সৈকত সরকার
সপ্তদশ শতকের একেবারে গোড়ায় লেখা রোম্যান্টিক কমেডি ‘টুয়েলফথ নাইট’-এ শেক্সপিয়র তাঁর মূল গল্পের, যা ভায়োলা, ওলিভিয়া আর অরসিনোর প্রেমের জটিলতায় সম্পৃক্ত, সঙ্গে সমান্তরালে চলতে থাকা আরেকটি গল্পেরও নির্মাণ করেন। এই সমান্তরাল আখ্যান মূলত এক অন্তর্দ্বন্দ্বের, যার একদিকে রয়েছে ওলিভিয়ার আমোদপ্রিয় ‘কাজিন’ স্যার টোবি বেল্চ, তার প্রেমিকা মারিয়া এবং ভাঁড় ফেস্টে আর অন্যদিকে এই আমোদপ্রিয় দলের বিরোধিতায় সদা ব্যস্ত ওলিভিয়ার স্টুয়ার্ড ম্যালভোলিও। নাটকের মূল গল্পের চাইতে এই সমান্তরাল গল্পটির আবেদন সমকালীন দর্শকদের কাছে কিছু কম ছিল না। এই গল্পে স্যার টোবির দলের হাতে ম্যালভোলিও-র যে করুণ পরাজয় ঘটে তার অন্তিম পরিণতি ম্যালভোলিও-কে সুচতুর ভাবে পাগল বা উন্মাদ প্রতিপন্ন করার মধ্যে দিয়ে। কীভাবে দক্ষ পরিকল্পনায় টোবির দলবল ম্যালভোলিও-কে উন্মাদ প্রমাণ করে তা এক চিত্তাকর্ষক কাহিনি হলেও এখানে তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই। মিশেল ফুকোর সভ্যতা ও উন্মাদনার অন্তর্দ্বন্দ্ব বিষয়ক এই লেখায় টুয়েলফথ নাইট-এর প্রসঙ্গ অবতারণের কারণ নাটকের একটি বিশেষ দৃশ্য যেখানে ‘উন্মাদ’ ম্যালভোলিও-কে বন্দি করে রাখা হয়েছে আর তার সাথে রগড় করার জন্য ফেস্টে এসেছে ধর্মযাজকের বেশে। যদিও ম্যালভোলিও ফেস্টের এই পাদ্রির বেশ দেখতে পায় না, কিন্তু ফেস্টের অভিনয়ের গুণে তাকে পাদ্রি ঠাহর করে ম্যালভোলিও তার কাছে নিজের মস্তিষ্কের সুস্থতা প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বলাই বাহুল্য, যে তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু আমরা আপাতত শেক্সপিয়ার সাহেবের হাতের জাদু থেকে মুখ ফেরাই আমাদের এই লেখার মূল বিষয়ের দিকে। পাঠক নিশ্চয় খেয়াল করেছেন যে ‘উন্মাদ’ ম্যালভোলিও, যাকে কারাগারে পুরে সমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে, তার উন্মাদনার শুশ্রূষায় হাজির হয়েছেন এক পাদ্রি; আমাদের পরিচিত চিকিৎসক নন।
এই চিন্তাসূত্র ধরেই আমরা এগিয়ে যাই মিশেল ফুকোর প্রথম প্রামাণ্য রচনায় যা ১৯৬১ সালে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়। ‘ধ্রুপদী যুগে উন্মাদনার ইতিহাস’ (‘Histoire de la folie à l’âge classique’) নামের এই লেখার এক সংক্ষিপ্ত ইংরেজি অনুবাদ ১৯৬৫ সালে ‘উন্মাদনা এবং সভ্যতা’ (সম্পূর্ণ শিরোনাম, ‘Madness and Civilization : A History of Insanity in the Age of Reason’) নামে প্রকাশ পায়। রিচার্ড হাওয়ার্ড কৃত এই অনুবাদটিই দীর্ঘকাল ইংরেজি ভাষী জগতের কাছে ফুকোর উন্মাদনা বিষয়ক গবেষণার মূল পাঠ ছিল। সম্প্রতি জিন খলিফার অনুবাদে ২০০৬ সালে প্রকাশ পেয়েছে ফুকোর পূর্ণাঙ্গ কাজের ইংরেজি অনুবাদ। পূর্বে উল্লিখিত চিন্তাসূত্র আমাদের দৃষ্টি দুটি বিষয়ে আকর্ষণ করে; প্রথমত, কে উন্মাদ তা নিরূপণ করা শুধু এক নৈর্ব্যক্তিক বৈজ্ঞানিক বিষয় নয়, বরং তা এক ভাষ্য বা ডিসকোর্স যা ক্ষমতাসীন মানুষ প্রয়োজন মাফিক নির্মাণ করতে পারে আর দ্বিতীয়ত, ইতিহাসের বিশেষ কালপর্বে উন্মাদনার নিরাময়ে মানুষ শরণাপন্ন হত ধর্মযাজকদের, চিকিৎসকদের নয়। উল্লেখ্য যে, ফুকো ধ্রুপদী যুগ বলতে সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতককে বুঝিয়েছেন। রেনেসাঁস-উত্তর ইওরোপে ইতালির সাংস্কৃতিক প্রাধান্য লোপ পাওয়ার পর ফ্রান্সে এই সময়ে জন্ম নেয় এক আধুনিক দর্শন যার মূলে ছিল যুক্তি ও যুক্তিবদ্ধ আলোচনার দ্বারা সত্যের অন্বেষণ। এই যুগের অন্যতম দার্শনিক দেকার্ত বলেন, মানুষের অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে রয়েছে মানুষের যুক্তিপ্রয়োগের ক্ষমতার ওপর। এই যুগে পালটে যায় উন্মাদদের প্রতি সমাজের মনোভাব। উন্মাদনার প্রতি মনোভাবের বিবর্তন বুঝতে আমরা যদি পেছনে তাকাই তাহলে দেখব যে পশ্চিমি সভ্যতার আদিকালে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো উন্মাদনাকে জৈব সমস্যার পাশাপাশি সামাজিক রীতিনীতি বিবর্জিত আচরণ হিসেবেও কল্পনা করেছিলেন। আর এর অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন শিল্পী, প্রেমিক, ভাববাদী, ধর্মান্ধ ও নবিদের। উন্মাদ শব্দটির পরিসর ছিল বিস্তৃত। সেকালের চিকিৎসক হিপোক্রাটেস (যার নামে বর্তমান কালেও নব্য চিকিৎসকরা শপথগ্রহণ করেন) তাঁর উন্মাদনা বিষয়ক গবেষণায় এমন নিদান দেন যে, এর চিকিৎসা বিবাহ। এই আদিকাল থেকে মধ্যযুগ পেরিয়ে রেনেসাঁস অবধি উন্মাদনার প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি, তার বিবর্তনে একপ্রকার ক্রমানুবর্তিতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু এই ক্রমানুবর্তন বদলে যায় ‘ধ্রুপদী’ যুগে। ফুকোর গবেষণায় বিশ্লেষিত হয় এই পরিবর্তন ও তার কারণ।
পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ফুকো তাঁর পড়াশুনোর বিষয়ে দর্শনের পাশাপাশি আগ্রহী হন মনোবিশ্লেষণে। ১৯৫২ সালে তিনি এই বিষয়ে ফ্রান্সের প্রখ্যাত ইনস্টিটিউট দে সাইকোলজি থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি প্যারিসের এক অ্যাসাইলাম সেন্ট-অ্যানে ক্লিনিক্যাল অভিজ্ঞতা লাভের জন্য যোগদানও করেন। কিন্তু তাঁর প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ করার জন্য তিনি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেননি। এহেতু মনোবিশ্লেষক হিসেবে তাঁর কাজ করা না-হলেও মানসিক রোগাক্রান্ত রোগীদের কাছের থেকে দেখার অভিজ্ঞতা তাঁকে তাঁর প্রথম গবেষণা সন্দর্ভ লিখতে প্রাণিত করে। যদিও তাঁর লিখনে মানসিক রোগের চিকিৎসা বা রোগ নিরূপণের উপায়ের কথা নেই। বরং আছে মানসিক রোগী হিসেবে সাব্যস্ত হওয়া মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উন্মাদনার পাঠ। আছে ঐতিহাসিকভাবে যাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে রাখা হয়েছে সেই উন্মাদদের কথা। উল্লেখ্য যে ফুকোর ব্যবহৃত ‘folie’ শব্দটির অনুবাদ সঠিক অর্থে শুধু ভ্রান্তি নয়; তার মধ্যে নিহিত আছে আধুনিক পাগলামির ধারণার সাথে সাথে যাকে আমরা সজ্ঞান নির্বুদ্ধিতা বলি তাও। এই সজ্ঞান নির্বুদ্ধিতার ধারণা আমাদের কাছে মূর্ত হয়ে উঠবে যদি আমরা মাথায় রাখি শেক্সপিয়র সৃষ্ট সেই ভাঁড় বা fool-দের কথা যারা তাদের আপাত চটুল কথার আড়ালে প্রকাশ করে গভীর অন্তর্দর্শন সঞ্জাত সন্দর্ভ। ফুকোর প্রতিপাদ্য মূল বিষয় হল যে, উন্মাদনা এবং যুক্তি ঐতিহাসিকভাবে ক্রমশ পরস্পরের থেকে বিযুক্ত হয়েছে; এবং বিশেষ করে আধুনিক যুগে উন্মাদনাকে আর ‘folie’ হিসেবে দেখা না-হয়ে দেখা হচ্ছে মনোবিকার হিসেবে। এই মনোবিকার সম্পর্কিত ভাষ্যে আর সজ্ঞান নির্বুদ্ধিতার ধারণা নিহিত থাকছে না। থাকছে শুধুই এর এক রোগ হিসেবে নিরূপিত হওয়ার সত্য যার নিরাময় হওয়া সম্ভব একমাত্র নৈর্ব্যক্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দ্বারা। নৈর্ব্যক্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আপাত অর্থে ব্যক্তির স্বার্থ বিবর্জিত হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে এ এক ডিসকোর্সই। ফুকোর চিন্তায় ডিসকোর্সের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। ফুকো ডিসকোর্সকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেন। তাঁর ধারণায় ডিসকোর্স হল এক সীমায়িত জ্ঞানের পরিসর যা কিছু বয়ান দ্বারা নির্মিত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের প্রেয় বা অপ্রেয় নির্ধারণে এই ডিসকোর্স আমাদের চালিত করে। ডিসকোর্সের পরিসরের পরিধি বা বয়ানের ধরন নির্মাণ করেন সমাজের ক্ষমতাসীন মানুষেরা। আর তাই, যা কিছু আমাদের জীবনের অংশ সে বিষয়ক জ্ঞান আমাদের অজ্ঞাতেই নির্মিত হতে থাকে। ক্ষমতাসীনের সুবিধার্থে নির্মিত বয়ানে চাপা পড়ে যায় সমাজের বহুমাত্রিক স্বর। তাঁর নিজের ইতিহাস পাঠে ফুকো প্রবর্তন করেন প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ধারণা (এই পদ্ধতির বিশদ আলোচনা ফুকো করবেন পরবর্তীকালে প্রকাশিত বই, ‘The Archeology of Knowledge’-এ) যা পুনঃপ্রকাশ করে বিস্মৃতিকে, উঁকি দেয় প্রামাণ্য বয়ানের মধ্যেকার ফাটলের ভেতর যাতে রূদ্ধস্বর আবার কণ্ঠ ফিরে পায়।
তাঁর গবেষণায় ফুকো বলেন যে পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাসে উন্মাদনাকে চারটি কালপর্বে চারটি ভিন্ন তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে দিয়ে দেখা হয়েছে। প্রথমেই আসে মধ্যযুগের কথা যখন উন্মাদনাকে দেখা হত দৈবরহস্য হিসেবে, যা দৈব হলেও মানুষের বিস্তৃত অভিজ্ঞতারই অংশ। পরবর্তীকালে রেনেসাঁসের সময় উন্মাদনা ছিল যুক্তির এক বিশেষ রূপ যা পৃথিবীর/জীবনের যুক্তিহীনতাকে প্রকাশ করে। উন্মাদ ব্যক্তির মধ্যে এক দ্বিমাত্রিকতা এই সময়ে পরিলক্ষিত হয়। সে একাধারে ট্র্যাজিক এবং কমিক, একাধারে পরিহাসকারী এবং ভয় উদ্রেককারী। ফুকো উল্লেখ করেন এক তদানীন্তন ধারণা, নির্বোধদের জাহাজের (ship of fools) কথা। এই জাহাজে করে পাড়ি দিত উন্মাদদের দল। তারা পাড়ি দিত তীর্থযাত্রী হিসেবে নিজেদের জন্য যুক্তির খোঁজে এবং বৃহদর্থে জীবনের যুক্তির খোঁজে। পশ্চিমি সভ্যতার এই প্রাক্-আধুনিক পর্বে উন্মাদনাকে ভাবা হত জীবনের মধ্যে অন্তর্লীন যে অযৌক্তিকতা তার সঙ্গে যোগ স্থাপন করার এক বিকল্প হিসেবে। উন্মাদনা কোনও বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে পরিলক্ষিত না হয়ে কল্পিত হত আমাদের সামগ্রিক জীবনে যুক্তিহীনতার যে ভ্রুকুটি রয়েছে তার দিগ্দর্শক হিসেবে। ফুকো এই যুগের নানা টেক্সটের উদাহরণ তুলে দেখান কীভাবে সেকালে নির্বোধের জ্ঞানের ধারণা জনমানসে প্রোথিত ছিল। রেনেসাঁসের কালে উন্মাদনাকে ভাবা হত ধর্মীয় সমস্যা হিসেবে আর তাই বর্তমান সময়ে একে যেভাবে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখা হয় তার চাইতে ভিন্ন ছিল উন্মাদনার প্রতি তৎকালীন মনোভাব।
উন্মাদনাকে এক সামাজিক এবং সামগ্রিক প্রবণতা হিসেবে ভাবার এই রীতিতে এক লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে সপ্তদশ শতকে। এই সময় থেকে উন্মাদকে আর মহাজগতের সঙ্গে তাত্ত্বিক লড়াইয়ে রত এক ট্র্যাজিকমিক জ্ঞানের অধিকারী সত্তা হিসেবে দেখা না-হয়ে দেখা হতে লাগল এক রোগী হিসেবে যাকে আবদ্ধ রাখতে হয় বিশেষভাবে নির্মিত বাড়িতে। মধ্যযুগ থেকে ইওরোপের একটা বড়ো সমস্যা ছিল কুষ্ঠ রোগ। কুষ্ঠ রোগীদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার প্রয়োজনে নির্মিত হয় বিশেষ কিছু বাড়ি যেগুলি অবস্থিত ছিল সামাজিক পরিসরের বাইরে। সপ্তদশ শতাব্দীতে এই রোগের প্রকোপ অনেকাংশেই নির্মূল হয়ে গেলে এই বাড়িগুলি খালি হতে থাকে। ইতিমধ্যে উন্মাদনার প্রতি সমাজের মনোভাব বদলায়। তাকে জীবনের সামগ্রিক কোনও প্রবণতা মনে না করে মনে করা হতে থাকে ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব সমস্যা হিসেবে। এই সমস্যা ছোঁয়াচে হতে পারে এমন আশঙ্কায় এই সময় থেকে উন্মাদদের সেই ফাঁকা বাড়িগুলিতে আবদ্ধ করে রাখা শুরু হয়। ফুকো দেখিয়েছেন একালে এই বাড়িগুলি কেবল উন্মাদ-আশ্রম হিসেবেই ব্যবহৃত হত না, এগুলি ছিল আইন ব্যবস্থার এক আধা রূপ। এখানে উন্মাদদের সাথে সাথে আবদ্ধ করে রাখা হত দরিদ্র, ভবঘুরে, ভিখারি, লম্পট, ছোটোখাটো অপরাধী, পানাসক্ত ও ঈশ্বরের নিন্দাকারী মানুষদের। ফুকোর মতে এই সংমিশ্রণ ছিল বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। একদিকে সমাজের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ এবং অপরদিকে অযুক্তির প্রতিরূপ মানুষ — এই দুই-ই সমাজের চোখে হয়ে দাঁড়ায় লজ্জার হেতু। অতঃপর আয়োজন হয় এদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার ব্যবস্থা।
এহেন সামাজিক ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আসে অষ্টাদশ শতকে যখন এই বাড়িগুলি সমাজের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। নিত্যকার কোলাহল বা গোলোযোগ যা এর নিকটবর্তী মানুষদের অসুবিধেয় রাখত তা ছাড়িয়ে মাথা চাড়া দিচ্ছিল সংক্রামক ব্যাধির ভয়। এর প্রতিকারের হেতু জন্ম নেয় দুধরনের মানুষ — সংস্কারক ও চিকিৎসক। ফুকোর লিখন ব্যাধি নিরাময়ে মানবিক সংগ্রামের ইতিহাস নয়। তা হল মানবিকতা নামক প্রকল্পের মহা-আখ্যানের আড়ালে যেসব ক্ষুদ্র আখ্যান চাপা পড়ে যায় তা উদ্ধারের প্রয়াস। ফুকো দেখান যে ফরাসি বিপ্লব শুরু হওয়ার আগে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি উন্মাদদের থেকে বাকি বন্দিদের পৃথক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই বাকি বন্দিদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন রাজনৈতিক বন্দি ও বুদ্ধিজীবী। অনেকেই ছিলেন অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান। এরা উন্মাদদের সঙ্গে একসাথে থাকতে অসম্মত হতে শুরু করেন। এছাড়াও নব্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এই সব অনুৎপাদনশীল মানুষদের কীভাবে দ্রুত উৎপাদনশীল করে তোলা যায় সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। দারিদ্র্য, যা ছিল লজ্জার প্রতীক, তাকে রাখা হত লোকচক্ষুর অন্তরালে। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এইসব ভবঘুরে, দরিদ্র বা আন্যান্য বন্দিদের সহজেই পরিণত করা হল স্বল্প পারিশ্রমিকে কাজ করা কর্মীতে। অতএব অন্যান্য বন্দিদের বন্দিদশা কাটলেও পাগল বা উন্মাদেরা রয়ে গেল স্ব-স্থানেই।
উন্মাদনার প্রতি সমাজের মনোভাবের বিবর্তনের ঐতিহাসিক কালপর্ব বিচারের সময় ফুকো এই পর্বটিকেই তার চতুর্থ পর্ব ভেবেছেন। এই সময় থেকে পাগল বা উন্মাদকে আর মানবিক মাপকাঠিতে ফেলে দেখা না-হয়ে তার মধ্যে সন্ধান করা হতে লাগল পাশবিকতার। মনুষ্যেতর পশুর মতো পাগল তার প্রবৃত্তির দাস, সে যুক্তি বোঝে না। আধুনিক যুগের এই প্রারম্ভিক পর্বে উন্মাদকে আর বিশেষ যুক্তির অধিকারী মনে না করে দেখা হচ্ছিল রোগগ্রস্ত হিসেবে। আর তার প্রতিকারে সক্ষম ব্যক্তি হলেন চিকিৎসক যিনি একাধারে সংস্কারকও। ফুকো ফিলিপ পিনেল নামে এক ফরাসি ও স্যামুয়েল টিউক নামে এক ইংরেজ সংস্কারকের কথা লিখেছেন যাঁরা যথাক্রমে ফ্রান্সে এবং ইংল্যান্ডে দুটি উন্মাদ-আশ্রম গড়ে তোলেন। টিউক ছিলেন একজন কোয়াকার। তিনি ১৭৯৩ সালে ইয়র্কশায়ারে তাঁর উন্মাদ-আশ্রমটি স্থাপন করেন। তিনি মনে করতেন উন্মাদদের মধ্যে শুভবুদ্ধি সম্পূর্ণ রহিত হয়ে যায়নি, তবে এসে ঠেকেছে তলানিতে। তিনি এও মনে করতেন যে সহায়ক পরিবেশে উন্মাদেরা যৌক্তিক ব্যবহার করতে পারে। টিউক এমন পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য চায়ের আসরের আয়োজন করতেন যেখানে বাকিদের সঙ্গে মিলে তাঁর আশ্রমের উন্মাদদের ভব্য আচরণ করতে হত। কিন্তু ফুকোর মতে সেইসব আসরে উন্মাদকে যুক্তির চৌহদ্দিতে একজন অপরিচিত আগন্তুক হিসেবে দেখা হত যে যুক্তির জগতে কেবল এই শর্তেই স্বাগত যে, সে পরিচয়হীন হয়ে থাকবে। টিউকের সৃষ্ট পরিবারে উন্মাদের ভূমিকা স্রেফ এক শিশুর।
পিনেলের চিকিৎসায় টিউকের মতো ধর্মীয় অনুষঙ্গ না থাকলেও টিউকেরই মতো তিনিও পাগলদের শৃঙ্খলমুক্ত করার প্রয়াস করেছিলেন। ফ্রান্সের বিসেত্র (Bicêtre)-এ তাঁর উন্মাদ-আশ্রমের কথা বলতে গিয়ে ফুকো দুজন রোগীর কথা উল্লেখ করেন। প্রথমজন এক ব্রিটিশ নৌ-ক্যাপ্টেন যিনি তাঁর হিংস্র ও উন্মত্ত ব্যবহার ভুলে স্বাভাবিক হন এবং বিসেত্র-এর পরিচালনায় অংশও নেন। দ্বিতীয়জন শভ্যাঁজে নামে ফরাসি সৈনিক যাঁর অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়। পিনেল একেও সুস্থ করে তোলেন। ফুকো দেখান যে এঁরা কেউ-ই প্রকৃত অর্থে স্বাভাবিক হয়নি। দুজনেই পিনেলের বশংবদ হয়ে ওঠেন। এঁদের রূপান্তরিত করা হয় সামাজিক টাইপে। টিউক এবং পিনেলের চিকিৎসায় পরিলক্ষিত হয় শৃঙ্খলামূলক ক্ষমতার প্রয়োগ। ক্ষমতার এই মাত্রা বিংশ শতাব্দীতে আরও ব্যাপকার্থে প্রয়োগ হবে। ফুকো তাঁর ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ বইয়ে এর বিশদ আলোচনা করবেন। ক্ষমতার এই ধারায় ক্ষমতা প্রযুক্ত হয় জ্ঞান নির্মাণের দ্বারা। এই নির্মিত জ্ঞান এক সীমায়িত পরিসর। আমরা আগেই ডিসকোর্সের কথা বলেছি। ফুকোর ধারণায় আধুনিক কালে শাসন আর দৈহিক ক্ষমতা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে হয় না। শাসনের প্রয়োগ হয় যে কোনও বিষয়ে বয়ানের দ্বারা জ্ঞানের সীমায়িত পরিসর নির্মাণ করে যার ফলে শাসিতের পক্ষে বিরূদ্ধস্বরে কথা বলার অবকাশই থাকে না। উন্মাদনার ক্ষেত্রে এই জ্ঞানের সীমায়িত পরিসরে আর উন্মাদের কন্ঠস্বরকে কোনও দৈবিক স্বর হিসেবে পরিগণিত করা হয় না বরং তা অযৌক্তিক বলে তাঁর কন্ঠ রুদ্ধই করে রাখা হয়। এই ডিসকোর্সে স্বর শোনা যায় কেবল চিকিৎসকের। কিন্তু উন্মাদের কন্ঠস্বর সম্পূর্ণ রুদ্ধ করা ক্ষমতার পরিধির বাইরে। কোথায় তা শোনা যায় তাঁর সন্ধান ফুকো দিয়েছেন তাঁর সন্দর্ভের শেষে যেখানে তিনি বলেছেন, এর দেখা মেলে সাহিত্যে ও শিল্পে।
ফুকোর এই উন্মাদনার পাঠ সমালোচিত হয়েছে একাধিক সমালোচকদের দ্বারা। ফুকো উন্মাদের স্বরকে ক্ষমতার বয়ানের বিপ্রতীপে অবস্থিত এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে কল্পনা করেছেন। কিন্তু তাঁর আলোচনায় এটা স্পষ্ট নয় কীভাবে একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গড়ে তোলা যায়। গ্যারি গাটিং ফুকোর উন্মাদনা সংক্রান্ত ভাবনাকে মনে করেছেন নিছকই রোম্যান্টিক। এরিক মাইডেলফোর্ট দেখিয়েছেন যে অপ্রয়োজনীয়কে আবদ্ধ রাখার ব্যবহার সপ্তদশ শতকের আগে থেকেই ছিল। রয় পোর্টারের মতে ফুকোর পাঠ স্রেফ ফরাসি সমাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। য়ুর্গেন হাবেরমাসের মতো দার্শনিকও মনে করেন ফুকোর এনলাইটেনমেন্ট যুগের প্রতি মনোভাব একপেশে। কলিন গর্ডন যদিও একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ফুকোকে প্রায় সবাই সমালোচনা করেছেন সংক্ষিপ্ত অনুবাদ পড়ে। আর একথাও প্রাণিধানযোগ্য যে থিওডর আডর্নো এবং ম্যাক্স হর্কহাইমারের মতো ফুকোও এনলাইটেনমেন্ট প্রকল্পকে বৃহদর্থে ক্রিটিসাইজ করতে চান। তাঁর মতে বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক স্বর যা আমাদের ধর্মীয় গোঁড়া অনুশাসন ও কুসংস্কার থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কালক্রমে তা পর্যবসিত হয় নিয়ন্ত্রণ ও স্বাভাবিকীকরণের এক যন্ত্রে। এনলাইটেনমেন্টের মূলে যে গ্রহণ ও বর্জনের বাইনারি কাঠামো আছে ফুকো তাকে প্রতিহত করতে চান। পরবর্তীকালে ফুকো তাঁর ‘হোয়াট ইজ এনলাইটেনমেন্ট’ প্রবন্ধে এই ভাবনা আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরবেন। ‘উন্মাদনা ও সভ্যতা’ ফুকোর প্রথমদিকের গবেষণাপত্র হলেও ক্ষমতার প্রকার সম্পর্কে তাঁর পরের দিকের ভাবনার বেশ কিছু সূত্র আমরা এখানে দেখতে পাই। এছাড়াও ক্ষমতা নির্মাণের ধরন এবং তার পালটা বয়ান তৈরির নিদর্শন হিসেবেও এই গ্রন্থের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
সহায়ক পাঠ :
পারভেজ হোসেন (সম্পাদিত) : ‘মিশেল ফুকো, পাঠ ও বিবেচনা’ (সংবেদ প্রকাশনী)
অমল বন্দ্যোপাধ্যায় : ‘উত্তর-আধুনিক চিন্তা ও কয়েকজন ফরাসী ভাবুক’ (এবং মুশায়েরা)
সারা মিলস : ‘মিশেল ফুকো’ (রাউটলেজ)
ব্যারি স্মার্ট : ‘মিশেল ফুকো’ (রাউটলেজ)