‘বহুত্ত্বের বিচার’-বিবেচনার (justice of multiplicities) মধ্যে বা বলা ভালো বিষয়ী-তন্ত্রের বিধ্বংসিতা বা বিখণ্ডনের মধ্যে যা চিত্তভ্রংশী মননের কার্যকারণ-এর আলোচনা’কে এক প্রকারের আধুনিকোত্তর বিজ্ঞানে পর্যবসিত করে।

এখন প্রশ্ন হলো চিত্তভ্রংশী মননের এই বিরুদ্ধ যুক্তিপট বোঝবার জন্য স্বভাবতই এক প্রকারের বিরুদ্ধ-পদ্ধতি প্রয়োজন যা বিরুদ্ধ-বিগ্রহের ধারণাটিকে স্পষ্ট করতে পারে। এই বিরুদ্ধ-পদ্ধতি আসলে কেমন? উত্তর হলো এই যে এটি সেই বিরুদ্ধ-পদ্ধতিতন্ত্র যা এক প্রকারের পদ্ধতিতান্ত্রিক বিরুদ্ধতার বা পদ্ধতিতান্ত্রিক অজ্ঞেয়বাদিতার কথা বলে, যা বিরুদ্ধ-পদ্ধতির প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে এমন এক ধরনের ভাষা-খেলার ধারণাকে পুষ্ট করে যা এতটাই সামঞ্জস্যহীন যে সেখানে ভাষা-খেলা সংগঠনকারী বা উৎপাদনকারী উপাদানগুলির মধ্যে আর কোনো সামঞ্জস্যকারী একক থাকে না। বিরুদ্ধ-পদ্ধতি এখানে একভাবে দেখলে একই সঙ্গে বিরুদ্ধ-আচরণ, বিরুদ্ধ-জীবন, বিরুদ্ধ-নিয়ম, বিরুদ্ধ-শৃঙ্খলা, বিরুদ্ধ-যুক্তি এবং তদুপরি বিরুদ্ধ-বিগ্রহের পরিচায়ক হয়ে ওঠে। উত্তরাধুনিক আধিবিদ্যক, বা উত্তর-আধিবিদ্যক, দর্শন থেকে দেখলে বিরুদ্ধ-পদ্ধতির এই ‘ব্যতিক্রমী তত্ত্বযন্ত্র’ (‘bizarre machinery’) আসলে আমাদের এক প্রকারের উৎপত্তিতত্ত্ব-এর দিকে নিয়ে যায় যার কাজ কোনো উৎসানুসন্ধান নয়; বরং চিন্তন, মনন, প্রতর্ক ও বিষয়ীর ইতিহাসে যে ‘ছেদ’ বা অনবচ্ছিন্নতা রয়েছে, তাকে অনুধাবন করা। তাই উৎসাভিমুখী যাত্রা বা অনুসন্ধান’কে পরিবর্জন করা আসলে হলো অবিচ্ছিন্নতা বা নিরবচ্ছিন্নতার একমাত্রিক পূর্ণতা বা সমগ্রতা’কে পরিবর্জন করা — যা আসলে সেই তত্ত্ব-কার্যের উপলব্ধি নিয়ে আসে যা আমদের দেখতে শেখায় কী করে একজন বিষয়ী এং তার ইতিহাস ক্রমশ নির্মিত এবং পুনর্নিমিত হয়ে থাকে ক্ষমতা-জ্ঞান (power-knowledge)-এর আন্তঃসম্পর্কের সংশ্লেষণ এর মধ্য দিয়ে। এইখানে আমাদের তত্ত্বাভিলাস একভাবে ফুকোবাদী উৎপত্তিতত্বে প্রবেশ করে ফেলে; কিন্তু আমরা এই প্রবন্ধে ফুকো-মার্গী হবো না; বরং আমরা লিওতার’কে অনুসরণ করব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আমরা এটা বলছি না যে লিওতার ও ফুকোর তন্ত্র-যন্ত্রের মধ্যে কোনোরূপ ভিন্নতা নেই। ভিন্নতা আছে। তাঁদের মধ্যে এক ধরনের বিষমসত্তীয় ভিন্নতা বা বহুরূপিতা আছে। আবার উত্তর-আধিবিদ্যক (post-metaphysical) ভাব-বিগ্রহ অনুযায়ী এই দুই দার্শনিকের চিন্তা-প্রস্থানে এক প্রকারের সমরূপিতাও আছে। এবং তা আছে কারণ দুজনেই দুটি ভিন্ন পদ্ধতিতে প্রাতর্কিক ভাষা-খেলা’কে বুঝতে গিয়ে তাঁদের দর্শনচিন্তায় অনবচ্ছিন্নতা’কে তত্ত্বায়িত করার চেষ্টা করেছেন। লিওতার-এর তত্বে যে অনবচ্ছিন্নতার ধারণা আমাদের ভাষা-খেলার মধ্যেকার সামঞ্জস্যহীনতা ও অ-মীমাংসা’কে বুঝতে সাহায্য করে; ফুকোবাদী প্রত্নোৎপত্তিতত্বে সেই অনবচ্ছিন্নতা আমাদের জ্ঞানের অনবচ্ছিন্ন সামাজিক নির্মাণ অনুধাবনের দিকে নিয়ে যায় যা সমসত্তীয় সমগ্রায়ন-এর আধিপত্যবাদিতা অগ্রাহ্য করে। তাই এই মর্মে আসা যাক সেই আলোচনায় যার দ্বারা আমরা অনুধাবন করতে পারব লিওতার কী করে প্রতর্ক ও তদুপরি ভাষা’কে বোঝার চেষ্টা করেছেন। প্রথমেই বলা ভালো লিওতার ভাষা ও প্রতর্ক’কে কোনোভাবেই এক প্রকারের পূর্ণ, সমগ্র এককত্বের যুক্তি দিয়ে ভাবেন নি; তিনি ‘logic of the whole and the one’-এর যুক্তি’কে বর্জন করেছিলেন। ‘দ্য পোস্টমডার্ন কণ্ডিশন’-এ, লিওতার বলেছেন — ‘We have paid a high price for the nostalgia of the whole and the one… Let us wage a war on totality; let us be witnesses to the unpresentable; let us activate the differences.’ অর্থাৎ, লিওতার তাঁর উত্তরাধুনিক দর্শনচিন্তায় সামগ্রিকতা বা সমগ্রায়নের (totalization) বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আবেদন রেখেছেন। লিওতার এর মতে প্রতর্ক বা প্রাতর্কিক ভাষা-খেলা নির্দেশ করে চেতনার সেই প্রতিরূপায়ন বা উপস্থাপনা’র শর্ত’কে যা এক প্রকারের যৌক্তিক শৃঙ্খলা বা প্রত্যয়গত পরিকাঠামো দ্বারা সৃজিত; সেই চেতনা যা আত্মপ্রকাশ করে এক ধরনের আলংকারিক বিরুদ্ধ-বিগ্রহ নির্মাণের মধ্য দিয়ে। তাই প্রাতর্কিক —, লিওতার-এর চিন্তনে, যুক্তি (rationality), জ্ঞান (cognition), চিহ্নায়ন (signification) ও তন্ত্রায়ন (systematization)-এর সঙ্গে বিজড়িত; এবং আলংকারিক (figural) নির্দেশ করে সেই অব্যক্ত (unspeakable), অ-কহতব্য ‘অপর’কে যা প্রতর্কের মধ্যে থেকে প্রতর্কের বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে; প্রতিরূপবাদী উপস্থাপনার (representationalist presentation) সকল যুক্তিবিগ্রহের (logical model) অনির্মাণের (unmaking) মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য এটাই যে প্রাতর্কিক (discursive) ও আলংকারিক (figural), সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যহীন থেকে, একে অপর’এর মধ্যে কোনো প্রকার দ্বিত্বে (duality) অবস্থান করে না; বরং তারা পরস্পর পরস্পর’কে নিয়ত নির্মাণ করে চলে। যার দরুণ প্রতর্ক-এর অবয়বে হয়তোবা কোনো ক্ষয়-লয় (wound) ঘনিয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত এই ভিন্নতা প্রতর্ক’কে, বা প্রাতর্কিক বলতে আমরা যা বুঝি তাকে, এক প্রকারের আত্যন্তিক বিষমসত্ততার (radical heterogeneity) প্রতি নিয়ে যায়, সকল প্রকার ধ্রুপদী প্রতিরূপবাদিতার (classical representationalism) আধিপত্য’কে ভেঙে দিয়ে। এই প্রবন্ধে তাই আমাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি হলো এই যে চিত্তভ্রংশ, বা চিত্ত যা ভ্রমের অংশবিশেষ, তাকে বুঝতে গেলে আমাদের সকল প্রকার ধ্রুপদী বা আধুনিক মহাসন্দর্ভ’গুলিকে (classical/modern metanarratives) প্রথমে চিনতে হবে, এবং অতঃপর তাকে পরিবর্জন করতে হবে। বোধবিজ্ঞানের দরবারে বা মনোবিজ্ঞানের দরবারে এই সকল মহাসন্দর্ভগুলি হলো সেই সব মহাসন্দর্ভ যা পরিগণনাত্মক প্রতিরূপবাদী প্রকল্পের উপর আস্থা রেখে একভাবে জ্ঞানতত্ত্বের সমগ্রায়নের কথা বলে। তাই আমরা বলার চেষ্টা করছি এই যে চিত্তভ্রংশ’র নিদানতত্ত্ব’কে (aetiology) বোঝবার জন্য আমাদের সকল প্রকার ধ্রুপদী/আধুনিক যুক্তি, বিষয়িতা, উপস্থাপনা, জ্ঞানতত্ব এবং তদুপরি ধ্রুপদী আধিবিদ্যক ভিত্তি ও ধারণা থেকে সরে এসে, চিত্তভ্রংশ’কে বুঝতে হবে এক প্রকারের ‘সাংস্কৃতিক রূপক’ হিসেবে। তাই উত্তর-শিল্পবিপ্লবকালীন সময়ে ও সমাজে চিত্তভ্রংশ, মানববিজ্ঞানে আর সেইভাবে বৈকল্য বা ব্যত্যয় হিসেবে চিহ্নিত না হয়ে, নব্যপরিচিতি লাভ করে যায় মনোবিজ্ঞানের সমাজতত্ত্বায়নের মধ্য দিয়ে; এক প্রকারের ‘সাংস্কৃতিক জীবনাচরণ’ হিসেবে বোধগম্য হবার মধ্য দিয়ে। যা আমাদের ‘চিত্তভ্রংশী বাতুলতা’ নামক ‘মনোরোগ’টিকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। এবং এখানেই উত্তরাধুনিক ভাষা’কে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য জন্ম নেয় ‘Trans-Avant-gardism’-এর ধারণা।

তাই এখন আসি লিওতারীয় উপ-যুক্তি, ‘Trans-Avant-gardism’ এবং কান্টীয় অনুপস্থাপনীয়তার পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণে।

উপ-যুক্তি, ‘ট্রান্স-আভাঁগার্দিসম’ এবং অনুপস্থাপনীয়তা

এক কথায় বললে উত্তরাধুনিক ভাষা হলো ‘Avant-gardism’-এর ভাষা যেখানে ‘আভাঁ-গার্দ’ কে বোঝার জন্য বোধ হয়, সেভাবে কোনো সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ নেই। তাই যা কিছু প্রথাবিরুদ্ধ, পরীক্ষামূলক, অপ্রচলিত, বৈকল্পিক ও ভিন্ন তাকেই ‘আভাঁগার্দ’ বলা চলে। এক কথায় বিজ্ঞানে, সাহিত্যে, কবিতায়, সংগীতে যা কিছু ‘Avant-gardist’, তা অবশ্যই ‘unconventional’। আমরা আসব সেই ‘Trans-Avant-gardist’ সূত্র’তে যা সকল অনুপস্থাপনীয়তার অনিশ্চিৎ প্রতিরূপায়ণ’কে খানিকটা নিশ্চিৎ করে; কিন্তু তার আগে ব্যাখ্যা করে নেওয়া ভালো, ‘ক্ষণস্থায়ী, বিলীয়মান, অনিয়ত’ [‘modernity is the transient, the fleeting, the contingent’] এই আধুনিকতার প্রেক্ষিতে ‘আভাঁ-গার্দিস্ট’ প্রকৃতপক্ষে কারা? যদিও বিজ্ঞান থেকে এই প্রতর্ক-এর খানিক সরণ ঘটে যায় সাহিত্যতত্ব ও কবিতার দুনিয়ায়, ‘স্থানচ্যুত বিষয়িতা’ বা ‘displaced subjectivities’ ব্যাখ্যার্থে। তথাপি এই বোদলেরীয় (উত্তর)আধুনিকতার জ্ঞান আবশ্যিক; — চিত্তভ্রংশী বিষয়িতার ভ্রমার্ত অন্তর্মনোজগৎ-কে অনুধাবনের জন্য। চিত্তভ্রংশী মনের স্থানচ্যুত বা বিকেন্দ্রায়িত বিষয়িতা, যা কেন্দ্র থেকে চ্যুত, অর্থাৎ, ‘displaced’ বা ‘decentered’, তা একটু খেয়াল করলে আমরা বোদলেরীয় ফ্ল্যানোর-এর প্রত্যয়গত বিষয়িতার স্থানচ্যুতি বা কেন্দ্রচ্যুতির মধ্য দিয়ে টের পাই। ফরাসী কবি শার্ল বোদলের তাঁর ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রচিত প্রবন্ধঃ ‘দ্য পেইন্টার অফ মডার্ন লাইফ’ (‘The painter of Modern Life and Other Essays’)-এ লেখেন ফ্ল্যানোর-এর কথা; ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া, অপস্রিয়মান সত্তাভিজ্ঞতার উপস্থাপন-অযোগ্যতার কথা। বোদলের লিখছেন —

The crowd is his [Flâneur’s] domain, just as the air is the bird’s, and water that of the fish. His passion and profession is to merge with the crowd. For the perfect idler, for the passionate observer it becomes an immense source of enjoyment to establish his dwelling in the throng, in the ebb and flow, the bustle, the fleeting and the infinite. To be away from home and yet to feel at home anywhere; to see the world; to be at the centre of the world and yet to be unseen by the world, such are some of the minor pleasures of those independent, intense and impartial spirits, who do not lend themselves easily to linguistic definitions.[৮] 

সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক প্রদীপ বসুর লেখা প্রবন্ধ — ‘কে আধুনিক? আধুনিকতাই বা কী? শার্ল বোদলের ও মিশেল ফুকো’ থেকে উত্তরাধুনিকায়নকারী এই ‘স্থানচ্যুত বিষয়িতা’ বা ‘বিকেন্দ্রায়িত বিষয়িতা’র ধারণা পাই ফ্ল্যানোর’কে বোঝবার মধ্য দিয়ে। আমাদের এই প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য নতুনত্ব এখানেই যে আমরা চিত্তভ্রংশী বিষয়িতার, বিলীয়মান আধুনিকতায়, অপসৃত আন্তর্মনোজাগতিক স্থানচ্যুতি’কে বোঝবার চেষ্টা করছি ‘Trans-avant-gardist’ বোদলেরীয় বিষয়িতা ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে। বোদলেরীয় ‘schizoid’ বিষয়িতা, কাব্যতাত্ত্বিক দিক থেকে সেই ফ্ল্যানোরের তাত্ত্বিক গাঠনিকতার প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করে যে ভিড়ের মধ্যে অলস ভ্রমণরত; যেমন করে জল, মাছের পরিসর; বাতাস, পাখির পরিসর; ঠিক তেমনি করেই এই সম্পূর্ণ জগৎ ও তার জনভিড়, হলো ফ্যানোর-এর পরিসর। ফ্যানোর রূপী মনের এই জনতার ভিড়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া আসলে, প্রদীপ বসু লিখেছেন, জনসমষ্টির হৃদয়ে নিজের গৃহসৃজনের মতোই এক প্রকারের নির্মাণ প্রক্রিয়া যেখানে ফ্ল্যানোর ‘বিচরণ করে গতিময়তার জোয়ারভাটার মধ্যে, বিলীয়মান ও অসীমের মাঝখানে’। এই ফ্ল্যানোর বা ফ্ল্যানোর রূপী ‘schizoid’ মন নিজের গৃহের বাইরে থেকেও এক প্রকারের গৃহসৃজনের মধ্যে নিয়ত থাকে; জগতের কেন্দ্রে থেকে এক প্রকারের কেন্দ্রচ্যুতির উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে প্রতিভাত বা প্রতিরূপায়িত হয়ে থাকে; এ এমন এক প্রতিরূপায়ণ যা উপস্থাপন অযোগ্য; এ এমন এক বিষয়িতা যেখানে ‘সাবজেক্ট [অর্থাৎ, বিষয়ী] নৈর্ব্যক্তিক, প্রতিসারক (refractory), যার কোনো অভ্যন্তর নেই, এই সাবজেক্টের ভিতরটাই বাহির।’ [৯]  আমাদের বক্তব্য এটা্‌ই, যে এই বোদলেরীয় আধুনিকোত্তর ‘schizoid’ বিষয়িতার, অতিপ্রতিবর্তী  (hyperreflexive), কূটাভাসী (paradoxical) সত্তাভিজ্ঞতা’কে, কখনোই কার্টেসীয় এবং নিউটোনীয় ‘নিশ্চয়াত্মক জ্ঞানের’ প্রতিরূপী নির্দেশ্যতার নিরিখে বোঝা যাবে না। কারণ (বোদলেরীয়) ‘schizoid’ বিষয়িতায়, ব্যক্তি কখনোই তাঁর নিজের সত্তায় থাকেন না। প্রদীপ বসু লিখেছেন, Walter Benjamin-কে উদ্ধৃত করে যে ‘বোদলের কখনোই তাঁর নিজের সত্তায় ছিলেন না।’ এই বোদলেরীয় স্থানচ্যুত, কেন্দ্রচ্যুত বিষয়িতা ব্যাখ্যার্থেই মিশেল ফুকো তাঁর আধুনিকতার আলোচনা প্রসঙ্গে বোদলেরীয় (উত্তর) আধুনিকতার ধারণা বা ‘বিষয়ীর কেন্দ্রচ্যুতি’র ধারণাকে ব্যক্ত করেছেন। 

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে আমরা এই প্রবন্ধে বোদলের’কে নিয়ে আমাদের আলোচনার পরিসর সাজাই নি। আমরা আলোচনা করছি লিওতার ও কান্ট নিয়ে।এতৎসত্ত্বেও বোদলেরীয় বিষয়িতা কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো এই প্রবন্ধের প্রতর্ক-এর পরিসর সৃজনের জন্য? কারণ য়ুরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে ফরাসী কবি বোদলের এবং জর্মন দার্শনিক কান্টের মধ্যেকার সন্নিধি বা সন্নিকর্ষ’কে প্রথম শব্দরূপ দিয়েছিলেন ফুকো। Patrick McHugh, তাঁর ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত প্রবন্ধ — ‘Dialectics, Subjectivity and Foucault’s Ethos of Modernity’-তে বলেছেন — 

The continuity between Kant and Baudelaire … that Foucault brings out and posits as the ethos of modernity, is not the focus on a transcendental subject, but on the historical subject or self, one that can transform, mature or produce itself […] Baudelaire’s analysis of the subject is thoroughly historical, and he conceives liberation as the transgression of the historical limits of subjectivity; but he remains consistent with Kant in that he seeks to establish new limits to subjectivity, a new identity, even if it is not a rationally produced, transcendental and necessary limit but a creative, historical and contingent limit. [১০]

অর্থাৎ কান্ট এবং বোদলের এর মধ্যে এই সন্নিধি, যা ফুকো প্রথম ‘What is Enlightenment?’ প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, ‘আধুনিকতার ভাবসত্তা’ (ethos of modernity) ব্যাখ্যার্থে, তা মূলত বোদলেরীয় বিষয়িতার ব্যাখ্যা। বোদলেরীয় মনোজগতে বিষয়ীর ধারণা কোনো অতিবর্তী বিষয়িতার সত্যের উপর নির্ভর করে না। বরং বোদলেরীয় বিষয়িতার বিশ্লেষণ সম্পূর্ণরূপে ঐতিহাসিক যেখানে বোদলের মুক্তিকে দেখেছিলেন বিষয়ীর ঐতিহাসিক সীমার অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে; কান্টীয় মনোজগত, বিষয়ীর অস্তিত্তের অতিবর্তী সীমার নিরূপণের প্রতি থাকলেও, বোদলেরীয় বিষয়িতা প্রতিফলিত হয়ে থেকেছে, বিষয়ীর [অন্তর্লীন] বিষয়ীগত সীমার অতিক্রমণের মধ্যে। যার ফলে বোদলেরীয় বিষয়িতার সীমা নিরূপণে এক নতুন ব্যক্তিসত্তা প্রস্তাবিত হয়েছে যা যুক্তি দ্বারা উৎপন্ন কোনো অতিবর্তী সীমার প্রত্যয় জ্ঞাপনের পরিবর্তে, বিষয়ীর সম্পর্কে আমাদের এক নতুন সীমার ধারণা দেয় যা ঐতিহাসিক অনিত্যতার ধারণার দ্বারা সৃজিত। সীমা বা ‘limits’-এর প্রতি এই মনোভাব, যাকে ফুকো ‘limit-attitude’ বলেছেন, আমাদের ফুকোর তত্ত্বে আধুনিক ভাবসত্তা’র চরিত্র’কে বুঝতে সাহায্য করে। কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের এই প্রবন্ধে আলোচিত লিওতার ও চিত্তভ্রংশী ব্যতিক্রম্যতার সম্পর্ক কী? এদের সম্পর্ক এখানেই যে ‘প্রতিবর্তিতার অতল গহ্বর’-এ তলিয়ে যাওয়া, খণ্ডাশ্রয়ী বিষয়ীর, বিষয়ীগত সীমা অতিক্রমণের যে তত্ব বোদলের দিয়েছেন, সেটাই প্রভাবিত ছিলো কান্টীয় ‘I-disorders’-এর ধারণার দ্বারা যাকে কান্ট, ‘Ichstörungen’ [১১] বলেছেন যা খানিকটা আরও ভেঙেচুরে ফুকোবাদী দৈশীকরণে, ‘কেন্দ্রচ্যুত বিষয়িতা’ বা লিওতারীয় ‘ruins of subject-systems’-এর মধ্য দিয়ে ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। একটা-দুটো উদাহরণ দিলে এই ‘I-disorders’ সম্পর্কে খানিকটা ধারণা দেওয়া যেতে পারে। যেমন, কেউ যদি বলে— (১) “My thoughts are not thought by me. They are thought by somebody else.” [“আমার চিন্তারা আমার নয়। তাদের অন্য কেউ ভাবছে।”]; (২) “Time has disappeared. Not that it is longer or shorter, it’s just not there; there are bits and pieces of time, shaken and mingled; often there is no time at all.” [“সময় অদৃশ্য হয়ে গেছে। বক্তব্য এটা নয় যে সময় প্রলম্বিত না বিলম্বিত; বক্তব্য হচ্ছে সময় সেখানে নেই; শুধু পড়ে আছে সময়ের কিছু প্রকম্পিত, দলা পাকানো খণ্ড; প্রায়শই মনে হয় যে সময় বলে কিছু নেই।”] এইরকম বাক্য বা বচনাংশগুলি যারপরনাই এক ধরনের ‘আমিত্ত্বহীনতা’  (loss of self) বা ‘আমিত্ব-বিলোপ’ (destruction of self)-এর কথা বলে যেখানে ‘temporal continuity of self’ বা মানবমনের যৌক্তিক আত্মার কালিক নিরবচ্ছিন্নতার মানদণ্ডটি বিধ্বস্ত।

আলোচিত অনুচ্ছেদে এই ‘I-disorder’-এর সাধারণ অভিজ্ঞতাকে আমরা ‘sublime experience’ বলতে পারি যার কোনো উপস্থাপনা বা প্রতিরূপায়ণ সম্ভব নয়। এই মর্মেই আমরা ‘I-disorder’ বা আত্ম-বিকলন সম্পর্কিত পর্যালোচনার পর আবারো আসবো, উপ-যৌক্তিকতা এবং ‘sublimity’ বা অনুপস্থাপনীয়তার পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণ প্রসঙ্গে। এমন কথিত আছে যে লিওতারীয় উপ-যৌক্তিক নির্ঘোষণা আসলে কান্টীয় অনুপস্থাপনীয়তার বর্ণনা যাকে কান্ট ও লিওতার দুজনেই ‘sublime’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। বরং বলা ভালো উপ-যুক্তি কান্টীয় ‘sublime’-এর সেই তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক প্রকাশ বা সম্প্রসারণ যার কোনো প্রতিরূপ নেই অথবা যা প্রদর্শন বা উপস্থাপনার অতীত।আসলে ‘সাবলাইম’ হলো সেই প্রত্যয় বা আত্ম-অভিজ্ঞতা যা ‘উপস্থাপনকারী অনুষদ’-এর ব্যর্থতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। তাই উত্তর-আধুনিক, উত্তর-গঠনবাদী উপ-যৌক্তিকতার ভিত আসলে সেই ‘বিলোপপ্রবণতার সংকট’ (‘crisis of obsolescence’)-এর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে যা থাকে ‘logic of avant-gardism’-এর কেন্দ্রে। এই যুক্তিবিগ্রহে সাহিত্য, বিজ্ঞান বা কবিতার কোনো ধারা বা প্রথা কোনোভাবে বিলোপ এর পথে এগিয়ে যায়। একভাবে দেখলে ‘আভাঁ-গার্দিসম’ বিজ্ঞান, সাহিত্য ও কাব্যদর্শনে, এক ধরনের বিরুদ্ধ-সংস্কৃতি’র কথা বলে যা উপস্থাপনা বা প্রতিরূপায়ণের নিয়মের বাইরে।গভীরভাবে ভাবলে, লিওতার কান্টীয় ‘sublime’-কে যেমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা এক ধরনের রূপান্তরণের কথা বলে। এই রূপান্তরণ আসলে হলো কান্টের, জ্ঞানতত্ত্বীয় এবং নৃকেন্দ্রিক, নরত্বারোপিত অনুপস্থাপনীয়তার সঙ্গে, লিওতারীয় সত্তাতাত্ত্বিক তথা সামাজিক অনুপস্থাপনীয়তার ভেদ।কান্ট বিশষত মানবমন’কে বুঝেছিলেন ‘epistemological aporia’-এর ধারণার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ, মানবমনের এক ধরনের জ্ঞানতত্ত্বীয় অনুপস্থাপনীয়তা’র দিক আছে যা ‘অ্যাপোরেটিক’। এই ‘aporia’ হলো জ্ঞানতাত্তিকগত দিক থেকে সেই সব অভ্যন্তরীণ অনির্ণনীয় সমাধান-অসাধ্য স্ববিরোধ যার কোনো উপস্থাপনা নেই।কিন্তু এখানে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে যে বোধ বিজ্ঞান-এ কখন এই কান্টীয় সাবলাইম-এর ধারণা মুখ্য হয়ে ওঠে? উত্তর হচ্ছে তখন, যখন বোধ বিজ্ঞান, এক উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বে পর্যবসিত হয়; যখন আমরা স্বীকার করি যে, বোধীয় ক্যাটিগরি বা বর্গগুলি সর্বদা ইতোমধ্যেই উপ-যৌক্তিক এবং যখন আমাদের মনোজাগতিক যুক্তি এবং বোধীয় চিন্তন, উপ-যৌক্তিক উত্তর-গঠনবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে আদ্যন্তই হয়ে ওঠে ‘tautegorical’ বা চক্রবৃত্তীয় (circular) দ্বিরুক্তি-দুষ্ট স্বতঃসত্য বর্গ বা বক্তব্য। উল্লেখ্য যে এই বৃত্তীয় স্বতঃসত্যতা উপ-যৌক্তিক তন্ত্রটিকে ‘তুচ্ছ’ করে দেয় না; বরং যুক্তিতন্ত্রটির উপর আরোপ করে এক ধরনের ‘nominalist’ বিশেষত্ব।

এখন যদি আমরা স্বীকার করি, যে দৃষ্টবাদী দর্শন, একভাবে মনস্তত্ব এবং বোধ বিজ্ঞান’কে, আচরণবাদী তথা পরীক্ষামূলক মনস্তত্ত্বের, অভিজ্ঞতানির্ভর পরখযোগ্যতার (empirical verifiability) ধারণার দ্বারা সীমায়িত করে, একমাত্র তখনই আমরা বোধ বিজ্ঞানের, জ্ঞানতত্ত্বীয় গঠনের উত্তরাধুনিকায়ন করার কথা ভাবব। নচেৎ, নয়। তাই আবারো উল্লেখ্য যে এই প্রবন্ধে আমরা দেখিয়েছি যে বোধ বিজ্ঞানের উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বায়ন নির্ভর করে এই প্রবন্ধে আলোচিত উপ-যুক্তি’র উপর যার যুক্তিবিগ্রহ আমাদের কান্টীয় ‘sublime’-কে মনে করিয়ে দেয়। উল্লেখ্য যে এই কান্টীয় ‘সাবলাইম’(sublime)-এর নন্দনতত্ব এবং লিওতারীর উপ-যুক্তিবাদ উভয়েই চিহ্নিত করে সেই ‘অনির্দেশ্যতার সূত্র’ বা নিয়ম’কে যাকে, আমরা আমেরিকান সাহিত্যতাত্ত্বিক Ihab Hassan-কে অনুসরণ করে, বলতে পারি প্রাতর্কিক নির্মাণের ‘অনির্দেশ্য বিশ্বনিহিতি’ বা ‘indeterminate immanence’ [১২]-এর নিয়ম। তাই উত্তর-আধুনিকতার চিন্তাপ্রস্থান থেকে মানবমন’কে চরিত্রায়িত করতে হলে বুঝতে হবে প্রাতর্কিক নির্মাণ রূপী মানবমনের অনির্দেশ্য পরিব্যাপ্তি। বোধীয় চিন্তনে এই ‘sublime’-এর ধারণা, বা চিন্তার এই অনুপস্থাপনীয়তা নির্মাণ করে বা নির্দেশ করে সেই ‘অনির্দেশ্যতম অলংকার প্রতিমার’ প্রতি, যার সত্যিই কোনো ‘প্রতিম’ নেই বা যা তুলনারহিত। অলংকারায়ণ-অযোগ্য এই অলংকার’কে আমাদের অভিজ্ঞতানির্ভর সংবেদনে নিয়ে আসতে গেলে, প্রাতর্কিক অনুপস্থাপনীয়তা’র নিরিখে আমাদের বুঝে নিতে হবে মানবমন-এর সেই জ্ঞানতত্ত্বীয় গঠন’কে যা সম্পূর্ণ এক ‘অন্য (মনো)জগৎ’-এর কথা বলে। এ এমন এক জগৎ যার উপস্থাপনা বা প্রতিরূপায়ণ পাওয়া যেতে পারে একমাত্র প্যল চেলান-এর কাব্যতাত্ত্বিক রূপকায়ণের মধ্যে কিংবা চিত্রশিল্পী প্যল ক্লী-এর ছবি’তে — যাকে উত্তর-আধুনিকতার ইতিহাসে ‘Nebenwelt’-এর রূপক দিয়ে বোঝানো হয়েছে, যার আক্ষরিক অর্থই হলো ‘অন্য (অতিবর্তী) জগৎ’।

এই পর্যন্ত এটুকু বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে ‘sublime’-নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। তার প্রধান কারণ এই যে ‘sublime’ শব্দটির কোনো বাংলা প্রতিশব্দ হয় না। এক অর্থে সাবলাইম হলো, বা সাবলাইম-এর অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা হলো, আমাদের সংবেদজ স্বজ্ঞা (sensory intuition) অতিবর্তী সেই মনোজগৎ যার কোনো চিহ্নতাত্ত্বিক উপস্থাপনা নেই; অন্যদিকে সাবলাইম-এর অভিজ্ঞতা, বা ‘experience of sublime’ হলো, সেই কূটাভাসী অভিজ্ঞতা (paradoxical experience) যা একই সঙ্গে একভাবে এক ধরনের উপহত সমাচ্ছন্নতা (overwhelming-ness), এবং অন্যভাবে এক ধরনের সমোন্নতির (exaltation) দ্যোতক, যাকে অনুধাবন করা যায় একমাত্র স্ব-প্রতিবর্ততার অতলান্তিক অতিবর্তী গহ্বরে প্রবেশের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ সাবলাইম-এর অতলভেদী ব্যঞ্জনা একভাবে বলতে গেলে বেদনাবিধুরতা (pain) এবং আনন্দমধুরতার (pleasures) এক বিমিশ্র কূটাভাস যাকে যুক্তিবিজ্ঞানে ধরা যায় না। উল্লেখ্য যে ‘সাবলাইম’ এবং ‘প্যারালজি’; অর্থাৎ, সাবলাইম এবং উপ-যুক্তিবাদ এই দুইই একভাবে উপস্থাপন-অযোগ্যতার কথা বলে কারণ ধ্রুপদী যুক্তির এবং ধ্রুপদী জ্ঞানতত্ত্বের সর্বজনাত্মকতা (universality) দিয়ে এদের প্রয়োগ’কে ধরা যায় না। এখানে লক্ষ্যণীয় এক সবিশেষ দ্বন্দ্ব-এর পূর্বাভাস। এই দ্বন্দ্ব ‘সেইড’ আর ‘শোন’-এর মধ্যে। হ্বিটগেনস্টাইনীয় দর্শন-ভাবনার সম্যক পর্যালোচনা করে অধ্যাপক শেফালী মৈত্র তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থঃ ‘হ্বিটগেনস্টাইনঃ জগৎ, ভাষা ও চিন্তন’-এ দেখিয়েছেন যে এই ‘সেইড’ বা বাচ্যের কোটি এবং ‘শোন’ বা অনির্বাচ্যের কোটি এক অপরের মধ্যে এক প্রকারের বিপরীত পরিপূরকতা দ্বারা সূচিত হয়ে থাকে। যা বলা যায়, অর্থাৎ যা ‘সেইড’, তা বাচ্যের কোটিতে অবস্থিত। এবং যা দেখানো যায়, অর্থাৎ যা ‘শোন’, তা অনির্বাচ্য; অর্থাৎ ‘ভাষা-অন্তর্গত অনির্বাচ্য’ কারণ তা বচনে প্রকাশ করা যায় না। আমরা এই প্রবন্ধে ‘সাবলাইম অবজেক্ট’ বা অনুপস্থাপনীয় বস্তুকূট-এর কূটাভাস’কে ভাষিক বচনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করার প্রয়াস করেছি। কিন্তু সম্ভবতঃ প্রতিবর্ততার অতল অতিবর্তী গহ্বর থেকে উদ্ধার করে, ‘সাবলাইম’-কে ভাষার সীমানার অভ্যন্তরে নিয়ে আসার চেষ্টা শেষমেষ ব্যর্থই হবে। কারণ বিজ্ঞানগ্রাহ্য বাচ্যের কোটি এবং ‘ভাষার সীমার বাইরে’ থাকা রহস্যের কোটির (mystical focus) মধ্যবর্তী কোনো অবস্থানে নৈশব্দ্যে নিমজ্জিত রয়েছে, এই অনুপস্থাপনীয়তার বস্তুকূট বা ‘sublime object’। কারণ সাবলাইম সেটাই যা দেখানোও যায় না, আবার কোনো উপস্থাপনার মাধ্যমে বাচ্যেও প্রকাশ করা যায় না। আমরা বলতে পারি, — ‘sublime is that which can neither be shown nor be re-presented in terms of propositions.’ কিন্তু তাহলেও একটা প্রশ্ন থেকে যায় আর সেটা হলো এই যে ‘sublime’-এর ভাষিক প্রকাশ কোনো ‘অবভাসবিষয়ক ভাষা’র মাধ্যমে হয়ে থাকে কিনা? আরও গভীরভাবে ভাবলে, ‘সাবলাইম’ এর ভাষিক প্রকাশ, ‘দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ব্যাবহারিক পদার্থবিষয়ক ভাষার ভিত্তি’ থেকে কীরূপে আলাদা? ‘সাবলাইম অবজেক্ট’ আসলে কী?

উত্তর হচ্ছে ‘সাবলাইম অবজেক্ট’ (sublime object) হলো সেই ভাষাতাত্ত্বিক তথা প্রাতর্কিক প্রকাশ যা কোনো ক্যালকুলাস-এর তোয়াক্কা করে না; সাবলাইম উপস্থাপিত হওয়ার ভাষা কোনো নির্দিষ্ট বাক্য গঠন বিধি বা ‘formation rules’ কিংবা কোনো অনুমান বিধি সংক্রান্ত ‘rules of inference’ অনুসরণ করে না; অর্থাৎ হ্বিটগেনস্টাইনীয় চিন্তাপ্রস্থান অনুসরণ করে বলা যায় যে না ইহা সত্য যে ‘sublime object’, ভাষা ও জগৎ-এর আন্তঃসম্পর্ক নিরূপণকারী একপ্রকারের অবভাসতত্ত্বীয় ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে জানা যায়, না ইহা মিথ্যা যে ‘সাবলাইম অবজেক্ট’-এর কোনো নির্দিষ্ট যৌক্তিক আকার নেই। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে সাবলাইম-এর উপস্থাপনা শেষে গিয়ে এক প্রকারেরে ‘অবিশুদ্ধ’ ভাষা-খেলা’তেই পর্যবসিত হয় যা সেই ভাষ্যকার-এর ‘যাপনের প্রেক্ষাপট’ বা যাপনের পরিমণ্ডল বিমুখ নয়। কিন্তু ভাষা-ক্রীড়া বা ভাষা-খেলা কী? কীভাবেই বা তৈরি হয় ভাষা-খেলার এই চিন্তন মডেল-এর অনির্দেশ্য বাগর্থতত্ব? সে বিষয়েও খানিকটা সম্যক আলোচনার প্রয়োজন আছে। অধ্যাপক রূপা বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘জগৎ, ভাষা ও চিন্তন’-নামক বইটির ‘হ্বিটগেনস্টাইন-এর বাগর্থতত্ত্বের বিবর্ত্তনঃ চিত্রতত্ব থেকে ভাষাক্রীড়া’ শীর্ষক লেখা থেকে ভাষা-ক্রীড়া বিষয়ে একটি পর্যবেক্ষণ আমরা উদ্ধৃত করতে পারি। অধ্যাপক রূপা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন —

‘ফিলসফিকাল রিমার্কস’-এ হ্বিটগেনস্টাইন সাধারণ ভাষাকে একপ্রকার ক্যালকুলাস রূপে গণ্য করলেও ‘ফিলসফিকাল গ্রামার’ রচনাকালে তিনি উপলব্ধি করেছেন যে সাধারণ ভাষার সঙ্গে যে কোনো ক্যালকুলাস-এর যত সাদৃশ্য আছে, ক্রীড়ার সঙ্গে তার থেকে অধিকতর সাদৃশ্য বিদ্যমান। কারণ যে কোনও ক্যালকুলাস-এ বাক্যগঠন এবং অনুমানের নির্দিষ্ট নিয়ম থাকলেও সাধারণ ভাষার ক্ষেত্রে প্রায়শই সেইরূপ কোনও নির্দিষ্ট বাক্য গঠেন বিধি(ফর্মেশন রুলস) বা অনুমানবিধি(রুলস অব ইনফারেন্স) থাকে না।[…] হ্বিটগেনস্টাইন […] প্রদর্শন করেছেন যে কোনো সাধারণ ভাষারই […] কোনও নির্দিষ্ট যৌক্তিক আকার থাকে না। [১৩]

এই মর্মে আমরা আবারো ফিরে আসব লিওতার-এ। লিওতার প্রকৃষ্টভাবে ‘সাবলাইম’ বোঝাতে চিন্তন ও ভাষার এই অতিবর্তী পরিসর-কেই ‘aesthetics of sublime’ বলেছেন। লিওতার ‘The Sublime and the Avant-Garde’-শীর্ষক প্রবন্ধে বলছেন — “সাবলাইম এর নন্দনতত্ব আরও অনির্দেশ্যঃ যেন সাবলাইম হলো একভাবে এক ধরনের আনন্দ মিশ্রিত কোনো বেদনা; যেন আনন্দের মাধুর্য উঠে আসছে বেদনার বিধুরতা থেকে। যেন বিশেষভাবে কোনো বৃহৎ বস্তু যেমন মরুভূমি, পর্বত বা পিরামিড কিংবা সর্বগ্রাসী ক্ষমতাসম্পন্ন এমন কিছু যেমন কোনো সামুদ্রিক ঝড় বা উদগীরিত লাভা — যাকে কোনো সংবেদজ স্বজ্ঞা ছাড়াই চিন্তায় ধরা যায়; এমন এক যুক্তিপট যার কোনো প্রতিরূপ নেই।” অর্থাৎ আমরা ধারণা করতে পারি যে, যে অর্থে সাবলাইম এক প্রকারের ‘নঞর্থক উপস্থাপনা’র মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয়, সেই একই অর্থে উপ-যুক্তি, ধ্রপদী দ্বিমানক যুক্তির বাইরে। আমরা বলতে পারি যে লিওতারীয় উপ-যুক্তি এবং কান্টীয় সাবলাইম-এর ধারণা, উভয়েই, একভাবে প্রতিরূপী-তন্ত্রায়ন-অযোগ্যতা’কে নির্দেশ করে। অর্থাৎ এমন এক যৌক্তিক তন্ত্র আমাদের কাছে উপস্থাপন করে যাকে কোনো প্রতিরূপী তন্ত্র দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। একেই কান্ট ও লিওতার দুজনেই ‘নঞর্থক উপস্থাপনা’ বা ‘negative presentation’ বলেছেন। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি যে লিওতারীয় উপ-যুক্তি এবং কান্টীয় অনুপস্থাপনীয়তা উভয়েই, হয় একভাবে একধরনের উপলব্ধিশূন্যতার, বা ‘শূন্যতার উপলব্ধি’র, (‘not grasping at all’) কথা বলে; অথবা, যা আপাতদৃষ্টিতে ‘অনুপলব্ধ’, তাকে এক প্রকারের স্ব-প্রতিবর্তী অন্তর্দৃষ্টি( self-reflexive inner vision) দিয়ে, উপলব্ধির জগতে নিয়ে আসার চেষ্টা করে; অর্থাৎ, ‘গ্র্যাস্পিং দ্য আন-গ্র্যাস্পেবল।’ সাবলাইম’কে বাচ্যে নিয়ে আসার এই প্রয়াস’কেই প্রকৃতপক্ষে লিওতার ‘দ্য ট্রান্স-আভাঁ-গার্দিস্ট ফর্মুলা’ — ‘presenting the un-presentable’ বলেছেন। তাই আমরা এটা বলার মধ্য দিয়ে এই পরিচ্ছেদ-এর ইতি টানতে পারি যে সাবলাইম হলো সেই নিরাকার (formless), সীমাহীন (limitless), বিধিহীন (normless) বস্তুকূট যার উপাদানগুলি একে অপরের মধ্যে, আমাদের সংবেদী স্বজ্ঞার (sensory intuition) অভ্যন্তরে, কোনো একত্ব-এর প্রতিস্থাপন না করে, আমাদের দেশ-কালের সীমানার বোধগম্যতাকে প্রশ্নের মুখে এনে ফেলে দেয়।

‘চিত্তভ্রংশী বাতুলতা’ এবং উপ-যুক্তি  

এটিই এই প্রবন্ধের শেষাংশ।এই পরিচ্ছেদে আমরা চিত্তভ্রংশী বাতুলতা এবং উপ-যৌক্তিকতার পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণে সমোদ্যত হব। ‘চিত্তভ্রংশ’ শব্দটির সমাসবিভাজন করলে আমরা পাই যে চিত্তভ্রংশী মন হলো সেই চিত্ত, বা মন, যা ভ্রম-এর অংশ। উল্লেখ্য যে বিজ্ঞান পরিভাষায় ভ্রম-এর ইংরেজি শব্দ হলো ‘delusion’। আবার ইংরেজিতে মনোরোগবিদ্যার পরিভাষায়, ‘চিত্তভ্রংশী বাতুলতা’ হলো ‘dementia praecox’ যাকে মনোচিকিৎসকরা ‘schizophrenia’ বলেছেন। যা জানা যায় তা হলো যে অষ্টাদশ শতাব্দীর খ্যাতনামা মনোচিকিৎসক এমিল ক্রেপেলিন ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে, তাঁর জর্মন গ্রন্থ- ‘Psychiatrie : Ein Lehrbuch fur Studierende und Aerzte’-এ, চিত্তভ্রংশী বাতুলতা বা ‘ডিমেনশিয়া প্রিকক্স’ এর তিনটি উপ-প্রকার [subtypes] শনাক্ত করেছিলেন এবং তারা হলোঃ ১) কিশোর নবযুবাদের ক্ষেত্রে প্রকট হওয়া — হেবিফ্রেনিয়া [hebephrenia]; ২) পেশীর অস্বভাবী অতিরিক্ত অর্থহীন অঙ্গসঞ্চালন যুক্ত, ক্যাটাটনিয়া [catatonia]; ৩) মানসিক দৌর্বল্যসূচক পীড়নভ্রান্তি সংক্রান্ত, ডিমেনশিয়া প্যারানইডেস [dementia paranoides]। এই ‘প্যারানয়া’ আবার হলো বদ্ধমূল ভ্রান্তিজনিত বিশৃঙ্খল মানসিক অবস্থা; এমন এক ভ্রম-বাতুলতা যা কোনো যুক্তি বা কার্য-কারণ সম্পর্ক দিয়ে নিরসন করা যায় না। পরবর্তীকালে এই রোগগুলিই স্কিজোফ্রেনিয়ার উপ-প্রকার হিসেবে চিকিৎসা পরিভাষায় পরিচিত হয়। স্পষ্ট যে ‘dementia praecox’ বা ‘schizophrenia’ উভয়ক্ষেত্রেই আলোচ্য হলো — ‘ভ্রম’। সমুচিত প্রশ্ন এখানে হলোঃ ‘ভ্রম জ্ঞানের স্বরূপ কি?’ ন্যায়বৈশেষিকদর্শন-এর সত্যানুসন্ধান প্রক্রিয়ায় এই ‘ভ্রম’ সংশয়জনিত ‘অবিদ্যা’ থেকে জন্ম নেয়। এখানে অবিদ্যা সেটাই যা ‘সাধারণভাবে অসন্দিগ্ধ ও অবাধিত (uncontradicted) জ্ঞান’ [১৪]-এর বিরুদ্ধে বা বিপরীতে। ভ্রম এর দ্বারা যে জ্ঞান লব্ধ হয় তা নিশ্চয়াত্মক জ্ঞানের স্থৈর্যের পরিপন্থী; ভ্রমোৎপন্ন জ্ঞান তাই ‘দেশ, কাল ও অবস্থা ভেদে’ বাধিত বা ‘contradicted’ হয়ে থাকে। ভারতীয় দর্শনে ন্যায়শাস্ত্রে এই ‘সংশয় জ্ঞান’ যখন ‘বিপর্যয় জ্ঞান’-এ পর্যবসিত হয়, তখনই তৈরি হয় ‘ভ্রম’ জ্ঞান বা ভ্রান্তি; মনোমধ্যে তৈরি হয় ‘অমূল প্রত্যয়’ বা ‘hallucinatory beliefs’।

এই মর্মে যেটি উল্লেখ করা সমুচিত তা হলো এই যে এই চিত্তভ্রংশী মন প্রকৃতপক্ষে হলো এক প্রকারের ব্যত্যয়ী, বৈকল্যায়িত মনের উদাহরণ যার ভিত্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে উপ-যৌক্তিক চিন্তন কাঠামোর উপর। এই প্রবন্ধে আমরা যে প্রাতর্কিক প্রকল্পটি হাজির করেছি তা হলো এই যে আমরা ‘মন-মস্তিষ্ক অভেদ’ (mind-brain identification) মানছি; আমরা স্বীকার করছি যে মানস-প্রতিরূপের (mental representations) মধ্য দিয়ে মস্তিষ্ক-প্রতিরূপের (brain representations) সন্ধান পাওয়া যায়; আমরা স্বীকার করছি যে মস্তিষ্ক-প্রতিরূপের উপস্থাপনা মানস-প্রতিরূপের মধ্যে সঞ্চিত থাকে। কিন্তু আমরা এটাও বলছি যে চিত্তভ্রংশী মনের নিদানবিদ্যা বা কার্য-কারণ তত্ব, আধুনিক, ধ্রুপদী পরিগণনাত্মক প্রতিরূপ্যতার যুক্তি দিয়ে ধরা যায় না। চিত্তভ্রংশী মনের মনোসামাজিক মানস-ব্যাপারগুলো (mental states) বা চিত্তভ্রংশী মনের জ্ঞানাত্মক প্রক্রিয়াগুলি (epistemic/cognitive processes), সম্পূর্ণরূপে মনোজৈবিক পরিগণনাত্মক/প্রতিরূপী প্রকল্প (Computationalist/representational hypothesis), যা বলে মন এক প্রকারের যন্ত্র বা ‘Turing machine model’, তা দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলে, সেটা হবে যথার্থই এক প্রকারের ‘রিডাকশন’। এখন আমরা যদি মেনে নিই যে মনের একটা সামাজিক-রাজনৈতিক দিক আছে; যদি মেনে নিই যে মানবমন সদাই তাঁর সমাজ ও পারিপার্শ্বিক রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত; যদি মেনে নিই যে একভাবে মন সর্বদা ইতোমধ্যেই শরীরায়িত; যদি মানি যে আমাদের মন ও মস্তিষ্ক সমগ্র, যাকে আমরা কখনোই যৌক্তিক ও অবরোহী সম্পূর্ণতা দিয়ে, সম্পূর্ণভাবে কখনোই জানতে পারব না; যদি মানি যে আমাদের মন ও মস্তিষ্ক সদাই এক প্রকারের শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার মাঝামাঝি অবস্থান করছে; এবং, সর্বোপরি যদি মানি যে মানবমন এক প্রকারের প্রতিরূপীযন্ত্র হওয়ার বদলে, এক ধরনের অনির্দেশ্যায়িত ‘quantum field’, তবেই বোধ হয় আমরা চিত্তভ্রংশী মন ও মননের উপ-যৌক্তিক যুক্তিবিপর্যয়’কে চিন্তার মধ্যে নিয়ে আসতে পারব। অর্থাৎ, চিত্তভ্রংশী মনের নিদানতত্ত্ব’কে হৃদয়ঙ্গম করার পূর্বে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে এই কার্টেসীয় প্রতিরূপ্যতার মতবাদ, বা ‘Cartesian representationalism’-ই হলো সেই সর্ষের মধ্যেকার ভূত যার আধিপত্যবাদিতা মেনে নিলে, আমাদের এটা মেনে নিতে হয় যে ‘represented’, অর্থাৎ যে ভৌত প্রতিরূপায়িত হয়, তা সর্বদাই ‘representing practices’ বা প্রতিরূপায়ণকারী প্রাতর্কিক যাপনের প্রেক্ষাপট থেকে পৃথক এবং স্বাধীন। কিন্তু বাস্তবে মনসম্বন্ধীয় এই সত্যটি আসলে অসম্পূর্ণ। ব্যাবহারিক জগতে প্রকৃতপক্ষে, প্রাতর্কিক (discursive) ও জড়বাদী ভৌত (material)-এর মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই; প্রাতর্কিক ও ভৌত সর্বদা ইতোমধ্যেই নিজেদের মধ্যে এক প্রকারের অনুপূরকতা বা ‘complementarity’-এর সম্পর্কে বিরাজ করে।

এই অনুপূরকতার ধারণা দিয়েই বর্ত্তমানকালে ‘চিত্তভ্রংশী বাতুলতা’ নামক মনোরোগের কারণ-তত্ত্ব’কে বোঝার চেষ্টা করা হয়; যেখানে জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক অনুপূরক কারণগুলি দিয়ে তৈরি এক বিমিশ্র ‘biopsychosocial’ প্রতিমূর্তিকে দায়ী করা হয়ে থাকে চিত্তভ্রংশী মনের কারণ-তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য। তবে এই ব্যাখ্যা খুবই নতুন। তাই এই প্রসঙ্গে চিত্তভ্রংশী মননের উৎপত্তিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে আমাদের আবারো চলে যেতে হয় উনবিংশ শতকের মনোচিকিৎসক, এমিল ক্রেপেলিন এর কথায়, যিনি প্রথম ‘চিত্তভ্রংশী বাতুলতা’কে ‘dementia praecox’ দ্বারা চিহ্নিত করে, চিত্তভ্রংশী মনন’কে ‘catatonia’; অর্থাৎ, দেহপেশীর অস্বভাবী সংকোচন-প্রসারণ এর জন্য এক উদ্দেশ্যহীন নিরর্থক অঙ্গ-সঞ্চালন হিসেবে দেখিয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ, ইউগেন ব্লিউলার চিত্তভ্রংশী বাতুলতা’কে ‘স্কিৎসোফ্রেনিয়া’র নাম দিয়ে পুনঃনামাঙ্কন করেন, যেখানে চিত্তভ্রংশী মননের কারণ-তত্ব মূলত দেখানো হয় মানবমনের জ্ঞানাত্মক (cognitive) ও আধানিক (affective) প্রক্রিয়াগুলির খণ্ডীকরণের (splitting) মধ্য দিয়ে। কিন্তু উল্লেখ্য এই যে এই ‘splitting’ বা খণ্ডীকরণ একভাবে একধরনের ‘shattering of psyche’ বা চিত্তবিপর্যয়-এর ইঙ্গিতবাহক যেখানে মন আর কোনোপ্রকারেই সংবদ্ধ (coherent) এবং সহযোজিত (coordinated) হয়ে থাকতে চায় না। কিন্তু সঠিকভাবে বলতে গেলে চিত্তভ্রংশী মনের কারণ-তত্ব বৈজ্ঞানিকরা এখনো পর্যন্ত ব্যাখ্যা করে উঠতে পারেন নি। কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক, স্নায়ুজৈবিক সূচক’কে দায়ী করেছেন আবার কেউ কেউ জিনগত প্রবণতা’কে চিত্তভ্রংশী বাতুলতার কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন। পক্ষান্তরে ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণে আবার দেখানো হয়েছে যে চিত্তভ্রংশী মননের মূল কারণ হলো বংশগত প্রবণতার (hereditary predisposition) সঙ্গে বাল্যকালীন অভিজ্ঞতা (infantile experience) মিশ্রিত হয়ে তৈরি হওয়া এক প্রকারের সংবন্ধন মুহূর্ত (fixation point) [১৫] যা চিত্তভ্রংশী বিষয়িতা’কে ‘transference’ বা পাত্রান্তরণ-এর উর্ধে নিয়ে যায়।মনোসমীক্ষণ এবং চিত্তভ্রংশী বাতুলতার এই সম্পর্ক নেহাতই খুব একটা সরল নয়। এবং ফ্রয়েডের এই মতবাদের অনেক বিরুদ্ধ-মত আছে। এক কথায় বলতে গেলে চিত্তভ্রংশী মনের নিদানতত্ব এখনো বিজ্ঞানে অধরা। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে যেখানে চিত্তভ্রংশী মননের নিদানতাত্ত্বিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে আন্তঃমানবিক সম্পর্কে ঘনিয়ে আসা ত্রুটি-বিচ্যুতির উপর, সেখানেই মনোসমীক্ষণগত দিক থেকে বলা হয়েছে অপত্যের বৃদ্ধিবিকাশে বাবা-মা’র সেবাযত্নে দেখা দেওয়া বিকার প্রক্রিয়া বা ‘pathogenic parenting’ চিত্তভ্রংশী বাতুলতার অন্যতম প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটা। মনোচিকিৎসক Peter McGuffin এবং Anne Farmer বলেছেন — “no one is certain what is the optimal or ‘most valid’ way of defining the disorder for biological studies.” [১৬]

কিন্তু মনোরোগবিদ্যায় চিত্তভ্রংশী বাতুলতা’কে এইভাবে এক প্রকারের অনুপস্থাপনীয় বস্তুকূট বা ‘sublime object’ হিসেবে দেখানোর ঘোর বিরোধিতা করেছেন সেই সকল দার্শনিক ও সমাজকর্মীরা যাঁরা ‘anti-psychiatry movement’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁদের মতে বিরুদ্ধ-মনোরোগবিদ্যার প্রতর্ক চিত্তভ্রংশী বিষয়িতা’র বহুত্ববাদী রাজনৈতিকতা এবং স্ববিরোধী অর্থ সিঞ্চনে সক্ষম।

এর পরে আমরা আবারো চলে আসবো চিত্তভ্রংশী বিষয়িতার উপ-যৌক্তিক চিন্তন কাঠামোয় যেখানে চিত্তভ্রংশী মনন’কে বোঝা হয় একটি আদ্যন্ত ভাষা ও চিন্তন বৈকল্য রূপে। তাই এই মর্মে আসা যাক সেই আলোচনায় যা দেখাবে চিত্তভ্রংশী বাতুলতা কীভাবে এক প্রকারের ‘language planning disorder’-এর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে? মনশ্চিকিৎসক র‍্যালফ হফম্যান এর মতে চিত্তভ্রংশী মননের বৈকল্যায়িত জ্ঞানাত্মক পরিসরে ঘটা ‘Verbal Hallucination’ বা বিভ্রান্ত বাক্যগঠন’কে আমরা চিকিৎসাপরিভাষায় ‘loss of ego boundaries’ [১৭] বা ‘inner/outer confusion’ বলতে পারি যার দ্বারা প্রণোদিত হয়ে একজন চিত্তভ্রংশীর বহুবাচনিক বাগ-পরিকল্পনায় বা ‘multipropositional discourse planning’-কার্যে যারপরনাই ছেদ পড়ে। এর ফলে বিষয়ীর সাধারণ প্রতিদৈনিক কার্যসম্পাদনের যে ‘abstract cognitive plan’ বা বিমূর্ত জ্ঞানীয় পরিকল্পনা বিষয়ীর মনে সঞ্চিত থাকে, তা বিপর্যস্ত হয়, এবং বিষয়ীর ‘speech apparatus’ বা বাগযন্ত্র সম্পূর্ণরূপে ‘disorganized’ হয়ে পড়ে। এবং এই ‘speech disorganization’ বা বাগ-বিপর্যয়’ই চিত্তভ্রংশী মননের উপ-যৌক্তিক চিন্তন-কাঠামোর ফলাফল। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন চিত্তভ্রংশী উপ-যৌক্তিক মননের অন্তর্স্থলে ‘বহুসংবেদী সমণ্বয়ের’ বা ‘multisensory integration’ [১৮]-এর কার্যে ব্যর্থতার কারণে ঘটমান এই বাগ-বিপর্যয়ই চিত্তভ্রংশী বিষয়িতার প্রত্যক্ষণজগৎ-কে অ-সুসংগতির দিকে নিয়ে যায়। তাই বোধহয় মনোরোগবিশেষজ্ঞ, সংস্কৃতিতাত্ত্বিক অ্যাঞ্জেলা উডস-এর মতে, ‘চিত্তভ্রংশী বাতুলতা’র উপ-যৌক্তিক অনুপস্থাপনীয়তা বা ‘paralogical sublimity’ এখানেই যে চিত্তভ্রংশী মনের চিত্তবিভ্রমের নেপথ্যে কোনো একটি বিশেষ আবেগ বা অনুভূতি সংক্রান্ত চিহ্ন; অর্থাৎ কোনো ‘unique pathognomic signs’ কাজ করে না।

তাই লিওতার ও কান্ট সম্বলিত এই আধুনিকোত্তর সাংস্কৃতিক বিতর্কে আমরা ‘চিত্তভ্রংশী বাতুলতা’কে আর বৈকল্য হিসেবে না দেখে; চিত্তবিভ্রমের ‘sublime status’-কে উত্তরাধুনিকতার আলোকে নতুন করে দেখার আহ্বান জানাবো যেখানে ‘schizophrenic sublimity’ বা চিত্তভ্রংশী অনুপস্থাপনীয়তার চিন্তা-প্রস্থান সম্পূর্ণরূপে বিনির্মিত। কেন একজন চিত্তভ্রংশী বিষয়িতার মননে তাঁর ধারণাগুলি, বা চিন্তার এককগুলি, পূর্বাপর এক উদ্ভট প্রক্রিয়ায় শিথিল ভাবানুষঙ্গগুলিকে (‘loose associations’) জুড়ে রাখে? এই উদ্ভট, শিথিল ‘semantic or formal associations’-গুলির স্বরূপ ঠিক কীরকম? — সেই বিষয়ে চিত্তভ্রংশিতার মনোবিজ্ঞানে এখনো সবিশেষ গবেষণা হয়ে ওঠেনি। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। [যেমনঃ-“আমার ব্রেইন-এর ভিতর দিয়ে কুমীর চলে গেছে।”] এই উদ্ধৃতিটি একজন চিত্তভ্রংশী বিষয়িতার পরিদৃশ্যমান বাগ-বিপর্যয়ের উদাহরণ। এখানে আলোচ্য বচনটিতে বিষয়ীর বাগ-পরিকল্পনা এবং জ্ঞানাত্মক প্রক্রিয়াটি এমনভাবেই ব্যাহত যে এখানে দুটি দৃশ্যত অ-সমণ্বিত শব্দগুচ্ছ, যারা সামঞ্জস্যহীন দুটি পরিবর্ত শব্দগুচ্ছ, যথা, ‘ব্রেইন’ এবং ‘কুমীর’, তাদেরকে পাশাপাশি বসিয়ে, এমন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে বিষয়িতা, যা নিরর্থক; ব্যত্যয়ী, ‘অ-স্বাভাবিক’। উল্লেখ্য যে এখানে ‘ব্রেইন’ ও ‘কুমীর’ এই দুই শব্দগুচ্ছের মধ্যে এক ধরনের শিথিল উদ্ভট অবাধ ভাবানুষঙ্গ বর্ত্তমান। আরও উল্লেখ্য যে এখানে বাকরোধগ্রস্ততায় আক্রান্ত ‘রোগী’টি বাক্যে উপস্থিত শব্দগুলিকে পাশাপাশি বসিয়ে সঠিক অর্থবহ বিন্যাসে সাজিয়ে উঠতে পারেন না। অর্থাৎ, বিষয়ীর বাক্যগঠন এখানে — ‘agrammatical’; অর্থাৎ পুরোপুরিভাবে ব্যাকরণের নিয়ম-বর্জিত, কিংবা ‘paragrammatical’ যেখানে ব্যাকরণের নিয়ম আংশিকভাবে গ্রহণীয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শেষ কথা কে বলবে যে বিষয়ী এখানে ‘উন্মাদ’ বা ‘পাগল’? যদি আমরা স্বীকার করি যে বিষয়ীর ধারণা এখানে, শ্রেণী, লিঙ্গ, অর্থনৈতিক অবস্থান, সামাজিক অবস্থান, ভাষা এবং যৌনতার প্রতিচ্ছেদনে তৈরি, খণ্ডাশ্রয়ী এবং অসঙ্গতিপূর্ণ, এক অস্তিত্ববাদী অবভাসিকতা (existential phenomenology) থেকে উঠে আসছে, তাহলে বোধ হয় শেষ পর্যন্ত আর এই ‘পাগল’ বলে দেগে-দেওয়াটা খাটে না।

মানবিকবিদ্যায় এই চিত্তভ্রংশী বাতুলতা বিষয়ক গবেষণার যাথার্থ্য এখানেই যে চিত্তভ্রংশী বিষয়িতামূলক জ্ঞান’কে, এই ধরনের গবেষণা শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যত্যয়ী বাতুলতা বা উন্মাদনার স্বতঃপ্রকাশ হিসেবে দেগে দিতে চায় না। বরং বিরুদ্ধ-মনোরোগতাত্ত্বিক আঙ্গিক থেকে, ফুকোবাদী তত্ত্বযন্ত্র ধার করে বলা যায় যে চিত্তভ্রংশিতা কোনো অভ্যন্তরীণ মানস-বৈকল্যের প্রতিরূপ নয়; কিংবা, চিত্তভ্রংশী মনন’কে যদি ‘উন্মাদনা’র সঙ্গে তুলনাও করা হয়, তাহলেও সে ‘উন্মাদনা’ হলো এক প্রকারের অস্থিত (shifting) পরিবর্তনশীল (variable) সামাজিক (social) ও প্রাতর্কিক (discursive) নির্মাণ। এমন এক নির্মাণ যেখানে আমাদের এই আধুনিকোত্তর সমাজ ও সময় — উভয়েই ধীরে ধীরে এই রোগগ্রস্ত উপ-বাস্তবতার বিপর্যয়ের কবলে, অপস্রিয়মান। 

তথ্যসূত্র :

[] দ্রষ্টব্যঃ ‘আমি ও আমার মন’, রচয়িতা- বিমলকৃষ্ণ মতিলাল। ভূমিকা ও সম্পাদনা- অরিন্দম চক্রবর্তী।অনুষ্টুপ।পৃষ্ঠাঃ৪৭

[] See Sohee Park and Henry A. Nasrallah, “The Varieties of Anomalous Self Experiences in Schizophrenia: Splitting of the Mind at a Crossroad,” Schizophrenia Research 152, no. 1 (2014): 1–4, https://doi.org/10.1016/j.schres.2013.11.036.

[] See Jean Lyotard Francois, “Postmodern Science as the Search for Instabilities,” in The Postmodern Condition: A Report on Knowledge, ed. Geoff Bennington and Brian Massumi, 1st ed. (United States of America: University of Minnesota Press, Minneapolis, 1984), 53–60., p. 60

[] See Georges Lyotard Francois-Jean and Abbeeles Den Van, “Interview: Jean-Francois Lyotard,” Diacritics, Autumn 14, no. No. 3 (1984): 15–21, https://www.jstor.org/stable/464841., p. 16

[] Lyotard’s ‘La Phénoménologie’ is quoted in Peter Dews, “Review : The Letter and the Line : Discourse and Its Other in Lyotard Reviewed Work ( s ): Discours , Figure by Jean-François Lyotard Review by : Peter Dews THE LETTER AND THE LINE : DISCOURSE AND ITS OTHER” 14, no. 3 (2017): 39–49. 

[] Diacritics, Issue, and Dews., p. 41

[] See Rodolphe Gasche, “Potmodernism and Rationality,” The Journal of Philosophy 85, no. No. 10 (1988): 528–38, https://www.jstor.org/stable/2026812., pp. 532-533

[] See Charles Baudelaire, The Painter of Modern Life, ed.  P. E. Charvet (United States of America: Penguin Books, 2010)., p. 21

[] দ্রষ্টব্যঃ প্রদীপ বসু, “কে আধুনিক? আধুনিকতাই বা কী? শার্ল বোদলের ও মিশেল ফুকো”। বই-এর নামঃ ভাষা দর্শন সংগীতঃ সমীক্ষা ও সন্ধান, প্রদীপ বসু-র প্রবন্ধ সংকলন। প্রকাশনা- অনুষ্টুপ.২০১৪। পৃষ্ঠাঃ ৮৫ 

[১০] See Patrick Mchugh, “Dialectics , Subjectivity and Foucault ’ s Ethos of Modernity Author (s): Patrick McHugh Reviewed Work (s): Dialectics , Subjectivity and Foucault ’ s Ethos of Modernity” 16, no. 2 (2012): 91–108.

[১১] See Manfred Spitzer, “Kant on Schizophrenia,” Philosophy and   Psychopathology, 1990, 44–58, https://doi.org/10.1007/978-1-4613-9028-2_4.

[১২] See Ihab Hassan, “Toward a Concept of Postmodernism,” in Postmodernism: A Reader, ed. Thomas Docherty, 2nd ed. (United Kingdom: Routledge, Talor and Francis Group, New York, London, 1993), 146–56.

[১৩] দ্রষ্টব্যঃ রূপা বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘হ্বিটগেনস্টাইন-এর বাগর্থতত্ত্বের বিবর্তনঃ চিত্রতত্ব থেকে ভাষাক্রীড়া’; বই- ‘হ্বিটগেনস্টাইনঃ জগৎ, ভাষা ও চিন্তন’;যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা, ২০২৩; পৃষ্ঠাঃ ১৩৬

[১৪] দ্রষ্টব্যঃ ‘আমি ও আমার মন’।পৃষ্ঠাঃ ৬২

[১৫] See Robbins, Michael. “Psychoanalytic and biological approaches to mental illness: Schizophrenia.” Journal of the American Psychoanalytic Association 40, no. 2 (1992): 425-454.

[১৬] See McGuffin, Peter, Philip Asherson, Michael Owen, and Anne Farmer. “The strength of the genetic effect: is there room for an environmental influence in the aetiology of schizophrenia?.” The British journal of psychiatry 164, no. 5 (1994): 593-599.

[১৭] See Hoffman, Ralph E. “Verbal hallucinations and language production processes in schizophrenia.” Behavioral and Brain Sciences 9, no. 3 (1986): 503-517.

[১৮] See L. Postmes et al., “Schizophrenia as a Self-Disorder Due to Perceptual Incoherence,” Schizophrenia Research 152, no. 1 (2014): 41–50, https://doi.org/10.1016/j.schres.2013.07.027.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান