সৌম্য মুখোপাধ্যায়
অনুভূতির ইতিহাস সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। একটি নির্দিষ্ট ঘটনা, সমাজ এবং সংস্কৃতির সংবেদনশীল ইতিহাসের অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করতে সক্ষম এই চর্চা। সেই সঙ্গে এটি অতীতকে মানসিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করার পরিসর প্রদান করে। অনুভূতিকে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় রূপে বিবেচনা করা হলেও, এটি যে সমসাময়িক মানুষ ও পরিবেশের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, অনুভূতিকে যদি আমাদের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম রূপে দেখা হয়, তবে সেটি নিশ্চিতভাবেই সমসাময়িক সংস্কৃতি নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতে পারে। এটি তখন এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক কাঠামোকে প্রতিফলিত করে যেখানে সমাজবদ্ধ মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতি এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক ঋদ্ধ করে অতীত-কথনকে।
অনুভূতি একটি অধরা ও অস্পষ্ট শব্দ। এই শব্দের প্রকৃত অর্থ নিয়ে মনোবিজ্ঞানী, স্নায়ুবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ বা দার্শনিকদের মধ্যে কোনও মতৈক্য নেই। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পূর্বে পশ্চিমি বিশ্বে দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব অনুভূতিকে বুঝতে সচেষ্ট হলেও ১৮৬০-এর পরই চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য, অলংকারশাস্ত্র, পরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞান ও স্নায়ুবিজ্ঞান অনুভূতিকে সংজ্ঞায়িত করতে তৎপর হয়ে ওঠে।[১] ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস অনুভূতির সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করেন। এই সময় মনোবিজ্ঞানীদের মত ছিল যে, সকলেই জানে অনুভূতি কী, অথচ তারা তার সংজ্ঞা দিতে অপারগ।[২] নৈতিক মনোবিজ্ঞানী মাইকেলস স্টকার আবার বলছেন, “অনুভূতি এমন এক চিন্তন প্রক্রিয়া যাকে অনুভবে ধারণ করা হয়”। এটি, “প্রবাহী, ক্ষণস্থায়ী, উদ্বায়ু, কেন কীভাবে আসে বা যায়, কেউ জানে না”।[৩] ইতিহাসগতভাবে অনুভূতিকে “মানুষের নৃতাত্ত্বিক সত্তার মতো প্রাচীন ও তার অস্তিত্বের জন্য মৌলিক” রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।[৪] ব্রিটিশ ঐতিহাসিক থমাস ডিকশনের মতে, যদিও ‘অনুভূতি’ আধুনিক মনোবিজ্ঞানের একটি মূল শব্দ, তবুও এর সংকট কাটেনি।[৫]
ধ্রুপদী গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (৪২৪-৩৪৮ খ্রিস্টপূর্ব) ও অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্ব) অনুভূতির সঙ্গে গতিময়তার সম্পর্ক দেখেছিলেন। প্লেটো অনুভূতিকে ব্যাখ্যা করতে সর্বপ্রথম গ্রিক ভাষায় ‘path’ শব্দটি ব্যবহার করলেন। তাঁর ছাত্র অ্যারিস্টটল ‘pathos’ শব্দের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, অনুভূতি হল সেই সকল মানসিক বৃত্তি যা আনন্দ ও বেদনা, যেমন, স্নেহ, রাগ, করুণা, ভয়, ইত্যাদি বিপরীতধর্মী সংবেদনশীলতার সঙ্গী হয়ে মানুষের মতামত ও সিদ্ধান্তকে চকিতে চলনশীল করে।[৬] মধ্যযুগের খ্রিস্টীয় ইতিহাস চর্চাতেও অনুভূতির প্রসঙ্গ এসেছিল। সেন্ট অগাস্টিনের (৩৫৪-৪৩০) মতে, এখানে যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল একজন মানুষের ইচ্ছার গুণমান। ইচ্ছা যদি সৎ, নীতিসম্মত হয়, তবে অনুভূতি হবে প্রশংসনীয় ও নির্দোষ, অন্যথায় তা বিকৃত।[৭] আবার, পশ্চিমি দ্বৈতবাদের প্রবক্তা রেনে ডেসকার্টেস (১৫৯৬-১৬৫০) অনুভূতির সঙ্গে যুক্তির পরস্পর-বিরোধী সম্পর্ক দেখেছিলেন।[৮] তাঁর বিপরীতে, বারুচ ডি স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭) অনুভূতি ও যুক্তিনিষ্ঠ কর্মকে বর্ণনা করেছিলেন একই বাস্তবতার দুটি দিক রূপে — প্রথমটি অন্তঃক্রিয়া ও দ্বিতীয়টি বাহ্যক্রিয়া।[৯]
আধুনিক যুগের দার্শনিক থমাস হবস্ (১৫৮৭-১৬৭৯) তাঁর প্রকৃতির রাজ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন অনুভূতির প্রাবল্য। “এখানে নেই কোনও শিল্প, শিক্ষা বা সমাজ, শুধুই বিরাজমান দীর্ঘমেয়াদি ভয়, কদর্য মৃত্যুর হাতছানি এবং মানুষের সংক্ষিপ্ত, পাশবিক জীবন”।[১০] হবসের বিপরীতে জন লক (১৬৩২-১৭০৪) অবশ্য মনে করেছিলেন, অনুভূতি হল ‘বাদ্যযন্ত্রের স্ট্রিং’ যা প্রকৃতির রাজ্যে সামঞ্জস্য বিধানে সচেষ্ট।[১১] আবার রুশো (১৭১২-১৭৭৮) তাঁর ‘এমিল’ উপন্যাসে বললেন, আদর্শ প্রকৃতির রাজ্যে একজন ব্যক্তির জীবনের মূল্যমান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাঁর জীবিত-কাল গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তাৎপর্যপূর্ণ সে কত বেশি জীবনকে অনুভব করেছে।[১২] জ্ঞানদীপ্ত দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) অবশ্য যুক্তি ও অনুভূতির মধ্যে বিভাজন টানলেন। তিনি অনুভূতিকে যুক্তির খবরদারির বাইরে রেখে একে সমস্ত রকম নৈতিক আদর্শের সঙ্গচ্যুত করলেন।[১৩]
ইতিহাসবিদদের জন্য অনুভূতির একটি কার্যকরী সংজ্ঞার অভাব পূরণে এগিয়ে এসেছিলেন জ্যান প্ল্যাম্পার। তিনি চারটি বৈশিষ্ট্য সমন্বিত অনুভূতির একটি কাজ-চালানো সংজ্ঞার খসড়া প্রস্তাব করেন। তাঁর মতে, এক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান বিষয় হল, অনুভূতি গঠনে সংবেদনশীল মনের ভূমিকাকে বিচার করা। কারণ জীবন বিজ্ঞান ও তার সহযোগী শাখাগুলির বিপরীতে অনুভূতির ইতিহাস কল্পনাপ্রবণ মনের একটি বড়ো ভূমিকাকে সমর্থন করে। দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের সময় শরীর ও মনের পারস্পরিক সম্পর্ককেও আলোচনায় আনা জরুরি। তৃতীয়ত, ঘটনার ঐতিহাসিক বিচার ও মূল্যায়ন কালে মানসিক উপাদান অবশ্যই বিবেচ্য হবে। সর্বোপরি, নৈতিকতার সঙ্গে অনুভূতির সম্পর্কের ওপর একটি সুনির্দিষ্ট অবস্থান তৈরি করা প্রয়োজন।[১৪] সুতরাং অনুভূতির ইতিহাস নির্মাণের জন্য জরুরি সংজ্ঞা গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেল অনুভূতি গঠনের প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক সময়কালে মানুষের সংবেদনশীলতার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের বিষয়টি। অর্থাৎ, এই চর্চা এমন একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে চাইছে, যেখানে মানুষ তার অনুভূতিকে উপলব্ধি করতে পারবে, সেইসঙ্গে অনুভূতিগুলি কীভাবে শ্রেণিবদ্ধ আকারে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ঘটনার পুনর্নির্মাণে ভূমিকা নিচ্ছে, তাও বোধগম্য হবে।
বিংশ শতকের আগে অনুভূতির ইতিহাস চর্চায় এক ধরনের পদ্ধতিগত দুর্বলতা থেকে গিয়েছিল। লুসিয়েঁ ফেব্রের (১৮৭৬-১৯৫৬) কালজয়ী কাজের আগে পর্যন্ত অনুভূতির ইতিহাসে তেমন কোনও নেতৃস্থানীয় চর্চা পরিলক্ষিত হয়নি। অবশ্য কিছু ইঙ্গিত মিলেছিল। যেমন, এথেনীয় ঐতিহাসিক থুকিডিডিস (৪৫৪-৩৯৯ খ্রিস্টপূর্ব) লিখেছিলেন, মানুষের কার্যকলাপের পেছনে অনুভূতি হল অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। ৪৩১ থেকে ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ঘটে যাওয়া পেলোপোনেশীয় যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লেখেন যে, এথেনীয় ও স্পার্টানদের যুদ্ধের প্ররোচনা রূপে ভয় ও অন্যান্য শক্তিশালী অনুভূতিগুলিই সক্রিয় ছিল।[১৫] অপর গ্রিক ঐতিহাসিক পলিবিয়াস (২০০-১২০ খ্রিস্টপূর্ব) মানুষের সিদ্ধান্ত ও কর্মের পেছনে কার্যকরী প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে অনুভূতির ভূমিকা আলোচনা করেছিলেন।[১৬] অনেক পরে, কার্ল ল্যাম্প্রেখট্ (১৮৫৬-১৯১৫) এবং অ্যাবি ওয়ারবার্গ (১৮৬৬-১৯২৯)-এর মতো দুই শিল্প ইতিহাসবিদকেও অনুভূতি নিয়ে চর্চা করতে দেখা গেছে। ল্যাম্প্রেখট আশা করেন, মানুষের অভ্যন্তরীণ জীবন সংক্রান্ত মনোবিজ্ঞানের রসদগুলিকে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দ্বারা সমৃদ্ধ করা যেতে পারে।[১৭] তাঁর সমসাময়িক, ওয়ারবার্গ শিল্প ইতিহাসের ক্ষেত্রে ‘pathosformel’ শব্দটির প্রবর্তন করেন, যার দ্বারা শিল্প ও ভাস্কর্য চর্চায় মনুষ্য মুখের অভিব্যক্তিগুলিকে মনোবিজ্ঞানের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়।[১৮]
অনুভূতির ঐতিহাসিক অনুসন্ধান যথাযথভাবে ১৯২০-এর দশকে শুরু হয়েছিল। এর প্রধান কৃতিত্ব ‘অ্যানালস স্কুল অফ হিস্ট্রি’-র অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা লুসিয়েঁ ফেব্রে। ফেব্রে তাঁর ‘Histoire et psychology’ (ইতিহাস এবং মনোবিজ্ঞান) শিরোনামের প্রবন্ধে লেখেন, “তাঁর এই কাজের প্রধান লক্ষ্য হল, একটি নির্দিষ্ট কালপর্বে মানুষের মানসিক উপাদানগুলির একটি বিশদ তালিকা প্রস্তুত করা। তারপর, বৌদ্ধিক চর্চা ও কল্পনার সাহায্য নিয়ে প্রতিটি পূর্ববর্তী প্রজন্মের শারীরিক, বৌদ্ধিক এবং নৈতিক মহাজগতের পুনর্গঠন করা”।[১৯] এই প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি অতীতের সংবেদনশীল জীবনের পুনর্নির্মাণের কাজে নিয়োজিত ঐতিহাসিকদের অনুসন্ধানী কৌশলগুলির জন্য অসাধারণ দিকনির্দেশনা রেখে যান। সেইসঙ্গে, ইতিহাসবিদদের কাজের কেন্দ্রভাগে অনুভূতিকে স্থাপন করার আহ্বান জানান। ঐতিহাসিক ঘটনায় অনুভূতি অন্বেষণ করার সময় মনোবিজ্ঞান শাখা সংক্রান্ত ইতিহাসবিদদের যে সমস্ত আড়ষ্টতা থাকে, ফেব্রে তাকেও কাটিয়ে ওঠার জন্য উৎসাহ দেন। তাঁর দৃঢ় মত ছিল, মানব মনস্তত্ত্ব কোনও ধ্রুবক বা সার্বজনীন বিষয় নয়, বরং প্রবাহী ও ইতিহাসগতভাবে পারম্পর্যপূর্ণ।[২০]
অ্যানালস ইতিহাসের অপর প্রবক্তা মার্ক ব্লক (১৮৮৬-১৯৪৪) তাঁর ধ্রুপদী গ্রন্থ ‘The Historian’s Craft’-এ লেখেন, ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম এককথায়, মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা প্রবাহ। কেননা, ঐতিহাসিক ঘটনার পূর্বাপর সূত্রগুলি মনস্তাত্ত্বিক ঘটনাবলির মধ্যে পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকের কাজই হল যৌথ আচরণের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে উন্মোচন করা।[২১] এইভাবে ফেব্রে ও ব্লকের গবেষণা ঐতিহাসিক উপাদানগুলিকে মনস্তাত্ত্বিক তদন্তের আওতায় নিয়ে এল এবং ফেব্রের ভাষায়, “মূক ও বধির ঘটনাবলির মুখে কথা ফোটাল”।[২২] দ্বিতীয় প্রজন্মের অ্যানালস ঐতিহাসিক ফার্নান্দ ব্রদেল (১৯০২-১৯৮৫) তাঁর ‘The Mediterranean World in the Age of Philip II’ গ্রন্থে পুঁজিবাদ এবং বস্তুগত জীবনের মধ্যে সংযোগের বর্ণনা দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনুভূতির ভূমিকা বা তার সক্রিয়তার সম্ভাবনা সম্পর্কে আলোকপাত করেন।[২৩] অ্যানালসের তৃতীয় প্রজন্মের ঐতিহাসিক ফিলিপ এরিস বা রজার চার্টিয়ার, প্রমুখ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষের অনুভূতির অধ্যয়ন করেছেন।[২৪] এইভাবে তিন প্রজন্মের অ্যানালস ঐতিহাসিকদের গবেষণা ঐতিহাসিক আলোচনাকে রাজা বাদশার ঘটনার বাইরে এনে সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে ইতিহাসের কেন্দ্রভাগে বসাল এবং তদানীন্তন সমাজ, অর্থনীতি, পরিবেশ, জনসংখ্যা ও মনস্তত্ত্বের অধ্যয়নে মনোনিবেশ করল।[২৫] গড়ে উঠল, তাঁদের পরিভাষায়, সার্বিক ইতিহাস বা Total History।
তৃতীয় প্রজন্মের অ্যানালস ঐতিহাসিকদের প্রায় সমসাময়িক জার্মান ঐতিহাসিক মনোবিজ্ঞানী নরবার্ট এলিয়াস (১৮৯৭-১৯৯০) তাঁর বিখ্যাত রচনা, ‘The Civilizing Process : The History of Manners’-এ ‘historical psychology’ বা ‘ঐতিহাসিক মনস্তত্ত্ব’ নামক একটি শব্দের প্রয়োগ করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হলেও যুদ্ধকালীন রাজনীতির কারণে ১৯৭০-এর পূর্বে বৃহত্তর পণ্ডিত সমাজের কাছে এলিয়াসের তত্ত্ব সমাদর পায়নি। যাইহোক, এলিয়াস এই শব্দটিকে ‘ঐতিহাসিক পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত ধারা’ রূপে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, পাশ্চাত্য সমাজের ‘সভ্য হয়ে ওঠার’ মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াটিকে বোঝা। তিনি পশ্চিমিদের দৈনন্দিন রীতিনীতি, আচার-আচরণকে মনোবিশ্লেষণ দ্বারা ব্যাখ্যা করেন এবং সচেতন ও অচেতন আবেগের পারস্পরিক টানাপোড়েনকে তুলে ধরেন। মানুষের অনুভূতি ও ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল, “সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে মুক্ত অনুভূতির প্রগতিশীল দমন পীড়নের মধ্য দিয়ে”।[২৬] ঐতিহাসিক মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যাকে আরও বিস্তারিত করার সময় এলিয়াস মানুষের সংবেদনশীলতাকে ঐতিহাসিক-সামাজিক প্রক্রিয়ার অচ্ছেদ্য অংশ বলে দেখান। লজ্জা-বিদ্বেষ বা ঘৃণার মতো অনুভূতি গঠন এক নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থার অধীনে মানব প্রকৃতির প্রকাশ বলে তাঁর মত ছিল।[২৭] এলিয়াসের ‘ঐতিহাসিক মনস্তত্ত্ব’-এর ধারাটিকে ১৯৭০-এর দশকে আরও জনপ্রিয় করে তোলেন জেভেদেই বারবু (১৯১৪-১৯৯৩) ও রবার্ট মান্দ্রোর (১৯২১-১৯৮৪) মতো ঐতিহাসিক মনোবিজ্ঞানীরা।[২৮]
১৯৭০-এর দশকে অনুভূতির ইতিহাসের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের সখ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ‘psychohistory’ বা মনোইতিহাস নামে নতুন এক শাখার উত্থান হয়। ইংরেজি অক্সফোর্ড অভিধান অনুযায়ী, মনোইতিহাসকে “মনোবিজ্ঞানের বিশ্লেষণের সাহায্য নিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা” রূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।[২৯] মার্কিন ঐতিহাসিক পিটার গে (১৯২৩-২০১৫), সমাজবিজ্ঞানী লয়েড ডি. মজ (জন্ম, ১৯৩১), জার্মান ঐতিহাসিক পিটার লোয়েনবার্গ (জন্ম, ১৯৩৩), প্রমুখ দ্বারা বিকশিত এই ক্ষেত্রটি ফেব্রে বা এলিয়াসের ‘ঐতিহাসিক মনস্তত্ত্ব’-এর ধারা থেকে পৃথক পরিসরে বিকশিত হতে দেখা গেছে। মনোইতিহাস চর্চার আঙ্গিকে তাঁদের পারস্পরিক ভিন্নতা থাকলেও তাঁরা ইতিহাসে অনুভূতির গুরুত্ব বিষয়ে সহমত ছিলেন।[৩০]
সমসাময়িক পর্বে, মার্কিন ঐতিহাসিক পিটার নাথানিয়ে স্টার্ন্স, কেনেথ লকরিজ, বারবারা এইচ. রোশেনউইন ইতিহাসে অনুভূতিকে নতুন প্রেক্ষিতে বোঝার চেষ্টা করেছেন। স্টার্ন্সের মার্কিন দেশে ঈর্ষার ইতিহাস, লকরিজের অষ্টাদশ শতকে লিঙ্গ ও ক্রোধের অধ্যয়ন বা রোশেনউইনের ক্রোধের অতীত, ইত্যাদি এই ধারার উল্লেখযোগ্য কাজ।[৩১] ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পিটার এন স্টার্ন্স এবং ক্যারল জিসোভিৎস স্টার্ন্স, Journal of Social History-এর ছত্রছায়ায় অতীতের আবেগময় ইতিহাসের তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্ন পন্থা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করেন। তাঁরা অনুভূতির প্রচলিত ধারা এবং ব্যক্তিগত অনুভবের মধ্যে তীক্ষ্ণ পার্থক্য তৈরি করে ইতিহাসের জন্য প্রথমটিকে গুরুত্ব দেন। Emotionology নামক শব্দটি তাঁদেরই দান, যার অর্থ, ‘সমাজের সম্মিলিত আবেগগত মান’।[৩২] তাঁরা ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত অনুভূতিকে ভিন্ন সত্তা বলে মনে করলেও বিশ্বাস করেছিলেন যে, এরা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত — অনুভূতির ইতিহাসকে তাঁরা সামাজিক ইতিহাসের সম্প্রসারণ রূপেই দেখেছেন।[৩৩]
১৯৯০-এর দশকের সূচনায় অনুভূতির ইতিহাস চর্চা জীবন বিজ্ঞানের প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। মার্কিন ঐতিহাসিক তথা নৃতাত্ত্বিক উইলিয়াম এম. রেড্ডি তাঁর ‘The Navigation of Feeling : A Framework for the History of Emotions’ গ্রন্থে জীবন বিজ্ঞানের ধারণাকে ভিত্তি করে ফ্রান্সে বিপ্লবোত্তর সন্ত্রাসের রাজত্বের (১৭৯৩-৯৪) অনুভূতির ইতিহাস রচনা করেছিলেন।[৩৪] তাঁর মতে, বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাস অনুভূতির ইতিহাসের সমালোচনামূলক বা বিরোধ-ধর্মী হওয়া অপেক্ষা পরস্পরের পরিপূরক।[৩৫]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১-এর মতো যুগান্তকারী ঘটনা অনুভূতির ইতিহাসের জন্য অদ্ভুত এক তাগিদ সৃষ্টি করেছিল। এরপর ইলেকট্রনিক্স যোগাযোগ মাধ্যমে সুনামি আসে এবং ভয়, ঘৃণা বা বিতৃষ্ণার মতো নেতিবাচক অনুভূতিগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সারা বিশ্বে সংক্রমিত হয়। টেক্সট, ব্লগ বা ইমেলের মাধ্যমে অনুভূতির বাধাহীন সম্প্রচার অনুভূতির ইতিহাসের বিকাশের পরিপূরক পরিবেশ প্রদান করল। এখানে লক্ষ করার মতো বিষয় হল যে, ৯/১১-এর পরে, গোটা বিশ্ব যে অনুভূতির জোয়ারে ভেসেছিল, তা কোনও ইতিবাচক অনুভূতি ছিল না। এখানে ফেব্রেকে স্মরণ করে বলা যায় — “অনুভূতির ইতিহাসের প্রাথমিক পাঠ শুরু হয় নেতিবাচক অনুভূতি, যেমন ভয়, ঘৃণা বা নিষ্ঠুরতার ইতিহাসের সঙ্গে মোকাবিলা করে”।[৩৬]
যাইহোক, ২০০২ খ্রিস্টাব্দে বারবারা এইচ রোশেনউইনের প্রবন্ধ সামনে আসে, যেখানে তিনি এতদিনের অনুভূতির ইতিহাসের স্বীকৃত ভাষ্য — “পাশ্চাত্যের সংবেদনশীলতার ইতিহাস আসলে আবেগ সংযমের ইতিহাস” — তার বিরোধিতা করেন। পরিবর্তে তিনি ‘অনুভূতিপ্রবণ সম্প্রদায়’ (Emotional Communities)-এর ধারণা উপস্থাপন করেন। এই সম্প্রদায়ের পরিচিতি দিতে গিয়ে তিনি লেখেন, “পরিবার, পাড়া, গিল্ড, মঠ, ইত্যাদির মতো এটিও এক ধরনের সামাজিক সম্প্রদায়, তবে এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা আবেগগত কারণে একে অপরের কাছাকাছি আসে, পরস্পরকে চিনতে শেখে, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার প্রেরণা পায়। প্রায় সমতুল্য সংবেদনশীলতা তাদের অভ্যন্তরীণ বন্ধনকে দৃঢ় করে”।[৩৭] ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে রোশেনউইন যখন আদি মধ্য যুগের অনুভূতিপ্রবণ সম্প্রদায়ের ওপর গ্রন্থ প্রকাশ করেন, তখনও তিনি দেখান, ভৌগোলিকভাবে এই সম্প্রদায় অনেকগুলি ছোটো বৃত্ত মিলিয়ে একটি বড় বৃত্ত প্রস্তুতে আগ্রহী। ছোটো বৃত্তের সদস্যদের জীবনে পাওয়া না পাওয়া দ্বারা উদ্ভূত অনুভূতির অমিলগুলি বৃহত্তর বৃত্তে এসে ক্রমে মুছে যায় এবং জন্ম নেয় সার্বজনীন মূল্যবোধ বা যৌথ সংবেদনশীলতা।[৩৮] ইতিহাসের চলমানতায় এভাবেই ‘অনুভূতিপ্রবণ সম্প্রদায়’ তার ভূমিকা পালন করে চলেছে।
জার্মান ঐতিহাসিক উতে ফ্রেভার্ট ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর Lost and Found গ্রন্থে অনুভূতির ইতিহাসকে নতুন দিশা দেখিয়েছেন। এখানে উঠে এসেছে অনুভূতির ঐতিহাসিকতা (historicity)। ফ্রেভার্ট এখানে সেই উপায়গুলির কথা বলেছেন, যা অনুভূতিকে জনস্বার্থ ও জনবিতর্কের সামনের সারিতে এনে ফেলেছে। এখানে দেখানো হয়েছে, কীভাবে অনুভূতি একটি সামাজিক ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে জনমানসকে আন্দোলিত করে এবং ‘সামাজিক কারসাজির’ জন্য গুরুত্বপূর্ণ ‘অনুভূতিপূর্ণ বুদ্ধিমত্তা’ (Emotional Intelligence)-এর জন্ম দেয়।[৩৯] ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ফ্রেভার্টের অপর নিবন্ধ ‘Wartime Emotions: Honour, Shame and the Ecstasy of Sacrifice’-এ প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ব্যক্তিগত ও জনপরিসরে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্মান ও লজ্জার অপরিহার্য ভূমিকা নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়। এখানে দেখানো হয়, কীভাবে বিংশ শতকে ইউরোপের ক্ষমতার রাজনীতি অনুভূতিপূর্ণ বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রবদ্ধ মানুষকে চূড়ান্ত আত্ম-বলিদানের ‘মহাসুখ পেতে’ উদ্বুদ্ধ করেছিল।[৪০]
ফেভার্টের এই পর্বে প্রকাশিত অনুভূতি সংক্রান্ত নিবন্ধগুলির অন্যতম হল ‘Emotional Lexicon : Continuity and Change in the Vocabulary of Feeling, 1700-2000 (২০১৪)’। এখানে তিনি ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় ব্যবহৃত অনুভূতির নানান পরিভাষা নিয়ে আলোচনা করেন। পাশাপাশি, এখানে অনুভূতি সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠিত ইউরোপীয় তত্ত্বগুলিকেও চর্চা করা হয়।[৪১] আবার, ‘Learning How to Feel : Children’s Literature and the History of Emotional Socialization, 1870-1970’ (২০১৪) গ্রন্থে তিনি ইউরোপ, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে শিশু ও কিশোরদের অনুভূতির গঠন, প্রকাশ এবং সেক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তক ও পরিবেশের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন।[৪২] অন্যদিকে, ফ্রেভার্টের তত্ত্বাবধানে মার্গ্রিট পার্নোর প্রকাশিত ‘Civilizing Emotions : Concepts in Nineteenth Century Asia and Europe’ (২০১৫) নিবন্ধে বৈশ্বিক ব্যবস্থা গঠনে অনুভূতির ভূমিকাকে পর্যালোচনা করা হয়। এখানে দেখানো হয়, কীভাবে আবেগ ও অনুভূতি সভ্য মানুষ ও সমাজের কাছে সম্পদ হয়ে উঠছে, কীভাবে তারা সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে জোরালো করছে বা পালন করছে সামাজিক গোষ্ঠীগুলির আন্তর্সম্পর্কে অনুঘটকের ভূমিকা।[৪৩]
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক থমাস ডিকশন তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশিত ‘Weeping Britannia: Portrait of A Nation in Tears’ (২০১৫) গ্রন্থে দেখিয়েছেন শক্ত উপরের ঠোঁট যুক্ত স্টোইক চরিত্রের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ব্রিটেনের আত্ম-পরিচয়ের একমাত্রিক ধারা নয়। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ থেকে ব্রিটেনের রাজনৈতিক সামাজিক ইতিহাসের অশ্রুসিক্ত অধ্যায়গুলিকে পর্যালোচনা করে তিনি এক কোমল, পেলব ব্রিটেনের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়েছেন। অলিভার ক্রমওয়েল থেকে মার্গারেট থ্যাচার পর্যন্ত সময়কালে ব্রিটেনের সংবেদনশীল জীবনযাত্রার নানান প্রতিচ্ছবি যেমন এখানে এসেছে, তেমনি ব্রিটিশ শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা ও সিনেমায় হৃদয়-নিংড়ানো উদ্দীপনাগুলিকেও তুলে ধরা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ডিকশন সচেতনভাবে এই গ্রন্থে কান্নাকে ব্রিটেনের অনুভূতি বা সংবেদনশীলতার প্রকাশ বলেননি, বরং সামাজিক-ঐতিহাসিক উদ্দীপনার মাধ্যম বলেছেন।[৪৪]
অনুভূতির ইতিহাস চর্চায় নিয়োজিত ঐতিহাসিকদের এযাবৎকাল কাজের প্রভাব থেকে ভারত বা উপমহাদেশের ইতিহাস চর্চা মুক্ত নয়। সামাজিক নির্মাণবাদী, ঐতিহাসিক মনস্তত্ত্ব, মনোইতিহাস, ইত্যাদির মতো প্রতিদ্বন্দ্বী স্কুলগুলি ভারতে অনুভূতির ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। তাঁরা ধর্ম, সংস্কৃতি এবং মানসিকতার ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে বিবিধ ধারার সন্নিবেশ ঘটিয়েছে। ‘সামাজিক নির্মাণবাদী’রা যারা পোস্ট-স্ট্রাকচারাল নৃবিজ্ঞান, সমালোচনামূলক তত্ত্ব এবং সংস্কৃতি অধ্যয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে অনুভূতির চর্চা করেছেন, তাঁরা মনে করেন যে, অনুভূতি সর্বতোভাবে সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত। এখানে, ওয়েন এম. লিঞ্চের ‘Divine Passions : The Social Construction of Emotion in India’ (১৯৯০) গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। লিঞ্চ যুক্তি দিয়েছেন যে ভারতে অনুভূতি এবং মানসিক জীবনের ধারণাটি পশ্চিমের প্রচলিত ধারণা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, যা পশ্চিমিদের ‘ভারত’-কে বোঝার প্রধান অন্তরায়। এই পৃথকত্বের মুখ্য কারণ হিসাবে তিনি উভয় সংস্কৃতির বৈপরীত্যকে নির্দেশ করেছেন।[৪৫]
এর বিপরীতে, প্রাক্-ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ইউরোপীয় এবং ভারতীয় চিন্তাধারার মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করেছেন উইলহেম হাবফাস, ‘India and Europe : An Essay in Understanding’ (১৯৯০) গ্রন্থে।[৪৬] আবার, ঔপনিবেশিক যুগে পশ্চিমি সভ্যতা কীভাবে ভারতের মন ও চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিল সে সংক্রান্ত সুবিশাল ঐতিহাসিক সাহিত্যও এদেশে তৈরি হয়েছে। প্রসঙ্গত, পার্থ চ্যাটার্জীর ‘Nationalist Thought and the Colonial World: A Derivative Discourse’ (১৯৮৬)-এর মতো রচনাকে উল্লেখ করা যায়।[৪৭] এছাড়াও তপন রায়চৌধুরীর ‘Europe Reconsidered : Perceptions of the West in Nineteenth-Century Bengal’ (১৯৮৮) গ্রন্থের প্রসঙ্গ আসবে।এটি এক উদারপন্থী দৃষ্টিকোণ থেকে ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং স্বামী বিবেকানন্দের মনস্তত্ত্বের অধ্যয়ন।[৪৮] আবার, ভারত ইতিহাসে অচেতন আবেগের পাশাপাশি সচেতন অনুভূতির সক্রিয়তাও আলোচিত হয়েছে। এরূপ ইতিহাসের নজির মেলে তপন রায়চৌধুরীর ‘Perceptions, Emotions, and Sensibilities : Essays on India’s Colonial and Post-Colonial Experiences’ (২০০০) গ্রন্থে।[৪৯] ভারতের ঔপনিবেশিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা দ্বারা ঋদ্ধ রজতকান্ত রায়ের কাজ, ‘Exploring Emotional History : Gender, Mentality and Literature in the Indian Awakening’ (২০০১)-এর কথাও এই সূত্রে চলে আসবে।[৫০]
বাস্তবিকই, বিশ্বজুড়ে অনুভূতির ইতিহাসে আজ প্লাবন এসেছে। অনুভূতির ইতিহাস আজ আর শুধু পুরনো বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাসে সীমাবদ্ধ নেই। সংস্কৃতি, ধর্ম এবং মনের অধ্যয়ন — সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। এর বিস্তৃতি সমসাময়িক সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ইতিহাস কোনোভাবেই রাষ্ট্র ও অভিজাতদের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নেই। বরং, ব্যক্তি ও জনসাধারণের অনুভূত পরিচয়, অনুভূতিপ্রবণ সম্প্রদায়ের গঠন, অনুভূতিপূর্ণ বুদ্ধিমত্তার বিকাশ, এবং সমগ্র সমাজের মানসিক সক্রিয়তা আজ ইতিহাসবিদদের দ্বারা বিবেচিত হচ্ছে। পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনে শোক, ক্রোধ, আনন্দ, কান্নার মতো মানসিক উদ্দীপনার ভূমিকার প্রসঙ্গ এই আলোচনায় বাদ পড়েনি। ইতিহাসে মনস্তত্ত্বের এই সার্বিক অধ্যয়ন সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পরিধির অভাবনীয় বিস্তার ঘটানোর পাশাপাশি সার্বিকভাবে ইতিহাসকে যে আকর্ষণীয় করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তথ্যসূত্র :
[১] Jan Plamper, ‘The History of Emotions : An Introduction’, trans. Keith Tribe, (OUP, 2015), pp. 9 – 10
[২] Beverley Fehr and James A Russell, ‘Concept of Emotion Viewed from a Prototype Perspective’, Journal of Experimental Psychology, 113/3 (1984), pp. 464 – 486
[৩] Michael Stocker, ‘Emotional Thoughts’, American Philosophical Quarterly 24 (1987) p. 59
[৪] Jan Plamper, ‘The History of Emotions : An Interview, History and Theory’, Vol. 49, No. 2 (May, 2010), pp. 237 – 265
[৫] Thomas Dixon, ‘Emotion, Emotion Review’, Vol 4, No. 4 (October 2012), pp. 338 – 344
[৬] Aristotle, ‘The Art of Rhetoric’, trans. John Henry Freese (Cambridge, Harvard University Press, 1959), p. 173
[৭] Augustine, The City of God, ed. & trans. R. W. Dyson (Cambridge, Cambridge University Press, 1998), p. 590
[৮] Jan Plamper, ‘The History of Emotions: An Introduction’, pp. 17-18
[৯] Ibid. p. 20
[১০] Thomas Hobbes, ‘Leviathan’, ed. Richard Tuck (Cambridge, Cambridge University Press, 1960), p. 89
[১১] Gardiner, Metcalf and Beebe-Centre, ‘Feeling and Emotion : A History of Theories’, Vol. 4, (Greenwood Press, 1937), p.167
[১২] Jean Jacques Rousseau, ‘Emile’, trans. & ed. Christopher Kelly and Allan Bloom (Lebanon, Dartmouth College Press, 2010), p. 167
[১৩] Jan Plamper, ‘The History of Emotions : An Introduction’, p. 24
[১৪] Ibid, p. 39
[১৫] Ibid, p. 43
[১৬] Ibid, p. 44
[১৭] Ibid, p. 45
[১৮] Aby Warburg, Durer and Italian Antiquity (1905), in ‘The Renewal of Pagan Antiquity : Contributions to the Cultural History of the European Renaissance’, trans. David Brett, (Los Angeles, Getty Research Institute for the History of the Arts and the Humanities), 1999, pp. 553-8
[১৯] Stewart Clark, ‘French Historian and Early Modern Popular Culture’, Past and Present 10 (1983), pp. 62-99
[২০] Susan J. Matt, Peter N. Stearns, ed. ‘Doing Emotions History’ (University of Illinois Press, 2013), p. 3
[২১] Marc Bloch, ‘The Historian’s Craft’, trans. Peter Putnam, (New York,1973), p. 194
[২২] Febvre, “A New Kind of History” in ‘A New Kind of History and Other Essays’, (New York, 1973), p. 34
[২৩] John Corrigan, ‘Business of the Heart : Religion and Emotion in the Nineteenth Century’, (University of California Press, 2001), p. 270
[২৪] Philippe Aries, ‘Centuries of Childhood : A Social History of Family Life’, trans. A. Knopf, (Vintage Books,1972); Roger Chartier, History of Private Life, Vol. 3, (Harvard University Press,1993)
[২৫] Jan Plamper, op. cit, p. 40
[২৬] Norbert Elias, ‘The Civilizing Process : The History of Manners’, trans. Edmund Jephcott (New York, 1978), p. 135
[২৭] Ibid, p. 135
[২৮] Zevedei Barbu, ‘Problems of Historical Psychology’, (New York, 1960); Robert Mandrau, ‘Introduction to Modern France : An Essay in Historical Psychology’, trans. R. E. Hallmark, (New York, 1975)
[২৯] https://en.oxforddictionaries.com/defination/psychohistory, accessed on 12. 03. 2023, at 15:55 hours
[৩০] Susan J. Matt, Peter N. Stearns, ed. ‘Doing Emotions History’, (University of Illinois Press, 2013), p. 2
[৩১] Ibid, p. 3
[৩২] Peter N. Stearns and Carol Z. Stearns, ‘Emotionology : Clarifying the History of Emotions and Emotional Standards’, The American Historical Review, Vol. 90, No. 4, (October, 1985), p. 813
[৩৩] John Corrigan, ‘Business of the Heart : Religion and Emotions in the Nineteenth Century’, (University of California, 2002), p. 274
[৩৪] John Corrigan, op. cit, pp. 273-4
[৩৫] Ibid, p. 275
[৩৬] Jan Plamper, op. cit, p. 42
[৩৭] Barbara H. Rosenwein, ‘Emotional Communities in Early Middle Ages’, (USA, Cornell University Press, 2006), p. 2
[৩৮] Ibid, p. 24
[৩৯] Ute Frevert, ‘Emotions in History : Lost and Found’, (Central European University Press, 2013)
[৪০] Ute Frevert, ‘Wartime Emotions : Honour, Shame and the Ecstasy of Sacrifice’, in U. Daniel et all, eds, Online International Encyclopaedia of the First World War, (Berlin, Freie Universitat)
[৪১] Ute Frevert et al., ‘Emotional Lexicon : Continuity and Change in the Vocabulary of Feeling 1700-2000’ (UK, Oxford University Press, 2014)
[৪২] Ute Frevert et all, ‘Learning How to Feel : Children’s Literature and the History of Emotional Socialization 1870-1970’, (UK, Oxford University Press, 2015)
[৪৩] Margrit Pernau et al., ‘Civilizing Emotions : Concepts in Nineteenth Century Asia and Europe’, (UK, Oxford University Press, 2015)
[৪৪] Thomas Dixon, ‘Weeping Britannia: Portrait of A Nation in Tears’, (UK, Oxford University Press, 2015)
[৪৫] Owen M. Lynch, ‘Divine Passions : The Social Construction of Emotion in India’, (Berkeley, University of California Press, 1990)
[৪৬] Wilhelm Halbfass, ‘India and Europe : An Essay in Philosophical Understanding’, (Delhi, Contemporary Religion and Philosophy, 1990)
[৪৭] Partha Chatterjee, ‘Nationalist Thought and the Colonial World: A Derivative Discourse’, (London, Zed Books, 1986)
[৪৮] Tapan Raychaudhuri, ‘Europe Reconsidered: Perceptions of the West in Nineteenth Century Bengal’, (0UP, 1988)
[৪৯] Tapan Raychaudhuri, ‘Perceptions, Emotions, Sensibilities: Essays on India’s Colonial and Post-Colonial Experiences’, (OUP, 2000)
[৫০] Rajat Kanta Ray, ‘Exploring Emotional History: Gender, Mentality and Literature in the Indian Awakening’, (Delhi, OUP, 2001)