ফ্রয়েডের মনোবিকলন-তত্ত্ব এবং বাংলা ছোটোগল্প

সঞ্জীব দাস

১৮৯৯ সাল। ভিয়েনায় প্রকাশিত হল একটি বই, ‘Die Traumdeutung’, ইংরেজি অনুবাদে ‘The Interpretation of Dreams’। ভিয়েনার স্নায়ুচিকিৎসক সিগমন্ড ফ্রয়েড বইটির রচয়িতা। এই গ্রন্থেই তিনি বহু আলোচিত মনোবিকলনবাদের নান্দীপাঠ করেন। আদতে সাইকোঅ্যানালিসিস মনোরোগ চিকিৎসার একটি পদ্ধতি। পরবর্তীকালে তা-ই হয়ে উঠল সাড়া জাগানো তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মূলকথা হল যৌনাকাঙ্ক্ষাই মানুষের মনোজগতের নিয়ন্তা। শুধু তাই নয়, মানবজগতের সবকিছুকেই তার যৌনাকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে। ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মনের দুটি অংশ: একটি সচেতন অংশ (the conscious mind) ও আরেকটি অচেতন অংশ (the unconscious mind)। এই দুই অংশের কার্যাবলিকে তিনি তিন ভাগে ভাগ করেছেন : das Es(id), das Ich(ego) und das. Über-Ich(superego)। মানুষের সকল কার্য লিবিডো নিয়ন্ত্রিত। লিবিডো সহ যাবতীয় আকাঙ্ক্ষার সম্মিলিত নাম Id. শিশু বড়ো হতে হতে বুঝতে পারে যে, বাস্তব জগতে তার সকল আকাঙ্ক্ষার অনেক কিছুই অনৈতিক এবং তাই বাস্তবে পূরণীয় নয়। তখন সে নৈতিকতা, বাস্তব ও তার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটি সামঞ্জস্য সাধনের চেষ্টা করে। এই প্রয়াসের মধ্য দিয়ে অর্জিত সেই মধ্যবর্তী জায়গাটিই হল ইগো। ইগোতে পৌঁছতে হলে ইদকে মনের সচেতন অংশ থেকে সরাতে হয়। এই সরানোর অনেকগুলো প্রক্রিয়া আছে। যেমন, repression, displacement, denial, projection এবং regression। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্রক্রিয়া হল রিপ্রেশন বা অবদমন। এই প্রক্রিয়ায় সকল অবদমিত কামনা মনের সচেতন অংশ থেকে সরে গিয়ে অচেতন অংশে জমা হয়। এইভাবে ইগো বাস্তবতা ও নৈতিকতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। আর সুপারইগোর কাজ হল, নৈতিকতার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে সমাজের সকল প্রকার নৈতিক বিধিনিষেধ সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সে অনুযায়ী নিজের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণের মানসিক প্রয়াস সাধন।

ফ্রয়েডের এই তত্ত্ব প্রভাবিত করেছে সাহিত্য জগতকেও। একদা বাংলা সাহিত্যিকদেরও তাঁর লিবিডো এবং মনোবিকলন তত্ত্ব গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। জগদীশ গুপ্ত, শৈলজানন্দ, মানিক, তারাশঙ্কর প্রমুখের গল্প পাঠ করলেই তা স্পষ্টভাবে বোধগম্য হয়। বাংলা গল্পে মনোবিকলন তত্ত্বের প্রভাব জরিপ করতে বসে যাঁর কথা প্রথমেই মনে পড়ে তিনি জগদীশ গুপ্ত। মানুষের মনের গহনে তিনি বারংবার অনুসন্ধানী দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছেন। মানুষের বাইরের আচরণ এবং মানসকূটের সামঞ্জস্য খুঁজতে হয়েছেন প্রয়াসী। মানুষের বাইরের আচরণের নিয়ন্তা যে সেই গহন মন, তা তিনি একজন মনোবিজ্ঞানীর মতোই বুঝেছিলেন অনায়াসে। আর সেই উপলব্ধিই তাঁকে নিয়ত প্রাণিত করেছে মানুষের চেতন সত্তার আড়ালে যে অবচেতন সত্তার ক্রীড়া চলেছে — সেই ক্রীড়া নিয়ন্ত্রিত মানুষের জীবনকে তুলে ধরতে। ‘বিধবা রতিমঞ্জরী’ থেকে ‘চন্দ্রসূর্য যতদিন’, ‘অরূপের রাস’, ‘শঙ্কিত অভয়া’ ইত্যাদি বেশকিছু গল্পে তিনি ফ্রয়েডের মনোবিকলন তত্ত্বের প্রয়োগ যেভাবে ঘটিয়েছেন তার জুড়ি মেলা ভার। উদাহরণ হিসেবে প্রথমে ‘শঙ্কিত অভয়া’ গল্পের কথাই ধরা যাক। তিনটি চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠছে এই গল্পের আখ্যান — অভয়া, অতুল এবং শান্তিময়ী। অভয়া জননী। শান্তিময়ী তার সন্তান। আর অতুল তার স্বামী। অতুলের সঙ্গে কন্যা শান্তিময়ীর খোলামেলা সম্পর্ক। ফুটবল থেকে চলচ্চিত্র, প্লেটোনিক প্রেম থেকে যৌনতা সবকিছু নিয়েই তাদের খোলামেলা আলোচনা চলে। অভয়া আড়াল থেকে সবকিছু শোনে। আর সঙ্কুচিত হয়। বাবা-মেয়ের এরকম আলোচনা হতে দেখে তার বিবমিষা জাগে। দু’জনকে নিবৃত্ত করতে দুজনকেই সে তীক্ষ্ণ বাক্যশরে বিদ্ধ করে। কিন্তু লাভ হয় না। বরং তার প্রতিক্রিয়া সেকেলে বলে তাদের ঠাট্টা বিদ্রুপের শিকার হয়।

এই পর্যন্ত পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে এযেন একজোড়া আধুনিক পিতা-কন্যা এবং তাদের বিপরীতে এক অনাধুনিক, সনাতন জীবনাদর্শে বিশ্বাসী মায়ের আখ্যান পড়ছি। কিন্তু এরপরেই এল অভয়ার সেই অস্তিত্বের মূল ধরে কাঁপিয়ে দেওয়া সংলাপ : “বল সত্যি করে শান্তি, ও তোকে নষ্ট করেনি তো?” মেয়ে বাবার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে রাত করে ফিরেছে। এর জন্য তিরস্কার তো হতেই পারে। তার জন্য কোনও মা এরকম অশ্লীল বাক্য মেয়েকে বলতে পারে! একটু পরেই তার একটি নিরীহ বাক্য থেকে জানা যায় তার এমন আচরণের নিহিত মনস্তাত্ত্বিক কারণ : “ও তোর বাবা নয়, কেউ নয়; তোকে নিয়ে ওর সঙ্গে কুলত্যাগ করেছিলাম।”

এই বাক্যটি না থাকলে আখ্যানটি অবৈধ সম্পর্কের সাধারণ আখ্যানে পরিণত হত। পরিবর্তে এই বাক্যাটির বদান্যতায় এটি মনোবিকলন তত্ত্বের এক অসামান্য শিল্পভাষ্য হয়ে দাঁড়াল। আসলে লিবিডোর দুর্নিবার তাড়নার বশীভূত হয়ে একদা অভয়া স্বামীর ঘর ছেড়েছিল। এরজন্য একপ্রকার অপরাধবোধ তার অবচেতন মনে ছিলই। সেই অপরাধবোধ থেকেই শান্তি ও অতুলের সম্পর্ক নিয়ে সে সন্দেহ করে। তার আচরণে দেখা যায় অস্থিরতা। আখ্যানের উপান্তে এসে দেখি সে মনের ভাব আর গোপন রাখতে পারল না। শান্তির সম্মুখে সে অকপটে নিজের মনোভাব উগরে দিল।

‘বিধবা রতিমঞ্জরী’ও মনোবিকলনধর্মী গল্প। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র রতিমঞ্জরী একজন বিধবা। স্বামীর মৃত্যুর পর সে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয় ‘বিবাহার্থিনী বিধবা’ শিরোনামে। এগারো বছরের দাম্পত্য জীবন যাপনের পর তার ধারণা হয় স্বামী তাকে বিয়ে করেছিল সুলভে গণিকা পাওয়ার লোভে। বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে এক ব্যক্তি তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। লোকটির সঙ্গে কথা বলে তার এই বিশ্বাস আরও গভীর হয় যে বৈবাহিক সম্পর্কে পুরুষেরা দেহাতীত কোনও প্রেম চায় না, তাদের চাই লোভনীয় নারী মাংস। এই উপলব্ধি থেকে তার সিদ্ধান্ত : “তার গণিকাবৃত্তিই পৃথিবী চায় – গণিকাই সে হবে”। আখ্যানটিকে ফুকোর ক্ষমতাতন্ত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তো যায়-ই। কিন্তু সব তত্ত্ব ছেড়ে দিয়ে যদি রতিমঞ্জরীর মনের গহন তলে তাকাই তো কী দেখব? রতিমঞ্জরীকে স্বামী দেখেছিল ‘সেক্স অবজেক্ট’ হিসেবে। এরজন্য তার নারী সত্তা আহত হয়েছে। তাকে বিবাহ করতে আসা নতুন লোকটির সঙ্গে কথা বলে তার মনে হয়েছে সে-ও নারী মাংসই চায়। বুঝতে পারে, এটাই পুরুষ জাতির Basic Instinct। তাই সে নাকি চলল দাপুটে গণিকা হতে! কিন্তু সত্য কি এতটুকুই? নাকি আরও সত্য আছে? পাঠক এবিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে রতিমঞ্জরীকে একটু মিলিয়ে নিই। তখন আমি একটি স্কুলে পড়াই। পরিচয় হয়েছিল অন্য এক স্কুলের দিদিমণির সঙ্গে। দিদিমণি সুলভ ভাবসাব এতটুকুও তাঁর ছিল না। বিবাহিতা। কিন্তু শাড়ি বদলানোর মতো বয়ফ্রেন্ড বদলাতেন। কামনার প্রকাশও ছিল একেবারে বেয়াব্রু। আমি তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আরও দিদিমণি আছেন, কতো মেয়ে দেখেছি তাদের তো এমন দেখেনি। আপনি এরকম খাই খাই করেন কেন? তিনি বলেন, খিদে আছে খাই। লজ্জা কেন? আরে ওদেরও পুরুষ খাবার ইচ্ছা আছে। শুধু সমাজের ভয়ে নিজেদের ইচ্ছাকে দমিয়ে রেখেছে। আমার মতে, রতিমঞ্জরীও এদেরই মতো ছিল। ভিতরে কামনার আগ্নেয়গিরি সুপ্ত অবস্থায় ছিল। সমাজ-সংস্কারের দিকে তাকিয়ে সে নিজের যৌন কামনাকে অবদমিত করে রেখেছিল। কিন্তু যখন পুরুষের প্রেমের আসল রূপটি জানা হয়ে গেল তখন সে বিদ্রোহ করল। তার ভিতরের পশুসত্তা সকল প্রকার সংস্কার ঝেড়ে ফেলে, আত্ম-অবদমনকে প্রত্যাহার করে এসে দাঁড়াল খোলা আকাশের নিচে। স্থির করল সে গণিকা হবে। পুরুষ যদি বহুনারী ভোগ করতে পারে, তবে সে কেন বহু পুরুষের স্বাদ নিতে পারবে না? নারীর গহনমনের বন্য কাম-বাসনা ও অবদমনের দিকটি একেবারে নগ্ন করে দিয়েছেন লেখক রতিমঞ্জরীকে আশ্রয় করে।

তাঁর ‘প্রলয়ঙ্করী ষষ্ঠী’ গল্পটিরও আলম্বন বিভাব নারীর গহনমনে স্থিত কামবাসনার আশ্চর্য লীলা। আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রভাবশালী ব্যক্তি সদু খাঁ। তাঁর দোতলা দালানে থাকে পাঁচ বিবি, দাসী বাঁদী খানসামা পরিচারকবৃন্দ। একবার ব্যবসার জন্য এক গ্রামে গিয়ে সেখানকার জনৈক জসীমের স্ত্রীকে তার পছন্দ হয়। জসীমের পরিবারের সঙ্গে সে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। নিজের ভাইয়ের বিয়ের কথা বলে জসীমের বৌকে নিজের বাড়িতে এনে রাখে। কিছুদিন পরে জসীম দেখা করতে গেলে সে তাকে তাড়িয়ে দেয়। অর্জুন নম:শূদ্রের সাহায্যে তার লাঠিয়াল বাহিনীকে পরাজিত করলে গ্রামীণ নিয়ম অনুযায়ী নিজের বৌকে ফেরত পাওয়ার কথা জসীমের। কিন্তু আখ্যানের শেষ দুটি লাইন আমাদের একবারে চমকে দেয় : “জসীম তার বৌকে ফিরিয়া পায় নাই। বৌ নিজেই আসিতে চায় নাই”। নারীর যৌন কামনার রহস্যময়তার দিকটি এখানে প্রাণস্পর্শী হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে ‘অরূপের রাস’ নারীসমকামিতার আখ্যান। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র রাণুর অবচেতন মনের বিচিত্রগতি আমাদের চমকে দেয়। কথক কানুর সঙ্গে তার বেড়ে ওঠা। কানুর প্রতি তার মনের গহনে প্রবল যৌন আকর্ষণ ছিল। কিন্তু বিবাহ হয় অন্যত্র। ফলে তার কামনা অতৃপ্ত থেকে যায়। তবে মনের গভীরে থেকেই গিয়েছিল কামনার বীজ। বিবাহের অনেকদিন পরে সে কানুর বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে আসে। কানুকে সামনে পেয়ে সেই সুপ্ত কামনা জেগে ওঠে। কিছুকাল পরে অফিস থেকে আসে স্বামীর পুনরায় বদলির সংবাদ। জানা গেল যাবার পূর্বে সে কানুর স্ত্রী ইন্দিরার সঙ্গে একরাত্রি কাটাতে চায়। সে ইন্দিরাকে বলে “তুই আর আমি এক হয়ে যাই”। এক নারী অপর নারীর সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার বাসনা কি শুধুই সমকামিতা? না, তা যে নয় বরং তার কাছে সমকামিতা যে একটা মাধ্যম. তা কিছু পরেই স্পষ্ট হয়ে যায়। জানা যায় তার মুখ্য উদ্দেশ্য হল ইন্দিরার অঙ্গসান্নিধ্যের মধ্য দিয়ে কানুর সঙ্গে মিলন সুখ আস্বাদন। অর্থাৎ রূপ নয়, অরূপের মধ্যে দিয়ে নিজেকে স্বামী আর ইন্দিরাকে স্ত্রী ভেবে যৌনসুখ আস্বাদনের এক নতুন মাত্রা যেন সে আবিষ্কার করে। এই আখ্যান প্রকৃতই যেন কমলকুমার মজুমদারের ‘মল্লিকাবাহার’ গল্পের পূর্বসূরি।

পরবর্তী সময়ের ‘বিকল্প বাস্তববাদী’ শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের প্রথমদিকের বেশ কিছু গল্পে মনোবিকলনের প্রবণতা স্পষ্ট। ‘নারীর মন’, ‘জননী’, ‘বধূবরণ’ ইত্যাদি গল্পে মনোবিকলন সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। বিশেষত ‘বধূবরণ’ গল্পের কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। এটি গ্রামের মধ্যবিত্ত জীবনের আখ্যান। এই আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র ননীমাধব। সে বাসন্তী ও গ্রামের অন্যান্য মেয়েদের পত্রলেখক। চিঠি লেখা থেকে বউ বউ খেলা সবই চলে। সে অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করলে বাসন্তী ঈর্ষান্বিত হয়। আসলে বাসন্তীর মনের গহন প্রদেশে ননীমাধবকে কেন্দ্র করে কামনার মেঘ বাসা বেঁধেছিল। সেই লিবিডোর থেকে জেগে উঠছে ঈর্ষা। আর সেই ঈর্ষাই তাকে বেপরোয়া করে তুলেছে। তবে বাসন্তীর মনোলোকের রহস্য উদঘাটন লেখকের উদ্দেশ্য নয়। ননীমাধবের মনোবিকলনের প্রকৃতি উন্মোচনের দিকে তিনি জোর দিয়েছেন। আখ্যানের শেষদিকে দেখি সে বিবাহিত স্ত্রীকে অচেনা স্টেশনে ফেলে রেখে তার গয়নার বাক্স নিয়ে অন্য ট্রেনে উঠে বসেছে। কিন্তু সে এমন কার্য করল কেন? একজন কুশলী মনোবিজ্ঞানীর মতো তা তিনি বুঝেছেন এবং পাঠকদেরও বোঝাতে প্রয়াসী হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন বিবাহিত নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে এবং নিজের মামীর যৌনকামনার শিকার হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তার মনের ‘ইদ’-এ এই ধারণাই দৃঢ়মূল হয়ে বসেছিল যে, মেয়েমাত্রেই বিশ্বাসঘাতিনী, কামুক। এই ধারণাই তাকে স্টেশনে ফেলে চলে আসার মতো ঘৃণ্য কার্য করতে প্রেরণা জোগায়। কিন্তু ইগো এবং সুপার ইগো জেগে উঠলে মানুষ তো পাল্টেও যায়। আখ্যানের সমাপ্তিতে দেখি ননীমাধবও বদলে গেছে। গৌরীকে ফেলে আসার পর তার মধ্যে অন্তর্দাহ শুরু হয়। সে ভাবে “নিখিলব্যাপী এই মিথ্যাচারের বাহিরে সত্যবস্তু হয়ত-বা কোথাও কিছু থাকিতেও পারে”। ইদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে তার ইগো এবং সুপার ইগো জয়যুক্ত হয়। তাই সে পরের স্টেশনেই ট্রেন থেকে নেমে পড়ে। এবার তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফেরার পালা।

মনোবিকলনধর্মী বাংলা গল্পের কথা আলোচনায় জগদীশ গুপ্ত, শৈলজানন্দ প্রমুখের পরেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা অবশ্যম্ভাবীভাবে চলে আসে। বস্তুতপক্ষে, মানিকের কথাসাহিত্যের একটি অন্যতম প্রধান ভরকেন্দ্র মানুষের মনের গহন স্তরে নিহিত জৈবকামনার রহস্যময় ক্রীড়া। তাঁর সাড়া জাগানো ‘অতসী মামী’, ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘সরীসৃপ’ ইত্যাদি গল্পে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের ছাপ আছে। ‘অতসী মামী’ গল্পে দেখি বংশীবাদক যতীন মামা যেখানে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যায় সেখানে প্রতি বৎসর তার স্ত্রী অতসী মামী এসে বাঁশি বাজিয়ে স্বামীর জন্মদিন পালন করেন। কোনো কোনো সমালোচক এই ঘটনার বর্ণনাকে ভাবালুতার উদাহরণ বলে মনে করেছেন। কিন্তু সাইকো অ্যানালিসিস সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান থাকলে বোঝা যায় এরকমটা আসলে ঘটেছে মনোবিকলনের তাড়নায়। এইভাবে দুর্ঘটনাস্থলে এসে বাঁশি বাজিয়ে মৃতস্বামীর জন্মদিন পালন আসলে তার মনের গহন স্তরে জমে ওঠা অতলান্ত বেদনারই প্রতীক। এরকমটি বাস্তবেও কম ঘটেনি। একদিকে গভীর জীবনাভিজ্ঞতা এবং অন্যদিকে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের তীক্ষ্ণ জ্ঞান থেকেই এই গল্পের জন্ম, একথা কি অস্বীকার করা যায়! অন্যদিকে ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে মানুষের নিয়ন্তা যে জৈবিক তাড়না বা লিবিডো ফ্রয়েডের এই নিরীক্ষণ কেন্দ্রীয় চরিত্র ডাকাত ভিখুর জীবন আখ্যানের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। ভিখু পেশাদার ডাকাত। খুন, ডাকাতি ও রাহাজানি করে আনন্দ পায়। মানুষ খুন করতে সে মোটেও ভয় পায় না। সে একদা বসন্তপুর নিবাসী বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করতে গিয়ে কাঁধে বর্শার খোঁচায় আহত হয়। দুর্দান্ত ডাকাত থেকে একজন পঙ্গু মানুষে সে পরিণত হয়। তাকে তার স্যাঙাৎ পেহ্লাদ বাগদি উদ্ধার করে নিজ গৃহের অদূরবর্তী জঙ্গলে মাচা বেঁধে তার উপর থাকার ব্যবস্থা করে। কয়েকদিনেই অযত্নে-অচিকিৎসায়-অনাহারে তার অবস্থা সঙ্গিন হয়ে ওঠে। উপায়ান্তর না দেখে পেহ্লাদ তাকে স্বগৃহে নিয়ে এসে খড়ের উঁচু গাদার উপর থাকবার ব্যবস্থা করে দেয়। সকলেই ভেবেছিল সে মারা যাবে। কিন্তু সকলকে অবাক করে সে প্রাণে বেঁচে যায়। তবে তার ডান হাতটি চিরতরে অকেজো হয়ে যায়। ভিখু যে এইভাবে বেঁচে উঠল তার নিহিত কারণ তার লিবিডো। এই লিবিডোর অন্তঃশীল শক্তিই তার মৃতপ্রায় দেহে প্রাণের সঞ্চার করল। এই লিবিডোর তাড়নাতেই সে পেহ্লাদের স্ত্রীকে ভোগ করতে চায়। তার মধ্যে যে প্রবল যৌনক্ষুধা ছিল তা প্রকাশ পেয়েছে আখ্যানের পরবর্তী অংশেও। সে নদীর ঘাটে মেয়েরা স্নান করতে নামলে ভিক্ষা চাইবার ছলে জলের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। মেয়েরা ভয় পেলে সে খুশি হয় এবং সরে যেতে বললে নড়ে না, দাঁত বের করে দুর্বিনীত হাসি হাসে। রাতে স্বরচিত শয্যায় সে কামবাসনায় ছটফট করে। নারী-সঙ্গহীন এই নিরুৎসব জীবন আর তার ভালো লাগে না। অতীতের উদ্দাম ঘটনাবহুল জীবনের জন্য তার মন হাহাকার করে। আখ্যানের শেষাংশে দেখা যায়, সে যখন নারী সঙ্গের জন্য পাগল-প্রায় তখন ভিখারিণী পাঁচীর দিকে তার চোখ পড়ে। সে তার সঙ্গে ভাব জমায়। কিন্তু পাঁচী তাকে পাত্তা দেয় না। সে তার পছন্দের মানুষ বসির মিঞার কথা বলে। সেই বসির তার সঙ্গে ঝগড়াতেও জড়িয়ে পড়ে। সবশেষে দেখা যায়, একদিন গভীর রাতে সে বসিরকে খুন করে এবং তারপর পাঁচীকে কাঁধে তুলে নিয়ে আদিম উল্লাসে পা বাড়ায়। আমরা জানি মানিকের উপর ফ্রয়েডের ‘যৌন সর্বস্ববাদ’ (Pan-Sexuality)-এর প্রভাব পড়েছিল। ভিখু সেই প্রভাবেরই ফলশ্রুতি।

এরপর আসা যাক, ‘সরীসৃপ’ গল্পের কথায়। গল্পের নামকরণেই ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের ছাপ স্পষ্ট। চারু-বনমালী-পরী, এই এয়ী নারী পুরুষের বিচিত্র সম্পর্ক এবং তাদের মানসকূট নিয়ে এই আখ্যান গড়ে উঠেছে। বিকৃত মস্তিস্ক স্বামী ও মনোরোগী পুত্র ভুবনের মাঝখানে পড়ে চারুর সৌন্দর্য ও যৌবন নিতান্ত‌ই মূল‍্যহীন হয়ে পড়ে। সেই সময় শ্বশুরের মোসাহেবের পুত্র বনমালী তার প্রতি আকর্ষিত হলেও সে তাকে নিয়ে খেলা করে। কিন্তু অবস্থা ও সময়ের পরিবর্তনে সেই চারু এখন বিধবা। এখন তার আশ্রয়দাতার বিশ্বাস অর্জন করেছে পাটের দালাল সে-ই বনমালীই। কিন্তু এখন আর চারুর শরীর বনমালীকে আকর্ষণ করে না। “চারুর মাথার চুলের কালিমা ফ‍্যাকাসে হ‌ইয়া আসিয়াছে কেবল এইটুকু লক্ষ‍্য করিয়া আবার সে আহারে মন দিল” — কথকের এই বর্ণনা চারুর প্রৌঢ়ত্ব এবং বনমালী ও চারুর সম্পর্কের দূরত্বের চিহ্নায়ক। এই পর্যন্ত আখ্যান প্রত্যাশিত দিকেই এগোচ্ছিল। কিন্তু চারুর বোন বিধবা হয়ে তাদের গৃহে আশ্রয় নিলে ঘটনার গতি অন্যদিকে মোড় নেয়। পরী যৌবনের বন্যায় বনমালীকে কুক্ষিগত করতে চায়, নিরাপদ করতে চায় নিজের‌ ও সন্তানের ভবিষ‍্যৎ। নিজের এবং তার মানসিক বিকৃতিগ্রস্ত সন্তানের ভবিষ‍্যতের অনিশ্চয়তা চারুকে উদ্‌বিগ্ন করে। সে মরিয়া হয়ে বোন পরীর সঙ্গে ঘৃণ‍্য প্রতিযোগিতায় নামে। কলেরা রোগীর ভেদবমির পাত্রে পরীকে তারকেশ্বরের প্রসাদ দেয়, যাতে কলেরায় পরীর মৃত‍্যু হয়। কিন্তু ভাগ‍্যের পরিহাসে চারুই কলেরায় মারা গেল। ভাবা গিয়েছিল, পরী ও বনমালীর নির্বিঘ্ন মিলনের কথায় আখ্যানের সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু আবারও আখ্যানের বাঁক বদল ঘটল। দেখা গেল বনমালীর স্নেহ ভালোবাসা মানসিক রোগী ভুবনের প্রতি জেগে ওঠে। অন্যদিকে সে পরীর প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। পরী এইসব সহ‍্য করতে না পেরে পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে মনস্থ করে। সে ভুবনকে গাড়িতে তুলে পাঠিয়ে দেয় অজানা ভবিষ‍্যতের দিকে। বনমালী সব বুঝেও চুপ থাকে। এপ্রসঙ্গে তার স্পষ্টোক্তি — “আপদ গেছে যাক”।আর তারপর নির্বিকার চিত্তে পরীকে নামিয়ে দেয় নিচে ঝি চাকরের চেয়েও অধম অনুগৃহীতদের মধ‍্যে।

সত্যকারের মনোবিকলনের গল্প। বিষয়টা অন্যভাবে বোঝাই। ধরা যাক, চারু এবং পরীকে তাদের অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করে বিচারকের কাছে আনা হল।কিন্তু তিনি কীভাবে তাদের কী শাস্তি দেবেন? চারু কেনই বা বোনকে মারতে চাইল, কেনই বা পরী ভুবনকে নিরুদ্দেশের পথে ঠেলে দিল — এর যথার্থ কারণ তিনি কীভাবে বুঝবেন? বুদ্ধিমান বিচারক হলে তাদের মনোচিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন। একমাত্র তিনিই এদের মনের রহস্য বুঝতে পারবেন। কিংবা বনমালী? যদিবা চারু ও পরীর আচরণের বাস্তব চাওয়া পাওয়া কেন্দ্রিক ব্যাখ্যা হয়-ও, কিন্তু বনমালীর আচরণের কী ব্যাখ্যা হবে! তার গহন মনের কোন দুরূহ কোণে চারুর প্রতি এত ভালোবাসা প্রচ্ছন্ন ছিল! যদি ভালোবাসা না-ই বা থাকবে তবে ভুবনের প্রতি তার এত সহানুভূতির কারণ কী? আবার ভুবনের চলে যাওয়ার বিষয়ে তার এই ঔদাসীন্যই বা কেন?

‘সরীসৃপ’ ছাড়াও এই গল্প সংকলনের ‘মহাকালের জটার জট’, ‘বিষাক্ত প্রেম’ গল্পদুটিও মনোবিকলন প্রধান গল্প। ‘বিষাক্ত প্রেম’ গল্পের কুশীলব সরলা এবং সত্যের জীবন আখ্যানের বর্ণনায় লেখক মন:সমীক্ষণ তত্ত্বের একটি বিশেষ দিক repression বা অবদমন তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তারা দুইজন প্রেমের অভিনয়ে প্রবৃত্ত হয়েছিল। সেই অভিনয়ে আকস্মিকভাবে দেখানো হয় উচ্চতরবোধের জাগরণ। আসলে যাপিত জীবনে মনের গহনে এই বোধ অবদমিত ছিল। অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তা উপরিতলে উঠে এল। Repression-এর বিপরীতে এই ঘটনাকে Sublimation-এর আশ্চর্য উদাহরণ বলা যায় কি?

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা গল্পেও ফ্রয়েডের লিবিডো তত্ত্বের পদার্পণ ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে ‘ছুরি’ গল্পের কথা মনে আসে। এটি এককথায় লিবিডো তাড়িত একজন মানুষের নৃশংস খুনিতে পরিণত হওয়ার তীক্ষ্ণ আখ্যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কলকাতা এই আখ্যানের পটভূমি। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নগেন কলকাতার এক লোন অফিসের মালিক। সে ত্রিশ বছরের প্রাণবন্ত যুবক, বিবাহিত। কিন্তু তার স্ত্রী ক্ষণিকা দুটি মৃত সন্তানের জন্ম দিয়ে তেইশেই অকাল বার্ধক্যকে আলিঙ্গন করেছে। একদিন এক বিদেশি ছুরি তার হাতে এসে পৌঁছয়। সে পাঁচ টাকার বিনিময়ে ছুরিটি বন্ধক রাখে। এতদিন তার মনের গহনে যে যৌনাকাঙ্ক্ষা অবদমিত ছিল ছুরিটি সেই অবদমিত আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তোলে। ছুরিটি কার্যত তার সেই অবদমিত লিবিডোর প্রতীক হয়ে ওঠে। সেই ঘুমন্ত ভিসুভিয়াসের জাগরণ ঘটে তীব্র জিঘাংসায়। রাতে ফেরার পথে সে সেই ছুরি দ্বারা নিজের দোকানের নরম তাকিয়ায় তীব্র আঘাত করে এক অনাবিল স্বর্গসুখ অনুভব করে। রাতে ফেরার পথে সেই ছুরি দিয়ে একটি নিরীহ কুকুরকে খুন করে। এরপর সেই ছুরির বলি হয় একের পর এক সাধারণ মানুষ। শেষ বলি তার ঘুমন্ত স্ত্রী। পরে ছুরির মালিক এসে সেই ছুরি ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। সে খালাস পায় এক ডাকাতের ঘাড়ে স্ত্রীর মৃত্যুর দায় চাপিয়ে। তারপর সে এক নবযৌবনাকে বিয়ে করে। তার এই নতুন জীবন-অধ্যায়ের কথায় আখ্যানের সমাপ্তি।

এটি একেবারে মনোবিকলনের ক্ল্যাসিক আখ্যান। ইগো এবং পরবর্তীকালে সুপার ইগোর ক্রিয়ায় এই আকাঙ্ক্ষা মনের গহনে চলে যায়। এখানে, ছুরিটি সেই অবদমিত যৌনতার প্রতীক। ছুরিটি হাতে পেয়েই তার অবদমিত কামনা জেগে উঠল। আর ওই ছুরি সে নরম গদি থেকে শুরু নরম শরীরে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে নিজের অবদমিত যৌন কামনাকে পরিপূর্ণ করল। এইভাবে নিরীহ ছুরিটি লিঙ্গের প্রতীক হয়ে উঠল।

মানিকের পরবর্তীকালের লেখক যাঁরা ফ্রয়েডের মনোবিকলন তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে সুবোধ ঘোষ এবং জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সুবোধ ঘোষ এই নামটি উচ্চারণ করলেই আমাদের যে গল্পটির কথা সর্বাগ্রে মনে পড়ে, সেই ‘অযান্ত্রিক’ গল্পে ফ্রয়েডীয় ভাবনার ছাপ আছে। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিমল ট্যাক্সি ড্রাইভার। সে একটি ফোর্ড গাড়ি চালায়। পুরনো ভাঙাচোরা গাড়ি হলেও সে তাকে প্রাণে ধরে বিক্রয় করতে পারে না এতটাই তার প্রতি ভালোবাসা। শেষ পর্যন্ত তাকে এক লোহার কারবারির কাছে অবশ্য বিক্রয় করতেই হয়। সেই লোহার কারবারি যখন তার যন্ত্রাংশ গুলো একে একে খুলতে থাকে তখন বিমলের প্রতিক্রিয়ার বর্ণনা লক্ষণীয় :

জগদ্দলের পাঁজর খুলে পড়ছে একে একে। বিমলের চৈতন্যও থেকে থেকে কোন অন্তহীন নৈঃশব্দের আবর্তে যেন পাক দিয়ে নেমে যাচ্ছে অতলে। তারপরই লঘুভার হয়ে ভেসে উঠছে ওপরে। এরই মাঝে শুনতে পাচ্ছে বিমল, ঠং ঠং ঠকাং ঠকাং, ছিন্নভিন্ন ও মৃত জগদ্দলের জন্য কারা যেন কবর খুঁড়ছে। ঠং ঠং ঠকাং ঠকাং, যেন অনেক কোদাল আর অনেক শাবলের শব্দ।

বস্তুবিশেষের প্রতি এই আসক্তিকেই fetish বলা হয়। যৌন আকাঙ্ক্ষার অবদমনের প্রতিক্রিয়ার গর্ভেই এর জন্ম!

অন্যদিকে তাঁর ‘সুন্দরম’ বাঙালি মধ্যবিত্তের আদর্শবাদের ভণ্ডামির স্বরূপ উন্মোচন করে। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুকুমার। সে ব্রহ্মচর্য পালন করে। বারো বছর বয়স থেকে নিরামিষ, ফোঁটা তিলক ধরেছে সে। আজও পায়ে সেধে তাকে মুসুরির ডাল খাওয়ানো যায় না। সাহিত্য, কাব্য তার কাছে অস্পৃশ্য। পাঠ্যপুস্তক ছাড়া জীবনে সে পড়েছে ক’খানি যোগশাস্ত্রের দীপিকা। তার এই নিরাসক্তির ভাব যে মেকি, আসলে তার ভিতরে সুপ্ত লিবিডোকে চাপা দেওয়ার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টা তা স্পষ্ট হয়ে যায় পরবর্তীকালে তুলসীর নির্মম পরিণতির ঘটনায়। তার ইদ স্তরে যে যৌন বুভুক্ষা ছিল, যাকে সে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ব্রহ্মচর্য পালনের মধ্য দিয়ে বিবাহ সম্পর্কে নিরাসক্তি জ্ঞাপন করে সেই বুভুক্ষা ভিখারি তুলসীকে দেখে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তাকে সে ভোগ করে। এর ফলে তুলসী গর্ভবতী হয়ে পড়লে তাকে প্রকারান্তরে খুন করতেও দ্বিধা করে না। অপারেশন থিয়েটারে মৃত তুলসীকে দেখে পুরো বিষয়টাই চিকিৎসক-পিতা কৈলাশের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায় :

হঠাৎ ঝফ করে টেবিলের কাছে আবার এগিয়ে এলেন কৈলাসডাক্তার। ছোঁ মেরে কাঁচিটা তুলে নিয়ে তুলসীর তলপেটের দুটো বন্ধনী ছেদ করলেন। নিকেলের চিমটের সুচিক্কণ বাহুপুটে চেপে নিয়ে, স্নেহাক্ত আগ্রহে ধীরে ধীরে টেনে তুলে ধরলেন, পরিশুল্কে ঢাকা সুডৌল সুকোমল একটি পেটিকা। মাতৃত্বের রসে উর্বর, মানব জাতির মাংসল ধরিত্রী। সর্পিল নাড়ীর আলিঙ্গনে ক্লিষ্ট ও কুঞ্চিত, বিষিয়ে নীল হয়ে আছে এক শিশু আশা। আবেগে কৈলাসডাক্তারের ঠোঁটটা কাঁপছিল থরথর করে। যদু এসে ডাকলো — হুজুর। ডেকে সাড়া না পেয়ে যদু বাইরে গিয়ে নিতাই সহিসের পাশে বসলো। নিতাই জিজ্ঞেস করে — ‘এত দেরী কেন রে যদু?’ — ‘শালা বুড়ো নাতির মুখ দেখছে।’

সুবোধ ঘোষের সমকালীন কথাশিল্পী জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘পতঙ্গ’, ‘রূপকথার রাজা’, ‘কালোবৌদি’, ‘সোনালী মাছ’ ইত্যাদি গল্পে মনোবিকলন তত্ত্বের জোরালো প্রভাব লক্ষগোচর। এদের মধ্যে ‘কালো বৌদি’ এক অভূতপূর্ব যৌনবিকারের আখ্যান। জনৈক শিবানন্দকে শারীরিকভাবে কাছে পেতে দুই বোন হিমি ও নিমির কদর্য প্রতিযোগিতা এবং তাদের অবাক করে দিয়ে কালো বৌদি অর্থাৎ জলধর পত্নীর শিবানন্দ জয়, এই আখ্যানের উপজীব্য। লিবিডোর তাড়নাকে যে প্রায়শই অহং সত্তা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় এবং সেই নিয়ন্ত্রণহীন লিবিডো যে কী ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে তা লেখক অসামান্য মুনশিয়ানায় এই আখ্যানের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন।

এবার শেষের কথায় আসা যাক। কথাটি এই : ফ্রয়েডের মনোবিকলন এবং বাংলা গল্পে তার প্রভাব নিয়ে লেখার কথা ছিল। সেই মতো চুম্বকে অনেক কথাই লিখলাম। আবার অনেক কথাই পরিসরের ক্ষীণকায়ার জন্য বাদ থেকে গেল। যাইহোক, মনোবিকলন নিয়ে এই তুচ্ছ রচনা বৃহত্তর গবেষণার প্রেরণা জোগাবে এই আশা রেখে আত্ম-প্রত্যাহার করলাম।  

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান