সুকান্তি ভট্টাচার্য্য
মনোরোগের সাথে শারীরবৃত্তীয় সম্পর্কের বিষয়ে সাধারণের বোধগম্য নিবন্ধ লেখা বড়োই কঠিন বিষয়। তবু ‘অভিক্ষেপ’ পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধকে মান্যতা দিয়ে একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। বিজ্ঞানের কঠিন ভাবনাগুলি যথাসম্ভব স্বল্প পরিসরে বিষয়নিষ্ঠভাবে পরিবেশিত হলে পত্রিকার পাঠকবৃন্দ তা গ্রহণ করে, ও আলোচনার মাধ্যমে পরিমার্জন এবং বিস্তার ঘটিয়ে বিষয়টিকে জনমানসে পৌঁছে দেবেন সেই বিশ্বাস ও ভরসা থেকেই এই নিবন্ধের অবতারণা।
মনোরোগের বিষয়ে আলোচনার আগে কতগুলি শব্দার্থ বলে নেওয়া ভালো। প্রথমেই, মনোরোগ কাকে বলে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (২০০১) বলেছে, মনোরোগ হল এমন মানসিক ও ব্যবহারগত গোলযোগ, যাতে চিন্তা, মেজাজ, আবেগ, বোধ ও আচরণের ব্যত্যয় ঘটার ফলে ব্যক্তির অস্বস্তি হয় ও/বা স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়।
‘সাইকিয়াট্রি’ কথাটা প্রথম বলেন জার্মান চিকিৎসক জোহান ক্রিস্টিয়ান রেল (১৮০৮)। ‘সাইক’ মানে ‘সোল’, ‘ইয়াট্রি’ মানে ‘চিকিৎসা’। সাইকিয়াট্রি হল মনোরোগের চিকিৎসা। অন্য যে-কোনও রোগের চিকিৎসার মতো মনোরোগের চিকিৎসাও কাল পরম্পরায় পরিবর্তিত হয়েছে; হয়ে চলেছে। এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে শুধুমাত্র রোগব্যাধির কার্যকারণ, স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহ (ন্যাচারাল হিস্ট্রি), শরীরের অভ্যন্তরে নানা রস, উপাদান, কাঠামো, কাজের পরিবর্তনের খুঁটিনাটি জানতে পারার পরিপ্রেক্ষিতে। এর ফলে রোগ সম্পর্কে শুধুই চিকিৎসকদের বোধচেতনাই বদলাচ্ছে না, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যাচ্ছে। মনোরোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একই রকম বিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ফরাসি দেশে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে ফিলিপ পেনেল শৃঙ্খলিত উন্মাদের হাতের শৃঙ্খল মুক্ত করে যে মানবিক সাইকিয়াট্রির ঐতিহাসিক সূচনা করেছিলেন, তা আজ মনোরোগীর নাগরিক অধিকার বা স্বাস্থ্যবিমার অধিকার প্রভৃতি বিভিন্ন দিকে পল্লবিত হয়েছে। এরকম সদর্থক বিবর্তন হলেও এখনও সমাজে মনোরোগ ও মনোরোগীর প্রতি বঙ্কিম ভ্রূকুঞ্চন বা শ্লেষাত্মক ওষ্ঠ্যভঙ্গিমাও রয়ে গিয়েছে। মনোরোগের বিষয়ে সাধারণের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমেই এই সোশ্যাল স্টিগমা দূর হতে পারে।
এখন মনোরোগ বলতে একটি বিশেষ কোনও রোগকে বোঝায় না। যেমন, হৃদ্রোগ বললে প্রদাহজনিত, যান্ত্রিক, রক্তবাহ ঘটিত, গঠনগত নানা ধরনের ব্যাধি আলোচনায় আসে; আবার হৃৎপিণ্ডের যান্ত্রিক গোলযোগ বলতে সঙ্কোচনঘটিত, প্রসারণঘটিত বা কপাটিকাঘটিত বিভিন্ন সমস্যা বোঝায়, মনোরোগের ক্ষেত্রেও তেমনই। সাধারণভাবে যে-যে ধরনের মনোরোগ দেখা যায়, সেগুলি হল: উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাঘটিত (অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার), অবসাদজনিত (ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার), নাছোরবান্দা আবেশিক বায়ুঘটিত (অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার), উভমেরু আবেগতাড়িত (বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার), চিত্তবাতুলতা জনিত (সাইকোটিক ডিসঅর্ডার), বিস্মরণঘটিত (ডিমেন্সিয়া), নেশাজনিত (ডিসঅর্ডার অফ সাবস্টেন্স ইউজ), শৈশবের মানসিক অসুস্থতা (চাইল্ডহুড মেন্টাল ইলনেসেস), বোধখর্বতা (ইন্টেলেকচুয়াল ডিজেবিলিটি), আত্মবদ্ধতা (অটিজম্), অমনোযোগিতা ও অতি চঞ্চলতা (এডিএইচডি) প্রভৃতি।
হৃদ্রোগের ক্ষেত্রে ধরন, কারণ যাই হোক-না-কেন, রোগীরা শ্বাসকষ্ট, কাশি, পা-ফোলা ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান। রোগের ধরন ও কারণভেদে উপসর্গের ধরন ও মাত্রা নানা রকমের হয়। তেমনই মনোরোগের ক্ষেত্রেও কিছু উপসর্গ বিভিন্ন প্রকারে প্রকাশে হতে দেখা যায়। এই উপসর্গগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল :
১) খেয়ালখুশিভাব বা কুণ্ঠিতভাব — একাকী থাকে, মেলামেশা করতে চায় না, নিজের পরিচ্ছন্নতাও খেয়ালে রাখে না।
২) অমূল প্রত্যক্ষতা — এমন কিছু দেখতে বা শুনতে পায়, যা আদৌ নেই বা অন্য কেউই দেখতে বা শুনতে পায় না।
৩) অস্বাভাবিক সন্দেহপ্রবণতা — আড়ি পেতে অন্যের কথা শুনতে চেষ্টা করে, ও ভাবে তাকে নিয়েই আলোচনা করছে বা তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।
৪) অমূলক প্রফুল্লতা ও দম্ভ — নিজের কৃতিত্ব বা ধনসম্পদ নিয়ে জাহির করে, অকারণে উগ্র পোষাক পরে, মাত্রাছাড়া উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।
৫) অত্যন্ত দুঃখভাব — ঘরের এককোণে গুটিয়ে বসে থাকে, অকারণে বিষণ্ণ থাকে ও/বা কাঁদে।
৬) আত্মহত্যার প্রবণতা — বিষণ্ণভাবে বসে থাকে, সব সময়েই কিছু ভাবতে থাকে, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবে।
৭) বিলম্বিত মানসিক বিকাশ — বয়সোচিত বিকাশের অভাব।
চিকিৎসকেরা মনোরোগের উপসর্গগুলিকে চারটি সাধারণ ভাগে বিচার করে থাকেন : শারীরিক কাজকর্মে ব্যাঘাত, মানসিক ক্রিয়াশীলতায় বিপত্তি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনযাপনে পরিবর্তন, ভিত্তিহীন দৈহিক কষ্ট (যেমন, গায়ের ওপর দিয়ে পোকা হেঁটে যাচ্ছে মনে হওয়া, অকারণে চুলকানো বা মাথা যন্ত্রণা বা পেটে ব্যথা ইত্যাদি)।
একসময়ে মনোরোগের কারণ হিসেবে ভূতের ভর করা, প্রেতাত্মার অভিশাপ, ডাইনি পাওয়া, ভগবানের দেখা পাওয়া এমন সব আজগুবি কথা বলা হত। রোগীকে শৃঙ্খলিত করে ঝাড়ফোঁক করা, ভূত তাড়ানোর নামে নৃসংশভাবে প্রহার করা, দীর্ঘদিন বন্দি করে অনশনে রাখা ইত্যাদি করা হত। সভ্যতার ইতিহাস এই নির্মম অন্ধকার পর্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল রেনেসাঁ যুগের আলোলিকা অনুসরণ করে। তবে, সেই পর্বেও মনোরোগবিদ্যা সম্পূর্ণভাবেই বিষয়ভিত্তিক ছিল; আজকের মতো এতটুকু নৈর্ব্যক্তিকও হয়ে উঠতে পারেনি। নিরন্তর বিজ্ঞানমনস্ক চর্চার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে কিছুটা হলেও নৈর্ব্যক্তিক ভাবনায় মনোরোগকে বিচার করা সম্ভব হচ্ছে। দেহের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রসের তারতম্যতার ভিত্তিতে মনের নানা রকমের অস্বাভাবিক অবস্থা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনাও সম্ভব হচ্ছে। তবে, শুধুমাত্র রাসায়নিক কারণেই মনোরোগ ঘটে থাকে এমনটাও নয়। মনোরোগ বহুধা কারণের বহুমুখী প্রকাশ। মনোরোগের সাধারণ কারণগুলিকে মোটের ওপর কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, জৈবিক উপাদান নির্ভর, শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন নির্ভর, মানসিক উপাদান নির্ভর ও সামাজিক বিষয় নির্ভর। তবে, সাধারণ কারণগুলির ভিত্তিতে চোদ্দোটি বড়ো ভাগে আলোচনা করা হয় —
১) জিনগত উপাদান ঘটিত
২) জৈব রাসায়নিক ব্যত্যয় ঘটিত
৩) স্নায়ুসম্প্রেরক (নিউরোট্রান্সমিটার) ঘটিত
৪) স্নায়ুতন্ত্রে ক্ষয়ক্ষতি জনিত
৫) আঘাতের কারণে মস্তিষ্কর বৈকল্য
৬) সংক্রমণের কারণে মস্তিষ্কর বৈকল্য (নিউরোসিফিলিস, এনকেফালাইটিস, এইচআইভি, স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণ ইত্যাদি)
৭) সুরা ও অন্যান্য নেশাদ্রব্য ঘটিত
৮) সংবহন ঘটিত — ইস্কেমিক বা হিমোরেজিক স্ট্রোক
৯) রক্তে বিভিন্ন উপাদানের বৈষম্য — গ্লুকোজ, সোডিয়াম, জল, অক্সিজেন ইত্যাদি
১০) আব ঘটিত — বিভিন্ন ধরনের ব্রেন টিউমার
১১) অপুষ্টি ও নির্দিষ্ট ভিটামিনের (বি১, বি১২ ইত্যাদি) অভাব
১২) অবক্ষয় (degenerative) জনিত — ডিমেন্সিয়া
১৩) অন্তঃক্ষরা ঘটিত — থাইরয়েড হরমোন, কর্টিসল ইত্যাদির বৈষম্য
১৪) তৎকালিক বা দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক অসুস্থতার কারণে — ফেব্রাইল ডিলিরিয়াম, হসপিটাল সাইকোসিস ইত্যাদি।
শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন (বিশেষত বয়ঃসন্ধিকালে, ঋতুস্রাবের সময়ে, গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের অব্যবহিত পরে) কেবলমাত্র অন্তঃক্ষরা ঘটিত শারীরবৃত্তীয় কারণেই ঘটে না, বেশ কিছু মানসিক ও সামাজিক বিষয়ও সহনক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। স্বজন-বান্ধবদের আন্তরিক সহযোগিতা এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে।
ক্ষোভ ও আবেগের বিষয়ে স্নায়ুজীববিদ্যার আলোচনায় দেখা যায় যে বিভিন্ন দেহরসের তারতম্যের পাশাপাশি শারীরসংস্থানেরও (অ্যানাটমি) গুরুত্ব সমধিক। মস্তিষ্কর পুরোখণ্ড (ফ্রন্টাল লোব অফ সেরিব্রাম) ও মস্তিষ্কের প্রান্তবর্তী তন্ত্রের (লিম্বিক সিস্টেম অফ দ্য ব্রেন) নির্ধারক ভূমিকা রয়েছে। বর্তুলাকার অ্যামিগডালা বিনষ্ট হলে বা করা হলে এক অদ্ভুত শান্ত অথচ নির্ভীক ভাব, যে কোনও কিছুই মুখে তুলে নেওয়ার প্রবণতা ও অতিরিক্ত যৌনতার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। একত্রে ক্লুভের বুসি সিনড্রোম বলে।
ফিনিয়াস গেজ-এর চারিত্রিক গুণাবলির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছিল আকস্মিক দুর্ঘটনায় পুরোমস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে (পাদটীকা দেখুন)। টেস্টোস্টেরন, ডোপামিনের আধিক্য ও সেরোটোনিনের স্বল্পতায় মানসিক ক্ষোভ প্রকাশ পায়। উচ্চ মাত্রায় কর্টিসলও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে পারে। কর্টিসল হল স্ট্রেস হরমোন। বিভিন্ন তৎকালিক বা দীর্ঘমেয়াদি রোগ, আঘাত, দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচার, সামাজিক বা মানসিক চাপক্লিষ্ট দশায় কর্টিসলের ক্ষরণ বাড়ে। এসব অবস্থায় মানুষ অনেক সময়েই স্বনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অস্বাভাবিক ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে।
লিম্বিক তন্ত্রের উল্লেখযোগ্য কাজগুলি হল : আবেগে উপযুক্ত সাড়া, নেশা, কর্মোদ্দীপনা, খাওয়ার ইচ্ছা, যৌনক্রিয়ার আগ্রহ, স্মৃতি, নিদ্রা ও সামাজিক বোধ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করা। লিম্বিক লোব ও বেশ কয়েকটি অববল্কল (সাবকর্টিকাল) অংশকে একত্রে লিম্বিক তন্ত্র বলে। এই অংশগুলি একটি কার্যকর স্নায়ুচক্র গঠন করে, যাকে প্যাপেজ সার্কিট নাম দেওয়া হয়েছে। লিম্বিক তন্ত্রের কাজ বহুলাংশে এই সার্কিটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।
এবারে, অতি পরিচিত কিছু মনোরোগের শারীরবৃত্তীয় ভিত্তি আলোচনা করা যাক।
১) অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার — অ্যামিগডালা ও অ্যান্টিরিয়র সিঙ্গুলেট কর্টেক্স (ACC) এবং অ্যামিগডালা ও অর্বিটোফ্রন্টাল কর্টেক্সের (OFC) উভমুখী সংযোগের মাধ্যমে, বিশেষত এই সংযোগের অতি সক্রিয়তার ফলে, ভয় ভীতি ও ত্রাসের অনুভূতি ঘটে।
ভয়প্রদ অবস্থাটি এড়িয়ে চলাই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। এটি চেষ্টীয় (মোটরিক) প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়া অ্যামিগডালা থেকে পেরিঅ্যাকুইডাক্টাল গ্রেম্যাটার (PAG) সংযোগের মাধ্যমে অংশত নিয়ন্ত্রিত হয়।
আরও দু-ধরনের চেষ্টীয় প্রতিক্রিয়া— লড়াই করা বা পালিয়ে যাওয়া দেখা যায়। এগুলি অ্যামিগডালার সাথে হাইপোথ্যালামাসের সংযোগ পথে নিয়ন্ত্রিত হয়। অত্যন্ত ভীতিতে (প্যানিক অ্যাটাকে) শ্বাসহারের পরিবর্তন, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানির উপসর্গ, দম নিতে না-পারার অনুভব অ্যমিগডালা থেকে প্যারাব্র্যাকিয়াল নিউক্লিয়াসের (PBN), সংযোগ পথের মাধ্যমে ঘটে থাকে।
হৃদ্হার ও রক্তচাপের বৃদ্ধি ঘটে থাকে অ্যামিগডালা থেকে লোকাস সেরুলিয়াস (LC) সংযোগের মাধ্যমে।
এই সংযোগ পথের পুনঃপুন বা দীর্ঘমেয়াদি অতিক্রিয়তার ফলে হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিওর, ডায়াবিটিস টাইপ ২, স্ট্রোক প্রভৃতি হয়ে থাকে। আতঙ্কের ফলে অ্যামিগডালার মাধ্যমে হাইপোথ্যালামাস ও পিট্যুইটারি গ্রন্থির অতিক্রিয়তার ফলে কর্টিসল হরমোনের অধিক ও দীর্ঘকালীন অতিরিক্ত ক্ষরণ ঘটতে থাকে। উচচ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস টাইপ ২, হার্ট ফেইলিওর, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়।
২) ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার — মুখ্যত মনোঅ্যামিন ও অ্যাসিটাইল কোলিন এবং অন্য কিছু স্নায়ুসম্প্রেরক (নিউরোট্রান্সমিটার) ঘটিত তারতম্যে অবসাদের বিভিন্ন উপসর্গ (শেষরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া ও আর ঘুম না আসা, কাজেকর্মে আগ্রহ না থাকা, নিজেকে অকর্মণ্য ভাবা, মনোযোগের অভাব ঘটা, ইত্যাদি; এমন কি আত্মহত্যার কথা ভাবা বা চেষ্টা করা) দেখা যায়। রাফে নিউক্লিয়াসের ওপর সেরোটোনিনের (মনোঅ্যামিন) ক্রিয়ার ফলে ক্ষুধাবোধ, দেহের তাপমাত্রা, বিপাকীয় প্রক্রিয়া , নিদ্রা, জৈবঘড়ির ছন্দ, যৌন ইচ্ছা নিয়ন্ত্রিত হয়।
অন্যদিকে, ডোপামিন (মনোঅ্যামিন) মেসোকর্টেক্সের পথে কাজ করে কর্মোদ্দীপনা, একাগ্রতা, লক্ষ্যস্থিরতা, প্রভৃতি; এবং মেসোলিম্বিক পথে কাজ করে নতুন বিষয় শেখা, প্রভৃতি বৃদ্ধি করা ও সুখানুভূতি-মূলক কাজে আগ্রহী করা, প্রভৃতি বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করে।
নরএপিনেফ্রিন (মনোঅ্যামিন) যদি অন্তঃপুরোরজ্জু পথে (মেডিয়াল ফোরব্রেন বান্ডল) কম পরিমাণে থাকলে বা কম কাজ করলে অনীহা, সুখবোধের সম্পূর্ণ লোপ, কামেচ্ছার লোপ ঘটে থাকে।
অ্যাসিটাইল কোলিনবাহী স্নায়ুগুলির সাথে ওপরের তিনটি মনোঅ্যামিনবাহী স্নায়ুগুলির উভমুখী সংযোগ রয়েছে। অ্যাসিটাইল কোলিনের স্নায়ুস্তরে আধিক্য ঘটলে অবসাদের উপসর্গ বেশি করে প্রকাশ পায়, ও ম্যানিয়ার উপসর্গ হ্রাস পায়।
৩) ম্যানিক ডিসঅর্ডার — ম্যানিয়া এককভাবে দেখা যেতে পারে; আবার বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডারের একটি পর্যায়েও দেখা যায়। ম্যানিয়াতে শারীরিক উদ্দীপনা ও মানসিক উত্তেজনা চরমে ওঠে। ম্যানিক দশায় ব্যক্তি নিজেকে রাজা-উজির মনে হয়, ঘুমের তাগিদ কমে, অনর্গল কথা বলতে থাকা, ভাবনাচিন্তা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায় বা শুধুই বদলে যেতে থাকে, অন্তিমফল যাই হোক না কেন তাৎক্ষণিক আনন্দের জন্য যে-কোনও কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের কল্পিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে ওঠে ব্যক্তি। ঝুঁকি নেওয়া ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না-পারা অর্বিটো-ফ্রন্টাল কর্টএক্স (OFC), ডর্সোল্যাটেরাল প্রি-ফ্রন্টাল কর্টএক্স (DLPFC), ভেন্টেরোমেডিয়াল প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স (VMPFC)-ওর অতিক্রিয়তার ফলে ঘটে থাকে। এগুলি সেরোটোনিন, ডোপামিন ও নরএপিনেফ্রিন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। অন্যান্য উপসর্গগুলি নিউক্লিয়াস অ্যাকাম্বেন্সের অতিক্রিয়তার ফলে ঘটে। এই অতিসক্রিয়তা সেরোটোনিন ও ডোপামিন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়।
৪) অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার — ওসিডির উপসর্গ হল হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই একই চিন্তা, ভয়, তাড়না জেরবার করে ফেলে; এসব এতই নাছোরবান্দা যে শত চেষ্টাতেও তাড়ানো যায় না। খুঁতখুঁতে স্বভাব (checker) ও শুচিবায়ুগ্রস্ততা (Washer) দিয়ে প্রায়ই একে চেনা যায়। এতে মানসিক অস্থিরতার কারণে ব্যক্তিটি বারেবারে একই কাজ খুঁটিয়ে যাচাই (checking) করে, যেমন: বেড়োনোর সময়ে দরজায় তালা দিয়ে ফিরে ফিরে এসে দেখতে থাকে তালাটা ঠিকমতো দেওয়া হয়েছে কিনা। শুচিবায়ুগ্রস্ত ব্যক্তি নিজের হাত-পা, বাসনপত্র, বিছানা, পোশাক, মেঝে সবকিছুকেই বারেবারে পরিস্কার (washing) করে থাকে; তবু তাদের মনে হয় নোংরা রয়ে গেছে। কর্টিকো-স্ট্রায়ো-থ্যালামো-কর্টিকাল সার্কিটের অস্বাভাবিক কাজের ফলে এইসব উপসর্গ দেখা দেয়। স্ট্রায়াটাম হল বেসাল নিউক্লিআই/ বেসাল গ্যাংগ্লিয়ার অংশ। সেরিব্রাল কর্টেক্স থেকে স্ট্রায়াটাম হয়ে স্নায়ু-উদ্দীপনা দু-ভাবে প্রবাহিত হতে পারে। সরাসরি গ্লোবাস প্যালিডাস ইন্টার্নাস হয়ে ‘সাবস্টেন্স পি’ স্নায়ুসম্প্রেরকের মাধ্যমে থ্যালামাসকে উত্তেজিত করে কর্টেক্সে ফিরে যেতে পারে। এটি সেরিব্রাল কর্টেক্সের উত্তেজনা ঘটায়। অন্যদিকে, স্ট্রায়াটাম থেকে গ্লোবাস প্যালিডাস এক্সটার্নাস ঘুরে গ্লোবাস প্যালিডাস ইন্টার্নাস হয়ে এনকেফালিন স্নায়ুসম্প্রেরকের মাধ্যমে থ্যালামাসকে নিস্তেজিত করে সেরিব্রাল কর্টেক্সে ফিরে যায় পরোক্ষ পথে।
এটি নিস্তেজক পথ। এই দুই পথে স্নায়ু-উদ্দীপনার সম্প্রেরণ ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে ওসিডির উপসর্গ প্রকাশ পায়। সেরোটোনিন, ডোপামিন এই পথদুটির স্নায়ুসম্প্রেরণের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। প্রিফ্রন্টাল কর্টএক্স-এ গ্লুটামিনের আধিক্য ওসিডিতে দেখা যায়।
৫) সাইকোটিক ডিসঅর্ডার — এতে চিন্তাশীলতা, আবেগে যথাযথ সাড়া দেওয়া, বাস্তবতার বিচার, কথাবার্তায় অসংগতি, পারস্পরিক সংযোগ ও সম্পর্ক বহুলাংশে হ্রাস বা লোপ পায়। ফলে ডিল্যুশন ,হ্যাল্যুশিনেশন, বার্তালাপে অসংগতি, ব্যাবহারিক বিচ্যুতি, বিরক্তি ও ক্ষোভের প্রকাশ দেখা যায়। পাশাপাশি, উপযুক্ত শব্দ খুঁজে না পাওয়ায় কথা বলায় আড়ষ্টতা, সামাজিক মেলামেশা করতে না পারা, সুখদুঃখ অনুভব করতে না পারা, লক্ষ্য পূরণে কাজের অনীহা প্রভৃতি নেতিপ্রবৃত্তিও দেখা যায়। ডোপামিন ও গ্লুটামিন সম্প্রেরিত স্নায়ু পথে কার্যগত অসংগতির ফলে এই উপসর্গগুলি দেখতে পাওয়া যায়।
ডোপামিন সম্প্রেরিত স্নায়ুপথ মূলত পাঁচটি : মেসোলিম্বিক, মেসোকর্টিকাল, নিগ্রোস্ট্রায়াটাল, টিব্যুলো-ইন্ফান্ডিব্যুলার ও থ্যালামিক। এরমধ্যে প্রথম দুটির অতিক্রিয়তা ও অবক্রিয়তার ফলে উপরে বলা ইতি ও নেতিধর্মী উপসর্গগুলি দেখতে পাওয়া যায়।
প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সে পাঁচটি গ্লুটামেট সম্প্রেরিত স্নায়ুপথ রয়েছে : কর্টিকো-ব্রেনস্টেম, কর্টিকো-স্ট্রায়াটাল, থ্যালামো-কর্টিকাল, কর্টিকো-থ্যালামিক, ও কর্টিকো-কর্টিকাল গ্লুটামেট পথ। এগুলির অতিক্রিয়তায় সাইকোসিসের উত্তেজনা-প্রধান উপসর্গ দেখা দেয়।
এনএমডিএ (NMDA) গ্রাহক প্রোটিনকে ফেনসাইক্লিডিন জাতীয় ওষুধের প্রভাবে অবরোধ করা হলে স্কিজোফ্রেনিয়ার অনেক ইতিধর্মী উপসর্গ অবদমিত হয়। ধারণা করা হচ্ছে যে এই এনএমডিএ গ্রাহক প্রোটিন সাইকোসিসের ক্ষেত্রে কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট। আগেই আলোচিত হয়েছে যে কর্টিকোস্টেরয়েড ও থাইরয়েড হরমোনের তারতম্যে কিছু কিছু মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়। গ্রোথ হরমোন ও প্রোল্যাক্টিনেরও অনুরূপ কিছু ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়।
এই আলোচনা থেকে একটি সাধারণ বিষয় উঠে এল যে মানসিক অসুস্থতা, মনোরোগ বা মানসিক ভাবের পরিবর্তন কোনোটাই আধিদৈবিক, আধিভৌতিক নয়; বরং নিতান্তই ভৌত-রাসায়নিক (Physicochemical)। অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিনের কম ক্ষরণ কোশস্তরে ইনসুলিন গ্রাহক প্রোটিনের গোলযোগে যেমন ডায়াবিটিস রোগ হয়; এপিনেফ্রিন, অ্যাল্ডোস্টেরন, অ্যাঞ্জিওটেনসিন ইত্যাদি কিছু রসের তরতমতার বা বৃক্কের, ধমনী-দেওয়ালের কিছু অসুবিধায় যেমন উচ্চ রক্তচাপ হতে দেখা যায়, তেমনি শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশের গাঠনিক সমস্যায় ও/বা নির্দিষ্ট স্নায়ুপথের কার্যগত অসংগতিতে ও/বা কিছু দেহরসের তারতম্যের কারণে মনোরোগ হতে পারে।
এটাই মনোরোগের শারীরবৃত্তীয় ভিত্তির মূল কথা। ব্লাডপ্রেসার, সুগার, থাইরয়েডের রোগ, হার্ট, কিডনি বা ফুসফুসের রোগের মতোই মনোরোগের ক্ষেত্রেও অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কার বা পাড়াপড়শির ভুল পরামর্শে প্রভাবিত না হয়ে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করাই সঙ্গত। এটিই হোক এই নিবন্ধের ‘টেক হোম মেসেজ’। শেষ করি কবির কথায় :
আমায় ছ’জনায় মিলে
পথ দেখায় বলে
বারেবারে পথ ভুলি হে।
পাদটীকা :
১৮৪৮ সালের কথা। ভার্মন্টতে রেলপথ তৈরির কাজে ব্যস্ত ফিনিয়াস গেজ। পাথরের ভেতর ফুটো করে বারুদে আগুন দিয়ে বড়ো বড়ো পাথর ভাঙার কাজ। প্রায় এক মিটার লম্বা ৬ কেজি ওজনের একটা টাম্পিং রড নিয়ে পাথরে বারুদ বাঁধছে। বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে বারুদের স্তূপের উপর বালি দিতে ভুলে গেল। সোজা বারুদের উপর রড দিয়ে একটা ঘা দিতেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারদিক কেঁপে উঠল। রডটা গেজের গালের হাড় ভেঙে মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। ফিনিয়াস বেঁচে থাকে। স্থানীয় ডাক্তারের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসায় ক্ষত শুকোয়। পরীক্ষা নিরীক্ষায় এও দেখা গেল যে স্মৃতি, বোধবুদ্ধি ঠিকই আছে। গেজ সুস্থ হয়ে কাজে ফিরতে চায়। কিছুদিন পর গেজ হঠাৎ সংজ্ঞাহীন হয়। ডাক্তারেরা ভাবেন এই হয়তো শেষ। দশ দিন ঘোরের মধ্যে থাকার পর গেজের জ্ঞান ফেরে। কিন্তু একটা মিরাকেল ঘটে যায়। এই দুর্ঘটনার ১২ বছর পর ১৮৬০-এ বারবার এপিলেকটিক সিজারের পর তার মৃত্যু হয়। এর মধ্যে অনেকেই তার ব্যক্তিত্ব ও আচরণের কিছু পরিবর্তন লক্ষ করে। যেমন, কেউ তার ইচ্ছা বিরোধী কোনও উপদেশ দিলে গেজ তা নিতে পারত না। কোনও কাজে মন স্থির করার পর কাজটা সম্পূর্ণ করার জন্য সে খাটত ঠিকই, কিন্তু সব ঠিক হওয়ার পরেও হঠাৎ সবকিছু থেকে সরে আসত। বলা হয় তার আগের মার্জিত স্বভাব চলে গিয়েছিল। সেই জায়গায় এক অভদ্র, কটুভাষী স্বভাবের গেজকে লোকে দেখতে পায়। এই কারণে তাকে চাকরিতে বহাল রাখা যায়নি। তার ডাক্তার জন হার্লো মনে করেছেন, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় তার আচরণের এই ধরনের পরিবর্তন এসেছিল। তাই মানসিক গঠন তথা আচরণ পরিবর্তনের পেছনে যে-রকম মস্তিষ্কের সামনের অংশের ভূমিকা কতটা সুনির্দিষ্ট, গেজের ঘটনাটি তার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।