লোপামুদ্রা গোস্বামী
কয়েকদিন ধরেই আকাশের মনটা বড়ো মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। এই উপমাটা অবশ্য দিয়ার দেওয়া। আকাশ নিজে অনেকবার ভেবে দেখেছে মাঝে মাঝে তার এই হঠাৎ বিষণ্ণতার কারণ কী? কখনও দু-চার দিনে এই মন খারাপ ঠিক হয়ে যায়, কিন্তু এবার তো প্রায় দু-সপ্তাহ হতে চলল। মাঝে মাঝে তার আজকাল বুক ধড়ফড় করে। টেনশনে শরীর কাঁপে। মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে আজকাল ভয় করে। মনে হয় রেললাইনটা তাকে ডাকছে।
এরকম ঘটনা যে শুধুমাত্র আকাশের ক্ষেত্রে ঘটছে এমন নয়। একজন মনোবিদ হিসাবে আমার কাছে সপ্তাহে তিনটি থেকে চারটি ফোন আসে এই ধরনের বিষণ্ণতার সমস্যা নিয়ে। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে, তরুণ-তরুণী থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই এই সমস্যার শিকার হতে পারে।
কোনও কারণে অনেকেরই দু-চারদিন মন খারাপ থাকতে পারে তবে যদি দেখা যায় সেই বিষণ্ণতা কোনোভাবেই কাটছে না এবং তা সেই ব্যক্তির অস্তিত্বকে গ্রাস করে ধীরে ধীরে অবসাদের দিকে এগোচ্ছে তখন কিন্তু সচেতন হতে হবে।
এই বিষণ্ণতা তথা মানসিক অবসাদ ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ত্রাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র মতে ২০৩০ সালের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা, মূলত অবসাদ পৃথিবীর একনম্বর ব্যাধি রূপে পরিগণিত হবে।
অনেক সময় শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে মানসিক অবসাদ বা depression জড়িত থাকে। এই মানসিক অবসাদ শারীরিক অসুস্থতার কারণেও হতে পারে আবার আলাদা ভাবেও হতে পারে। হার্টের অসুখ, ক্যানসার, ডিমেনশিয়া এগুলোর সঙ্গে মানসিক অবসাদ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত থাকে।
গত দু-বছরে কোভিড পরবর্তী বিশ্বে মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয়েছে অনেক বেশি পরিমাণে। কোভিড নামক এক অচেনা দৈত্যর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে বহু মানুষ তার প্রিয়জনকে হারিয়েছে, কর্মচ্যুত হয়েছে ,অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে; সেই সঙ্গে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
মানসিক অবসাদের চরিত্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হয়। কোনও ব্যক্তিগত আঘাত বা ঘটনার প্রভাব অনেক সময় যে দীর্ঘস্থায়ী হয় তার উদাহরণ আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়ে।
কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ যে মর্মান্তিক আঘাত পেয়েছিলেন তাতে তিনি ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন। এই মৃত্যুর প্রায় ৩২ বছর বাদে রবীন্দ্রনাথ কবি অমিয় চক্রবর্তীকে একটি চিঠিতে লেখেন, “তার মৃত্যুতে আমার পায়ের নীচ থেকে যেন পৃথিবী সরে গেল, আমার আকাশ থেকে আলো নিভে গেলো, আমার জগৎ শূন্য হলো…।”
রবীন্দ্রনাথ বারবার মানসিক আঘাত অবসাদ ও বিষণ্ণতার কথা বলেছেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দু-বছরের মধ্যে যখন তাঁর কাছে খ্যাতি অর্থ সবই ছিল, তখন তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে লেখেন, “দিনরাত্রি মরার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করছে। মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি… আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ।” তবে অসাধারণ আত্মবিশ্বাস এবং মনের জোর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এই অবসাদকে জয় করেছিলেন।
সাম্প্রতিক অতীতে বিনোদন জগতের বেশ কিছু তরুণ-তরুণীর মৃত্যু মূলত আত্মহত্যার পর আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে এই অবসাদ। প্রত্যাশার ক্রমবর্ধমান চাপ নাকি শিল্পীর হৃদয়ের অন্য কোনও বেদনা এই অবসাদের কারণ তা আমরা জানি না।
বেশ কিছু মহিলা প্রসবের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মানসিক অবসাদের শিকার হন। একে post partum depression বলে। প্রথমে হাল্কা বিষণ্ণভাব দিয়ে শুরু হলেও কখনও এই অবসাদের তীব্রতা গুরুতর আকার ধারণ করে। এই ধরনের অবসাদের লক্ষণ প্রসবের কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা দিতে পারে। তবে বেশির ভাগ সময়ে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পরে দেখা দেয়। সন্তান প্রসব করার মানসিক চাপ এবং মা হওয়ার ফলে সাংসারিক অন্য সব কাজকর্ম করে সন্তান পালন করার বাড়তি দায়িত্ব সামলানোর চিন্তা তাকে এই অবসাদের দিকে ঠেলে দেয়। এই অবস্থায় আক্রান্ত মহিলা অনেক সময় এমন আচরণ করেন যাতে মনে হয় যে সে শিশুকে ভালোবাসে না বা সে শিশুর ক্ষতি করতে চায়। এই ধরনের অবসাদ যে কোনও সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাতেই সমানভাবে দেখা দিতে পারে।
ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় মানুষের মনের উৎসাহ উদ্দীপনা আনন্দ স্ফূর্তি কমে যায়। বিষণ্ণতা গ্রাস করে। বেশির ভাগ সময় এই বিষণ্ণতা শীতের শুরুতে আরম্ভ হয় বলে একে winter blues বলা হয়। যদিও এটা পাশ্চাত্য বা শীতপ্রধান দেশের অসুখ তবে আজকাল উত্তরভারত তথা সমগ্র ভারতে এই মানসিক অবসাদের রোগী প্রচুর দেখা যাচ্ছে।
কোনও উৎসব পরবর্তী সময়েও মানুষ অনেক সময় বিষণ্ন হয়ে পড়েন। আমার কাছে এক ভদ্রমহিলা বলেছিলেন যে বিজয়া দশমীর দিন ঠাকুর বিসর্জন চলে যাবার পর ফাঁকা মণ্ডপের মাঝে একটা ছোটো প্রদীপ জ্বলছে দেখে তার মনটা খাঁখাঁ করে উঠেছিল। সেই মনখারাপ বেশ কয়েকদিন স্থায়ী হয়েছিল। এই উৎসব পরবর্তী বিধুরতা অনেক সময় অবসাদে পরিণত হয়।
এই নানা ধরনের মনখারাপ যদি দু-সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয় কোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে এবং তিনি যে-কাজ বা কাজগুলো করতে ভালোবাসতেন, যেমন কেউ যদি গান শুনতে বা টেলিভিশন অথবা সিনেমা দেখতে কিংবা বই পড়তে ভালোবাসেন কিন্তু এখন আর সেটা ভালো লাগছে না — এই লক্ষণগুলো অনেকসময় অবসাদ বা depression-কে চিহ্নিত করে। এর সঙ্গে আরও কিছু লক্ষণ থাকে।
• ঘুম কমে যাওয়া বা অতিরিক্ত ঘুমানো।
• খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন (অতিরিক্ত কম বা বেশি খাওয়া)।
• উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলা, যদি না অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা থাকে।
• কোনও বিষয়ে মনোনিবেশ করতে অসুবিধা হওয়া।
• যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া।
• চলাফেরা অতিরিক্ত কমে বা বেড়ে যাওয়া।
• সর্বশেষে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেওয়া।
মানসিক অবসাদ কাটানোর জন্য সময়মতো চিকিৎসা করা জরুরি। একথা ঠিক যে কোনোরকম চিকিৎসা ছাড়াই পাঁচজনের মধ্যে তিনজন মানসিক অবসাদের রোগী ভালো হয়ে যেতে পারেন। হয়তো সুস্থ হতে কিছুদিন সময় লাগতে পারে। তাহলে মানসিক অবসাদের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন কেন? পাঁচজন অবসাদগ্রস্ত মানুষের মধ্যে তিনজন চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যেতে পারেন কিন্তু কে ভালো হবে না এটা আগে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। সেইজন্য সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন। অনেকসময় সাইকিয়াট্রিস্ট অথবা সাইকোলজিস্ট-এর সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করা নাও যেতে পারে, সেক্ষেত্রে পরিবারের লোক, বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
মনোবিদ বা মনোচিকিৎসক রোগীর সঙ্গে কথা বলে কাউন্সেলিং শুরু করেন। সেই সঙ্গে তার অন্য কোনও শারীরিক অসুবিধা আছে কিনা সেই পরীক্ষা করা হয়।
রোগী যদি দীর্ঘস্থায়ী ও গভীর অবসাদের শিকার হন তাহলে মনোচিকিৎসক তাকে ওষুধ দেন। এই ওষুধগুলো অধিকাংশ সময়েই দীর্ঘমেয়াদি হয়।
এছাড়াও therapy-র মাধ্যমে অবসাদের চিকিৎসা করা হয়।
Cognitive Behaviour Therapy (CBT)-র মাধ্যমে রোগীর চিন্তাভাবনার জগতে এবং আচরণে ইতিবাচক দিক আনার চেষ্টা করা হয়।
Mindfulness Based Cognitive Therapy (MBCT)-র মাধ্যমে যারা দীর্ঘদিন ধরে এবং বারেবারে depression-এ আক্রান্ত হন এমন রোগীদের বিভিন্ন meditation technique বা breathing exercise-এর মাধ্যমে নেতিবাচক (negative) চিন্তন প্রক্রিয়া ভেঙে ইতিবাচক দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।
মনোরোগ বিশেষষজ্ঞ, পারিবারিক চিকিৎসক, বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের কোনও দায়িত্ববান সদস্য যার উপর অবসাদগ্রস্ত মানুষ আস্থা রাখতে পারেন, মূলত তারাই এক সহায় পদ্ধতি (support system) তৈরি করে রোগীকে সুস্থ করে তুলতে পারেন। তাদের কথাবার্তা আচার-আচরণ রোগীর কাজকর্মকে প্রভাবিত করে এবং রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে।