শিপ্রা সরকার
মেলা মানেই পাঁপড় ভাজা, রসে ডুবো গরম জিলিপি আর নাগোরদোলা; মাটির পুতুল, তালের পাখা, হরেকরকম জিনিসপত্রের দোকান আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কয়েক ঘন্টার অনাবিল আনন্দ, একার নয়, ‘মেলার’। মেলা লোকের আনন্দ বলেই তো নাম ‘মেলা’। মিলনমঞ্চ। কিন্তু ঠিক এরকমই এক মিলনমেলা প্রাঙ্গণে যদি বাকি সব কুশিলব আর পরিবেশ-পরিস্থিতিকে অপরিবর্তিত রেখে একটি নতুন চরিত্রের সংযোজন করা যায়, তাহলে কেমন হয়? সেই নতুন চরিত্রটি হবে আরেক ধরনের মানুষ, সমাজের একটা অংশের চোখে যারা বেশ খানিকটা এলোমেলো গোছের, যাদের চিন্তার পথ গতে-বাঁধা কাঠামো ধরে এগোয় না, যারা আপন মর্জিতে চলেন-ফেরেন, তাদের? আসলে যাদের মনের অসুখ করেছে, তাদের যদি মেলায় বেড়াতে নিয়ে আসা হয় অথবা যদি একটা গোটা মেলাই মূলত তাদের জন্য হয়? এতে অসুস্থ মানুষ এবং তার পরিজনবর্গের বিবর্ণ জীবনে কিছু রঙের ছিটে দেওয়া যাবে, যা তাদের ভবিষ্যতের রঙ চিনে নিতে সাহায্য করতে পারে। ঠিক এই ভাবনা থেকেই কিছু প্রথা ভাঙা মানুষের এগিয়ে আসা। যার ফল হল একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে পশ্চিমবঙ্গে জন-মানসিক স্বাস্থ্য মেলার সূচনা।
পটভূমির সন্ধানে
নব্বইয়ের দশকে বিশ্বায়নের প্রভাবে মেলার অর্থ আর গণ্ডি শুধুমাত্র সংস্কৃতি আর বিনোদনের মধ্যে আটকে না থেকে বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান, বইপত্র, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদিও ঢুকে পড়ে মেলার মাঠে। সেইসঙ্গে মেলার প্রকৃতি-চরিত্র-ধারণাতেও আসতে থাকে বদল। পশ্চিমবঙ্গে জন-মানসিক স্বাস্থ্য মেলার সাধারণ পটভূমি এটাই।
সাধারণ পটভূমিটি যদি হয় সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বিমুক্তকরণ, তাহলে বিশেষ পটভূমিটি হল পশ্চিমবঙ্গে জন-মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের বিকাশ এবং কম্যুনিটি বেসড রিহ্যাবিলিটেশন (সি.বি.আর) বাস্তবায়নের উদ্যোগ। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের পশ্চিমবঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল তরুণচন্দ্র সিংহ বা ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তবে, মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনে ‘জন’-এর অংশগ্রহণের মানদণ্ডের নিরিখে আশির দশক ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। নব্বইয়ের দশকে তা ভরপুর মাত্রা পায়। অন্তরা (১৯৭১), মানস (১৯৮২), মন (১৯৯২) প্রভৃতি স্বেচ্ছাসেবী অ-সরকারি মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থা যে ভাবনাটা নিয়ে এগোচ্ছিল, পশ্চিমবঙ্গে তখন তা অভিনব। যেমন বারুইপুর থানার অন্তর্গত দক্ষিণ গোবিন্দপুরে অবস্থিত অন্তরা তার আবাসিক মনোরোগীদের সামাজীকিকরণের জন্য সমাজের আপাত সুস্থ মানুষদের নানাভাবে কাছে টানছিল। আশি-নব্বইয়ের দশকে প্রতিষ্ঠানটি বিজ্ঞপ্তি ছাড়ছিল অন্তরায় এসে সময় কাটিয়ে যাওয়ার জন্য বা ইচ্ছে হলে কিছু দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। অর্থাৎ, সমাজকেও সে সুযোগ দিচ্ছিল যুক্তিবাদী হওয়ার এবং পাল্টা সুযোগটাও সে নিতে চাইছিল। নদীয়ার মদনপুরের অন্তর্গত তেঘড়ি গ্রামের মানস (প্রথম নাম সৃজনী) ভাবছিল আরও একধাপ এগিয়ে। শুধু মনোরোগী নয় মনোরোগীর পরিবারের ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে যায়, সেটা কাটাতে না-পারলে যে সামাজীকিকরণের সব চেষ্টাই বৃথা হবে, তা সে বুঝেছিল। তাই সে প্রথমে মনোরোগী এবং তাদের পরিবারকে এক জায়গায় এনে একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে উদ্যোগী হল। এমন একটা প্ল্যাটফর্ম, যেখানে মনোরোগীদের পরিবার নিজেদের সমস্যার কখা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারবেন। তারা মানসিক নিরাপত্তা ফিরে পাবেন। ১৯৯৪ সালে মানসের সম্পাদক অমল সোম স্মৃতি থেকে লিখলেন, ‘প্রথমদিকে আমরা গায়ে পড়েই আলাপ জমাতাম, বন্ধুত্ব করতাম। পরে সেই বন্ধুত্ব, ডাক্তারবাবুর পরামর্শর থেকেও বেশি নির্ভরতার স্থান বলে মনে হত রোগী ও তার পরিবারের।’[১] এভাবেই শুরু হল মানসের সামাজিকীকরণের কাজ।
আশির দশকে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু হয়। ১৯৮২ সালে সকলওয়াড়া ও রায়পুর রানি থেকে শিক্ষা নিয়ে যে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মসূচী স্থির হল, তাতে বলা হল যে, সর্বসাধারণ, বিশেষ করে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ যাতে ন্যূনতম মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা লাভ করতে পারে, সেটা সবার আগে সুনিশ্চিত করতে হবে।[২] মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ বা জ্ঞানকে যাতে মানুষের কাজে লাগানো যায় বা সমাজের স্বার্থে প্রয়োগ করা যায় এবং সবচেয়ে বড়ো কথা হল এই পুরো ব্যাপারটার মধ্যে যাতে কমিউনিটিকে নিয়োজিত করা যায়, যাতে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতাভুক্ত হয়ে তারাও ‘সেল্ফ-হেল্প’ বা ওই জাতীয় কোনো স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তুলতে পারে, সেইসব দিকের ওপর নজর দিতে হবে।[৩] যদিও বাস্তবে গণ অংশগ্রহণ সেভাবে দেখা যায়নি, আবার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটা আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠীও সহসা গজিয়ে উঠেছিল।
পঞ্চাশ-ষাটে পাভলভ ইনস্টিটিউট বা সত্তরে অন্তরা, বাউল মন প্রভৃতির ক্ষেত্রে যেটা দেখা গিয়েছিল যে, এরা সবাই জন-মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বলছে, অর্থাৎ গোষ্ঠী বা সমষ্টিকে মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত করতে চাইছে, তার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে, এমনকি প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান নিজে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু মানুষ সাড়া দিচ্ছেন, কিছু কঠোরতা শিথিল হচ্ছে। কিন্তু, আশির দশকে গোটা প্রক্রিয়ায় একটা স্বতঃস্ফূর্ততা এল। এবারে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠানের কাছে এল এবং এল আগের তুলনায় আরও অনেক বেশি করে। এতে করে মনোরোগীর চিকিৎসায় কমিউনিটির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আরও অনেক বেশি সক্রিয় ও বিস্তৃত হল। সর্বোপরি, মনোরোগ নিয়ে জনমত গঠনের একটা তীব্র ও সক্রিয় প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেল। পশ্চিমবঙ্গের গণবিজ্ঞান আন্দোলনের একদল কর্মী, মনশ্চিকিৎসক তথা বিভিন্ন নেশা ও পেশার সমভাবাপন্ন মানুষ মিলে মনোরোগ সম্পর্কে দীর্ঘদিনের বদ্ধ ধারণাগুলিকে ভাঙতে উদ্যোগী হলেন। পরিবর্তন আনতে উদ্যোগী হলেন মনশ্চিকিৎসার সমকালীন প্রচলিত ধারণা এবং পদ্ধতিতন্ত্রে। সর্বোপরি, এঁরা সমাজকে যুক্ত করতে চাইলেন মানসিক ভারসাম্যহীনের চিকিৎসায়। ফলে জন-মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি তো মজবুত হলই সেইসাথে সামাজীকিরণের বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মেজাজ এল। মানসিক স্বাস্থ্য মেলার ভাবনার শুরু ঠিক এই পটভূমিতেই।
আবার আসবে কবে?
২০১৯ সালের বসন্ত। কলকাতার দক্ষিণে পার্ক সার্কাস স্টেশন থেকে হাঁটা পথে বেশ কয়েক মিনিট ১৮ নং গোবরা রোড। সেখানে গিয়ে দেখা গেল টুকাই আর তার বন্ধুদের, একদিন যারা মনের কথা এঁকেছিলেন আর্টপেপারে, সাদা চাদরে, গাছের গুঁড়িতে; হাসপাতালের লোহার বেড, যে বেড তাদের অবর-সবরের সঙ্গী, তা দিয়ে বানিয়ে ছিলেন শিল্পকর্ম, বাতিল প্লাস্টিকের বোতল ভাষা পেয়েছিল তাদের হাতে। পাভলভের সেইসব আবাসিকের কাজ নিয়ে বসেছিল চিত্র ও শিল্পকলা প্রদর্শনী। ছবি আঁকতে আবাসিকদের দেওয়া হয়েছিল অবাধ স্বাধীনতা। এমন নয় যে, শুধু আনন্দের কথাই বলা যাবে ছবি বা শিল্পকর্মে; বলা যাবে কষ্ট-দুঃখ, পছন্দ-অপছন্দ, সমস্যা-সম্ভাবনার কথাও — মন খুলে বলো মনের কথা। আবাসিকরা তাই ছবি এঁকেছিলেন হাসপাতালের বিছানায় ছারপোকার উৎপাতের, ছবি এঁকেছিলেন তাঁদের ফেলে আসা জীবনের, পুকুর, মাছ, নৌকো, প্রজাপতি, বিড়াল, ইঁদুর, পাখি, ফড়িং আর দুর্গাপুজোর। মনের মধ্যে ঘরে ফেরার ইচ্ছে ফুটে উঠেছিল ছবিতে। বড়ো এক বট গাছে তাঁরা ঝুলিয়েছিলেন অসংখ্য আয়না। তাতে অস্পষ্ট সব মুখচ্ছবি। আবাসিকরা বলেছিলেন, ওই আয়নাই হবে তাদের গেছে যে-দিন, তার প্রতীক। কাছের মানুষেরা আয়নার তাদের পুরনো মুখছাপ দেখেই তাঁদের চিনে নেবেন। কারণ, বয়সের সাথে তো তাঁদের মুখাবয়ব বদলে যাবে।
প্রদর্শনী চলেছিল সপ্তাহ তিনেক — ২-২৩ ফেব্রুয়ারি। শিরোনাম বাছা হয়েছিল ‘Across the Lines’, a CIMA art awards collateral event at Pavlov Hospital Kolkata।[৪] সহযোগিতায় ছিল কলকাতার মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থা অঞ্জলি এবং পাভলভ হাসপাতাল। অতএব, সমাজবিধির পথ গেল খুলে। শুরু হল দেওয়া-নেওয়া। ফেরার সময় টুকাই আর তাঁর বন্ধু-বান্ধব আবদার করেছিলেন, ‘আবার আসবে কবে?’
গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকেই মননশীল মনের ডাক্তাররা বুঝে গিয়েছিলেন যে, মনের অসুখ সারানোর সবচেয়ে বেশি কার্যকর থেরাপি হল অসুস্থ মানুষকে সামাজিক বৃত্তের মধ্যে রাখা। এতে হাসপাতালের ওপর বিপুল চাপও কমে আবার যত্নআত্তিতে রোগীর রোগও আয়ত্তে আসে। নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে মনোরোগীর সামাজিকীকরণের একটা অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসাবে তাই বেছে নেওয়া হয়েছিল মেলাকে। তবে মানসিক স্বাস্থ্য মেলারও নানা রূপভেদ আছে। কোথাও তা হয় ওপরে বর্ণিত পথে মেলার প্রচলিত ধারণার ওপর ভিত্তি করে, জিলিপি, পাঁপড়, নাগরদোলা সহযোগে; আবার কোথাও তা হয় মূলত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য, মনের রোগ ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা গঠনের মধ্যে দিয়ে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাপ্রাপ্ত বা আরোগ্যপ্রাপ্ত মনোরোগীরাও নিজেদের সৃষ্টিকর্ম আর অভিজ্ঞতা নিয়ে তাতে যোগ দেন।
বন্ধুর মুখ ভিড়ের ভেতর…
• অন্তরার মেলা
অন্তরার মানসিক স্বাস্থ্যমেলার সামগ্রিক চিত্রটি ঘরোয়া এবং স্বভাব-চরিত্রে আদ্যোপান্ত সমাজ সচেতনতামূলক। সতীর্থ প্রতিষ্ঠানগুলির দেখা হয়ে যাওয়ার আবহে অন্তরার আবাসিকদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ, মেলামেশাকে কম্যুনিটি সাইকিয়াট্রির এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলা হয়েছিল।
অন্তরার মানসিক স্বাস্থ্য মেলা সম্পর্কে জানতে বিশেষভাবে সাহায্য করে ফোটোগ্রাফিচর্চা। এছাড়া রয়েছে তার প্রচারিত লিফলেট এবং বিভিন্ন চিঠিপত্র। অন্তরা প্রতিবছর তার আয়োজিত মেলার স্থির চিত্র সংগ্রহ করে ছবির অ্যালবাম বানিয়ে রাখত। ২০০১-২০০৫ পর্যন্ত যেসব চিত্রাবলী পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় যে, মেলা প্রাঙ্গণ অনেকটা বই মেলার ধাঁচের। তাতে রয়েছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী মানসিক স্বাস্থ্য সংগঠন এবং বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংস্থার স্টল। এসেছে বাউলমন, সেতু, সমীক্ষণী, নারী ও বধূ নির্যাতন-বিরোধী সংগঠন স্বয়ম, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, ফোরাম ফর মেন্টাল হেলথ মুভমেন্ট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান। ২০০১ সালের মেলার ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে, মেলার মাঠে প্রবল জনসমাবেশ। উৎসাহী মুখের ভিড় সেখানে উপচে পড়ছে। অন্তরা অকুপেশনাল থেরাপি ইউনিটেও ব্যাপক ভিড়। আগত প্রতিষ্ঠানগুলি নিজের নিজের স্টলে নিজেদের সংস্থার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সাধারণকে সচেতন করছে। স্থানে স্থানে চেয়ার টেনে পুরোভাগের মানুষদের জটলা। সাধারণ মানুষ ভীড় জমিয়েছেন ‘অন্তরা ক্যুইজ স্টলেও’। মেলার মাঠে গুণীজনের বসার জন্য বা বক্তব্য রাখার জন্য কয়েকটি চেয়ার সাজিয়ে, পিছনে হাতকয়েক কাপড়ের পটভূমি টাঙিয়ে কিছুটা জায়গা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সংস্থার কর্ণধার পি. এম. জন বক্তব্য রাখছেন সেখানে। ২০০৩-এ মেলায় এসেছিলেন গণ মাধ্যমের লোকজন। ছিলেন অন্তরা সোসাইটির কর্মী ও সদস্যবৃন্দ।
• মানস মেলা
মানসের মেলাও প্রকৃতিগত দিক থেকে অন্তরারই অনুরূপ। তবে, নদীয়া জেলার মধ্যে মানসই সর্বপ্রথম মানসিক স্বাস্থ্য মেলা পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল বলে জানা যায়। মেলা বিষয়ক তার একটি লিফলেটে দিন আর মাসের উল্লেখ থাকলেও সালের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘আমরা আগামী নভেম্বর মাসের ২৫ এবং ২৬ তারিখে (শনি এবং রবিবার) মদনপুরের তেঘড়ি গ্রামে মানসের জমিতে একটি মানসিক স্বাস্থ্য মেলার আয়োজন করতে চলেছি।…এটাই হবে নদীয়া জেলার প্রথম মানসিক স্বাস্থ্যমেলা।’ এই লিফলেটেই বলা হয়েছিল যে, মানসের হাসপাতাল বাড়ির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হবে এই মেলাতেই। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, সেটা ২০০৪ সালের কথা।
মানসের মেলাতেও অন্তরার মতো পারস্পরিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের পরিসর ফুটে ওঠে। মন, মানব সংবেদ, কাঁচড়াপাড়া বিজ্ঞান দরবার, নৈহাটি বিজ্ঞান সংস্থা, ফোরাম ফর মেন্টাল হেলথ মুভমেন্ট প্রভৃতি অ-সরকারি সংস্থা নিজেদের প্রকাশিত পুস্তিকা, লিফলেট সাথে করে জনসচেতনতা গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে যোগ দেয় দু’দিন ব্যপী এই মেলায়। মানস মেলায় মনোরোগীর সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত। মাথার ওপর নীল আকাশের শামিয়ানা আর পায়ের তলায় ঘাস বিছানো সবুজ জমিতে কিছু চেয়ার পাতা রয়েছে সারি দিয়ে। মঞ্চে একটা টেবিল, তার ওপর হারমোনিয়াম রাখা আছে। সেখানে আবাসিক ও কর্মীরা মিলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবেন। কোনো নিয়মের বাঁধন নেই, যে যা পারে, তাই করে দেখাচ্ছে, আহ্বান আসছে মাঠে বসে থাকা দর্শকমন্ডলীর কাছেও কিছু করে দেখানোর জন্য। মানসের দর্শন যেহেতু ‘এলেবেলে’ মানুষদের জীবন দয়ার দানে ভরিয়ে না-দিয়ে তাদের আপন খেয়ালে বাঁচতে দেওয়া, তাই দর্শকাসনে সুস্থ-অসুস্থর ভেদাভেদ নেই। কে কার পাশে বসছেন, সেটা দেখার মানসিকতা মানসের নয়। মেলায় যোগ দিচ্ছেন আবাসিক মনোরোগীরা, আর যারা বহির্বিভাগে চিকিৎসা করান, তারা আসছেন বাড়ির লোকের সাথে কাছাকাছি বা দূর থেকে। আশেপাশের স্কুল থেকে খুদে শিশুর দল এসে নৃত্য পরিবেশন করছে। মানসে আগত নার্সিং ট্রেনিং স্কুলের ছাত্রীরা পরিবেশন করছেন মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ক নাটক। তারই ফাঁকে ফাঁকে চলছে মঞ্চে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বক্তব্যের মাধ্যমে সচেতনতা গঠনের কাজ। থাকছে শরীরচর্চা, টেলিস্কোপ দিয়ে রাতের আকাশ দেখা, তারা চেনার মতো অনুষ্ঠান। এই হচ্ছে মানস-মেলার মেজাজ।
২০০০ সালের মানস মেলায় আগত বিভিন্ন সংস্থার নাম ও স্টলের বিষয়বস্তু নীচে (সারণি — ক) উল্লেখ করা হল —
সারণি — ক
| সংস্থা/স্টল | বিষয়বস্তু | |
| ১ | মানস | মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ছবি এবং পোস্টার প্রদর্শনী, বই, পত্র-পত্রিকা, পোড়া মাটির কাজ, কাঁথা সেলাই, মুখোশ তৈরি। |
| ২ | শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ | বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলায় স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বই ও নির্দেশিকা এবং অন্যান্য কাজের সঙ্গে পরিচয়। |
| ৩ | ক্যানিং যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা ও বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা | জীবন্ত সাপ প্রদর্শন। সাপ সম্পর্কে ভয় দূর করা। প্রত্যেক হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাপে কাটার ওষুধ এ ভি এস মজুত রাখার দাবিকে সোচ্চার করা। |
| ৪ | ব্রীহিবীজ বিনিময় কেন্দ্র, বাঁকুড়া | বাঁকুড়া সাবেকি ধানের বীজ সংগ্রহ। |
| ৫ | অঙ্কোলিঙ্ক | পোস্টার সহযোগে ক্যান্সার বিষয়ক সচেতনতা তৈরি। চাষিদের শরীরে কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব ও তার প্রতিকারের উপায় অনুসন্ধান। |
| ৬ | বেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি | পানীয় জলে আর্সেনিক পরীক্ষা |
| ৭ | খড়দহ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি পরিষদ | স্বাস্থ্যপত্র (Health Card) প্রদান। রক্তের গ্রুপ নির্ণয়। |
| ৮ | প্রতিবন্ধী কল্যাণ কেন্দ্র, ব্যাণ্ডেল | বধির ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিক্ষায়, শিক্ষা ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত প্রদর্শনী। নামমাত্র মূল্যে (২ টাকা) শ্রবণশক্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে (Secreening Audiometry)। |
| ৯ | ইনার আই, কাঁচড়াপাড়া | ভ্রাম্যমাণ চিত্র প্রদর্শনী। |
| ১০ | হালিশহর বিজ্ঞান পরিষদ | জলাতঙ্ক, সাপ, পাখি নিয়ে পোস্টার এবং খাদ্যে ভেজাল নির্ণয়। |
| ১১ | স্থির চিত্র প্রদর্শনী | বিবর্তন, পাখি, মহাকাশ, জলাতঙ্ক, সাপ ইত্যাদি। প্রদর্শক : পীযুষ দাশগুপ্ত, রাজু মণ্ডল, পার্থ চক্রবর্তী। |
| ১২ | ভিডিও প্রদর্শনী | আর্সেনিক, রক্তদান ইত্যাদি |
| ১৩ | মা সারদা পুতুলনাট্য সমাজ | লালন ফকির পালা। |
পরবর্তীকালে মানস মেলা নভেম্বরের পরিবর্তে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পালন করা হতে থাকে, বিশেষত ৪ এবং ৫ জানুয়ারি।
• আনন্দ নিকেতন গ্রামীণ মেলা
কাটোয়ার খাজুরডিহির আনন্দ নিকেতনের মানসিক স্বাস্থ্য মেলা কিন্তু অন্তরা আর মানসের মেলা থেকে প্রকৃতিগত দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন — নামেও, স্বভাবেও। এটি হল ‘আনন্দ নিকেতন গ্রামীণ মেলা’। ২০০৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম চারদিন ব্যাপী এই মেলার সূচনা হয়। প্রথম বছরেই এই উদ্যোগ আবাসিক আর গ্রামবাসীদের মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলেছিল। ফলে পরের বছর মেলা আরও একদিন বাড়িয়ে দেওয়া হল। ২০০৯ সাল থেকে মেলার আয়োজন করা হয় ৩১ জানুয়ারি – ৪ ফেব্রুয়ারি অবধি। চিরাচরিত গ্রামীণ মেলার রূপ-বৈশিষ্ট্য যেমন হয়, আনন্দ নিকেতনের মেলাও ঠিক তেমনই। পাঁপড়-বাদাম, আমোদ-প্রমোদ, যাত্রা-পালা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চুড়ি-মালা-খেলনার দোকান– সব মিলিয়ে পাঁচদিনের জমজমাটি আনন্দ। মেলার দিনগুলিতে মেলার মাঠে সাধারণের প্রবেশ অবাধ। উদ্দেশ্য কেবল একটাই, সংশ্লিষ্ট সংগঠনের আবাসিক মানসিক রোগী, অন্যভাবে সক্ষম শিশু প্রমুখের জীবনে আনন্দ-উচ্ছ্বাস এনে দেওয়া আর তাদের সামাজিকীকরণ। আনন্দ নিকেতনের বর্তমান সম্পাদক, হরমোহন সিংহের পুত্র সুব্রত সিংহ স্মৃতিচারণ করছিলেন শুরুর সেসব দিনের উদ্যোগের [৫] —
তিনশোর ওপর বিশেষ মানুষদের নিয়ে কোনো মেলায় ঘুরিয়ে আনা, তাদের সময় দিয়ে সব কিছু দেখানো এবং প্রকৃত অর্থে তাদের অংশগ্রহণ খুবই সমস্যা সংকুল হয়। তবে একেবারে অসম্ভব নয়।
সেই কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা: হরমোহন সিংহ মহাশয় আজ থেকে ৯ বছর আগে (২০০৭) ঠিক করেছিলেন যে, সকল আবাসিককে মেলা বা কোনো উৎসবে নিয়ে যেতে না পারলে নিজেদের ক্যাম্পাসের ভিতর একটা মেলার আয়োজন যদি করা যায়, তাহলে অবশ্যই খুব ভালো হয়।
সেই থেকে শুরু হয় মেলা। গ্রামবাসী আর আবাসিকদের মেলামেশায় বয়ে চলে সামাজীকিকরণের ধারা। মেলা নিয়ে ছড়া বেরিয়ে আসে সেরে ওঠা জনৈক আবাসিকের কল্পনায় [৬] —
আনন্দের এই মেলাতে আজ মিলেছি সব্বাই —
আপশোশ শুধু গীতাদি আর মোদের মাঝে নাই।
মেলায় এখন দারুণ মজা ঘুরছে নাগরদোলা
পয়সা খোঁজে রুকসানা, আর গৌরী, বাঘা, ভোলা।
মেলায় ঘোরে গোপাল, সুরজ, পিন্টু আর অক্ষয়,
আসছে কে ঐ বিবিজান আর আয়েষা নিশ্চয়।
রঞ্জনাদির হাতে খাতা বানায় কবিতা ছড়া,
চুড়ির দোকানে ভিড় করেছে উর্মী, কুসুম, মীরা।
দারুণ লাগে চাউমিন, হায় পয়সা কোথায় পাই —
বিক্রমদাকে পাই না খুঁজে বাবার কাছেই যাই।
কুকুর কোলে ঘুরছে কে ঐ কালী না সায়েদা?
রূপা দিদির সঙ্গে ঘোরে সুপ্রিয়া, সবিতা, লতা।
কুন্দনদা ব্যস্ত খুবই ক্যুইজে মাথা ঘামায়,
খোকন স্যার, অরূপ বাবু — প্রোগ্রামে চোখ বোলায়।
নাটক হবে দিদিরা সব করবে যে সাজগোজ,
অঞ্জনদা শেখায় তাদের কেমন হবে পোজ।
চুপটি শুধু ডাক্তারবাবু — সব দিকেতেই নজর,
প্রণাম ওঁকে মোদের মেলায় থাকুন বছর বছর।
অজান্তেই লেখা হয়ে যায় মানসিক স্বাস্থ্য মেলার ইতিহাসের বিচিত্র সব আকর।
• মানব সংবেদের মেলা
সোদপুরের মানব সংবেদ মানসিক স্বাস্থ্য মেলা শুরু করেছিল একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষভাগে এসে। ২০১৭ সালে প্রথম মানব সংবেদের এক দিবসীয় মানসিক স্বাস্থ্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জন সচেতনতা গঠন। ২০১৮ সালে মেলা বসেছিল ১৪ জানুয়ারি। সোদপুরের দেশবন্ধু হাইস্কুলে। সেবছর মেলার মূল বিষয় ভাবা হয়েছিল ‘কৈশোরের সমস্যা, সমস্যার কৈশোর’। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন অনেক সংগঠন, যেমন– মানস, ডানা, মানবিক, সুস্থ জীবন প্রভৃতি নিজেদের সচেতনতা মূলক বইপত্র ও প্রকাশনা সম্ভার নিয়ে যোগ দিয়েছিল সেদিনের মেলায়।
মানব সংবেদের মেলায় আমন্ত্রণের চিঠিতে বা অন্যান্য সংস্থার মেলা বিষয়ক লিফলেট থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে, নির্দিষ্ট কোনো মানসিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মেলা সহজেই হয়ে ওঠে সমমনস্ক সংগঠনগুলির একটা যৌথ মঞ্চ, যেন একটা বার্ষিক পুনর্মিলন। এমন একটা মুক্ত মঞ্চ, যেখানে সমধাঁচ ও সমভাবের যেকোনো প্রতিষ্ঠানই তার নিজের কথা বলার সুযোগ পায়। দর্শকের পক্ষেও একসাথে বহু এবং বিচিত্র ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, যেমন — মানসিক স্বাস্থ্য সংগঠন, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংস্থা, বিজ্ঞান ক্লাব, পরিবেশ-বন্ধু সংস্থা প্রভৃতির কার্যকলাপ সম্পর্কে জানা-শোনা ও সচেতন হওয়া সম্ভব হয় এতে। এই জাতীয় মেলা অনেক সময়ই বসে কোনো প্রতিষ্ঠানের উঠোনে বা চাতালে। হলঘরে বা স্কুলঘরে বক্তব্য প্রদান, আলাপ-আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়। স্টল বসে উঠোনে বা বারান্দায়। অনেকক্ষেত্রেই মেলা শেষ হয়ে যায় সন্ধে নামার আগেই। মেলার খরচ-খরচা উঠে আসে সাধারণত সংগঠনের নিজস্ব তহবিল, সদস্যদের চাঁদা বা অনুদান থেকে। সামগ্রিকভাবে, মানসিক স্বাস্থ্য মেলা সমমনস্ক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে বাড়ায় পারস্পরিক সহযোগিতা ও তৈরি করে বোঝাপড়ার সুযোগ। সেইসাথে আসে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
• কলকাতা মানসিক স্বাস্থ্য মেলা
একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এই আলোচনায় এসে পড়ে আরও বৃহত্তর উদ্যোগের কথা। ২০২০ সালের ৯-১২ জানুয়ারি কলকাতার এস. এস. কে. এম. হাসপাতালের মাঠে Kolkata Psychiatric Association, Institute of Psychiatry (IOP) এবং Institute of Post-Graduate Medical Education and Research-এর যৌথ উদ্যোগে মানসিক স্বাস্থ্যমেলার আয়োজন করা হয় — অনুষ্ঠিত হয় প্রথম কলকাতা মেন্টাল হেলথ ফেয়ার। মেলার মর্মবাণী ছিল ‘মনের শরীর খারাপ হলে, মনের মেলায় চলো সদলে’। মেলার মাঠের ব্যানারে মেলা সম্পর্কে লেখা হয়েছিল ‘4 Days Long Mental Health Awareness Fair for the First Time in The World’।
চারদিন ব্যাপী মেলার আলোচ্যসূচিতে রাখা হয়েছিল মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা গঠনমূলক একাধিক আলোচনা। প্রশ্নোত্তর পর্বে একাধিক প্রশ্ন উঠে এসেছিল সাধারণ দর্শকের মধ্যে থেকে। IOP-এর বিভিন্ন ওয়ার্ডের মোট ১১জন রোগী মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ক নাটক এবং নাচ, গান, আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করেন দ্বিতীয় দিন। মেলায় বিভিন্ন স্টলের দেওয়াল জুড়ে বড়ো বড়ো ব্যানারে টাঙানো হয়েছিল খবরের কাগজে প্রকাশিত একদা মনোরোগ জয় করে ফিরে আসা রোগীদের খবরের কাটিং (সারণি-খ দ্রষ্টব্য)।[৭] উদ্দেশ্য জনসচেতনতা গঠন।
সারণি-খ
| সংবাদের শিরোনাম | বিষয় | সংবাদপত্রের নাম |
| বিকল্প মনোরোগে স্ট্যাচু কিশোর, নড়াচড়া ফিরিয়ে রক্ষা আই ও পি-র | টুপোরাস ক্যাটাটোনিয়া পসচারিং ডিসঅর্ডার রোগে জীবন্ত মূর্তি হয়ে যায় নদীয়ার তেহট্টের কিশোর। | এই সময় |
| ৪ বছরের আঁধার কাটল ৬ মাসে : মনোরোগের চিকিৎসায় ঘুঁচল অন্ধত্ব | মনের নিকষ কালো অবসাদে, অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান মেটিয়াবুরুজের তরুণী। রোগটা ছিল তার ডিসথাইমিয়া উইথ ডিসোসিয়েশন। | এই সময় |
| পাকস্থলী না থাকার দুঃখ কাটিয়ে পি. জি-তে মাছ-ভাত খাচ্ছেন স্নেহলতা | বিজারে ইলিউশন ডিসঅর্ডার-এ ভুগতেন তিনি, যে রোগে মানুষের মনে অনেক অবাস্তব ধারণাও বদ্ধমূল হয়ে যায়। | _ |
| অবশেষে বধূর দৃষ্টি ফেরাল পিজি : অবসাদের ছোবলে অন্ধত্ব | সাইকোজেনিক ব্লাইন্ডনেসের ঘটনা, যেখানে অপটিক্যাল নার্ভের পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল অবসাদ। | _ |
| পিজিতে চিকিৎসা : স্পন্দনের তালে হেঁচকি, এপার বাংলায় সুস্থ ওপারের যুবক | পারসিসটেন্ট হিকক্যাপ উইথ অ্যাবনর্মাল মুভমেন্ট ডিসঅর্ডার থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের যুবক কে. এম. হাসিবুল। | _ |
| রোগের ফেরে একাধিক যৌন সম্পর্কে স্ত্রী, স্বামী তবু পাশেই | নিম্ফোম্যানিয়াক ডিজিজ উইথ সাইকোটিক ডাইমেনশন নামক এই রোগে অস্বাভাবিক যৌনচাহিদা, যেকোনো কারো সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রবণতা, কাল্পনিক কারোর কণ্ঠস্বর শোনা। | _ |
| নড়ে চড়ে দুলে চলা রোগিনী সুস্থ মনোচিকিৎসায় | বিরল গোত্রের ইনভলান্টারি মুভমেন্ট ডিসঅর্ডার ও মনোবিকারের শিকার সান্ত্বনা বিবি সুস্থ হয়ে ওঠেন চিকিৎসায়। | এই সময় |
| ওপার থেকে এপারে : মাথায় জমেছে বরফ, সুস্থ করল কলকাতা | বাংলাদেশের হামিদা খাতুনের রোগটা ছিল ৮ বছরের, ‘পিকিউলিয়ার সাইকোটিক ডিসঅর্ডার অ্যান্ড রিফ্র্যাকটরি ইন নেচার’। কখনো তার মাথায় তুষারপাত তো কখনো আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, বহুবার স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রচেষ্টা, বারবারই ব্যর্থ। অবশেষে সেরে ওঠেন আই ও পি থেকে। | _ |
| থামল ক্যাসেট : এপারের সম্মোহনে ওপারের শাপমুক্তি | অন ডিফারেনশিয়েটেড সিজোফ্রেনিয়া গোত্রের একটি রোগ, যেখানে শিকার মনে করতে শুরু করেছিলেন যে, তার মাথায় একটি ক্যাসেট ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। টানা পনেরো বছর তাই তার মাথার মধ্যে ক্যাসেটের চিল-চিৎকার শুনে শুনে অতিষ্ট হতেন তিনি। ক্রনিক নন-অ্যাফেক্টিভ সাইকোসিসের কেস, যা সঠিক চিকিৎসায় সেরে যায়। | _ |
| মনের চিকিৎসায় সচল হল তরুণীর অসাড় পা | প্যারাপ্লেজিয়া সাইকোজেনিক ইন অরিজিন। | _ |
কোনো কোনো স্টলে বসেছেন IOP-এর এককালের মনোরোগীরা, যারা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। তারা কেউ কেউ নিজেদের হাতে আঁকা ছবি নিয়ে মেলায় বসেছেন দর্শনার্থীদের দেখাতে ও বিক্রি করতে। তেমনই একজন বলছিলেন, ছোটো থেকেই তিনি ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। মনোরোগের কবলে পড়ার পর তিনি ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছিলেন বিতৃষ্ণায়। ডাক্তারদের দেওয়া ভরসায় তিনি আবার এই ছবি আঁকার মধ্যে দিয়েই জীবনের রঙ খুঁজে পান। আসলে কলকাতা মানসিক স্বাস্থ্য মেলার সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ আর অনুপ্রেরণাই ছিলেন এইসব মানুষ, যাদের বলাযায়, মনোরোগ বিষয়ে সচেতনতা গঠনের জীবন্ত উদাহরণ।
এক বোধ কাজ করে
মনোরোগীর সামাজিকীকরণের উদ্যোগ সমাজের এক বোধ জাগরণের গল্প। মানসিক স্বাস্থ্য মেলা মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের ইতিহাসে এক নবতম সংযোজন। মনোরোগীর সামাজিকীকরণে এটি কীভাবে আরও ইতিবাচক হতে পারে, সে বিষয়টি এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। সেই পর্যন্ত টুকাই ও তাঁর বন্ধু-বান্ধবের গাছে ঝোলানো আয়নার উদ্দেশ্যকে সার্থক করে তোলার দায়িত্ব সমাজের বাকি অংশের।
তথ্যসূত্র :
[১] মানস থেকে সংগৃহীত লিফলেট (তারিখ অনুল্লেখিত)।
[২] Sumeet Jain & Sushrut Jadhav, ‘A Cultural Critique of Community Psychiatry in India’, International Journal of Health Services, Vol. 38, No.: 3, 2008, p. 561-584.
[৩] N. N Wig, Srinivasa Murthy & W. Harding, ‘A model for Psychiatric Service: Raipur Rani Experiences’, Indian Journal of Psychiatry, vol. 23, No.: 4, 1981, p. 275-290.
[৪] ‘How an art exhibition at a Kolkata hospital became an interface between two worlds’ The Hindu, March 15, 2019 03:58 pm, Updated March 16, 2019 12:21 pm IST.
[৫] সুব্রত সিংহের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বর্তমান গবেষক ২০১৯ সালে।
[৬] ‘মেলার মজা’, সুশান্ত দত্ত, আনন্দ নিকেতন গ্রামীণ মেলা, আনন্দ নিকেতন, বর্ধমান, ২০১৫, পৃ. ১৯।
[৭] বর্তমান গবেষক কর্তৃক সংগৃহীত।