ধর্ষকের মন

রুমঝুম ভট্টাচার্য্য

হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশিত ‘হোয়াই মেন রেপ?’ নামের বইতে লেখিকা তারা কৌশল একটি ভারি চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। তিনি নয় জন ধর্ষকের ইন্টারভিউ করেন। তারা নিজেও শিশু বয়সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তিনি দেখলেন এই নয় জনের কেউ-ই যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীর সম্মতির বিষয়টাকে স্বীকার করে না। এদের মধ্যে একজন বহুবার ধর্ষণ করেছে এবং তার মতে ধর্ষণ বলে কিছু হয় না। তবে কি ধর্ষণের সংজ্ঞায় বিশ্বাস করে না অধিকাংশ ভারতীয় ধর্ষক পুরুষ? কৌশল জানিয়েছেন ক্ষণিক যৌন সুখের পূর্তি, নারীর তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস, নারীকে ভোগ্য পণ্য মনে করা, বা প্রতিহিংসার কারণে পুরুষ ধর্ষণ করে। ভারতে অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে ভালো (চরিত্রের) মেয়েরা ধর্ষিত হন না। মেয়েদের পোশাক আশাক, তাদের গতিবিধি নির্ধারণ করে সে ধর্ষিত হবে কি না। গত বিশ বছরে মনোবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা ধর্ষণের মতো অপরাধ কেন ঘটে তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে একটা সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন সেটা হল— ধর্ষণ শুধুমাত্র যৌন ইচ্ছার পূর্তি নয়, ধর্ষণ আসলে তার থেকেও আরও অনেক বেশি কিছু। তাই যদি হয় তবে প্রশ্ন ওঠে শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে তবে এর মধ্যে কোন কারণ কাজ করছে? স্বল্প পোশাক? অশালীন ভাব-ভঙ্গি? অনিয়ন্ত্রিত গতিবিধি? কিংবা মেয়েদের যৌন সম্পর্কে সম্মত না-হওয়া আসলে তার সম্মতিরই লক্ষণ গোছের মানসিকতা? বিদ্বেষ? হিংসা? নয় মাসের শিশু যখন ধর্ষিতা হয় তখন এই সব কারণ বা অকারণ যাই বলা যাক না কেন সব কেমন গুলিয়ে যায়।

যে কোনও মানুষের মনস্তত্ত্ব বিচার করতে গেলে আগে জানা প্রয়োজন আমাদের মন কীভাবে কাজ করে এবং কী কী উপাদান সেখানে গুরুত্বপূর্ণ। একটা বরফের চাঙড় যখন জলে ভাসে তখন তার অধিকাংশ অংশই জলের নীচে ডুবে থাকে আর অল্প খানিক জলের ওপর ভেসে থাকা অংশ আমরা দেখতে পাই। মানুষের মনস্তত্ত্বের ক্ষেত্রে এই উপমা যথার্থ। ভেসে থাকা বরফের যে অংশটুকু চোখে দেখা যায় তা আসলে আমাদের আচরণ। বরফের যে অংশ জলের নীচে ডুবে আছে সেই বেশির ভাগ অংশ আসলে আমাদের আচরণের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা চলমান শক্তিসমূহের এক বিরাট, বিচিত্র গতিশীল জগৎ। সেখানে সর্বদা গতিশীল আমাদের চিন্তা, ভাবনা, বিশ্বাস, লব্ধ অভিজ্ঞতা, আবেগ, ইচ্ছা, অনিচ্ছা, প্রেষণা, আমাদের চাহিদা, কাম, মোহ ইত্যাদি। বলা চলে সেই গতিশীল শক্তিসমূহ আমাদের মনকে চালনা করে চলেছে অহর্নিশি। ঠিক সেই রকমই সামাজিক পরিমণ্ডল এবং ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক অবস্থা, তার আর্থ-সামাজিক অবস্থান, রক্তে বয়ে চলা বংশের ধারা, ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য — সবের ঘাত-প্রতিঘাত আচরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা পালন করে। তাই ধর্ষকের মন বিচার করতে বসে শুধু মনটুকু বেছে নিয়ে বিচার করা আর আকাশের তারা গোনা প্রায় সমান দুরূহ কাজ। 

দীর্ঘ তিন দশকের গবেষণা থেকে জানা যায় যে কোনও ধরনের যৌন হিংসা বা ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষকের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধর্ষকের মানসিকতা বোঝার জন্য সেই বিষয়গুলো সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা সেরে নেওয়া যাক। 

স্নায়ুজাত জৈব কারণ 

মস্তিষ্কের জৈব ত্রুটির কারণে ধর্ষণের মতো হিংস্র আচরণ ঘটতে পারে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন আমাদের মস্তিষ্কের যে অংশে হিংস্রতা নিয়ন্ত্রণ হয় সেই অংশই যৌন উত্তেজনার জন্য দায়ী। কাজেই কৈশোরে যখন যৌন উত্তেজনা বাড়তে থাকে তখন অনেক সময় তার জন্য হিংস্র আচরণের প্রবণতাও অনেক মানুষের মধ্যে বাড়ে। কৈশোরে বিকাশের ধর্ম অনুযায়ী এই দুই উত্তেজনার পার্থক্য বুঝতে শেখা জরুরি ও আবশ্যক। কিন্তু কোনও কারণে বিকাশের এই স্তরে সেই শেখা অসম্পূর্ণ থেকে গেলে হিংস্রতা ও যৌনতার মধ্যের সীমারেখা মুছে গিয়ে দুই যেন এক হয়ে যায়। এমনকি গবেষণায় দেখা গেছে যারা ধর্ষকাম মানসিকতার ধর্ষক তাদের মস্তিষ্কের টেম্পোরাল হর্ন-এ কিছু অস্বাভাবিকতা পাওয়া গেছে কিংবা দেখা গেছে অনেক ধর্ষকের মাথায় আঘাত লাগার ইতিহাসও আছে। 

মনোরোগজনিত কারণ 

কিছু কিছু মনোরোগে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে সামাজিক বিধিনিষেধ আছে তা শিথিল হয়ে পড়ে এবং যৌন আচরণেরও অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায়। যেমন বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ম্যানিক এপিসোডে বা যারা হাইপো ম্যানিয়া বা ম্যানিয়াক তারা যৌন উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সুইডেনের এক গবেষণায়  দেখা গেছে পাঁচশো তিপান্ন জন রেপিস্টের মধ্যে ৯.৩% মাদকাসক্ত, ২.৬% পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত, ১.৭% সাইকোসিস রোগী। তবে এই তথ্যের ভিত্তিতে একথা বলা যায় না মানসিক রোগী মানেই সে রেপিস্ট, যেমন বলা যায় না সিজোফ্রেনিয়া রোগী মানেই খুনী। 

ধর্ষণ কোনও মানসিক অসুখ নয়।

ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাস 

দেখা গেছে ধর্ষক পুরুষ প্রায়শই তার আচরণের স্বপক্ষে যে-সব যুক্তি দেয় সে-সব যুক্তির গোড়ায় গলদ। বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাস তার মনে গেড়ে বসে আছে। সেগুলোর কয়েকটা আলোচনা করলে বোঝা যাবে, পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক পরিমণ্ডল একজন মানুষের মনে কতটা কুপ্রভাব ফেলতে পারে। ধর্ষণের মতো আচরণের পেছনে এই সব ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাস প্রেষণারূপী চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে। কেমন সেই সব ধারণা বা বিশ্বাস? তারা মনে করে — 

১। বৈশিষ্ট্যে ও শারীরিক গড়নে নারী পুরুষের থেকে আলাদা। কাজেই স্ত্রী চরিত্র দুরূহ। তাকে জানা পুরুষের কর্ম নয়। কাজেই নারীর সঙ্গে সম্পর্ক মানেই তাতে বাধা বিঘ্ন আসবেই। নারী তার শারীরিক চাহিদার কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না, তাই পুরুষকেই দায়িত্ব নিয়ে তার মনের কথা বুঝে নিতে হয়। সে কী চায় তা বুঝে নেওয়া যাবে কীভাবে? কেন মেয়েটা ছোটো স্কার্ট পড়েছে, ওই তো ওর বুকের খাঁজ দেখা যাচ্ছে। এই তো যথেষ্ট। তার মানেই তো মেয়েটা আসলে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে চাইছে। কাজেই ধর্ষক পুরুষটি বুঝে নেয় যৌন মিলনের জন্য তাকে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। মেয়েটি আপত্তি জানায়। কিন্তু পুরুষটি বিশ্বাস করে মেয়েদের ‘না’ মানে আসলে ‘হ্যাঁ’।

২। নারী আসলে ভোগ্য বস্তু। নারী জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হল পুরুষকে যৌন সুখ দেওয়া। নারী সে কথা সব সময়ে বোঝে না। কাজেই তার আপত্তি থাকলেও পুরুষ জোর করে যৌন সুখ আদায় করতেই পারে। এতে শারীরিক ভাবে কোনও ক্ষতি হয় না। ধর্ষণ কখনোই মারধোরের মতো নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে না। 

৩। পুরুষের যৌন তাড়না অপ্রতিরোধ্য। কাজেই নারী যদি সেই যৌন তাড়না তৃপ্ত করতে সহায়তা না-করতে চায় তবে পুরুষ হওয়ার সুবাদে তার ধর্ষণ করায় কোনও বাধা নেই। 

৪। বিয়ে করা বউ মানে তার সঙ্গে যৌন মিলনের ক্ষেত্রে তার সম্মতির প্রয়োজন নেই। স্বামী হওয়ার সুবাদে পুরুষের ইচ্ছাই শেষ কথা। 

ধর্ষকের প্রকারভেদ 

ধর্ষকের মন নিয়ে আলোচনার এই পর্যায়ে এসে বোঝা যায়, জৈব রাসায়নিক কারণগুলোর প্রভাব সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলোর তুলনায় কিছুটা কম। গবেষকরা দেখেছেন ধর্ষকেরও আচরণের প্রকারভেদ আছে। প্রকারভেদ অনুযায়ী তাদের মানসিকতাও আলাদা হয়। যেমন কিছু ধর্ষক সুযোগ সন্ধানী হয়। তারা পরিস্থিতি বুঝে ধর্ষণ করে। যেমন, নিরালা রাস্তা বা বেশি রাতের নির্জনতা, বাড়িতে একা আছে কোনও মহিলা — এমন পরিস্থিতিতে সেই মূহূর্তে তার মধ্যে যৌন তাড়না কাজ করে এবং পরিস্থিতির আনুকূল্যের জন্য সেই তাড়নার তৎক্ষণাৎ পূর্তিতে উদ্যত হয়। এই ধর্ষক পুরুষ পরিকল্পনা করে অপরাধ করে না, পরিস্থিতি অনুযায়ী মূহূর্তের দুর্বলতায় কাজ সারে। এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের নির্যাতন করে, কারণ সুযোগ পেলে শিশুদের ভয় দেখিয়ে বা কাউকে জানালে বিরাট ক্ষতি করে দেবে এই হুমকি দিয়ে দিনের পর দিন অপরাধ করে চলে। আবার কিছু ধর্ষক কোনও কারণে মনের ভেতর কোনও বিশেষ নারী সম্বন্ধে বা সাধারণভাবে মেয়েদের সম্বন্ধে ঘৃনা বা রাগ পুষে রেখেছে, সেই রাগ থেকেও ধর্ষণে উদ্যত হয় এবং এরা সচরাচর ধর্ষণের সঙ্গে বিচিত্র হিংসাত্মক আচরণ করে থাকে, যেমন — রড পুরে দেওয়া ইত্যাদি। আর এক ধরনের ধর্ষক যারা দিনের অধিকাংশ সময় বিভিন্ন যৌন কল্পনায় মগ্ন থাকে এবং যৌন তাড়না অনুভব করে। এরা প্যারাফিলিক এবং এদের চিহ্নিত করে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। স্যাডিস্ট যারা তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা কাজ করে এবং অন্যের ওপর অত্যাচার করে তারা যৌন সুখ উপভোগ করে, তাদের মনে হয় মহিলার ওপর অত্যাচার করে সে তার পৌরুষ বা জোর প্রকাশ করতে পারবে। 

দ্য আনডিটেকটেড রেপিস্ট    

তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রকারভেদেও ধর্ষকের ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। এ তো গেল যারা ধর্ষক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে তাদের কথা, কিন্তু যারা অধরাই থেকে গেছে এমন ধর্ষকরা কী ভাবে তাদের অপরাধ নিয়ে? আপনারা চমকাবেন। সে আবার কেমন ব্যাপার? তারা তো ধরাই পড়েনি তাহলে তাদের মনের কথা কেমন করেই বা জানা যাবে? 

১৯৭৬ সালে লস এঞ্জেলেসের বিভিন্ন সংবাদপত্রে একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। বিজ্ঞাপনের বয়ান ছিল এই রকম — ‘আপনি কি ধর্ষক? গবেষক আপনার ইন্টারভিউ নিতে চান। সকাল ন-টার থেকে রাত ন-টার মধ্যে কল করুন এই নম্বরে,…আপনার পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখা হবে।’ বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন স্যামুয়েল ডি স্মিদাইম্যান। তাঁর পিএইচ ডি-র বিষয় ‘দ্য অ্যানডিটেকটেড রেপিস্ট’। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট স্যামুয়েল তো বিজ্ঞাপন দিয়ে অপেক্ষা করছেন আর মনে ভাবছেন একটাও ফোন আসবে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল ফোন বাজল। একবার নয় দু-বার নয়, ফোন বাজল দুশো বার। অনেক লম্বা সেই লিস্টে আছে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, আছে আর্টিস্ট, আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত মানুষ। এহেন পঞ্চাশ জনের ইন্টারভিউয়ের ওপর ভিত্তি করে তিনি লিখে ফেললেন তাঁর গবেষণা পত্র দ্য আনডিটেকটেড রেপিস্ট। আরও বিশ বছরের গবেষণায় উঠে এল অনেক তথ্য। দেখা গেল ধর্ষণ করে ধরা পড়া লোকের তুলনায় সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো ধর্ষকের সংখ্যা অনেক বেশি এবং তাদের মধ্যে বিশেষ কিছু মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। এই ধর্ষকরা জাতি বা ধর্মে আলাদা হতে পারে কিন্তু বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে তাদের বেশ কিছু মিল আছে। এরা খুব কম বয়স থেকে এই আচরণ করতে থাকে। যৌনতার ক্ষেত্রে নারীর সম্মতির গুরুত্ব স্বীকার করে না। এদের মধ্যে অনেকেই মাদক দ্রব্য ব্যবহার করে মহিলাদের ধর্ষণ করেছে। তবে এরা ধর্ষিতার ওপর অতিরিক্ত অত্যাচার করে না। এরা অবস্থার সুযোগ নিয়ে ধর্ষণ করে। বার বার ধর্ষণের প্রবণতা দেখা যায়। অনেক সময় বিভিন্ন মহিলাকে ধর্ষণ করে নিজের পৌরুষের জোর অনুভব করতে চায়। পেডোফিলিয়া থাকলে শিশুদের দেখে যৌন উত্তেজনা অনুভব করে এবং সহজলভ্যতার কারণে বার বার শিশু ধর্ষণ করে।

পুরুষ যখন ধর্ষিত  

দিল্লির এক সিভিল সোসাইটির সার্ভে অনুযায়ী ১৮ শতাংশ পুরুষ কোনও না কোনও সময়ে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে বা জোরের মুখে সঙ্গমে বাধ্য হয়েছে। চমকপ্রদ তথ্য হল এদের ষোলো শতাংশ নারী দ্বারা অত্যাচারিত আর মাত্র দুই শতাংশ পুরুষ দ্বারা অত্যাচারিত। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে শিশুদের মধ্যে ছেলেরাই (৫৭%) মেয়েদের (৪২%) থেকে বেশি যৌন হেনস্থার শিকার হয়। তাহলে নারী যখন ধর্ষণের মতো অপরাধ করে তার মানসিকতা কীভাবে কাজ করে? এ প্রশ্নে হয়তো নারীবাদীরা হই হই করে উঠবেন। অত্যাচারিত পুরুষের তুলনায় অত্যাচারিত নারীর সংখ্যা অনেক বেশি। সে কথা মেনে নিয়েই বলছি আমাদের দেশের আইনে নারীর যে সুরক্ষার কথা ভাবা হয়েছে সেই আইন পুরুষকে ধর্ষক হিসাবেই দেখেছে। পুরুষ যৌন নির্যাতনের শিকার হলে ধর্ষণের মামলা করার কোনও ধারা আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত নেই। তবে কি সেই পুরুষতান্ত্রিক দম্ভই এর কারণ? পুরুষ নারীর দ্বারা ধর্ষিত হবে এমন চিন্তাও বুঝি পৌরুষত্বের অপমান। 

ধর্ষিতার মন 

পুরুষ হোক কি নারী, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলে যে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে একজন মানুষকে যেতে হয় সেই যন্ত্রণার কোনও লিঙ্গ হয় না। তবু যেহেতু পুরুষের তুলনায় ধর্ষিত নারীর সংখ্যা অনেক বেশি তাই ধর্ষিতার মন বিষয়েই আলোকপাত করা ব্যাবহারিক দিক থেকে শ্রেয়। ধর্ষণ পরবর্তী জীবনে আক্রান্ত মানুষটি মানসিক দিক থেকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রেপ ট্রমা সিন্ড্রোম অর্থাৎ কিনা একগুচ্ছ উপসর্গ চিহ্নিত করা হয়েছে। ধর্ষণের পরে পরেই  এবং ঘটনার পরবর্তী সময়ে এই উপসর্গগুলি নারী পুরুষ নির্বিশেষে দেখতে পাওয়া যায়। প্রায়ই উদ্‌বেগের লক্ষণ দেখা যায়, তাছাড়া ঘন ঘন কান্নাকাটি করা, অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল ও সংবেদনশীল হয়ে পড়া, নিজের শরীরকে ঘৃণা করতে শুরু করা — এই সব লক্ষণ দেখা যায়। ঘুম না-হওয়া, অতিরিক্ত ভয়ের এপিসোড, খিদে না-হওয়া, মন মেজাজ খারাপ হয়ে থাকা — এসব খুব স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ করা যায়। মনের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ে বলে অনেক রেপ ভিক্টিম লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে চায় এবং সুইসাইড করার প্রবণতা এদের মধ্যে অনেক গুণে বেড়ে যায়। 

সমাজের রক্তচক্ষু, আর আত্মসম্মান লোপের গ্লানি ধর্ষিতার মনে যেন এক অদ্ভুত অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলে। যেন যে ধর্ষণ করেছে সে দোষী নয়। দোষী সে নিজেই। কারণ তাকেও বার বার বলা হয়েছে মেয়েদের চলন বলন ঠিক না-থাকলে, মেয়ের চরিত্র ঠিক না-থাকলে সেই মেয়েকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়। ধর্ষিতার মনও গড়ে উঠেছে সেই ছাঁচে। কাজেই এমন অঘটন ঘটে গেলে সে ক্রমাগত হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকে। আমাদের দেশে অধিকাংশ ধর্ষণ রিপোর্ট করা হয় না পরিবারের সম্মানহানির ভয়ে। নিকট আত্মীয় দ্বারা ধর্ষিত হলে বংশমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে তার পরিবারের লোকজন তাকে বোঝায়, এই ঘটনার কথা যেন সে কাউকে না বলে। হয়তো সে দেখে সেই লোক তার বাড়িতে আসছে, চা খাচ্ছে বা এক বাড়িতে তার সাথে থাকতে হচ্ছে। তখন তার মানসিক যন্ত্রণা বহু গুণ বেড়ে যায়। শিশু বা কিশোরী মেয়েদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা বেশি ঘটে। 

ধর্ষণ একটা সামাজিক রোগ। এই রোগের নিরাময় করতে হলে অনেক গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে ধর্ষণের মতো আচরণের কারণ। ধর্ষক হয়ে কি কোনও মানুষ জন্মায়? ধর্ষকও একদিন শিশু ছিল। একজন শিশুর ধর্ষক হয়ে ওঠার নেপথ্যে কাহিনি কী? পুরুষ ও নারী পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। দুয়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে সুস্থ সমাজ। শিশু প্রথম থেকে যদি এই শিক্ষা না-পায় তবেই ধর্ষক জন্মায়। শিশু অবস্থায় যৌন হেনস্থার শিকার হলে পরবর্তী কালে তার ধর্ষক হওয়ার প্রবণতা অনেক গুণে বেড়ে যায়। দেশে জনপ্রতিনিধি হুংকার ছাড়ে, ‘প্রতিবাদ করলে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেব।’ যেন পুরুষাঙ্গ থাকলে মেয়েদের আঘাত করতে আর কোনও অস্ত্র লাগবে না। সিনেমার মতো শক্তিশালী গণমাধ্যমে নির্বিবাদে ধর্ষণ চিত্রায়ণ করা হয় যেখানে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে নেমে আসে নারীর ওপর চরম অত্যাচার। শিশুর নির্মল মানসে জোর করে যৌনহিংসার গরল প্রবেশ করানো হয়। সমাজ, সংস্কৃতি মানসিকতায় জন্ম নেয় ধর্ষক। 

তথ্যসূত্র :

https://journals.lww.com/indianjpsychiatry/Fulltext/2013/55030/Mental_health_assessment_of_rape_offenders.6.aspx

https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3777344/

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান