দাম্পত্যে টানাপোড়েন

অমিত চক্রবর্তী

মনের মিল থেকে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম ভালোবাসা আর তারই পরিণতি ঘটে বিয়ের মধ্যে দিয়ে। আবার উল্টোটাও ঘটে, যখন বিয়ের পর তৈরি হয় বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা, তবে সে ক্ষেত্রেও মনের মিল হওয়াটা জরুরি। মনের তাল মিল কেটে গেলে বন্ধুত্বের চিড় ধরে। ভালোবাসার রং ফিকে হতে থাকে, টানাপোড়েন শুরু হয় দাম্পত্য সম্পর্কে। যথা সময়ে সম্পর্কের মেরামতি হয় না বলে তা অনেক সময় ভেঙে যায়। পরিসংখ্যান বলে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও বিবাহ বিচ্ছেদের হার ভয়ংকর ভাবে বেড়ে চলেছে এবং এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েছে স্বামী-স্ত্রী- সন্তান-পরিবার ও সমাজের ওপর।  

দাম্পত্যের সমস্যা গুলিকে বুঝতে হলে দাম্পত্যের শুরুটা একবার দেখে নেওয়া দরকার। নারী-পুরুষের ভালোবাসা, যার সম্ভাব্য পরিণতি হল বিয়ে তার চেহারাটাও নানান রকম। সমাজ মনোবিদরা এ যাবৎ প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিয়ে যেসব সমীক্ষা চালিয়েছেন, তাতে ভালোবাসার ছটি ধরনকে চেনা গেছে।  প্রতি তিন জোড়া প্রেমিক প্রেমিকার একজন পরস্পরের প্রেমে পড়েন। এই ধরনের ভালোবাসার শুরু থেকেই পরস্পরের প্রতি তীব্র আকর্ষণ লক্ষণীয়। ভালোবাসার দ্বিতীয় ধরনটা প্রযোজ্য তাদের ক্ষেত্রে, যারা বন্ধুত্ব থেকে একে অপরের সঙ্গে কখন যে ভালোবাসায় জড়িয়ে গেছেন, নিজেরাই তা ঠিক করে বলতে পারেন না। যাবতীয় প্রেমিক প্রেমিকার দুই-তৃতীয়াংশ এই ধরনের ভালোবাসার কথাই সাধারণত বলে থাকেন এবং এদের প্রায় সকলেই বিয়ের ব্যাপারে কোনো দোটানায় ভোগেন না। সংখ্যায় কম হলেও, বেশকিছু মানুষ ভালোবাসাকে অনেকটা খেলার মতই মনে করেন। একই সঙ্গে এরা একাধিক সম্পর্ক চালিয়ে যান এবং কাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করবেন তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কিছু মানুষ আবার ভালোবাসা বলতে সম্পূর্ণ নির্ভরতাকেই বোঝেন। নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে এরা একেবারে আঁকড়ে ধরেন অন্য কারো সঙ্গে তার বন্ধুত্ব আত্মীয়তাও এরা সহ্য করতে পারেন না। যথেষ্ট হিসেব-নিকেশ করে ভালোবাসায় জড়ান বেশ কিছু মানুষ। ভালোবাসার সম্পর্কটা সুবিধাজনক না হলে এরা বেশিদূর এগোন না। সম্বন্ধ করে বিয়ের সঙ্গে এই ধরনের ভালোবাসায় বেশ মিল পাওয়া যায়। এদের ঠিক বিপরীতে আছেন অল্প কিছু মানুষ, যারা নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে পারেন,ভালবাসার জন্য প্রভূত ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন। এই ধরনের ভালোবাসা প্রায়শই বিয়ে অবধি পৌঁছোয় না।

ভালোবাসার দুটো ধরন; যেখানে স্বামী স্ত্রীর একজন প্রেমটাকে একরকম খেলা বলেই মনে করেন, প্রেমের দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে চলেন — তেমন ভালোবাসা সাধারণত দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরায়। একই ঘটনা ঘটে যখন কোনও দম্পতির একজন অন্যের ক্ষেত্রে পজেসিভ আচরণ করেন। অমূলক সন্দেহ যে কত প্রেমের মৃত্যু ঘটায়, বিবাহ-বিচ্ছেদ ডেকে আনে তার বলার অপেক্ষা রাখে না। 

দুজন মানুষ পরস্পরের প্রেমে পড়বে কিনা তা সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে তাদের চারিত্রিক মিলের ওপর। তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থায় ফারাক থাকলে প্রেম তো দূর অস্ত, এমন কি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠাও মুশকিল। 

যে তিনটি মূল স্তম্ভের উপর প্রেম-ভালোবাসা দাঁড়িয়ে থাকে, তার প্রথমটা অবশ্যই ‘প্যাশন’ যার অর্থ আসক্তি ও আবেগ, যৌন আকর্ষণও যার একটা বড় অঙ্গ। এরপর আসে পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এবং নৈকট্য। ‘আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড’ — কথাটা একেবারে ভুল নয়। পরস্পরের কাছাকাছি থাকতে পারলে ভালোবাসা শক্তপোক্ত হয়। ভালোবাসার সব শেষ এবং সবচেয়ে জরুরি স্তম্ভ হল — দায়বদ্ধতা। ভালোবাসার প্রধান অর্থই হলো আরেকজনের দায়িত্ব নেওয়া। যে কোনো ভালোবাসার সম্পর্কে একে অপরের দায়িত্ব নেবার বিষয়টা থাকে। বিয়ে করার পর ভালবাসার মানুষটির দায়িত্ব কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেললে ভালোবাসা মরে যায়। বিয়েটাও আর অনেক সময় টেকে না।

যে ভালোবাসার মধ্যে শুধুই প্যাশন, যাকে বলা হয় ‘ইনফ্যাচুয়েশন’ — তার পরিণতিতে যদি দুজনের মধ্যে বিয়ে হয়, প্যাশন ফিকে হয়ে এলে সেই বিয়ে টেকানো মুশকিল হয়। যে দাম্পত্যে প্যাশন নেই, দুজন পাশাপাশি থেকে স্রেফ সংসার করা, ছেলে মেয়ে মানুষ করা, — সেই সম্পর্ক টিকে থাকলেও স্বামী স্ত্রী যে তাতে সুখে থাকেন, তা নয়। প্যাশনের সঙ্গে যখন ইন্টিমেসি বা অন্তরঙ্গতা যুক্ত হয় দুজন পরস্পরের প্রতি যখন আকর্ষণ বোধ করেন এবং সেই সঙ্গে পরস্পরের কাছে থাকার সুযোগ হয় — তাদের মধ্যে যেটা গড়ে ওঠে তা হলো ‘রোমান্টিক ভালোবাসা’। একমাত্র দায়বদ্ধতা থেকেই যে সম্পর্ক টিকে থাকে, যেমন যে স্বামী বছরের পর বছর বিদেশে থাকেন, স্ত্রী ও সংসারের প্রতি যার কোনও আগ্রহ নেই, তবে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য টাকা পাঠিয়ে যান — তাদের দাম্পত্যে শূন্যতাই বড়, ভালোবাসার বিশেষ কোনো জায়গায় থাকে না। যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক প্যাশন অন্তরঙ্গতা এবং দায়বদ্ধতা এই তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকে — সেই দাম্পত্যে সাধারণত কখনোই বড়সড় চিড় ধরে না।প্রধানত মনের মিল থেকেই দুজন মানুষ বৈবাহিক সম্পর্কের দিকে এগোয়। মনের মিল বলতে আচার-আচরণ চিন্তাভাবনা এবং সামাজিক অবস্থানের মিল। একজন মানুষকে একবার ভালো লাগতে শুরু করলে তার মধ্যেকার অমিল গুলিকে অন্যজন যে উপেক্ষা করবে সেটাই স্বাভাবিক। একেবারে নিজের মনের মতো মানুষ পাওয়া যায় না বলেই প্রেমিক বা প্রেমিকার অপছন্দের দিকগুলোকে নজরের বাইরে পাঠিয়ে তাকে মনের মতো করে নেওয়ার প্রবণতা সবার মধ্যেই দেখা যায়। খনার কথা, বিয়ের পর একসঙ্গে ঘর করার সময় সেই অমিল গুলোই প্রকাণ্ড আকার নিয়ে ভালোবাসার মানুষটির প্রতি  বিতৃষ্ণা জাগায়। বিয়ের আগে তার সঙ্গে যে মিলগুলো চোখে আসতো সেগুলোর কথা আর মনেই পড়ে না।

সম্বন্ধের বিয়ে 

স্কুল-কলেজ-কোচিং ক্লাস-ফেসবুক — এসবের সূত্রে বহু মানুষের জীবনে প্রেম প্রণয় ঘটলেও আমাদের মতো  ট্রাডিশনাল সমাজে এখনও সম্বন্ধ করেই বিয়ে হয় সিংহভাগ মানুষের। যারা অন্তর্মুখী, যারা লাজুক, যারা রক্ষণশীল সমাজে বড় হয়, তারা সহপাঠী বা বন্ধু কাউকে ভালো লাগলেও সেই ভালো লাগা বা পছন্দের কথাটা তাকে জানিয়ে উঠতে পারে না। বহির্মুখী ছেলেমেয়েরা যেহেতু অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারে এবং চট করে মনের কথা জানিয়ে দিতেও দ্বিধা করে না। তাই অন্তর্মুখীদের তুলনায় ওরাই এই প্রেমে পড়ে বেশি। তাছাড়া স্কুল-কলেজের অপরিণতমনস্ক ছেলেমেয়েরা অনেকেই পরিবেশের চাপে দীর্ঘ সময় ধরে প্রেমকে টিকিয়ে রাখতে পারে না তাদেরও শেষমেষ বিয়ের জন্য ঘটকের শরণাপন্ন হতে হয়।

এ যুগে অবশ্য ঘটকের ব্যাপারটা প্রায় অচল। এদের জায়গা নিয়েছে খবরের কাগজের পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন,  ম্যারেজব্যুরো আর সব ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইট। পাত্রপাত্রীর মধ্যে যোগাযোগ ঘটাতে সোশ্যাল সাইটগুলি ও কার্যকরী, যদিও তাতে পরিবারের অন্য সদস্যদের তেমন উপস্থিতি থাকে না।

সম্বন্ধের বিয়েতে পরিবারের ভূমিকা বড়, কারণ প্রাথমিক পছন্দের কাজটা সারতে হয় তাদেরই। এরপর পাত্র-পাত্রীর পরস্পরকে দেখা এবং পছন্দ হলে মেলামেশা করা। এই মেলামেশা কতটা হবে সেটাও নির্ভর করে পাত্র-পাত্রীর পরিবারের ওপর। অধিকাংশ রক্ষণশীল পরিবার এখনো বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদের একান্তে মেলামেশার বিরোধী ফোনে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের মধ্যে দিয়েই এদের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ। চাকরির প্রয়োজনে ছেলেমেয়েদের অনেককেই পরস্পরের থেকে অনেক দূরে থাকতে হয়। নামমাত্র চাক্ষুষ দেখা এবং স্রেফ মোবাইল এর মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে এখন হাজার হাজার পাত্র পাত্রী বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ে। ফলে বিয়ের পর একসঙ্গে থাকতে গিয়ে অনেকেরই যে পরস্পরের প্রতি মোহভঙ্গ হবে তাতে আর আশ্চর্য কি? 

বিয়ের আগে মেলামেশা করার বেশ খানিকটা সুযোগ পেলেই একে অপরকে খুব ভালো করে চিনে নেওয়া যাবে, এমন নয়। বেশ কয়েক বছর চুটিয়ে প্রেম করার পরও বিয়ের পর কত মানুষেরই মনে হয় বিয়ের আগে অন্য মানুষটাকে চিনতে ভুল হয়েছিল। স্বল্পপরিচয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে নিজের স্বরূপ অন্যের কাছে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। যাকে আমরা জয় করতে চাই তার কাছে নিজের মন্দ স্বভাবের দিকগুলো লুকিয়ে রেখে ভালো গুণগুলোকে মেলে ধরাই স্বাভাবিক।  বিয়ের পর পড়াশুনো গান-বাজনা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা স্বাধীনতা দেওয়ার অঙ্গীকার করে বিয়ের পর সেগুলোকে যখন বেমালুম অস্বীকার করা হয়, দাম্পত্যের কফিনে পেরেক  ঠোকা শুরু হয়ে যায় তখনই।    

আবার বিয়ের আগে মেলামেশার সময় অন্যজনকে একবার মনে ধরে গেলে তার দোষ গুলো চোখ এড়িয়ে যায়। নিতান্তই তা না হলে, ধরে নেওয়া যায়, বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে! সম্বন্ধ করার সময় দুটো পরিবারের মধ্যে অনেক সময় মনোমালিন্য হয়, অথবা পাত্র-পাত্রী একজনের আচরণে অন্যজন কষ্ট পায়, ক্ষুব্ধ হয় এবং বিয়ে ভাঙার অবস্থা হয়। শেষমেশ জোড়াতালি দিয়ে যদি বিয়েটা লাগিয়ে দেওয়া হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার পরিণতি সুখের হয় না। অনেককেই বলতে শুনি ‘বিয়ের ঠিক আগেই মনে হয়েছিল এই বিয়েটা সুখের হবে না, কিন্তু তখন তো আর উপায় নেই —  কার্ড ছাপা হয়ে গেছে, বিয়ে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে, আত্মীয়-স্বজনরা অনেকে জেনে গেছে — তখন মনে হল বিয়েটা হয়েই যাক’। এই ধরনের বিয়ে শেষ পর্যন্ত যে টিকবে এমন সম্ভাবনা কম।

যাদের সহ্য ক্ষমতা বেশি, বিয়ের পর তাদের সমস্যা হয় কম। সহ্য ক্ষমতা যাদের কম, যারা অহংকার আর স্পর্শকাতরতায় ভোগে, অন্যের সমালোচনা করা যাদের স্বভাব এবং অন্যের কাছে প্রচুর প্রত্যাশা থাকে, বিয়ের ব্যাপারে তাদের সাবধানতা নেওয়া উচিত অনেক বেশি। বিয়ের পর ডিভোর্সের তুলনায় বিয়ের আগে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া যে মন্দের ভালো সেটা যারা বোঝে, আখেরে লাভ হয় তাদেরই।

বিয়ে ভাঙে কেন?

কথায় বলে এক ছাতের তলায় না এলে কোনও মানুষের স্বরূপ ধরা পড়ে না।  সম্বন্ধের বিয়ে — যেখানে পুরুষ নারীর চেনা জানাটাই সীমিত, তার কথা বাদ দিলাম। দীর্ঘদিনের প্রণয় থেকে যে পরিণয় — তাও তো সবসময় সুখের হয় না। বিয়ের আগে যে মানুষটাকে মনে হতো খুব রোমান্টিক, প্রেমিক বা প্রেমিকার প্রতি যার যত্ন ছিল অসীম, বিয়ের পর একা ঘরে সেই মানুষটাই একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়। প্রেম করার সময় যে মানুষটাকে সবচেয়ে কাছের বলে মনে হত — ঘর করার সময় সেই মানুষটাই যখন ভয়ংকর হয়ে ওঠে তখন যে অন্যজনের মোহ ভাঙবে, তাদের সম্পর্কে যে চিড় ধরবে তার আর সন্দেহ কি। বিয়ের পর স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি চাহিদা যদি হঠাৎ করে বহুগুণ বেড়ে যায়, তবেও সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা দেখা দেয়।

পুরুষ নারীর মানসিকতায় যেসব পার্থক্য চিরকালীন, অনেক সময় তা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নারী সাধারণত পুরুষের এমন মনোযোগ চায় যার ধরনটা রোমান্টিক। অন্যদিকে পুরুষের কাছে নারীর শারীরিক আকর্ষণটা বড়। পরস্পরের কাছে স্বামী স্ত্রীর চাহিদার এই ফারাকটাই অনেক সময় সম্পর্কে ফাটল ধরায়। বিয়ের পর স্বামীরা যখন আরও বেশি করে পুরুষ এবং স্ত্রীরা যখন আরও বেশি করে নারী হয়ে ওঠে, তখন সংঘাত বাধাটাই স্বাভাবিক।

সম্পর্ক ভাঙার ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভাব বিনিময় এবং মতামত আদায় প্রদানের ব্যর্থতা একটা বড় কারণ। যে কোনও দুজন মানুষ যখন একে অপরের কথা বুঝতে পারেন না, মানতে চান না, তখনই শুরু হয় তর্ক এবং ঝগড়া।ঝগড়া থেকে কথা বন্ধ, ফলে সম্পর্কের আরও অবনতি।  স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক এর ব্যতিক্রম নয়। শুধু মুখের কথাই নয়, শরীরের অঙ্গভঙ্গি এবং আবেগের ভাষা থেকে মনের কথা বোঝার ক্ষমতা যদি একজনের কম থাকে তবে অন্যজনকে কষ্ট পেতে হয়। ভাব বিনিময়ের অভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ব্যবধান যদি বেড়েই চলে, তবে পারস্পরিক টান আর ভালোবাসাও উবে যেতে থাকে। প্রসঙ্গত নারীর তুলনায় পুরুষের মধ্যে অন্যের আবেগের ভাষা মনের ভাব বোঝার ক্ষমতা কম থাকে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাই স্বামীকে দায়ী করা চলে।

শ্বশুর বাড়ি-বাপের বাড়ি

মেয়েকে বিয়ের পর স্বামীর হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়। মেয়েদের প্রতি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের এই বিধান চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। বাপের বাড়ির স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে শ্বশুরবাড়ির নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়াটা বড় সহজ নয়। আমাদের মতো পরিবার প্রধান সমাজে পারিবারিক প্রতিকূলতা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরানোর অন্যতম প্রধান কারণ। কারোর মনোবল ভেঙে দেবার সবচেয়ে ভালো উপায়,  ক্রমাগত তার সমালোচনা করে যাওয়া,  তার সামান্য ভুল ত্রুটিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো, হাজার চেষ্টাতেও যে তাকে শোধরানো সম্ভব নয় তা বারবার করে তাকে মনে করিয়ে দেওয়া। অন্য পরিবারের একটি মেয়ে নিজেদের পরিবারের বউ হয়ে এলে অনেক ক্ষেত্রে শাশুড়ি এবং ননদরা এই কাজটাই খুব সুচারুভাবে করে থাকেন। তাদের ভাবটা এমন — এত কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করেছি, কিংবা ছোটবেলা থেকে দাদা বা ভাইয়ের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছি আর অন্য বাড়ির একটা অচেনা মেয়ে এসে দুদিনেই তাকে দখল করে নেবে? এই ভাবনাটাই নতুন বউয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের বিপন্ন করে তোলে। প্রেম-ভালোবাসার বিয়েতে যদি ছেলের বাড়ির লোকেরা খুশি না হয়, তবে মেয়ের কপালে দুর্ভোগের পাল্লা ভারী হয়।

পুরুষশাসিত সমাজে আজও অনেক জায়গায় মেয়েদের যেহেতু ‘বোঝা’ হিসেবে দেখাটাই রেওয়াজ তাই বাবা-মায়েরাও মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ করতে গিয়ে ছেলেটি এবং তার পরিবার সম্পর্কে যথেষ্ট খোঁজখবর করেন না। আবার ছেলেটির শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং চাকরি বা রোজগার যদি আকর্ষণীয় হয়, তার বা তার পরিবারের নেগেটিভ দিকগুলোকে উপেক্ষা করা হয়ে থাকে। সম্বন্ধ করে বিয়েতে এখনও বহু পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের পরস্পরের সঙ্গে একান্তে মেলামেশার সুযোগ দেন না। ফলে বিয়ের পর সম্পূর্ণ অচেনা দুটি মানুষের পরস্পরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। প্রত্যেকটা পরিবারের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম নীতি থাকে সেই নিয়ম নীতির প্রতি আনুগত্যের ফলেই পরিবারের নতুন সদস্যটিকে সেগুলি মানতে বাধ্য করা হয়। নতুন বউটি যদি সেগুলি অনুসরণ করার চেষ্টা না করে নিজের বাপের বাড়ির নিয়ম-নীতির প্রতি নিষ্ঠা দেখায়, তাহলে শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে তার যে সংঘাত বাধবে তা বলাই বাহুল্য। সেই সংঘাতের সময় সে যদি তার স্বামীকে পাশে না পায়, তবে দুজনের মধ্যে ব্যবধান তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কত স্ত্রী যে তার স্বামীর প্রতি অভিমানে সারা জীবন দূরে সরে থাকেন তার হিসেব হয় না।

মায়ের বাছা 

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ সন্তানের জন্ম দেয় যে মা — নারী হয়েও পরিবারে-সমাজে তার দাম বাড়ে; যার জন্য এই গৌরব প্রাপ্তি, সেই ছেলের প্রতি মায়ের অবচেতনে যে কৃতজ্ঞতা জন্ম নেয় — তা থেকে ছেলের প্রতি অস্বাভাবিক টান, তাকে আঁকড়ে ধরা — আগলে রাখার মানসিকতা তৈরি হয়। মায়ের প্রতি শিশুর যে জন্মগত নির্ভরতা, তাতে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। মেয়ের তুলনায় ছেলেরা মাকে আঁকড়ে ধরে অনেক বেশি। বড় হওয়ার সাথে সাথে মায়ের প্রতি এই মনোযোগ অনেকের ক্ষেত্রে কমে না। পরিণত বয়সেও বহু পুরুষ তার মায়ের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে থাকে, মায়ের সঙ্গে কোনও রকম বিচ্ছেদ মেনে নিতে চায় না। জন্মের পর যেন নাড়িকাটা হয় না এদের। মাকে কাছে পেলেই পরম স্বাচ্ছন্দ্য, একমাত্র মাই তাকে ঠিকমত বুঝতে পারে, যাবতীয় বিপদে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে — এমন মনোভাব অনেক পুরুষের মধ্যেই থেকে যায় আজীবন।

শাশুড়ি বৌমার বৈরিতা চিরকালীন। সমাজে একজন পুরুষের উপর অধিকার কায়েম নিয়ে দুই নারীর দ্বন্দ্ব বুঝতে গেলে মনস্তত্ত্বের পণ্ডিত না হলেও চলে। ছেলের বিয়ের পর কোনও মা যদি নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন, যদি মনে করেন —  নতুন  আগন্তুকের জন্য সংসারে তার দাম কমে যাবে, নিজের ছেলেকে আর আগের মতো করে কাছে পাবেন না — তবে সেই নিরাপত্তাহীনতা তার মনে বৌমার প্রতি আগ্রাসী মনোভাব জাগাতে পারে। তার সে আগাসী মনোভাব তখন ফুটে ওঠে সমালোচনার মধ্যে।  সংসারে আসা নতুন মেয়েটির চালচলন-আচার ব্যবহার নিয়ে কটূক্তি ঝড় বয়ে যায় এবং মেয়েটির আঘাত বাড়ানোর জন্যই তার বাবা মাকে সমালোচনার হাত থেকে রেহাই দেওয়া হয় না; অবশ্য সব বৌমাই যে মুখ বুঝে অত্যাচার সহ্য করবে এমন কথা নেই। শাশুড়ি-বৌমার যখন লড়াই বাঁধে, তখন নিজের স্বামীও যদি শাশুড়ির দিকে যোগ দেয় — বিয়ে ভাঙ্গার ঘন্টা বেজে যায় তখনই। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে এসে যেসব মেয়ের মনে হয় — শ্বশুর-শাশুড়ি ননদ স্বামীর চক্রব্যূহে তার যেন ঢোকার অধিকার নেই — তাদের মধ্যে হতাশা জাগারই কথা। সেই হতাশাই শেষ পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে।

এর বিপরীত ঘটনাও যে একেবারে ঘটে না, তা নয়। বাবা-মায়ের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত টান থেকে শ্বশুরবাড়ির মানুষজনের সঙ্গে নতুন বউয়ের সম্পৃক্ত হওয়ায় অনীহা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। বাপের বাড়ির আদব-কায়দা শ্বশুরবাড়িতে চালু করতে গিয়ে অথবা বাপের বাড়ির মাহাত্ম্য প্রচার করার ফলে শ্বশুরবাড়িতে সংঘাত বাধে। কথায় কথায় বাপের বাড়ি চলে যাওয়া, দরকারে দরকারে বাপের বাড়িতে দিনের পর দিন থেকে যাওয়া — এ থেকেও স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য জন্মায়।

সমীক্ষায় দেখা গেছে যেসব নারী তাদের স্বামীকে তেমনভাবে কাছে পাননি, শ্বশুরবাড়িতে অপমানিত-অসম্মানিত হওয়ার সময় স্বামীকে পাশে পাননি, তাদের মধ্যে সহমর্মিতা দেখেননি — তারা বেশি করে নিজের ছেলেকে আঁকড়ে ধরেন। এতে মায়ের প্রতি ছেলের যে প্রবল আনুগত্য জন্মায়, তার ফলে তার নিজের স্ত্রী ও তার ভালোবাসা সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে সেই স্ত্রীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, এবং মা ও ছেলের পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে থাকার প্রবণতা চলতেই থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। পড়াশোনা ছাড়া কাজের জন্য দূরে থাকতে হলেও ছেলের উপর মায়ের কর্তৃত্ব যে কমে, তা নয়। ফলে ছেলে ও ছেলের বউ দূরে থাকলেই যে তারা নিজেদের মতো করে ভালো থাকতে পারে তা বলা যায় না।

শরীর মনের চাহিদা

নারী-পুরুষ তাদের বিশেষ কতকগুলি চাহিদা পূরণের জন্যই বিয়ের বাঁধনকে মেনে নেয়। ভালোবাসা এবং জোট বাধার চাহিদা দুজনের মধ্যে থাকলেও আরও এমন কিছু চাহিদা থাকে যা নারী পুরুষের আলাদা। সাধারণভাবে নারীর মধ্যে রোমান্সের চাহিদা এবং পুরুষের মধ্যে যৌন চাহিদা থাকে বেশি। এক্ষেত্রে পরস্পরের চাহিদা মেটাতে না পারলে মানসিক টানাপোড়েন শুরু হয়। পুরুষদের অনেকেই বিয়ের পর স্ত্রীকে যথেষ্ট সময় দেন না। এর পেছনে কাজের চাপ যে থাকে না তা নয়, তবে অনেক সময়, ‘বিয়েটা তো হয়েই গেছে, নাগালের মধ্যে যে মানুষটাকে সব সময় পাচ্ছি তাকে গান কবিতা শোনানোর কিংবা তার সঙ্গে কানে কানে কথা বলাটা এখন নেহাতই আদিখ্যেতা!’ — এমন চিন্তাও স্বামীর মনে আসে। আবার শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে বহু মেয়ের মধ্যে অজানা ভয় এবং অনীহা থাকে। বিয়ের পর এটাকে অনেকে এড়িয়ে চলতে চায়, অথবা সন্তানজন্মের পর শারীরিক সম্পর্কটাকে বাহুল্য বলে মনে করে অনেক মেয়েই। দুক্ষেত্রেই,  তার যে দোসর তাকে অতৃপ্তির মধ্যে দিন কাটাতে হয়। আবার ঠিক এর উল্টোটাও যে একেবারে ঘটে না, তা নয় সেক্ষেত্রে  স্বামীর হয়তো শারীরিক চাহিদা কম, বিছানায় অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে থাকা স্বামীর পাশে নিজেকে বড় অবহেলিত অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মনে হতে পারে অনেক স্ত্রীর। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ডিভোর্সের পয়লা নম্বর কারণ হিসেবে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরকে ঘিরে শারীরিক অতৃপ্তিকেই ধরা হয়ে থাকে।

সমীক্ষায় দেখা গেছে স্বামীর কাছে স্ত্রীর যে চাহিদাগুলি প্রধান, তা হল স্বামী যেন তাকে প্রতিদিন ভালোবাসার কথা বলেন, তার ভুলগুলো ক্ষমা করেন, ঘর গেরস্থালি এবং শিশু পালনের ক্ষেত্রে খানিকটা অন্তত দায়িত্ব নেন, মাঝে মাঝে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান, ‘না’-এর বদলে ‘হ্যাঁ’-টা বেশি বলেন, তার কথা মন দিয়ে শোনেন, তার প্রতি স্নেহ এবং উদারতা দেখান এবং সবশেষে নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখেন। শেষ  চাহিদাটার পিছনে নারীর নিরাপত্তার অভাববোধ কাজ করে। স্বামীদের নেশা কিংবা অতিরিক্ত পরিশ্রমের বিরুদ্ধে স্ত্রীরা যে ক্রমাগত অনুযোগ করে সেটা এই কারণেই।

স্ত্রীর কাছে স্বামীর চাহিদাগুলি আবার একটু অন্যরকম। যেমন স্বামী চান স্ত্রী যেন তার ক্ষমতার ওপর সবসময় আস্থা রাখেন, তার সুবিধে অসুবিধে বোঝেন, স্বামীর কৃতিত্ব সাফল্যগুলিকে স্বীকৃতি দেন, তাকে নিঃশর্তে গ্রহণ করেন, বাড়ি ফিরলেই যেন অভিযোগের ঝাঁপি খুলে না বসেন, তার প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা দেখান, সংসারের কাজ এবং ছেলে মেয়ের দেখাশোনার মধ্যেও স্বামীর জন্য খানিকটা সময় খানিকটা ফাঁকা সময় বের করেন, তাকে যেন অবিশ্বাস না করেন এবং তাকে সঙ্গ দেন।

যেসব স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের এই চাহিদাগুলোকে চিনে নিতে পারেন এবং সেগুলি পূরণের চেষ্টা করেন, একে অন্যকে দাম দেন, একে অন্যের সমালোচনার বদলে প্রশংসা বেশি করেন — সাময়িক মন কষাকষি সত্ত্বেও তারা দাম্পত্য সুখ থেকে কখনো বঞ্চিত হন না।

দাম্পত্য যৌনতা, বহুগামিতা

প্রাণীজগতের নিয়মে, খিদে-তেষ্টা-ঘুমের মতোই সেক্স বা যৌনতা একটা প্রাথমিক চাহিদা যা না মিটলে মানুষের চলে না। এখনো পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কাছে, বিশেষ করে প্রাচীন ধ্যান ধারণা-রীতিনীতিতে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর কাছে যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য বিয়েটাই একমাত্র উপায়।

যৌন চাহিদার রকম সকম পুরুষ নারীর ক্ষেত্রে এক নয়। সেক্স-এর জন্য পুরুষরা ব্যাকুল হয়, অপেক্ষা করতে পারে না। যে-কোনও সময় যে কোনও জায়গায় যৌন সম্পর্ক ঘটাতে তাদের অসুবিধা হয় না। পুরুষের মস্তিষ্কে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যার দরুন একটা কোনও কাজ এবং সেই সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তা থেকে অন্য একটা কাজ এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ভাবনাচিন্তাকে সে একদম আলাদা করে রাখতে পারে। একটু আগেই যে মানুষটা বসে টিভিতে খবর দেখছিল, একটু পরে খেতে বসে তার  মাথা থেকে সেটা বেমালুম উধাও। নারীর ক্ষেত্রে এটা হয় না বলেই সন্ধ্যেবেলায় স্বামীর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি কান্নাকাটি হলে রাত্রে শোবার পর সেটাকে মাথা থেকে একদম সরিয়ে সে যৌন সম্পর্কে আগ্রহী হতে পারে না। অফিসে সহকর্মীর সঙ্গে রাগারাগি, বাড়ি ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি-কথা বন্ধের পরও পুরুষ তার স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিকভাবে মিলিত হবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতে পারে। বেডরুমের বাইরে স্বামীর আচার-আচরণে অনেক সময়ই সেক্সের প্রতি স্ত্রী-রা বিরূপ হয়।

সাংসারিক দায়িত্ব বেশি থাকার দরুন অনেক সময় ব্যস্ততা এবং ক্লান্তির ফলে স্ত্রীরা স্বামীর সঙ্গে শারীরিক মিলনে আগ্রহ বোধ করে না। যেসব নারীর কাছে সন্তানের গুরুত্ব খুব বেশি, সন্তানকে ছেড়ে তার স্বামীর কাছে যেতে ইচ্ছে জাগে না। পুরুষরা সাধারণত যৌনতার বিষয়ে বেশি আগ্রহী হয় বলেই তাদের স্ত্রী বা সঙ্গিনীর শারীরিক গঠন এবং সৌন্দর্যের ব্যাপারে বেশি সচেতন থাকে। পুরুষ সেক্স নিয়ে অনেক বেশি চিন্তা করলেও, আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও নারীর শারীরিক গঠন এবং বিশেষ ধরনের হরমোনের নিঃসরণ দীর্ঘ সময় ধরে বারে বারে তাকে যৌনতৃপ্তির দিকে এগিয়ে দেয়। সেক্স বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রোজমেরি বেসনের মতে, মেয়েদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে যৌন সম্পর্কের জন্য এগিয়ে যাবার ঘটনা কম ঘটে। পুরুষ যখন যৌন মিলনের সূচনা করে তার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়েই নারী সেই মিলনের পথে এগোয়। মজার কথা, মিলনের পরপরই পুরুষ ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে গেলেও নারী তার সমস্ত সত্তা দিয়ে যৌন সুখ উপভোগ করতেই থাকে বেশ খানিকটা সময় ধরে।

নারীর শরীর নিয়ে পুরুষের আগ্রহের কথা জানা থাকে বলেই, শারীরিক সম্পর্কের সময় নারীদের অনেকেই নিজের শরীর নিয়ে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে পড়ে। ‘আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি’, ‘আমার চামড়ায় ভাঁজ পড়ছে’, ‘আমাকে বোধহয় ওরা তেমন ভালো লাগে না’ — এইসব অহেতুক চিন্তা অনেক সময় শারীরিক সম্পর্কে বড়ো রকম বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

সেক্স নিয়ে গত পাঁচ দশকের গবেষণা প্রমাণ করেছে, যেসব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনের এবং মতের মিল থাকে, যারা একে অপরের উপর নির্ভরশীল, যারা যে-কোনও সমস্যাকে দুজনেরই সমস্যা বলে মনে করে এবং নিজেদের মনের ভাব প্রকাশে অনিচ্ছা দেখায় না — শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তারা পুরোপুরি সফল হয়। যৌনচাহিদা মেটানোর সময় স্বামী স্ত্রী যদি পরস্পরের পরিপূরক না হয় তবে তাদের মধ্যে যে অতৃপ্তি দেখা দেয় তার সরাসরি প্রভাব পড়ে তাদের দৈনন্দিন সম্পর্কে। শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দূরত্বের কারণেই সাংসারিক অশান্তি শুরু হয় এবং সম্পর্কে ভাঙন ধরে।

এবারে আসি বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কথায়। হাজার হাজার বছর ধরে ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানটি মানুষের কাছে জীবনভোর এক বিশেষ জনের প্রতি ভালোবাসা এবং যৌনতার দিক থেকে একনিষ্ঠ থাকার যে চ্যালেঞ্জ রেখেছে সফলভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি অনেকের পক্ষেই। এর ফলেই লক্ষ লক্ষ সংসার ভেঙেছে, অগণিত মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে, অসংখ্য যুদ্ধবিগ্রহ ঘটেছে এবং সামাজিক পট পরিবর্তন হয়েছে। সেদিক থেকে দেখলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দুর্ভিক্ষ অর্থনৈতিক মন্দার চেয়েও মানুষের জীবনে পুরুষ নারীর ভালোবাসা-যৌন সম্পর্কে টানাপোড়েনের প্রভাব যে অনেক বেশি পড়েছে, তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।

সাধারণভাবে আমাদের ধারণা যারা একগামিতাকে অনুসরণ করে না, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে নিজেদের জড়ায়, তারা বুঝি খুব স্বার্থপর, অনৈতিক,  নিজের ছেলেমেয়েদের কথা ভাবে না, শুধুমাত্র সেক্সের জন্যই অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক করে— সব সময় সেটা ঠিক নাও হতে পারে। যিনি মনে করেন একই সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে ২০-৩০ বছর ধরে যৌন সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়াটা রীতিমতো একঘেয়ে, অথবা স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ না করেও তাকে আজীবন ভালোবেসে যাওয়া যায়, তার ধারণাকেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

একগামিতায় বিশ্বাসী হয়েও অনেকে আবার মনে করেন জীবনে যথার্থ সঙ্গী বা সঙ্গিনী না পাওয়ার কারণেই তাদের দ্বিগামিতা অথবা বহুগামিতার পথে হাঁটতে হয়েছে। অনেকে আবার মনে করেন সংসার এবং ছেলে মেয়ের স্বার্থে জুড়ে থেকে, তাদের স্বার্থে আঘাত না করে, অন্য কারোর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোটা তেমন দোষের নয়। কোনও দম্পতি যৌথভাবে এটা মানতে না পারলে অবশ্য সম্পর্ক এবং সংসারে ভাঙন ধরে।

বহুগামিতার বিপদ অনেক। যেহেতু সমাজ-পরিবার বহুগামিতাকে স্বীকার করে না, স্বামী বা স্ত্রীর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক পরিবারের অন্য সব সদস্যের কাছে মানসিক চাপ এবং অস্থিরতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা দাম্পত্য জীবনকে অবিশ্বাস এবং অশান্তিতে যেমন ভরিয়ে দেয়, তেমনি ছেলেমেয়েদের মধ্যেও অসহায়তা এবং অপরাধবোধের জন্ম দেয়। গত কয়েক দশকের সমীক্ষায় দেখা গেছে জীবনে কখনো না কখনো বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ। এক্ষেত্রে পুরুষের সংখ্যা মহিলাদের তুলনায় এখনো অনেক বেশি। অন্যদিকে প্রতি পাঁচটি দম্পতির একটির জীবন কাটে কোনরকম যৌন সম্পর্ক ছাড়াই। হেলেন ফিসার নামে এক নৃতাত্ত্বিক দেখিয়েছেন — গোটা দুনিয়াতেই এখন বিয়ের চার-পাঁচ বছরের মধ্যে বিচ্ছেদের পথে এগোন এক তৃতীয়াংশ  থেকে অর্ধেক সংখ্যক দম্পতি। সন্তানের প্রাথমিক শৈশব কেটে যাবার পর স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে থাকার প্রয়োজনটা অনেক কমে আসে বলেই একে অপরকে ছেড়ে যাওয়াটা অনায়াস হয়।

এখন থেকে ১০০ বছর পিছিয়ে গেলে দেখব তখনও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে মানুষ জড়িয়ে পড়ত, টাকা দিয়ে যৌন সুখ কেনার ঢালাও বন্দোবস্ত ছিল। পুরুষ বাইরে কাজ করে অর্থের ব্যবস্থা করবে, নারী ঘর সামলাবে এবং ছেলেমেয়েদের বড় করে তুলবে, যৌনচাহিদা দেখানোর অধিকার শুধু পুরুষের এবং নারীর কর্তব্য সেই চাহিদা মেটানো — মোটামুটি এই ব্যবস্থায় চলতো দাম্পত্য জীবন। সেখানে মেয়েদের যৌনতৃপ্তির কথা ভাবাই হত না এবং স্ত্রী তার স্বামীকে তৃপ্তি না দিতে পারলে অন্য নারীর কাছ থেকে সেটা নেওয়াটা স্বামীর জন্য দোষের ছিল না। এখনকার সময়টা অনেকটাই আলাদা। শিক্ষা ও কাজের সুযোগ পেয়ে দুনিয়া জুড়ে মেয়েদের বড় অংশই এখন আর্থিকভাবে স্বনির্ভর, ঘরের কাজ এবং সন্তানের লালন পালনের দায় থেকে সে অনেকটাই মুক্ত; পুরুষ এবং নারীর অধিকারের ফারাক আজ ক্রমেই কমছে। যৌনতা নিয়ে নিজেদের ভাবনা-চিন্তা এবং চাহিদা জানানোর ক্ষেত্রেও মেয়েরা আর পিছিয়ে থাকছে না। পরিবার সংকুচিত হবার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের উপর পারিবারিক সামাজিক চাপও কমছে। ইন্টারনেটের যুগে পর্নোগ্রাফি এখন সর্বক্ষণ হাতের মুঠোয়। সোশ্যাল মিডিয়া আর ডেটিং অ্যাপের কল্যাণে অন্যের শারীরিক সান্নিধ্য এখন শুধু চাওয়ার অপেক্ষা। এইসব ঘটনা পুরুষ নারীর পারস্পরিক সম্পর্কের সমীকরণ ক্রমেই পাল্টে দিচ্ছে। স্বামী স্ত্রী দুজনের ক্ষেত্রেই বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা যে দ্রুত বাড়ছে, সেটাই আসলে চিন্তার বিষয়।

নেশার কামড় 

বিয়ের সম্পর্ক ভাঙার ব্যাপারে নেশাও অনেক সময় প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রেমিকের সিগারেট খাওয়া বা অল্পস্বল্প মদ্যপানের মধ্যে অনেক মেয়েই তেমন আপত্তির কারণ খুঁজে পায় না, বিয়ের পর সেটাই আবার অসহ্য হয়ে ওঠে। বন্ধুদের হাত ধরে যে নেশার সূত্রপাত, বিয়ের পর সাংসারিক অশান্তি বাড়লে অথবা কর্মক্ষেত্রে প্রতিকূল অবস্থায় পড়লে স্রেফ টেনশন এড়াতে বহু লোক সেই নেশার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আনন্দের চট জলদি উপায় হিসেবে মদ এবং মাদকের নেশাকে বেছে নেয় দুর্বল মনের মানুষরা। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে লিভার-হার্ট-ব্লাড প্রেসারের সমস্যার পাশাপাশি এফিলিপসির মতো ফিট, প্রলাপ বা ডিলিরিয়াম, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিশক্তি লোপ, হ্যালুসিনেশন এবং ক্রমবিকার বা ডিলিশন দেখা দিতে পারে। নেশায় আসক্ত মানুষের কাছে নেশা ছাড়া জীবনের বাকি সমস্ত কিছুই যেহেতু অর্থহীন, ঝগড়াঝাঁটি অশান্তি করেও তাই বিশেষ লাভ হয় না। নেশা যেহেতু আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনে, নেশায় আসক্ত স্বামীর ওপর স্ত্রী কোনোভাবেই আর নির্ভর করতে পারেন না। ছেলে মেয়েদের মুখ চেয়ে সংসারটাকে বাঁচানোর জন্য — স্ত্রীরা যে স্বামীর নেশা কাটানোর চেষ্টা করেন না তা নয়। মদ এবং মাদকের নেশা ছাড়াতে হলে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে হাসপাতাল বা ডি-অ্যাডিকশন সেন্টারে রেখেই তা করতে হয়। নেশার জিনিসের ওপর শারীরিক নির্ভরতা কাটাতে এটা করা জরুরি। তবে স্বামীর মধ্যে নেশা থেকে নিষ্কৃতি পাবার আকাঙ্ক্ষা না জাগলে ডি অ্যাডিকশন এ পাঠিয়েও লাভ হয় না। মাসের পর মাস রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে রেখে কাউন্সিলিং করানোর পরও শতকরা ৮৫ জন ১৫ দিন থেকে তিন মাসের মধ্যে নেশার জগতে ফিরে যান। এমন এক পরিস্থিতিতে স্বাবলম্বী মেয়েরা স্বামীকে ছেড়ে যাওয়া ছাড়া বেঁচে থাকার অন্য কোনও পথ খুঁজে পান না।

টেনশন এবং সন্দেহ থেকে বিপর্যয়

স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে একজন অথবা দুজনেই যদি উৎকণ্ঠা প্রবণ হন তবে সবসময় যে তারা বিপদের আশঙ্কায় ভুগবেন তাতে আর সন্দেহ কি বিপদটা অনেক সময় মনগড়া বাস্তবে যার হয়তো অস্তিত্ব নেই ছোটবেলায় যারা খুব কড়া শাসনে বড় হয়, যাদের সব সময় অন্যের ওপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়, তারাই পরবর্তীকালে কথায় কথায় টেনশনে ভুগতে থাকে। স্বামী যদি উৎকণ্ঠাপ্রবণ হন, তবে স্ত্রী বাড়ির বাইরে একা ঘোরাফেরা করলেই তিনি টেনশনে ভুগবেন, স্ত্রীর ক্ষমতায় আস্থা রাখবেন না, তাকে নিজস্ব কোনও স্পেস দেবেন না। আবার স্ত্রী যদি উৎকণ্ঠাপ্রবণ হন, বাড়ির বাইরে স্বামীর যাবতীয় গতিবিধির ওপর নজর রাখার চেষ্টা করেন, দিনের মধ্যে বহুবার ফোন করেন, বাড়ির বাইরে অন্য কারো সঙ্গে মেলামেশা বরদাস্ত করেন না। বিয়ের আগে প্রেম করার সময় যে টেনশন কে কেয়ার বা যত্ন নেওয়া বলে মনে হতো, বিয়ের পর তা যেন গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়ায়।

টেনশন থেকে অনেক সময় সন্দেহ জন্ম নেয়। স্বামী অথবা স্ত্রীর মধ্যে একজন সন্দেহপ্রবণ হলে বিবাহিত জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। দুজনের মধ্যে একজন যদি হীনম্মন্যতায় ভোগেন, অন্যজন পাছে তাকে ছেড়ে চলে যান এই ভেবে তিনি ক্রমাগত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারেন। এই কারণেই অন্যজনের উপর সবসময় নজরদারি, তার অনুপস্থিতিতে মোবাইল ঘাটাঘাটি চলতে থাকে।

ধরা যাক, বিয়ের আগে কোনও একটি ছেলের অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এবং সেই মেয়েটি হয়তো কোনও কারণে সেই সম্পর্কে ইতি ঘটায়। বিয়ের পর নতুন বউয়ের সঙ্গে আলাপ জমানোর সময় যদি সে জানতে পারে যে তার বউয়েরও বিয়ের আগে ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, তবে তার মনে বউয়ের চরিত্র নিয়ে সন্দেহ জাগতে পারে। আবার অনেকের মধ্যেই একটা ধারণা আছে, কারো সঙ্গে প্রেম বা বিয়ে হলে তাকে অতীতের সমস্ত গোপন কথা জানাতে হবে। স্বামী বা স্ত্রী যদি দুর্বল মনের মানুষ হন তবে তার পক্ষে পার্টনারের অতীত প্রেমকে মেনে নেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। তার দোসর পাছে তার প্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে পুরনো সম্পর্কে  ফিরে  যান এই আশঙ্কা তাকে অস্থির করে তুলতে পারে। তার স্ত্রী বা স্বামী তাকে যতই বোঝাক যে আগের সম্পর্কটা স্রেফ ভালোলাগা ছাড়া প্রেমজাতীয় কিছু ছিল না, তাহলেও সন্দেহবাতিক মন তা কিছুতেই মেনে নেয় না। সন্দেহের বিষ যে কত ভালোবাসাকে মেরে ফেলে, কত দাম্পত্য বিচ্ছেদ ঘটায় তার ইয়ত্তা নেই!

দাম্পত্য সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী ও মজবুত রাখতে হলে স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের প্রতি দায়বদ্ধতা যেমন জরুরি, তেমনি সেই সম্পর্কে পারস্পরিক টান বা ভালোবাসা থাকাটাও খুব দরকার। দুজনের মধ্যে একজন যদি রাগী, জেদি এবং উদ্ধত স্বভাবের হন, তবে তার কর্তৃত্ব করার মনোভাব অন্যজনকে প্রতিনিয়ত আঘাত দেয়। পুরুষ শাসিত সমাজে স্ত্রীর প্রতি প্রভুত্ব ফলানো কিংবা তাকে নিয়ন্ত্রণ করার মনোভাবকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া হয়। আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে স্ত্রী যদি স্বামীর কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন, স্বামীর শারীরিক এবং অন্যসব চাহিদা মেটাতে অসম্মত হন — দুজনের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। যেসব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক খারাপ তারা যদি ভাবেন সন্তান জন্মালেই তাদের সব সমস্যা মিটে যাবে — সেটা সব সময় সত্যি নাও হতে পারে। বাবা-মায়ের বিরোধের মধ্যে বড় হতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা যে কত রকমের মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয় তা বলে শেষ করা যায় না।

কৈশোর যৌবনে দুজন মানুষের প্রেমে পড়ার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নেই। প্রেম যথা নিয়মে একসময় দুজনকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেয়। বিয়ের পর সারা জীবন ধরে একসঙ্গে পথ চলতে গিয়ে পরস্পরের প্রতি প্রেম ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখাটাই আসল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ যারা সফলভাবে সামলাতে পারেন, তাদের জীবনে চলার পথ কখনও তার মসৃণতা হারায় না, সাংসারিক ঝামেলাগুলির মোকাবিলা করা সহজ হয় আর সন্তান মানুষ করতে তাদের বাড়তি কোনও উদ্যোগ নিতে হয় না।

স্বামী-স্ত্রীর ডিভোর্সের হার কমাতে রিনিউবেল অর্থাৎ পুনর্নবীকরণযোগ্য বিয়ের চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছেন কেউ কেউ। বিয়ে মানেই সারা জীবনের জন্য গাঁটছড়া বাধার ধারণা এতে বন্ধ হতে পারে। প্রতি পাঁচ বা দশ বছর অন্তর অন্তর ড্রাইভিং লাইসেন্স বা পাসপোর্ট এর মতো বিয়ের চুক্তিকেও রিনিউ করার বন্দোবস্ত থাকলে, স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ইচ্ছেমতো ব্যবহারের সুযোগ পাবেন না। এতে পরস্পরকে সমীহ করা, পরস্পরের সঙ্গে মানিয়ে চলার সম্ভাবনা হয়তো বাড়বে। তবে তাতে তাদের ভালোবাসা বিনিময়ের অঙ্গীকার এবং দাম্পত্য সুখ যে টিকে থাকবেই এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।

দাম্পত্য সুখ : কিছু টিপস

 ১. সফল দম্পতিরা নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেশন কখনোই বন্ধ করে দেন না, কথা বন্ধ করে গুম মেরে থাকেন না। পরস্পরকে তারা দোষারোপ করেন না, কথায় কথায় একে অন্যের ভুল ধরেন না, নিজের কথা বলার চেয়ে অন্য জনের কথা শোনেন বেশি। 

২. স্বামী যদি অন্যের কাছে নিজের স্ত্রী-র প্রশংসা করেন এবং স্ত্রী যদি স্বামীর ক্ষমতার প্রতি আস্থা দেখান, তবে তাদের সম্পর্ক জোরদার হয়। 

৩. যখনই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়, তা সেটা পারিবারিক, অর্থনৈতিক অথবা ছেলে মেয়ে সংক্রান্ত যাই হোক না কেন, সমস্যার কারণ নিয়ে রাগারাগি-ঝগড়াঝাঁটির বদলে কী করলে তার সমাধান হবে সেটা নিয়ে আলোচনাই বুদ্ধিমানের কাজ। 

৪. অতীতের অপ্রিয় ঘটনা ভুলে যাওয়াটাও শ্রেয়। স্বামী-স্ত্রীর আলোচনায় অতীতকে টেনে না-আনাটাই মঙ্গল।

৫. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতবিরোধ হলে তা ছেলে-মেয়ে এবং পরিবার বা বাইরের কোনও মানুষের কাছ থেকে আড়াল করাটাই বাঞ্ছনীয়। 

৬. স্বামী-স্ত্রী যে পরস্পরকে ভালোবাসেন, সেটা একে অপরকে বোঝানোটা খুব জরুরি। যে স্বামী কোনও উপলক্ষ্য ছাড়াই নানা রকম উপহার দেন এবং যে স্ত্রী স্বামীর প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের ওপরে রাখেন, পরস্পরকে নিয়ে তাদের মধ্যে কখনোই অতৃপ্তি দানা বাঁধে না।

৭. সুখী দম্পতিরা সাধারণভাবে তাদের ছেলে মেয়ের উপর খুব বেশি জোর খাটান না, আবার অবহেলাও করেন না। এই ধরনের বাবারা সাধারণত ছেলেমেয়েদের তাদের মাকে ভালবাসতে শেখান এবং মায়েরা সেখানে তাদের বাবাকে শ্রদ্ধা করতে। 

৮. দাম্পত্যে সুখী হতে হলে সংসারের দায়িত্বগুলো যথাসম্ভব সমান ভাগে ভাগ করে নিতে হয়। একজন তার দায়িত্ব পালনে সাময়িকভাবে অসমর্থ হলে অন্যজন সেই দায়িত্ব ভাগ করে নেন। স্ত্রীর যদি শরীরটা ভালো না থাকে, স্বামী রান্না আর ঘর গোছানোর কাজটা যেমন সামলান, তেমনি স্বামীর আর্থিক সংকটের সময় স্ত্রী সংসারের প্রয়োজনে টিউশনি অথবা পার্ট টাইম কাজ নেন। 

৯. সুখী দম্পতিরা আজীবন রোমান্টিক থাকেন এবং শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে নিজের চেয়ে অন্যজনের চাহিদাকে বেশি গুরুত্ব দেন।

১০. সাংসারিক এবং অর্থনৈতিক যাবতীয় বিষয়ে পরস্পরের মতামতকে গুরুত্ব দিলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরে না। দুজনেই যদি রোজগেরে হন, তবে তারা সাংসারিক খরচে কে কোনটার দায়িত্ব নেবেন সেটা প্রথমেই নিষ্পত্তি করে নিলে অনর্থক মন-কষাকষি এড়ানো যায়।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান