অবন্তী ভট্টাচার্য্য
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই — প্রীতি নেই — করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
― জীবনানন্দ দাশ, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ৩০৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর এই গোলকায়িত পৃথিবীতে, কী যেন একটা হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। বাস্তবতা ঝরে গেছে বাস্তব থেকে, নির্মিতি থেকে আকরণ, বাচন থেকে সংযোগ। আমাদের চারপাশে এত অজস্র পথের বিকল্প, চারিদিকে এত রাস্তা, তবু যাওয়া নেই আসাও নেই। টি.এস এলিয়ট বর্ণিত ফাঁপা মানুষগুলোর মতো আমরাও যেন প্রতিনিয়ত বলছি, “We are the hollow men”. এই উত্তর-আধুনিক পৃথিবী, বাস্তবকে বিষময় করে তুলেছে। চারপাশে আকাঙ্ক্ষার বিপুল বিস্তার ঘটাচ্ছে অথচ সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপায়িত করার কোনও ইচ্ছা জাগাচ্ছে না। স্ববিরোধিতায় ভরা এই ভঙ্গুর সময়ের উৎস, আমরা কি মানুষের মনের ভিতর খুঁজবো? মানুষের আধুনিক জীবনশৈলী, যা আমাদের চারপাশকে ঘিরে রয়েছে, যা হয়তো আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার উৎস, সেটাই কি দায়ী এসব কিছুর জন্য? এই আধুনিক জীবনশৈলীতে “শর্তহীন” বলে কিছু নেই। এই জীবনশৈলীতে “প্রগতি” ও “পরাগতি” দুটি সম্পর্কেই আমরা সমান নিরপেক্ষ এবং উদাসীন। আমরা চাই কেবলমাত্র এক ধরনের ভোগবাদী উন্নতি। পণ্য-সর্বস্ব এই আধুনিক পৃথিবীতে, আমাদের এই আধুনিক জীবনশৈলী কীভাবে মানুষের মনের মধ্যে ঈর্ষা, টেনশন, হতাশার জন্ম দিচ্ছে তাই নিয়েই আমাদের এই প্রবন্ধের বিষয়।
আধুনিক জীবনশৈলী বা মডার্ন লাইফস্টাইল, আমূল বদল এনেছে আমাদের ভাবনা-চিন্তায়, মননে, মানসিকতায়। আমাদের আচার-আচরণে দিন যত গেছে আমরা আপন করে নিয়েছি নিত্যনতুন জীবনপণ্থাকে, আমাদেরই সুবিধার্থে। এই আধুনিক জীবনশৈলী যেভাবে আমরা আপন করে নিতে চেয়েছি ঠিক তেমনভাবেই এই প্রযুক্তি-নির্ভর সুযোগ-সুবিধাযুক্ত আধুনিক জীবনযাত্রাও আমাদের নিরাশ করেনি। উজার করে দিয়েছে আমাদের। কিন্তু এই দানের প্রতিদান স্বরূপ কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। আমরা যা পেয়েছি তা অনেক সময়ই আমাদের সুখ শান্তির বিনিময়ে পেয়েছি। আর ভালো বেশকিছুর সাথে পেয়েছি নিদ্রাহীন রাত্রি, ঈর্ষা, অস্থিরতা, হতাশা ও অবসাদ। আধুনিক জীবনশৈলী আমাদের জীবনকে করে তুলেছে অনেক সহজ সরল — দিয়েছে গতিময়তা। সে দ্রুতশিক্ষা হোক, ফাস্টফুড হোক বা দ্রুততার সাথে যোগাযোগ। ।এই প্রসঙ্গে ফরাসি কালচারাল থিওরিস্ট পল ভিরিলিওর (Paul Virilio) (১৯৩২-২০১৮) বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। ভিরিলিও ছিলেন একজন নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার দার্শনিক। প্রযুক্তি, শহরকেন্দ্রিক স্থাপত্য, শিল্পকলা এবং গতির মধ্যে যে সংযোগ রয়েছে, তার কথা তার লেখায় বারবার উঠে এসেছে। তিনি তাঁর The Art of the Motor (1995) বইতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন: “Totalitarianism is latent in technology”. এক ধরনের একনায়কতান্ত্রিক সর্বগ্রাসিবাদ, আধুনিক প্রযুক্তিতে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। Speed and Politics (১৯৮৬) গ্রন্থে তিনি আধুনিক সভ্যতার উপরে গতিশীলতার প্রভাব নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন। ভিরিলিও “ড্রমোলজি” নামক একটি নতুন শব্দবন্ধ তৈরি করেন, যা গ্রিক শব্দ “ড্রমস” থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার মানে হচ্ছে রেসকোর্স। এই ফরাসি দার্শনিক এই আধুনিক পৃথিবীতে “টাইম-স্পেস কম্প্রেশন” এর কথাও বলেন, যা বিশ্বব্যাপী মূলধনের সম্প্রসারণের দ্বারা চালিত হয়। তিনি দেখান যে কীভাবে বিংশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া দুটি বিশ্বযুদ্ধ, এই পৃথিবীতে আরও বেশি করে গতি এনেছে — নতুন বাজার উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে এবং উৎপাদন চক্রের গতি বাড়াতে টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, ফ্যাক্স মেশিন এবং পরবর্তীকালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লব- পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ আধুনিক সভ্যতাকে যেরকম এনে দেয় স্বস্তি এবং আরাম, তার সঙ্গে সঙ্গে দানবীয় করে এই পৃথিবীকে। ভিরিলিওর নিজের ভাষায়, “we are entering a space which is speed-space … This new other time is that of electronic transmission, of high-tech machines, and therefore, man is present in this sort of time, not via his physical presence, but via programming” (‘Speed and Politics’ 71).
গত দু-দশক এরকমই দ্রুততার সাথে আশেপাশের সবকিছু পরিবর্তন হতে দেখছি। এই পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার সাথে মানিয়ে নেওয়ার বা সাযুজ্য রাখার প্রক্রিয়াটিও বেশ জটিল, যা আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তরায় হয়েও দাঁড়িয়েছে। আর এই আধুনিক জীবনশৈলীর আড়ালে কোথাও লুকিয়ে আছে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ঈর্ষা, হিংসা, টেনশন, হতাশা বা অবসাদের বীজ। যা একদিনের নয়, ধীরে ধীরে স্লো পয়জনের মতো আমাদের জীবন থেকে সরিয়ে দিচ্ছে সুখ-শান্তি-স্বস্তি। আমরা নিজের অজান্তেই ছুটে চলি মরীচিকার পেছনে। আরও চাই, আরও বেশি করে চাই। আধুনিক জীবন শৈলীর সাথেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ভোগবাদের বীজ। যার অমোঘ আকর্ষণে আমরা মোহগ্রস্ত হয়ে ‘ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর’-এর মন্ত্র আওড়াতে থাকি। ভারতবর্ষ সহ গোটা বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বস্তু-কেন্দ্রিক উন্নয়নের জোয়ার, যত বেশি ক্রমবর্ধমান, আধুনিক জীবনে হতাশার বিস্তারও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আধুনিক মিডিয়া এবং মার্কেটিং এর সীমাহীন হাইপে মানুষের ব্যক্তিগত প্রত্যাশার পারদ ক্রমশ উর্ধ্বমুখী। কিন্তু প্রাপ্তির জায়গা নিঃসন্দেহে সেই হারে বাড়ছে না। ফলে আধুনিক সমাজে, নাগরিকদের একটি বড় অংশ, ক্রমশই প্রতিযোগিতার ময়দানে নিজেকে পরাজিত বলে ভাবতে শুরু করছে। হতোদ্যম হয়ে পড়ে, হতাশার গ্রাস থেকে তারা আর নিজেকে বের করে আনতে পারছে না। ফলে অধিকাংশ সময়েই নেতিবাচক সিদ্ধান্তেই সে মুক্তির পথ খুঁজে চলেছে। কেউ ক্ষণিকের মিথ্যা সুখের জন্য বেছে নিচ্ছে অনৈতিক সিদ্ধান্ত কিংবা মাদকের মতো নীল দংশন, কেউবা চূড়ান্ত পর্যায়ে বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ। এটাই বাস্তব এবং রূঢ় সত্য যে মানুষ এই আধুনিক জীবনের নিঃসঙ্গতার ফাঁকে পড়ে দিন দিন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। সবকিছু থেকেও না থাকার বেদনায় বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে উঠছে অনেকের কাছেই।
আধুনিক জীবনযাত্রার বল্গাহীন চাহিদা, আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দিতে থাকে তা পূরণের জন্য। তা ক্ষমতাই হোক বা প্রশংসা বা ভালোবাসা বা বস্তুগত প্রাপ্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা। একটি কিশোর যখন ছোটবেলা থেকে প্রাচুর্যের মধ্যে পালিত হয়, তখন সেই ক্রমবর্ধমান প্রাপ্তির ফলে প্রথম কোনও কিছুর জন্য ‘না’ শুনলে মানিয়ে নিতে পারে না। বর্তমান ইঁদুর দৌড়ের যুগে যখন একটি কিশোর তারই সহপাঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে ও সহপাঠী নম্বর -প্রাপ্তি প্রতিযোগিতার-খেলায় এগিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে নম্বরের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও তা পূরণ না করতে পারার অতৃপ্তি আর এই অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় ‘হার’ তার মনে সহপাঠী সম্পর্কে ঈর্ষাপরায়ণতার বীজ বপন করে। এক্ষেত্রে ঘৃতাহতির কাজ করে সমাজের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ তুলনা। উন্নতির পরিবর্তে এই ক্রমাগত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যেতে থাকে সেই কিশোর বা কিশোরী। ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে পারে হতাশা ও অবসাদের গভীরে। আধুনিক দ্রুতগতির জীবনের তীব্র প্রতিযোগিতা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বোধের জন্ম দিচ্ছে যা মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে বিষণ্ণতার দিকে (Gurung, 2014)। এছাড়াও প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার উপরে অত্যধিক নির্ভরশীলতার ফলে মানসিক এবং মুখোমুখি যোগাযোগ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, যা আন্ত:ব্যক্তিক সম্পর্কগুলোকে ক্রমশ তলানিতে নিয়ে যাচ্ছে। Beck (1976)-এর “কগনিটিভ থিওরি অফ ডিপ্রেশন” অনুযায়ী ব্যক্তির নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা তাকে বিষণ্ণতার দিকে পরিচালিত করে।
বর্তমান জীবনশৈলীতে বাবা-মা নিজের অজান্তেই রোপন করে উচ্চাকাঙ্ক্ষার চারাগাছ। আধুনিক জীবনে কর্মব্যস্ত বাবা-মা সন্তানকে সময় দিতে না পারার অপরাধবোধে শিশুর হাতে তুলে দেয় অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষার চাবিকাঠি। ছোটো থেকেই শিশুটির পেয়ে চলার এই অভ্যাস বড় হয়ে প্রকট হয়ে ওঠে সম্পর্ক বা কেরিয়ারের ক্ষেত্রে। এই প্রসঙ্গে Senik (2008) গবেষণাপত্রটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘না- পাওয়া’ হতাশ মন কখনো আঁকড়ে ধরে অবসাদ, আবার কখনো তার মূল্যবোধ বা নীতিবোধ বিসর্জন দিতেও পিছপা হয় না। সেই শিশুটিই বড় হয়ে সহকর্মীর পদোন্নতি দেখে সেই একই ঈর্ষা, ভয়, হতাশায় কুণ্ঠিত হয়। নিজের অজান্তে এক তুলনার খেলায় মেতে ওঠে মন। নেগেটিভ অটোমেটিক থট গ্রাস করে। মনে হয় ‘আমার দ্বারা কিছুই হবে না’। মন হয়ে ওঠে অস্থির, হতাশাগ্রস্ত।
কখনো বাবা-মা নিজেদের ‘না’ পাওয়া, নিজেদের অতৃপ্তিগুলি সন্তানের থেকে যোজন দূরে রাখতে,ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে আপ্রাণ ভাবে সচেষ্ট থাকে নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে। ধীরে ধীরে সাধ ও সাধ্যের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। অন্যের হাতের দামি খেলনা, দামি গাড়ি দেখে শিশুটির মনেও আকাঙ্ক্ষা জাগে কিন্তু শখ-পূরণের সামর্থ্য থাকেনা। শিশুটি হয়ে ওঠে ঈর্ষাপরায়ণ — না পাওয়ার কষ্ট তাকে প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। দেখা গেছে ঈর্ষাপরায়ণতা কিন্তু আমরা সবার ক্ষেত্রে অনুভব করি না, কার সাথে তুলনা করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভরশীল আমাদের ভালো থাকার অবস্থা (subjective well-being), Zhang ও Wang (2021) -এর কাজেও এই একই বার্তা প্রতিধ্বনিত হয়। যেটা না বললে আধুনিক জীবনশৈলীর সম্বন্ধে পুরোটা বলা হয় না, তা হল- সমাজমাধ্যমের অবদান। আধুনিক জীবনশৈলীর অন্যতম দান — সমাজ মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া। ভালো হোক বা খারাপ — এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। প্রযুক্তির ব্যবহার ও সমাজ মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত পরক্ষেভাবেই বাড়িয়ে দেয়, মানব মনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ঈর্ষা, অস্থিরতা, হতাশা ও অবসাদ।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (২০১৭)-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্রমাগত সমাজ মাধ্যমের ব্যবহার বা ইন্টারনেটে সংযুক্ত থাকা আমাদের মানসিক পীড়নকে (stress) অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। আমেরিকায় একটি স্টাডিতে দেখা যায়, শতকরা ১৮ জন ব্যক্তি মনে করেন প্রযুক্তি হল স্ট্রেসের উৎস। ৬৫ শতাংশ আমেরিকাবাসী ক্রমাগত e-mail-এ চোখ রাখেন। এর মধ্যে ৪৪% আমেরিকাবাসী বারংবার সমাজ মাধ্যমে চোখ রাখেন এবং এর মধ্যে ৪২ শতাংশ মানুষ সমাজ মাধ্যমের ব্যবহারের কারণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তাও করেন এবং এটা অন্যতম কারণ যে তাঁরা তাদের পরিবার থেকে অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় (২০১৭) সমাজ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ‘ফ্রেন্ডশিপ প্যারাডক্স’ এর কথা বলেছেন। যেখানে সমাজ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা অন্য বন্ধুদের থেকে কম জনপ্রিয় এবং কম সুখী। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীরা নিজেদের সামাজিক পরিতৃপ্তি কম বলে মনে করেন এবং অন্যদের সাথে নিজেদের তুলনা করে দেখেন, তারা অধিক জনপ্রিয়, যা ব্যবহারকারীদের অসুখী হওয়ার অন্যতম কারণ বলে ধরা যায়। মানুষ সামাজিক জীব। কিন্তু সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীরা তাঁদের ব্যক্তিগত সময়ের অনেকটাই তাদের ফোনের সাথেই অতিবাহিত করেন। আধুনিক জীবনশৈলী আমাদের একত্রে বেঁধে রাখার পরিবর্তে আমাদের জীবনকে কিছু কম্পার্টমেন্টে ভাগ করে দিয়েছে। মানুষ এখন অনেকের সাথে থেকেও নির্জন, একাকী। পেনসিলভানিয়া স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা থেকেও অনুরূপ ফল পেয়েছেন এবং এই সমাজ মাধ্যমের ব্যবহার মানুষকে করে তুলেছে অনেক বেশি অবসাদগ্রস্থ। এবং খুব সহজেই শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সর্বাঙ্গীন অবনতি ঘটছে।
আধুনিক জীবনের এই যে দান এই সমাজমাধ্যম, সেখানে মানুষ সর্বদা তার শ্রেষ্ঠ বা ইতিবাচক দিকটি তুলে ধরেন। ক্রমাগত অন্যের এই ইতিবাচক ব্যক্তির সাথে পরিচিত হতে থাকলে খুব সহজেই নিজের সাথে তুলনা চলে আসে। অথচ আমাদের জীবনে সেই ইতিবাচকতার কোনও ‘ফিল্টার’ থাকে না। মনে হয় অন্যের জীবনের সবটাই যেন ভালো, আমাদের জীবনটা ঠিক তেমন নয়। অন্যের জীবনটা ছবির মতো, আমাদের জীবনটা কঠোর রুঢ় বাস্তবে মোড়া। সমাজমাধ্যমে মানুষের ইতিবাচক দিকগুলোর সোচ্চার উপস্থিতি থাকে। ফলতঃ প্রতিবেশীর বিদেশ ভ্রমণের ছবি দেখে ফেলা নিঃশ্বাস — সেই সত্যটি আরেকবার মনে করিয়ে দেয়, ‘neighbour’s envy, owner’s pride’. এই ঈর্ষাপরায়ণতা জীবনে নিয়ে আসে একরাশ হতাশা, অস্থিরতা, মন খারাপ ও অবসাদ। সমাজ মাধ্যমের জনপ্রিয়তার আগে মানুষ তুলনা করত তাঁর প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী ও পরিচিত জনদের সাথে। কিন্তু সমাজ মাধ্যমের ব্যবহার এই তুলনার পরিধিকে আরও বিস্তৃত করে তুলেছে।
কেন আসে এই হিংসা, ঈর্ষাপরয়ণতা? মনোসমীক্ষ্মণ তত্ত্ব অনুযায়ী, এই ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে একটা শূন্যতা তৈরি করে। আমাদের অতৃপ্তি, মনে করায় আমরা যথেষ্ট নই। ফল? নিরাপত্তাহীনতা। এই হিংসা আসলে আমাদের মধ্যেকার নিরাপত্তাহীনতার বহিঃপ্রকাশ, যার সাথে জড়িয়ে থাকে low self-esteem ও rejected হওয়ার ভয়।
মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে ঈর্ষার জন্ম। সাধারণভাবে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতাবোধ, তৎসংলগ্ন ভয় এবং উদ্বেগ থেকে ঈর্ষার জন্ম। মানুষের মনে এই হিংসা এক বা একাধিক আবেগ যেমন রাগ, বিরক্তি, অপর্যাপ্ততা, অসহায়ত্ব, বিতৃষ্ণা, এবং সর্বোপরি উচ্চাকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন নিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি হতে পারে। ঈর্ষা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু জটিল এক অনুভূতি। নিজের উচ্চাভিলাষ সফল হয়নি, অতএব পরের উন্নতি দেখে কাতর হওয়াও ঈর্ষা। এটা ব্যক্তিত্বের এক বিশেষ প্রকাশ।
নিজের যা আছে তাকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা থেকেও ঈর্ষার জন্ম হয়। আবার উল্টোদিকে নিজের যা নেই, অথচ অন্যের আছে তা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও ঈর্ষার উৎপত্তি। বেশ কয়েকজন বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানী বলেন, ঈর্ষা জিনঘটিত, কোনও কিছু অর্জন করার তাগিদ থেকে মানুষের মনে এর জন্ম। কিন্তু এ নিয়ে বিজ্ঞান এখনো কোনও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। এর প্রকাশ খানিকটা নির্ভর করে পরিবেশের ওপর, পারিপার্শ্বিকতার ওপর। অনেক সময় ঈর্ষা থেকে তুলনা ও অনুকরণ আসে। কোনও একজনের মতো কোনও কিছু করতে না পারলে ঈর্ষার জন্ম হয়। মূলত এক ধরনের অভাববোধ থেকেই মানুষের মনে ঈর্ষা বা হিংসার জন্ম। এই অভাব বোধ যেকোন প্রকারের হতে পারে। সব সময় এটা পার্থিব বস্তুর অভাব নাও হতে পারে। সুখের অভাব বা সন্তুষ্টির অভাব। পারিপার্শ্বিক হিংসাশ্রয়ী এই পৃথিবী মানুষকে মনে মনে সন্তুষ্ট হতে দেয় না। আমাদের প্রত্যেকের আমিত্বের একটা গণ্ডি বা সীমানা আছে। বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, বাড়ি-গাড়ি, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আমাদের জগৎ। এই আমিত্বের গণ্ডি যে ব্যক্তির যত সীমিত, একাত্মবোধের চিন্তাভাবনা, যার যত কম, ততই তার মধ্যে নিরাপত্তার অভাব। এই অভাববোধ আমাদের মধ্যে অসম্পূর্ণতা নিয়ে আসে, যা ঈর্ষার জন্ম দেয়। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত দুই নিউরোসায়েন্টিস্ট, ভি. এস রামচন্দ্রণ এবং বলন্দ জালালের বিখ্যাত প্রবন্ধ, “The Evolutionary Psychology of Envy and Jealousy”-র উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁরা লিখেছেন,
Most men are more envious of the latter (9 out of 9 males we surveyed chose B). In other words, you are more jealous of what the other person has access to (in relation to what you desire), than of the final overall state of joy and happiness. This is true even though common sense might dictate the opposite. Put differently, evolution has programmed into you an emotion (jealousy) that is triggered by certain very specific “releasers” or social cues; it is largely insensitive to what the other person’s final state of happiness is. The final state of happiness is too abstract to have evolved as a trigger of envy or jealousy. (Ramchandran 4)
বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুটি জিনিস চোখে পড়ার মতো। প্রথমত, সাফল্যের প্রতি মানুষের একমুখী ধাবমান গতি এবং দ্বিতীয়ত, মানুষে মানুষে প্রতিযোগিতামূলক বিরোধের সম্পর্ক। শিক্ষার একেবারে প্রথম পর্যায়ে থেকে আমাদেরকে শেখানো হয় কোনও কাজের সাফল্যই একমাত্র অভীষ্ট লক্ষ্য। আর সফলতা লাভে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে দরকার প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা। এই পরিস্থিতিতে মানুষ তার ব্যবহারে হয়ে পড়ে যান্ত্রিক, তার মধ্যে দেখা দেয় পরশ্রীকাতরতা, হিংসা, লোভ। এখান থেকেই জন্ম নেয় নিরন্তর মানসিক অশান্তি এবং খুব তাড়াতাড়ি মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছন্দ হারায়। আজকের এই হাইটেক, আধুনিক পৃথিবীতে মানুষ যত দ্রুত উন্নতির পথে এগোবে, যত বেশি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠবে, তত বেশি ঈর্ষা মানুষকে ঘিরে ধরবে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠার এক ধরনের প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করে ঈর্ষা।
এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মনোসমীক্ষক মেলানি ক্লাইন (১৮৮২-১৯৬০), এর কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর অবজেক্ট রিলেশন থিওরি হল মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার একটা পদ্ধতি যা এই ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে যে মন বাইরে থেকে নেওয়া উপাদানগুলির সমন্বয়ে গঠিত, কার্যত অন্যান্য ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সমাহার। একজন মানুষ, চারপাশের পরিবেশের বিভিন্ন প্রক্রিয়াগুলি মনের ভিতর অভ্যন্তরীকরণের (internalization) মাধ্যমে নিজের সহজাত প্রবৃত্তি তৈরি করে। এই তত্ত্ব বলে মানুষের মানসিকতা কেবলমাত্র তার কিছু মৌলিক প্রবৃত্তিগুলোকে সন্তুষ্ট করার প্রয়োজনের ওপরে নির্ভরশীল নয়। বরঞ্চ অনেক সময়ই মানুষ তার প্রবৃত্তি বা ড্রাইভ কেবলমাত্র pleasure বা আনন্দকে কেন্দ্র করে উদযাপন করে না। ক্লাইনের মতে মানুষের মন অনেক সময়ই অবজেক্ট বা বস্তু-সন্ধানী হয়। (হাইলস, ২০০৭)
ক্লাইনের মতে হিংসার উৎস এক ধরনের রাগান্বিত অনুভূতি অন্য আরেকজন ব্যক্তির প্রতি যার ‘কিছু একটা’ রয়েছে এবং সে সেটা উপভোগ করছে, যেটা সেই রাগান্বিত ব্যক্তির নেই। হিংসার মধ্যে একটা লুণ্ঠন করার প্রবৃত্তি থাকে। হিংসাকে কিন্তু অনেকটাই বিদ্বেষ অর্থে ব্যবহার করেছেন ক্লাইন। ক্রোধের আগুনে পুড়তে থাকে সেই ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি। এর সাথে কিন্তু এক ধরনের বেদনা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন ক্লাইন। তিনি বলেন একজন ছোট্ট শিশুর ঈর্ষা অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম জীবনে sadistic প্রকৃতির হয়। মানুষকে কষ্ট দিয়ে এক ধরনের আনন্দ পাওয়ার মধ্যে এটি পরিচালিত হয়। ক্লাইন বিদ্বেষে উন্মত্ত এই ধরনের অনুভূতিকে “Death instinct” বলেছেন। অন্যদিকে এই হিংসা থেকে বেরিয়ে মানুষের সমাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসার অভিব্যক্তিকে “life instinct” বলেছেন।
সমাজের বিভিন্ন স্তরবিন্যাসের মানুষের মধ্যে ঈর্ষা, কাজ করতে থাকে। উচ্চবিত্তের সঙ্গে মধ্যবিত্তের লড়াই, মধ্যবিত্তের সঙ্গে নিম্নবিত্তের লড়াই। বাঁচার তাগিদে এরা যেরকম একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, সেরকম এক ধরনের “ক্লাস কনফ্লিক্ট” চলতে থাকে সমাজের মধ্যে। সামাজিক উত্তরণের স্পৃহার মধ্যে, ঈর্ষা সবসময় সুপ্ত অবস্থাতে নিহিত থাকে। চাহিদা অবাস্তব হলেই ঈর্ষা মানসিকভাবে প্রভাবিত করে। ব্যর্থতার অসমতা মেনে নিতে না পেরে মানুষ ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। যে সমস্ত মানুষ এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না, পিছিয়ে পড়েন, তারাও হয়ে যান ঈর্ষার শিকার। ঈর্ষা থেকেই জন্ম নেয় মানুষের অসামাজিক আচার-আচরণ।
আমরা কতটা স্বাভাবিক ও সুস্থ আছি, অর্থাৎ সুস্থতার মানসিক বোধ বা state of well-being নির্ভর করে মানুষের ব্যক্তিত্বের উপরে। ঈর্ষানুভূতি অনেক ক্ষেত্রে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কে ভারসাম্যহীনতা নিয়ে আসে। তখনই হয় ক্ষতির সূচনা। মাত্রাহীন পরশ্রীকাতরতায় মানুষের বাস্তববোধ কাজ করে না। শেক্সপিয়ারের ওথেলোর উপমায়, মানুষ ঈর্ষায় হয়ে ওঠে, “Green eyed monster” (Complete Works of Shakespeare 145)। এই সবুজে চোখের দানব আদতে খুবই শক্তিশালী। এই দানবীয় শক্তির মোকাবিলায় চাই অন্তরের সুস্থ মানবিক বোধের বিকাশ। ঈর্ষা থেকে মুক্তির জন্য চাই সুস্থ সমাজ, সুস্থ বোধের মানসিকতার বিকাশ। ঈর্ষা থেকে চিন্তাকে মুক্ত করাটা মানুষের নিজের দায়িত্ব। বলগাহীন সমাজে যারা ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাচ্ছে তারা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে এই সমাজে। তারাই ঈর্ষার শিকার। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সুস্থ সমাজ, সমবন্টন ও পরিশীলিত, সুস্থ পরিবেশের প্রয়োজন। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমতা রাখাটাও খুবই জরুরী। মানুষের নিজের বোধ, বিবেচনা ও বুদ্ধি দিয়ে বাস্তবের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারলে ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণে আনা অবশ্যই সম্ভব। যা আগামী দিন গুলোকে অনেক বেশি হতাশামুক্ত ও অনেক বেশি সুন্দর করে তুলতে পারবে।
গ্রন্থপঞ্জি
১) দাশ, জীবনানন্দ। ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’। কলকাতা, ভারবি, ১৯৫৬।
২) American Psychological Association’s Stress in America Survey, 2017, American Psychological Association.
৩) Beck, A. T., Weissman, A., Lester, D., & Trexler, L. (1976). ‘Classification of suicidal behaviors: II. Dimensions of suicidal intent’. Archives of General Psychiatry, 33(7), 835-837.
৪) Eliot, Thomas Stearns. (2011). ‘The complete poems and plays of TS Eliot’. Faber & Faber.
৫) Hiles, D. (2007). ‘Envy, jealousy, greed: A Kleinian approach’. Centre for Counselling and Psychotherapy Education, London. Retrieved December, 13, 2008.
৬) Ramachandran, V. S., & Jalal, B. (2017). ‘The evolutionary psychology of envy and jealousy’. Frontiers in Psychology, 8.
৭) Senik, C. (2008), ‘Ambition and Jealousy: Income interactions in the ‘Old’ Europe Versus the ‘New’ Europe and the United states’. Economica, vol.75, No. 299, Pp- 495-513, Wiley Online Library.
৮) Virilio, P. (1995) ‘Speed and Politics’, Routledge.
৯) Zhang, Z; and Wang, X. (2021), ‘Ambition or Jealousy? It Depends on Whom You are compared with’, Journal of Happiness Studies, Vol. 22, Pp- 1189-1215.