সুশান্ত পাল
এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে-এ-এ না।
এ-লেখার খসড়া চূড়ান্ত করার সময় চলভাষ পর্দায় বার্তা এল — চেন্নাইতে গবেষকের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার। বত্রিশ বছরের শচীন কুমার জৈন ছিল মাদ্রাজ আইআইটির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে গবেষণারত। নিজেকে শেষ করার পূর্বে হোয়াটসঅ্যাপের স্টেটাসে আমাদের প্রতি বার্তা রেখে গেছে সে — ‘আমি দুঃখিত। নট গুড এনাফ।’ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই তিনজন আত্মহত্যা করল উচ্চশিক্ষা তথা গবেষণার জন্য খ্যাত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
তথ্য থেকে আপাত সত্যের অনুসন্ধানে হস্তক্ষেপবিবিক্ত ‘ডেটা’ (Data) সহায়ে প্রথমে থাক ভয় ধরানো এক পরিসংখ্যান। শেষের ৬৩ মাসে মোট ৩৩ জন আইআইটি পড়ুয়া আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। তবে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে আরও বেশি; হয় ব্যর্থ হয়েছে, নতুবা ভাবনা কার্যকরে এখনও রয়েছে দোলাচলে। নিশ্চিত যে, আগামী দিনে আত্মহত্যা ও তার প্রবণতার বৃদ্ধি হতে থাকবে ক্রমাগত।
প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বীজমন্ত্র হল — চ্যাম্পিয়ন হও অথবা বাতিলের দলে গোত্রভুক্ত হও। ব্রাত্যজনেদের জন্য নেই কোনও করুণা; সংবেদনশীলতা অক্ষমের সংরক্ষণ।
বয়স ষোলো। নাম কৃত্তিকা পাল। টিভির পর্দায় দেখেছিলাম তার আত্মহননের খবর। সহপাঠীদের কথায়, শান্ত ও অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিল। নাচ, গান, আঁকায় ভালোবাসা। ক্লাস সেভেনের ছাত্রী প্রস্তুতি নিচ্ছিল আইএসআই পরীক্ষার! বন্ধু-বান্ধবহীন জগৎ ছিল বাবা-মা ও পড়াশোনা ঘিরে। তার একাকিত্ব, হতাশা, অবসাদের খোঁজ পায়নি কেউ। কিশোরীর শিরাছিন্ন রক্তের ধারায় কলকাতার নামী স্কুলের বাথরুমের মেঝে ছাপিয়ে উঠেছিল।
নিস্তব্ধ দুপুর। অঙ্ক কষা সাদা বোর্ডের একপাশে আত্মহত্যার প্রতিবেদন — ‘মা আই কুইট’। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী আর নিতে পারছিল না পড়াশোনার চাপ। গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে যাওয়া বন্ধ করেছিল দিন কয়েক আগেই। শিলিগুড়ির সেবক রোডের ছাত্রের মনের খবর রাখেনি কেউ। ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন শিক্ষিকা মাকে বলেছিল, ‘সাবধানে যেয়ো মা। ফেরার সময় শিঙাড়া নিয়ে এসো’। সন্ধ্যায় শিঙাড়ার ঠোঙা হাতে ফিরেছিল মা। তখন সব নিথর।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল হৃষিক কোলে। সিঙ্গুর থেকে বাংলা মিডিয়ামের মেধাবী ছাত্র ভর্তি হয়েছে কলকাতার সম্ভ্রান্ত ইংরাজি মাধ্যম কলেজে। দু-দিনের মধ্যেই স্বপ্নালু চোখে নেমে এল আতঙ্ক। জীবনযাপনের ভিন্নতা অসহ ঠেকল — সফলতার দীক্ষামন্ত্রকে মনে হল মরণফাঁদ। অঙ্ক নিয়ে পড়তে চেয়েছিল হৃষিক, বাধ্য হয়েছে পদার্থবিদ্যায় নিরুপায় আত্মসমর্পণে। মন মেনে নেয়নি। পরিপার্শ্ব সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। অতঃপর মুক্তি আত্মনাশের পথে। চলে যাওয়ার আগে লিখেছিল — ‘এখানে সবারই হাই লেভেল প্রোফাইল। সব ক্লাসই ইংরেজিতে পড়ানো হয়, মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। এখানে মানিয়ে নিতে পারছি না। বাড়িতে জানালে বাপি বকবে’।
অতীত, সমসাময়িকতার নানা নজিরে বিষণ্ণ, অবসাদিত, হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাবলির উল্লেখ দীর্ঘায়িত করা যায়। সংখ্যাধিক্য সমস্যার ভয়াবহতা প্রকট করছে। উত্তরোত্তর জন্ম নিচ্ছে প্রশ্ন — অকালে চলে যাওয়া কেন? কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া? প্রতিযোগিতার ক্লান্তি শ্রান্তি তাদের নিঃসঙ্গ করে? ব্যর্থতার সম্ভাবনায় তারা হয়ে ওঠে ভীত? ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা তাদের পায়ের তলার মাটি আলগা করে দেয়? হাত ধরার কেউ নেই, মনের কথা বলার মনের মানুষ পাশে? সবাই যে-যার মতো খুঁজে চলেছে এল ডোরাডো?
ফটিকের রাখালিয়া মন জল মেপে চলে। জলের তল খুঁজে ফেরে। ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রে একাকী অসহায় তরি ফিরে পায় না তট। অগাধ শূন্যতা রুধিবে কে? গুপ্তধন প্রাপ্তির অভিযানে ছোটো-বড়ো যে-যার মতো মত্ত।
এক যে আছে এল ডোরাডো
সম্পদ বাসনার তৃষ্ণা দুর্নিবার। সোনাকে ছেনে পেতে চায় সবাই। কাল-কালান্তরে স্বর্ণ-স্বপ্ন বিভোর অভিযাত্রীর দল দুঃসাহসী অভিযান করেছেন কলম্বিয়ার চুন্দিনামারকায় অবস্থিত গুয়াতাভিতা হ্রদে। সোনায় খচিত মানুষের বাসভূমি এল ডোরাডোর সন্ধানে শতসহস্র প্রাণের বিনষ্টি ঘটেছে; মানুষিক সম্ভাবনা অপচয়িত হয়েছে। অধরা থেকেছে গুপ্তধন। তবু গুপ্তধন প্রাপ্তির দুরাশা মানুষকে ছুটিয়ে নিয়ে যায় মিথ নগরী এল ডোরাডোয়। এডগার এলান পো পথনির্দেশ করেছেন — ‘এল ডোরাডো যেতে চাও, তবে চাঁদের পাহাড় পেরিয়ে, ছায়ার উপত্যকা ছাড়িয়ে হেঁটে যাও, শুধু হেঁটে যাও…’।
ভিনদেশে যাওয়ার ঝক্কি সামলানোর প্রয়োজন নেই। কলকাতা থেকে বিমান যাত্রায় অথবা ট্রেনে পৌঁছে যেতে হবে মরুরাজ্যের জয়পুরে। সেখান থেকে মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টার সড়ক পথ পৌঁছে দেবে স্বর্গোদ্যান কোটা শহরে, কোচিং ক্যাপিটাল অফ ইন্ডিয়া। ফি-বছর দু-লক্ষ পড়ুয়া এখানে ছুটে আসে সবাইকে ছাপিয়ে ‘অনির্বচনীয় হুন্ডি’-র সন্ধান পাবে বলে। বিজয়ীর মুকুট হাসি ছড়াবে গর্বিত পিতা-মাতার ওষ্ঠাধরে। বাৎসরিক ছয় হাজার কোটির ব্যবসা ফুলবন্ত হবে প্রজ্ঞাপনে, প্ররোচনে। সোনার মুকুট মাথায় সাফল্যধারীদের ছবি মায়া ছড়াবে ঘরে ঘরে। কেউ-কেউ নাচ, গান, নাটক ভালোবাসে, কারো রয়েছে সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ — ওসবে অর্ধাশন অনিবার্য। সুতরাং পরিত্যাজ্য।
অর্থকরী বৃত্তির সঙ্গে সামাজিক সম্মান প্রাপ্তির সুনিশ্চিত হাতছানির মায়াপুরী কোটার বাতাসে কিন্তু মিশে আছে চাপা কান্নার বিষাদ। অব্যক্ত যন্ত্রণা গুমরে গুমরে ওঠে, ঝকঝকে হোস্টেলের পাষাণ দেওয়াল ভেদ করতে পারে না। শেষ চার বছরে কোটায় আত্মহত্যা করেছে ৫২ জন পড়ুয়া। হয়তো তারা চিকিৎসক হবার সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষায় যোগ্যতা অর্জনে অসমর্থ থেকেছে; ব্যর্থতার গ্লানি, বাবা-মায়ের প্রত্যাশা পূরণে অসফল হয়ে তারা জীবনকে শেষ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। পরাজয়ের দৈন্য, পিছিয়ে পড়ার ভয় তাদেরকে যে খাদের কিনারে পৌঁছে দেয়— হীনম্মন্যতায় কুঁকড়ে থাকা সেই মনের হদিস কেউ রাখে না। টিভিতে, দৈনিক সংবাদপত্রের সমগ্র পাতা জুড়ে, সমাজমাধ্যমের স্ক্রিনে শুধুই সাফল্যের জয়ধ্বনি বিঘোষিত হয়। পরীক্ষায় স্থানাধিকারী (/কারিনী) থেকে রুপালি পর্দার নায়ক-নায়িকা, বাইশ গজের অধিনায়ক সোচ্চারে জানান দেয় বিজ্ঞাপনী বিজয়গাথা।
কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে
দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;...
এল ডোরাডো উপাখ্যান থেকে জানা যায়, মুসাইকা সম্প্রদায়ের আদিবাসী মানুষ তাদের নতুন রাজা ‘জিপা’-র অভিষেক মুহূর্তে গুয়াভিতা হ্রদে নিজেদের মূল্যবান সামগ্রী, সোনাদানা দেবতার উদ্দেশে অর্ঘ্যরূপে প্রদান করে নাচগান উৎসবে মেতে উঠত। তারপর ফিরে যেত নতুন কালাধিপের অধীন জীবনপ্রবাহে। এদিকে সভ্য মানুষেরা তথাকথিত পুঁথিশিক্ষা বর্জিত বর্বর মানুষদের হেলায় সমপির্ত ধনসম্পদ আহরণের জন্য ছুটে যায় নদী-সমুদ্র পেরিয়ে মহাদেশান্তরে! প্রসঙ্গান্তরে মনে পড়ে গেল ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’ সিনেমায় কাঞ্চনের কথা। গ্রামীণ স্কুলের প্রধানশিক্ষকের সন্তান বালক কাঞ্চন পিতার শাসন-ত্রাসন, তর্জন-গর্জনের হাত থেকে রেহাই পেতে পাড়ি জমিয়েছিল তার এল ডোরাডো কলকাতা শহরে। কিন্তু এ শহর যে তার স্বপ্নের ঠিকানা নয়, জেনে যায় সে অচিরেই। ভিখারি, মুটে, জাদুকর, উদ্বাস্তু, সন্তানহারা জননী, ব্যবসায়ী মিলে জীবনসংগ্রাম জারি রাখে শহরের বুকে। কুসুমাস্তীর্ণ নয় তার নিয়ন নগর। জীবনযুদ্ধের শিক্ষা অর্জন করেছিল সে কৈশোরের পরিস্ফুটনেই। বহুরূপী হরিদাস তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল তার প্রীতির প্রান্তর; নাড়ির সংযোগ; একান্ত বাসভূমি তার গ্রাম। কাশফুল, ঝিল, নদীপ্রান্তর, ডিঙি, তার অ-বাধ শৈশব। নগর থেকে গ্রামে এ-এক উজানি যাত্রা।
‘বহু বাসনা’-কে ‘বঞ্চিত করে’ আজকের শৈশব নিজের মতো করে বাঁচবে কীভাবে? প্রকৃত ভারতবর্ষের শিশু-কিশোরেরা, ন্যূনতম টিকে থাকার জৈবচাহিদা-র অধিবাসী যারা, স্ল্যামডগদের মিলিয়োনেয়ার হওয়ার অস্কার কাহিনি যাদের অস্তিত্বকে চূড়ান্ত পরিহাস করে, তারা বেছে নেবে কোন্ পথ?
‘আজকে দেশের এ-প্রান্তরে তেপান্তরে…’
ছেলেভুলানো উপকথায় রাজপুত্রেরা বেরিয়ে পড়ে রহস্যরোমাঞ্চবৃত অভিযানে। রাক্ষস-খোক্কস জব্দ করে উদ্ধার করে আনে বন্দিনী রাজকন্যা। বর্তমান দরিদ্র অভাবী ভারত রূপকথার গল্প ভুলেছে। জনমদুখিনি মা তাঁর স্নেহাপত্যের পাতে তুলে দেবে কী — সেই প্রাত্যহিক চিন্তায় জর্জরিত। সন্তান ভাবে সাংসারিক সুরাহায় নিজের দায়ের অন্তর্ভুক্তি। শৈশব তার অপহৃত প্রতীয়মান বাস্তব অভিঘাতে। স্কুল শিক্ষা থেকে নিজেদের প্রত্যাহৃত করে বারো-চোদ্দো-ষোলোর পড়ুয়ারা দলবেঁধে সমবেত হচ্ছে ভাটি, ভেড়ি, ধাবা, ইটভাটা, বিড়ি-বাজি কারখানায়, খাদানে খনিতে। তারা শিশু শ্রমিক, দাস শ্রমিক। রাষ্ট্রের হিসেব দেখানো খাতায় তাদের সংখ্যা স্থিরীকৃত। অথচ, ক্রমাগত শোনা যায় বাজি কারখানায় ছিন্নভিন্ন কিশোরদের দেহাবশেষ গায়েব হয়েছে সুচতুর তৎপরতায়; ধসে যাওয়া কিশোরকে চিনতে অস্বীকার করছেন খাদান মালিক। চাইল্ড রেজিস্টারের ড্রপ আউট বিভাগ শূন্য থাকলেও প্রতিবছর চেন্নাই, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোরে সোনার কারখানায়, ভেড়িতে, জরির কাজে, বহুতল নির্মাণে ভিড় বাড়ায় স্কুলছুট কিশোর-তরুণ। এরা সবাই ‘দাস-শ্রমিক’। স্বাধীনতা নেই। বন্দিজীবনে বেকার খাটা চলে সকাল থেকে রাত। আলোবাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অপার্যাপ্ত খাবারে এক অমানুষী টিকে থাকা। তবু ওরা এই জীবনে একসঙ্গে থাকতে, কাজ করতে ভালোবাসে। খবরের কাগজের প্রতিবেদনে ওদের কয়েকজনের কথা পড়ছিলাম। ওদের বাইশ জনের বন্ডেড লেবারের একটি দলকে উদ্ধার করেছিল পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ। এই পদক্ষেপে ওরা কিন্তু মুক্তির আনন্দে বিহ্বল হয়ে যায়নি। বরং, আঠারো বছর হলে ওরা আবার পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ফিরে যাবে — এই সিদ্ধান্তে অবিচল। সংখ্যাগরিষ্ঠ ওরা পুনর্বার বিদ্যালয়ে ফিরে যেতে চায় না। দাস-শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকারের দেওয়া তিরিশ হাজার টাকা দিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করতে চায়। কতরকমের সরকারি প্রকল্পের আয়োজনেও তো নাবালিকা বিবাহ রুখতে ব্যর্থ হয়ে চলেছে প্রশাসন [জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-এর এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ৬৭৩৩টি বাল্যবিবাহ প্রচেষ্টার অভিযোগ এসেছে। প্রশাসন ৫০৯৩টি বিবাহের প্রচেষ্টা রুখতে পারলেও ১৬৩০টি ঘটনায় প্রশাসনিক পদক্ষেপের কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।]। নাবালিকা পাচারের পরিসংখ্যান ঊর্ধ্বমুখী। দৈন্যের তাড়না নিঃসন্দেহে মূল কারণের একটি। আশ্চর্যের যে, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলের ৭৪ শতাংশ পড়ুয়া প্রাইভেট টিউশনের ওপর নির্ভরশীল। ভাগচাষি, খেতমজুর, রিক্সাওয়ালা দরিদ্রতম মানুষেরা বেঁচে থাকবে না ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাবে? প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় পেশার সুনিশ্চিতি কোথায়? সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার সুরাহা? প্রতিযোগিতা ক্রমবর্ধমান, অথচ সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপোষণে যোগ্যতার নিরিখ মূল্যহীন। বেসরকারিকরণ, কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তির ব্যবহারে চাকরির বাজারে আজ আপামর ভারতের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ডিজিটাল ডিভাইডের সুফলভোগী যারা, যাদের বাড়ির ইলেকট্রনিক গ্যাজেটে লোড করা আছে ‘লার্নিং অ্যাপ্লিকেশন’, অমৃতলোকের ভারতবর্ষে তাদের বাড়ির ছেলে-মেয়েরা সুযোগ্য। বাকিরা ধাবা, খনি, খাদানে, অকাল মাতৃত্বে, নিষিদ্ধ যৌনপল্লিতে কৈশোর তারুণ্য পার করে চলে।
তবু, প্রশ্ন জাগে — পেটের খিদে কী শেষ সত্য, মনের খিদে এতই অকিঞ্চিৎকর? কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই নাম না লেখাক, মাধ্যমিক স্তর থেকেও নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে কেন অগণিত কিশোর তরুণ? দেখা যাক এই সময়কালে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলের সংখ্যাবলি। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সারা দেশে মোট ৫১,১০৮টি সরকারি স্কুল বন্ধ হয়েছে। শেষের দশ বছরে রাজ্যে ৭,০১৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তালা ঝুলেছে। সামাজিক মাধ্যমে ৮,২০৭টি সরকারি স্কুলের একটি তালিকা ছড়িয়ে পড়েছে। শোনা যাচ্ছে, প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের এই স্কুলগুলিতে সর্বোচ্চ ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা মাত্র তিরিশ। শহর কলকাতায় পুরসভা পরিচালিত ১১৩টি স্কুলে ছাত্র সংখ্যা শূন্য অথবা এতই নামমাত্র যে সেখানে পঠনপাঠন প্রায় শিকেয় উঠেছে।
উল্লেখিত প্রতিবেদনে উদ্ধার হওয়া এক দাস-শ্রমিক কিশোরের কাছে প্রশ্ন ছিল — মাধ্যমিক দিতে সে ইচ্ছুক নয়? মুহূর্তেই প্রত্যুত্তর ছিল — ‘পড়াশোনা ভালো লাগে না’। হতবাক প্রতিবেদকের মনে প্রশ্ন জেগেছে — ‘কবে থেকে ভাটা, ভেড়ি, কারখানার চাইতেও নিরানন্দ, নিপীড়নকারী হয়ে উঠল আমাদের স্কুলগুলো? কী করেই বা?… যখন শিশুমন পড়াশোনায় তৃপ্তি পায় না, তখন সাইকেল, জামা-জুতো, কোনও প্রলোভনই তাকে স্কুলে ধরে রাখতে পারে না’।
‘থাকত ওর নিজের জগতের কবি…’
অম্বিকে মাস্টার ‘সহজ পাঠ’-এর কবির কাছে দুঃখ করছেন। বছর দশকের এক অনাথ ছেলে শিশুপাঠের কবিতার পাতা নিজে কেটে রেখে দোষ চাপায় ইঁদুরের নামে। কবির কবিতা ওর মন টানে না। তার চেয়ে মুক্তপ্রাণ ছুটে বেড়ায় কুল বাগান, জাম বাগান, মজা নদীর বাঁকে। রথ দেখে, কাদা মাখে, ভির্মি খায়, ডুব দেয় ‘আঁকা-বাঁকা ছায়া’ জলের তলায়। সবকিছু দেখতে চাওয়া, জানতে চাওয়ায় তার যত লোভ। কোলাব্যাং পুষে খেতে দেয় পোকামাকড়, গুবরে পোকাকে জোগান দেয় গোবরের গুটি। ইস্কুল যায় কাঠবেড়ালি পকেটে; দেশি কুকুর বিছানায় সুখনিদ্রা। পোষ্যের দেহাবসানে মুখে রোচে না অন্নজল। এহেন ছেলেটার কাছে মূর্ত হয়ে ধরা দেয় না কবির শব্দছন্দিত কল্পচিত্র। কবি স্বয়ং স্বীকার করেছেন সেই ত্রুটি। ওর আপন জগতের কথা, তার সঙ্গী-সাথির কথা, গুবরে পোকা, ‘ব্যাঙের খাঁটি কথা’, ‘নেড়ী কুকুরের ট্র্যাজেডি’ যে সত্য হয়ে ওঠেনি তাঁর লেখায়। অম্বিকে মাস্টারের পাঠশালায় তাই ছেলেটার মন বসে না। ‘ছাড়া পেলেই’ দে-দৌড়।
তবে, পালিয়ে রেহাই পাওয়া যায় না সর্বত্র। সুকুমার ও তার সমবয়সী বন্ধুদের স্কুলজীবনের বিভীষিকা তটস্থ করে রেখেছিল ম্যাট্রিকুলেশনের গণ্ডি পেরিয়ে আরও বহুদিন। ভয়ের উৎসে ছিলেন স্কুলের অঙ্ক স্যার। পৃথিবীর সব জটিল অঙ্ক চোখের নিমেষে সমাধান করায় যিনি অদ্বিতীয়। চাইতেন তাঁর মতোই ছাত্ররা যেন ছবির মতো অঙ্কের সমাধান করে ফেলে তৎক্ষণাৎ। অথচ সবাই অঙ্ক বিশারদ নন, কতিপয়। কিন্তু প্রকাণ্ড হাতের প্রচণ্ড চড়ে, হুংকারে সবাই ত্রস্ত। কাঁদবার জো নেই। বজ্রনির্ঘোষ গুরুবাণী — ‘পুরুষ মানুষ হয়ে অঙ্ক পারিসনে — তার উপরে কাঁদতে লজ্জা করে না? এখনি পা-ধরে স্কুলের পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দেবো’। এভাবেই গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর কলে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয় ছাত্রদশার। অবাঞ্ছিত তাড়নায় কুঁকড়ে যাওয়া শিশুমন সারা জীবন বয়ে চলে অবর্ণনীয় ক্লৈব্য-ক্লেশ। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অবিস্মরণীয় অপঘাতের মুখোমুখি হয়েছেন বাল্যকালে। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ পাঠের সময় কবির বাঁ-গালে ধেয়ে এসেছিল বড়ো এক চড়।
অনেকেরই মনে থাকবে জনপ্রিয় বলিউড সিনেমা ‘তারে জমিন পর’-এর কথা। এক বাড়ির দুই বাচ্চা ঈশান ও উহান। উহান সব বিষয়ে যখন সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বাড়ি ফেরে, তখন ঈশানের রেজাল্ট শিট বাড়ির পোষ্যের মুখে ঘোরে। পড়া পারে না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে, বারবার মন চলে যায় ক্লাসের জানলা পেরিয়ে সুদূরে। প্রতিফলে প্রহার, ঘরে-বাইরে কোথাও স্নেহের আশ্রয় নেই, স্কুল থেকে বহিষ্কার — ঈশান নন্দকিশোর অবস্তির জীবন হয়ে ওঠে বিষময়। আট-নয় বছরের ছেলে এমনকি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চায়। তখনই তার জীবনে আসে রাম শংকর নিকুম্ভ স্যার, যাঁর স্নেহে, প্রশ্রয়ে, ভালোবাসায় ঈশান ফিরে আসে মূল স্রোতে। ঈশান ছিল বিরল ডিসলেক্সিয়া অসুখে আক্রান্ত। শব্দ অক্ষর তার চোখের সামনে নেচে বেড়াত, ফলে সমস্যা হত তাদের মনে রাখতে, উচ্চারণ করতে। নিকুম্ভ স্যার পৌঁছেছিলেন মূল জটে। সন্ধান পেয়েছিলেন ঈশানের কল্পনাপ্রবণ মনের। তার মনকে স্বচ্ছন্দবিহারের পরিসর দিয়ে তিনি অপাংক্তেয়-র আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সেলুলয়েডের নিকুম্ভ স্যার বাস্তবের মাটিতে সেভাবে নেমে আসেন কি? বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত ছাড়া দৃশ্যমান হন কি? মূলধারার স্কুলশিক্ষায় যেখানে শিক্ষার্থীদের দিয়ে শুধুই পাশ-ফেলের জপমন্ত্র আওড়ানো হয়, অভিন্ন পরিকাঠামো ও গতানুগতিক সেই শিক্ষাচিন্তায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের শিখন প্রক্রিয়া এক দুঃসহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে আমাদের। স্থগিত অথবা প্রলম্বিত-বিকাশের এই শিশুরা সামাজিক শিক্ষালয়ে সহমর্মিতা বঞ্চিত, যেন উদ্বৃত্ত। কোনও এক সময় পরিবারেরও বোঝা। শুধু সরকারি ভাতায় তাদের পৃথক স্বীকৃতি — Children with Special Needs (CWSN)। শিক্ষার বাগাড়ম্বর আয়োজনে শুধু অব্যক্ত রয়ে যায় শিক্ষার্থীর একান্ত ইচ্ছা-অনিচ্ছার নিভৃত আলোড়ন। প্রকৃত চাহিদা।
‘সব শিক্ষা একটি সার্কাস…’
১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো-তে পেশ করা হয় ‘ডেলোর রিপোর্ট’। আত্মপরায়ণতার অসুখ থেকে আগামী পৃথিবীর শিক্ষার রূপরেখা নির্দিষ্ট করতে প্রতিবেদনে মূলত চারটি অভিমুখের ওপর জোর দেওয়া হয় —
ক) Learning to know
খ) Learning to do
গ) Learning to be
ঘ) Learning to live together
বলতে দ্বিধা নেই যে, প্রকৃত জ্ঞানার্জনের, স্বাবলম্বনের, সমাজবদ্ধতার দায়বোধের ও প্রতিমুহূর্তে মানুষ হয়ে ওঠার লক্ষ্য সমসাময়িক শিখন মনস্তত্ত্ব ও পাঠক্রমের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বরং শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে পুথি সঞ্চয়ন, ডিগ্রিধারী হওয়া। শ্রেণি উত্তরণের এক সিড়িভাঙার খেলা। এ খেলায় জেতার জন্য প্রয়োজন কিছু কৌশলের যান্ত্রিক অনুশীলন। শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে তোতাপাখির মতো শুধু পুথির গলাধঃকরণ করো ও শেখানো বুলি বলে চলো। রবীন্দ্রনাথ সখেদে বলেছিলেন — ‘মুখস্থ করিয়া পাশ করাই তো চৌর্যবৃত্তি। যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই বা কম কী করিল? […] অতএব, যারা বই মুখস্থ করিয়া পাশ করে তারা অসভ্য রকমে চুরি করে, অথচ সভ্যতার যুগে পুরস্কার পাইবে তারাই?’
সার্কাসে ভিড় জমিয়েছে অধিপতি, অভিভাবক, শিক্ষক, পড়ুয়া এবং সর্বশক্তিমান শ্রেষ্ঠীপ্রভু। লাইম লাইট শুষে নিচ্ছে সুদক্ষ ট্র্যাপিজ খেলোয়াড়। স্বভাবতই সফলতার কৃৎকৌশল অধিকাংশের দুরধিগম্য থাকে। প্রতিযোগিতার রিং থেকে তারা ছিটকে পড়ে। ওরা বোধহয় জোকার; রংচঙে বেশ-ভাষে গোপন রাখে পরাজিতের যন্ত্রণা।
এবং রবীন্দ্রনাথ
সুতরাং, চলতি শিক্ষাব্যবস্থায় আনন্দের কোনও আয়োজন নেই। স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার অবকাশ নেই। সুকুমারবৃত্তি চর্চায় উৎসাহ নেই। ‘আত্ম’ তথা ‘অপর’-কে জানার মাধ্যমে বিশ্ববোধ জাগরণের সমস্ত পথ রুদ্ধ। শারীরিক বিকাশের প্রয়োজন অবহেলিত। শুধুই কেরানি বানানোর কলের ছাঁচের উপাসনা। অর্থাৎ, শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে জৈবতার প্রয়োজন মেটানো, ব্যাবহারিক জীবনে সাফল্য করায়ত্ত করতে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে বাধ্য হওয়া। এখানে জ্ঞান নেই, ‘জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই’; শুধুই ‘পুঁথির শুকনো পাতা [র] খসখস্ গজগজ্’।
গোড়ার গলদ সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি প্রথমেই শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, ‘আমরা কী হইব এবং আমরা কী শিখিব এই দুটো কথা একেবারে গায়ে গায়ে সংলগ্ন’। শিক্ষাতত্ত্বের সঙ্গে তাই মনুষ্যজীবনের সার্থকতার প্রশ্নটি ওতপ্রোত। প্রথমে আসে আমরা কী হতে চাই? দ্বিতীয়, তৃতীয় অতঃপরের জিজ্ঞাসা প্রথমের সঙ্গে সংযুক্ত — কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণে কী শিখব? কীভাবে শিখব? ইত্যকার নানাবিধ।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনের মূলে রয়েছে মনুষ্যত্বের সাধনা; দেশচেতনার সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে বিশ্বচেতনাকে আত্তীকরণ করা। তিনি শিক্ষার দ্বিবিধ লক্ষ্যের কথা বলেছেন — উচ্চতর ও ব্যাবহারিক। একটিকে তিনি অপরটি থেকে পৃথক করেননি। দুয়ে মিলেই জীবনমুখী শিক্ষার সার্থকতা। প্রথমটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আত্মতা, সত্যতা; স্বাধীনতা, নান্দনিকতা ও মনুষ্যত্বের বিকাশ। নিম্নতর ব্যাবহারিক উদ্দেশ্যে প্রাধান্য পেয়েছে পার্থিব প্রয়োজন। অর্থাৎ, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জীবিকার সামর্থ্য অর্জন করা। যদিও রবীন্দ্রনাথ দ্বিধাহীন চিত্তে বলেছেন — ‘মানুষের সত্য পরিচয় তার জৈবতায় নয়, তার আত্মকর্তৃত্বে, তার স্বাধীনতায়, সৃজনশীলতায়। কবি চিত্রকর গায়ক ভাস্কর না-ও যদি হয়, তবু সব মানুষই শিল্পী। কেননা প্রত্যেক মানুষই জীবনশিল্পী।’ — তবু বৃত্তিমুখী শিক্ষাকেও তিনি অপরিহার্য মনে করেছেন। শ্রীনিকেতনকে কেন্দ্র করে তিনি পল্লিসংগঠনকে নতুন করে গড়তে চেয়েছেন। এখানের শিক্ষাসত্র বিদ্যালয়ে কারিগরি, হস্তশিল্পের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। কাঠের কাজ, চামড়ার কাজ, বয়ন শিল্পে পারদর্শী করে জীবনধারণের জন্য বিকল্প জীবিকা সংস্থানের (ঔপনিবেশিক কেরানি তৈরির শিক্ষা প্রকল্পের বিপরীতে) সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। কৃষিতে আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহারে তিনি উৎসাহী ছিলেন। নিজ পুত্রকে এই কার্যক্রমে নিযুক্ত করেছেন। তবে, বারংবার সতর্ক করেছেন — ‘যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহার মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানব জীবনের ধর্ম নহে।’
প্রয়োজন অনিবার্য করে আবশ্যককে, কিন্তু মনের তো স্বভাব বৈরাগী। অনির্দেশ্য তার যাত্রা। ঔপনিবেশিক শিক্ষা প্রণালীর সূচনা থেকে আজকের দিনের শিখন প্রক্রিয়ার দীর্ঘ যাত্রাপথে অনালোচিত থেকেছে শিশুর মনন, মানসিকতা — ওদের মন কী চায়? বাণিজ্যবুদ্ধি চালিত পাকামাথার শিক্ষাবিদদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার এই অসঙ্গতির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন কবি — ‘অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিলাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না। […] কিন্তু, দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের হাতে কিছুমাত্র সময় নাই। যত শীঘ্র পারি বিদেশীয় ভাষা শিক্ষা করিয়া, পাশ দিয়া, কাজে প্রবিষ্ট হইতে হইবে। কাজেই শিশুকাল হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে, দ্রুতবেগে, দক্ষিণে বামে দৃক্পাত না করিয়া, পড়া মুখস্থ করিয়া যাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুর সময় পাওয়া যায় না। সুতরাং ছেলেদের হাতে কোনো শখের বই দেখিলে সেটা তৎক্ষণাৎ ছিনাইয়া লইতে হয়…’
মনকে উপবাসে রেখে পুথিকে একমাত্র পার্থিব সংকটের থেকে মোক্ষলাভের উপায় বিবেচনায় শিক্ষালাভে থেকে যায় এক মস্ত বড়ো ফাঁকি। প্রতারণা করা হয় নিজের সঙ্গে। সৃজনের যে সম্ভার প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বীজাকারে থাকে, শৈশবকালেই সে-সম্ভাবনার অঙ্কুরে বিনাশ ঘটে। দেশের আত্মার সঙ্গেও বিচ্ছেদ হয় পাকাপাকি। কেননা, তখন দেশের ভূগোল, ইতিহাস, মিথ, পুরাণ সবই মুখস্থের সামগ্রী; প্রাণময় সজীব সত্তা নয়। ফলত, শ্রুতিপরম্পরার উত্তরাধিকার অন্তঃশীল হয়ে সমগ্রতার ঐকতানে নিজেকে মেলাতে পারে না অচলায়তনিকেরা। ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণে রবীন্দ্রনাথ সতর্ক করেছেন — ‘আমরা নৃতত্ত্ব অর্থাৎ Ethnology-র বই যে পড়ি না তাহা নহে। কিন্তু, যখন দেখিতে পাই সেই বই পড়ার দরুন আমাদের ঘরের পাশে যে হাঁড়ি ডোম কৈবর্ত বাগদি রহিয়াছে তাহাদের সম্পূর্ণ পরিচয় পাইবার জন্য আমাদের লেশমাত্র ঔৎসুক্য জন্মে না তখনই বুঝিতে পারি, পুঁথি সম্বন্ধে আমাদের কত বড়ো একটা কুসংস্কার জন্মিয়া গেছে, পুঁথিকে আমরা কত বড়ো মনে করি এবং পুঁথি যাহার প্রতিবিম্ব তাহাকে কত তুচ্ছ বলিয়াই জানি।’
দেশকে একান্ত আপনার করে পাওয়া, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে তুলতে, প্রাণের সঙ্গে প্রাণের যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়াস করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বভারতী ছিল সেই মুক্ত শিক্ষাঙ্গন, যেখানে ‘ছেলেরা বৃষ্টিতে ছুটে বেড়ায়, জ্যোৎস্নারাত্রিতে আনন্দ ভোগ করে, তারা রৌদ্রকে ডরায় না, তারা গাছে চড়ে বসে পড়া করে…।’ গুরুদেব কখনও আশ্রমিকদের খেয়ালখুশির স্বেচ্ছাযাপনে নিষেধের গণ্ডি টেনে দেননি। নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক না-হয়ে পাঠদানকে চিত্তাকর্ষক রূপে গড়ে তুলতে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল সর্বাঙ্গীণ। সোভিয়েত ইউনিয়নে লোকশিক্ষায় জীবনের সঙ্গে পাঠ্যবিষয়ের সংযোগের প্রশংসা করে স্বীয়-পাঠদানের প্রকৃতি সম্পর্কে বলেছেন — ‘চেষ্টা করেছি তাদের মনে সব কিছু সম্বন্ধেই ঔৎসুক্য জাগাতে — প্রকৃতির সৌন্দর্যে, আশেপাশের গ্রামে, অভিনয়ের মাধ্যমে, সাহিত্যে, সংগীতে। প্রকৃতির রাজ্যের সবকিছু দিয়ে, শুধু ক্লাসের পড়া দিয়ে নয়, পর্যবেক্ষণ ও স্বক্রিয় সহযোগিতার মাধ্যমে।’
অর্থাৎ, শিক্ষক ও ছাত্রের তথাকথিত অজর উচ্চাবচ অবস্থানের অনমনীয় মনোভাবের পরিবর্তন চাই সর্বাগ্রে। দাতা ও গ্রহীতার অনড় স্থাণু সম্পর্কে আনতে হবে যৌথতা। এক যৌথ পরস্পর-নির্ভর পাঠপরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে শিশুর থেকে শিক্ষকের জানা ও শোনার প্রয়োজন সর্বাধিক। শিশুর কাছে শেখা পাঠে শিক্ষকের পাঠক্রম সৃজিত হবে। বিশ্বপ্রকৃতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মিলেমিশে গড়ে তুলবেন এক গোষ্ঠীজীবন। ছাত্ররা নিজেরাই অন্তর দিয়ে গড়ে তুলবেন নিজেদের বিদ্যালয়। খাঁচা নয়, সযত্নে গড়া কুলায় সম।
আমাদের মনে হবে ইউটোপিয়া। রবীন্দ্রনাথ এভাবেই ভেবেছেন, কর্মোদ্যোগী হয়েছেন।
পরিশেষে
আমরা কীভাবে ভাবব?
বারে বারে নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা চলছে, চলবে। কাম্য শিখন সামর্থ্যের তালিকা চূড়ান্ত করতে প্রশিক্ষণ চলবে, চলুক। তবে, বাজারের সর্বগ্রাসী লোলুপ কার্যক্রম ব্যতিরেকে, নীতি-ন্যায্যতা সাম্যের প্রশ্নে, জাতি-ধর্ম ও আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বুনিয়াদি স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত উৎকর্ষমুখী শিক্ষা লাভের সমানাধিকার যে সাংবিধানিক তথা মানবাধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট — রাজনৈতিক যাথার্থ্যের কারণেই হোক অথবা ভদ্রজনের শোভন সামাজিক (-ছদ্ম-) দায়বোধে — সকলেই সহমত হবেন এই দাবির সঙ্গে।
বড়ো প্রয়োজন বুঝি শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ-প্রকৃতির যোগ। শিশুর সঙ্গে শিক্ষকের আত্মীয়তার সমানুভূতির যোগ। জীবনের সঙ্গে জীবনের বন্ধন। শিশু অনুচ্চারিত অবচেতন মেলে ধরুক আমাদের বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। ওরা শুধু প্রাণ খুলে কথা বলুক। আমরা শুধু শুনে যাই।
কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে।
এখন হবে প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানে গানে।।
তথ্য, গ্রন্থ ও চলচ্চিত্র সহায় :
আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ জানুয়ারি, ২০২২
ঐ, অম্লানকুসুম চক্রবর্তী, ‘সন্তানকে সফল করার বাজি’, ১৪ মার্চ, ২০২৩
ঐ, স্বাতী ভট্টাচার্য, ‘কারখানায় কৈশোর’, ২২ মার্চ, ২০২৩
ঐ, ‘প্রদীপের নীচে’ (সম্পাদকীয়), ২৩ মার্চ, ২০২৩
ঐ, মোহিত রায়, ‘কাগুজে বাঘদের কর্মকাণ্ড’, ২৯ মার্চ, ২০২৩
ঐ (অনলাইন), ২ এপ্রিল, ২০২৩
ঐ, ‘বাল্য বিবাহ নিয়ে ডিজিকে পত্রাঘাত জাতীয় কমিশনের’, ৫ এপ্রিল, ২০২৩
এই সময়, ৩ আগস্ট, ২০১৯
জি নিউজ, ২৩ জুন, ২০১৯
আইয়াপ্পা পানিকর, ‘শিক্ষার সার্কাস’
দিনেশ দাস, ‘দোলনা’
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, ‘দাম’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘কোলাহল তো বারণ হল’
ঐ, ‘ছুটি’
ঐ, ‘ছেলেটা’
ঐ, ‘তোতাকাহিনী’
ঐ, ‘দুই পাখি’
ঐ, ‘শিক্ষা’, কলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ
অমল গুপ্ত পরিচালিত ‘তারে জমিন পর’ চলচ্চিত্র
ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’ চলচ্চিত্র