নেহাশ্রী বিশ্বাস
রৈ দুপুরের খাওয়া শেষ করে মায়ের মোবাইলটা হস্তগত করে কুকিং গেমে মনোনিবেশ করেছে। একটা ক্লিকেই সে ইতালি থেকে জার্মানি, আফ্রিকা থেকে আমেরিকা ঘুরে একেবারে ভারতের অন্দরমহলের সুস্বাদু রান্নাগুলো করে ফেলছে চোখের নিমেষে আর কোনো বাধা ছাড়াই একের পর এক লেভেল আপ করে ফেলায় মনে মনে নিজেই নিজেকে বাহবা দিচ্ছে।
কেবল ওই মুঠোফোনের মধ্যে বন্দি থাকলে চলবে! শাক, পাতা কুড়িয়ে ফুল, ফল, মাটি দিয়ে লুচি-তরকারির থালা সাজালে তো বুঝবি রান্নার কত স্বাদ।
খেলায় এতই মশগুল হয়ে ছিল যে কখন রৈ-এর পাশে ওর দিন্না এসে বসেছে ও টেরই পায়নি। দিন্নার কথায় একগাল হেসে গলা জড়িয়ে ধরে বলল, সেই কখন থেকে আমি অপেক্ষা করছি, এতক্ষণে তোমার পান খেয়ে আসার সময় হল?
তোকে যে এখন গল্প বলতে হবে, তাই তো পরীক্ষার আগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম রে, ভালো না-হলে তোর ফোনের বন্ধুদের কাছে আবার মান থাকবে না যে।
থাক থাক অনেক হয়েছে, আর তোমায় এসব অজুহাত দিতে হবে না। এবার তোমার গল্পটা শুরু করো, আজ কিন্তু তোমার ছোটবেলার গ্রামের গল্প বলবে বলেছিলে।
আচ্ছা বেশ তাই ই বলব, ফোনটা রাখ দিকিনি এবার।
রৈ লক্ষী মেয়ের মতো ফোন সরিয়ে একটা বালিশে হেলান দিয়ে দিন্নার গা ঘেঁষে গল্প শুনতে বসল।
তবে আজ তোকে দুগ্গা দিদির গল্প বলি শোন। আমাদের নিশ্চিন্দপুর গ্রামের ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে ছিল দুগ্গাদিদি। লম্বা চুল, বড়ো বড়ো চোখ, ছিপছিপে গড়ন, শ্যামলার মধ্যে ভারী মায়াকারা মুখ ছিল। তোদের মতো তো হাতে এমন ফোন, কম্পিউটার আর এত ধরনের খেলার সরঞ্জাম ছিল না তখন, তবে যাদের টাকা ছিল তাদের বাড়িতে অবশ্য খেলার জন্য মাটির সবজি, রবারের বাঁদর, দম দেওয়া পুতুল এসব পাওয়া যেত; কিন্তু আমাদের মতো বাড়িতে খেলার জন্য খোলা আকাশ, সবুজ ঘাস, গাছপালার হাতছানি, দু-একটা ভাঙা পুতুল আর হাতে কটা কড়ি ছিল। তখন দুগ্গা দিদি এ বাগান ও বাগান ঘুরে ঘুরে কাঁচা আম, আমড়া, নারকেল এসব জোগাড় করে নিয়ে আসত, তারপর তেল-নুন দিয়ে সেই টক আম মেখে খাওয়া হত— তার যে কি অমৃত সমান স্বাদ ছিল তা তুই জানিস না রৈ।
রৈ সাথে সাথে বলে উঠল, জানোতো দিন্না আমাদের স্কুলের সামনেও আম, কুল, আমসির টক মিষ্টি আচার বিক্রি হয়, কিন্তু মা আমাকে কিছুতেই খেতে দেয় না, বলে ওসব খেলে নাকি পেটে ব্যথা করবে।
দিন্না মাথায় হাত বুলিয়ে বলল — আচ্ছা দিদিভাই আমি তোমাকে খাওয়াব, মাঝে মধ্যে একটু-আধটু খেলে কিছু হয় না।
জানিস দিদিভাই, তখন আমরা শীত পরলে বাগানের মিষ্টি রোদে বসে চড়ুইভাতি করতাম।
ওইরকম পিকনিক তো আমরাও করি দিন্না। এইতো সেদিন আমাদের ভূগোল টিউশন-এর স্যার বাস ভাড়া করে ওনার প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে পিকনিকে গেলেন। মিউজিক্যাল চেয়ার, ব্যাডমিন্টন, হিট দা উইকেট কত রকমের কত খেলা হল, ভালো খাওয়া-দাওয়া হল, গান-বাজনা হল; খুব মজা হয়েছিল, খুব ভালো কেটেছিল সময়টা। তারপর জানোতো দিন্না, আমার বান্ধবী জিনার অর্কদীপদা-কে খুব মনে ধরেছিল। সেদিন তো সারাদিন অর্কদীপদা-র পেছন পেছন ঘুরে সব কাজ করছিল আর বাড়ি আসার পর থেকেই সর্বক্ষণ অর্কদীপদা-র প্রোফাইল স্টক করে যাচ্ছে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট-ও পাঠিয়ে দিয়েছে, যদিও দাদা সেটা অ্যাকসেপ্ট করেনি, তাই রোজ আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করে।
তবে আমাদের চড়ুইভাতি তোদের মতো ছিল না। আমরা সবাই চুপিচুপি যে-যার বাড়ি থেকে চাল, তেল, নুন, সবজি এসব জোগাড় করে বাগানে আনতাম।
লুকিয়ে কেন? তোমার মাকে বললেই তো সে সব গুছিয়ে দিয়ে দিত তোমায়, দরকার হলে রান্নাটাও করে দিত, তোমরা একসাথে মিলে মজা করে খাওয়া দাওয়া করতে।
না রে রৈ, তখন আমাদের সবার অভাবের সংসার ছিল। মা নিজে আধপেটা খেয়ে আমাদের দুবেলা খাওয়াত। তখন যদি শোনে আমরা ঘরের চাল, তেল নিয়ে বাইরে হইহুল্লোড় করছি তাহলে আর রক্ষা থাকত না। তবে মা যে একেবারেই টের পেত না তা নয়, রান্নাঘরে ঢুকে ঠিকই বুঝতে পারত জিনিস সরানো হয়েছে, কিন্তু তখন তো হাতেনাতে প্রমাণ নেই, তাই সহজেই অস্বীকার করে এড়িয়ে যেতাম। তারপর কোথা থেকে একটা মাটির হাড়ি জোগাড় করে এনে তাতেই আমাদের রান্না চাপত। সেবার আমার পুতুলের বিয়ের নকল রান্না খাওয়ার পর চড়ুইভাতিতে আমার ওপর দায়িত্ব পরল আসল রান্না করার। সেই প্রথমবার আগুনের সামনে রান্না করতে বসে তো আমার এক অদ্ভুত উত্তেজনা — মিনু কাঠের জোগান দেওয়ার পর টিয়া চাল ধুয়ে এনে দিল, আমি ঐ ছোট্ট হাড়িতে ভাত বসলাম, ভাতের পর সবজি করতে গিয়ে দেখি ওমা, কি কাণ্ড — মশলা আনতেই আমরা ভুলে গেছি; ওদিকে এই সময় মা ঘাট থেকেও ফিরে এসেছে, তাই বাড়ি থেকেও নিয়ে আসার উপায় নেই। শেষে সেই নুন দিয়ে সবজি সেদ্ধই রান্না হল আর ভ্যাবলা কোথা থেকে খুঁজে দুটো পাতিলেবু, চারটে কাঁচালঙ্কা নিয়ে এল, ব্যাস এই দিয়েই আমাদের বনভোজন জমে গেল। সেই গলা ভাত আর সবজি সেদ্ধ লেবু, কাঁচালঙ্কা সহযোগে কলাপাতায় মেখে আমরা অসীম পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেলাম। সে যে কী অপার আনন্দ তা আজও মনে করলে শিহরণ হয়।
আমার তো শুনেই বেশ থ্রিলিং লাগছে দিন্না; তোমরা এত সুন্দরভাবে চড়ুইভাতি করতে, আমারও ইচ্ছা করছে এরকম পিকনিক করতে। তবে আই মাস্ট সে দিন্না, ইউ অল আর ভেরি ট্যালেন্টেড।
না না, আমার তো তোদের এই জেনারেশনকে দেখে ভীষণ ভালো লাগে। এখনকার ‘তোরা’ কত বুঝদার, কত্ত স্মার্ট, পড়া-আবৃত্তি-নাচ-ক্যারাটে একসাথে সবগুলো কি সুন্দর সামলাস। আমাকে এসব দিলে বাপু আমি পারতাম না। সারাদিন বাগানে বাগানে ঘুরে এটা ওটা পেড়ে কুড়িয়ে সময় কাটিয়ে দুপুরের খাওয়ার সময় বাড়ি আসতাম, খাওয়া শেষে মায়ের কাছে বায়না ধরতাম বিকেলে পায়েস বানিয়ে দেওয়ার জন্য — অথচ সেই মায়ের যে সামান্য ভাতটুকু মুখে জোটেনি তা বোঝার ক্ষমতা ছিল না রে আমার।
আচ্ছা দিন্না, তোমাদের গ্রামেও তো বেশ কয়েকদিন ধরে বড়ো করে মেলা হত। তুমিও কি তখন আমার মতো নাগরদোলা চড়া আর হাওয়াই মিঠাই, ঘুগনি খাওয়ার নেশায় মেলায় যেতে?
আরে আমরা তো সারাবছর ধরে ওই চড়ক পুজোর মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। তখন মেলা মানেই সারাদিন হই হই রই রই ভাব, বাবার দেওয়া দু-পয়সা দিয়ে সারা বছরের অপেক্ষারত সন্দেশ, মুড়কি কিনে খাওয়া। তবে সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ ছিল যাত্রাদলের প্রবেশ — গ্রামের সবাই মুখিয়ে থাকত ঐ পালা দেখার জন্য। টিভি, থিয়েটার, সিনেমা এসব তো কিছু ছিল না তখন, তাই বিনোদনের শ্রেষ্ঠ উপাদান ছিল এই পালা, আর এই পালায় গাওয়া গানগুলো আমরা সব শুনে শুনে শিখে নিতাম, তারপর সারাবছর ধরে খেলার সময় ঐ গান গুনগুন করতাম। ছেলে-মেয়ে একসাথে মেশার যেহেতু চল ছিল না, তাই যাত্রা দেখার জন্য মেয়েদের আলাদা বসার জায়গা করা হত। মায়ের সাথে ওখানে বসে খানিকক্ষণ যাত্রা দেখে আবার মায়ের সাথেই ফিরে আসতাম, পুরো যাত্রাপালা দেখার সৌভাগ্য কখনো হয়নি; তবে ভাই ভোর রাতে বাড়ি ফেরার পর ওর থেকে সব গল্প শুনে তারপর ছাড়তাম। আসলে আমাদের সবার ঘুরতে যাওয়া বলতে তো ছিল এ বাগান ও বাগান, চণ্ডীমণ্ডপ, ভ্যাবলাইদের উঠোন আর গ্রামের চড়কপুজোর মেলা। তাই অন্যরকম কিছু শুনতে পেলেই ইচ্ছা হত তার সমস্ত রস আস্বাদন করে নিতে। যেমন রেলগাড়ির গল্প শুনে রেললাইন দেখার খুব স্বাদ জেগেছিল মনে — কিন্তু গ্রামের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তাই মনে মনেই কল্পনার রং-তুলিতে অপূর্ব এক পটভূমির সৃষ্টি করেছিলাম। তবে দুগ্গাদিদি বড়ো সাহসী ছিল, সে অপুর সাথে ছুটেছিল রেললাইন দেখতে, শেষে পথ হারিয়ে অনেকদূর গিয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল আবার। তবু যেন ঐ ছোটো ছোটো চাওয়া-পাওয়ার মুহূর্তগুলোতেই একরাশ আনন্দ লুকিয়ে ছিল, যার সবটা গোগ্রাসে চেটে-পুটে নিতাম।
তোমাদের অপেক্ষা দীর্ঘ ছিল, খুশি তোমরা অল্পেতেই হতে দিন্না। আমার তো কদিন পর পরই বাইরের খাওয়ার না খেলে, মা-বাবা রেস্টুরেন্টে না-নিয়ে গেলে মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়, ভালোই লাগে না কিছু। আর তিতিরটা তো হয়েছে সিনেমার পোকা, সারাদিন কী কোরিয়ান ফিল্ম চালিয়ে হা-করে বসে থাকবে, কারোর কোনো কথা শুনতে পায় না তখন ও। আসলে পুরো দোষটা ওরও নয় জানোতো; দোষটা হয়তো সময়ের— আসলে আমাদের সময়টাই বড্ড গতিময় আর তার ওপর এই করোনা এসে, লকডাউন হয়ে সবটা কীরকম এলোমেলো করে দিয়েছে। এমনিতেই আমরা তোমাদের মতো ওরকম বাড়ি থেকে বেরোতে পারতাম না, তার ওপর এই করোনা কালে ঘরবন্দি হয়ে সিরিজ দেখা, সোশ্যাল মিডিয়া করা, ভিডিও গেম খেলায় ভীষণরকম আসক্তি বেড়েছে, সবটা আগের মতো কিছুতেই হয়ে যাচ্ছে না আর। আমি তো আজও বাইরে বেরিয়ে সংক্রমণের আতঙ্কে থাকি, কিছুতেই আর আগের মতো বন্ধুদের সাথে মিশতে, একসাথে টিফিন ভাগ করে খেতে পারি না, এক অবরুদ্ধ দ্বার যেন সম্মুখে এসে পরে।
হুম বুঝতে পারছি রে রৈ, সময়টা অনেক বদলেছে,হতোরাও যথেষ্ট জটিল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস; মূল চাওয়া-পাওয়ার হিসাবগুলো এক থাকলেও আমাদের থেকে তোদের কিশোরবেলার বিস্তর ফারাক। যুগ পরিবর্তনের হাওয়ায় নতুন প্রযুক্তির আলোয় ভাবনা-চিন্তার পরিবর্তনই স্বাভাবিক—এটাই তো আগামীর পথ নির্দেশক। আচ্ছা দিদিভাই, তোর বন্ধু রিয়াংশু এখন কেমন আছে? শুনলাম ওর এক্সিডেন্ট হয়েছে।
দুর্ঘটনাটা সাধারণ অনিচ্ছাকৃত নয়, ইচ্ছাকৃত ছিল দিন্না।
মানে! এসব কী বলছিস?
তুমি তো জানো রিয়াংশু পড়াশোনায় খুব ভালো, বরাবরই ক্লাসে টপ করে। কিন্তু কী জানি কী কারণে ইদানীং ও আর তেমন ভালো ফল করতে পারছিল না আর এই নিয়ে বেশ কিছুমাস ধরে ও মানসিক অবসাদে ভুগছিল। এসব কথা ও কাউকে না-জানিয়ে নিজেকে আরও গুটিয়ে নিয়েছিল, লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়াও শুরু করেছিল। একদিন ধূমপান করতে গিয়ে ওর মায়ের কাছে ধরা পরে খুব বকা খেয়েছিল, তবু পরিবর্তন হয়নি। তারপর দেখতে দেখতে ফাইনাল পরীক্ষা এল, পরীক্ষা দিল, ফলাফল বেরোল — শতাংশের হিসাবে সেই টপ করা ছেলেটা আজ অনেকটাই পিছিয়ে পড়ল। বাড়ি এসে জুটল মায়ের অনেকখানি বকা; তাতেই আর নিজেকে সামলে নিতে না-পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারেনি ও।
তোরা সত্যিই বড়ো অল্পেতেই অধৈর্য হয়ে যাস রে। সবসময় মনে রাখিস সময়ের থেকে মূল্যবান ওষুধ অন্য কিচ্ছু নেই আর নিজেকে ভালোবাসতে না-জানলে কাউকে ভালোবাসতে ভালো রাখতে পারবিনা এ জীবনে। তোদের বয়সে ঠিক সময় খেতে না-এসে এ-গাছ ও-গাছ চড়ে বেড়ানোর জন্য কত মার জুটেছে আমার কপালে, তা তোর কল্পনাতীত। দুগ্গাদিদির তো আবার মারের চোটে নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে গেছিল, একগোছা করে চুলও উঠে এসেছে কতবার। তবে ওসবের জন্য আমাদের কোনোদিন জীবন শেষের কথা মাথায় আসেনি, চোখ লাল করে গাল ফুলিয়ে কেঁদেছি প্রচুর, তারপর ভুলেও গেছি। আসলে স্মৃতি তো হয় সময়। তাই যে সময় সুন্দর মুহূর্তের সৃষ্টি করে, ভবিষ্যতে এগিয়ে যেতে পথ দেখায় তাকে স্মৃতিবন্দি করে রাখতে হয়, অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে নেই।
হুম বুঝলাম, মনে রাখব এটা আমি দিন্না। আচ্ছা, তোমার ছোটবেলার ক্রাশের গল্প বলো তো শুনি।
সে আবার কি বস্তু! ওসব তো আমাদের মেয়েবেলায় ছিল না রে। হ্যাঁ, তোর মায়ের মুখে অবশ্য ক্র্যাশ কথাটা শুনেছি ক-বার, তা তখন তো বাড়ি বাড়ি অত গাড়ি ছিল না, ক্র্যাশ করবেই বা কী!
আরে দিন্না, উফ্ফ এটা সেটা নয় গো। ক্রাশ মানে হল সামওয়ান স্পেশাল, এমন একজন যাকে তুমি মনে মনে ভীষণ পছন্দ করো, যার সাথে সময় কাটাতে চাও এমন কেউ।
ও আচ্ছা, এই ব্যাপার, বুঝেছি এবার। আরে, ওসব বোঝার আগেই তো তখন আমাদের বিয়ে হয়ে যেত, তাই আর ওই উপলব্ধির সুযোগ হয়ে ওঠেনি। সংসারে প্রবেশের পর ধীরে ধীরে ছেলেমানুষী কাটিয়ে ভালোবাসা-আঁকড়ে ধরা-নিরাপত্তা-সোহাগ-মায়ার চাদরে জড়িয়ে থাকার অর্থ অনুধাবন করেছি।
তবে শোন, সেবার আমার বিয়ের আগে নলিনীর বিয়ে উপলক্ষ্যে আমি মামাবাড়ি গেছিলাম। ওইসময়েই আমার পরিচয় ওদের নতুন প্রতিবেশী মৃণালিনীর সঙ্গে। অমন প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি, ডানপিটে মেয়ে এর আগে আমি দেখিনি। ওর যত খেলা ছিল বাইরে বাইরে ঘুরে ছেলেদের সাথে, ঘরে বসে ঐ পুতুল খেলার মানুষ ও কখনোই ছিল না। তোরা আজকাল বলিস না ‘টমবয়’ — তা অনেকটা ওরম ধারারই ছিল মৃণালিনী। আমরা সবাই যখন বিয়ের গল্প, বিয়ের চিন্তায় মশগুল, ঐসময় মৃণালিনীর মাথায় রাখালকে গাট্টা মারা, লোকজনকে ভ্যাঙানো, জুতো সরিয়ে লুকিয়ে দেওয়া এসব দুষ্টু বুদ্ধি ঘুরপাক করত; বড্ড সরল মনের হাস্যমুখর মিষ্টি মেয়ে ছিল। ঠিক সেইসময় অপূর্ব দাদাও কলকাতা থেকে অনেক পাশ দিয়ে ডিগ্রি নিয়ে সদ্য গ্রামে ফিরেছে। অপূর্ব দাদার মনে ধরল এই মিষ্টি ছটফটে মৃণালিনীকে; সাথে সাথে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব গেল, তাই শুনে হই হই করে তেরো বছরের মৃণালিনীর বিয়ে হয়ে গেল অপূর্বদাদার সঙ্গে। বাকিরা সবাই অমন হিরের টুকরো জামাই পেয়ে খুশি হলেও মৃণালিনীর মনে ভারী দুঃখ, সংসার জীবন তার কাছে বন্দিদশায় পরিণত হল। সারাদিন বাইরে ঘুরে খেলতে না-পেরে চার দেওয়ালের মধ্যে তার দমবন্ধ হয়ে এল। অপূর্বদাদা মৃণালিনীর মতো করে নিজেকে উপস্থাপন করার সর্বতো চেষ্টা করলেও মৃণালিনী কিছুতেই স্বামী-সংসারের অর্থ-অনুভূতি বুঝে উঠতে পারল না। শেষে ব্যর্থ হয়ে তীব্র অভিমান নিয়ে অপূর্বদাদা কলকাতায় ফিরে গেল আইনি পড়াশোনার জন্য, তখনও মৃণালিনী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
তবে জানিস তো রৈ, সম্পর্ক-অনুভূতি-টান এগুলো অনেক সময় অপরজনের অনুপস্থিতিতে অনেক বেশি জোরালো ভাবে প্রকাশ পায়; তখন ইচ্ছা হয় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে সবটা নতুন করে তৈরি করতে আর এই সৃষ্টি-ই চিরস্থায়ী হয়। মৃণালিনীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হল না — ও ছেলেমানুষীর গণ্ডি ছেড়ে কৈশোর যৌবনের আবর্তে প্রবেশ করল। উচ্ছল সমুদ্রের প্রবল জলরাশির পাগল ঢেউয়ের নিকট আত্মসমর্পণ করে প্রশান্তি পেল। সবটা দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে সারাজীবনের মতো অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে নতুন সম্পর্কের জোয়ার-ভাটায় গা ভাসাল।
আমি আর সৌপ্তিকও তো চাই একে অপরের ভালো-মন্দে পাশে থেকে পরিপূরক হয়ে জীবনের পথটা সুন্দর করে হেঁটে যেতে। যে-কোনো সম্পর্কেই তো বন্ধুত্বের থেকে প্রিয় আচ্ছাদন কিছু হয় না। তবে সবাই বলে এ সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী নয়, কলেজের গণ্ডিতে প্রবেশের পরেই সমীকরণ বদলে যাবে; কিন্তু দিন্না মৃণালিনী ঠাম্মি তো পেরেছিল সেই তেরো বছরের শুরুর সম্পর্ককে সারাজীবন পূর্ণতা দিতে, আমরা পারব না কেন!
পুরোনো দিনের মানুষ তো, তাই মাঝে মধ্যে মনে হয় গাঁটছড়ার এক অদ্ভুত শক্তি আছে। তবে কবি শঙ্খ ঘোষের কথা মতো আমিও মনে করি —
হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারাজীবন বইতে পারা সহজ নয়।
তাই হাতের ওপর হাত রাখলেও তার ভার সারাজীবন বইতে পারে না অনেকেই। তবে এ কাজ কঠিন হলেও অসাধ্য নয়; জড়িয়ে থাকতে পারলে নিশ্চয়ই হাত ধরে সময় কাটিয়ে দিতে পারবি। কথাগুলো শুনে রৈ-এর মনের ভার অনেকখানি লাঘব হল। মনে মনে ভাবল পরের দিন সৌপ্তিকের সাথে দেখা হলে ওকে সমস্ত কথাগুলো জানিয়ে দুবাহু ডোরে ঘিরে কপালে স্নেহ চুম্বন এঁকে দেবে — এভাবেই ওদের প্রেমগাথা রচিত হবে।
যখন ভাবনা চিন্তার অতল সাগরে তলিয়ে গেছিল রৈ, ঠিক তখনই দিন্নার কথায় চমক ভাঙল।
তোরা এখন অনেক আধুনিক, কুসংস্কারমুক্ত, আমাদের মতো মানুষকে ডাইনি ভেবে ভয় পাস না, বরং তার অবহেলার প্রকৃত কারণ খুঁজে বার করার চেষ্টা করিস; ছোটো-বড়ো সমস্ত অনুভূতির অর্থ বুঝতে সচেষ্ট তোরা। শুধু অপ্রাকৃতিক তাৎক্ষণিক হাতছানিতে সাড়া না-দিয়ে বুদ্ধির দীপ্তিতে সময়কে এগিয়ে নিয়ে চল— তবেই সূর্যের রঙিন আভায় তোদের উজ্জ্বল উপস্থিতির নিদর্শন রয়ে যাবে, সমস্ত অসুখ সেরে ভালো থাকবে, শান্তিতে থাকবে এ ধরণী। আমরাও চিরকাল মাথা উঁচু করে গর্ববোধ করব আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে আর তোদের দেখানো আলোর সুবিশেষ পথে নিজেদের বিলিয়ে দেব।
একগাল হেসে এক অদ্ভুত ভাবুক দৃষ্টি নিয়ে রৈ বলল — কিছু ভাবনা, চিন্তন, অনুভূতির কোনোকালেই পরিবর্তন হয় না, শুধু বদলে যায় তার প্রকাশের ভঙ্গিমা, তবে অন্তস্তলের অন্তঃসার একই থেকে যায়।
সে রোদের নিশানা, মেঘের শামিয়ানা
সে খোলা জানলার কাছে রেখেছে বিছানা
সে জুড়ে দিয়ে ডানা কবে উড়ে যাবে আকাশের গায়ে
— হঠাৎ আসা এই শব্দগুলোতে ভাবনায় ছেদ পরেই চোখ গেল মোবাইল স্ক্রিনের ওপর আর সাথে সাথেই অস্ফুটে বেরিয়ে এল ‘উফ কি টাইমিং’।
ওপাশ থেকে সৌপ্তিকের গলা ভেসে এল —
কিরে রিদ্ধিমা আজ রাতেই অডিওস্টোরিটা পাচ্ছি তো! আমরা সবাই কিন্তু দিন্নার ছোটোবেলার গ্রামের গল্প শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছি আর লেট্ করিস না প্লিজ।
ঠিক আছে, তোরা আর একটু অপেক্ষা কর, আজ রাতেই আপলোড করে দেব। আচ্ছা বাই, এখন অনেক কাজ আছে, রাখছি।
ফোনটা রাখার পরই সূর্য ডোবার কমলা আভায়, পাখিদের বাড়ি ফেরার কলকাকলিতে চারদিকটা অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পাশের বাগান থেকে ভেসে আসা ফুলের পাগল করা গন্ধে বাইরে বেরিয়ে এল রৈ, আকাশের দিকে নির্নিমেষ নেত্রে চেয়ে কী যেন একটা খোঁজার চেষ্টা করছে ও।