জলবায়ু পরিবর্তন বয়ে আনছে মানসিক বিপর্যয়

রাহুল রায়

‘মাত্রএকটিইপৃথিবী’ — ১৯৭৪ সালে পরিবেশ দিবসে মানুষের কাছে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রথম যে বার্তাটি ছিল, ২০২২-এ আটচল্লিশতম পরিবেশ দিবসেও রাষ্ট্রপুঞ্জ মানুষের কাছে একই বার্তা জানিয়েছে। প্রায় অর্ধশতাব্দ-র মাথায় কীসের দরকারে ফিরে আবার এই একই চেতাবনি! রাষ্ট্রপুঞ্জের দেওয়া প্রতিটি পরিবেশ বার্তা ভালভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, পৃথিবীকে বাঁচানোর কথাটা বার বার বলা হয়েছে নানাভাবে। তো বারবার কেন প্রায় একই কথা বলতে হচ্ছে! ১৯৭২ সালে স্টকহোম-এ প্রথম পরিবেশ সম্মেলনের পঞ্চাশ বছর কেটে যাবার পরেও মানুষ-পরিবেশ সম্পর্ক কি তবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে? রাষ্ট্রপুঞ্জের দেওয়া আটচল্লিশটি পরিবেশ-চেতাবনি কি কাজে এল না এই একমাত্র প্রাণময় গ্রহটিকে রক্ষা করতে? কী হবে এর উত্তর?          

সর্বনাশের আশায় 

বর্তমানে যে কোনও প্রকৃতি-পরিবেশের আলোচনায় নানান ভয়াল দিকের কথা উঠে আসে, যেমন — এই গ্রহটির ক্রমশ উষ্ণ হওয়া, হিমবাহ গলে যাওয়া, সমুদ্রের জলতল ক্রমশ বেড়ে যাওয়া, মৃতপ্রায় প্রবাল প্রাচীর, বনজঙ্গল কমে আসা ও দাবানল, নদীগুলি দূষণে কালো হওয়া, নানান প্রজাতির বিলুপ্তি, পৃথিবী জুড়ে জলবায়ু বদলে যাওয়া ইত্যাদি৷ এটি একটি দীর্ঘ তালিকা। সামনে আরও কী কী অপেক্ষা করছে তা এখনও পুরোটা জানাও নেই।

পৃথিবীর ৭০টিরও বেশি দেশের ২৫০ জন বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞের তৈরি UNEP’র Sixth Global Envvironmental Outlook Report (2019) অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী সামগ্রিক পরিবেশের অবনতি হচ্ছে। প্রতিবেদনটিতে বেশ কিছু উদ্‌বেগপূর্ণ প্রধান দিক তুলে ধরা হয়েছে যার আশু সমাধান দরকার। সুস্থ-সবল মানুষ নিয়ে ভবিষ্যৎ এক সুস্থ গ্রহ গড়ে তোলার লক্ষ্যে নতুন চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে UNEP’র এই ষষ্ঠ গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল আউটলুক (২০১৯) প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে, যেখানে ‘এখন উন্নয়ন, পরে শোধন’ (‘Grow now, clean up after’) মডেলটির বদলে ২০৫০ সালের মধ্যে ‘প্রায়-শূন্য-বর্জ্য অর্থনীতি’-র (‘near-zero-waste economy’) উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে পৃথিবী যে পথে চলেছে তাতে ২০৩০ বা ২০৫০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় কিছুতেই পৌঁছাতে পারবে না বলে ষষ্ঠ গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল আউটলুক সতর্ক করেছে। জলবায়ু সংক্রান্ত জরুরি পদক্ষেপ নিতে আর দেরি হলে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে অনেক বেশি মূল্য চোকাতে হবে, কারণ জলবায়ু পরিবর্তন উন্নয়নের মুখটিকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে বা একে অসম্ভব করে তুলতেও পারে।  

জলবায়ু পরিবর্তন এখন বাস্তব 

মানুষের নিজকৃত নিয়তিস্বরূপ জলবায়ু পরিবর্তন এক সংকটময় অবস্থা সৃষ্টি করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন আজ আর কোনও ‘ঘটতে পারে’ গোছের বিষয় না। এটি ঘটছে। এটি সত্য। এর ফলে  ভারত সহ বিশ্বের অনেক জায়গায় আরও চরম আবহাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে, যেমন — তাপপ্রবাহ, অতি ভারী বৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং আরও অনেক কিছু। রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (‘আইপিসিসি’) এর ২০২১ সালের প্রতিবেদনে এ নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। এই ধরনের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চরম ঘটনা নানান ক্ষতি, দুর্ভোগ সৃষ্টি এবং মানুষকে ভিটেমাটিছাড়া করে। জলবায়ু পরিবর্তন যে বিশ্বব্যাপী বাস্তুতন্ত্রের ‘অপরিবর্তনীয়’ ক্ষতির কারণ হয়েছে এবং হচ্ছে, তা ‘আইপিসিসি’-র সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তাই সব কিছু হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগে যা করার তা এখনই করতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত 

সব মিলিয়ে, সামনের দিনগুলি যথেষ্টই ভয়ের। একথা এড়িয়ে যাবার কোনও উপায় নেই যে, মানুষের মঙ্গল তার চারপাশের পরিবেশের সাথে জড়িত। এই পরিবেশ এখন বিপন্ন। প্রাকৃতিক পরিবেশের এই বিপন্নতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে। মানুষের মনে এটি হতাশা, ব্যর্থতা এবং ক্রোধের সৃষ্টি করছে। মনের এই অবস্থাটি ক্রমশ এতটাই উদ্‌বেগজনক হয়ে উঠছে যে, গবেষক অ্যাশলি কুনসোলো এবং নেভিল এলিস-এর মতে, এই প্রভাবগুলির ফলে মানসিক আঘাতজনিত ধকল, বিষণ্ণতা, এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে।

কুনসোলো এবং এলিস জানাচ্ছেন, কানাডা’র ল্যাব্রাডর-এর নুনাটসিয়াভুট (Nunatsiavut) অঞ্চলে ‘ইনুইট’ (‘Inuit’) সম্প্রদায়ের তুষারাবৃত বাসভূমিতে সাম্প্রতিককালে অত্যন্ত বেশিরকম বরফ গলে যাবার ফলে এখানে পর্যটকরা তাদের ঐতিহ্যশালী কার্যকলাপ (মাছ ধরা ও পশু শিকার) এবং সাংস্কৃতিক স্থানগুলি দেখতে আগের তুলনায় অনেক কম সংখ্যায় আসছে। এতে ইনুইট’রা খুব মুষড়ে পড়েছে। এদের রোজগার কমে গেছে। তাদের মধ্যে দুঃখ, রাগ, হতাশা এবং অবসাদ দেখা দিচ্ছে। পৃথিবীর আরও বেশ কিছু অঞ্চলে এ ঘটনা ঘটছে। মানসিক এই অবস্থার নাম মনোবিজ্ঞানীরা দিয়েছেন ‘ইকোলজিক্যাল গ্রিফ’, সংক্ষেপে ‘ইকো-গ্রিফ’ (‘Ecological grief’) বা ‘ইকো-দুঃখ’ — বনভূমি, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি এসব বর্তমানে যা হারাচ্ছি বা ভবিষ্যতে যা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে, তার জন্য পরিবেশগত শোক। 

কাকে বলে ইকো-দুঃখ 

শোক এবং বিলাপ সাধারণত প্রিয়জন হারানোর সাথে যুক্ত। কিন্তু এখন এগুলি প্রকৃতি-পরিবেশের বর্তমান বিপন্নতা ও ক্ষতির সাথেও জড়িত। মানুষ বর্তমানে এক অস্বাভাবিক বাস্তুতান্ত্রিক ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে চলেছে। মানুষের কাজকর্ম পৃথিবীর প্রাণ টিকিয়ে রাখার ক্ষমতাটিকেই যে শুধু নড়বড়ে করে তুলেছে তা নয়, মানুষের কাজ পৃথিবীকে এক নতুন ভূতাত্ত্বিক যুগে নিয়ে চলেছে। বিজ্ঞানীরা একে বলছেন ‘অ্যানথ্রপোসিন’ (‘Anthropocene’)। মানুষ-আধিপত্যময় প্রকৃতিতে বিগত শতাব্দ’র মাঝামাঝি থেকে ‘অ্যানথ্রপোসিন’ শুরু হয়েছে বলে কলিন ওয়াটার প্রমুখ একদল বিশিষ্ট গবেষক জানিয়েছেন। 

বাস্তুতান্ত্রিক ক্ষয়ক্ষতি এবং এই গ্রহটির প্রণালীতে (system) যে পরিবর্তন ঘটে গেছে মানুষের অবিবেচক কাজকর্মে, তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব মানুষ রোজকার জীবনে বুঝতে শুরুও করেছে। পৃথিবীর নানান প্রণালীতে পরিবর্তন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দ্যে বয়ে আনছে অবসাদ ও অমঙ্গল। বইপত্রে এখনও এ ধরনের আবেগসংক্রান্ত প্রতিক্রিয়ার তথ্য বা তত্ত্ব খুব বেশি মেলে না। গবেষক অ্যাশলি কুনসোলো এবং নেভিল এলিস বাস্তুতান্ত্রিক ক্ষয়ক্ষতিজনিত এ ধরনের আবেগপ্রবণ অবস্থাকে ‘ইকোলজিক্যাল গ্রিফ’ বলেছেন। এঁরা আরও জানাচ্ছেন, ইকো-দুঃখ মনের এক স্বাভাবিক অবস্থা, যাকে প্রায়ই এড়িয়ে যাওয়া হয়। 

অ্যাশলি কুনসোলো এবং নেভিল এলিস জানাচ্ছেন, ‘তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে প্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্র হারানো বা ক্ষতির অভিজ্ঞতা বা আশঙ্কার অনুভূতির সাথে ইকো-দুঃখ সম্পর্কিত।’ পরিবেশগত শোক বা ‘ইকো-দুঃখ’ উদ্‌বেগ, দুঃখ এবং শোকের সাথে যুক্ত। এটি এমন এক ধরনের দুঃখ যা প্রায়ই প্রকাশ্যে স্বীকার করা হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে একে জলবায়ু-শোক-ও বলা হয়। এই গবেষকরা কানাডা’র উত্তরাঞ্চলে এবং অস্ট্রেলিয়া’র বিস্তীর্ণ গম-উৎপাদক অঞ্চলে (wheatbelt) ক্ষেত্রসমীক্ষা করে সেখানকার মানুষের মধ্যে বাস্তুতান্ত্রিক ক্ষয়ক্ষতিজনিত ‘ইকো-দুঃখ’ লক্ষ করেছিলেন। এঁরা ‘ইকো-দুঃখ’-কে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। 

  • যে সব দুঃখ প্রাকৃতিক পরিবেশগত ক্ষতির (যেমন জমি, বাস্তুতন্ত্র এবং প্রজাতি) সাথে জড়িত — উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার মতো চরম আবহাওয়ার কারণে স্থানচ্যুত মানুষ তাদের বাড়িঘর, জমিজমা এবং প্রতিবেশী হারানোর দুঃখ পায়।
  • যে সব দুঃখ পরিবেশগত জ্ঞানের অবক্ষয় এবং ব্যক্তি-পরিচয় হারানোর সাথে জড়িত — উদাহরণস্বরূপ, অনেক সম্প্রদায়ের মানুষদের স্থানীয় প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ‘পরম্পরাগত পরিবেশীয় জ্ঞান’ থাকে। কোনও অঞ্চলে কতগুলি বাস্তুতন্ত্র কাজ করে বা রয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে বোঝার জন্য এই ধরনের ‘পরম্পরাগত পরিবেশীয় জ্ঞান’ বর্তমানে ক্রমশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকৃত হচ্ছে। এর সাহায্যে স্থানীয় আবহাওয়ার মরশুমি ছন্দকেও স্পষ্ট বোঝা যায়। যেমন, ভারতের কৃষিজীবী মানুষ তাদের জীবনজীবিকার জন্য মৌসুমি বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে। তাদের পরম্পরাগত অভিজ্ঞতায় নানান ফসল চাষের জন্য স্থানীয় আবহাওয়ার এক পাঁজি রয়েছে, যা মেনে তারা চাষ করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন স্থানীয় এবং আঞ্চলিক আবহাওয়ার ধরনগুলিকে ওলটপালট করে দিয়েছে। এই ‘পরম্পরাগত পরিবেশীয় জ্ঞান’ আর কাজে আসছে না। এটি এদের মধ্যে উদ্‌বেগ এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। 
  • যে সব দুঃখ আগামী পরিবেশগত ক্ষতির সাথে জড়িত — বর্তমান অভিজ্ঞতায় এটি স্পষ্ট যে, পৃথিবীতে যেসব পরিবর্তন হচ্ছে তা মোটেই ভাল নয়। ভবিষ্যতে যদি এসব পরিবেশগত ক্ষতি ঘটতে থাকে বা এগুলি আরও বাড়তেই থাকে, তাহলে আগামী প্রজন্মের কী হবে? তারা কীভাবে এর মোকাবিলা করবে? এসব ভাবনা বেশ কিছু মানুষকে ক্রমশই বিষণ্ণ করে তুলছে। 

শোক সর্বব্যাপী 

এখানে একটি বিষয় উল্লেখের যে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক অঞ্চলে বন্যপ্রাণী এবং বাস্তুতন্ত্রের হাল নথিভুক্ত করার সময় বিজ্ঞানীরা বর্তমানে যে অবনতি এবং ক্ষতি দেখতে পাচ্ছেন, তাতে তাঁরাও ইকো-দুঃখের মুখোমুখি হচ্ছেন বলে গায়া ভিন্স জানাচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়া’র ‘গ্রেট ব্যারিয়র রিফ’ উষ্ণায়নে ক্রমশ ধ্বংস হওয়ায় ‘এক্সটার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মেরিন বায়োলজি অ্যান্ড গ্লোবাল চেঞ্জ’ বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক স্টিভ সিম্পসন ইকো-দুঃখে ভুগছেন। উত্তর-কানাডা’র ‘নুনাভুট’ অঞ্চলের বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয়ে ইকো-দুঃখের হাত থেকে রেহাই পাননি ‘ল্যাব্রাডর ইন্সটিটিউট অফ মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটি-‘র অধিকর্তা অ্যাশলি কুনসোলো। এরকম আরও নাম করা যায়। 

মার্কিন প্রকৃতিবিদ অ্যালডো লিওপোল্ড ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘A Sand County Almanac’-এ প্রথম বাস্তুতান্ত্রিক ক্ষয়ক্ষতির আবেগজাত মানসিক বিপর্যয়ের কথা বলেন। বইটিতে লিওপোল্ড লিখেছেন — ‘বাস্তুতান্ত্রিক শিক্ষার একটি অন্যতম শাস্তি হল ক্ষতভরা পৃথিবীতে একাকী বেঁচে থাকা।’ 

ইকো-দুঃখের প্রভাব মানুষ এবং তার সংস্কৃতিতে কতটা ছাপ ফেলতে পারে? এটা কি সমাজের কিছু অংশের মানুষকে অন্যদের চেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে? মানুষের এখনও ইকো-দুঃখ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। আশেপাশের পরিবেশ বদলে যাওয়ায় যে মানসিক অবসাদ আসে,তাকে বলে ‘সোলাস্টালজিয়া (‘Solastalgia’)। এখনও মানুষ ঠিকমতো জানে না যে ‘ইকো-দুঃখ’ এবং ‘সোলাস্টালজিয়া’-র তফাত কতটুকু বা কী। 

শুনলে অবাক হতে হয়, গবেষক সাশা স্টারোভইটভ জানাচ্ছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ-এ মানুষ বিশ্ব উষ্ণায়নে ব্যাপক হিমবাহ বিগলনে স্বজন হারানোর শোকের মতো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পালন করছে। আইসল্যান্ড-এর ‘ওকে’ (‘Ok’) হিমবাহ বিগলনে ২০১৯ সালে প্রায় ১০০ জন ভারাতুর মানুষ কবিতা পড়ে ও নানান কথনের মাধ্যমে শোকজ্ঞাপন করে এক স্মৃতিফলক স্থাপন করেন। ২০২০ সালে অরিগন-এর ‘ক্লার্ক’ (‘Clark’) হিমবাহকে হিমবাহবিদেরা (Glaciologist) মৃত (অর্থাৎ হিমবাহ যখন আর আয়তনে বাড়ে না) বলে ঘোষণা করেন। তখন ‘অরিগন গ্লেসিয়ার ইন্সটিটিউট’ এক পারলৌকিক ক্রিয়ার আয়োজন করে হিমবাহটির ওপর কড়া নজর রাখে। হালফিলে ‘বাসোদিনো’ (‘Basodino’) হিমবাহ গলে যাওয়ায় সুইস ক্লাইমেট অ্যালায়েন্স অনুরূপ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করে।

প্রকৃতি-পরিবেশ আলাদা, দুঃখ একই

নুনাটসিয়াভুট অঞ্চলের ‘রিগোলেট’ (‘Rigolet’) সম্প্রদায়ের শিকার করে বেড়ে ওঠা এক পুরুষ জানাচ্ছেন —

মানুষ এখন আগের মতো নেই। তারা স্বস্তিতে নেই এবং একই জিনিস আর করতে পারছে না। তোমার কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিলে তা আর তোমার থাকে না। তোমার জীবনযাপনের কোনও পথ যখন পারিপার্শ্বিক কারণে, যেটি তোমার হাতের বাইরে, হারিয়ে যায় তখন জীবনের ওপর তোমার রাশ আলগা হয়ে যায়। 

এই একই কথা শোনা যায় পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া-র বিস্তীর্ণ গম উৎপাদক অঞ্চলের বংশ পরম্পরায় চাষিদের মুখে। এক বয়স্ক চাষি বলছেন,

নিজের সাধের খামারটিকে ধূলিঝড়ে নষ্ট হয়ে যেতে দেখার মতো খারাপ দৃশ্য সম্ভবত আর হয় না। আমার স্মৃতিতে এটিই সম্ভবত সবচেয়ে জঘন্য অনুভূতি। আমার নাক-সমান উঁচু ধূলিঝড়ে খামারটিকে উড়ে যেতে দেখেছি বহুদূর। আমার জীবনের এ এক অন্যতম অবসাদজনক ঘটনা। এত জোরে ঝড় বইছিল যে আমি সেখানে দাঁড়িয়ে তা দেখতে পারিনি। ঘরের ভেতর বাধ্য হয়ে ঢুকে পড়েছি।

উল্লেখ্য যে, ওপরের দুটি ঘটনার অভিজ্ঞতা সোলাস্টালজিয়া-র তত্ত্বকে দু’ভাবে ধ্বনিত করছে। প্রথমত, নিজের জায়গার জন্য এক ধরনের কাতরতা; এবং দ্বিতীয়ত, চেনা জায়গা ক্রমশ বদলে যাওয়া ও সমৃদ্ধ বাস্তুতন্ত্র চোখের সামনে ধ্বংস হতে দেখার এক মনোকষ্ট। অস্ট্রেলিয়া-র পারিবারিক চাষিরা ফসলের মরশুমি বৈচিত্র্য হ্রাস এবং দীর্ঘকালীন শুষ্কতার কারণে ভূপ্রকৃতির অবনমনে লজ্জায় নিজেদেরই দোষ দেন। 

নিজেদের খামার উড়ে যেতে দেখতে চাষিরা ঘৃণা করে। এ ঘটনাটি তাদের যেন বলে যায় তুমি একজন অপদার্থ চাষি। আমি মনে করি সকল চাষিই ভাল চাষি। সকলেই তাদের সব সেরাটুকু দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে। তারা সকলেই তাদের জমিকে ভালবাসে।

আবহাওয়া এবং ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন নুনাটসিয়াভুট-এর বয়স্ক ইনুইটদের দীর্ঘকালের বংশানুক্রমিক বাস্তুতান্ত্রিক জ্ঞানকে যেন খারিজ করে দিচ্ছে। এটি তাদের সনাতন কৃষ্টি ও আত্মবিশ্বাসেও আঘাত করছে। সেখানকার এক বিশিষ্ট শিকারি জানাচ্ছেন,

এ ঘটনাটি আমাদের অনেক ভাবে আঘাত করছে। যেমন, আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন আর কখনোই আমার নাতিদের এতকাল যা করে এসেছি, তা আর দেখাতে পারব না। এটা আমার কাছে বড়ো বেদনার। সবসময় যেন বুকে বাজছে। এ ব্যথা আমি নিজের মধ্যেই চেপে রেখেছি।

বহু ইনুইট এবং পারিবারিক চাষি তাদের আগামী দিনগুলি নিয়ে চিন্তিত। ভবিষ্যতে বাস্তুতান্ত্রিক ক্ষয়ক্ষতি যে আরও বাড়বে বই কমবে না, এটা আঁচ করতে পেরে তারা বিষাদগ্রস্ত। রিগোলেট সম্প্রদায়ের এক মহিলা বলছেন —

আমার মনে হয় এসব পরিবর্তন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলবে। কারণ এতদিন যা কিছু করেছি, তা করতে বাধা এলে মন বিষণ্ণ হয়। এতদিনের চেনা ভূমি যখন আর আমাদের থাকছে না, মনে হয় যেন জীবনের একটা অংশ হারিয়ে গেল। এটা ভয়ানক অবসাদ বয়ে আনছে।

একইভাবে অস্ট্রেলিয়ার একজন গমচাষি ভবিষ্যতে তাঁদের পারিবারিক খামারটি হারানোর দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তিনি জানাচ্ছেন,

এটা যেন মৃত্যুর সমান। এই খামার আমাদের পরিবারের সকলকে একসাথে ধরে রেখেছিল। এটাকে হারানো প্রিয়জন হারানোর থেকেও বেশি বেদনার। আমি আর কিছু জানি না। এটা সত্যিই খুব কষ্টের।       

দুঃখ কীসে যায়

মনোবিজ্ঞানী ও গবেষকদের মতে এটি নিশ্চিত যে ইকো-দুঃখ সহজে যাবার না। আগামী দশকে পৃথিবী আরও ইকো-দুঃখের মুখোমুখি হতে চলেছে, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলি যেহেতু চলতে থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার সাথে পৃথিবীর নানান অঞ্চলে মানুষের মধ্যে এটি আরও বেশি দেখা যাবে। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ইকো-দুঃখের প্রভাবগুলি ভালভাবে খতিয়ে দেখা অতি জরুরি। এই প্রভাবগুলিকে গভীরভাবে বুঝতে পারাই ব্যক্তিমানুষ থেকে শুরু করে গোষ্ঠীস্তরে মানসিক বিপর্যয় মোকাবিলা করার একমাত্র উপায়। আশা একটাই, তখন যদি মানুষ তার নিজের মানসিক নৈরাশ্য থেকে মুক্তির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে রুখতে কোমর বেঁধে মাঠে নামে। মানুষের নিজকৃত নিয়তিস্বরূপ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলি দূর করতে বা ঠেকাতে ব্যক্তি-মানুষ, গোষ্ঠী এবং রাষ্ট্র এখনও যদি তৎপর না হয়, তবে আগামীদিনে সমাজের আরও ব্যাপক অংশের মানুষ ইকো-দুঃখের শরিক হবে। 

তথ্যঋণ

1. Cunsolo Ashlee & Neville R. Ellis: Ecological grief as a mental health response to climate change-related loss; Nature Climate Change, 03.04.2018.

2. Ellis R. Neville & Ashlee Cunsolo: Hope and mourning in the Anthropocene: Understanding ecological grief; The Conversation, April 4, 2018. 

3. Perinchery Aathira: Worrying About Nature Is Affecting Mental Health. It’s Called Eco-Grief; ScienceTheWire, 14.03.2022. 

4. Starovoitov Sasha: Glacier Funerals Offer a Way of Coping With Ecological Grief; State of the Planet, Columbia Climate School, 24.09.2021.

5. Vince Gaia: How scientists are coping with ‘ecological grief’; The Guardian, 12.01.2020. 

6. Water N Colin, Sjan Zalasiewicz, Colin Summerhayes, Anthony D. Barnosky, Clément Poirier, Agnieszka, Gałuszka Alejandro Cearreta, Matt Edgeworth, Erle C. Ellis, Alexander P. Wolfe et al.: The Anthropocene is functionally and stratigraphically distinct from the Holocene; SCIENCE, Jan 2016, Vol 351, Issue 6269. 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান