গুরু-শিষ্য সংবাদ : সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং

সমীররঞ্জন অধিকারী

Conscious fear may be a form of unconscious desire.

সিগমুন্ড ফ্রয়েড

গুরু ও শিষ্যকে নিয়ে আলোচনা কালে অনিবর্যভাবে শুরুতেই আসেন গুরু। গুরু ‘মনোসমীক্ষণ’ (Psychoanalysis) নামক মনোচিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবক অস্ট্রীয় মানসিক রোগ চিকিৎসক এবং মনস্তাত্ত্বিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তাঁর জন্ম ৬ মে, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর বিভিন্ন কাজ জনমানসে বিরাট প্রভাব ফেলেছে — বিশ্বে সর্বকালের জনপ্রিয়তম বিজ্ঞানীদের অন্যতম ফ্রয়েড। মানব সত্তার ‘অবচেতন’, ‘ফ্রয়েডীয় স্খলন’, ‘আত্মরক্ষণ প্রক্রিয়া’ এবং ‘স্বপ্নে আসা প্রতীকগুলির ব্যাখ্যা’ প্রভৃতি সম্বন্ধে তাঁর আবিষ্কার অত্যধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাঁর বিভিন্ন তত্ত্ব বিশ্বের সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদি ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। তিনি তাঁর ‘ইডিপাস কম্পলেক্স’ ও ‘ইলেক্ট্রা কম্পলেক্স’ বিষয়ক মতবাদ সমূহের জন্য অধিক আলোচিত ও সমালোচিত। 

‘তিনি অস্ট্রিয়ার একজন মন্ত্রী বা সেনাপতি হয়েছেন’ — ফ্রয়েড ছোটোবেলায় এমনই স্বপ্নে বিভোর থাকতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ইহুদি। এই সময়ে জাতিবিদ্বেষের বিষ ওদেশেও প্রচণ্ড পরিমাণে বিস্তৃত ছিল। আর সেই কারণেই মন্ত্রী বা সেনাপতি হওয়ার পথ তাঁর কাছে রুদ্ধই ছিল — কেবলমাত্র ডাক্তারি আর ওকালতি করা ছাড়া আর কোনও পথই তাঁর জন্য খোলা ছিল না। তাই তিনি ডাক্তার হবেন এটাই ঠিক করলেন। তিনি ১৮৭৩-এ ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসাবে পড়াশোনা শুরু করলেন এবং ১৮৮১-তে এম ডি ডিগ্রি লাভ করার অল্প কিছুদিন পরেই Institute of Cerebral Anatomy-তে গবেষক হিসাবে কাজে যোগদান করলেন — গবেষণাই তাঁর সব থেকে প্রিয় কাজ ছিল। এই গবেষণাগারে তিনি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের সঙ্গে ভ্রুণাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্কের তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন। এইভাবে গবেষণার মধ্যে দিয়ে তিনি সামগ্রিকভাবে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের কর্মপদ্ধতি জানার চেষ্টা চালিয়ে ষেতে থাকেন। তবে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ফ্রয়েডের জীবনে একটা বিশেষ পরিবর্তন আসে — তিনি প্যারি শহরে সুবিখ্যাত স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ সাঁরকোর কাছে শিক্ষালাভের জন্য যান। এখানে হিস্টিরিয়া রোগ নিরাময়ে সাঁরকোর সম্মোহন (Hypnosis) পদ্ধতির প্রয়োগ ফ্রয়েডকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। 

তারপর, ১৮৮৬-তে ফ্রয়েড আবার ভিয়েনায় ফিরে সম্পূর্ণভাবে স্নায়ুরোগের, বিশেষ করে হিস্টিরিয়া রোগের, চিকিৎসায় মনোনিয়োগ করেন। মানসিক রোগের চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতির গবেষণাধর্মী পর্যবেক্ষণ ও বিচারবিশ্লেষণ থেকেই তিনি ‘মনঃসমীক্ষণ’ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি ১৯০০ থেকে ১৯৩০-এর দশক (প্রয়াণ দিবস ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯) অর্থাৎ তাঁর চুয়াল্লিশ বছর বয়স থেকে আশি বছর পর্যন্ত দীর্ঘ সময় কালে ‘ফ্রয়েড’ নামক কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।

বস্তুত উদ্‌বায়ু (Neurosis) নামক বিশেষ মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করতে করতে ফ্রয়েড ‘মনোসমীক্ষণ’ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি উদ্‌বায়ু রোগী এবং মনোসমীক্ষণেচ্ছু স্বাভাবিক ব্যক্তিদের সমীক্ষণকালীন আচরণ পর্যালোচনা করে মনস্তত্ত্বের দু-টি মূল সত্যের আবরণ উন্মোচন করেন; তিনি আবিষ্কার করেন — (অ) অবদমন (Repression), (আ) শৈশবকালীন যৌনতা (Infantile Sexuality)।

অবদমন (Repression)

মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতি ও তত্ত্বের ভিত্তিমূলে আছে অবদমন সম্বন্ধে ফ্রয়েডের মতবাদ। মুক্ত ভাবানুষঙ্গের (Free Association) মাধ্যমে কোনও ব্যক্তির মনোসমীক্ষণ করা কালে চিকিৎসক তাকে আরামে শায়িত অবস্থায় অবাধে মনের কথা বলে যেতে বলেন — ব্যক্তিও কথা বলে যেতে থাকে। কিন্তু ফ্রয়েড লক্ষ করেন কথা বলতে বলতে ব্যক্তি হঠাৎ থেমে যায় — তখন তার মনের মধ্যে একটা বাধা আসে, যে বাধা তাকে মন খুলে সব কথা বলতে দেয় না, যে বাধা তার পূর্বস্মৃতির উদ্ধারপথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। মনোসমীক্ষণ করার সময় প্রত্যেকবারই তাঁর এই রকম অভিজ্ঞতার উদ্ভব ঘটে। এই ধরনের অভিজ্ঞতাই তাঁকে ‘অবদমন’ তত্ত্ব আবিষ্কার করার পথে পরিচালিত করেছিল। ফ্রয়েডের মতে অবদমন আছে বলেই এই বাধার অনুভূতি হয়। মানুষের মন প্রচণ্ডভাবে গতিশীল এবং এই মন নামক মানবিক উপাদানটি সহজাত প্ৰবৃত্তির তাড়না, বিরোধ, গূঢ়ৈষা, অবদমন ইত্যাদির মতো কিছু ইচ্ছামূলক ক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

শৈশবকালীন যৌনতা (Infantile Sexuality)  

মানবশিশু একেবারে নিষ্পাপ, কাম-গন্ধহীন, হিংসা-দ্বেষহীন এক অমৃতের উৎস থেকে আগত — চার্চের এই ধর্মীয় ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে ফ্রয়েড প্রতিষ্ঠিত করলেন মানবমনের প্রকৃত স্বরূপ। তাঁর মতে শৈশবকালেও যৌনতা থাকে। এই সিদ্ধান্তে ফ্রয়েড অবশ্য ‘অবদমন’ আবিষ্কারের বেশ কিছুদিন পরে উপনীত হন। বহু উদ্‌বায়ু রোগীর মনঃসমীক্ষণ করার অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। মনোসমীক্ষণ করার সময় তিনি দেখলেন যে, ব্যক্তি অব্যবহিত অতীতের কথা বলতে বলতে তার শৈশবকালের ও অতি শৈশবকালের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথাও ব্যক্ত করতে থাকে। এই সময় ব্যক্তির স্মৃতিপথে শৈশবের কথা ফিরে ফিরে আসতে পারে। এই সময়ে শৈশবকালীন আকাঙ্ক্ষার অতৃপ্তির অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ব্যক্তি অবশ্য কাল্পনিক অনেক অভিজ্ঞতার কথা বলতে থাকে। মনেই যে আকাঙ্ক্ষার জন্ম, মনেই যার মৃত্যু, বাস্তব রূপায়ণের সঙ্গে যার কোনও সম্পর্ক নেই, এমন শৈশবকালীন আকাঙ্ক্ষার অতৃপ্তিজনিত অভিজ্ঞতাও ব্যক্তির মনে আসে। সকল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আত্ম-কাম বা আত্ম-রতি সংক্রান্ত ইচ্ছার সম্পর্ক আছে। এসব আকাঙ্ক্ষার প্রকৃতি এমন যে এর মধ্যে এক ধরনের যৌনসুখ ও যৌনতার সম্পর্ক আছে। পরবর্তীকালে ফ্রয়েড শৈশবকালীন যৌনতা সম্বন্ধে আরও সুনিশ্চিত হন। অতি শৈশবে শিশুদের আচার-আচরণ প্রত্যক্ষ করে ও তার যথাযথ বিশ্লেষণ করে তিনি শৈশবকালীন যৌনতা বিষয়ে (Infantile Sexuality) সিদ্ধান্তে আসেন। ফ্রয়েড মা-র প্রতি ছেলের যৌনেচ্ছাকে ইডিপাস কমপ্লেক্স বা গূঢ়ৈষা বলেছেন। সাধারণভাবে এটাকে অসম্ভব বলেই মনে হয়। তবে ফ্রয়েডের ব্যাখ্যায় প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই নির্জ্ঞানে এরকম ইচ্ছা ক্রিয়াশীল থাকে। ফ্রয়েড যৌন কামনাকে বৃহত্তর অর্থে দেখেছেন। তিনি এই কামনাকে সুখ পাওয়ার ইচ্ছা বা ভালোবাসা পেয়ে সুখী হওয়ার ইচ্ছার সঙ্গে সমার্থক করে দেখেছেন। একেই ফ্রয়েড শৈশবকালীন যৌনতা (Infantile Sexuality) বলেছেন। ছেলে মা-এর ভলোবাসার কামনা করতে বাবার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়, এই অবস্থাকেই ফ্রয়েড ইডিপাস অবস্থা বলেছন। মায়ের প্রতি শিশুর ভালোবাসার আকর্ষণ যত বৃদ্ধি পায়, ততই সে পিতাকে তার বেশি বেশি প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে এবং পিতার প্রতি বিদ্বেষী হয়ে ওঠে, তাঁর ক্ষতি, এমনকি মৃত্যু, কামনাও শিশুর চিন্তায় উঁকি মারে। 

অবদমন ও শৈশবকালীন যৌনতা সম্পর্কে ফ্রয়েড যে মতবাদ প্রদান করেছেন তা কোনও মতেই বাস্তবতা বিবর্জিত অনুমাননির্ভর কোনও সিদ্ধান্ত নয়। প্রকৃত পক্ষে এই দুটি সিদ্ধান্তের প্রত্যেকটিই মনোসমীক্ষকের বাস্তব পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। ‘অবদমিত’ ‘শৈশবকালীন’ ‘যৌনতা’— এই তিনটি শব্দের প্রত্যেকটিরই বিশেষ তাৎপর্য আছে। এই তিন শব্দের তাৎপর্য অন্বেষণেই ফ্রয়েড সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই ফ্রয়েডের মূল সিদ্ধান্ত এই তিনটিই বিষয় নিয়েই।

মানব মনের ক্ষেত্রগত শ্রেণিবিভাগ  

মনোবিদ্যায় সচেতন মনের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে আলোচনার পাশাপাশি ফ্রয়েডের আবিষ্কারের পর থেকে নির্জ্ঞান মনের ক্রিয়াকাণ্ড সম্পর্কে আলোচনারও বিস্তৃতি লাভ করেছে। ফ্রয়েড ও তাঁর অনুগামীরা নির্জ্ঞান মনের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তাঁদের মতে এই নির্জ্ঞান মনই মানুষের সমস্ত বাস্তব আচরণের নির্ধারক হিসেবে নীরবে কাজ করে থাকে। 

আগেই বলেছি মানসিক বিকারগ্রস্ত (উদ্‌বায়ু রোগগ্রস্ত) ব্যক্তিদের আচরণ ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের ফলে মনোবিদ্যার এক বিশেষ শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যাকে বলা হয় মনঃসমীক্ষণবাদ। এই মতবাদের জনক অবশ্যই সিগমুন্ড ফ্রয়েড। মানুষের আচরণের প্রকৃত স্বরূপ বিশ্লেষণে মনোবিদ্যার এই শাখা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবলম্বন করেছে। ফ্রয়েডের পূর্বে মনের এই নির্জ্ঞান অংশের ক্রিয়া সম্পর্কে মনোবিদদের বিজ্ঞানসম্মত কোনও ধারণাই ছিল না।

ফ্রয়েডই প্রথম মনের তিনটি স্তরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করেন — (অ) চেতন (Conscious), (আ) অবচেতন (Subconscious) বা প্রাক্‌চেতন (Pre-conscious), ও (ই) অচেতন বা নির্জ্ঞান (Un-conscious)। 

(অ) চেতন মন (Conscious Mind) : মনের একটা অংশের সঙ্গে বাস্তব জগতের সম্পর্ক বর্তমান থাকে। সেই অংশটি তাৎক্ষণিক আচরণের কারণ নির্দেশ করতে পারে। মনের ওই অংশ কোনও ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে। ব্যক্তি সদা সর্বদা মনের এই অংশ সম্বন্ধে অবহিত থাকে। ফ্রয়েড মনের এই অংশকে চেতন মন (Conscious Mind) বলেছেন। কোনও কাজ সম্পাদন করা কালে বা কোনও কিছু বিষয় নিয়ে চিন্তা করা কালে বা কোনও কিছু উপলব্ধি করা কালে বা কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কালে ব্যক্তিমানসের এই অংশই ক্রিয়াশীল থাকে। 

চেতন মনকে অনেকগুলি মানসিক বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি হিসেবে গণ্য করা হয় — ‘আত্মমাত্রিকতা’, ‘আত্মচেতনা’, ‘অনুভূতিশীলতা’, ‘পৃথককরণ ক্ষমতা’ এবং নিজের সত্তা ও আশেপাশের পরিবেশের মধ্যকার সম্পর্ক অনুধাবনের ক্ষমতা। 

অনেক সময় ব্যক্তি তার ভুলে যাওয়া তথ্য, স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া ঘটনা, নানা তর্কবিতর্কের রেশ, গানের সুর ও বাণী, কোনও নাম-ধাম, তারিখ, দীর্ঘদিনের অ-দেখা মুখাবয়বও মনে করতে পারে তার চেতন মন দিয়ে। 

(আ) অবচেতন মন (Subconscious Mind) বা প্রাক্‌চেতন মন (Preconscious Mind) : ব্যক্তি মানসের বর্তমান চেতনার (Focal Awareness or Immediate Awareness) পরিসরে না থাকা অংশকে ফ্রয়েড অবচেতন (Subconcious) বলেছেন। কোনও কোনও সময় হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি একটু চেষ্টা করলেই স্মরণ করতে পারা যায়। কোনও ঘটনা অন্য আর একটি সম্পূর্ণ বিস্মৃত ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দিতেও পারে। সেই আপাত বিস্মৃত ঘটনার স্মরণ অবচেতন বা প্রাক্‌চেতন মনের ক্রিয়া। তবে প্রাক্‌চেতন স্তরে থাকা সব ঘটনা অনায়াসে স্মরণে আসে না — যথেষ্ট চেষ্টা করে তবে চেতনে আনতে হয়। সুতরাং, এই ঘটনা কিছুতেই তাৎক্ষণিক নয়। প্রাক্‌চেতন মনের তথ্য স্মরণে আনা মোটেই অনায়াসসাধ্য কাজ নয়। কখনও কখনও কোনও ব্যক্তি অন্যের সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে চেষ্টা করে এই স্তরে থাকা কোনও তথ্যকে চেতন মনে তুলে আনতে পারে। 

(ই) অচেতন বা নির্জ্ঞান মন (Un-conscious Mind) : মনের এই অংশটি ব্যক্তির জাগ্রত চেতনার বাইরে থাকে। তার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণেরও বাইরে থাকে। সাধারণ অর্থে মনের এই অংশকে অচেতন বা নির্জ্ঞান মন বলে। এই নির্জ্ঞান বা অচেতন মনকে অযুক্তিকর কিছু অদ্ভুত ও অবাস্তব চিন্তা-ভাবনার ভাণ্ডার হিসেবেও দেখা হয়ে থাকে। এইসব চিন্তা-ভাবনাগুলি মাঝে মধ্যে কিছু সময়ের জন্য ব্যক্তির চেতন মনে এসে তাকে বিব্রতও করে থাকে। অচেতন মনের এমন চিন্তা-ভাবনাগুলিকে মন তার প্রতিরক্ষণ ব্যবস্থার জন্য পুনরায় অচেতন মনে অবদমন করে। 

জাগ্রত অবস্থায় চেতন মনের দ্বারা কোনও ব্যক্তি তার পারিপার্শ্বিক জগৎ ও সমাজের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলে। অচেতন মন সংযোগ রাখে অন্তর্জগতের সঙ্গে — অতীত স্মৃতি ও জৈবিক প্রয়োজনসমূহের সঙ্গে। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, মানবমনের প্রায় ৯০ শতাংশই অচেতন, বাকি কেবল ১০ শতাংশ চেতন অবস্থায় থাকে। অচেতন মন যদিও ব্যক্তির জাগ্রত চেতনার বাইরে থাকে তথাপিও কিছু প্রচেষ্টার বিনিময়ে একে চেতন মনে ফিরিয়ে আনাও যায় — এই প্রক্রিয়ার সাহায্যেই মানসিক রোগীদের মনোচিকিৎসা করা হয়।

এমন কিছু ঘটনা থাকে যা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়, চেষ্টা করলেও তাকে স্মরণে আনা যায় না। তাহলে অতীতে কোনো ব্যক্তির জীবনে যে ঘটনা ঘটেছিল, তা কোথায় হারিয়ে যায়? সম্মোহন বা হিপনোটিক পদ্ধতিতে হিস্টিরিয়া রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে ফ্রয়েড এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেন। তিনি দেখলেন যে কোনও অভিজ্ঞতাই হারিয়ে যায় না বা মনের অতলে তলিয়েও যায় না। হিপনোসিসের সাহায্যে সেই ঘটনাকে পুনরায় স্মরণে আনা যায়। তাই তিনি বললেন কোনও কোনও অভিজ্ঞতা আপাত দৃষ্টিতে হারিয়ে গেছে বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তার অবস্থান হয় ‘অচেতন’ মনে। অনেক সময় তার জীবনে ঘটা কোনও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার কথা ব্যক্তি মনে করতে চায় না— তাকে অবদমন (Repression) করে অচেতন মনে পাঠিয়ে দেয়। তাই সেই কথাগুলি মনে এলে বিভ্রান্তি বা অশান্তির সৃষ্টি হয়, এই ভয়েই ব্যক্তি সেগুলিকে ভুলে যেতে চায়, তাই এই বিস্মরণ। আসলে জীবনের ধন কিছুই হারায় না, সবই সঞ্চিত থাকে মনের গহনে— অচেতনে। এই সকল ধারণার অনেকগুলিই ইদ্-আবেগ (Libidinal Urges) থেকে উৎসারিত হয়। 

মনের ক্রিয়াগত উপাদান 

ফ্রয়েড তাঁর ক্ষেত্রগত শ্রেণি বিভাগের সঙ্গে সমতা রেখে, মনের ক্রিয়াগত দিককেও (Dynamic Aspect) তিনটি উপাদানে বিভক্ত করেছেন। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত বই The Ego and The Id-এ তিনটি উপাদানের কথা বলেছেন— অদস্ (Id), অহম্ (Ego) এবং অধিসত্তা (Superego) ।

অদস্ বা ইদ্ (Id) : অদস্ বা ইদ্ হল পূর্ণমাত্রায় অচেতন এবং সবচেয়ে মৌলিক। এটি লিবিডোর আদিম আশ্রয়স্থল এবং ব্যক্তির সমস্ত প্রবৃত্তিমূলক কামনার চরিতার্থতার পেছনেই ইন্ধন জুগিয়ে থাকে। ইদের কাজই হল মানুষের সমস্ত রকম প্রবৃত্তির চাহিদা পরিতৃপ্ত করা। এই চাহিদা দুইভাবে ব্যক্তি জীবনে আসে। প্রথমত, ব্যক্তি জন্মগতভাবে কিছু প্রবণতা নিয়ে আসে। এই জন্মগত প্রবণতাগুলির উৎস অদস্ বা ইদ্। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি-জীবনে নানা রকম চাহিদার সৃষ্টি হয়। সামাজিক নানা বিধি-নিষেধ থাকার জন্য বা ব্যক্তিগত অক্ষমতার জন্য সবসময় এগুলিকে চরিতার্থ করা যায় না। এমত অবস্থায় এইসব আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদাগুলিকে ব্যক্তি অবচেতন মনে অবদমন করে। এই অবদমিত চাহিদা ও জন্মগত চাহিদাগুলি অবচেতন মনে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে থাকে না— তাদের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে নানা কম্প্লেক্স বা জট (Complex) তৈরি করে, আবার গতি থাকার ফলে তাদের মধ্যে শক্তি সঞ্চালিত হয়। অতৃপ্ত কামনা-বাসনার গতিধর্মিতার (Dynamic Nature) দরুন অবদমিত চাহিদাগুলি সবসময় পরিতৃপ্তি পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। এই সকল ঘটনা পর্যালোচনা করে ফ্রয়েড উপলব্ধি করলেন — ইদ্ সর্বদাই সুখভোগের নীতি (Pleasure Principle) অনুসরণ করে। তাই তিনি ইদ্-কে মানুষের কামনা-বাসনার নগ্ন প্রতিচ্ছবিও বলেছেন। এই ক্ষেত্রে পশু ও মানুষ স্বভাবগতভাবে একই। ভালো-মন্দ বিচারের কোনও অবকাশ ইদ্-এর নেই। সকল সময়ই সে মনের অতৃপ্ত বাসনা চরিতার্থ করতে চায়। আর সুখই তার কাছে প্রধান। প্রাপ্ত বয়সে শৈশবের বিভিন্ন অতৃপ্ত কামনা-বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য বাইরের জগতের সঙ্গে ইদ্-এর বোঝাপড়া করার প্রয়োজন হয়। তখন তাকে হয় বহির্জগতের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে হয়, নতুবা বহির্জগতকে জয় করতে হয়। কিন্তু ইদ্-এর মতো বিচার-বিবেচনাহীন অচেতন মনের অন্ধ শক্তির দ্বারা এই কাজ করা সম্ভব হয় না — তাই ব্যক্তিমানসে উচ্চতর স্তরের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করলেন ফ্রয়েড।

অহম্ (Ego) : মনের উচ্চতর স্তরকে ফ্রয়েড বলেছেন অহম্ (Ego)। ইদ্ তার নির্জ্ঞান মনের কোনও ইচ্ছাই সরাসরি পূরণ করতে পারে না। তার ইচ্ছা বাস্তবে চরিতার্থ করতে হলে অহম্ (Ego)-এর প্রয়োজন। ফ্রয়েডের মতে জন্মের সময় শিশুর অহম্ থাকে অতি দুর্বল। কিন্তু শিশু যত বড়ো হতে থাকে ততই সে বাস্তবের সংস্পর্শে আসে এবং তার অহম্ (Ego) পুষ্ট হতে থাকে। ইদ্ সুখভোগের নীতি দ্বারা পরিচালিত হলেও অহম্ (Ego) কিন্তু বাস্তবতার নীতির দ্বারা (Reality Principle) পরিচালিত হয়। অহম্ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন এবং যুক্তিধর্মী — সে ভালোভাবেই বোঝে যে তাকে সমাজে অস্তিত্ব বজায় রেখে চলতে হলে বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখেই চলতে হয়। তাই সে বহির্জগতের বাধাকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। কোনও প্রতিক্রিয়া প্রদান কালে যদি অহম্ বোঝে যে ইদ্-এর কোনো বিশেষ চাহিদার পরিতৃপ্তি ঘটবে, অথচ ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ হবে না, তবেই সেই কাজ সে করে। অন্যথা সে ইদ্-এর ইচ্ছাকে চেপে রাখে এবং বাইরে প্রকাশ হতে দেয় না — তবে ইদ্-এর পরিতৃপ্তি মানে অহম্-এর নিজেরই পরিতৃপ্তি, কিন্তু বাস্তবের চাপে অহম্ ইদ্-কে দমিয়ে রাখে। 

অধিসত্তা (Superego) : শিশুর অতি শৈশব কালেই অধিসত্তা বা সুপার ইগো-র জন্ম হয় — এটাও মানব মনের একটি উচ্চতর উপাদান। প্রকৃত পক্ষে মাতা-পিতার কাছ থেকে পাওয়া নৈতিক শিক্ষা এবং সমাজের ন্যায়-নীতিবোধ ও বিধি-নিষেধের ধারণা — এই দু’য়ে মিলে অধিসত্তা তৈরি হয়। নিজের মনের দাবি ও বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে চেয়ে অহম্-কে অনেক সময় কিছুটা সমঝোতা করে চলতে হয়, কখনও কখনও হয়তো কিছুটা অন্যায় কাজকেও প্রশ্রয় দিতে হয়। কারণ মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যই এটা প্রয়োজন। সেই জন্য অহম্-এর ওপর নজরদারি করার জন্য একটি সত্তা আছে ফ্রয়েড যার নাম দিয়েছেন অধিসত্তা বা সুপার ইগো। এই অধিসত্তার দুটি অংশ — একটি হল উচিত-অনুচিত বোধ (Ego ideal) এবং অপরটি হল ন্যায়-অন্যায়ের সতর্ক প্রহরী বা বিবেক (Conscience)। দৈবাৎ কোনও অন্যায় করলে ব্যক্তি যে অপরাধবোধে ভোগে তা বিবেকের দেওয়ার শাস্তি ছাড়া আর কিছুই নয় — কিন্তু বাস্তব জীবনের সমঝোতা ছাড়া বাঁচাও যায় না। আবার, অধিসত্তা বা সুপার ইগো অস্বাভাবিক ভাবে শক্তিশালী হলে সব কিছুকে উচিত-অনুচিত এইভাবে বিচার করতে চেয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা দুরূহ হয়ে ওঠে। সুতরাং অহম্-এর আরেকটি কাজ হল সুপার ইগোর সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে চলা।

অজাচার (Incest) অর্থাৎ নিকট আত্মীয় বা আত্মীয়ার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রবৃত্তিতাড়িত ইচ্ছাও সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকে একটা গর্হিত কাজ। সকল ব্যক্তির মধ্যেই এরকম ইচ্ছার অস্তিত্ব ঘুমন্ত বা তীক্ষ্ণভাবে বিরাজিত থাকে এবং এই জন্যই একে রোধ করার জন্য সমাজে শাস্তির ভয় ও নিয়ম মেনে চলার অনুশাসনও প্রণীত হয়েছে বলে ফ্রয়েড মনে করেন। মনের গভীরে লুক্কায়িত এইরকম আদিম ইচ্ছার অস্তিত্বকে এইভাবেই নির্ণয় করতে করতে অবচেতন মনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ফ্রয়েড সিদ্ধান্তে আসেন ও মনস্তত্ত্বের নতুন ধারার সূচনা হয়। 

‘মানুষ যাকে ভয় করে, তাকে বোধহয় প্রত্যাশাও করে’ — এটিও ফ্রয়েডের বহু অভিজ্ঞতার আলোকে আবিষ্কৃত আরও একটি নীতিসূত্র। কাউকে ভয় পাওয়া যেন তাকে পেতে চাওয়ারই নামান্তর। অনেক সময় বাস্তব জীবনে মানুষের মধ্যে অদ্ভুত ধরনের এক ভয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। বিশেষ করে উদ্‌বায়ু রোগীদের ক্ষেত্রে যে সকল ভয় দেখা যায় তা আরও অদ্ভুত। ফ্রয়েডের মতে সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়, এমন ইচ্ছাকে ঢেকে রাখা বা অবদমিত করার জন্যই এই ভয়ের অবতারণা। কখনও কখনও কোনও কোনও ব্যক্তির কোনও কোনও ব্যক্তির প্রতি  অতিরিক্ত হিতাকাঙ্ক্ষা বা অতিরিক্ত দয়া প্রদর্শনের ঘটনা লক্ষ করা যায়। এই ধরনের পরিস্থিতির পর্যালোচনা করার সময় ফ্রয়েড দেখেছেন দয়ালু ব্যক্তির অচেতন মনে ওই ব্যক্তির প্রতি রাগ বা তার ক্ষতি করার ইচ্ছা গোপনে কাজ করে থাকে এবং তা থেকে দয়ালু ব্যক্তির মধ্যে পাপবোধের উদয় ঘটে; সেই পাপস্খালনের চেষ্টা রূপে ইচ্ছারা এসে অতিহিত কামনা ও দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে।

শারীরিক দিক থেকে কোনও বিকৃতি বা বিচ্যুতি না থাকা সত্ত্বেও কখনও কখনও কোনও কোনও ব্যক্তির মধ্যে অন্ধত্ব, বধিরতা বা আরও কোনও অঙ্গের আড়ষ্টতা ঘটতে দেখা যায়। এই ধরনের ব্যাধি মানসিক ক্রিয়াবৈকল্যের জন্যই দেখা দিয়েছে বলে ফ্রয়েড আবিষ্কার করলেন। ফ্রয়েডের মতে এরকম দৈহিক অসুস্থতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি তার কোনও গোপন ইচ্ছারই পূরণ করে। এই সকল ইচ্ছা অবশ্যই অচেতন মনে অবদমিত কোনো ইচ্ছা— যে ইচ্ছার স্বরূপ ও প্রকৃতির খবর চেতন মনের বিচারে ব্যক্তি নিজেও বুঝতে পারে না। 

কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং

এবার আলোচনার বিষয় শিষ্য — কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং। কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং ২৬ জুলাই ১৮৭৫, সুইজারল্যান্ডের একটি গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর বাবা-মা উভয়েই অতীন্দ্রিয় জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতায় গভীর বিশ্বাসী ছিলেন। বাবা-মা-র প্রভাব হয়তো ইয়ুং-এর মানসিকতা গঠনে কিছুটা কাজ করে থাকতে পারে। পরিণত বয়সে তাঁর চিন্তায় এই আধ্যাত্মিকতার প্রকাশও লক্ষ করা যায় — তাঁর আবিষ্কৃত মনোবিজ্ঞানের নতুন নতুন তত্ত্বেও এই চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। 

তিনি প্রত্নতত্ত্ব (Archaeology) নিয়ে তাঁর পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু পরবর্তীতে চিকিৎসাবিদ্যাই হয় তাঁর পড়াশোনার বিষয়। তিনি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে বেসাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক হন। এরপর জুরিকের একটি মানসিক হসপিটালে সহকারী মনোরোগ চিকিৎসক হিসাবে যোগদান করেন। এই মানসিক চিকিৎসালয়ের অধিকর্তা ছিলেন বিখ্যাত মনোরোগ চিকিৎসক ইউজেন ব্রিউলার (Eugen Bleuler)। ডাক্তার ব্রিউলার সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) নামক এক কঠিন মানসিক রোগ নিরাময়ে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তারপর, ১৯০২-এ মাত্র ছয়মাসের জন্য ইয়ুং প্যারিতে পিয়ারে জ্যানে (Pierre Janet)-র কাছে শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ লাভ করেছিলেন। এরপর প্যারি থেকে ফিরে এসে তিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগদান করেন এবং সেই সঙ্গে মানসিক রোগের চিকিৎসক হিসাবে হাসপাতালের কাজেও নিযুক্ত থাকেন। অধ্যাপক রুইলারের তত্ত্বাবধানে তিনি শব্দ-অনুষঙ্গ মানসিক অভীক্ষা (Word Association Test) নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করেন, এবং সিজোফ্রেনিয়া রোগ নিয়ে গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে অনেক নিবন্ধও রচনা করেন। এই লেখালেখির সুবাদেই তিনি ফ্রয়েডের সান্নিধ্যে আসেন। এদিকে ১৯০৯-এ রুইলারের সঙ্গে তাঁর মত পার্থক্যের কারণে ইয়ুং মানসিক হাসপাতালের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Interpretation of Dreams’ প্রকাশিত হয় ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে। ইয়ুং ফ্রয়েডের এই বইয়ের প্রতিবেদনে মুগ্ধ হয়ে তাঁর বিশেষ অনুরাগী হয়ে ওঠেন। তারপর ১৯০৭-এ ফ্রয়েডের আমন্ত্রণে ইয়ুং ভিয়েনা যান। ফ্রয়েডও ইয়ুংকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখতেন। বিশ্ববিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী স্টেনলি হলের কাছ থেকে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে ফ্রয়েড ১৯০৯-এ ইয়ুং-কে নিয়ে আমেরিকার ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। ফ্রয়েডের প্রভাবে ও একান্ত সহায়তায় ইয়ুং ১৯১১-তে আন্তর্জাতিক মনোসমীক্ষণ সংস্থার (Psychoanalytical Society) সভাপতি নির্বাচিত হন। 

পরে অবশ্য ফ্রয়েড ও ইয়ুং-এর মধ্যে অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিতে থাকে। অবশেষে ইয়ুং মনোসমীক্ষণ সংস্থার (Psychoanalytical Society) সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা প্রদান করেন এবং নিজস্ব মনোবিজ্ঞানের মতবাদের প্রবর্তন করেন। ইয়ুং তাঁর প্রবর্তিত মনোবিজ্ঞানের নামকরণ করেন ‘অ্যানালিটিকাল সাইকোলজি’ (Analytical Psychology)। ইয়ুং ব্যক্তিত্বের গঠন ও প্রকৃতি নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা করেছিলেন। গবেষণার ও মনোচিকিৎসার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তিনি একটি পুস্তক প্রয়ণন করেন এবং নাম দেন ‘Psychological Types’। এই গ্রন্থে তিনি ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নানাবিধ পৌরাণিক কাহিনির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ লিপিবদ্ধ করেন। মনোবিজ্ঞানী মহলে বইটি বিশেষভাবে সমাদর লাভ করে। ইয়ুং-এর নতুন ব্যাখ্যা মনোবিজ্ঞানীদের চিন্তাধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। মনোবিজ্ঞানী মহলে ইয়ুং-এর প্রভাব ফ্রয়েডকেও ছাপিয়ে যায়। হারভার্ড ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়ে সম্মানিত করে। ইয়ুং ১৯৪৪-এ বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘Medical Psychology’ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হিসাবে কাজে যোগদান করেন। নিজের জন্মভূমি সুইজারল্যান্ডেই ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসের ৬ তারিখে এই মহাবিজ্ঞানীর জীবনাবসান ঘটে।

নির্জ্ঞান মনের অন্বেষণে

গুরু ফ্রয়েডের মতো ইয়ুংও মানবমনের অতল গভীর স্তরের স্বরূপ ও প্রকৃতি উন্মোচনে ব্রতী হয়েছিলেন। ইয়ুং প্রথমদিকে ফ্রয়েডের সহগামী ও অনুরাগী ছিলেন। ফ্রয়েড তাঁর তত্ত্বানুযায়ী নির্জ্ঞান মনের যৌন মানসিকতার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করেন; ইয়ুং কিন্তু এই সত্যতাকে অস্বীকার করেন — আর এখানেই গুরু-শিষ্যের মধ্যে দ্বন্দ্বের উৎপত্তি। 

ইয়ুং নির্জ্ঞান মনের সৃজনশীল শক্তির উপর গুরুত্ব প্রদান করে মনোবিজ্ঞানের আরও একটি দিগন্তের আবরণ উন্মোচন করলেন। ইয়ুং আবিষ্কৃত নির্জ্ঞান মনের প্রতীকধর্মিতা, মগ্নচেতনা (Collective Unconscious) ও আর্কিটাইপ (Arcketypes) মানব মনের স্বরূপ ও তার ঐতিহাসিক বিবর্তনকে বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে। 

মনোবিজ্ঞানে ইয়ুং-এর মডেল

ইয়ুং-এর মতে তিনটি উপাদান নিয়ে মানব মন গঠিত — (অ) অহম্ (Ego), (আ) ব্যক্তিগত নির্জ্ঞান বা অচেতন (Personal Unconscious), এবং (ই) সমষ্টিগত অচেতন বা মগ্নচেতনা (Collective Unconscious)। 

() অহম্ (Ego) : অহম্ সচেতন মনের প্রতিনিধিত্ব করে। যা জগতে বিদ্যমান তা সম্পর্কে সচেতনতা এবং ব্যক্তিগত পরিচয়ের অনুভূতি অহম্ ধারণ করে। এখানেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিদ্যমান থাকে। ব্যক্তির সংবেদন, অনুভূতি, অন্তর্দৃষ্টি ও চিন্তা উপলব্ধ হয় অহমের দ্বারা। এটি বাইরের জগৎ থেকে মানসিকতার অভ্যন্তরে প্রবেশের দরজা। 

(আ) ব্যক্তিগত নির্জ্ঞান বা অচেতন (Personal Unconscious) : ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্মৃতি এবং ভুলে যাওয়া এবং/অথবা অবদমিত কামনা-বাসনা নিয়ে ব্যক্তিগত নির্জ্ঞান বা অচেতন তৈরি হয়। ইয়ুং-এর মতানুসারে সচেতন অহম্ এবং ব্যক্তিগত অচেতন একত্রিত হয়ে ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয়।

(ই) সমষ্টিগত বা যৌথ অচেতন বা মগ্নচেতনা (Collective Unconscious) : সমষ্টিগত অচেতন ট্রান্সপারসোনাল অচেতন নামেও পরিচিত। ব্যক্তিত্ব তত্ত্বে এই ধারণাটি ইয়ুং-এর অন্যতম অনন্য এবং বিতর্কিত সংযোজন। ইয়ুং-এর মতে ব্যক্তিগত অচেতনের একটি সর্বজনীন সংস্করণ আছে, যা মানব প্রজাতির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যেও উপস্থিত থাকে। বিবর্তনের মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের স্মৃতি থেকে এই অচেতন উদ্ভূত হয়।

প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান

ইয়ুং-র বিশ্লেষণাত্মক মনোবিজ্ঞানের মধ্যে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান রয়েছে। সেইগুলির থেকে প্রধান চারটির কথা আলোচনা করা হচ্ছে। 

() পারসোনা (Persona) : পারসোনা (Persona) বলতে ‘মুখোশ’-কে বোঝায়। প্রতিটি ব্যক্তিই নিজেকে বিশ্ব সংসারের কাছে মুখোশ পরিহিত অবস্থায় উপস্থাপিত করে। মন-বাহ্যিক মুখকেই পারসোনা বলে নির্দেশ করা হয়ে থাকে। এটা ব্যক্তির প্রকৃত স্বরূপ নয়। তবে এই মুখোশ সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সঙ্গতি বিধানে সহায়তা করে। এ যেন অভিনয়। 

() ছায়া (Shadow) : ছায়া একটা আর্কিটাইপ। ব্যক্তিত্বে প্রাণী দিকের প্রতিনিধিত্ব করে ছায়া। ছায়া থেকে ব্যক্তি সৃজনশীল এবং ধ্বংসাত্মক উভয় শক্তিই অর্জন করে থাকে। ছায়া যৌনতা এবং প্রজন্ম রক্ষার কাজের প্রবণতাকে প্রভাবিত করে।   

() অ্যানিমা/অ্যানিমাস (Anima/Animus) : অ্যানিমা/অ্যানিমাসকে ইয়ুং মানুষের জৈবিক লিঙ্গের মিরর ইমেজ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। পুরুষদের মধ্যে অচেতন একটা মেয়েলি দিক এবং এর বিপরীতে, মহিলাদের মধ্যে অচেতন একটা পুরুষালি দিক বর্তমান থাকে। অ্যানিমা মেয়েলি দিকগুলির প্রতিনিধিত্ব করে, আর অ্যানিমাস পুরুষালি দিকগুলির প্রতিনিধিত্ব করে। 

() স্বয়ং (Self) : ইয়ুং-এর বিশ্লেষণাত্মক মনোবিজ্ঞানে ‘স্বয়ং’ একটি অভ্যন্তরীণভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানুষের নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে একতার অনুভূতির প্রমাণ দেয় এই ‘স্বয়ং’। নিজের স্বার্থ ও মানসিক ভারসাম্য রক্ষার্থে সচেতন ও অচেতন মনের মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করাই প্রতিটি ব্যক্তির জীবনের লক্ষ হওয়া উচিত। ‘স্বয়ং’ এই কাজটিই করে থাকে।

মানবমনের বিবর্তন

মানুষের শরীর অনেকগুলি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে গঠিত। আবার, এগুলির প্রত্যেকটিরই ক্রমবিবর্তনের একটা ইতিহাস আছে। মানবমনেরও তেমনি সৃষ্টি ও বিবর্তনের একটা ইতিহাস আছে। আদিমানবের (Archaic Man, প্রাচীন আদি মানুষ) মনের গঠন পশুদের মনের গঠনের মতোই ছিল। এখান থেকেই ক্রমবিবর্তনের স্রোত বেয়ে গড়ে উঠেছে বর্তমান মানবমন। 

ইয়ুং দেখালেন আদিমানবের মানসিক উপাদানের অবশেষ মানবমনে থাকে চিহ্ন বা ছাপ হিসেবে। আর মানব মনে অবশিষ্ট থাকা এই চিহ্নই হল মনের আদি ছাঁদ (Archetypes) বা (Primordial Images)। পুরাণ-কাহিনির মধ্যে থাকা নানা অদ্ভুত মানবচরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে মনের এই সকল আদি ছাঁদ বা Archetypes-এর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। স্বপ্নের প্রতীকও আদি ছাঁদেরই প্রকাশ। 

আদিম যুগের মানুষ প্রবৃত্তিতাড়িত হয়ে চালিত হত — পরে ধীরে ধীরে বাস্তবতার সঙ্গে আদিমতার যুদ্ধ থেকেই মানুষের মধ্যে যুক্তিবোধের উন্মেষ ঘটে এবং মানুষ এইসব প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। এই ঘটনার ফলে মানবমনে আদিম চেতনার উপর যুক্তিসমৃদ্ধ নতুন চেতনার স্তর সঞ্চিত হতে থাকে। চেতনাও এই দু-টি স্তরে বিভক্ত হয়। এই দুই স্তরের চেতনাই স্বপ্নে নানাপ্রকার প্রতীকের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। অনেক সময় স্বপ্নে নানা রকম প্রতীক আসতে দেখা যায়— (অ) বিপজ্জনক প্রাণী দ্বারা তাড়িত হওয়া, (আ) শত্রুভাবাপন্ন মানুষ দ্বারা তাড়িত হওয়া, (ই) স্বল্পবাস পরিহিত বা নগ্ন নারী বা পুরুষ, (ঈ) জনসমক্ষে উদ্ভট পোশাকে থাকা, (উ) ভোঁতা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করা, (ঊ) আত্মরক্ষা করতে সম্পূর্ণ অপারগ হওয়া, (ঋ) আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়েও কোথাও আশ্রয় না-পাওয়া, (এ) ক্রমশ বড়ো হয়ে যাওয়া বা ছোটো হয়ে আসা। এ ছাড়াও আরও অনেক প্রতীকের মধ্য দিয়ে মনের ভিতরের ছবিটি ফুটে ওঠে। ইয়ুং-এর ব্যাখ্যায় এইসব প্রতীকের মধ্যে নিহিত থাকা অর্থগুলি হল — স্বপ্নদ্রষ্টার আদিম প্রবৃত্তিতাড়িত হওয়া, প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার চেষ্টা, ভয় ও অসহায় ভাব: আদিম মন ও বুদ্ধিযুক্ত মনের দ্বন্দ্ব: এই দ্বন্দ্বের মাধ্যমে অচেতন থেকে পাঠানো ভাষা। 

মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় স্বপ্নে ব্যবহৃত প্রতীকের (Symbol) অনেক অবদান আছে। স্বপ্নে ব্যবহৃত এই প্রতীকের মধ্যমেই স্বাভাবিক মনে দু-টি কাজ সুসম্পন্ন হয় — প্রথমত চেতন ও অচেতন মনের মধ্যে সুসংহত যোগাযোগ সংরক্ষিত থাকে; দ্বিতীয়ত চেতন ও অচেতন মন সমান্তরালভাবে চলতে থাকে। তার ফলে দুই মনের দ্বন্দ্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। চেতন ও অচেতন মনের অবস্থান বিচ্ছিন্ন হলে মানসিক যন্ত্রণা ও বিকার আরম্ভ হয়। স্বপ্নে প্রতীকরাই অচেতন মনের ভাব-দূত হয়ে চেতন মনের যুক্তিবোধের কাছে আসে। প্রতীকের অর্থ নির্ণয় করে চেতনা সমৃদ্ধ হয়— এই ভাবে চেতনমন অচেতনমনে বাসাবেঁধে থাকা পাশব প্রবৃত্তির ভাব ও ভাষা বুঝতে শেখে। প্রতীকের মধ্যে নিহিত থাকা ভাব প্রায়শই অবোধ্য ও দুর্বোধ্য হয়ে থাকে তাই এই ভাব বোঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে খুব সহজ কাজ নয়। স্বাভাবিক জীবনে স্বপ্নের কোনও অর্থ আছে এটাই সকলে মেনে নিতে চায় না। 

ইয়ুং-এর মতে এই প্রতীকগুলো কিন্তু কোনও ব্যক্তি বসে বসে সচেতন ভাবে তৈরি করেনি, এর পেছনে কোনও যুক্তিশানিত চেতনচিন্তাও নেই। সচেতন যুক্তিবোধ বা চিন্তা থেকে প্রতীক এমন কিছুর ইঙ্গিত দেয়, যার সবটা অনেক সময় বোঝা যায় না। স্বপ্নে প্রতীক স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। স্বপ্ন নির্জ্ঞানমন থেকে আপনা আপনি আসে — তা ইচ্ছে করে চেতন মন দিয়ে কেউ তৈরি করে না। 

এমন অনেক প্রতীক আছে যা ব্যক্তিগত নয়, বরং সেগুলির প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা য়ায় তাদের উৎপত্তি স্থল থাকে যৌথচেতনা বা মগ্নচৈতন্য (Collective Unconscious)-র মধ্যে প্রোথিত। বহু প্রাচীন কালেই ধর্মীয় মূর্তি বা চিহ্নের উদ্ভব ঘটেছে। আবার অনেক সময় এই সকল চিহ্নের উৎস খুঁজেও পাওয়া যায় না। আদিযুগের মানুষের স্বপ্ন ও মনের সৃজনধর্মী কল্পনা থেকেই এদের উৎপত্তি বলে অনুমান করা যায়। আর তার জন্যই নির্জ্ঞান মন থেকে এইসব প্রতিকৃতি ও প্রতীকের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে বলেও অনুমান করা যায়। তবে এগুলিকে কোনোভাবেই চেতন মনের ভাবনা-চিন্তার প্রকাশ বলা যায় না। 

ফ্রয়েডের মতে স্বপ্নের ব্যাখ্যা ঠিক না হলে স্বপ্নের অন্তর্লীন অর্থ বোধগম্য হয় না। দৃষ্ট স্বপ্ন সব সময়ই অবগুণ্ঠনের আড়ালে নানা আপাত অনর্থের সাজে সজ্জিত হয়ে আসে। স্বপ্নে প্রকাশিত আপাত অর্থকে ভেদ করে সেই সজ্জার ভাঁজে ভাঁজে লুক্কায়িত আসল অর্থ খুঁজে বের করতে হয়। এই মর্মেই ইয়ুং-এর নতুন সংযোজন— স্বপ্নে আসা প্রতীকের গূঢ়ার্থ না বুঝলে স্বপ্নের অর্থও বোঝা যায় না। 

প্রতীকের উপর ইয়ুং-এর দেওয়া গুরুত্ব ও ব্যাখ্যা প্রদানের ফলে স্বপ্ন ও তৎসহ অন্যান্য সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টির ব্যাখ্যাও অনেক স্পষ্ট হয়েছে। দৈহিক বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানবমনেরও বিবর্তন ঘটেছে, তাই এই সকল প্রতীকের শেকড় প্রাগৈতিহাসিক বা ঐতিহাসিক সকল পর্বের মধ্যেই প্রোথিত আছে। মাতৃগর্ভে শিশুভ্রূণের বিকাশ প্রাগৈতিহাসিক স্তরের মধ্য দিয়ে যায়। আবার, ঠিক সেইরকম মনের গঠন ও বিকাশ প্রাগৈতিহাসিক বিকাশ পর্যায়ের মধ্যে দিয়েই যায়। আদিম মানুষের মনের নানা বিবর্তিত অবস্থা ও স্বরূপ অভিযোজিত হয়ে মানবশিশুর মন গঠনে বিশেষ ভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। তাই-তো স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে আদি মানবমন মাঝে মাঝে উঁকি দেয়। 

শিশু চেতনে ও অচেতনে ধীরে ধীরে তার নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা গঠনের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। একদিকে থাকে একান্তই অন্ধ প্রবৃত্তিতাড়িত আদিম মনের সত্তা অন্য দিকে থাকে প্রগতিবাদী আধুনিক মন — এই দুই-এর মধ্যে সংঘাত লেগে থাকে। পরিণত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার শৈশব স্মৃতি আদি মনের প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে এক নতুন মনোভূমি তৈরি করে। ফ্রয়েডের নির্জ্ঞান মনের ধারণা আর ইয়ুং-এর নির্জ্ঞান মনের ধারণার মধ্যে পার্থক্য এখানেই।

প্রবৃত্তি তাড়িত আদিম মন ও যুক্তি-বুদ্ধি যুক্ত আধুনিক মনের এই দ্বন্দ্বের নিরসনে প্রতীকের অমোঘ আবির্ভাব বলে ইয়ুং মনে করেন। আর এর থেকেই তিনি নির্জ্ঞান মনের কাজের বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। ইয়ুং পুরাণের কাহিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন— মনের স্বরূপ, মনের মধ্যে বিরাজিত শুভাশুভশক্তির মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং তার ফলে শুভশক্তির জয় ও অশুভশক্তির পরাজয়ের প্রতীকী বিন্যাস এই সকল কাহিনির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। আর এখানেই মনোবিজ্ঞানে ইয়ুং-এর অভিনব অবদান। 

যুগ্ম-বৈপরীত্যের ধারণা

অহম্, ব্যক্তিগত অচেতন ও যৌথ অচেতন বা মগ্ন চেতন কোন নীতি মেনে ক্রিয়াশীল থাকে তা নিয়েও মন্তব্য করেন ইয়ুং। মনস্তত্ত্বের নীতি হিসেবে প্রথমেই মানতে হয় ‘বৈপরীত্যের নীতি’, যে কোনও মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়ারই প্রেক্ষাপটে অবস্থান করে এক ধরনের বৈপরীত্য। আলোর চিন্তা করতে বুঝতে হয় অন্ধকারকে, ভালো কাজ করতে হলে মন্দ কাজ-সম্পর্কীয় ধারণা নিতে হয়। এমন সব যুগ্ম-বৈপরীত্যের ধারণা ইয়ুং-এর মতাদর্শে পাওয়া যায়। 

ইয়ুং আরও বলেন যে, মানুষের কামপ্রবৃত্তির অন্তর্গত বিষয়গুলোতেও বৈপরীত্য ভিত্তিক মনস্তাত্ত্বিক শক্তি সমান ভাবে বর্তমান থাকে। ভালোবাসা/ঘৃণা, এই দুই বৈপরীত্যকে বিশ্লেষণ করলে ‘ভালোবাসা’ ও ‘ঘৃণা’-র মনস্তাত্ত্বিক শক্তি যে সমান, এ-সত্যকে অস্বীকার করতে পারা যায় না। ইয়ুং-এর মতাদর্শে উল্লেখিত যুগ্ম-বৈপরীত্যের সমমানের মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকে ‘সমমাত্রার নীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। একজন মানুষ মনস্তাত্ত্বিক বৈপরীত্যের মধ্যে থেকে কোনটাকে গ্রহণ করবে সে বিষয়ে কোনও সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তার মানসপটে সৃষ্টি হয় এক ধরনের কমপ্লেক্স। কোনও একজন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া সময়কে মান্যতা দিয়ে বিভিন্ন মাত্রায় অবস্থান করে — একজন তরুণ বা তরুণীর যৌন-বাসনা যে মাত্রায় থাকবে, সেই একই মাত্রায় কোনো প্রৌঢ় বা প্রৌঢ়ার কাছে তা আশা করা যায় না। দেশকালকেন্দ্রিক মনস্তাত্ত্বিক এই বিবর্তনকে ইয়ুং ‘পতনের নীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। 

প্রায়োগিক মনস্তত্ত্বের বিষয় হিসেবে মানুষের অন্তর্মুখীনতা ও বহির্মুখীনতার বিস্তারিত বর্ণনাও দিয়েছেন ইয়ুং। অহম্, ব্যক্তিগত অচেতন ও যৌথ অচেতনের বা মগ্নচেতন — বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের উপর একজন মানুষের অন্তর্মুখীনতা বা বহির্মুখীনতা এবং সংবেদন, প্রত্যক্ষণ, চিন্তন ইত্যাদি মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া-কলাপের অন্যান্য উপাদানের কার্যকারিতা নির্ভর করে। ইয়ুং বিস্তারিতভাবে সামাজিক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন বটে কিন্তু তাঁর সব প্রকল্প সমানভাবে সবার কাছে গ্রাহ্য হয়নি। তবে এ কথাও সত্য যে, যৌথ বা মগ্ন অচেতনের বিশ্লেষণ ছাড়া সামাজিক মানুষকে সঠিক ভাবে চেনার অন্য কোনো উপায়ও নেই।

গুরু ও শিষ্য

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের থেকে উনিশ বছরের ছোটো কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং। ইয়ুং ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, জনমুখী, বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি সংযুক্ত ও বহু চর্চিত ব্যক্তি এবং সর্বোপরি একজন সুইস প্রটেস্ট্যান্ট যাঁর শরীরে একফোঁটাও ইহুদি রক্ত ছিল না। এই ইয়ুং-এর মেধা দেখে ফ্রয়েড চমৎকৃত হয়েছিলেন। এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েড ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৭-এ ভিয়েনার বার্গাসে তাঁর প্রেমে পড়লেন। এ যেন ‘মেঘ না চাইতেই জল’-এর মতো ফ্রয়েডের কাছে ইয়ুং-এর আবির্ভাব। ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন, ‘একমাত্র তাঁর উপস্থিতিই মনোসমীক্ষণ তত্ত্বকে ইহুদি প্রসঙ্গ থেকে মুক্তি দেয়’।

প্রকৃতপক্ষে তাঁদের সাক্ষাতের আগেই শিষ্য ইয়ুং গুরু ফ্রয়েডকে তাঁর প্রথম উপহারটি দিয়েছিলেন। সেটা ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ, ইয়ুং তাঁর শব্দানুষঙ্গ পরীক্ষা বা ‘ওয়ার্ড-অ্যাসোসিয়েশন টেস্ট’ প্রয়োগ করেছিলেন ফ্রয়েডের মুক্তানুষঙ্গ (ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন) তত্ত্বের ওপর। এটা ছিল অবদমিত স্মৃতি উদ্ধারের এক গুরুত্বপূর্ণ উপায়। আবার, এটাই ছিল মনোসমীক্ষণের প্রথম অভীক্ষামুলক পরীক্ষাগুলোর একটি। এই পরীক্ষার ফলাফল যেভাবে তাঁর তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতালব্ধ সমর্থন জুগিয়েছিল তাতে ফ্রয়েড স্বাভাবিকভাবেই উল্লসিত হয়েছিলেন। 

বিজ্ঞানের ছাত্র সিগমুন্ড ফ্রয়েড নিজেকে একজন লজিক্যাল পজিটিভিস্ট বলেই মনে করতেন। তাই তিনি বরাবরই তাঁর মনোসমীক্ষণ তত্ত্বকে বিজ্ঞান হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। মনোসমীক্ষণ প্রাথমিকভাবে অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল বটে, তবুও ফ্রয়েড নিশ্চিত ছিলেন যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলে এই তত্ত্বের সমর্থনে নিশ্চয়ই প্রমাণ পাওয়া যাবেই। আর, ইয়ুং সেই দিকেই বড়ো একটা অবদান রেখেছিলেন। ফলে ইয়ুং-এর প্রতি তাঁর এই ভালোবাসা অনেকাংশেই ছিল ফ্রয়েডের আত্মমগ্নতারই এক বর্ধিত রূপ, কোনও মতেই অস্বাভাবিক নয়। ফ্রয়েড ইয়ুংকে লিখছেন, ‘তোমার উপস্থিতি আমাকে ভবিষ্যতের প্রতি আস্থাশীল করেছে’। আর, এই অনুরাগ চূড়ান্ত আদলে পৌঁছোলে ফ্রয়েড হয়ে ওঠেন পিতা আর ইয়ুং পুত্র। ইয়ুং হয়ে উঠলেন অফিশিয়ালি ফ্রয়েডের উত্তরসূরী — তিনি মনোসমীক্ষণের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে চাইলেন ইয়ুং-এর হাত ধরেই।

লিবিডো তত্ত্ব প্রণয়নের পর ফ্রয়েড নিশ্চিত ছিলেন যে মানুষের যাবতীয় ইচ্ছা, কীর্তি ও কামনার পেছনে একটাই চালিকা শক্তি কাজ করে, যা আসলে যৌনতা থেকে উদ্ভূত। মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের পুরোটাই ফ্রয়েডের মতে লিবিডো তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে। সুতরাং, যৌনতা বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করার অর্থ গোটা তত্ত্বটাকেই চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করানো। যে সকল মনোসমীক্ষকের সঙ্গে ফ্রয়েডের বনিবনা হয়নি তাঁদের বেশিরভাগের সঙ্গেই তাঁর মতান্তরের বিষয় ছিল যৌনতা নিয়ে। আর, এই নিয়ে প্রথম থেকেই ইয়ুং-এর মনে সন্দেহ ছিলই; তিনি মনে করতেন যৌনতাই মৌলিক চালিকাশক্তির একমাত্র উৎস নয়। তবে, ফ্রয়েড শুরুতে ভেবেছিলেন ইয়ুং-এর এই ধারণা তিনি অচিরেই কাটিয়ে তুলতে পারবেন, তা কিন্তু সম্ভব হয়নি। তাই এক গভীর দার্শনিক কারণ তাঁদের মধ্যকার সম্পর্কে অচিরেই চিড় ধরায়। 

আর, ১৯১২-এর দিকে তাঁদের সম্পর্কের ফাটল আরও চওড়া হতে থাকে। ফ্রয়েড ‘টোটেম ও ট্যাবু’ প্রকাশ করেন ১৯১৩-এ। তিনি দেখাতে চান ধর্ম উদ্ভবের কারণটি নিহিত থাকে ইডিপাস কমপ্লেক্সের ভেতর। অন্যদিকে ইয়ুং কিছুটা অদ্ভুত বিকল্প যুক্তি বিস্তার করছেন। এই যুক্তির মধ্যে সুপ্ত থাকছে তাঁর বিখ্যাত আর্কিটাইপ ও মগ্ন চেতনের (Collective Unconscious) মতো ধারণাগুলির বীজ। তাঁর থেকেও বড়ো কথা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে ইয়ুং লিবিডোকে নতুন করে দেখতে চাইছেন একটি আত্মিক চালিকাশক্তি (Mental Energy) হিসেবে।

সম্পর্কটা খুবই তিক্তভাবে শেষ হয় — বন্ধুত্ব ভরে ওঠে বিদ্বেষে; ১৯১৩-এর মিউনিখ কনফারেন্সে খুব অস্বস্তিজনক সাক্ষাতের পর থেকে ফ্রয়েড এবং ইয়ুং-এর মধ্যে আর প্রায় কখনোই কথা হয়নি। তাঁদের বিচ্ছেদের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান