পাভলভ এবং স্কিনার

সুদর্শন শৰ্মা

ইভান পেত্রভিচ পাভলভ ১৮৪৯ সালে ১৪ সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার পুরনো শহর রিয়াজনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা একজন দরিদ্র ধর্মযাজক ছিলেন এবং সংসার প্রতিপালনের জন্য তাঁকে গির্জার পাশের মাঠে ফলের বাগান ও চাষবাস করতে হত। পাভলভের পিতা ঐ অঞ্চলে একজন বুদ্ধিজীবী হিসাবে পরিচিত ছিলেন, তিনি বই পড়তে ভালোবাসতেন। তাঁর ঘরে মূল্যবান বইয়ের একটি চমৎকার গ্রন্থাগার ছিল এবং কিশোর ইভান ছেলেবেলা থেকেই এই বইপত্রগুলির প্রতি যথেষ্ট আকৃষ্ট হয়েছিলেন, এটা পরিণত বয়সে তাঁর লেখার মধ্যে তিনি প্রকাশ করেছেন। এখান থেকেই তিনি উচ্চশিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন এবং পরিবারের দাবি ছিল তাঁকে যাজক হতে হবে। এর বিরুদ্ধে তিনি শারীরবিজ্ঞানে পড়ার কথা ভাবতে পেরেছিলেন।

পাভলভের কিশোর-নবযুবাকালে রাশিয়ার সামাজিক ইতিহাসে প্রভূত পরিবর্তন শুরু হয়। ১৮৬০ সালকে সামাজিক দিক থেকে একপ্রকার নবজাগরণও বলা চলে। ১৮৬১ সালে কৃষকরা ভূমিদাস প্রথা থেকে মুক্ত হয় এবং সমগ্র রাশিয়া জুড়ে বুদ্ধিচর্চার এক জোরালো হাওয়া বইতে থাকে। অসংখ্য পণ্ডিত ও উদারমনস্ক মানুষ এই সময়ে জন্মগ্রহণ করেন ও সমাজসংস্কারে হাত লাগান। এর মধ্যে ছিলেন বেলিনস্কি, হার্জেন, চের্নিশেভস্কি, দব্রুলুভব, পিসারেভ প্রমুখেরা। এই মনীষীরা রুশসমাজের সমস্ত ধরনের কুসংস্কার ও পিছিয়ে পড়া মনোভাবের বিরুদ্ধে যথেষ্ট লড়াই শুরু করেন। তাঁদের ভাবধারায় যেমন ছিল উদারনীতিবাদ তেমনি ছিল বিজ্ঞানমনস্কতা এবং এই বিজ্ঞানমনস্কতার হাত ধরে প্রবেশ করে বস্তুবাদী দর্শনের যাবতীয় ভাবনাচিন্তা। রুশ সমাজের এই বিপ্লবী মনীষীরা তরুণ পাভলভের মনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ঐ সময়ে রুশ সমাজের সমস্ত নামী পত্র-পত্রিকায়, সাময়িক পত্রিকায় তাঁরা নিয়মিত নানা আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন এবং নতুন ভাবনাচিন্তার রসদ জুগিয়ে যেতেন। এর ফলে তখন রুশসমাজে একদল মুক্তবিচারবোধসম্পন্ন, উদারমনস্ক, বিজ্ঞানমনস্ক নবযুবার উদ্ভব ঘটেছিল, তরুণ ইভান ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন।

এরপর থেকে ইভান এই ভাবনায় দৃঢ়প্রত্যয় ছিলেন যে বিজ্ঞান হল আধুনিক যুগের দিশারি এবং বিজ্ঞানের জ্ঞানই মানবসভ্যতার সমস্ত অন্ধকার দূর করতে সক্ষম। পরবর্তীকালে যে সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনচরিত আমরা পাই তাতে ইভান লিখলেন, ‘ষাটের দশকে যে লেখাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল বিশেষত পিসারেভ-এর লেখা, তা-পড়ে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃতিবিজ্ঞান পড়ার জন্য আমাদের আগ্রহ জন্মায়।’ তবে সেমিনারিতে থাকাকালীন দুটি বই ইভানকে সব থেকে বেশি প্রভাবিত করেছিল, এর মধ্যে প্রথম হল রুশ শারীরবিজ্ঞানের জনক আই এম সেচেনভের ধ্রুপদী বই ‘Reflexes of the Brain’ আর দ্বিতীয়টি হল শারীরবিজ্ঞানের গবেষণাগারের একটি পাঠ্যপুস্তক।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ধরনের শারীরবিজ্ঞানের আধুনিকতম বইপত্রর প্রভাবে ইভান ধর্মযাজকের পাঠ্যক্রম পরিত্যাগ করে সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিমুখে রওনা হন। সেখানে গিয়ে প্রকৃতিবিজ্ঞানের অঙ্ক এবং পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তিনি পড়াশোনায় ব্যুৎপত্তি লাভ করায় বৃত্তি পান। ফলে পড়াশোনার খরচ চালাতে তেমন বেগ পেতে হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে ইভান কয়েকজন চমৎকার শিক্ষকের সংস্পর্শে আসেন। এ ব্যাপারে আত্মজীবনচরিতে তিনি লিখছেন, ‘ঐ সময়ে আমাদের শিক্ষককুল ছিলেন অতি চমৎকার ধরনের। এমন কিছু শিক্ষক দ্বারা আমরা শিক্ষিত হয়েছি যাদের বিজ্ঞানের জ্ঞানের কোনও সীমা-পরিসীমা ছিল না। ফলে তাঁরা যথেষ্ট দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁদের জ্ঞানের বিষয়গুলি আমাদের মনে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারতেন। আমি প্রাণী-শারীরবিজ্ঞানে সব থেকে বেশি আগ্রহ বোধ করতাম এবং সঙ্গে ছিল রসায়নশাস্ত্র। আমরা যারা শারীরবিজ্ঞান পড়তাম তারা সিয়নের মতো শিক্ষক দ্বারা যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হয়েছি। জ্ঞানের প্রভূত জটিল বিষয়গুলিকে কী পরিমাণে সহজ-সরল করে সিয়ন আমাদের সামনে পরীক্ষামূলকভাবে তুলে ধরতেন তা বলে বোঝানো অসম্ভব। তাছাড়া তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে, নিখুঁতভাবে। আমার তো মনে হয় এমন শিক্ষক যদি কেউ জীবনে একবারও পায় তাহলে সে জীবনে কোনও দিন এই শিক্ষকের অবদান ভুলতে পারবে না।’

পাভলভের কাজ

পাভলভ সারাজীবন গবেষণাগারের চার দেওয়ালের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন। সেখানে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দিনরাত কুকুরকে মাধ্যম করে শারীরবিজ্ঞানের গবেষণা করেছেন। তাঁর এই বিপুল গবেষণাকর্মের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হল কন্ডিশনড রিফ্লেক্স বা শর্তাধীন পরাবর্ত সম্পর্কে গবেষণাসমূহ। পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের কাছে এই বিষয়ে তিনি কুড়িটি অমূল্য বক্তৃতা দিয়েছেন যা লেকচার্স অন কন্ডিশনড্ রিফ্লেক্স শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।

পাভলভ তাঁর আবিষ্কৃত তত্ত্বে দেখিয়েছেন, ‘ক্রনিক মেথড’ পরীক্ষণ দ্বারা লালাগ্রন্থিতে নির্গমন নালি তৈরি করে বাইরে দূরের উদ্দীপনায় প্রাণীটির ‘সাইকি’-র আপাত-বিশৃঙ্খল যে চঞ্চলতার সৃষ্টি হয় তা পরীক্ষাগারে নিখুঁত ও যথাযথভাবে পরিমাপযোগ্য করে বিজ্ঞানসম্মত ও বিষয়গত তত্ত্ব-সূত্র তৈরি করা সম্ভব। পাভলভ তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে উদ্দীপনাগুলিকে বিশেষায়িত করে, এর তীব্রতার হেরফের ঘটিয়ে প্রাণীটির লালা নিঃসরণ করিয়ে সাইকির প্রকৃতি পরিমাপ করতে সমর্থ হলেন। এই প্রকারে এই পরীক্ষানিরীক্ষাগুলির মাধ্যমে তিনি যে সঠিক, আকাঙ্ক্ষিত তথ্যগুলি পেলেন এদের কাজে লাগিয়ে তিনি প্রাণীর সাইকি সম্পর্কে সাধারণ ও বিশেষ প্রকারের ধারণা তৈরি করতে সমর্থ হলেন। এই ধারণা তিনি সূত্রের আকারে প্রকাশ করলেন।

এই বিষয়ে প্রথম যে সূত্রটি তিনি বিস্তারিতভাবে আমাদের কাছে প্রকাশ করলেন তা হল, কোনও একটি প্রাণী যখন বাইরের উদ্দীপনায় আগ্রহ প্রকাশ করে এবং এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে তখন এই বিষয়ে তার অভ্যন্তরে একপ্রকার প্রস্তুতি হয়ে থাকে। অর্থাৎ এখানে খাবার পাবার আশায় কুকুরটি যখন লালা নিঃসরণ ঘটাবে তখন তার খিদে থাকতে হবে। কারণ এখানে খাদ্যের উদ্দীপনা গ্রহণ করার জন্য কুকুরটির প্রস্তুত হওয়ার প্রথম শর্তই হল ক্ষুধা। এর থেকে উপলব্ধি করা যায় বাইরের পরিবেশে খাদ্যগ্রহণের উদ্দীপনা যখন প্রাণীটির সংবেদনগ্রাহী কেন্দ্রে আছড়ে পড়বে তখন যদি প্রাণীটির খিদে না থাকে তাহলে সে ঐ উদ্দীপনায় সাড়া দেবে না। একে বলা যেতে পারে অভ্যন্তরের চাহিদায় বাইরের সঙ্গে অভিযোজনের প্রথম শর্ত। কেননা খিদের চাহিদা না হলে প্রাণীটি সাড়া দেবে না। তখন প্রাণীটি অন্য উদ্দীপনায় সাড়া দেবার জন্য প্রস্তুত হবে এবং মস্তিষ্কে খিদের এই উদ্দীপনাটির স্নায়ুপথ নিস্তেজিত করে রাখবে।

দ্বিতীয় সূত্র হল, একটি প্রাণীকে বার বার খাবার দেখিয়ে তা না দিলে ক্রমশ পরবর্তী পরীক্ষানিরীক্ষায় এর লালা নিঃসরণের হার কমতে থাকবে এবং একসময় তা শূন্য হয়ে যাবে। কিন্তু খাবারের এক টুকরো মুখে দিলেই এই পরাবর্ত পুনঃশক্তিসঞ্চারিত হবে এবং তা পূর্ণরূপে কার্যকর হবে। এর থেকে পাভলভ সিদ্ধান্ত করলেন যে অর্থপূর্ণ ফল না পেলে প্রাণীর পূর্বেকার অভিযোজিত পরাবর্তক্রিয়াও নিস্তেজিত হয়ে যায়। কিন্তু আবার ঐ উদ্দীপনা ফলপ্রসূ হলে ঐ অভিযোজিত পরাবর্তটি পুনরায় ফিরে আসে। সুতরাং জৈবিক চাহিদা বা পরাবর্ত প্রশমিত হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি না হলে বাইরের পরিবেশের যে কোনও ধরনের সংকেত বা উদ্দীপনা প্রাণীটির কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে।

তৃতীয় যে সূত্রটি পাভলভ এক পরীক্ষানিরীক্ষার সাহায্যে হাজির করলেন তা হল, শুকনো রুটি খাবার হিসাবে দিলে কুকুরটির যথেষ্ট লালা নিঃসরণ ঘটবে, পরিবর্তে মাংসের ঝোল খাবার হিসাবে দিলে কোন লালা নিঃসরণই ঘটবে না। এমনকি এই দুটি উপাদান একইসঙ্গে খাবার হিসাবে হাজির করলে কুকুরটি কোন্ খাবারটিকে উদ্দীপনা হিসাবে গ্রহণ করছে এর ওপর এর লালা নিঃসরণের পরিমাণ নির্ভর করবে। তখন যদি মাংসের ঝোলকে সে উদ্দীপনা হিসাবে গ্রহণ করে তাহলে এর অগ্রে শুকনো রুটি থাকলেও তার কোনও লালা নিঃসরণ ঘটবে না। এই ঘটনাকে পাভলভ ব্যাখ্যা করলেন, বাইরের উদ্দীপনার সঙ্গে প্রাণীটির তাৎক্ষণিক অভিযোজনের ক্ষমতা হিসাবে। তাই পাভলভ বললেন, এখানে দুটি উদ্দীপনার বদলে যদি প্রাণীটির পছন্দসই একটি উদ্দীপনা থাকে (যেমন এখানে মাংসের ঝোল) তাহলে কুকুরটির মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হবে না। ফলে তার অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি শক্তিশালী হবে। সাধারণভাবে এই ঘটনাকে আমরা ‘মনোযোগ’, ‘আগ্রহ’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে থাকি।

এই ধরনের অসংখ্য গবেষণা-কর্মসূচি ও পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে ‘সাইকি’-র উদ্দীপনাকে যাচাই করে পাভলভ এই ধরনের মতামত রাখলেন: খাবার বা যে কোনও বস্তু প্রাণীর মুখগহ্বরের সংস্পর্শে এলে এর রাসায়নিক গুণের কারণে মুখের অভ্যন্তরে এক প্রকার উদ্দীপনা তৈরি হয় এবং এই উদ্দীপনা অন্তর্বাহী স্নায়ুপথ ধরে মস্তিষ্কের লালা নিঃসরণের কেন্দ্রে চলে যায়। তলিয়ে বিচার করলে দেখা যায় উদ্দীপনা তৈরি করতে পারে এমন ধরনের বস্তুর দুই প্রকারের উদ্দীপনা সৃষ্টি করার ক্ষমতা রয়েছে। এর এক ধরনের উদ্দীপনা প্রাণীটির কাছে প্রয়োজনীয়, যেমন কোনও খাবারের পুষ্টিগুণ; কিন্তু অন্য অনেক ধরনের উদ্দীপনা বস্তুটি তৈরি করতে পারে, যেমন যান্ত্রিক, রাসায়নিক ইত্যাদি, যা প্রাণীটির কাছে প্রয়োজনীয় নয়। তাই প্রাথমিকভাবে বা আকস্মিকভাবে প্রাণীটির লালা-নিঃসরণ কেন্দ্র এই উদ্দীপনাগুলির বিশ্লেষণ করে কোনটি এর অস্তিত্বরক্ষার জন্য আবশ্যিক তা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তবে কিছু সময় ধরে পুনর্বার এই উদ্দীপনাটি গ্রহণ করে প্রাণীটির মস্তিষ্ক একে বিচার-বিশ্লেষণ করতে সমর্থ হয় এবং বাইরের পরিবেশের প্রয়োজনীয় ঐ উদ্দীপনাটি গ্রহণ করার বিষয়ে সে মনোযোগী হয়। এর ফলে একপ্রকার তাৎক্ষণিক বা অস্থায়ী স্নায়ুসংযোগ তৈরি হয়। তখন এই উদ্দীপনার তীব্রতা এমনই হয় যে অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় উদ্দীপনাগুলিকে সে নিস্তেজিত করতে সমর্থ হয়।

তাই আমরা দেখলাম, এমন অস্থায়ী স্নায়ুসংযোগ যা প্রাণীটি বাইরের পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ ও অভিযোজনের জন্য গড়ে তোলে, একে এর সহজাত স্নায়ুসংযোগ বা পরাবর্তগুলি থেকে পৃথক করা সম্ভব হয়। আরও দেখা যাবে এই অস্থায়ী স্নায়ুসংযোগ বার বার একই উদ্দীপনা দেওয়ার ফলে স্থাপিত হয় বা মজবুত হয়। অন্যদিকে এই উদ্দীপনা না পেলে এই স্নায়ুসংযোগ সক্রিয়ভাবে নিস্তেজিত করে দেওয়া হয় যা ক্রমশ দুর্বল হওয়ার কারণে আর ক্রিয়াশীল থাকে না। এবার পাভলভ আমাদের দেখালেন প্রাণীর অভ্যন্তরীণ অঙ্গসংস্থানব্যবস্থা এবং বাইরের পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এই ধরনের অস্থায়ী স্নায়ুসংযোগব্যবস্থা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ।

পাভলভ এই ঘটনাটিকে পরাবর্তক্রিয়া আখ্যা দিয়েছেন, এই ব্যাপারে অনেক বিশেষজ্ঞ আপত্তি তোলেন। কিন্তু কাজের কথা হল এই ঘটনাকে কী নামে বর্ণনা দিলে তা সম্পূর্ণ উপযুক্ত বা যথাযথ হবে এই বিষয়ে তাঁরা একমত হতে পারেন না। আমাদের বক্তব্য হল যতদিন না এর উপযুক্ত ‘নাম’ আমরা খুঁজে পাচ্ছি ততদিন একে এই নামেই ডাকব। এই বিষয়ে পাভলভের ব্যাখ্যা ছিল এই ধরনের: দেহে একটি পরাবর্তক্রিয়া গঠন করতে হলে এর তিনটি নির্দিষ্ট অংশ থাকে। এই বিচারে বলা যায় এখানে একটি দূরের উদ্দীপনা প্রাণীদেহের সংবেদনগ্রাহী অঞ্চলের ওপর আপতিত হয়ে একপ্রকার স্নায়ু-উদ্দীপনা তৈরি করছে, ফলে একপ্রকার স্নায়ুসংযোগ তৈরি হচ্ছে— তাই তখন একে পরাবর্ত ছাড়া আর কোনও নামে ভাবা যায় না। এমন বিচার করে বলা যায় শারীরবৃত্তিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সব ধরনের দেহজ প্রতিক্রিয়া হল পরাবর্ত। অবশ্যই এই দুই ধরনের পরাবর্তর মধ্যে তফাত রয়েছে। 

এখন আমাদের জানতে হবে এই তফাতটি কী?

এদের মধ্যে প্রধান তফাত হল, শারীরবৃত্তিক পরাবর্তক্রিয়ায় উদ্দীপনাটি স্থায়ী, সহজাত, মজবুত এবং অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। কারণ এখানে উদ্দীপনাটিকে দেহের গ্রাহীকেন্দ্র আপন চেনা ভাষায় রূপান্তরিত করে নির্দিষ্ট অন্তর্বাহী স্নায়ুসংযোগ মারফত মস্তিষ্কের অনুষঙ্গ অঞ্চলে পাঠাচ্ছে, যেখানে এই বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণের কাজটি হয়ে থাকে। এখান থেকে নির্দিষ্ট স্নায়ুপথ বেয়ে এর প্রতিক্রিয়ায় কি করতে হবে, এই নির্দেশ সম্মিলিত উদ্দীপনা বহির্বাহী স্নায়ুসংযোগের মাধ্যমে নেমে আসছে। প্রাণীটির অস্তিত্বরক্ষার ক্ষেত্রে সহজাতভাবে পাওয়া এই পরাবর্ত হল ধ্রুব।

অন্যদিকে মনস্তাত্ত্বিক যাবতীয় পরাবর্ত বা প্রতিক্রিয়া অস্থায়ী, পরিবর্তনযোগ্য এবং বাইরের পরিবেশের বিভিন্ন শর্তের ওপর তা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। সুতরাং এদের শর্তাধীনও বলা যায়। তাহলে এমনই দাঁড়াচ্ছে যে শারীরবৃত্তিক পরাবর্তগুলি সহজাতভাবে আমরা পেয়ে থাকি এবং তা শর্তহীন। অন্যদিকে মনস্তাত্ত্বিক পরাবর্তগুলি সারাজীবন ধরে পরিবেশের বিভিন্ন অবস্থায় ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটিয়ে আমাদের অর্জন করতে হয় এবং তা শর্তাধীন ও অস্থায়ী। আরও একটি বিষয় আমাদের খেয়াল করতে হবে যেমন শর্তহীন পরাবর্তক্রিয়ায় উদ্দীপনার সারবস্তু যথার্থ উদ্দীপনা রূপে কাজ করে। যেমন শুকনো খাবার ভিজিয়ে নিতে হবে বা শক্ত খাবার নরম করে নিতে হবে। কিন্তু শর্তাধীন পরাবর্তে বস্তুর গৌণধর্ম, যেমন বস্তুর বাহ্যিক রং, আকার, গন্ধ ইত্যাদি উদ্দীপনা হিসাবে ক্রিয়াশীল হয় যার সঙ্গে প্রাথমিকভাবে লালা নিঃসরণের কোনও সম্পর্ক নেই।

পাভলভ আমাদের জানাচ্ছেন, শর্তাধীন পরাবর্তক্রিয়ায় ঐ বাহ্যিক বস্তুর গৌণধর্মগুলি শারীরবৃত্তিক ক্রিয়ার অন্তর্বস্তু রূপে অর্থাৎ এর সংকেতে পরিণত হয়। এইভাবে প্রাণীর মনের জগৎ গড়ে ওঠে। অর্থাৎ বাইরের বস্তুনিচয়ের গৌণধর্ম বা সংকেত প্রাণীটির প্রয়োজনীয় অন্তর্বস্তুতে পরিণত হয়। এখানে শারীরবৃত্তিক ক্রিয়ার জন্য যথার্থ বস্তুটির সংকেত রূপে এরা প্রাণীর মনোজগতে ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটায়। সুতরাং প্রাণীটি কেমন করে এই সংকেতগুলি অস্থায়ী স্নায়ুসংযোগ মারফত ধরে রাখে বা বাতিল করে দেয়, এই চর্চা করলেই প্রাণীর মনোজগতের চর্চা করা সম্ভব। কারণ প্রাণীটি এমন সংকেত-নির্ভর ব্যবস্থার মাধ্যমে বাইরের পরিবেশের পরিবর্তনের জন্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষা করা ও আপনাকে সঠিকভাবে অভিযোজনের জন্য সর্বদা অস্থায়ী স্নায়ুসংযোগগুলি পালটে চলে।

এইভাবে বিচার করলে দেখা যাবে, বাইরের সংকেতগুলি ব্যবহার করে প্রাণীটি কী প্রকারে শর্তাধীন পরাবর্ত গঠন করে থাকে, এটি পরীক্ষাগারে প্রমাণ করার জন্য পাভলভ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরূপে পরিগণিত হবেন। এর ফলে ‘পশু মনস্তত্ত্ব’-এর বিষয়ে আমরা আমাদের মননক্রিয়া অর্থাৎ আমার মনে যখন এমন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তখন পশুটির মনেও একই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, এমন ভাবনা চিরকালের জন্য পাভলভ তাঁর গবেষণাকর্মর ফল দ্বারা বাতিল করে দিলেন। কারণ তিনি দেখিয়ে দিলেন, কেমন করে প্রাণীর মননক্রিয়া, বাইরের জগতের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব।

এই ক্ষেত্রে পাভলভকে মনে হবে ডারউইনের একনিষ্ঠ ছাত্র যিনি জানতে চাইছেন বাইরের পরিবেশের সঙ্গে একটি প্রাণীর ঠিক কী ধরনের ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটে থাকে এবং তা তিনি পরীক্ষাগারে প্রমাণ করে ছাড়লেন। এই কাজটি খুব সহজ-সরল ধরনের এমনটি নিশ্চয়ই কেউ ভাববেন না, কারণ এই ক্রিয়া-বিক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে প্রাণীর সহজাত প্রকৃতি, যা এর আচার-আচরণকে অনেক পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এইভাবে দেখা যাবে, প্রকৃতির বাছাই পর্বর জন্য প্রাণীজগতের পরিব্যক্তি বা পরিবৃত্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে নানা বৈচিত্র্য বা নতুন প্রজাতির উদ্ভবের মাধ্যমে পরিবর্তিত পরিবেশ-পরিস্থিতিতে প্রাণীটির অভিযোজন করতে হচ্ছে। অথবা একই প্রজন্মে একে অন্যের সঙ্গে কিছু নির্দিষ্ট সংকেত মারফত সে অর্জিত শিক্ষার আদান-প্রদান করার সুবিধা ভোগ করছে।

সাধারণত যে পরিবেশে আমরা বাস করি এর একটি পর্যায়কাল স্থায়ী ধরনের। কিন্তু একে হাজার, লক্ষ বছরের পটপ্রেক্ষিতে দেখলে তা অস্থায়ী। এই কারণে কোনও প্রাণী বা প্রজাতিকে যখন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাইরের পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন করতে হয় তখন দেখা যায় আপাত স্থায়ী কিছু পাভলভীয় শর্তহীন পরাবর্ত সহজাতভাবে এর সঙ্গী হয়। যার দ্বারা ঐ বিশেষ প্রাণীটি এর অস্তিত্বরক্ষার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি সংগ্রহ করে টিকে থাকতে পারে। কারণ এসব বংশগতিতে সঞ্চারিত হয়। যেমন হাঁচি, কাশি, খাবার গিলে ফেলা, বমি ইত্যাদি ক্রিয়াগুলি। অধিকাংশ শর্তহীন পরাবর্ত হয় সহজ-সরল ধরনের। কিন্তু দেখা যায় কিছু শর্তহীন পরাবর্ত হয় অত্যন্ত জটিল ধরনের, যেমন শীতকালে পাখিদের হাজার হাজার মাইল উড়ে যাওয়া বা ডিম পাড়ার জন্য এক ধরনের কচ্ছপের কয়েক হাজার মাইল সমুদ্রে সাঁতার দিয়ে কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পৌঁছানো, মৌমাছির চাক তৈরি করা ইত্যাদি। প্রাণীর এই ধরনের সক্রিয়তাকে আমরা ‘প্রবৃত্তি’ বলে থাকি। কিন্তু ‘প্রবৃত্তি’ শব্দটি বিজ্ঞানসম্মত নয় তাই একে পাভলভ ব্যাখ্যা দিতে চাইলেন শর্তহীন পরাবর্ত হিসাবে। কারণ এর দ্বারা তিনি বোঝাতে চাইলেন একপ্রকার অমোঘ কার্য-কারণ সম্পর্ক এর দ্বারা নির্দিষ্ট। অন্যদিকে ‘পরাবর্ত’ একটি বিজ্ঞানসম্মত, বিষয়গত ধারণা।

আবার যেহেতু পরিবেশের বিষয়গত অবস্থা ধ্রুব নয় তাই এর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভিযোজন করার জন্য প্রাণীটিকে এক ধরনের অস্থায়ী পরাবর্ত গঠন করতেই হবে। তখন এর ভিত্তি হবে শর্তহীন পরাবর্ত অর্থাৎ শর্তহীন পরাবর্তের চাহিদা অনুযায়ী এসব গঠিত হবে; কিন্তু এই চাহিদা চলে গেলে ওই পরাবর্ত নিস্তেজিত হয়ে মিলিয়ে যাবে। এইভাবে বাইরের পরিবেশের চাহিদায় যখন শর্তহীন পরাবর্ত প্রয়োগ করতে হবে তখন প্রাণীটি প্রয়োজনমতো তাই প্রয়োগ করবে এবং যখন শর্তাধীন পরাবর্ত ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে তখন সে তাই করবে। ফলে সে যে কোনও স্থায়ী বা পরিবর্তিত অবস্থায় অভ্যন্তরীণ ও বহিঃপরিবেশের এক চমৎকার ভারসাম্য রক্ষা করে এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে। 

বিজ্ঞানসম্মত মনোবিদ্যার বিকাশ

ডারউইন যখন তাঁর ‘প্রকৃতির বাছাই তত্ত্ব’ আবিষ্কার করেন তখন তাঁর বংশগতি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত কোনও ধারণা ছিল না। তিনি তাঁর সৃষ্টিশীল বিজ্ঞানভাবনায় বংশগতির বাস্তবতাকে স্বীকার করে তাঁর তত্ত্ব তিনি প্রস্তাব আকারে রাখেন। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল পাভলভের ক্ষেত্রে। তিনি যখন ‘শর্তাধীন পরাবর্ত’ আবিষ্কার করেন তখন স্নায়ুতন্ত্র, গুরুমস্তিষ্ক তথা মানব মন সম্পর্কে আমাদের প্রায় কোনও ধারণাই ছিল না।

এই আলোচনার সম্বন্ধসূত্রে বলা যায় পৃথক বিভাগ হিসাবে মনোবিদ্যাকে বিকশিত করার আন্দোলনে জগৎ জুড়ে বহু রথী-মহারথীর সমাবেশ ঘটেছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুটি প্রধান ভাবধারায় এর মেরুকরণ ঘটেছে এবং উভয়েই দাবি রাখছেন যে সঠিক মনোবিদ্যার সন্ধান তাঁরা দিতে পারবেন। এই দুই ভাবধারার একটি পাভলভীয় স্নায়ুবিজ্ঞান, যা বিষয়গত বিজ্ঞানভাবনার ফসল, যা বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানের কথা বলে এবং অন্যটি ফ্রয়েডীয় ভাবধারা যা ভাববাদী আপ্তবাক্যের সপক্ষে অন্তর্বীক্ষণ পদ্ধতির ওকালতি করে থাকে। ফলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে পাভলভীয় ভাবধারায় গবেষণাগারে বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষানিরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব-সূত্রগুলি গঠন করা হয়। অন্যদিকে ফ্রয়েডীয় ভাবধারায় আত্মগত চিন্তা বা অন্তর্বীক্ষণের সাহায্যে মনোবিদ্যার যাবতীয় তত্ত্ব-প্রকল্প তৈরি করা হয়। বলা উচিত, আমাদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপে আমরা পাভলভীয় বিজ্ঞানসম্মত মনোবিদ্যার ধারাকে অনুসরণ করে থাকি।

খোঁজ নিলে জানা যাবে, এর মাঝামাঝি আরও অসংখ্য ধরনের ভাবধারা মনোবিদ্যায় এখনও চালু রয়েছে এবং প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তলিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে এরা হয় ভাববাদী অন্তর্বীক্ষণ-জাত নয়তো বস্তুবাদী পরীক্ষানিরীক্ষা-জাত, এর বাইরে কিছু নেই। সুতরাং কোথাও মনোবিদ্যার কোনও ধরনের ঘরানার উদ্ভব ঘটলে আমাদের দেখতে হবে এটি কোন ভাবধারার প্রতিনিধিত্ব করছে ভাববাদী না বস্তুবাদী। কারণ আমাদের প্রধান দেখার বিষয় হল এই ঘরানার পেছনে বিজ্ঞানসম্মত তথ্যের সমর্থন আছে কি না। এর যথাযথ উত্তর পেতে হলে এই প্রতিটি ঘরানার বিকাশের ইতিহাসকে খুঁটিয়ে বিচার করতে হবে। কিন্তু আমরা এখানে শুধুমাত্র পাভলভীয় ঘরানার কথাই বলতে চেয়েছি। কারণ আমাদের জানা নেই পাভলভীয় ঘরানা ছাড়া মনোবিদ্যার আর এমন একটি ঘরানা আছে কি না যেটি গবেষণাগারের পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্য-সূত্রর ওপর প্রতিষ্ঠিত।

স্কিনার

আমেরিকার অধিবাসী ব্যুরস ফ্রেডেরিশ স্কিনার ছিলেন প্রখ্যাত আচরণশাস্ত্রবিদ্‌ (Behaviorist)। তাঁকে বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় মনোবিজ্ঞানী বলা হয়ে থাকে। তিনি ১৯০৪ সালের ২০ মার্চ পেনসিলভেনিয়ায় সাসকোয়েহানায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আর লিউকোমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯০ সালের ১৮ অগাস্ট ৮০ বছর বয়সে আমেরিকার কেমব্রিজ, ম্যাসাচুসেটস-এ মারা যান। যদিও তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল মনোবিদ্যা, কিন্তু তিনি আরও কিছু ক্ষেত্রে পদচারণা করেছেন। কুশলী যন্ত্রবিদ হিসাবে তিনি কিছু যন্ত্রও আবিষ্কার করেছেন, প্রচুর বই লিখেছেন (২১টি বই এবং ১৮০টি প্রবন্ধ ও গবেষণাপত্র)। সমাজ-দার্শনিক হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল, এমনকি তিনি কবিতাও লিখতেন। ১৯৫৮-১৯৭৪ সাল অবধি তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যার এডগার পির্সে অধ্যাপক ছিলেন। তিনি খ্যাতি পেয়েছেন বিহেভিয়র অ্যানালিসিস, অপারেন্ট কন্ডিশনিং, র‍্যাডিক্যাল বিহেভিয়রিজম, ভার্বাল বিহেভিয়র, অপারেন্ট কন্ডিশনিং চেম্বার ইত্যাদি তত্ত্ব ও বিষয়-পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য। তাঁর জীবিতকালে তিনি ছিলেন একটি ঘরানা এবং প্রতিষ্ঠান। তিনি একটি গবেষণা-পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যা দিয়ে তিনি প্রাণী, প্রধানত পায়রা নিয়ে গবেষণা করতেন। এদের আচরণ বিচার-বিশ্লেষণ করতেন। মানবীয় আচরণকে বিশ্লেষণ করে তিনি যে তত্ত্বে উপনীত হন একে বলা হয় ‘বাচিক আচরণ’, যা নিয়ে আধুনিককালে বিপুল সংখ্যায় গবেষণা চলছে এবং এর প্রয়োগগত দিকগুলিও সকলের নজরে পড়েছে।

স্কিনার মনোবিদ্যায় যে মৌলিক গবেষণার জন্য খ্যাত তা হল প্রতিক্রিয়া বা সাড়া দেবার হারকে নির্ভরশীল চলরাশি (ডিপেনডেন্ট ভেরিএবল) হিসাবে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করা। তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রর মাধ্যমে প্রাণীদের ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা করে তিনি দেখান অল্প অল্প উদ্দীপনার যোগফল কেমন করে পুনঃশক্তিসঞ্চারিত (রিইনফোর্সমেন্ট) শৃঙ্খলা তৈরি করে থাকে।

যে মনীষীরা স্কিনারকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছেন এমনটি তিনি স্বীকার করেছেন তাঁর মধ্যে আছেন বেকন, ডারউইন, পাভলভ, বিজ্ঞানদার্শনিক আর্নস্ট মাখ, দার্শনিক জ্যাকি লোয়েব, আচরণশাস্ত্রবিদ এডওয়ার্ড থর্নডাইক, আমেরিকার মনোবিদ্যার জনক উইলিয়াম জেমস এবং রুশো।

বিংশ শতাব্দীতে মনোবিদ্যায় স্কিনারের অবদান অভূতপূর্ব মনে করা হয়। বিশেষত পাশ্চাত্যে তত্ত্বগত এবং প্রয়োগগত দিক থেকে কোনও মনোবিজ্ঞানী তাঁর মতো এমন অবদান রেখে যেতে পারেননি। ফ্রান্সিস বেকনের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি খুব ছেলেবেলা থেকে তত্ত্বকে প্রয়োগের আকার সম্পাদিত করার বিষয়ে আগ্রহী ও অনুসন্ধিৎসু ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন আশ্চর্যরকমের স্বকীয়। 

হ্যামিলটন কলেজে পড়াকালীন স্কিনার, জীববিজ্ঞানী জ্যাকিস লোয়েবের এই তত্ত্বে নিশ্চিত হন যে, পরীক্ষাগারে হাতেকলমে কাজ করার নামই জ্ঞান। তাঁদের শিক্ষকদের কাছে তিনি জানতে পারেন যে, আধুনিক মনোবিজ্ঞানের জনক হলেন পাভলভ এবং পরীক্ষাগারে কাজ করতে হলে তাঁকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে। তাই পাভলভকে শিরোধার্য করে তিনি হার্ভার্ডে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

হার্ভার্ডে তিনি শারীরবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাগারে স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। যেখানে খাবার পাবার আশায় পায়রাকে ঠেসকল বা লিভারে চাপ দেবার কাজে অভ্যস্তীকরণ করেন (instrumental learning/behaviour)। এটা হল সেই বিখ্যাত ‘স্কিনার বাক্স’ যার মধ্যে প্রাণীটিকে রেখে পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। তুলনায় পাভলভের পরীক্ষানিরীক্ষাকে বলা হয় ধ্রুপদী শর্তাধীন পরাবর্ত (classical conditioning/learning) যেখানে খাদ্যগ্রহণের আশায় ক্ষুধার্ত কুকুরের লালা ঝরতে থাকে। এইভাবে স্কিনার প্রাণীর আচরণকে দুই ভাগে ভাগ করেন যথা বহির্জাত (respondent) এবং অন্তর্জাত (operant)।

ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে স্কিনার অপারেন্ট আচরণ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান। এই কাজ করতে গিয়ে স্কিনার তাঁর দেশের ভাবাদর্শ প্রয়োগবাদের (কোনও কাজে সফলতাই সত্য) দিকে গভীরভাবে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৩৮ সালে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম বই ‘The Behavior of Organisms’, আচরণগত বিশ্লেষণের পটপ্রেক্ষিতে এই বইটিকে পথিকৃৎ বিবেচনা করা হয়।

স্কিনারের বিজ্ঞানজাত জ্ঞানের সারাৎসার হল পরীক্ষামূলক বর্ণনা, পূর্বানুমান এবং নিয়ন্ত্রণ। এই কর্মপ্রক্রিয়ায় স্বাধীন ও নির্ভরশীল চলরাশিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে পরীক্ষামূলক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিজ্ঞানের নীতি হল পরীক্ষামূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে এই আন্তঃসম্পর্ককে খুঁজে বার করা। আর এই সমস্ত বিষয়কে সমাকলিত (integrated) করার জন্য তত্ত্বর আমদানি করা হয়। আচরণকে একটি স্বতন্ত্র মাত্রায় উপস্থিত করে একে বিচার-বিশ্লেষণ করার কৃতিত্ব স্কিনারের। পরবর্তীকালে তাঁর অপারেন্ট কন্ডিশনিং-এর তত্ত্ব থেকে তিনি চলে যান উদ্দীপনা-নিস্তেজনা, পুরস্কার-শাস্তি, মুখ্য ও গৌণ উদ্দীপনা-সৃষ্টিকারী ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়ের ওপর গবেষণায়, যা আচরণবাদী মনোবিদ্যার ভিত্তি হিসাবে গণ্য করা হয়।

স্বাভাবিকভাবে স্কিনার তাঁর পরীক্ষাগারের গবেষণার ফলকে আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক আচরণ এবং বিবিধ সামাজিক আচরণে প্রয়োগ করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলেন। এর প্রথম ফল হল ১৯৫৭ সালে তাঁর বই Verbal Behavior । অটিজম-এর শিশুদের ভাষার সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য বিশেষ পদ্ধতির উদ্ভাবন করে তিনি বোঝাতে চাইলেন যে এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিশুদের ভাষার বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব। এর থেকে তিনি পরবর্তীকালে বিহেভিয়রল জেনেটিক্স এবং বিহেভিয়রল ফার্মাকোলজির ওপর গবেষণা শুরু করেন। বাণিজ্যিকভাবে প্রাণীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নানা ধরনের প্রযুক্তিতে কাজ করানো সম্ভব কি না তা তিনি অন্যদের ভেবে দেখতে বলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ইদানীংকালে ইজরায়েল-এ নাশকতামূলক কাজকর্ম অনুসন্ধানের জন্য ইঁদুরদের প্রশিক্ষিত করে কাজে লাগানো হচ্ছে। এরপর স্কিনার জানালেন, পায়রাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নৌবাহিনীর মিসাইল ছোড়ার বোতাম টেপার কাজ করানো সম্ভব। কিন্তু স্কিনারের এই প্রস্তাব সরকার গ্রহণ করেনি।

১৯৪৪ সাল নাগাদ স্কিনার মানবীয় আচরণের প্রশিক্ষণের বিষয়ে মনোযোগী হলেন। জন্মানোর পর থেকে শিশুদের কীভাবে প্রশিক্ষিত করা যায় এই বিষয়ে বিশেষ দোলনা নির্মাণ থেকে শুরু করে তাদের খেলাধুলা, খাদ্যগ্রহণ, ঘুমানো ইত্যাদি নানা বিষয়ে তিনি তাঁর সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে নতুন ধরনের যন্ত্র আবিষ্কার করলেন। এই পদ্ধতিগুলি প্রাথমিকভাবে তিনি তাঁর বাড়িতে তাঁর কন্যাদের ওপর প্রয়োগ করেন। এই সময় তিনি Walden Two নামে একটি উপন্যাসও লেখেন। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি ব্যক্ত করেন কেমন করে বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে একটি জনগোষ্ঠী তাদের জীবনধারণের মান বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিশেষত তাঁর তত্ত্বর একটা মস্ত বড়ো দিক হল বিভিন্ন ধরনের আকস্মিক, অনিশ্চিত পরিস্থিতি থেকে কেমনভাবে আমরা বিজ্ঞানের সাহায্যে পরিত্রাণ পেতে পারি।

১৯৪৫ সালে তিনি ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যা বিভাগে যোগ দেন। ততদিনে তাঁর ভাবাদর্শ, কর্মকাণ্ড র‍্যাডিকাল বিহেভিয়রিজম-এর তকমা পেয়েছে যাতে বলা হয় মনোবিদ্যার অর্থ হল আচরণশাস্ত্র এবং আচরণ ছাড়া মনোবিদ্যার আর কোনও অর্থ নেই। বলা যেতে পারে, ফ্রয়েডীয় নির্জ্ঞানমূলক মনস্তত্ত্বর বিরুদ্ধে এ যেন এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ ।

স্কিনার ১৯৪৮ সালে আবার হার্ভার্ডে ফিরে আসেন এবং পায়রাদের নিয়ে একটি গবেষণাগার খোলেন। ১৯৫৩ সালে প্রকাশ করেন ‘Science and Human Behavior’, এতে তিনি ব্যক্তির নানাবিধ আচরণকে যেমন আত্মনিয়ন্ত্রণ, চিন্তা-প্রক্রিয়া, হিংসাত্মক আচরণ, বিভিন্ন জীবনচর্চার শিক্ষা ইত্যাদি বিচার-বিশ্লেষণ করা শুরু করেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, কেমন করে মানবীয় আচরণকে পরিবর্তন করা সম্ভব। আর এর থেকেই উদ্ভব ঘটে মনোচিকিৎসায় বিহেভিয়র থেরাপির এবং ফলিত আচরণের বিশ্লেষণ। ১৯৫৭ সালে তাঁর সহ-গবেষক চার্লস ফস্ত ফর্স্টারের সঙ্গে বিশ্বকোশ-ব্যাপী ‘Schedules of Reinforcement’ গ্রন্থ (পুনঃশক্তিসঞ্চারে পূর্ব-নির্ধারিত কর্মসূচি) প্রকাশিত হয়।

১৯৫০ সাল নাগাদ আরও অনেক সহযোগীদের সঙ্গে মনোরোগী এবং স্কুলশিক্ষা-প্রশিক্ষণের বিষয়ে স্কিনার কাজ শুরু করেন। ছাত্রদের ক্লাসরুমে প্রশিক্ষিত করার জন্য তিনি বিভিন্ন যন্ত্রপাতিরও আবিষ্কার করেন, নানা পাঠ্য কর্মসূচির উদ্ভব ঘটান। এই ক্রিয়াকলাপের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ১৯৬৮ সালে লেখেন ‘The Technology of Teaching’। তিনি মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বর ঘোর সমালোচক ছিলেন এবং পরামর্শ দেন যে তাঁর মনোবিজ্ঞানকে যেন জৈবিক বিকারতত্ত্বের সঙ্গে সমাকলিত (integrated) করা হয়। মানবীয় আচরণের নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে নীতি-মূল্যবোধের বিষয়টি নিয়েও তিনি আলোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কাল রজার্সের সঙ্গে এক বিতর্কে জড়িয়ে গিয়ে বলেন যে মূল্যবোধ কখনও আচরণের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয় না, এটি শুধু শক্তিসঞ্চারক হিসাবে ক্রিয়াশীল হয়। এ ব্যাপারে আমরা স্বাধীন নই, কিছু নিয়মকানুন আমাদের মেনে চলতেই হয়। আর বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে যখন মানবীয় সভ্যতায় প্রয়োগ করা হবে তখন নিয়ন্ত্রণের সমস্যা থাকবেই।

এই বিষয়গুলি সম্পর্কে তিনি সমগ্র ছয়ের দশক জুড়ে ভেবেছেন এবং এরই ফল হল ১৯৭০ সালে প্রকাশিত তাঁর বিতর্কিত বই ‘Beyond Freedom and Dignity’। এই বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিকে স্কিনারের নাম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৪ সাল নাগাদ তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন এবং ঐ সালেই প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘About Behaviorism’। এই বইয়ে তিনি যেন তাঁর ভাবদর্শের সারাৎসার করেন। যদিও অবসর নেওয়ার পরও অনেকদিন তিনি সক্রিয় ছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত বিজ্ঞান নিয়ে তিনি বহুবিধ তত্ত্বগত কাজ করেন। যেমন জ্ঞানাত্মক, জৈবিক, ভাষাগত, চেতনাধারা সম্পর্কিত বিষয়গুলিতে তাঁর বিজ্ঞানকে কীভাবে প্রয়োগ করা যায়। শাস্তি এবং মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিবিধ বিষয় নিয়ে তিনি অনেকগুলি বক্তৃতা দেন এবং যুদ্ধ ও শান্তির বিষয়ে নানা আন্তর্জাতিক আলোচনাসভায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালে এম ই বিভানের সঙ্গে তাঁর শেষ বই ‘Enjoy Old Age’ প্রকাশ করেন। আমেরিকার মনোবিদদের সংগঠন তাঁকে সারাজীবনের গবেষণাকর্মর জন্য পুরস্কৃত করে। তাঁর বিজ্ঞানদর্শনের সর্বাপেক্ষা বড়ো বৈশিষ্ট্য হল, এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ধ্রুপদী দর্শনের কোনও সংযোগ নেই, তা তৈরি হয়েছে বিজ্ঞান বলা যায় বিজ্ঞানের পরীক্ষামূলক বিষয়গুলি থেকে। তিনি হাতে-কলমে যা কাজ করছেন একেই প্রকল্পায়িত বা তত্ত্বায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এই কারণে তাঁর বিজ্ঞান ও ভাবাদর্শ এখনও শক্তিশালী।

সূত্র :

. Bjork, D. W. (1993) : ‘B. F. Skinner : a life’.

. Chiesa, M. (2004) : ‘Radical Behaviorism : The Philosophy and Sciences’.

. Evans, R.I. (1968) : ‘B. F. Skinner : The Man and his Ideas’.

. Skinner, B. F. (1976) : ‘Particulars of my life : Part I of an Autobiography’.

. Skinner, B. F. (1979) : ‘The Shaping of a Behaviorist : Part 2 of an Autobiography’.

. Skinner, B. F. (1983) : ‘A matter of consequences : Part 3 of an Autobiography’.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান