নিশি পুলুগুর্থা
(অনুবাদ : গৈরিক বসু)
এক নভেম্বরের দিনে মা বাড়িতে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, প্রায়ই করে থাকেন। তিনি স্বাধীন নারী, দীর্ঘকাল ধরে ঘরে-বাইরের কাজ এবং পেশাদারি জগৎ সামলাচ্ছেন। কিন্তু নভেম্বরের এই দিনটা অন্যরকম হয়ে দাঁড়াল। তিনি ফিরে এলেন না। আমরা আটচল্লিশ ঘণ্টা পরে তাঁকে একটু অসংলগ্ন অবস্থায় খুঁজে পেলাম। খুঁজে পাওয়ার পর তিনি এমনভাবে কথা বললেন, যেন কিছুই ঘটেনি! আমি আর বোন মাকে ফিরে পেয়ে এত খুশি ছিলাম যে, কোথায়, কেন এতক্ষণ মা ছিলেন, জিগ্যেসই করা হয়নি। মাকে দিল্লি হাইওয়ের এক পেট্রোল পাম্পের কাছে পাওয়া যায়। এক ভদ্রলোক, হারিয়ে গেছেন বুঝতে পেরে মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। মায়ের কাছে থাকা আমার ভিজিটিং কার্ড পেয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
তারপর বেশকিছু পরীক্ষানিরীক্ষা ও ডাক্তার দেখানোর পর বোঝা গেল রোগটি হল অ্যালজাইমার। অনেক সময়েই মা এক কথা বারবার বলতেন। ধরিয়ে দিলে, বয়সের দোষ বলে উড়িয়ে দিতেন। কখনোই আমাদের একে কোনও গুরুতর বিষয় বলে মনে হয়নি। ঐ হারিয়ে যাওয়ার আগের দিনও মা ব্যাংকে গেছেন, জিনিসপত্র কিনেছেন — যেমন সর্বদাই করেন। তেমন কিছু যে ঘটতে পারে আমাদের সুদূর কল্পনাতেও আসেনি।
আমি ভেবেছিলাম, অ্যালজাইমার রোগটা কী, আমি জানি। তখন আমার ধারণা ছিল এই রোগ স্মৃতিভ্রংশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু মাকে সেবা করতে গিয়ে ধীরে ধীরে বুঝলাম স্মৃতি হারানো এই রোগের একটা দিক মাত্র, তার সঙ্গে আরও অনেক বিষয় আছে। রোগটি জার্মান মনস্তত্ত্ববিদ অ্যালিওস অ্যালজাইমার, যিনি এই রোগকে চিহ্নিত করেন, তাঁর নামে রাখা। এই রোগ হল স্নায়ুতন্ত্রের ক্রমিক অবক্ষয়, যার সূচনা অত্যন্ত ধীরে ধীরে, কিন্তু যত সময় যায়, রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করে। Dementia-র অর্থ অনেক বড়ো, মস্তিষ্কের যে-কোনও স্মৃতি সম্পর্কিত রোগ। প্রাথমিক লক্ষণাবলি হল — ভুলে যাওয়া, সাধারণ কাজ করতে অসুবিধা, ভাব প্রকাশ করতে অসুবিধা বা ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন। অ্যালজাইমার সবচেয়ে সাধারণ ধরনের এক ডিমেনশিয়া। ডিমেনশিয়া সারানো যায় না, অ্যালজাইমার তো নয়ই। একদম প্রাথমিক লক্ষণ সাধারণত মনে রাখার সমস্যা। যতদিন যায়, অন্যান্য লক্ষণ, যেমন ভাষার সমস্যা, ব্যবহারগত সমস্যা, অগোছালো অবস্থা — এগুলো প্রকাশিত হয়। রোগ যখন চিহ্নিত হয়, তার আগেই মস্তিষ্কের বেশ খানিকটা ক্ষতি হয়ে যায়।
মায়ের এই বাড়িতে তালা দিয়ে বেরোনো ও হারিয়ে যাওয়া এবং রোগ ধরা পড়া, আমাদের দৈনন্দিন জীবন পালটে দিল। মাকে চব্বিশ ঘণ্টা চোখে চোখে রাখতে বাধ্য হলাম, কিন্তু মায়ের সেটা বিলকুল না-পছন্দ ছিল। এতদিন যে স্বাধীন জীবন তিনি যাপন করেছেন, এ-যে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রায়ই হ্যালুসিনেট করতে শুরু করলেন। প্রথম প্রথম আমি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তাম, বুঝে উঠতে পারতাম না কীভাবে মাকে বোঝাব যে, যা তিনি দেখছেন সবই অলীক। ধীরে ধীরে বুঝলাম, যা মা বলছেন, সবই জটপাকানো মস্তিষ্কের স্নায়ু তাঁকে বলাচ্ছে। তারপর নিজের মতো করে এই সমস্যার মোকাবিলা করতাম। আমার কাছে এ-এক অতি কঠিন শিক্ষা।
মায়ের রোগ চিহ্নিত হওয়ার পর সবথেকে উদ্বেগের বিষয় ছিল কীভাবে মা যা চাইছেন তাতে বাধা না দিয়ে, নিরাপদে রাখা যায়। তাঁর বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার ঝোঁক বন্ধ করার উপায় ছিল, সবসময় তালা দিয়ে রাখা এবং চাবি নাগালের বাইরে রাখা। কিন্তু তা সমস্যার, স্ববিরোধীও বটে। অ্যালজাইমার ধরা পড়ার আগে মায়ের জীবনযাত্রা আর ধরা পড়ার পরের জীবনযাপনে ছিল দুস্তর ব্যবধান। কিন্তু আপনাকে মানিয়ে নিতেই হবে। অ্যালজাইমার যে কীভাবে আপনার জীবন পালটে দেবে, তার জন্যে কেউ-ই প্রস্তুত থাকে না বা থাকা সম্ভবও নয়।
অ্যালজাইমার-এর সঙ্গে যুদ্ধ করা কঠিনতম কাজ, বিশেষ করে যখন আপনার অতি নিকটজনের ওপর রোগটি থাবা বসায়। বিশেষত প্রত্যক্ষভাবে রোগীর সেবার সঙ্গে যুক্ত ও রোগীর আশেপাশের স্বজনদের ওপর অসম্ভব চাপ পড়ে। মেনে নেওয়া খুব মুশকিল হয় যে, আপনার অতি প্রিয়জন এতদিন যেভাবে ব্যবহার করে এসেছেন, এখন তার সঙ্গে আর কোনও মিলই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমন সব কাণ্ড ঘটাচ্ছেন যে তা সামলাতে আপনি বিভ্রান্ত, অসহায়, কোনও কুলকিনারাই পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি বুঝতে পারলাম মায়ের কাছে সর্বক্ষণ কাউকে থাকতে হবে। স্থানীয় আয়া সেন্টারে লোক পাওয়া যায় বটে, কিন্তু অ্যালজাইমার রোগী সামলানোর বিন্দুমাত্র প্রশিক্ষণ তাদের নেই। রোগীর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে বা কিছু ঘটলে কীভাবে তা সামল দিতে হবে, এ বিষয়ে তারা চূড়ান্ত রকমের অজ্ঞ। মায়ের কী ধরনের মানসিক পরিবর্তন হয়েছে, তা গরিব ঘরের স্বল্প শিক্ষিত আয়া কীভাবে বুঝবে, যখন তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরাই অ্যালজাইমার বা ডিমেনশিয়া সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না।
অ্যালজাইমারের হাজার রকমের সমস্যা মায়ের মধ্যে দেখা দিল। এ নিয়ে যতই আমি পড়াশোনা করি না কেন, নিত্যনতুন লক্ষণ আমাকে রোজই কঠিন সমস্যায় ফেলতে লাগল। উপলব্ধি করলাম মায়ের জটিল সমস্যার সমাধান ব্যাপারে আমার পক্ষে আগে থেকে কোনও পরিকল্পনা করে প্রস্তুত থাকা সম্ভব নয়। মা স্বাধীনচেতা মহিলা, সতেরো বছর বয়স থেকে কাজ করছেন। অল্পবয়সে দাদুর মৃত্যু সাতজনের পরিবারকে গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছিল। মা দিনে কাজ করতেন, রাতে কলেজ। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবথেকে বড়ো ছিলেন মা; ছোটো বোনের বিয়ের আগে নিজের বিয়ের কথা ভাবেননি। দিদিমা গর্বভরে এসব আমাদের বলতেন। শেষপর্যন্ত বিয়েতে যখন রাজি হলেন, তখন একভাই কলেজে পড়ছে, সংসারের দায়িত্ব নিতে তৈরি। স্থায়ী সরকারি চাকরি ছেড়ে বিয়ের পর মা কলকাতায় আসেন। আমি আর আমার বোন প্রায়ই জিগ্যেস করতাম, কেন তিনি হঠাৎ করে এমন চাকরি ছেড়ে দিলেন; উত্তর ছিল — এসব নিয়ে তত ভাবিইনি। বলতেন, এখানে কাজ পাওয়াও তাঁর পক্ষে কোনও ব্যাপারই না। তিনি কাজ নিলেন, যখন আমার বয়স নয় এবং বোনকে আমি দেখাশোনা করতে পারি।
এই ছিলেন আমার মা — স্বাধীনচেতা, নিজের শর্তে জীবন কাটিয়েছেন, নিজের ভালোমন্দ চিরকাল নিজেই ঠিক করেছেন। সর্বদা উৎসাহে ভরপুর, আমুদে, ঘরে-বাইরে দায়িত্ববান। মনোযোগী পাঠক, সিনেমা নাটকের উৎসাহী দর্শক; বেড়াতে উৎসাহী, কখনও একাই বেরিয়ে পড়তেন; দারুণ রাঁধুনি, যে-কোনও লোকের সঙ্গে গল্প করতে ওস্তাদ। নিয়ম শৃঙ্খলায় আমাদের বড়ো করেছেন, সর্বদাই চাইতেন আমরা যেন স্বাধীন হই, পরমুখাপেক্ষী না থাকি। অবশ্য বাবা সর্বদাই যোগ্য সঙ্গত করেছেন। বাবার মৃত্যুর পর মা একা হয়ে পড়েন, বাড়িতে বেশিক্ষণ মন টিকত না। কিন্তু তা সত্ত্বেও খুব সামাজিক ছিলেন। দুঃখ হতাশার কথা কখনোই আমাকে বা বোনকে বলেননি।
অ্যালজাইমার মাকে একেবারে পালটে দিল। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় নিজের কাজ সবই মোটামুটি পারতেন, তবে কাউকে সর্বদা নজর রাখতে হত যাতে গ্যাসের সিলিন্ডারের নব বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে নিজের ক্ষতি না-করে বসেন। ওনার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ার বাতিক ছিল, কিন্তু তখন তো আর একা একা পাঠানো সম্ভব নয়। কিন্তু সেটা মা মেনে নিতে পারতেন না। বুঝতাম, একজন স্বাধীনচেতা মানুষের পক্ষে এ বড়ো অস্বস্তিকর। অনেক সময় দরজা খোলা পেলেই বেড়িয়ে পড়তেন। কখনও সদর দরজার চাবি খুঁজতেন, আর আয়ার নামে আমাকে নালিশ করতেন, চাবি লুকিয়ে রাখে বলে। ওনার বাড়িতে ওনাকেই কিনা চাবি দেওয়া হচ্ছে না!! প্রথম প্রথম মাকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম, পরে অন্য কথা বলে মায়ের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতাম। কিছুক্ষণ কাজ হত, কিন্তু মা আবার গোড়া থেকে শুরু করতেন।
মায়ের পছন্দের সব জায়গায় আমি তাঁকে নিয়ে যেতাম। যেমন সবজির বাজারে, মুদির দোকানে, সিনেমা নাটক দেখতে। আমাকে খুব সাবধানে থাকতে হত। বাস অটো করে যেতাম আর মাকে সর্বদা পাশে রাখতাম, হাত ধরে থাকতাম। যদিও মা পছন্দ করতেন না। কখনও মুখে বলতেন না, কিন্তু মাঝে মাঝে হাত ছাড়িয়ে নিতেন। তখন আমাকে অন্য পন্থা নিতে হত। আমি মায়ের কাঁধ জড়িয়ে পথে চলতাম, মা বাধা দিতেন না। মা খুব জোরে হাঁটতেন। মা মেয়ের ভূমিকা অদলবদল হয়ে গিয়েছিল।
রোগ ধরা পড়ার পরেও মায়ের প্রিয় জায়গাগুলোতে আমরা বেড়াতে গিয়েছি — তিরুপতি, হায়দরাবাদে মা-এর বোনের বাড়ি, ঘুমকিতে আমার বোনের বাড়ি আরও কোথাও। সাধারণত বিমানেই যেতাম, কারণ ট্রেনে গেলে আমাকে সারারাত জাগতে হত। মায়ের বেড়াতে খুব ভালো লাগত। হায়দরাবাদে মস্ত নতুন বিমানবন্দর দেখে মায়ের শিশুর মতো খুশি মুখ আমি ভুলিনি।
বোন আর বোনের বর তাদের সঙ্গে মাকে থাকতে বলত। নাতি-নাতিরা ছিল মায়ের প্রাণ, তবুও মা থাকতে রাজি হতেন না। কলকাতাই ছিল তাঁর ঘর, সেখানে বড়ো মেয়ের (আমি) কাছে থাকতেই পছন্দ করতেন। মায়ের সময়ের বোধ গুলিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বুঝতেন কখন আমি কাজ থেকে ফিরব। গেটের দিকে নজর রাখতেন, আমাকে দেখলেই মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত। পরের দিকে অবস্থা যখন খারাপ, তখনও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
সময় যত এগোল, অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে লাগল। ক্রমশ কথা বলা কমে গেল — ইশারা ইঙ্গিতে হাততালি দিয়ে মনের ভাব বোঝাতেন। মা ভালো আছেন কিনা বা কোনও অস্বস্তি হচ্ছে কিনা বোঝার কোনও উপায় থাকল না। মায়ের মেজাজ বা ব্যবহার দেখে কিছু গন্ডগোল হয়েছে কিনা আমি বুঝতে পারতাম। অসুস্থ হয়ে পড়লে, ডাক্তার ডাকা হত; মা তাঁকে দেখে হাসতেন।
রোগ ধরা পড়ার প্রায় সাত বছর পরে মায়ের খিঁচুনি শুরু হল। এর ফলে মা সেদিন অসুস্থ থাকতেন, তারপর আস্তে আস্তে ঠিক হতেন। মাকে যথাসাধ্য আরামে রাখার চেষ্টা করতাম। তাছাড়া আমার কীই বা করার ছিল। কিন্তু প্রতিটি খিঁচুনির পরেই মায়ের মধ্যে আরও পরিবর্তন আসতে লাগল। হাঁটাচলা কমে এল। সারাবাড়িতে যিনি কর্ত্রীর মতো সর্বদা ঘুরে বেড়াতেন, তাঁর এখন উঠে বসাও কষ্টকর। অনেক চেষ্টা করে উঠে দাঁড়াতেন, একটু হেঁটেই বসে পড়তেন। দাঁড়াতে চাইতেন, কিন্তু শরীর সায় দিত না। মায়ের বাথরুম যাবার জন্য হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করা হল।
আমি যা-ই করতাম, মা তাতেই হাসতেন। এই হাসি ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে এল। রোগ ধরা পড়ার ন-বছর পরেও পরিচিত কাউকে দেখলে মায়ের মুখে হাসি ফুটে উঠত। অপরিচিত জনেদের জন্যেও মায়ের একটা সামাজিক হাসি ছিল। সাড়া দিতেন মা, কিন্তু সেগুলো ছিল নীরব। আমি বুঝতে পারতাম, অনুভব করতে পারতাম। মা কখনও আমার দিকে তাকাতেন, কখনও অন্যদিকে; তারপর ধীরে ধীরে আমার গায়ে হাত বোলাতেন; কখনও হাত ধরতেন, ধরেই থাকতেন।
ফেব্রুয়ারি ২০১১-এ মা চলে যান। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তাঁর শরীর খারাপ ছিল। শেষ সময়ে শান্তিতে পরিবার পরিজনের সঙ্গেই কেটেছে তাঁর। মাকে সেবা করার অভিজ্ঞতা লিখে রাখতাম। সাধারণ লোককে এই রোগ সম্পর্কে অবহিত করার জন্যে অনেক সেমিনারে বলেওছি। রোগ যখন ধরা পড়ে, আমার মাথায় বজ্রপাত হয়েছিল; তারপর আরও এগারো বছর আমি ও মা নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে শিখতে শিখতে গেছি। আমার অভিজ্ঞতা আমি বলেছি, কিন্তু মায়ের দিক থেকে কিচ্ছু আমার জানা হয়নি — তবে, আমরা দুজনে মিলেই তো এই কঠিন পথ অতিক্রম করেছিলাম।
আপনার মতো বুঝেই বা কজন চলতে পারবে। আপনার মতো চেষ্টা যেনো সবার মধ্যে আসে। তাহলেই হয়তো ভবিষ্যতে আমরা এই কঠিন পথটা কিছুটা সহজ করতে পারবো।
LikeLike