মোহিত রণদীপ
শৈশবে লেখাপড়া শুরুর প্রথম পর্বে আমাদের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ চিনতে শিখেছিলাম। তিরিশ চিহ্ন দিয়ে আমাদের শেখানো হয়েছিল, কোনটা আমাদের হাত, কোনটা পা, কোনটা মাথা, কোথায় আমাদের চোখ… কোনটা জিভ প্রভৃতি। আর একটু বড়ো হওয়ার পর আমরা চিনতে শিখলাম শরীরের ভিতরের নানা প্রত্যঙ্গ। একই পদ্ধতিতে চিনলাম কোথায় আমাদের ফুসফুস, কোথায় হৃৎপিণ্ড, কোথায় আমাদের অলিন্দ-নিলয়, কোনটা গুরুমস্তিষ্ক-সুষুম্নাকাণ্ড…প্রভৃতি! এই চেনার পর্বে ‘মন’ বলে কোনও কিছু কোথাও ছিল কি? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবারই জানা, এখানে মনটা ঠিক কোথায়, কীভাবে রয়েছে, তা অনুচ্চারিত থেকেছে এই তির চিহ্ন দিয়ে শেখার পর্বে। তাহলে কি মন বলে কোনও কিছু নেই! থাকলে কোথায়, কীভাবেই বা আছে তা! মনের অস্তিত্ব এবং তার রূপ নিয়ে চর্চা সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই। অতীতের প্রাজ্ঞ ঋষি-দার্শনিকরা যেমন করেছেন প্রাচ্যের প্রাচীন সভ্যতার সময়-পর্ব থেকে, একইভাবে পাশ্চাত্যের দার্শনিকরাও বুঝতে চেয়েছেন মনের রূপকে। ইউরোপে নবজাগরণের সময়েও সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে। আমাদের দেশেও বহু বিশিষ্ট দার্শনিক মনকে জানা ও বোঝার অনুসন্ধিৎসা বজায় রেখেছেন। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাও নিজের মতো করে মনকে জানা-বোঝার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেয় ‘মনস্তত্ত্ব’ নামের একটি বিষয় যা পরবর্তীকালে স্বীকৃতি পায় বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পঠনপাঠনের জন্য। বহু বিশিষ্ট গবেষক ও মনোবিজ্ঞানীর অবদানে পুষ্ট হয়েছে ‘মনস্তত্ত্ব’। কিন্তু, তাঁদের প্রত্যেকেরই ‘মন’-কে দেখার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সবাই একই ভাবে ‘মন’-কে দেখেছেন, এমন নয়। মনের রূপ নিয়ে দেখার ভঙ্গিতে ফারাক রয়েছে মনোচিকিৎসক এবং মনস্তাত্ত্বিকদের মধ্যেও। তবু ওঁদের অন্বেষণে অনেক অজানা দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে মানুষের মনের! কিন্তু, তবু মানুষের জানাবোঝার বাইরে থেকে গেছে ‘মন’-এর অনেকখানি! এখনও পর্যন্ত ‘মন’-এর কোনও সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নিরূপিত হয়নি। তাহলে ‘মন’ বলতে আমরা ঠিক কী বুঝব? অন্ধের হস্তীদর্শনের মতো দর্শন-মনস্তত্ত্ব-মানসিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের এক-একটি তত্ত্ব অনুযায়ী ‘মন’-কে দেখব, নাকি সামগ্রিক ভাবে ‘মন’-কে বুঝতে চেষ্টা করব? আমরা যারা হাতেকলমে মানুষের মনের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি, আমাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খোঁজার চেষ্টা করি মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মডেলের মধ্যে, যে মডেলটির উদ্ভাবন ১৯৭৭ সালে। এর স্রষ্টা বিশিষ্ট আমেরিকান অভ্যন্তরীণ রোগ বিশেষজ্ঞ (Internist) ও মনোচিকিৎসক (Psychiatrist) ডাঃ জর্জ এঙ্গেল। এই মডেলে সাধারণভাবে সব ধরনের অসুস্থতার ক্ষেত্রেই জৈবিক (Biological), মনস্তাত্ত্বিক (Psychological) এবং সামাজিক (Social) উপাদানের মিথস্ক্রিয়ার কথা বলেছেন ডাঃ এঙ্গেল। তবে এই মডেলের প্রাসঙ্গিকতা মানসিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক বেশি।
‘মন’-কে নির্দিষ্ট ভাবে শরীরের কোনও একটি অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গে খুঁজে না-পেলেও সাধারণভাবে ‘মন’-এর অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাই তার কয়েকটি কাজের মধ্যে দিয়ে। আমাদের চিন্তা-ভাবনা (Thinking), প্রত্যক্ষণ বা আমাদের পাঁচটা ইন্দ্রিয় দিয়ে বহির্জগতকে যেভাবে অনুভব করি (Perception), আমাদের আবেগ-অনুভূতি (Emotions-Feelings), আচরণ (Behaviour) এবং স্মৃতি (Memory)-র মাধ্যমে আমাদের মনের অস্তিত্ব আমরা বুঝতে পারি।
মন বলে যে কিছু আছে তা বোঝা যায় এই কাজগুলোর মধ্যে দিয়েই! আর, মনের এই কাজগুলো কীভাবে সম্পন্ন হয়? আমাদের অভ্যন্তরে রয়েছে কিছু উপাদান :
- আমাদের বংশগত বৈশিষ্ট্য — যা আমরা বংশ পরম্পরায় বহন করে চলি
- আমাদের শৈশব অভিজ্ঞতা — যা আমাদের ভিতরেই কোথাও সচেতনে/ অচেতনে/ অবচেতনে সঞ্চিত রয়েছে
- আমাদের মানসিক বৈশিষ্ট্য — অর্থাৎ আমাদের চিন্তা-ভাবনার ধরন, আমাদের প্রত্যক্ষণ বা দেখার ধরন, আমাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের ধরন — যা গড়ে উঠেছে আমাদের বংশগত বৈশিষ্ট্য, শৈশব অভিজ্ঞতা ও আমাদের চারপাশের পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ায়
- আমাদের মস্তিষ্ক
- স্নায়ুতন্ত্র
- বিভিন্ন ধরনের স্নায়ুপ্রেরক বা নিউরোট্রান্সমিটার — যা বহির্জগতের সঙ্গে আমাদের অভ্যন্তরের সংযোগ রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
অভ্যন্তরের এই উপাদানগুলোর সঙ্গে আমাদের শরীরের বাইরের জগতের প্রতিনিয়ত আদানপ্রদান চলতে থাকে! সেই আদানপ্রদানের প্রকাশই আমরা দেখতে পাই মনের সেই কাজগুলোর মাধ্যমে, যার কথা আগে আলোচিত হয়েছে এই নিবন্ধে, আমাদের চিন্তা-ভাবনা, আমাদের প্রত্যক্ষণ, আবেগ-অনুভূতি, আচরণ আর স্মৃতির মধ্যে দিয়ে। যখন আমাদের মনে কোনও সমস্যা দেখা দেয়, তখন এই পাঁচটা ক্ষেত্রের কোনও-না-কোনও ক্ষেত্রে কিংবা একাধিক ক্ষেত্রে সমস্যার লক্ষণ ফুটে ওঠে।
মনের অসুস্থতার কোনও নির্দিষ্ট একটি কারণ কি আদৌ চিহ্নিত করা সম্ভব? আমাদের মনে রাখতে হয়, ‘মন’-এর অস্তিত্বের মধ্যে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে বংশগত বৈশিষ্ট্য, শৈশব-অভিজ্ঞতা, মানসিক বৈশিষ্ট্য, মস্তিষ্ক-স্নায়ুতন্ত্র-স্নায়ুপ্রেরকের মতো অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলির সঙ্গে শরীরের বাইরের সমস্ত কিছু! এবারে যদি আমরা আমাদের মনের সমস্যার কারণ খুঁজতে যাই, তাহলে কোন একটি মাত্র নির্দিষ্ট কারণকে চিহ্নিত করব? আমাদের অভ্যন্তরের এবং শরীরের বাইরের জগতের প্রতিনিয়ত আদানপ্রদানের মধ্যেই নিহিত থাকে মনের অস্তিত্ব, মনের সুস্থতা এবং মনের অসুস্থতার কারণও।
কোনও আত্মহননের ঘটনা ঘটার পরেই শুরু হয়ে যায় অনুসন্ধান, কী ঘটেছিল? কেন এই আত্মহনন? তিনি যদি বিশিষ্ট কেউ হন, তাহলে সংবাদ মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ! বলাবাহুল্য বাহ্যিক ঘটনাপ্রবাহ-ই এক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়। অন্তর্নিহিত কারণগুলো অন্তরালেই থেকে যায়! আবার একদল বিশেষজ্ঞ পুরো ঘটনাটিকেই বায়ো-মেডিক্যাল লেন্সের মাধ্যমে দেখতে চাইবেন। সেখানে সেই মানুষটির স্নায়ুপ্রেরকের ভারসাম্যহীনতাই পাবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার! এই দু-ধরনের দেখার মধ্যেই এক ধরনের একদেশদর্শিতা রয়েছে। কোনও একমাত্রিক দৃষ্টি দিয়ে মনকে সামগ্রিক ভাবে বোঝা কতটা সম্ভব তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়! মন এবং মনের সমস্যার নানাবিধ কারণ সামগ্রিকভাবে বোঝার ক্ষেত্রে ডাঃ জর্জ এঙ্গেলের ‘বায়োসাইকোসোশ্যাল মডেল’-এর গুরুত্ব বর্তমানে অপরিসীম।
মনের সমস্যার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলির গুরুত্ব যতটা রয়েছে, বাহ্যিক-পরিবেশগত নানা উপাদানের ভূমিকা এতটুকু কম নয়। সম্প্রতি কোভিড ১৯-এর অভিঘাত মানুষের মনে কতটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে তা আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। কোভিড-অতিমারির পর্বে মানসিক সমস্যার প্রকোপ যে অনেকটাই বেড়েছে, তা বেশ কয়েকটি সমীক্ষা-গবেষণায় উঠে এসেছে।
মানুষের ভালো থাকার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তার জীবনের জরুরি চাহিদাগুলো পূরণ হওয়ার। সেই জরুরি চাহিদাগুলোর মধ্যে রয়েছে তার দু-বেলা সুষম খাদ্য, পরিধান, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ এবং নির্বিঘ্নে জীবন যাপন। এর সঙ্গে দুটো অধিকারও যুক্ত হয়ে যায়, অন্যদের অসুবিধা না-করে নিজের পছন্দ মতো যাপন ও মতপ্রকাশের অধিকার।
‘বিশ্ব প্রসন্নতা সূচক’ বা ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্স-এ একটা দেশের মানুষের ভালো থাকা নির্ধারণ করা হয় কতকগুলি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে।
- প্রকৃত সামাজিক সুরক্ষা
- মাথাপিছু জাতীয় গড় উৎপাদন
- নিজের পছন্দে যাপনের স্বাধীনতা
- বয়সের নিরিখে সুস্থভাবে বাঁচার প্রত্যাশা
- দুর্নীতি সম্পর্কে ধারণা/দৃষ্টিভঙ্গি
- উদারতা
ওপরের এই বিষয়গুলি আপাতভাবে আমাদের শরীরের বাইরের বিষয়, বাহ্যিক পরিবেশের বিষয়। এই বাহ্যিক বিষয়গুলির ওপরেও আমাদের ভালো থাকা অনেকটা নির্ভর করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যখন কাশ্মীরে ভারত রাষ্ট্র সেখানকার মানুষের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে, যোগাযোগের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দিয়ে পুরো কাশ্মীরকেই জেলখানা বানিয়ে ফেলে তখন সেখানকার মানুষের মনের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা, বিপর্যয়ের গভীর ক্ষত তৈরি হওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক। অবশ্য এই বিপর্যয়ের প্রভাব শুধু কাশ্মীরের মানুষের মনেই পড়েছে এমন নয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী বহু মানুষের মনেও গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল কাশ্মীরের ওই সময়ের ঘটনা-পরম্পরা। এভাবেই আমাদের পারিপার্শ্বিক আমাদের মনের ওপর ছাপ ফেলে যায়! জন্ম দেয় নানাবিধ মানসিক সমস্যা কিংবা অসুস্থতার।
মূলত, অভ্যন্তরীণ নানা প্রবণতা এবং বাহ্যিক বিবিধ কারণের মিথস্ক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা সৃষ্টির কার্যকারণ!
শরীর অসুস্থ হলে যেমন তার চিকিৎসার নানা পদ্ধতি রয়েছে, তেমনই মনের মধ্যে কোনও সমস্যা দেখা দিলেও রয়েছে চিকিৎসার বহুবিধ উপায়। আমরা যদি মনের অসুস্থতার কারণগুলিকে মনে রেখে মনের সমস্যা থেকে নিষ্কৃতির উপায় খুঁজি তাহলে আমাদের শুরু করতে হয় অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলি দিয়ে। অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলির মধ্যে আমরা আগেই উল্লেখ করেছি বংশগত বৈশিষ্ট্য, শৈশব-অভিজ্ঞতা, মানসিক বৈশিষ্ট্য, মস্তিষ্ক-স্নায়ুতন্ত্র-স্নায়ুপ্রেরকের মতো উপাদানগুলির কথা। মানসিক সমস্যার কারণ অনেক সময় সুপ্তভাবে থাকতে পারে আমাদের বংশগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যা আমরা বংশ পরম্পরায় বহন করে চলি। এক্ষেত্রে যদি কোনও কারণ থেকে থাকে, তার সংশোধন আমাদের আয়ত্তের বাইরে।
শৈশব অভিজ্ঞতার মধ্যেও অনেক সময় আমাদের বর্তমান মানসিক বিপত্তির কারণ সুপ্তভাবে থাকতে পারে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সাইকোডায়নামিক তত্ত্বের মধ্যে শৈশব অভিজ্ঞতাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে। শৈশবের অবদমিত সেইসব অভিজ্ঞতা, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি অতীত খুঁড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মতো তুলে এনে নতুন করে resolve বা সমাধান করার ব্যবস্থা ফ্রয়েড উদ্ভাবিত সাইকোঅ্যানালিসিস বা মনঃসমীক্ষণের মাধ্যমে রয়েছে।
আমাদের মানসিক বৈশিষ্ট্য — অর্থাৎ চিন্তা-ভাবনার ধরন, প্রত্যক্ষণ, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের ধরন — যা গড়ে উঠেছে আমাদের বংশগত বৈশিষ্ট্য, শৈশব অভিজ্ঞতা ও আমাদের চারপাশের পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ায় — সেগুলির পরিবর্তন কথোপকথন-নির্ভর কাউন্সেলিং এবং সাইকোথেরাপির মাধ্যমে অনেকটাই সম্ভব। এক্ষেত্রে কাউন্সেলর (Counselor) এবং মনোবিদ (Psychologist)-এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
শরীরের ভিতরের বিভিন্ন স্নায়ুপ্রেরক বা নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা আমাদের মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে! এক্ষেত্রে মনোচিকিৎসক (Psychiatrist) বিভিন্ন ধরনের আধুনিক ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসার সাহায্যে সেই স্নায়ুপ্রেরকের ভারসাম্যহীনতা দূর করে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত মানুষকে সুস্থ করে তুলতে পারেন। মনোরোগ চিকিৎসায় ওষুধের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনোরোগের চিকিৎসা এবং ওষুধ সম্পর্কে বহু ভ্রান্ত ধারণা জনমানসে ছড়িয়ে রয়েছে। এর ফলে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক ধরনের বিপত্তি দেখা দেয়।
এতক্ষণ আমরা দেখলাম, মনের অসুখ হলে তার চিকিৎসার পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। যদিও সেই সুযোগ কতটুকু সমাজের বিপুল অংশের মানুষ পেতে পারেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, মনোচিকিৎসক-মনোবিদ-কাউন্সেলর — এঁদের বেশির ভাগেরই সাক্ষাৎ মেলে শহর এবং শহরের আশপাশে। অথচ দেশের সিংহভাগ মানুষের বসবাস গ্রামাঞ্চলে।
সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে রোগপ্রতিরোধ বা প্রিভেনশন-এর গুরুত্ব অপরিসীম। মনের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও প্রিভেনশনের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভাবার কথা! কিন্তু, আমাদের দেশে শারীরিক বা মানসিক — কোনও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেই প্রিভেনশন বা রোগপ্রতিরোধের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কোথাও সেভাবে চোখে পড়ে না! এক্ষেত্রে সরকার এবং অসরকারি দৃষ্টিভঙ্গিতেও তফাত তেমন চোখে পড়ে না! ব্যতিক্রম কিছু থাকতে পারে, তবে তা ‘নিয়ম’-কেই সিদ্ধ করে। মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রেও রোগ প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে!
মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রতিরোধে কোন বিষয়গুলোর ওপর আমরা গুরুত্ব দেব? মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার, মন ভালো রাখার উপায় কী? কী করলে মনের অসুস্থতা থেকে দূরে থাকা যাবে?
…এই প্রশ্নগুলোর কোনও সহজ হাতে গরম উত্তর নেই। নেই কোনও মেড-ইজি বা পাসওয়ার্ড। একজন মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী ভালো থাকার উপায় খুঁজে পেতে পারেন মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির অন্তর্নিহিত ও পরিবেশগত বাহ্যিক কারণের মধ্যে। অন্তর্নিহিত কারণের মধ্যে চিন্তা-ভাবনার ধরন, প্রত্যক্ষণ বা দেখার ভঙ্গি, আবেগ-অনুভূতির অবদমন কিংবা যথাযথ প্রকাশে অপারগতা এবং স্নায়ুপ্রেরকের ভারসাম্যহীনতা মুখ্য ভূমিকা নেয়। এছাড়াও শরীরের বাইরের পরিবেশ এবং প্রতিকূল ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেও নিহিত থাকে মনের অসুস্থতার কারণ।
মনের সমস্যার অল্প কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানে আমরা উল্লেখ করতে চাইব, যে কারণগুলোর মধ্যে আমাদের মনের সমস্যার বীজ সুপ্ত ভাবে থাকে। সেই কারণগুলোকে যদি আমরা একটু গভীরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে তার প্রতিকারের পথও আমরা খুঁজে পেতে পারি!
- প্রতিদিনের যাপনে পর্যাপ্ত পুষ্টি ও জলের ঘাটতি, প্রয়োজন মতো বিশ্রাম ও ঘুমের অভাব;
- বয়স অনুযায়ী পেশাগত দায়িত্ব থেকে দূরে থাকা, কোনও কাজকর্ম না-করে অলস যাপন;
- জীবনে যত্ন, পরিচর্যা ও ভালোবাসার অভাব;
- ন্যূনতম শরীর চর্চা না-করা;
- প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বাস্তবতা বোধ এবং পরিমিতির অভাব;
- প্রকৃত আত্মসচেতনতার অভাব;
- যথার্থ আত্মপ্রতীতি (Selfesteem)-র অভাব : নিজেকে খুব বড়ো কিংবা ছোটো করে দেখার প্রবণতা;
- অন্যের কথা শোনার ধৈর্য ও মানসিকতার অভাব, কথোপকথনের ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে বোধের অভাব;
- কাছের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্কে যত্ন ও পরিচর্যার অভাব;
- সম্পর্কে উদাসীনতা কিংবা অতিনির্ভরতা;
- কাছের মানুষদের অনুভূতিকে তাঁদের জায়গা থেকে অনুভব করার অক্ষমতা;
- সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সবদিক বিবেচনা করে, পক্ষের-বিপক্ষের যুক্তিগুলো বিশ্লেষণ না-করে সিদ্ধান্ত নেওয়া;
- নিজের অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা স্ট্রেসের লক্ষণ এবং কারণগুলো সম্পর্কে সজাগ না- থাকা;
- যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞানমনস্কতার পরিবর্তে অলীক কোনও কিছুর প্রতি ভয় ও ভক্তির প্রাবল্য;
- শুধু নিজে ভালো থাকতে চাওয়া, স্বার্থপরতা, অন্যের বিপদ-আপদে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকা, একা বাঁচার প্রবণতা;
- নিজের বিভিন্ন আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, সেগুলোর অবদমন কিংবা প্রকাশে সংযমের অভাব;
- অন্যদের সব সময় সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা, কারোর ওপর আস্থা রাখতে না-পারা;
- সব কিছুতে নিজেকেই একমাত্র সঠিক হিসাবে দেখা, অন্যদের মতামত ও ভাবনাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা, অন্যদের থেকে শিখতে না-চাওয়া;
…এই তালিকা এখানে থেমে যায় না, আরও অনেক দীর্ঘ হতে পারে, আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা দিয়ে পুষ্ট হতে পারে। আমাদের মনের সমস্যার কারণ নিহিত থাকে এগুলোর মধ্যেই। আমরা যদি কারণগুলোকে আর একটু গভীরে, আর একটু বিস্তারিত ভাবে জানতে বুঝতে পারি, তাহলে এগুলো সম্পর্কে ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠতে পারি, চেষ্টা করতে পারি এগুলো থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ১৯৯৭ সাল নাগাদ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধ ও মনোসামাজিক উৎকর্ষ বৃদ্ধির ভাবনা থেকে জীবন কুশলতা বা Life Skills-এর গুরুত্বকে তুলে ধরে। এই কুশলতাগুলো সম্পর্কে যথাযথ বিজ্ঞানসম্মত ধারণা ও নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে সম্ভব হতে পারে মনের বেশ কিছু সমস্যাকে প্রতিহত করা, তুলনামূলক সহজ হতে পারে দৈনন্দিন জীবন যাপনের পথে নানাবিধ প্রতিকূলতা সামাল দেওয়া, বৃদ্ধি পেতে পারে বিভিন্ন ধরনের মনোসামাজিক উৎকর্ষ যা একজন দায়িত্বশীল সুস্থ মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।
খুব সংক্ষেপে এখানে কয়েকটি কুশলতা সম্পর্কে একেবারে প্রাথমিক ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম আমরা।
নিজেকে জানা
আমরা সবাই নিজেকে জানি। কিন্তু, সেই জানার মধ্যেও অনেক অজ্ঞতা, অনেক অসচেতনতা, অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। পুরাকালে প্রাজ্ঞজনেরা নিজেকে জানার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পাশ্চাত্যের দার্শনিকের কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, ‘Know thyself’, আমাদের উপমহাদেশেও উচ্চারিত হয়েছিল ‘আত্মানংবিদ্ধি’। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না…!’ আপনাকে জানার শুরু থাকে, শেষ থাকে না! যতদিন জীবিত থাকি আমরা, নিরন্তর চলতে থাকে সেই আত্মসচেতনতার পাঠ। জীবনের সঙ্গে সঙ্গেই ফুরায় সেই জানা।
দার্শনিকের প্রজ্ঞায় নয়, সহজভাবে নিজেকে জানাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের প্রত্যেকের জন্য। জীবনের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন বিষয়ের মুখোমুখি হতে, নিজেকে সম্যকভাবে জানা জরুরি। নিজের পছন্দ-অপছন্দ, নিজের দক্ষতা-সীমাবদ্ধতা, নিজের দোষ-গুণ, নিজের আবেগ অনুভূতি, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য, সেই লক্ষ্য অর্জনে নিজের পরিকল্পনা…এই সব কিছু নিয়েই আত্মসচেতনতার পাঠ, যা জীবনযাপনের পথে বিশেষ জরুরি। বয়ঃসন্ধিকালে নিজের শরীর ও মনের বিভিন্ন পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণাও ‘আত্মসচেতনতার’-র এই পাঠের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠতে পারে। ঝুঁকিপ্রবণ বা বিপজ্জনক কিছু করার আগে কিংবা ভুল পথে চলার সময় কী করছি? কেন করছি? কী তার পরিণতি? — এইসব প্রশ্নও মনের মধ্যে জাগতে পারে আত্মসচেতনতার পথ ধরেই।
আত্মপ্রতীতি
ক্রমাগত নেতিবাচক সমালোচনা শুনতে শুনতে ছেলেমেয়েদের একটা বড়ো অংশ হীনম্মন্যতার জালে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ে। হারিয়ে ফেলে আত্মবিশ্বাস। ফলে দেখা যায় নিজের ওপর অনাস্থা, লক্ষ্য স্থির করার ক্ষেত্রে অনীহা কিংবা দোদুল্যমানতা, একটুতেই উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, বিষণ্ণতা। হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যেই ঝুঁকিপ্রবণ, হঠকারী কাজকর্মে (যেমন — মাদক-নির্ভরতা, দুর্ঘটনা-প্রবণ আচরণ, অরক্ষিত যৌনসংসর্গ প্রভৃতি) জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বিশেষভাবে চোখে পড়ে। আত্মপ্রতীতি যথার্থ না-থাকার কারণেই অসামাজিক কাজকর্মের মাধ্যমে সমীহ আদায়কারী কোনও চরিত্রকে নিজের রোলমডেল হিসাবে ভাবতে শুরু করে আত্মপ্রতীতি যথার্থ না-থাকা কিশোর বা কিশোরী। বড়োদের ক্ষেত্রেও যথার্থ আত্মপ্রতীতির অভাব এই ধরনের প্রভাব ফেলে।
আত্মপ্রীতির চর্চা সেই হীনম্মন্যতা দূর করে নিজের সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন করতে শেখায়। নিজের প্রতি ও অন্যদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। নিজের মধ্যেকার সুপ্ত সম্ভাবনাগুলি সম্পর্কেও তৈরি হয় ইতিবাচক ধারণা। গড়ে ওঠে আত্মবিশ্বাস, যা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের অন্যতম প্রধান শর্তও।
কথোপকথন/ সংযোগস্থাপন
আমাদের শৈশব থেকেই শিখতে হয় পড়তে এবং লিখতে। কিন্তু, কেমন করে শুনতে হয় অন্যের কথা তা বাড়িতে বা স্কুলে গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয়েছে — এমন অভিজ্ঞতা ব্যতিক্রমী। পারস্পরিক কথোপকথনের বা সংযোগস্থাপনে অন্যের কথা ধৈর্যের সঙ্গে, মন দিয়ে শোনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা রপ্ত করা সংযোগস্থাপনের চর্চা এবং নিয়মিত অনুশীলনে অনেকটাই সম্ভব।
‘কী বলব?’ — এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ‘কীভাবে বলব?’ — তার ওপরেও সমান গুরুত্ব দেওয়া এবং সেই বিষয়ে কুশলতা অর্জন করা জরুরি। বহুক্ষেত্রেই সংযোগস্থাপন কুশলতার অভাবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে তৈরি হয় অনভিপ্রেত বিষণ্ণতা, সম্পর্কের সংকট।
পারস্পরিক সম্পর্ক
পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য মানুষজনের সঙ্গে কীভাবে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা ও বজায় রাখা যায়, কীভাবে সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায় — সে বিষয়ে ভাবনার এবং চর্চার প্রয়োজন বোঝা যায় এর অনুশীলনে। পারস্পরিক সম্পর্ক-কুশলতার চর্চা সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে যেমন সচেতনতা গড়ে তোলে, তেমনি ক্রমবিচ্ছিন্নতার এই সময়ে যূথবদ্ধ সামাজিক মানুষ হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও উপলব্ধি তৈরি করতে সাহায্য করে।
সমানুভূতি
পারস্পরিক সম্পর্ক — তা সে ব্যক্তিগত বা সামাজিক, যাই হোক না কেন, তার প্রকৃত যত্ন ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে সমানুভূতি বা Empathy-র ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিজেকে অন্যের জায়গায় নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে তার আবেগ-অনুভূতিকে অনুভবের আন্তরিক প্রয়াস এবং যথাযথভাবে তার কাছে তা প্রকাশ করা — এই হল সমানুভূতির মূল কথা।এই কুশলতার চর্চায় শেখা যায় কীভাবে অন্যের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হয়, শ্রদ্ধা করতে হয়।
আজকের পৃথিবীতে বর্ণ-ধর্ম-লিঙ্গ-যৌন পরিচিতি নিয়ে বৈষম্য যেভাবে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে, বাড়ছে নিপীড়ন, বাড়ছে সামাজিক ও ব্যক্তি জীবনে পারস্পরিক দূরত্ব — এই প্রেক্ষাপটে অন্যের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছে। সমস্ত ধরনের প্রান্তিকতাকে সমানুভূতির সঙ্গে গ্রহণের মাধ্যমেই একীভূত সমাজ বা Inclusive society-র বাস্তবায়ন সম্ভব।
দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের কথা বলতে পারা/ প্রয়োজনে ‘না’ বলতে পারা
- অনিচ্ছা থাকলে ‘না’ বলব, কিন্তু কীভাবে বলব?
- প্রয়োজন মনে হলে ‘না’ বলব, কিন্তু কীভাবে বলব?
- চাপের মুখে ‘না’ বলব, কিন্তু কীভাবে বলব?
- দৃঢ়ভাবে নিজের মত ব্যক্ত করব, কিন্তু কীভাবে?
নিয়মিত অনুশীলনে রপ্ত করা সম্ভব অন্যকে আঘাত না-করে নিজের মনের কথা দৃঢ়তার সঙ্গে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার কুশলতা। এই কুশলতা দৈনন্দিন জীবনে অন্যদের অবাঞ্ছিত অনুরোধ/ চাপ/ প্ররোচনার হাত থেকে রক্ষা পেতে যেমন অত্যন্ত কার্যকর তেমনই কোনও মাদক দ্রব্য নেওয়ার জন্য চাপ বা প্ররোচনা থেকে রক্ষা পেতেও সহায়ক। এছাড়া অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন সংসর্গ বা নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতেও যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে এই কুশলতা। এই কুশলতার চর্চার মধ্যে দিয়েই ঝুঁকিপ্রবণ বিভিন্ন আচরণের পরিণতি সম্পর্কেও গড়ে তোলা যেতে পারে সম্যক ধারণা।
সমস্যা নিরসন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ
সমস্যাকে স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা, তার সমাধানের বিভিন্ন উপায়গুলো চিহ্নিত করা, এরপর সেই উপায়গুলো স্বতন্ত্রভাবে বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে কার্যকর সমাধানসূত্রটি বেছে নেওয়া এবং তাকে বাস্তবে প্রয়োগ করা — এই কুশলতা সমস্যা নিরসনের যুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়ার অনুশীলনের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। এলোমেলো চিন্তাকে সুবিন্যস্ত করে যুক্তিগ্রাহ্য সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পদ্ধতি রপ্ত করা সম্ভব এই কুশলতার অনুশীলনে।
স্ট্রেস বা অতিরিক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ
‘স্ট্রেস’ শব্দটি আমাদের কাছে খুব অপরিচিত নয়। এর নিকটতম বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে ‘চাপ’। এই স্ট্রেস বা চাপ আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে একপ্রকার অপরিহার্য। আমরা সারাদিনে যে কাজই করি না কেন, তা স্ট্রেস না থাকলে সম্ভবপর নয়। পড়াশোনা করা/ পরীক্ষা দেওয়া, খেলাধুলো, চাকরি করা, কোথাও যাওয়া, সাংসারিক কাজ করা, সামাজিক/ রাজনৈতিক/ সাংস্কৃতিক কাজ… সবেতেই স্ট্রেস প্রয়োজন। এমন কি এক গ্লাস জল গড়িয়ে খেতেও স্ট্রেস লাগে। স্ট্রেস ছাড়া আমাদের জীবন স্থবির-স্থাণু-গতিহীন! তাই মানুষের জীবনে স্ট্রেস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান।
কিন্তু, কখনও কখনও এই স্ট্রেস বা চাপ একটা সীমা অতিক্রম করলে দেখা দেয় নানাবিধ সমস্যা। ‘ওভার-স্ট্রেস’ বা ‘অতিরিক্ত চাপ’ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে আমাদের শরীরে, মনের চিন্তায়-আবেগঅনুভূতিতে-আচরণে। নেতিবাচক প্রভাব আমরা দেখি, পড়াশোনায়-কাজকর্মে-ফলাফলে এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কেও।
মনের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হলে কীভাবে তার লক্ষণগুলো চেনা যায়, কীভাবে সময় সচেতন হয়ে উঠে চাপ কমানো যায়, কীভাবেই বা অতিরিক্ত চাপ থেকে মুক্ত থাকার জীবনযাপন পদ্ধতি রপ্ত করা যায় — এই কুশলতার চর্চায় সে সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে।
আবেগ নিয়ন্ত্রণ
নিজের বিভিন্ন অনুভূতি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং যথাযথভাবে সেগুলোকে প্রকাশ করার মাধ্যমে নিজের বিভিন্ন আবেগকে সামাল দিতে পারা সম্ভব আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে সচেতনতা এবং তা নিয়ন্ত্রণের চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে। ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সংক্রান্ত নানা সমস্যা এবং বিষণ্ণতা ও আত্মহননের প্রবণতা প্রতিরোধেও আবেগ নিয়ন্ত্রণ কুশলতার অনুশীলন যে কোনও মানুষের কাছে সহায়ক হয়ে উঠবে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
যুক্তিমনস্ক চিন্তার কুশলতা
ইতিহাস বইয়ের দৌলতে আমরা জেনেছি, মানব সভ্যতার আদি পর্বে মানুষ বনে-জঙ্গলে-গুহায় বসবাস করত। আর, সমাজবিজ্ঞানের পঠনপাঠনে আমরা জেনেছি, আদি মানবজীবন প্রকৃতির কাছে অসহায়তা থেকেই উদ্ভাবন করেছিল ঈশ্বরের। আদিম মানুষ যখন বনে-জঙ্গলে-গুহায় বসবাস করত, সেই সময় সম্পূর্ণভাবে তাদের অস্তিত্ব প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাদের খাদ্য ছিল ফলমূল, নদীর মাছ, শিকার করা বন্য জীবজন্তু। এই জঙ্গলজীবনে তাদের বিপদ আপদ খুব কম ছিল না! প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হত প্রায়ই তাদের। বন্যা, বজ্রবিদ্যুৎ, দাবানল, সাইক্লোন, নানা অসুখবিসুখ-মহামারি, আর ছিল নানা হিংস্র জীবজন্তু ও বহু রকমের সরীসৃপ। এসবই আদি মানবজীবনে নিয়ে আসত নানা বিপর্যয়। এইসব বিপদের কাছে মানুষ নিজেকে অসহায় ভাবত। আর, এই ভাবনা থেকেই মানুষ এইসব বিপর্যয়কারী শক্তিকে বিভিন্ন কৌশলে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু করে। ওই সময়েই কিছু মানুষ ভাবতে শুরু করে, এইসব বিপর্যয় সৃষ্টিকারী প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো কেউ হয়তো নিয়ন্ত্রণ করে। সেই শক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে বিপর্যয়। মানুষ তখনও আবিষ্কার করতে পারেনি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বস্তুগত বা প্রাকৃতিক কারণ। এই পর্বেই প্রতিটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মূলে মানুষ কল্পনা করল অসীম শক্তিধর নিয়ন্ত্রকের। জন্ম হল ঈশ্বরের। মানুষের অসহায়তা, ভয়, অজ্ঞতা আর অসামান্য কল্পনাশক্তির মিথস্ক্রিয়াই ঈশ্বরের জন্মভূমি।
সেই সময়ে মানুষ নানা ধরনের ইন্দ্রজালের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু করে এইসব প্রাকৃতিক শক্তিকে। তাতে ব্যর্থ হয়ে কালক্রমে মানুষ আত্মসমর্পণ করে নিজেরই কল্পনায় গড়ে তোলা ঈশ্বরের কাছে। ইন্দ্রজাল ক্রমে রূপান্তরিত হয় যাগযজ্ঞ, পূজা-অর্চনায়। মানুষ বিশ্বের প্রায় সর্বত্র এই ভয় থেকেই, এই অসহায়তা থেকেই ঈশ্বরের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু, সর্বত্র একই ঈশ্বর সৃষ্টি করেনি।প্রথম পর্বে প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকেই ঈশ্বরে রূপান্তরিত করেছে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষ ওই পর্বে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে দাবানলের ভয়ে অগ্নিদেবকে, বৃষ্টি বন্যার ভয়ে বরুণদেবকে, বজ্রবিদ্যুতের ভয়ে ইন্দ্রকে। পরবর্তীকালে মানুষ তার অসাধারণ কল্পনাশক্তির দ্বারা রচনা করেছে অনেক পুরাণ কাহিনি। নিজের অবয়বেই গড়ে তুলেছে অধিকাংশ ঈশ্বরকে। আরোপ করেছে সেই সব ঈশ্বরের উপর নানা শক্তি, নানা গুণাবলি। এক এক দেশে এক এক রকম ঈশ্বর। আমাদের দেশের হিন্দু পুরাণে গড়ে তোলা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের সন্ধান পৃথিবীর অন্য প্রান্তগুলোতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার গ্রিক পুরাণে গড়ে তোলা জিউস প্রমুখ দেবতার সন্ধান এই উপমহাদেশে পাওয়া সম্ভব নয়।
মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে কৌতূহল থেকেই মানুষ আত্মার কল্পনা করেছে। স্বর্গ-নরক গড়ে তুলেছে কল্পনায়। আবার ভূত-প্রেত-অশরীরী আত্মার সৃষ্টিও এই ভাবনা থেকেই।
সমাজবিজ্ঞানের পাঠকদের কাছে এই বৃত্তান্ত অজানা কিছু নয়। বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারের ফলে আমরা জেনে গেছি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণগুলোও। তবুও আমাদের ভয় আর অসহায়তা থেকে গড়ে তোলা ঈশ্বর এখনও রয়ে গেছেন দিব্যি! আসলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মূলে যে বস্তুগত কারণ থাকে, তা হয়তো সমাজের একটা অংশ বুঝেছেন। কিন্তু, এখনও বৃহত্তম অংশের কাছে তা পৌঁছায়নি। কিংবা পৌঁছালেও তা আস্থা অর্জন করতে পারেনি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো ছাড়াও মানুষের জীবনে নেমে আসে অনেক ধরনের বিপর্যয়, দেখা দেয় অনেক রকমের অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা। আধুনিক এই পৃথিবীতে ঈশ্বরের টিকে থাকার, ভূত-প্রেত-অশরীরী আত্মার টিকে থাকার, যাগযজ্ঞ পূজা-অর্চনা, ঝাড়ফুঁক, আংটি-কবচ টিকে থাকার বস্তুগত কারণ হয়তো এর মধ্যেই রয়েছে।
একেবারে যখন মুখে কথা ফোটেনি, শিশুর সেই সময় থেকে শুরু হয় কোনও ঈশ্বর-মূর্তির সামনে দাঁড় করিয়ে ‘নমো’ করতে শেখানো। হিন্দুর ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুটি শেখে মাটি বা অন্য কিছু দিয়ে গড়া মূর্তিকে ঈশ্বর কল্পনায় পুজো করতে, মুসলমান পরিবারে শেখে ইসলামি রীতিতে নামাজ, খ্রিস্টান পরিবারের শিশু শেখে গির্জায় প্রার্থনা করতে। এইভাবে শৈশবেই ধর্মবিশ্বাসের ইনজেকশন দেওয়া শুরু হয়। সেই বিশ্বাসকে আরও পাকাপোক্ত করতে হাতে খড়ি, উপনয়ন, ব্রত, তাগাতাবিজ… চলতে থাকে। নানা ধরনের বিপদের তাড়না থেকেই বিপত্তারিণীর লালসুতো ‘আধুনিক’, ‘শিক্ষিত’, ‘প্রগতিশীল’ হাতেও দিব্যি শোভা পায় — তা যতই মলিন এবং নোংরা হয়ে যাক না কেন!
পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম আমাদের ভূত, প্রেত অশরীরী আত্মার বিশ্বাসকে টেনে নিয়ে চলেছে। হিন্দু সমাজে মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধ নামক যে অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে তা আসলে ওই ভয় থেকেই মূলত। আত্মার শান্তি! মৃতজনের আত্মা যদি শান্ত না-হয়, ক্ষতি করতে পারে কাছের মানুষদেরই — এমন একটা অদ্ভুত বিশ্বাস থেকেই শ্রাদ্ধ-শান্তির আয়োজন হয়। শ্রাদ্ধ না-হওয়া পর্যন্ত তাই কাছার সঙ্গে লোহার চাবি নিয়ে থাকতে হয়, নইলে যদি ক্ষতি হয়! অভিজ্ঞতায় আমরা দেখতে পাই এইসব শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে ভুরিভোজ আর আনুষ্ঠানিক রীতিনীতিই মুখ্য থাকে, ‘শ্রদ্ধা’-র স্থান তেমনভাবে থাকে না বললেই চলে! জন্ম থেকে শুরু করে বিবাহ মৃত্যু প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভয় আর ভক্তির চাষাবাদ চলতে থাকে। আর বর্তমানে ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ বারোয়ারি রূপ নিয়ে হাজির আমাদের কাছে। যুক্ত হয়েছে ফুর্তির নানা অনুষঙ্গ, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, কর্পোরেট বদান্যতায় যা এক উৎকট চেহারা নিয়েছে। ‘নবজাগরণের অগ্রদূত’ রামমোহন রায়ের উচ্চারিত ‘মূর্তিপূজা কুসংস্কার’-কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে আমরা অন্ধকারের আরাধনায় নিমগ্ন। ছেলেমেয়েদের আস্থা রাখতে শেখাচ্ছি নানা দেবদেবীতে, মন্দির-মসজিদে, পুরুত-মৌলবিতে, জ্যোতিষ-গুনিনে, তাবিজ-কবচে — শুধু নিজের ওপর নয়! ছেলেমেয়েদের আত্মবিশ্বাসের সমূহ সর্বনাশ করে, সারাজীবন নানান ভয়ের দাসত্বকেই আমরা নিশ্চিত করতে চাইছি! আর, এই সব ঈশ্বর-আল্লাহ্-গড-আত্মা-পরমাত্মা-ভূত-প্রেত-এর ওপর বিশ্বাস থেকেও অনেক সময় চোখে পড়ছে তীব্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-ভয়-আতঙ্ক-আত্মবিশ্বাসের অভাব-অপরাধবোধ-অসহায়তার মতো নানা মনের সমস্যার লক্ষণ! অলীক কোনও কিছুর প্রতি ভক্তি কিংবা ভয়, দুটোই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। দুটোর কোনোটাই মনের স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল নয়। এখানে মনে রাখা জরুরি, স্পিরিচ্যুয়ালিটির সঙ্গে অলীক কোনও কিছুর প্রতি বিশ্বাস-ভিত্তিক ধর্মবোধের পার্থক্য রয়েছে।
তথ্য বলছে, যে দেশগুলোতে ঈশ্বর-আল্লাহ্-গডে বিশ্বাসীর সংখ্যা যত বেশি সেই সব দেশে দারিদ্র, হিংসা ও অসুখী মানুষের সংখ্যা তত বেশি। বরং, ‘পরম কল্যাণময়’-এর অস্তিত্বে অবিশ্বাসী দেশগুলো বিশ্বের সুখী দেশগুলোর তালিকায় বেশ ওপরের দিকে!
উদ্ভাবনী চিন্তার কুশলতা
প্রযুক্তির বিকাশ যেমন আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে, ঠিক সেভাবেই ক্রমশ কেড়েও নিচ্ছে অনেক কিছু। সেই কেড়ে নেওয়ার মধ্যে রয়েছে আমাদের উদ্ভাবনী কুশলতা। যে কুশলতা অনেকাংশেই নির্ভর করে আমাদের কল্পনাশক্তির ওপর। টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ট্যাব আমাদের মনের মধ্যে কোনও চিত্রকল্প তৈরি করতে সাহায্য করে না। বরং তা রুদ্ধ করে দেয় আমাদের ভাবনার এবং কল্পনার জগতকেই। উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ আমাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সামগ্রিকভাবে, এই হল কিছু মৌলিক জীবনকুশলতা, যা ব্যক্তি মানুষের মনোসামাজিক উৎকর্ষ (psychosocial competence) বাড়াতে অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এবং এর বিস্তৃত পরিসরে জীবনের প্রয়োজনীয় যে কোনও বিষয়কেই অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব, তা সে মাদক-নির্ভরতাই হোক, কিংবা এইচ আই ভি /এইডস হোক বা আত্মহননের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোক।
সামগ্রিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের রোগ প্রতিরোধ ও মনোসামাজিক উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে জীবনকুশলতার চর্চার গুরুত্ব নীতিনির্ধারকরা যথাযথ ভাবে উপলব্ধি করতে পারলে এবং প্রয়োগের উদ্যোগ নিলে সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে তা বড়ো ভূমিকা নিতে পারে।