মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতাতত্ত্ব

ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়

(ইসভান মেসজারোস রচিত ‘Marx’s Theory of Alienation’ গ্রন্থের আলোচনা।)

১৯৩২ সালে কার্ল মার্কস-এর ‘ইকনমিক অ্যান্ড ফিলজফিক ম্যানাসক্রিপটস’ একযোগে জার্মান, রুশ ও ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়; তারপর থেকে এই বইটিকে কেন্দ্র করে তর্ক-স্রোতের আর বিরাম নেই। এই শ’দুয়েক পাতার পুস্তিকাটির অসংখ্য ব্যাখ্যা ও সমালোচনা-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সমালোচক ও ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে কমিউনিস্টদের চেয়ে কমিউনিস্ট-বিরোধীদের সংখ্যা বোধহয় বেশি। মার্কস-এর এই ‘ম্যানাসক্রিপটস’-এর প্রধান আলোচ্য বিষয় বিচ্ছিন্নতা ও বিচ্ছিন্নতা থেকে উত্তরণের বা বিচ্ছিন্নতা-অতিক্রমণের ধারণা ও কল্পনা। গত কয়েক বছরে ঐতিহাসিক কারণেই এই আলোচনার গুরুত্ব বেড়েছে। আমার মনে হয় বিচ্ছিন্নতাবোধ ও বিচ্ছিন্নতা নিরসনের ধারণা সংক্রান্ত সব আলোচনাই অতিমাত্রায় ‘টেকনিক্যাল’ ও জটিল হওয়ার দরুন অনেকক্ষেত্রে দুর্বোধ্যতার পর্যায়ে রয়ে গেছে এবং তারই সুযোগ নিয়ে কিছু সংখ্যক তাত্ত্বিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্বকে সহজবোধ্য করার নামে ‘ভালগারাইজ’ করেছেন।

আমাদের আলোচ্য পুস্তকটি [১] সহজপাঠ্য নয়, কিন্তু দুর্বোধ্যতার পর্যায়েও পড়ে না। বিচ্ছিন্নতা সংক্রান্ত আলোচনায় মার্কস-এর ‘ম্যানাসক্রিপটস’-এর প্রধান বক্তব্যকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা নেই। গ্রন্থকার প্রথমেই বলেছেন যে, মার্কস-এর বহুমাত্রিক সংক্ষিপ্ত সূত্র আপাতদৃষ্টিতে সরল, কিন্তু বোধগম্যতার দিক থেকে দুরূহ [২]; কাজেই ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ ও বিপদ দুইই দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি থেকে কোনো কোনো তাত্ত্বিক ‘র‍্যাডিক্যাল নিউ মার্কস’-এর সন্ধান পেয়েছেন। এই ‘মার্কস’-এর সঙ্গে পরবর্তীকালের ‘মার্কস’-এর মৌলিক তত্ত্বগত বিরোধ দেখা দিয়েছে। আবার কেউ বা মার্কসকে বিকৃত করার উদ্দেশ্য নিয়েই অংশবিশেষকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আর. সি. টাকার-এর নাম এই সূত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য।[৩]

গ্রন্থলেখক এদেশে খুব বেশি পরিচিত নন। হাঙ্গেরিতে জন্ম। লুকাকস-এর অধীনে গবেষণা করেছেন। ‘স্যাটায়ার’ নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ লিখে তাঁর লেখক জীবনের আরম্ভ। ১৯৫৬ সালের নভেম্বর মাসে টুরিনে সহকারী অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করে তিনি হাঙ্গেরি ত্যাগ করেন। বর্তমানে ইংলন্ডের সাসেক্সে অধ্যাপনায় নিযুক্ত রয়েছেন। সাহিত্য ও দর্শন সম্বন্ধীয় বহু প্রবন্ধও লিখেছেন। হাঙ্গেরি, ইতালি, ইংলন্ড, ফ্রান্স, আমেরিকার নামকরা পত্রপত্রিকায় এইসব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থকার তাঁর শিক্ষক জর্জ লুকাকস-এর মতোই দর্শন, অর্থশাস্ত্র, সমাজবিদ্যা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত। কাজেই তাঁর গ্রন্থে মার্কসীয় ব্যাখ্যায় বিচ্ছিন্নতার আলোচনা অনেকখানি অখণ্ডিত রূপ পেয়েছে।

মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, নিজের সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন, অন্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন, মানবপ্রজাতি থেকে বিচ্ছিন্ন — এ সবই শ্রম-বিচ্ছিন্নতার ফল। মার্কসীয় মূলসূত্রের এই চারটি অবয়ব প্রথম পঠনে খুবই সহজবোধ্য মনে হয়। আসলে ব্যাপারটি বেশ জটিল। ভূমিকাতে গ্রন্থকার এই অবয়বগুলির জটিলতার আভাস দিয়েছেন এবং পরে ব্যাখ্যার সাহায্যে জটিলতা দূর করার চেষ্টা করেছেন। বিচ্ছিন্নতা অতিক্রমণের তত্ত্বটিও যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়েছে। বস্তুত গ্রন্থকার এই কথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে উত্তরণ, বিচ্ছিন্নতার সীমা অতিক্রমই বিচ্ছিন্নতাতত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য।[৪] যাঁরা কেবলমাত্র বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে মার্কস-এর বিশ্বপ্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছেন তাঁরা মার্কস-এর প্রতি অবিচার করেছেন, মার্কসবাদকে বিকৃত করেছেন। আবার অন্যদিকে যাঁরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা যদি বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্বকে অবহেলা করে এখনও দূরে সরিয়ে রাখতে চান, তবে মার্কস ও মার্কসবাদের প্রতি সমান অবিচার করা হবে। ইতিহাসে এই প্রথম ধনতন্ত্রের একেবারে বনিয়াদে পৃথিবীব্যাপী কাঁপন লেগেছে; শ্রম থেকে, সত্তা থেকে, প্রজাতি থেকে, অন্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার দিন শেষ হয়ে আসছে। এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে, এমনকি তিরিশের দশক পর্যন্ত যে আলোচনাকে বুদ্ধিজীবীদের ‘ব্যায়াম’ নাম দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখা চলত, আজ আর সেই আলোচনাকে শ্রমিক আন্দোলনের বিষয় সূচির বাইরে রাখা চলছে না। যতদিন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা আংশিকভাবে বা এক-আধটি দেশে প্রতিষ্ঠিত ছিল, ততদিন সামগ্রিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিচ্ছিন্নতা বিমোচনের, — “পজিটিভ ট্রানসেনডেন্স অফ লেবারস সেল্‌ফ অ্যালিয়েনেশন” — ধারণার অবস্থান ছিল পশ্চাদভূমিতে।[৫]

তখনও ধনতন্ত্রে দুনিয়াজোড়া সঙ্কট দেখা দেয়নি, সারা পৃথিবীর সামাজিক আর্থনীতিক ব্যবস্থার আশু আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভূত হয়নি, তাই বিচ্ছিন্নতা ও তার নিরসনের সমস্যা সাধারণকে পীড়িত করেনি। জগৎজোড়া সর্বাত্মক সঙ্কটের সমাধানে সামগ্রিকভাবে প্রযোজ্য প্রতিকারবিধির প্রয়োজন। তা বলে একথা যেন মনে করা না হয় যে এই প্রয়োগে রাতারাতি কোনো ফল পাওয়া যাবে অথবা মার্কস-এর এই বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্ব ত্রাণকর্তার অমোঘ অব্যর্থ ত্রাণমন্ত্র। গ্রন্থকারের বক্তব্য এই যে, এ যুগের প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের দৈনন্দিন সমস্যা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও বিচ্ছিন্নতা নিরসনের প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত।

বছর-পাঁচেক আগে পোল্যান্ডের অ্যাডাম শাফ এই প্রসঙ্গে প্রায় একই ধরনের অভিমত প্রকাশ করেছিলেন, যদিও মার্কসীয় বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্বের বিচারে তিনি ছিলেন ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক এরিক ফ্রমের বিশিষ্ট ধ্যান-ধারণার দ্বারা প্রভাবিত। তিনিও বলেছিলেন যে, মার্কস-এর প্রথম দিককার লেখা দুটি গুরুত্বপূর্ণ রচনার (ইকনমিক অ্যান্ড ফিলজফিক ম্যানাসক্রিপটস ১৮৪৪ এবং দি জার্মান ইডিওলজি) সঙ্গে কমিউনিস্টদের পরিচয় ঘটেছে একান্ত হালে। প্লেখানভ ও লেনিন এবং কাউটস্কি ও রোজা লুক্সেমবুর্গ যদি এই দুটি পুস্তকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত থাকতেন, তাহলে তাঁরা মার্কস-এর পরবর্তীকালের তত্ত্বগুলির ব্যাখ্যা হয়তো ভিন্নভাবে করতেন। স্তালিনযুগে তরুণ মার্কস-এর রচনাবলীর দিকে নজর দেবার রেওয়াজ ছিল না। ব্যক্তিগত সমস্যা অথবা মানবতাবাদ চর্চার আবহাওয়া তিরিশের যুগে তৈরি হয়নি।[৬] তাই পশ্চিমি পণ্ডিতদের কাছে সমাদৃত হল তরুণ মার্কস-এর ‘ম্যানাসক্রিপটস’ ও ‘ইডিওলজি’। আর মার্কস-এর মানবতা সম্পর্কিত দার্শনিক বক্তব্যের ভক্ত হলেন পূর্ব-জার্মানির আর্নস্ট ব্লক ও পোল্যান্ডের লেসজেক কোলাকৌস্কির মতো শোধনবাদী কমিউনিস্ট। তরুণ-মার্কস-এর বক্তব্য আর পরিণত মার্কস-এর বক্তব্যের মধ্যে বিপরীত মতাবলম্বীরা নিজেদের বিপরীত মতের সমর্থন খুঁজে পেলেন। পশ্চিমি পণ্ডিত আর ঐসব শোধনবাদীরা তরুণ মার্কসকে নিয়ে পরিণত মার্কস-এর ‘ক্যাপিটাল’ ও এঙ্গেলস-এর ‘অ্যান্টি ডুরিং’-এর মতবাদকে খণ্ডন করার চেষ্টা করলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরাই হলেন তরুণ মার্কসের গোঁড়া সমর্থক। টাকার  বললেন, মার্কসকে অর্থনীতি রাজনীতি বা সমাজবিদ্যার পণ্ডিত মনে করা যুক্তিযুক্ত নয়, তিনি আসলে ধর্মনীতির প্রচারক। কথাগুলো অদ্ভুত শোনালেও সত্যি, টাকার [৮] সত্যিই এইরকম লিখেছেন। পরিণত মার্কস, টাকারের মতে, মৌলিকত্ব হারিয়ে নিজের সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। আবার অন্যদিকে, সরকারি মার্কসবাদের সমর্থকরা (যাঁরা দুই মার্কসকে ভিন্ন বক্তব্যের প্রবক্তা বলে মনে করেন) তরুণ মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্বকে কাঁচা হাতের লেখা বলে একেবারে উড়িয়ে দিয়ে পরবর্তীকালের লেখার মধ্যেই খাঁটি মার্কসবাদের সারবস্তু খুঁজে পেয়েছেন। অ্যাডাম শাফ (১৯৬৬) এই মত প্রকাশ করেছিলেন যে — মার্কস এক, মার্কসবাদও একটি। মার্কস-এর চিন্তাধারা ক্রমশ পরিণতি লাভ করেছে, মতবাদ ক্রমশ পুষ্ট, প্রসারিত হয়েছে। তাঁর ধারণার কোনো গুণগত মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতাতত্ত্ব ও পরবর্তীকালের পুঁজিকেন্দ্রিক তত্ত্বের মধ্যে মৌলিক কোনো বিরোধ নেই। প্রমাণ হিসেবে তিনি ও তাঁর সমর্থকরা মার্কসের পরবর্তীকালের রচনা থেকে দু’-একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন। বলার ভঙ্গি, ভাষা, স্টাইল ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটলেও মানুষ সম্পর্কিত দার্শনিক মতবাদের পরিবর্তন ঘটেনি। শাফ মনে করেন বরং তাঁর তরুণ বয়সের রচনা তাঁর পরিণত ভাবধারা ও মতবাদকে বুঝতে সহায়তা করে। অ্যাডাম শাফ ও তাঁর সমর্থকরা (সমর্থকদের মধ্যে বেশির ভাগ হলেন পশ্চিমি বুর্জোয়া পণ্ডিত ও তথাকথিত শোধনবাদী) ‘ম্যানাসক্রিপটস’ ও ‘জার্মান ইডিওলজি’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে [৯] দেখালেন যে, মার্কসবাদীদের পক্ষে সব থেকে বড় ও বাধ্যতামূলক কাজ হল মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, মনুষ্যোচিত গুণবর্জিত পৃথিবীর ক্লেদ থেকে মানুষকে মুক্ত করা।

অ্যাডাম শাফ-এর প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে বিচ্ছিন্নতা আলোচনা এসে পড়ল। মেসজারোসের আলোচ্য পুস্তকটির বছর চারেক আগে শাফ-এর ‘মার্কসিজম অ্যান্ড দি ইনডিভিজুয়াল’ বইটি প্রকাশিত হয়। পোলিশ পার্টির কোনো শীর্ষস্থানীয় তাত্ত্বিক শাফ্‌-এর আগে কখনও সরকারি পার্টির সমালোচনা করেননি। তিনিই প্রথম সমালোচকের ভূমিকা নিলেন। কমিউনিস্ট নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যকলাপের ফলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাঞ্ছিত পরিবর্তন ঘটছে না, আন্তর্মানবিক সম্পর্কের, রাষ্ট্র ও পার্টির সঙ্গে ব্যক্তিসাধারণ ও কেডার-সাধারণের সম্পর্কের উন্নতি ঘটছে না। এক অন্ধগলিতে এসে প্রগতির স্রোত যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। এর মূলে শাফ মনে করছেন, আছে মার্কস-এর সঠিক শিক্ষার প্রতি অবহেলা, তরুণ মার্কসীয় ‘সমাজবাদী মানবতা’র প্রতি অশ্রদ্ধা ও বিচ্ছিন্নতাতত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতা। শুধু বিমূর্ত মানুষের নয়, ব্যক্তিমানুষের জন্যই সমাজতন্ত্র। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যদি ব্যক্তিমানুষের সুখ-দুঃখে উদাসীন থাকে তবে সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য বিফল হতে বাধ্য। বিপ্লব সামাজিক অন্যায়-অবিচারের প্রতিবিধানকল্পে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে (পোল্যান্ড) অন্যায় অবিচার রয়েই গেছে। মার্কস লিখেছিলেন, ব্যক্তিসম্পত্তির বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটবে।[১০] কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলছে। মার্কস-এর ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়নি।[১১] কেবলমাত্র ব্যক্তিসম্পত্তির বিলোপ বিচ্ছিন্নতার নিরসন ঘটায় না, এমনকি অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতাও এর ফলে বিলুপ্ত হয় না। (মার্কস-এর বক্তব্যের সঠিক ব্যাখ্যা করেননি শাফ। তরুণ মার্কস-এর ধারণা ও বিচ্ছিন্নতা নিরসনের সার্বিক উপায়-পদ্ধতি থেকে পৃথক করে দেখে শাফ সেই ভুলই করেছেন, যা তাঁর মতে বুর্জোয়া পণ্ডিত ও শোধনবাদীরা করেছিলেন : ধী.গ.)। মানুষেরই সৃষ্ট বস্তু-প্রতিষ্ঠান যখন মানুষের প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজস্ব নিয়মে চলে ও নিজের শক্তিতে ব্যক্তিমানুষকে শৃঙ্খলিত করে, তখন বিচ্ছিন্নতার বিকাশ ঘটে। সমাজের স্রষ্টা মানুষ যদি সামাজিক আইন-কানুনের নিগড়ে বাঁধা পড়ে সত্তা ও স্বাধীনতা থেকে বিযুক্ত হয়, যদি অন্ধ সামাজিক শক্তির নিষ্পেষণে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, তাহলে তার উচিত যে করেই হোক সমাজের উপর, সামাজিক শক্তির উপর নিজের প্রভাব ফিরিয়ে আনা। বিচ্ছিন্নতার নিরসনের চেষ্টা মানে মানবমুক্তির সংগ্রাম, সত্যিকারের ব্যক্তি-স্বাধীনতার সংগ্রাম। শাফের পুস্তক প্রকাশের বেশ কিছুদিন আগে (১৯৫৭) সার্ত্র একটি পত্রিকায় লেখেন যে, অস্তিবাদী বিচ্ছিন্নতার সমস্যা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও বিদ্যমান।[১২] আসলে বিচ্ছিন্নতার সমস্যা অস্তিত্বের সমস্যা, ধনতন্ত্রের সমস্যা নয়।[১৩] মার্কসীয় তত্ত্বের এই বিরোধিতা সে সময় শাফ সহ্য করেননি। অন্যান্য অনেকের সঙ্গে শাফও সার্ত্রের বিরুদ্ধে তর্কযুদ্ধে নেমেছিলেন। যদিও তখন তিনি ব্যক্তি-স্বাধীনতার সপক্ষে ওকালতি করছিলেন, কিন্তু সরাসরিভাবে পার্টি বা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কিছু লেখেননি।[১৪] বুর্জোয়া পত্রিকার মতে তিনিও ছিলেন শোধনবাদী, কিন্তু গোঁড়া ধরনের। তাঁর সমালোচনার উদ্দেশ্য ছিল পার্টির শক্তি বাড়ানো ও পার্টির আধিপত্যকে আরও সুদৃঢ় করা। [১৫] পরবর্তী সময়ে সরকারি সমালোচনায় যখন তিনি মুখর হয়ে উঠলেন, তখন অল্পসংখ্যক সমালোচক তাঁর সপক্ষে এলেন, বেশির ভাগই গেলেন বিপক্ষে। তাঁর পুস্তকের মধ্যে যে সব ঘটনার উল্লেখ ছিল (পার্টি ও রাষ্ট্র পরিচালনার ত্রুটিবিষয়ক) সেইগুলো নিয়েই খুব হইচই হল; তত্ত্বগত বক্তব্য সম্পর্কে বেশি উচ্চবাচ্য করা হল না।[১৬] 

অ্যাডাম শাফ-এর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত ধারণা অস্তিবাদ প্রভাবিত। শাফ-এর সমালোচকরা সে সম্বন্ধে খুব বেশি সজাগ নন। তাঁদের প্রধান আপত্তি তথ্যমূলক ভুল-ত্রুটির উল্লেখে। এ থেকে আমার মতো সীমিত জ্ঞানের লোক যদি মনে করে যে, সমাজতান্ত্রিক দেশে তাত্ত্বিক আলোচনায় ক্রমশ ভাটা পড়ছে, তত্ত্ব ও তথ্যের ডায়ালেকটিক সম্পর্কে ছেদ পড়ছে, আপাতসুবিধাবাদ মার্কসবাদকে বিকৃত করতে চলেছে — তাহলে তাদের খুব দোষ দেওয়া যায় কি? সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্ব তাত্ত্বিকরা অস্বীকার করতে পারেন না, তাই হয়তো অনেকে বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্বকেই অস্বীকার করতে চান।

নিও-ফ্রয়েডীয়ান ও অস্তিবাদী দার্শনিকদের বস্তুবাদবিরোধী সুকৌশলী আক্রমণের উপযুক্ত ধারালো কোনো উত্তর বোধহয় কমিউনিস্ট তাত্ত্বিকরা বোধহয় দিতে চান না, তাই পার্টির শিল্পী-সাহিত্যিকরা নিজেদের অজ্ঞাতে মনে মনে ভাববাদাশ্রিত ধারণা পোষণ করেন। অনেক সময় তাঁদের শিল্পকৃতির মধ্যে সেটা প্রকাশ হয়ে পড়ে। ব্যক্তি-সম্পর্কের ব্যাপারে অস্তিবাদী বিচ্ছিন্নতাতত্ত্বকে অথবা ফ্রয়েডীয় লিবিডো-তত্ত্বকে মেনে নেবার ফলে এঁদের নিজেদের জীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে সহাবস্থান নীতি গ্রহণ করার অতি উৎসাহে অথবা মার্কসীয় তত্ত্বের আলোচনার উপর গুরুত্বের অভাবে অনেক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে ও আরও হবার সম্ভাবনা রয়েছে। চেকোশ্লোভাকিয়ায় কাফকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরবর্তী অধ্যায়ের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এইরূপ এক বিপর্যয়ের নিদর্শন। এই অবস্থায় মেসজারোস-এর বিচ্ছিন্নতা বিষয়ক সুদীর্ঘ তাত্ত্বিক আলোচনার এই গ্রন্থটি আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের কাছে বিশেষ মূল্যবান মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

বইটি তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে তিনটি অধ্যায়ে আছে মার্কসীয় তত্ত্বের উদ্ভব ও গঠন সম্পর্কে আলোচনা। দ্বিতীয় খণ্ডে চারটি অধ্যায়: বিচ্ছিন্নতার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিচার। তৃতীয় খণ্ডে আবার তিনটি অধ্যায়: বিচ্ছিন্নতার সমকালীন তাৎপর্য এই খণ্ডে বিশেষভাবে আলোচিত। সার্ত্র, শাফ বা ফিশারের মতো আলোচ্য লেখক কোথাও মার্কসীয় তত্ত্বের ব্যাখ্যায় অস্তিবাদী দর্শন বা ফ্রয়েডীয় নির্জ্ঞানের শরণাপন্ন হননি; এইখানেই তার বৈশিষ্ট্য। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বজায় রেখেই তিনি বিচার করেছেন।

প্রথম দুটি খণ্ডের চেয়ে তৃতীয় খণ্ড অপেক্ষাকৃত সরল ও বেশি কৌতূহলোদ্দীপক। প্রথম অধ্যায়ে তরুণ ও পরিণত মার্কস-প্রসঙ্গ, দ্বিতীয় অধ্যায়ে ব্যক্তি ও সমাজ প্রসঙ্গ ও তৃতীয় অধ্যায়ে শিক্ষাসঙ্কট-প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। সব পাঠকই শেষের অধ্যায় তিনটি পড়ে বিশেষভাবে উপকৃত হবেন। অষ্টম অধ্যায়টিতে তরুণ বনাম পরিণত মার্কস-এর বিতর্কটি সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। অ্যাডাম শাফের মতো অস্তিবাদের দ্বারস্থ না হয়েই লেখক সপ্রমাণ করেছেন যে, বিচ্ছিন্নতাতত্ত্ব মার্কস কোনোদিনই পরিত্যাগ করেননি। পরিণত মার্কস-এর মধ্যেই তরুণ মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতাতত্ত্বের ক্রমবিকাশ ও পরিণতি।

তিনি প্রথমে জন ম্যাকমারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, [১৭] তরুণ ও পরিণত মার্কসকে পৃথক করে দেখা দ্বন্দ্বমূলক বিচারসম্মত নয়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাজনীতির দিক থেকে দুই বিপরীত আদর্শের পণ্ডিতরা এই ভুল করেছেন; একদল তরুণ মার্কসকে মাথার তুলে নিয়েছেন, অন্যদল পরিণত মার্কসকে শুধু গ্রাহ্য করেছেন। ম্যাকমারে এই মন্তব্য করেছেন ১৯৩৫ সালে। তারপর এই প্রবণতা কমে গেছে মনে করলে ভুল হবে। বরং দুই মার্কস-এর মধ্যেকার এই বিচ্ছেদকে এখন যেন মোটামুটিভাবে মেনে নেওয়াই হয়েছে। এ কথা লিখেছেন মেসজারোস। আমাদের দেশে বিচ্ছিন্নতার আলোচনা বোধহয় খুব বেশি হয়নি। বছর পাঁচেক আগে পাভলভ ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে যে আলোচনাচক্র অনুষ্ঠিত হয়, তাতে এইরকম মতবাদের প্রাধান্য দেখেছিলাম। আলোচনা বেশির ভাগই অবশ্য বিশৃঙ্খলভাবে চলেছিল এবং মার্কস-এর ‘ম্যানাসক্রিপটস’-এর কথা খুব কম বক্তাই মনে রেখেছিলেন। কিছুদিন আগে ‘মূল্যায়ন’ পত্রিকার আয়োজিত সভায় আগের দিনের মতোই দুই মার্কসকে একেবারে পৃথক করে দেখা না হলেও, তরুণ মার্কস-এর তারুণ্যকে যেন একটু অনুকম্পার সঙ্গে বিচার করার চেষ্টা হয়েছে। ঐ পত্রিকায় প্রদত্ত বিবরণী থেকে আমি এইরকমই বুঝেছি।[১৮]

তরুণ মার্কসকে ‘অমার্কসবাদী মার্কস’ বলা, আবার তাকে ‘বিপ্লবী হিসেবে চিনে নিতে কষ্ট না-হওয়ার’ মধ্যে আমি অনুকম্পার ভাব লক্ষ্য করেছি। এক জায়গায় লেখা হয়েছে ‘দুই মার্কস’-এর তত্ত্বটা যেন বুর্জোয়াদের আমদানি, আবার অন্য জায়গায় দেখছি লেখা হয়েছে ‘তারা (ঐ বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা  ধী. গ.) ‘দুই মার্কস’-এর মূলগত পার্থক্যটা ভুলে যান বা অস্বীকার করেন।’ রিপোর্টার আবার শেষের দিকে লিখেছেন — ‘কিন্তু আমরা জানি, তরুণ মার্কসকে পরিণত মার্কসের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা মার্কসকে মার্কসবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবার নামান্তর।’ আমার কাছে রিপোর্টটি একটু গোলমেলে মনে হয়েছে। পাঠকদের অবগতির জন্য তাই রিপোর্টের অনেকখানি তুলে ধরছি।

কেন এই তরুণ-পরিণত বিরোধ? আলোচ্য গ্রন্থের লেখক বলেছেন যে, কারণটা নিহিত রয়েছে ‘দি জার্মান ইডিওলজি’ ও ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-র দুটি উদ্ধৃতির মধ্যে — যেখানে মনে হয়, মার্কস যেন নিজেকে তাঁর অতীত থেকে, দার্শনিকের ভূমিকা থেকে সরিয়ে আনতে চেয়েছেন। সত্যিই কি তাই? গ্রন্থকার তা মনে করেন না।[১৯] ‘জার্মান ইডিওলজি’-র অনুবাদক ও ভাষ্যকারের সঙ্গে তিনি একমত নন। ‘সেলফ এসট্রেঞ্জমেন্ট’ কথাটা তিনি পরবর্তীকালে বর্জন বা অস্বীকার করতে চাননি। ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র যে-লাইনগুলো উদ্ধৃত করে ‘ম্যানাসক্রিপটস’-এর বিরুদ্ধে খাড়া করা হয়, [২০] সেগুলোর তাৎপর্য সঠিকভাবে অনুধাবন করা হয়নি — গ্রন্থকার এই মত পোষণ করেন। সমগ্র আলোচনা তুলে ধরা সম্ভব নয়। পাঠক ঔৎসুক্য বোধ করলে আলোচ্য পুস্তকের ২১৮-২২২ পৃষ্ঠা পড়ে দেখবেন। আমার মনে হয়েছে মেসজারোসের যুক্তি গ্রহণযোগ্য। পরবর্তীকালের রচনায় মার্কস তাঁর বিচ্ছিন্নতাতত্ত্বের বিরোধিতা করেননি; বিচ্ছিন্নতার ভাববাদী ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে পাঠকদের সতর্ক করে দিয়েছেন। ‘ইকোয়ালি হোয়াট ইজ্ অ্যাটাকড্ হিয়ার ইজ্ নট দি নোশন অফ ‘ম্যান’ ডিফাইন্ড বাই মার্কস ইন ১৮৪৪ অ্যাজ দি সোস্যাল ইনডিভিজুয়াল, বাট দি অ্যাবস্ট্রাকশন — ‘হিউম্যান নেচার’ অ্যান্ড ‘ম্যান ইন জেনারেল’।’ গ্রন্থকার প্রতিপন্ন করতে চান যে, ১৮৪৪-এর লেখায় মার্কস শুধু নৈতিক ও বিমূর্ত আদর্শের প্রচার করতে আগ্রহী, এই ধারণা ঠিক নয়। এ যুক্তিও গ্রন্থকার খণ্ডন করতে সমুৎসুক যে, ১৮৪৫ থেকে মার্কস মানুষ ও তার বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে নিরুৎসাহ, নিরাসক্ত হয়ে উঠেছিলেন। গ্রন্থকার কতদূর সফল হয়েছেন ও তাঁর বক্তব্য কতটা তর্কাতীত সেটা পাঠকেরা বিচার করবেন। আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, তাঁর অভিগমন (অ্যাপ্রোচ) আমার কাছে বিজ্ঞানসম্মত মনে হয়েছে। ‘শ্রেণী’ ও ‘সর্বহারা’-র ধারণা মার্কসকে বিচ্ছিন্নতাতত্ত্ব থেকে দূরে নিয়ে যায়নি। বিরোধী পক্ষের ‘সমাজসম্পর্ক রহিত’ ‘বিমূর্ত মানুষ’ নিয়ে তিনি ১৮৪৪-এর আগেও কোনোদিন ঔৎসুক্য প্রকাশ করেননি। [২১] যদি তাই হয় তবে ‘বিচ্ছিন্নতা’ শব্দটি তার পরবর্তী রচনায় এত বিরল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন গ্রন্থকার মার্কস-এর রচনা থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরে। ‘দি হোলি ফ্যামিলি’, ‘দি জার্মান ইডিওলজি’, ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’, ‘ওয়েজ লেবার অ্যান্ড ক্যাপিট্যাল’, ‘আউটলাইনস অফ এ ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকনমি’, ‘থিওরিজ অফ সারপ্লাস ভ্যালু’ ও ‘ক্যাপিটাল’ থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে গ্রন্থকার প্রমাণ করেছেন যে, ‘বিছিন্নতা’, বা সমার্থবাচক শব্দ পরবর্তী রচনায় খুব বিরল নয়। এই ‘ড্রপ আউট থিওরি’ অচল। [২২]

যাঁরা মনে করেন তরুণ মার্কস দার্শনিক আর পরিণত মার্কস বৈজ্ঞানিক ‘পলিটিক্যাল ইকনমিস্ট’ — তাঁরাও দ্বান্দ্বিক বিচারপদ্ধতি থেকে বিচ্যুত। ব্যক্তি ও স্বাধীনতার দার্শনিক ব্যাখ্যা নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামাতে চান না তাঁরা তরুণ মার্কস-এর রচনা দূরকল্পী জ্ঞানে এড়িয়ে চলেন। আর যাঁরা মার্কসবাদের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের শক্তিকে ভয় পান তাঁরা পরিণত মার্কসকে তাচ্ছিল্য করেন। যুক্তিবিচারে এই দুই দলের বক্তব্যই অচল ও অসম্পূর্ণ। ‘ম্যানাসক্রিপটস’-এর প্রথম লাইনদুটিই নির্ভুলভাবে প্রমাণ করে যে, তরুণ বয়সেই মার্কস ‘পলিটিক্যাল ইকনমি’-তে পরিণত জ্ঞানলাভ করেছেন।[২৩] ‘ম্যানাসক্রিপটস’-এর পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, মার্কস তদানীন্তন ‘পলিটিক্যাল ইকনমি’-কে যেমন চেয়েছিলেন বাতিল করতে, তেমনি চেয়েছিলেন ভাববাদী দর্শনের মূলোচ্ছেদ করতে। কাজেই দার্শনিক আর বৈজ্ঞানিকের বিরোধ-তত্ত্ব আমদানি করে — দুই মার্কস-এর পরিকল্পনা জিইয়ে রাখা যায় না। মার্কস দার্শনিকের দৃষ্টিকোণ থেকে দর্শনের বিচার করেননি; বিচার করেছেন ব্যাবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের পক্ষ থেকে। মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে শিল্পী-সাহিত্যিকের চিন্তাধারা মিশিয়ে তিনি তাঁর নতুন প্র্যাকটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করেছেন। তেমনি ‘পলিটিক্যাল ইকনমি’-র ক্ষেত্রেও মানুষের জীবনের সর্বাঙ্গীণ অভিজ্ঞতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। তাই তাঁর রচনায় সহজ স্বচ্ছন্দভাবে শেকসপিয়র-গ্যেটে-বালজাক প্রবেশ করতে পেরেছেন। ‘ম্যানাসক্রিপটস’ রচনায় ও ‘ক্যাপিটাল’ রচনায় তিনি পলিটিকাল ইকনমিতে সমান আগ্রহ দেখিয়েছেন। আবার অন্যদিকে বলা চলে যে, দুই পর্বেই তিনি দর্শন সম্পর্কে সমান অনুসন্ধিৎসা প্রকাশ করেছেন; অবশ্য এ ‘দর্শন’ তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ভিন্নতর। তরুণ মার্কস থেকে পরিণত মার্কস-এ উত্তরণের পথে কোথাও ছেদ পড়েনি।[২৪]

শ্রমবিচ্ছিন্নতা সব রকমের বিচ্ছিন্নতার মূল — এই তত্ত্ব উপলব্ধির মধ্যে পরিণত মার্কস-এর মহীরুহের অঙ্কুর নিহিত রয়েছে। ‘ম্যানাসক্রিপটস’-উত্তর সব রচনার কেন্দ্রবিন্দুতে বিচ্ছিন্নতার প্রভাব অনুভূত। পরবর্তী রচনায় ‘বিচ্ছিন্নতা’ শব্দটি অনেক সময় হয়তো ব্যবহৃত হয়নি; তার মানে এই নয় যে, বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্ব পরিত্যক্ত হয়েছে।[২৫]

মার্কসীয় বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্ব বিশ শতকের বুর্জোয়া দার্শনিক-শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাঁদের নিজস্ব শর্তে গ্রহণ করেছেন। হাইডেগার বলেছেন যে, মার্কস-এর ইতিহাসের ধারণা অন্য সব ধারণার তুলনায় শ্রেষ্ঠ, কেননা তিনি আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতার কথা জানেন।[২৬] হাইডেগার অস্তিবাদীর দৃষ্টিকোণ থেকে মার্কসকে দেখতে চেয়েছেন। অনেক মার্কসবাদী, আগেই বলেছি, অস্তিবাদী ধ্যানধারণা দ্বারা প্রভাবিত। বিচ্ছিন্নতা থেকে মানুষের মুক্তি নেই, হেগেলের এই মত মার্কস কর্তৃক অগ্রাহ্য ও পরিত্যক্ত হয়েছে; কিন্তু বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা হেগেলের এই একটি মতকেই আঁকড়ে ধরেছেন অভ্রান্ত মনে করে। অস্তিবাদীরা সময় বিশেষে হেগেলকে নিজেদের রহস্যময় মতবাদের সমর্থনে দাঁড় করিয়েছেন। শাফ প্রমুখ তাত্ত্বিকরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্নতার বিলোপ না দেখে মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতা অবসানের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। মার্কসীয় ‘ট্রানসেনডেন্স’ একটা ‘মিথ’ বলে আজ অনেকে মনে করছেন। কারণ কি?

নিপীড়িত মানুষ ‘ইউটোপিয়া’-র স্বপ্ন দেখে থাকে। স্বর্গরাজ্য বা ইউটোপিয়া আনার একমাত্র শর্ত হল ব্যক্তিসম্পত্তির বিলোপ সাধন; অনেকে এই রকম ধারণা নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে থাকেন। শিল্পবাণিজ্য রাষ্ট্রায়ত্ত হলেই স্বর্গরাজ্য গড়ে ওঠে না। বিপ্লব পুরনো রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে একেবারে গুঁড়িয়ে ফেলেনি সোভিয়েতে। পূর্ব-ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র আবার অনেকক্ষেত্রে বিপ্লব ছাড়াই করায়ত্ত হয়েছে। কাজেই সে-সব দেশে বিচ্ছিন্নতার সম্পূর্ণ নিরসন ঘটেনি, স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে বিলাপ করা চলে না। আমার মনে হয় না, কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সাহায্যে ব্যক্তি-সমাজ, পার্টি-কেডার- এর বিচ্ছিন্নতা দূর করা যায়। পার্টি ও রাষ্ট্রের সংগঠনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার বীজ নিহিত থাকতে পারে। ব্যক্তিমানসিকতা ও আন্তর্মানবিক সম্পর্কের জটিলতা বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখতে অনেক সময় সাহায্য করে। রাজনীতি-অর্থনীতির চর্চা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে পরিমাণে চলে, মনস্তত্ত্বের চর্চা সে পরিমাণে হয় না। নেতা জনতা, শোষক-শোষিতের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক নির্ণয়ে বুর্জোয়া-তাত্ত্বিকরা অতিমাত্রায় আগ্রহী; আবার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এইসব ব্যাপারে উৎসাহের অভাব। স্বর্গরাজ্য গড়ার স্বপ্নে বিভোর হলেই চলবে না, বিপ্লবী ভাবধারায় আবিষ্ট হলেই বিপ্লবোত্তর পরিবর্তনগুলো আপনা থেকে ঘটবে না; তার জন্যেও প্রয়োজন হবে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। কেবলমাত্র অর্থনীতির ক্ষেত্রে নয়, মানসিক-আত্মিক ক্ষেত্রের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণাও পরিকল্পনাসাপেক্ষ।

মেসজারোস বিচ্ছিন্নতা বিলোপ বা ‘ট্রানসেনডেন্স’-এর প্রশ্নে বাস্তবধর্মী আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। অনেক সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু মনে হয় যে, মার্কসবাদের বর্তমান সমস্যার উপর যথেষ্ট আলোকপাত করতে পারেননি।

মানুষের প্রকৃতির মধ্যে, আত্মসচেতনতার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা নিহিত আছে, ভাববাদীদের এই ভ্রান্ত ধারণা তিনি যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে খণ্ডন করেছেন। শ্রমোৎপন্ন বস্তুমাত্রই বিচ্ছিন্নতার জনক — একথা তিনি স্বীকার করেননি। বস্তু ও মানুষের গড়া প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য তিনি সহজভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। একটা বড় মেহগনি টেবিলের ওধারে বসে ম্যানেজার এধারে বসা কর্মচারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে পারেন, কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতাবোধ টেবিলের জন্য নয়, ম্যানেজার-নির্ভর প্রতিষ্ঠানের জন্য।

তিনি মনে করেন, প্রতিষ্ঠানের আমলাতান্ত্রিক পরিচালনাপদ্ধতির পরিবর্তন সম্ভব। তিনি সর্বপ্রকার প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে নন। নয়াবামদের মতো ‘এসট্যাবলিশমেন্ট অ্যালার্জি’ তাঁর নেই। সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোনোরকম কাজ করা সম্ভব নয়। আর সংগঠন-প্রতিষ্ঠান থাকলেই তার একটা নর্ম থাকবে, একটা পরিচালনবিধি থাকবে, খানিকটা আমলাতান্ত্রিক নিয়মকানুন এসে যাবে।[২৭] আদর্শ প্রতিষ্ঠানের ধারণা স্বর্গরাজ্যের মতোই উদ্ভট। আদর্শ প্রতিষ্ঠানের জন্য আদর্শ মানুষের প্রয়োজন। সেরকম মানুষ আবিষ্কার করতে হবে— এমন এক জাতীয় মানুষ যাদের কর্তৃত্বাভিলাষ নেই, সুখদুঃখ ও সাফল্য-অসাফল্যে কোনো বিকার নেই, চাওয়া-পাওয়ার কোনো বালাই নেই।

তাহলে উপায় কী? এই জটিল সমস্যার কী সমাধান নেই? গ্রন্থকারের মতে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যেকার বিরোধ যতই কমিয়ে আনা যাক না কেন, বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা — ন্যূনতম হলেও, থেকেই যাবে।

গ্রন্থকার কিন্তু এইসব আলোচনার কোথাও রহস্যময়তা, অস্তিত্বের সমস্যা, নির্জ্ঞান-প্রবণতা ইত্যাদি আমদানি করে বাস্তবের সমস্যাসঙ্কট এড়াতে চান না। তাঁর সঙ্গে সব ব্যাপারে একমতাবলম্বী না হয়েও — তাঁর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী বিচার-পদ্ধতির জন্য — তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ বাদানুবাদ ও বিতর্কে প্রবৃত্ত হওয়া যায়। তিনি এই সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে সমাধানেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন।[২৮]

বিচ্ছিন্নতার সম্ভাব্য কারণগুলো বিশ্লেষণ, যন্ত্র ও প্রতিষ্ঠান যে মানুষের (ব্যক্তি-মানুষ) জন্য — এই উপলব্ধি, এবং ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের যুক্তিসঙ্গত বিচার; এইভাবে বিচ্ছিন্নতাকে কমিয়ে আনা যায়। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত এটা আদৌ সম্ভব নয়। যন্ত্র-প্রতিষ্ঠান ধনতন্ত্রের আওতায় যে বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে তার ফলেই বিচ্ছিন্নতার বিস্তার ঘটেছে। সমাজতন্ত্র এই রুগ্‌ণ বৈশিষ্ট্য দূর করতে সক্ষম।[২৯]

বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের অপপ্রচারের শিকার আজ প্রগতিবাদী তরুণ। বিচ্ছিন্নতা যন্ত্রসভ্যতার ফল — ফিশারের এই ধরনের প্রচারে অনেকেই বিভ্রান্ত। সমাজতন্ত্রের বিচ্ছিন্নতা ও ধনতন্ত্রের বিচ্ছিন্নতাকে এঁরা এক করে দেখছেন। কাজেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রনায়করা বিচ্ছিন্নতাতত্ত্বকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। মনে রাখা দরকার যে — ধনতন্ত্রে ‘অ্যালিয়েনেশন-রিইফিকেশন’ চরমে উঠেছে, যার ফলে মানবজাতির অস্তিত্বই বিপন্ন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্নতা-সমস্যার ব্যাপকতা ও তীব্রতা অনেক কম। বিচ্ছিন্নতাতত্ত্বকে এড়িয়ে না-গিয়ে সমাজতান্ত্রিক দেশের তাত্ত্বিকদের উচিত সমস্যাকে (যতই লঘু ও সামান্য হোক) স্বীকার করে নিয়ে এর নিরসনের চেষ্টা করা। না হলে অ্যাডাম শাফ-হ্যাভম্যান-এর মতো অনেকেই বিভ্রান্ত হবেন, আর সার্ত্র-ফ্রম-ফিশারের দলের পাঠক সংখ্যা ও প্রতিপত্তি বাড়তেই থাকবে।

(রচনাকাল : ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ। লেখক অনুসৃত বানানরীতি বজায় রাখা হয়েছে।) 

[কৃতজ্ঞতা : পাভলভ ইনস্টিটিউট।]

তথ্যসূত্র :

[] Meszaros, I. : ‘Marx’s Theory of Alienation’, The Merlin Press, London, 1970

[] The enormous complexity of the closely inter-related theoretical levels is often hidden by formulations which look deceivingly simple. Paradoxically enough, Marx’s great power of expression … make an adequate understanding of his work more, rather than less, difficult … the dangers of misinterpretation are acute.

[] Tucker R. C. : ‘Philosophy and Myth in Karl Marx’ (1961) (Meszaros. I. ‘Marx’s Theory of Alienation’: p. 11)

[] … The key to understanding Marx’s theory of alienation is his concept of “Aufhebung” (transcendence), and not the other way round … The concept of “Aufhebung” must be in the centre of our attention for three main reasons :

(1) it is, as we have seen, crucial for the understanding of the “Economic and Philosophic Manuscripts of 1844” whose analysis constitutes the major part of this study;

(2) the concept of the “transcendence (Aufhebung) of labour’s self-alienation” provides the essential link with the totality of Marx’s work, including the last works of the so-called “mature Marx;”

(3) in the development of Marxism after the death of its founders, the issue was greatly neglected and, for understandable historical reasons, Marxism was given a more directly instrumental orientation. (Meszaros : ‘Marx’s Theory of Alienation’, pp. 20-21)

[] Ibid p. 21.

[] ‘In the atmosphere of the nineteen thirties’ Schaff wrote, ‘there was no room in official Marxism for the problems of the individual, the philosophy of man and humanism।’ [Jordan Z. A : Survey : July 1966,  p. 123]

[] Tucker R. C. : Philosophy and Myth in Karl Marx, Cambridge University Press, 1961

[] Marx’s main work is an inner drama projected as a social drama. (Ibid p. 22). Just like Feuerbach — as Hegel before him — who did not realize that when he analysed religion he was in fact talking about “the neurotic phenomenon of human self-glorification or pride, and the estrangement of the self that results from it”. (p. 93) Marx had no idea that in his presumed analysis of capitalism he unconsciously painted something resembling R.L. Stevenson’s Dr. Jekyll and Mr. Hyde: a purely psychological problem, related to an entirely “Individual matter” (p. 240). “Being a suffereing individual himself, who had projected upon the outer world an inner drama of oppression, he saw suffering everywhere.” (p. 237) [Moazaros : pp. 331-332]

[] মার্কস-এর পরবর্তীকালের লেখার মধ্যে তরুণ মার্কস-এর সুসম্মত প্রথার ও পরিণতির প্রমাণ শাফ ও সমর্থকরা খুব বেশি দেখাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। Meszaros তাঁর পুস্তকের একটি অধ্যায়ে নানা উদ্ধৃতি ও বিচার বিতর্কের সাহায্যে তরুণ মার্কসকে পরিণত মার্কস-এর মধ্যে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমাদের আলোচনা সেই দিকে যাবার আগে শাফ সমর্থকদের একটি উদ্ধৃতির প্রয়োজন : In Grundrisse der Kritik der politischen Okonomie (Outlines of a Critique of Political Economy) composed by Marx in 1857/58, we find a passage which combines the socialist humanism of the young Marx with the evolutionary sociological holism of later years and thus corroborates the hypothesis of continuity. : See Hobsbaw, E. J. (ed): Karl Marx: ‘Pre-Capitalist Economic Formations’, London, 1964, p. 84

[১০] The positive transcendence of private property as the appropriation of human life is the positive transcendence of all estrangement, — that is to say, the return of man to his human, i.e.  social mode of existence. (Marx : ‘Economic and Philosophic Manuscripts’ 1844; p. 103)

[১১] Meszaros এ সম্পর্কে অন্যমত পোষণ করেন। আলোচ্য পুস্তকের 244-252 পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।

[১২] সার্ত্র লিখেছিলেন যে, অস্তিত্বের মৌলিক সমস্যাগুলো সর্বদেশেই সর্বকালে বিদ্যমান। ভয় উদ্বেগ অশান্তি নিরাপত্তার অভাব থেকে ব্যক্তিমানুষের মুক্তি নেই। The desire for happiness, the fear of death, the experience of solitude, the dread of life or the sense of its meaninglessness— remain unresolved as much under socialism as under capitalism. But the main cause of the persisting disillusionment with an unsatisfactoriness of life is alienation which socialism has not managed to overcome. সোভিয়েত লেখকেরা এর প্রতিবাদ করেছিলেন এবং সেই সময় শাফ এই বাদ-প্রতিবাদে সোভিয়েত পক্ষ গ্রহণ করেছিলেন। (‘A Philosophy of Man’, N.Y. 1963, p. 74)

[১৩] অস্তিবাদীরা বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা পোষণ করেন। মানবজাতি বা মানবতার সঙ্কটবোধ থেকে অস্তিবাদ দর্শনের উৎপত্তি। Existentialism is in all its forms a philosophy of crisis. It expresses the crisis of man openly and directly, where as other schools, like that of Logical Positivists, express it indirectly and unconsciously. For this reason, the fact of estrangement in its enormous complexity and many sidedness becomes central with them. (Heineman, F. H. : ‘Existentialism and the Modem Predicament’, Adom & Charles Black, London, 1953, p.1967) সঙ্কটের মৌলিক কারণ বিচ্ছিন্নতা — হাইনেমানের বক্তব্য। সব অস্তিবাদীর পক্ষে কিন্তু একথা প্রযোজ্য নয়। বিশ শতকের অস্তিবাদীরা বিচ্ছিন্নতা সমস্যাকে পূর্বসুরিদের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু সার্ত্র, কিয়ের্কেগার্ড, জ্যাসপার্স ও মার্সেলের বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত অবস্থান এক নয়। কিয়ের্কেগার্ড-এর লেখায় বিচ্ছিন্নতার সমস্যা প্রান্তস্থ, অপরপক্ষে সার্ত্র-এর কাছে এ সমস্যা কেন্দ্রস্থ। জ্যাসপার্স এবং গ্যাব্রিয়েল মার্সেলের অবস্থিতি এই দুইজনের মাঝামাঝি। প্রসঙ্গত বলা উচিত, নিরীশ্বরবাদী ও খ্রিস্টবিশ্বাসী অস্তিবাদীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। One cannot discuss fundamental estrangement from a Christian standpoint… This concept of estrangement, which from the Christian standpoint so categorically denies the Incarnation of the Transcendent being in human being, is, by contrast, a prominent feature of the Atheist branch of existentialism. (Mounier, ‘Existential philosophies’, An Introduction, Rockliff, London, 1948, pp. 35-36)

[১৪] The trump-card of anti-marxist and anti-communist propaganda has been the question of the rights of the individual under socialism. Our opponents argue that they have a democracy and we a dictatorship, that the rights of the individual are respected in their countries and not in ours. This is an argument that does appeal to many people and can for a time effectively frighten them away from socialism. — ‘Philosophy of Man’ (New York 1963) p. 102

[১৫] Schaff’s revisionism can be called orthodox because he subordinated it to the supreme objective of keeping the party in power and of making its hold on the country secure and effective … He was successful so long as he dealt with theoretical or philosophical problems regarded by his more practically-minded comrades with condescending indifference … But when he crossed this line and took up matters directly affecting the reputation and politics of the party, as he did in ‘Marxism and the Individual’, the party turned against him with anger and fury. (Jordon Z. A. : Survey, July 1966, p. 120)

[১৬] While some problems of substance, for instance, Schaff’s use of the term ‘alienation’ or affinity of his views with existentialist philosophy were raised, the main objection was his ‘long list of exaggerated and often groundless complaints against socialism.’ (Ibid p.133)

[১৭] Communists are rather liable to misinterpret this early stage even if they do not entirely discount It. They are naturally apt to read these writings in order to find in them the reflection of their own theory as it stands today, and therefore, to dismiss as youthful aberrations those elements which do not square with the final outcome. This is, of course, highly undialectical. It would be equally a misunderstanding of Marx to separate the early stage of his thought from their conclusion, though not to the same extent. For those are earlier stages and though they can only be fully understood in terms of the theory which is their final outcome, they are historically earlier and the conclusion was not explicitly in the mind of Marx when his earlier works were written. (McMurray, John : ‘The Early Development of Karl Marx’s Thought, in Christianity and Social Revolution’, Victor Gollancz, London, 1935, pp.209-10)

[১৮] এই সব পূর্ববর্তী রচনায় যদিও মার্কসকে বিপ্লবী হিসেবে চিনে নিতে কোনো কষ্ট হয় না, কিন্তু তখনো অর্ধস্ফুট বিপ্লবী চেতনার পরিপূর্ণ বিকাশ না ঘটায় তাঁর রচনায় সেই অপরিণত চিন্তার অনেক ছাপ রয়েছে — মার্কস নিজেও সেই সময় পুরোপুরি মার্কসবাদী হয়ে ওঠেননি … মার্কসবাদ যখন পরিণত হয়ে ওঠেনি সে সময়কার রচনায় পরিণত মার্কসবাদী মার্কস থেকে অনেকাংশে অমার্কসবাদী মার্কসকেই বেশি পাওয়া যায়। কেননা, তখনো বিশেষ করে উনিশ শতকের চল্লিশের দশকের লেখাগুলিতে মার্কস প্রধানত তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের তত্ত্বের আলোচনা ও সমালোচনার ভেতর দিয়ে নিজস্ব দর্শন সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছেন। মার্কসের সেই অমার্কসবাদী রূপটাই বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের কাছে পরম লোভনীয় হয়ে উঠল … কিন্তু হেগেল ও ফয়েরবাখ সম্পর্কিত আলোচনা ও সমালোচনায় তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন — ‘ক্যাপিটাল’-এর মার্কস-এর চিন্তার সঙ্গে তার বিরাট পার্থক্য ছিল। … তারা (বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা — ধী.গ.) দুই মার্কসের মূলগত পার্থক্যটাই ভুলে যান বা অস্বীকার করেন … আরো একটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন — মার্কসবাদের বিকাশের প্রাথমিক স্তরে ধনতন্ত্রের প্রতি মার্কস যে অসীম ঘৃণা ও বিরোধিতা পোষণ করতেন তার অনেকটাই ছিল নৈতিক ও বিমূর্ত। [মূল্যায়ন : ৭ম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১১১-১১৩]

[১৯] Meszaros : ‘Marx’s Theory of Alienation’, pp. 218-220

[২০] Marx-Engels : ‘Manifesto of the Communist Party in Selected Works Edition’, Vol. I. p. 58

[২১] He was, in fact, never interested in this ‘Man, not even before 1843, let alone at the time of writing the Economic and Philosophic Manuscripts of 1844. On the other hand ‘real man’— the self-mediating being of nature the ‘social individual’— never disappeared from his horizon. Even towards the end of his life when he was working on the third volume of Capital, Marx advocated for human beings the ‘conditions most favourable to and worthy of their human nature.’ Thus his concern with classes and the proletariat in particular always remained to him identical with the concern for ‘the general human emancipation’. (Meszaros : ‘Marx’s Theory of Alienation’, p. 221) কোটেশন চিহ্নিত অংশ দুটি যথাক্রমে Marx : ‘Capital’ ed, cit; vol. III p. 800 — Marx-Engels : ‘On Religion’, ed, cit, p. 53 থেকে গৃহীত। 

[২২] It should be clear by now that none of the meanings of alienation as used by Marx in the Manuscripts of 1844 dropped out from his later writings. And no wonder, for the concept of alienation, as grasped by Marx in 1844, with all its complex ramifications, is not a concept which could be dropped or one-sidedly translated. As we have seen in various parts of this study, The concept of alienation is a vitally important pillar of the Marxian system as a whole and not merely one brick of it. To drop it or to translate it one-sidedly, would therefore, amount to nothing short of the complete demolition of the building itself. (Ibid p. 227).

[২৩] Wages are determined through the antagonistic struggle between capitalist and worker. Victory goes necessarily to the capitalist. (Marx : ‘Manuscripts 1844’: Moscow, 1961; p. 20)

[২৪] The people who deny this tend to be either those who crudely identify ‘human’ with ‘economic’, or those who, in the name of mystifying psychological abstractions, treat with extreme scepticism the relevance of social-economic measures to the solution of human problems. (Meszaros : ‘Marx’s Theory of Alienation’ : p. 232)

[২৫] One must distinguish between conception and presentation. It is simply unthinkable to conceive the Marxian vision without this fundamental concept of alienation. But once it is conceived in its broadest outline — in the Manuscripts of 1844 — it becomes possible to let the general term recede in the presentation. (Ibid p. 238)

[২৬] Because Marx, through his experience of the alienation of modern man, is aware of a fundamental dimension of history, the Marxist view of history is superior to all other views. (p. 243). হাইডেগারের এই উক্তি গ্রন্থকার ৩৩নং Soviet Survey (July-Sept. 1960, p. 88) থেকে নিয়েছেন। এই মতের খণ্ডনে গ্রন্থকার মন্তব্য করেছেন: Needless to say, Marx did not experience alienation as ‘the alienation of modern man’, but as the alienation of man in capitalist society. Nor did he look upon alienation as a ‘fundamental dimension of history’ but as the central issue of a given phase of history. Heidegger’s interpretation of Marx’s conception of alienation is thus revealing not about Marx, but about his own very different approach to the same issue. (p. 243)

[২৭] But what the total abolition of human institutions would amount to is, paradoxically, not the abolition of alienation but its maximization in the form of total anarchy, and thus the abolition of humanness, ‘Humanness’ Implies the opposite of anarchy : order which, in human society, is inseparable from some organization. (Ibid p. 245)

[২৮] All these problems, nevertheless, are capable of a solution, though of course only of a dialectical one. In our assessment of the transcendence of alienation it is vitally important to keep the ‘timeless’ aspects of these problematics in their proper perspectives. Otherwise they can easily become ammunition for those who want to glorify capitalist alienation as a ‘tension inseparable of existence’. (Ibid 247)

[২৯] Human instruments are not uncontrollable under capitalism because they are instruments … but because they are instruments — specific; reified second order mediations— of capitalism. As such they cannot possibly function except in a ‘reified’ Form, that is, they control man instead of being controlled by him. It is, therefore, not their universal characteristics of being instruments that is directly involved in alienation but their specificity of being instruments of a certain type … . Precisely because they are capitalistic second order mediations— the fetish character of commodity, exchange and money; wage and labour; antagonistic competition; internal contradictions mediated by the bourgeois state; the market; the reification of culture; etc.— is necessarily inherent in their ‘essence’ of being ‘mechanism of control’ that they must elude human control. That is why they must be radically superseded: ‘the expropriators must be expropriated,’ ‘the bourgeois state must be overthrown’; antagonistic competition, commodity production, wage labour, the market, money-fetishism must be eliminated; the bourgeois hegemony of culture must be broken. … (Ibid pp. 248-249)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান