ইডিপাস ও শৈশব যৌনতা : ফ্রয়েড বনাম পাভলভ

ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়

ধারণা ও পদ্ধতিগত আলোচনা

হ্যারি. কে. ওয়েলস ফ্রয়েড ও পাভলভের দুজনের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কিত পদ্ধতি ও ধারণার তুলনা করতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন যে, পাভলভ লালাগ্রন্থীর নালিপথে (salivary) উচ্চমস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত অনুসন্ধান চালিয়েছেন, আর ফ্রয়েড স্বপ্নের নালিপথে (dream fistula) মনের রহস্য অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন। সুকঠিন করোটির অভ্যন্তরে অবস্থিত মস্তিষ্কের ক্রিয়াপ্রক্রিয়া প্রত্যক্ষগোচর হয় না, কাজেই পাভলভ ‘ক্রনিক’ পদ্ধতি আবিষ্কার করে জীবিত সুস্থ প্রাণীর মস্তিষ্কক্রিয়া অনুধাবনের চেষ্টা করেন। মনের সবটাই প্রায় অজানা, ভাসন্ত তুষারস্তূপের (icebarg) মত দশ ভাগের নয় ভাগ অতল সাগরে অদৃশ্য, কাজেই ফ্রয়েড স্বপ্নের নালিপথে  নির্জ্ঞান রাজ্যে অনুপ্রবেশের প্রয়াস করেন। তুলনা কিন্তু এখানেই শেষ। পাভলভ বিজ্ঞানের চিরাচরিত পন্থায় তাঁর অনুসন্ধান চালালেন। ইন্দ্রিয়ের গ্রাহী অংশকে বাইরের বা দেহের ভিতরকার কোনো উদ্দীপকের দ্বারা উত্তেজিত করলে উদ্দীপনার তরঙ্গ স্নায়ুতন্তুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে সাড়া জাগায় — এই কথা তাঁর জানা ছিল। পরাবর্ত (reflex) সম্পর্কে পূর্বসূরিদের পরীক্ষালব্ধ তথ্যাদি পাভলভ স্বীকার করে নিলেন, সেইসব তথ্যের সাহায্যে ও তাঁর অভিনব গবেষণাপদ্ধতি প্রয়োগ (লালাগ্রন্থির নিঃসরক নলটিকে অস্ত্রোপচারের দ্বারা বাইরের চামড়ার সঙ্গে যুক্ত করে) করে নিঃসৃত লালাকে পাত্রে সঞ্চিত করে তার পরিমাণ ও গুণাবলী নির্ণয় করবার সুযোগ করে নিলেন। এইভাবে আবিষ্কৃত হল যুগান্তকারী শর্তাধীন পরাবর্ত-ক্রিয়া, জানা গেল তার বৈশিষ্ট্য ও কার্যকলাপ। শর্তহীন অর্থাৎ জন্মগত পরাবর্ত ও শর্তাধীন অর্থাৎ শিক্ষালব্ধ পরাবর্তের পার্থক্য ও পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে, মনোবিদ্যার বস্তুবাদী অর্থাৎ মস্তিষ্কভিত্তিক ও বিষয়মুখীন (objective) গবেষণায় পথ প্রদর্শন করলেন। বিজ্ঞানের ঐতিহ্য পুরোপুরি মেনে চলে তিনি কোপারনিকাস, নিউটন প্রমুখের মত যুগান্তকারী আবিষ্কার করতে সক্ষম হলেন। ঘণ্টা বাজানোর সঙ্গে লালা নিঃসরণের সম্পর্ক স্থাপন প্রাথমিক পর্যায়ের অতি সরল মানসিক ক্রিয়ার মডেল সৃষ্টি, একথা নিঃসঙ্কোচে বলা চলে। এখানে ঘণ্টা বাজানো — কারণ, সঙ্গে লালা নিঃসরণ-কার্য ; কার্যকারণ সুনিশ্চিতভাবে সম্পর্কিত — এইভাবে নিমিত্তবাদ প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত। পাভলভ ও সহকর্মীরা সব ইন্দ্রিয়-মাধ্যমে শর্তাধীন পরাবর্ত গঠন করেছেন, দেখেছেন মস্তিষ্কবল্কল (cortex)- হীন প্রাণীর শর্তাধীন পরাবর্ত তৈরি হয় না। হাজার হাজার এই ধরনের পরীক্ষা থেকে তারা অজস্র উপাত্ত সংগ্রহ করে, সেগুলির যথার্থতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়ে শর্তাধীন পরাবর্ত তত্ত্ব ও ঐ তত্ত্বভিত্তিক মনোবিদ্যা গড়ে তুলেছেন। শর্তাধীন পরাবর্ত উর্বর মস্তিষ্কের সৃষ্ট কল্পনা নয়, কঠোর পরিশ্রম ও পরীক্ষালব্ধ তথ্যের সামান্যীকরণের ফলে এর উদ্ভব : রাতারাতি কয়েকটি মাত্র তথ্যকে কেন্দ্র করে চমকপ্রদ অনুমানের সাহায্যে গড়ে ওঠা কোনো তত্ত্ব নয়। যে কোনো গবেষণাগারে যে কোনো পরীক্ষক সবসময়ে একই ফল যদি পায় তবেই বুঝতে হবে পরীক্ষালব্ধ তথ্যগুলি অবজেকটিভ ও নির্ভরযোগ্য। পাভলভের পরীক্ষালব্ধ তথ্য সম্পর্কে কোনো প্রতিবাদ সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা করেননি ; যদিও তাঁদের অনেকেই তাত্ত্বিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে পাভলভের সঙ্গে একমত ছিলেন না।

ফ্রয়েড কিন্তু প্রধানত দুটি পর্যবেক্ষিত তথ্যকে ভিত্তি করে তাঁর অনুমান ও দূরকল্পনা নির্ভর মনস্তত্ত্ব গড়েছেন। রোগীদের বেদনাদায়ক ঘটনা ভুলে যাওয়া এবং সেই ভুলে যাওয়া ঘটনা ও ঘটনা-সংশ্লিষ্ট প্রক্ষোভকে স্মৃতিপথে আনার বিরোধিতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি কাঁচা ও দুর্বলভিত্তির উপর অনুমাননির্ভর বিরাট সৌধ নির্মাণ করেছেন। তিনি অনুমান করেছেন যে মানুষের সহজাত মৃত্যুরতি প্রবৃত্তির (psychic energy) অস্তিত্ব আছে, অবদমনের ফলে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ও ঘটনার সঙ্গে জড়িত সাইকিক এনার্জি নির্জ্ঞানের রাজ্যে নির্বাসিত হয়, সেন্সর বা পাহারাদার নির্জ্ঞান থেকে সজ্ঞানে আসার দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে, আর নির্জ্ঞানস্থিত অবদমিত বাসনা কামনা নানা বাঁকাচোরা পথে ছদ্মবেশে চেতনার রাজ্যে প্রবেশ করার জন্যে নিয়ত সচেষ্ট।

এইসব অনুমান অসত্য বা অসার কল্পনা বলে উড়িয়ে দেবার কথা কেউ বলবেন না। বিজ্ঞানের সব তত্ত্বই রাশি রাশি পরীক্ষালব্ধ তথ্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, একথা বলা চলে না। বিমূর্ত গাণিতিক সঙ্কেতভিত্তিক তত্ত্ব আধুনিক বিজ্ঞানে কম নেই। কিন্তু সেই তত্ত্বভিত্তিক গণনা সবসময়েই বিভিন্ন পরীক্ষক দ্বারা পরিচালিত হলেও প্রায় একইরকমের হয় এবং মিলে যায়। নতুন তথ্য বা উপাত্ত যদি কোনো পুরানো তত্ত্বের সূত্র নিয়ে ব্যাখ্যা করা না যায় — তবে তত্ত্বকে পরিবর্তিত করা হয় অথবা পুরানো তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নেওয়া হয়। ফ্রয়েডের অনুমানসিদ্ধ প্রতীক সংকেতের অর্থ নির্বিচারে মেনে না নিয়ে স্বপ্নব্যাখ্যা বা অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতিতে মনোরাজ্যে প্রবিষ্ট হওয়া যায় না। এই প্রতীক-সংকেতের অর্থ ফ্রয়েড উদ্ভাবিত এবং কেবলমাত্র ফ্রয়েডবাদীদের দ্বারাই সমর্থিত। ফ্রয়েডবাদের সমালোচকদের প্রধান ও প্রথম আপত্তি এই যে, ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষা-পদ্ধতির গোড়াতেই গলদ। তাঁর অনুসন্ধান পদ্ধতি, বিচার বিশ্লেষণ ও তত্ত্বপ্রণয়নের মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত বিধান লঙ্ঘিত। ফ্রয়েড প্রথমে নিউরোটিকদের ব্যবহারের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে একটি তত্ত্ব প্রণয়ন করেন। পরে অন্য রোগীদের মধ্যে সেই রোগ-উপসর্গ ও ব্যবহার বৈশিষ্ট্য দেখে ভুল করে মনে করেন যে এর দ্বারা তাঁর তত্ত্ব প্রমাণিত হচ্ছে। ফ্রয়েডের অনুগামী অন্যান্য মনোসমীক্ষক ফ্রয়েডের পর্যবেক্ষণকেই শুধু নিজেদের পর্যবেক্ষণ দ্বারা সমর্থন করেছেন। তাঁর তত্ত্ব প্রমাণের কোনো চেষ্টা করেননি। বাচ্চাদের আঙুল চোষা থেকে ফ্রয়েড যে তত্ত্ব প্রণয়ন করেছেন, তাঁর সমর্থকরা আরো অনেক শিশুকে আঙুল চুষতে দেখে সেই তত্ত্বের সমর্থন করেছেন। ফ্রয়েডের পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে মনের রোগের বহু লক্ষণ ও উপসর্গ আবিষ্কার করে মনোরোগবিদ্যাকে সমৃদ্ধ করেছে কিন্তু তাঁর তত্ত্ব অপ্রমাণিত ও রহস্যময় রয়ে গেছে। একথা শুধু বস্তুবাদী পাভলভপন্থীরা নন, আরো অনেকে, যাঁদের পাভলভের প্রতি বা বস্তুবাদের প্রতি কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই — তাঁরাও বলেছেন। মানুষের আচরণ মূলত শৈশবের অবদমিত কামনা বাসনার (প্রধানত কামেচ্ছা) উপর নির্ভরশীল; পরবর্তীকালের অন্য সব ঘটনা তুচ্ছ অথবা শৈশবের অবদমনের দ্বারা প্রভাবিত— এই তত্ত্ব যুক্তিনির্ভর বলে অনেকেই ভাবতে পারেন না। পারিবারিক সমস্যা, মাতাপিতার সম্পর্ক, সন্তানের আচরণ ও মানসিকতাকে প্রভাবিত করে, কিন্তু সেই প্রভাব আজীবন তার সকল ক্রিয়াকর্ম ও চিন্তাভাবনার নিয়ন্ত্রক, এই ফ্রয়েডীয় শিক্ষার সারবত্তা সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করতে বাধ্য। চার বছরের শিশুর মধ্যে যুবকের যৌনধর্মিতা আবিষ্কার করার মধ্যে নতুনত্ব আছে কিন্তু এ আবিষ্কারের সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক নেই। এই একরৈখিক মতবাদ অনেকের মতে অগ্রাহ্য। এইসব কথা নানা স্থানে উল্লিখিত হয়েছে। তত্ত্বগঠনে বৃত্ততুল্যতা (circularity) ফ্রয়েডবাদের একটি গুরুতর ত্রুটি। শিশুর সবকিছু সমস্যা মাতাপিতার মানসিকতার দ্বারা প্রভাবিত, মাতাপিতার মানসিকতা আবার তাঁদের মাতাপিতার ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য ও ত্রুটিবিচ্যুতি দ্বারা নির্ধারিত — এইভাবে বিচার করলে সমাজব্যবস্থার দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে চলা যায় বটে, কিন্তু সঠিক কারণ নির্ধারণ করা যায় না। বিষয়ীগত দৃষ্টিতে মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়ার মূলে যে বিষয়গত (objective) উপাদান আছে তাকে উপেক্ষা করলে মানসিকতার এবং নিউরোসিসের সমাজ-পরিবেশগত কারণের অনুসন্ধান ব‍্যাহত হয়। পরিবারের বাইরে যে বৃহত্তর সমাজ সেখানেই পারিবারিক নিয়মকানুন, বিধিব্যবস্থা, ন্যায়নীতির উৎস বিদ্যমান। ব্যক্তি হিসেবে মাতাপিতার মানসিকতার বৈশিষ্ট্য অপেক্ষা শ্রেণীবিভক্ত সমাজের কোন বিশেষ ধরনের নীতি-আদর্শ ও আচরণ তাঁরা শিশুমনে অনুপ্রবিষ্ট করছেন — তাঁর গুরুত্বই বেশি। বয়ঃসন্ধিকালের (ফ্রয়েডের পরিভাষায় phallic stage) যৌনসমস্যা সহজ প্রবৃত্তিগত জৈব সমস্যা নয়; সমাজে প্রচলিত নর-নারীর সম্পর্ক ও সমাজসংগঠনের সঙ্গে এই সমস্যা বিশেষভাবে সম্পর্কিত। যৌনতা সম্পর্কিত কুসংস্কার, রহস্যময়তা, সমাজে পুরুষ প্রাধান্য, বিবাহের ও বিবাহ-বিচ্ছেদের বিশেষ আইনকানুনের সঙ্গে যৌনসমস্যা জড়িত। একজন আমেরিকান মনোরোগবিদ মন্তব্য করেছেন যে, সমাজে নরনারীর সমমর্যাদা বিদ্যমান থাকলে এবং পরিবারের সংগঠন পরিচালনা আরো স্বাস্থ্যকর হলে, যৌনসমস্যার জটিলতা অনেকখানি হ্রাস পেতে বাধ্য। ফ্রয়েড প্রেমের যে ব্যাখ্যা করেছেন, তা মেনে নিলে বা তার দ্বারা প্রভাবিত হলে নর-নারীর বৈবাহিক সম্পর্ক ও প্রেমের মধ্যে পরস্পরকে ভালবাসা বা পছন্দ অপছন্দের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর মতে স্ত্রী স্বামীর মধ্যে পিতাকে পেতে চায় বলে তাকে ভালবাসে, অথবা তার নিজের লিঙ্গহীনতা গূঢ়ৈষার (castration complex) দরুণ হীনম্মন্যতা দূর করতে স্বামীর বা প্রেমিকের উপর নির্ভর করে। পুত্রসন্তানের প্রতি মায়ের ভালবাসার মূলেও ঐ একই মানসিকতার প্রতিফলন আবিষ্কার করেছেন ফ্রয়েড। মাতৃস্নেহ, ফ্রয়েডের মতে, পুরুষ-বিদ্বেষের (তাদের যৌনাঙ্গের প্রতি ঈর্ষা) উদ্গতির ফল।

এই লিবিডোভিত্তিক ধারণার পাশাপাশি পাভলভের পরাবর্তভিত্তিক ধারণা উপস্থাপিত করা যাক। শৈশবে মাতাপিতার ও পারিবারিক প্রভাব ও শৈশব যৌনতা সম্পর্কে পাভলভের বক্তব্য বুঝতে হলে শৈশবে শর্তাধীন পরাবর্ত সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। মানবশিশু, পাভলভের ধারণা অনুযায়ী, প্রধানত দুটি শর্তহীন পরাবর্ত নিয়ে জন্মগ্রহণ করে — আত্মরক্ষামূলক পরাবর্ত ও প্রজাতি-সংরক্ষণ পরাবর্ত। আত্মরক্ষামূলক শর্তহীন কতকগুলি সহজাত শারীরবৃত্তিক ধর্ম প্রথম থেকেই শিশুর মধ্যে দেখা যায়, যথা চোষা, গেলা, মলমূত্র ত্যাগ, প্রাথমিক আত্মরক্ষামূলক চেষ্টা (চোখের কাছে আঙুল নিয়ে গেলে চোখ বন্ধ করা, খোঁচা দিলে হাত সরিয়ে নেওয়া ইত্যাদি), অবস্থান নির্ণয় (orientation reflex), বন্ধনমুক্তি চেষ্টা (freedom reflex)। কিন্তু এ সবগুলিই সংবেদন সাপেক্ষ। অর্থাৎ ঠোঁটে কিছু ছোঁয়ালে শিশু চোষার চেষ্টা করবে, হাতে খোঁচা মারলে হাত সরিয়ে নেবে ও ব্যথা পেলে কাঁদবে। সংবেদন ছাড়া শর্তহীন পরাবর্ত চালু হতে পারে না; সংবেদন ছাড়া শর্তাধীন পরাবর্ত বা নতুন অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে না। অর্থাৎ সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মালেও বাইরের জগতের বা দেহের ভিতরকার কোনো না কোনো উদ্দীপক ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত না করলে শর্তহীন পরাবর্ত (সহজাত প্রবৃত্তিক্রিয়া) সক্রিয় হয় না। শর্তাধীন পরাবর্ত বা নতুন অভ্যাস তো পুরোপুরি সংবেদনের উপর নির্ভরশীল। এসব সিদ্ধান্ত পাভলভের অনুমান নয়, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষালব্ধ উপাত্তভিত্তিক ধারণা। মলমূত্র ত্যাগের ব্যাপারে ও মলদ্বারে বা মূত্রাশয়ে সঞ্চিত মলমূত্রের চাপ সংবেদন সৃষ্টি করে বলেই মলমূত্রত্যাগের মত সহজাতক্রিয়া সচল হয়। এইসব ক্ষেত্রেই সংবেদন স্নায়ুতন্তুবাহিত হয়ে মস্তিষ্কত্বকের সংশ্লিষ্ট কোষে পৌঁছে সাড়া জাগায় বলেই প্রাথমিক শারীরবৃত্তিক ক্রিয়া সংঘটিত হয়। এইভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পদ্ধতিতে পাভলভ প্রাথমিক সহজাতক্রিয়াগুলির ওপরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা শর্তাধীন পরাবর্তিক ক্রিয়া বা মননক্রিয়ার বিষয়মুখীন গবেষণার পথ নির্দেশ করলেন; মনস্তত্ত্বকে প্রকৃতিবিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করবার বৈপ্লবিক পদ্ধতি সহকর্মী ও উত্তরসূরিদের কাছে তুলে ধরলেন। মনোবিদ্যার গবেষণা পাভলভের নির্দেশিত পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও ধৈর্যের প্রয়োজন অনেক গবেষকের মধ্যে তার অভাব থাকার দরুনই পাভলভ নির্দেশিত পথ তাঁর দেশেও সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি এবং মানুষের পবিত্র আত্মাকে ল্যাবরেটরির গবেষণার বিষয়বস্তু করার অপরাধে তিনি অনেকের দ্বারা নিন্দিত ও ঘৃণিত হয়েছেন এবং লেনিনের সরকার গঠিত হবার পূর্বে গবেষণাকার্যের জন্য উপযুক্ত উৎসাহ ও অর্থসাহায্যের অভাবে পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এইভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে তিনি ক্রমশ বুঝতে পারলেন কিভাবে সংবেদন থেকে প্রত্যক্ষণ, এবং প্রত্যক্ষণ থেকে ধারণা গড়ে ওঠে। এই ব্যাপারে স্নায়ু ও মস্তিষ্কের অর্থাৎ মননক্রিয়ার অধঃস্তরের ভূমিকা নির্ণয়ই পাভলভীয় গবেষণার বিশিষ্ট অবদান এবং এখানেই ফ্রয়েডের পদ্ধতির সঙ্গে তাঁর মৌলিক পার্থক্য।

পাভলভের পদ্ধতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে জানা গেছে যে কথা বলার আগে পর্যন্ত শিশুর অভ্যাস গঠন ও উচ্চপ্রাণীর অভ্যাস গঠন প্রায় একই ভাবে হয়ে থাকে। এই অভ্যাসের ফলেই শিশু-মানসিকতার প্রথম পর্যায় তৈরি হয়। প্রায় একই ভাবে গড়ে উঠলেও শিশুমনে তার সামাজিক পরিবেশের প্রভাব এই প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুমনকে পশুমন থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে। সামাজিক পরিবেশের প্রভাব কিন্তু নগণ্য নয়। এই প্রভাবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যে মানবশিশু প্রাথমিক মানবিক ধর্ম আয়ত্ত করে যা পশুদের অলভ্য। শারীরবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক দুই ক্ষেত্রেই নতুন গুণাবলীর বিকাশের পক্ষে সামাজিক পরিবেশের প্রভাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মাতাপিতা ও অন্যান্য আত্মজন এক কথায় পরিবার, সমাজের একটি ক্ষুদ্রতম অংশ। বৃহৎ সমাজে একই সময়ে বহু রকমের সাংস্কৃতিক ধারা, রীতিনীতি, নিত্যকৃত, মূল্যবোধ প্রচলিত থাকতে পারে। একটি পরিবার সাধারণত সে সমাজের একটি বিশেষ ধরনের ভাবধারা ও রীতিনীতির বাহক। অবশ্য পরিবারের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক রীতিনীতি মূল্যবোধের অনুগামীও হতে পারেন। সকল শিশুর মানসিকতা গঠনে পরিবারের তথা সমাজেরই সেই সব প্রভাবই কার্যকর হবে, যেগুলির সঙ্গে শিশু সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত। তবে, মোটামুটি একথা অনায়াসেই বলা চলে যে, সমাজের বহু করণীয় ও অকরণীয়, বাঞ্ছনীয় ও অবাঞ্ছনীয় ব্যাপার সম্বন্ধে শিশুমনে বাক্‌শক্তি লাভের সঙ্গে সঙ্গেই একটা ধারণা জন্মায়। বেশির ভাগ সমাজেরই শিশুচর্চার ভার মা-ঠাকুমা-দিদিমা নিয়ে থাকেন। যে সমাজে ছেলের মূল্য বেশি, মেয়ের মূল্য কম, সেখানে স্বভাবতই পুত্রসন্তান ও কন্যাসন্তানের লালন ও চর্যার ব্যাপারে মা-ঠাকুমার ব্যবহারের কিছুটা পার্থক্য দেখা দিতে পারে। ব্যবহারের বৈষম্য আদরযত্নের ত্রুটি বা আধিক্য বাক্‌স্ফূর্তি ও অন্যের কথা বোঝার ক্ষমতা আয়ত্ত করার পর শিশু অন্তত কিছুটা বুঝতে সক্ষম হয়। বাক্‌স্ফূর্তির পর থেকে শিশুর শিক্ষার ও নতুন অভ্যাস আয়ত্ত করার ক্ষমতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় সাংকেতিকস্তরে সামান্যীকরণ ও বিমূর্তকরণের ফলে বাক্‌ভিত্তিক শর্তাধীন পরাবর্ত গঠনের অজস্র সম্ভাবনা দেখা দিয়ে থাকে। শৈশব থেকে বয়ঃসন্ধিকালের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তিই পরিবারের লোক ছাড়া বাইরের অনেকের সাহচর্য পায়। অনেক কিছু শুনে, অনেক কিছু দেখে, কিছু কিছু জ্ঞান সে পাঠ্যপুস্তক ও খেলার সাথী বা শিক্ষকের কাছ থেকে লাভ করে। এ সব ব্যাপারে বাক্‌শক্তির ভূমিকাই প্রধান। নতুন যা কিছু শিখছে, নতুন যে অভ্যাস গড়ে উঠছে, সবই তার শর্তাধীন পরাবর্তকে ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও শর্তাধীন পরাবর্ত তার শর্তহীন পরাবর্ত, সহজাত প্রবৃত্তিকে পরিবর্তিত ও সংস্কৃত করছে। সে পশুশিশু থেকে ধীরে ধীরে মানবশিশু হচ্ছে, সমাজের উদ্দীপক তাকে ক্রমশ সামাজিক জীবে পরিণত করছে। পশুসুলভ জৈব প্রবৃত্তি শৈশব থেকেই ক্রমোন্নত মানবসুলভ সামাজিক ধর্মে রূপান্তরিত হচ্ছে। পশুপ্রবৃত্তির উপর চুনকাম ও পালিশ করে তাকে চকচকে করে তোলা হচ্ছে না, সহজাত প্রবৃত্তিকে সামাজিক প্রয়োজনের শর্তদ্বারা গঠিত পরাবর্তের সাহায্যে মৌলিকভাবে পরিবর্তিত করা হচ্ছে। যে সমাজে ফ্রয়েডের শৈশব অতিবাহিত হয়েছে, সেই সমাজে সামন্ততন্ত্র ভেঙে পড়েছে, বুর্জোয়া সভ্যতার পত্তন চলেছে; পরিবৃত্তিকালীন নানা সংকটের উদ্ভব ও সমাধানসূত্রের সন্ধান একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে। একদিকে ইহুদি বিদ্বেষ, ধর্মান্ধতা, অল্পসংখ্যক উচ্চশ্রেণীর শৃঙ্খলহীন অবাধ কামক্লিন্ন জীবনযাপন, প্যারী-কমিউনের পতনের দরুন এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর মনে হতাশা সিনিসিজম (cynicism); আবার অন্যদিকে মার্কসবাদ-প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠনের ক্রমবর্ধমান দাবিদাওয়া ও আশাবাদী বুদ্ধিজীবীর আমূল পরিবর্তনের স্বপক্ষে নানা ধরনের প্রচার। সমাজের নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক দিকটির প্রতি ফ্রয়েডের নজর পড়ল। তিনি সমাজের বিশেষ শ্রেণী ও ব্যক্তির মধ্যে নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্বকে মানুষের স্বভাব-নিহিত ধর্ম বলে মনে করলেন; সামন্ততান্ত্রিক সমাজের অলস সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর যৌনবিকারগ্রস্ত রোগীদের গোটা সমাজের প্রতিনিধিস্থানীয় জ্ঞান করলেন। এদের চরিত্র ও  মানসিকতাকে বিশ্লেষণ করে স্বাভাবিক মনের ক্রিয়াকলাপের তত্ত্ব প্রণয়ন করলেন। লিবিডোতত্ত্ব ও ইডিপাসতত্ত্ব দিয়ে তিনি তদানীন্তন পচনশীল সমাজের সবকিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেলেন। কঠিন করোটির আড়ালে অবস্থিত মস্তিষ্কের ক্রিয়াকাণ্ডের অধ্যয়ন বা বিশ্লেষণের কোনো উপায় না পেয়ে, তিনি নির্জ্ঞানভিত্তিক মনস্তত্ত্ব গঠনে দুর্লভ প্রতিভাকে নিয়োজিত করলেন। সমাজ বিশৃঙ্খলার অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা না করে তাঁর দূরকল্পনাভিত্তিক মনস্তত্ত্বের সাহায্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যার ব্যাখ্যা ও সমাধানের চেষ্টা করলেন। লিবিডোকে আদ্যশক্তি কল্পনা করে শিশু থেকে বয়স্ক মনের সুস্থ অসুস্থ সবরকম কার্যকলাপ লিবিডোরই খেলা মনে করে আত্মতৃপ্তি লাভ করলেন। অপরপক্ষে, পাভলভ শিশুমনের বিকাশে ও নতুন ধর্মের উন্মেষে মস্তিষ্কবিজ্ঞানের সাহায্য গ্রহণ করলেন, মানবমস্তিষ্কের বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করলেন, শিশুর মানসিকতা গঠনে মস্তিষ্ককোষের উত্তেজনা-নিস্তেজনা-ধর্মের সাহায্যে পরিবেশের উদ্দীপনাসঞ্জাত শর্তাধীন পরাবর্তের ভূমিকা নির্ণয় করলেন। কিন্তু কখনও স্নায়ুতন্ত্রের শারীরবৃত্ত আর মনস্তত্ত্বকে এক মনে করলেন না, তাদের সমীকরণ করলেন না। মস্তিষ্ককে মানসিকতার অধঃস্তর হিসেবে গ্রহণ করলেন।

ফ্রয়েডের লিবিডোভিত্তিক মনস্তত্ত্বের বিরুদ্ধে অনেকে অনেক কথা বলেছেন, এর ত্রুটি বিচ্যুতি নানাভাবে প্রদর্শন করেছেন। পাভলভ ও ফ্রয়েডের তুলনামূলক বিচারের অন্য এক বিশেষ দিক আছে, বলেছেন হ্যারি. কে. ওয়েলস। পাভলভই প্রথমে মস্তিষ্কাশ্রিত মনোবিদ্যা গঠনের পথ প্রদর্শন করেন। এই পথের অভাবেই সাইকো-অ্যানালিসিস-এর মত অনুমানভিত্তিক মনস্তত্ত্ব গড়ে উঠেছিল। আমাদের জ্ঞানভাণ্ডারের এক বিশেষ শূন্যতা পূরণ করে পাভলভ বিজ্ঞানীমাত্রেরই কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদভাজন হয়েছেন।

মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ফ্রয়েড বিষয়মুখীন বিজ্ঞানের পথ পরিত্যাগ করে বিপরীতমুখী পথে চলেছেন; মস্তিষ্কক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল মননক্রিয়াকে মস্তিষ্কবিজ্ঞান ছাড়াই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। মন দিয়ে মনকে জানবার এই বিষয়মুখীন ভাববাদী প্রচেষ্টাকে মেটাসাইকোলজি বলে অভিহিত করলেও তিনি তাঁর প্রচেষ্টাকে ‘নির্জ্ঞানের বিজ্ঞান’ বা the science of unconscious mental activity বলতে কুণ্ঠিত হননি। উইলিয়াম জেনস সম্পর্কেও ঐ একই কথা বলা যায়। কিন্তু বিজ্ঞানী কোনো বিষয়ের অজ্ঞতার দরুন, সেই অজ্ঞতা দূর করার চেষ্টার পরিবর্তে যদি অতিকথা, রহস্যময়তা দিয়ে অজ্ঞতাকে দুর্জ্ঞেয় করে তোলেন, তা হলে তাঁদের অসাধারণ মনীষা ও কল্পনাশক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদের কৃতজ্ঞতা বা প্রশংসা দাবি করতে পারেন না।

পরিবারের পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের কি ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠবে, সেটা পাভলভের মতে, নির্ভর করছে সমাজের কোন ধরনের উদ্দীপক পিতামাতা ও সন্তানকে প্রভাবিত ও শর্তায়িত করছে তার ওপর। এ সম্পর্কে সহজকামজ প্রবৃত্তি নির্ধারিত নয়। সন্তানের শৈশবের জৈবিক ও মানসিক প্রয়োজন মেটাবার উপযুক্ত ক্ষমতা ও ব্যবস্থা, সমাজ ও পরিবারের কতটা পরিমাণে আছে এবং কি উপায়ে প্রয়োজন মেটানো হচ্ছে তার সঙ্গে সম্পর্কিত। লিবিডোর মৌখিক তৃপ্তি না ঘটলে পরিণত বয়সে ব্যক্তি খাদ্যলোলুপ হবে এ কথা কি ঠিক? পরিবর্তে যদি বলা হয় যে বাচ্চার ক্ষুন্নিবৃত্তি না হলে সে পেটুক হবে, তবু তার মধ্যে কিছুটা যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু তাও সবসময় ঘটে না; অনেকদিন ধরে অনশনে অর্ধাশনে থাকলে খাদ্যের প্রতি, এমনকি জীবনের প্রতিও আকর্ষণ চলে যেতে পারে। খাদ্যের সংকেত দিয়ে কয়েকবার যদি খাদ্য সরবরাহ না করা হয়, তবে কুকুর সংকেতে আর সাড়া দেয় না, খাদ্যপাত্র তাকে আর আকৃষ্ট করে না, এটা পরীক্ষিত সত্য। অনেকেই জানেন যে, প্রথম বৎসরের মৌখিক বা চোষার চাহিদা ভালভাবে মেটা সত্ত্বেও অনেক শিশু আঙুল চোষায় অভ্যস্ত হয়। এর কারণ, শিশুকে শান্ত রাখতে স্তন বা পরিবর্তে অন্য কিছু চুষতে শিশুকে অভ্যস্ত করা হয়েছে। সমাজের ব্যক্তি-সম্পর্ক পরিবারের ব্যক্তি-সম্পর্ক দ্বারা নির্ধারিত হয় না, যদিও আপাতদৃষ্টিতে সেই রকম মনে হতে পারে। আসলে পারিবারিক সম্পর্ক সমাজের আর্থনীতিক সংগঠনের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। যৌনতার প্রশ্নে পাভলভপন্থীরা বলেন যে শিশু যৌন রিফ্লেক্সের সবকিছু উপাদান নিয়েই জন্মগ্রহণ করে; কিন্তু যৌনগ্রন্থি ও যৌনাঙ্গের ক্রম-পরিণতির সঙ্গে যৌনতার বিকাশ ঘটতে থাকে। পরিবারের মধ্যে যৌন ব্যাপারে সমসাময়িক সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি, নৈতিকতা, ন্যায় অন্যায় বিচার প্রতিফলিত হতে বাধ্য। শিশুমনে যৌনতার প্রভাব সমকালীন সামাজিক প্রভাবেরই এক বিশেষ রূপ। যুগে যুগে এর পরিবর্তন ঘটে। ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংরেজি সাহিত্যে শিশুদের যৌনক্রিয়া ও সমস্যার বিশেষ কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। ফ্রয়েডোত্তর সাহিত্যে ও মনস্তত্ত্বের পুঁথিতে শিশুদের কামেচ্ছা অথবা ভালবাসার ইচ্ছা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এইসব আলোচনায় স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক, সমাজে পুরুষ প্রাধান্য, পারিবারিক কলহ, দারিদ্র্য ইত্যাদির উপর বিশেষ আলোকপাত করা হয়নি। সবকিছু ঠিকমত বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, ছেলেমেয়ে সকলেরই সাধারণত মায়ের প্রতিই বেশি ভালবাসা ও আকর্ষণ থাকে। কারণ মা তাদের অভাব অভিযোগ পূরণ করেন এবং বেশির ভাগ সময়েই বাড়িতে থাকেন। আজকাল মায়েরাও কাজে বেরুচ্ছেন; তাই বিশেষ করে, যৌথ পরিবারের বাইরে শিশুরা ঝি চাকরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে, মা বাবাকে অল্পসময়ের জন্য পাবার দরুন তাঁদের প্রতি অভিমান ও চাপা বিতৃষ্ণা পোষণ করে। যেখানে মা চাকরি করেন, বাবা কোনো কারণে বেকার হয়ে বাড়িতে থাকেন, সেখানে শিশু, ছেলে মেয়ে দুজনই বাবার নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এইসব দেখেশুনে ফ্রয়েড শেষের দিকে তার ইডিপাস তত্ত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য কন্যার মায়ের প্রতি আসক্তির নতুন ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে ফার্স্টের মতামতের গুরুত্ব আছে, কেননা তিনি অনেকবছর ফ্রয়েডীয় পদ্ধতিতে চিকিৎসা করেছিলেন। তার মতে পিতা-পুত্রী ও মাতা-পুত্রের ভালবাসার ও পরস্পর নির্ভরতার মধ্যে ফ্রয়েড বর্ণিত যৌনতার সম্পর্ক নেই। দু’একটি অতি বিরল ঘটনার উল্লেখ হয়তো করা যায়, কিন্তু অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে সে ঘটনা সহজাত প্রবৃত্তির নিদর্শন নয়; সে ঘটনার মূলে আছে মাতাপিতা কর্তৃক সন্তানকে যৌনকার্যে প্ররোচিত করা অথবা উৎসাহ দেখানো।

(লেখক অনুসৃত বানানরীতি বজায় রাখা হয়েছে।) 

[কৃতজ্ঞতা : পাভলভ ইনস্টিটিউট।]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান