সোমনাথ মুন্সী
আদি বা প্রথম শৈশব আমাদের সকলেরই জীবনে সব থেকে উর্বর সময়। এই সময়েই দরকার সব থেকে বেশি যত্নের ও সঠিক পরিচালনার এবং পরিপূর্ণ বিকাশের সহযোগী সবরকম বাতাবরণ। বিকাশের সম্ভাবনাকে আর যা-যা পুষ্টি জোগায়, সবই তখন যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া চাই। আদি শৈশবের পর্বটিকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগানোর উপরই নির্ভর করছে শিশুর ভবিষ্যৎ।
বৌদ্ধিক অক্ষমতাযুক্ত শিশুর এই মহার্ঘ সময়টা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ বিফলে যায়। তার কারণ রূপে অনেক ক্ষেত্রেই থাকে সামাজিক ও পারিবারিক অজস্র ভুল ধারণা। কুসংস্কার ও ঐসব ভুল ধ্যানধারণার বশবর্তী হয়ে পরিবারের অজ্ঞাতসারেই শিশুর জীবনে ওই উর্বর সময় সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারা যায় না।
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা কোনও ব্যাধি নয়। এটি একটি অবস্থা। স্বাভাবিক শিশুর বুদ্ধি ও কার্যকলাপের সর্বনিম্ন স্তরে তার অবস্থান। স্বাভাবিক শিশুর মিছিলে সে যে ঠিক দলছুট তা কিন্তু নয়। বরং তাকে স্বতন্ত্র বলে চিহ্নিত করাই সংগত।
শিশুটিকে ঠিক এই ভাবে বুঝতে পারলে এবং মন থেকে তা সহজে মেনে নিতে পারলেই শিশুটির জন্য সঠিক ব্যবস্থা নিতে পারবেন মা বাবা, সাহায্য করতে পারবেন তার বিকাশে। অন্যভাবে বললে শিশুটির পরিস্থিতিকে নেতিবাচক ভাবে দেখলে চলবে না। হতাশা, অবিশ্বাস, বিষাদ আসে নেতিবাচক মনোভাবের জন্যই, তাই এই মনোভাব সম্পূর্ণভাবে বর্জনীয়।
যেহেতু এটি কোনও রোগ নয়, তাই এই অবস্থাটি যে ওষুধ দিয়ে সারিয়ে ফেলা যাবে তার কোনও উপায় নেই। বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতাযুক্ত শিশুটির অবস্থার পরিবর্তন চটজলদি পথে হবার নয়। যত্নের সঙ্গে যথেষ্ট সময় নিয়ে বিশেষ শিক্ষার পথেই অবস্থার উন্নতি হতে পারে। ধারাবাহিক প্রয়াসের মাধ্যমে সে ক্রমেই কিছুটা সচল, কিছুটা কার্যক্ষম হয়ে উঠবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এখানে একটি জরুরি কথা হল, দ্রুত প্রশিক্ষণ শুরু হওয়া। যত তাড়াতাড়ি অর্থাৎ যত কম বয়সে সে এই প্রশিক্ষণ পাবে তার উন্নতির আশা ঠিক ততটাই বেশি।
শিশুর জীবনের শুরুর দিনগুলো বাড়িতেই কাটে, বাবা-মার সান্নিধ্যে। তাই শিশুটির যথাযথ দেখাশোনার দায়িত্ব বাবা-মায়ের উপরই বর্তায়। তাঁদেরই দেখা কর্তব্য যাতে শিশুর বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। শিশুটির লালন পালনের সময় বাবা-মার উচিত নিম্নলিখিত বিষয় স্মরণে রাখা —
- শিশুরা ফুলের মতো স্পর্শাতুর। এদের স্বাভাবিক ভাবে বড়ো হতে দিন।
- উন্নতি বা বিকাশের প্রশ্নে এদের উপর জবরদস্তি করা যায় না। এটা সময়ের ব্যাপার। তবে, শিশুটির বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা দ্রুত করতে পারলে যে ঢের লাভ হয় তাতে সন্দেহ নেই।
- শিশুদের পরস্পরের সঙ্গে তুলনা করার অভ্যাস আদৌ স্বাস্থ্যকর নয়। প্রতিটি শিশুর বিচার তার যোগ্যতা ও ক্ষমতা অনুসারেই করতে হবে। সে কী পারেনা-র থেকে কী পারে ও কী করলে সে আরও কিছুটা অগ্রসর হতে পারে তার উপর জোর দেওয়া উচিত।
- প্রত্যাশা বাস্তবানুগ হওয়াই কাম্য। শুধু আশা করলেই চলবে না। শিশুর বিকাশে নিবিড় প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।
বৌদ্ধিক অক্ষমতাযুক্ত শিশুরা কেমন?
- দেরিতে সাড়া দেয়।
- লেখার ব্যাপারে দীর্ঘসূত্রিতা।
- চটপট কিছু বুঝতে পারে না।
- পরিষ্কার করে নিজের মনের কথা বলতে পারে না।
- অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে অক্ষম।
- মনোযোগের অভাব।
- দুর্বল স্মৃতি।
শিশুর এইসব সমস্যাই কোনও কিছু শেখার পথে বাধা। তাই এদের কিছু শেখাতে হলে বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকাকে এইসব বাধা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকতে হবে। এইসব শিশুদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সেরা পথ হল ধৈর্য। পড়া, লেখা আর চর্চার জন্য এদের অঢেল সময় দিতে হবে। প্রতিটি তথ্য এদের কাছে ভেঙে বলতে হবে এবং যতটা সম্ভব সহজ করে। যাতে সবকিছু মিলে তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। এদের পরিবেশ যেন বেশ ঝলমলে হয়। মন টানে। আচরণ সংশোধনের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে সেই মতো এদের আচরণ শোধরানোর চেষ্টা করতে হবে। শেখানোর সময় জোর দিতে হবে নিজের যত্ন-আত্তির উপর। যাতে শিশু নিজেই তার প্রাথমিক প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে শেখে। এছাড়া সামাজিক জীবনের কিছু জরুরি নিয়মকানুনও তাকে শেখাতে হবে। এ দুয়ের যোগফলই সমাজ জীবনে তার পুনর্বাসনকে সহজ করে তোলে।
বাড়িতে শিশুটিকে কীভাবে শেখাবেন?
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করুন। আর অভিভাবকরাই এই কাজ সব থেকে সুচারুভাবে করতে পারেন। বাড়িতে শেখানোর সময় বাবা-মা নিম্নলিখিত পন্থা নিতে পারেন —
- কাজটিকে অনেকগুলো ছোটো ছোটো টুকরোয় ভাগ করে নিন। এবং ধরে ধরে একটা-একটা করে শেখান।
- জানা জিনিস থেকে অজানা জিনিসের দিকে যান। সহজ থেকে জটিল জিনিসের দিকে।
- অনুশীলনটি বার বার করে দেখান এবার শিশুকে তা করে দেখাতে বলুন।
- শিশুর চারপাশটাকে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করুন।
- শেখানোর সময় ধৈর্য রাখুন এবং তার সম্পর্কে উৎসাহ বজায় রাখবেন। আর তা প্রকাশও করবেন।
- প্রথম ধাপ ভালো করে শেখার পরই দ্বিতীয় ধাপ শেখান।
- পরিবেশ যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক রাখুন।
শিশুর বিকাশে মা-বাবা বাড়িতে এই পদ্ধতিগুলো কাজে লাগাতে পারেন। বিশেষ প্রশিক্ষক হিসাবে অভিভাবকদের পূর্ণ সহযোগিতা আমাদের একান্ত প্রয়োজন। একমাত্র তাহলেই আমাদের কর্মসূচির সফল রূপায়ণ সম্ভব। অভিভাবকরাই সেরা বিচারক। এইসব কর্মসূচি রূপায়ণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তো তাঁদেরই হাতে।
বিশেষ প্রশিক্ষণের একান্ত জরুরি সদস্য যে বাবা-মা একথা বোধকরি আর আলাদা করে বলে দেবার দরকার নেই। এঁদের পুরোপুরি না-পেলে গোটা কাজটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।