রেনি গুঁয়ো
(অনুবাদ : নূপুরশিঞ্জন ভট্টাচার্য)
মানুষের জীবনের একদিকে যেমন রয়েছে যৌনচেতনা, যা অদম্য ও চিরস্থায়ী; তেমনই অন্যদিকে রয়েছে যৌন চেতনা সংক্রান্ত নানান ট্যাবু বা বিধিনিষেধ। উভয়ের মধ্যে বিরোধ অন্তহীন। আমাদের দূরদৃষ্টিই বলে দেয় যে, এই বিরোধের ফলে যেসব হতভাগ্য তাদের নৈতিক আদর্শ ও যৌন চাহিদা এ-দুয়ের টানাপোড়েনে ছটফট করছে তাদের ভারীরকম শারীরিক গণ্ডগোল দেখা দেবেই।
সত্যিই তা ঘটে। যেসব মানুষের সুখী হওয়ার সবরকম উপকরণই আছে, তারাও যে বিষাদ, একঘেয়েমি বা বিরক্তিতে ভোগে, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তার কারণ হল যে, তাদের যৌনকামনা অতৃপ্ত থাকে অথবা যথেষ্ট তৃপ্ত হয় না। বস্তুত আমাদের সমাজে, ধর্মে, যৌননিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যই এই যে, মানুষের অত্যন্ত ন্যায়সংগত ও যুক্তিসংগত যৌনকামনাও যেন হতাশায় পর্যবসিত হয়। ফ্রয়েড প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে শিশুর তুলনা করতে গিয়ে যথার্থই মন্তব্য করেছেন, শৈশবে শিশু যে জিনিসগুলি পছন্দ করত খুব, পরবর্তীকালে তাকে সেই সব জিনিসই ঘৃণ্য বলে শেখানো হয় : “কোনও ব্যক্তি বড়ো হলে তখন তার কাছে আশা করা হয় যে শৈশবে যে কাজগুলিতে সে আনন্দ পেত সেই কাজগুলিই যেন সে এখন ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করে।” আমরা যদি বলি, পূর্বের অবস্থাটাই ছিল স্বাভাবিক প্রকৃতিগত, আর পরবর্তী অবস্থাটাই হল সম্পূর্ণ কৃত্রিম ও প্রথাগত, তাহলে সেই স্বাভাবিক অবস্থাকে দমিয়ে রাখার ফলে যে স্নায়ুবিকার বা নৈতিক অস্বস্তি দেখা দিতে পারে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
তাছাড়া চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তো লক্ষ করা যায়, যৌনতৃপ্তির ফলে সুনিদ্রা হয় অন্যদিকে “অধিকাংশ স্নায়বিক অনিদ্রারোগই যৌনজীবনে ঘাটতি থেকেই জন্মায়।” [অনেক অনিদ্রারোগী আমাকে জানিয়েছেন যে তৃপ্তিদায়ক যৌনসংগম বা এমনকী হস্তমৈথুনের পর তাঁদের ভালো ঘুম হয়। — নরম্যান হেয়ার] আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, শুধু এই ঘাটতি বা অভাবের জন্যই নয়, আসলে অবদমনের ফলে যে মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তা-ই হল সকল প্রকার স্নায়ুবিকারজনিত রোগের সিংহদ্বার। কিছু কিছু প্রাপ্তবয়স্কের মনে যৌনসংযমের ফলে জাত উৎকণ্ঠা সমগ্র শারীরতন্ত্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। পশুদের জীবনেও তো আমরা দেখতে পাই, তাদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর কামোত্তেজনা যদি বিশেষভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় তবে তা উন্মত্ত অবস্থার সৃষ্টি করে; তাহলে মানুষের ক্ষেত্রেই বা তার অন্যথা হবে কী করে? সুতরাং এই অবস্থাটাকে হালকা করে দেখা অযৌক্তিক। তদুপরি, সাধারণ নিয়ম বা প্রথা যাই বলুন না কেন, যৌনতৃপ্তির চেয়ে সংযম অধিক বাঞ্ছনীয় — এ এক অবাস্তব কল্পনা। আমরা শুধু এইটুকু স্বীকার করতে পারি, একজনের তৃপ্তির প্রয়োজন আরেকজনের প্রয়োজনের চেয়ে কমবেশি হতে পারে। নিষেধবাদের শিক্ষার ভুল এইখানেই। কারণ তা বলে, যৌনকামনা পরিত্যাগ করা সম্ভব। “সত্তর বৎসর বয়স্ক একজন ইতালিয়ান মঠাধ্যক্ষ কুরিয়ার (Courier)-কে জানিয়েছেন যে, যদিও তিনি আজীবন তাঁর কৌমার্যের শপথ রক্ষা করে এসেছেন, তবু পরবর্তী কোনো জন্মেই তিনি আর কুড়ি বছর বয়সে ওইরকম যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নিতে রাজি নন… ।” আমরা La Réole-এর নিকটবর্তী Cours-এর এক যাজকের গল্পও জানি — তিনি পূর্ণ যৌনসংযম অভ্যাস করতে গিয়ে কামোন্মাদ (Satyriasis) রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েন ও মাত্র বত্রিশ বৎসর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। শারীরবিজ্ঞানের সঙ্গে নীতিশিক্ষার জেদি দ্বন্দ্বের এই-ই হল ভয়ংকর পরিণতি।
যৌনক্রিয়া ও যৌন-ইন্দ্ৰিয় (যা রসক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে) কতকগুলি পর্যায়ক্রমিক ধর্ম মেনে চলে; এগুলি পুষ্টিক্রিয়ার মতোই নিয়মিত। কিন্তু “বৌদ্ধিক ও সামাজিক প্রভাবে মানুষের মধ্যে এই প্রাকৃতিক ছন্দ এত বেশি বিপর্যস্ত হয়ে গেছে” যে, ওই প্রাকৃতিক ধর্মগুলি নির্ণয় করা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং যাঁরা কৌমার্য বা সংযমের বাণী প্রচার করেন তাঁরা এই প্রাকৃতিক ধর্মগুলিকে হয়তো ভুল বুঝতে পারেন অথবা পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু এই দ্বিতীয় অবস্থাটি আদৌ স্বাভাবিক নয়, বরং অত্যন্ত কৃত্রিম আর তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী সেই নৈতিক প্রথা যা সুখবর্জনের উপদেশ দেয়। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই ‘স্বাভাবিক ছন্দ’-ই লঙ্ঘিত হয় আমাদের কৃত্রিম সমাজে — মানবিক স্বাস্থ্যের পক্ষে এ-এক অত্যন্ত ক্ষতিকর অভ্যাস এবং এর ফলে মানবজাতির অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে।
এমনিতে যারা স্বাস্থ্যবান অথচ অলঙ্ঘনীয় যৌননিষেধের ফলে স্নায়বিক বিকারগ্রস্ত এমন রোগীর সংখ্যা অগণন। মনোবিশ্লেষণের ফ্রয়েডীয় পদ্ধতিতে ও অন্যান্য নানা স্নায়ুবিকাররোগ-চিকিৎসার মাধ্যমে এইসব যৌন-অবদমনের অসহায় রোগীর কথা আমরা জানতে পারি। এই জাতীয় রোগীদের চিকিৎসার জন্য যখন ফ্রয়েডকে ডাকা হত, তিনি কেবলই মনেমনে নিজেকে প্রশ্ন করতেন, ওদের এই স্নায়বিক বিকারের মূলে কী আছে? এই প্রশ্নই সম্ভবত তাঁকে মনোবিশ্লেষণী চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কারের দিকে নিয়ে যায়। কার্যকারণ-সম্পর্কের সাহায্যে তিনি লক্ষ করেন যে সকল ক্ষেত্রেই বা অন্তত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্নায়বিক বিকাররোগের কারণ হল নানাবিধ ‘সেন্সরশিপ ও যৌন-অবদমন’।
আমরা শুধু এই বিষয়ের ওপর ফ্রয়েড ও জুরিখ স্কুল যে গবেষণা করেছেন, এখানে তার উল্লেখটুকু করেই সন্তুষ্ট থাকব। তাঁরা যাবতীয় স্নায়বিক গণ্ডগোলকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন — প্রকৃত স্নায়বিক পীড়া, মানসিক-স্নায়বিক পীড়া ও আত্মপ্রেমী স্নায়বিক পীড়া। এই শ্রেণিবিভাগের মধ্যে সকল প্রকার স্নায়বিক পীড়াই — যেমন স্নায়বিক দৌর্বল্য, অবসাদ, বায়ুরোগ, মূর্ছা, বিষাদোন্মত্ততা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
এইসব রোগের চিকিৎসা ক্ষেত্রে অসংখ্য পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে; আমরা এখানে তার পুনরুল্লেখ করব না। আমরা শুধু আমাদের নিজস্ব আরও কয়েকটি পর্যবেক্ষণ যোগ করতে চাই এবং এই জাতীয় চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা থেকে যৌননৈতিকতা সম্পর্কে কী গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে সেই ব্যাপারেই আমাদের আগ্রহ সীমাবদ্ধ রাখব।
বিচিত্র প্রকার সমষ্টিগত স্নায়বিক পীড়া :
আমরা এখানে ফ্রয়েড-এর যৌনতা সংক্রান্ত স্নায়বিক রোগতত্ত্বকে সমর্থন জানিয়েও কতকগুলি বিশেষ স্নায়বিক রোগকে গুরুত্ব সহকারে দেখব। এইগুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে এক অর্থে এগুলি সমষ্টিগত, অর্থাৎ একই প্রকার শারীরিক ও সামাজিক অবস্থার মধ্যে বসবাসকারী একদল মানুষের মধ্যে এই রোগগুলি প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়।
(ক) শৈশবকালীন স্নায়বিক পীড়া :
এই রোগ অল্পবয়সি ছেলে বা মেয়ে উভয়ের মধ্যেই দেখা যায়, যতদিন না তারা ‘বড়ো’ হচ্ছে ও অন্তত কিছুটা স্বাধীনতা পাচ্ছে। যদি খুব দেরি না হয়ে গিয়ে থাকে তবে সামান্য চেষ্টা ও নিজস্ব বুদ্ধি প্রয়োগ করলে হয়তো এই অসুখ সারানো যায়। এই প্রথম শ্রেণির স্নায়বিক পীড়ার লক্ষণ স্নায়বিক অসাড়তা ও রক্তাল্পতা (যথার্থ লক্ষণগুলি ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন রকম হতে পারে) সেই সব অল্পবয়সিদের মধ্যে দেখা যায় প্রকৃতি যাদের শরীরে মনে সুতীব্র যৌনকামনা সঞ্চারিত করেছেন (অথচ তা চরিতার্থ করার উপায় নেই)। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক বা শিক্ষাজীবনে যৌনজীবন যাপন, নিষেধের ফলে, বিশেষ যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে; তাছাড়া অল্পবয়সিদের সঙ্গে তাদের বাবা-মায়ের বা শিক্ষকের গোপন বা প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব তো আছেই।
এই শ্রেণির রোগীদের মধ্যে রয়েছে অবসাদগ্রস্ত, বিষণ্ণ, গভীর অদ্ভুত রকমের নীরব, ভীরু ও অন্তর্মুখী সব ছেলেমেয়েরা, যারা পারিবারিক গণ্ডিতে বা স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে আড়ষ্ট জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। নিজে নিজে উত্তেজিত হয়ে যৌনসুখের চর্চাই তাদের একমাত্র আশ্রয় এবং তা অনেক সময় বাড়াবাড়ি রকমের অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। আমরা এই বিরোধটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখাতে চাই যে, অল্পবয়সেই যৌনকামনা সবচেয়ে সুতীব্র ও গভীরভাবে এবং আরও বলা যায়, সবচেয়ে চমৎকার ও আকর্ষণীয়রূপে প্রকাশ পায়, অথচ তা কোনো স্বীকৃতি বা তৃপ্তিবিধানের সুযোগ পায় না। এই নিষেধাত্মক মনোভাবের ফলে, জীবনকে সুন্দর ও মূল্যবান করে তোলার সম্ভাবনার বদলে অনিবার্যরূপে দেখা দেয় স্নায়ুরোগের পূর্বলক্ষণ, যা প্রায়শই দুরারোগ্য। এই জাতীয় কোনো কোনো রোগীর বয়ঃসন্ধিক্ষণে প্রচণ্ড ক্রোধবৃদ্ধি দেখা যায়, তা কখনো কখনো উন্মাদ অবস্থার সৃষ্টি করে, কিন্তু অতদূর না হলেও ব্যক্তির চরিত্র ও মেজাজের ওপর সর্বদাই গভীর প্রভাব বিস্তার করে। রিফরমেটরিতে এই ধরনের রোগ সারানো যায় না, কারণ সেখানে শুধু দমনকারী সমাজকে ঘৃণা করতে শেখানো হয়; তাদের আরোগ্যলাভের একমাত্র উপায় হল যৌনতার প্রতি মুক্ত মনোভাব ও যৌনচর্চার সুযোগ। যাঁদের এই আরোগ্যবিধান প্রয়োগ করার মতো বুদ্ধি আছে তাঁরা দেখে অবাক হবেন কী দ্রুত এইসব রোগীরা আরোগ্যলাভ করছে; অস্বাভাবিক, খিটখিটে, ক্রুদ্ধ, বিষণ্ণ উদাসীন ছেলেমেয়েগুলি প্রাণোচ্ছল সুস্থ কর্মচঞ্চল তারুণ্য লাভ করছে। অথচ যেসব শিক্ষাব্যবস্থা যৌনকার্যকে একটি নির্দিষ্ট বয়স না-হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছে তাদের প্রত্যেকটিকেই যৌন স্নায়বিক রোগসৃষ্টির ‘উষ্ণ শয্যা’ (উপযুক্ত স্থান) বলা যেতে পারে।
(খ) বিবাহিত জীবনে স্নায়বিক পীড়া :
বিবাহিত জীবনে যেহেতু নিয়মিত যৌনচাহিদা পূরণ অনুমোদিত তাই আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, বিবাহিত জীবনে বুঝিবা যৌন স্নায়বিক রোগ হওয়ার বা তা বজায় থাকার সম্ভাবনা কম, কিন্তু আসলে সবসময় তা হয় না।
আমাদের সমাজে আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত দুই শ্রেণির যৌন-চরিত্রের সন্ধান পাই — যার একদিকে রয়েছে জরায়ুকেন্দ্রিক নারী ও অণ্ডকোষকেন্দ্রিক পুরুষ এবং অপরদিকে রয়েছে ভগাঙ্কুরকেন্দ্রিক নারী ও লিঙ্গকেন্দ্রিক পুরুষ। এই দ্বিতীয় শ্রেণির নারী ও পুরুষের একটি সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য হল এঁরা মাঝেমাঝে যৌনসঙ্গী পরিবর্তন ছাড়া সম্পূর্ণ ও দীর্ঘস্থায়ী কামতৃপ্তি লাভ করতে পারেন না। একজন মাত্র যৌনসঙ্গীকে নিয়ে এঁরা অচিরেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এঁদের যৌন-আবেগ শুকনো জ্বলন্ত খড়ের মতো — তাড়াতাড়ি নিভে যায়, কিন্তু সহজেই আরেক জায়গায় প্রজ্বলিত হয়। এঁদের ক্ষেত্রেই সেই প্রবাদবাক্যটি সুপ্রযোজ্য : প্রেমের প্রথম মুহূর্তগুলিই সবচেয়ে আনন্দদায়ক। বস্তুত, এঁদের জীবনে এই ‘প্রথম মুহূর্ত’ প্রায়ই আসে। পরম প্রশান্তিতে একই ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন অধিকার করে রাখার কোনো মানে নেই এঁদের কাছে। কামোত্তেজনার সুখ (একই ব্যক্তির কাছে দীর্ঘদিন পেতে পেতে) ক্রমেই তীব্রতা হারায়। দীর্ঘদিন পরে এমনও দেখা যায়, যে-সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে তার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং যে তাকে নতুন কোনো যৌন-অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পেতে দিচ্ছে না, তার প্রতি বিরক্তি ও ঘৃণা জন্মাতে থাকে।
দেখা যাচ্ছে যে যাদের যৌনকামনা এই ধরনের, তাদের কাছে বিবাহিত জীবনের ভার বড়ো বেশি। বিবাহিত জীবন যে তৃপ্তি দেয় তা যখন আর তারা পায় না, তখন তাদের দ্বৈতজীবনের পরিবেশটাই পরস্পরের কাছে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। এমন বহু দম্পতি দেখা যায় যাদের ক্ষেত্রে স্বামী তার স্ত্রীকে উপভোগ করে-করে এতই তৃপ্ত যে এখন সে স্ত্রীর কাছে বস্তুত যৌনশক্তিহীন পুরুষে পরিণত। অথচ অন্য কোনো নারীর কাছে ওই পুরুষেরই অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। এই অবস্থায় অচিরেই স্নায়ুরোগ দেখা দেয় এবং অনতিবিলম্বেই তা তীব্র আকারে প্রকাশ পায়। এই শ্রেণির নারী হলে, সে তখন নতুন প্রেমিক খোঁজে এবং তাকে পাওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে সামাজিক মর্যাদাও ত্যাগ করতে রাজি; অথবা সে ‘স্বামীর সঙ্গে মিলছে না’ এই কারণে বিবাহবিচ্ছেদ করবে। এই সম্পর্কে নীচের ঘটনাটি কৌতূহলোদ্দীপক: ত্রিশ বৎসর বয়স্কা, কয়েকটি সন্তানের জননী, এক মহিলা প্রবল স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত হন। এর ফলে তাঁর জীবন বেশ বিপর্যস্ত হয় ও নানা দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে, অথচ তার আশেপাশের ঘনিষ্ঠজনেরা এর কোনো কারণ খুঁজে পান না। অবশেষে একজন মনোবিশ্লেষকের সহায়তায় এই লেখক ওই মহিলার পূর্ণ ও অসংকোচ আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হন। তিনি জানান যে, তিনি আর তাঁর স্বামীকে ভালোবাসেন না, যদিও স্বামী তাঁকে খুবই ভালোবাসেন। স্বামীর সকল আদর-ভালোবাসা সত্ত্বেও তিনি স্বামীর কাছে শীতল; যখনই তাঁর মনে হয় তিনি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন, তিনি এই বিবাহিত জীবনে বন্দিনী, এ জীবনে হয়তো তিনি আর অন্য কোনো পুরুষের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারবেন না, নতুন কোনো প্রেমের আনন্দ-শিহরণ আবার নতুন করে উপভোগ করার সুযোগ, ক্রমে ক্রমে সেই আনন্দে ডুবে যাওয়ার সুযোগ আর হয়তো ঘটবে না — তখনই হতাশায় তাঁর দুচোখ জলে ভেসে যায়। সবকিছু থেকে এভাবে বঞ্চিত হওয়ার চিন্তা ওই মহিলার কাছে সহ্যাতীত মনে হয়, তাই তিনি স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত।
অবশেষে এই রোগ আরোগ্যের উদ্দেশ্যে, সুস্থতার প্রয়োজনে যখন তিনি কিছুটা স্বাধীনতা লাভ করেন ও নতুন প্রেমিক (সম্ভবত একাধিক) লাভ করে তাঁর কামনাতৃপ্তির সুযোগ পান তখনই তিনি দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন।
জার্মান গবেষক ম্যাগনাস হার্সখ্ফিল্ড (Magnus Hirschfeld) একবার যৌন জীবন বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতা দেওয়ার সময় লক্ষ করেন যে বারেবারেই তাঁকে একটি বিশেষ প্রশ্ন করা হচ্ছে এবং যেহেতু ওদেশে মনোবিশ্লেষণের কাজ বেশ এগিয়েছে তাই প্রশ্নটিও অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই খোলাখুলি করা হয়েছে — “যদিও আমি একজন সুখী বিবাহিত নারী তবু কেন আমার মনে নতুন একজন যৌনসঙ্গী পাওয়ার বাসনা এত প্রবল? আপনি এই বৈপরীত্যকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?” বক্তা তখন উত্তর দেন যে, “এতে বৈপরীত্য কিছু নেই। নতুন যৌনসঙ্গী পাওয়ার উদগ্র ইচ্ছা মানুষের আদিম যৌনকামনারই স্বাভাবিক প্রকাশ, এর সঙ্গে প্রকৃত অর্থে প্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই।” যতদিন না যৌনকার্যের মৌলিক বৈধতাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়, অন্তত ততদিন পর্যন্ত এই ব্যাখ্যায় যৌনবিষয়ক আলোচনায় সর্বদাই যে বিভ্রান্তি দেখা যায় তা থেকে স্পষ্ট অব্যাহতি মিলবে। মানুষের যৌনকামনা কোনো বিশেষ প্রথার গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে মনের মধ্যে যে হতাশাবোধের জন্ম দেয়, বিবাহিত জীবনে স্নায়বিক রোগ তারই একটি রকমফের মাত্র।
পুরুষের মধ্যে যৌন স্নায়বিক রোগ কম দেখা যায়, কারণ পুরুষ সাধারণত বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কস্থাপনের ব্যাপারে একটু বেশি স্বাধীনতা নেয়। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, যখন এ জাতীয় সম্পর্ক স্থাপন অসম্ভব বা কঠিন হয়, তখন স্বামীর মধ্যেও স্নায়ুদৌর্বল্য, অসহ্যবোধ, খিটখিটে মেজাজ, রূঢ়তা প্রভৃতি লক্ষণ প্রকাশ পায়, ফলে স্ত্রী উদ্বিগ্ন হন ও যন্ত্রণা ভোগ করেন। আবার এমনও ঘটে, ওই পুরুষই আবার আগেকার মতো চমৎকার প্রিয় মানুষ হয়ে ওঠে, কারণ তখন সে তার জীবনকে সুশৃঙ্খল করার এমন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছে যাতে সে তার যৌনসুখের বাসনা চরিতার্থ করতে পারে — সে সুখের সঙ্গে নিশ্চিন্ত পারিবারিক সুখের কোনো সম্বন্ধ নেই।
বিবাহিত জীবনে এই স্নায়বিক রোগ অসংখ্য বিবাহ-বিচ্ছেদের মূল কারণ, বিশেষ করে সেইসব পরিবারে যেখানে, মিচেলেট (Michelet)-এর ভাষায় ‘বিবাহের মধ্যেই রয়েছে বিচ্ছেদ’ — আর সেরকম ঘটনার সংখ্যাও অগণন।
(গ) সাহিত্য সংক্রান্ত স্নায়বিক রোগ :
এই শিরোনামে আমরা যৌনতা থেকে উৎসারিত সেইসব স্নায়বিক রোগকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, যেখানে রোগী, কোনো না কোনো কারণে, স্বাভাবিক যৌনতৃপ্তির দ্বারা আরোগ্যলাভ করতে না পেরে, তার প্রবল কামনা চরিতার্থতার জন্য একটি নতুন বিকল্প পথ খোঁজে — এমন এক পথ যা যৌনতায় সম্পৃক্ত অথচ বিশেষ একটি কল্পনার জগতে সীমাবদ্ধ — যাতে যন্ত্রণাও আছে, আবেগের তীব্রতাও আছে।
এই জাতীয় স্নায়বিক রোগের একটি অতি সাধারণ ধরন দেখতে পাওয়া যায় ধর্মভাবাপন্ন কিছু কিছু মানুষের মধ্যে; এঁদের আধ্যাত্মিক প্রেম কামনার আবেগে রঙিন, মাঝেমাঝে তা বিস্ময়কর বাস্তবের রূপ পায় প্রকাশভঙ্গিতে। ‘প সং অব সংস্’ এক অতি আকুল প্রেমগীতি। কার্মেলাইট (Carmelite) সন্ন্যাসিনীরা নিজেদের মনে করতেন যিশুর বাগদত্তা বধূ। সিয়েনার ক্যাথারিনও তেমনই ভাবতেন; মাঝেমাঝে তাঁর অলৌকিক দর্শনলাভ হত, তিনি দেখতে পেতেন স্বয়ং যিশু তাঁর আঙুলে বিবাহের অঙ্গুরীয় পরিয়ে দিচ্ছেন; তিনিই কুমারী মেরীর বুক থেকে দুগ্ধ পান করতেন। মাদাম গুঁয়োর মাঝেমাঝে শ্বাসরোধের মতো অবস্থা হত এবং তখন তাঁর পোশাক আলগা করে দেওয়ার প্রয়োজন হত। এই সময় “তিনি তার সৌন্দর্য প্রাচুর্য এতই প্রকাশ করতেন যে তাঁর পার্শ্বে উপবিষ্ট বিশেষ নির্বাচিত (Elect) ব্যক্তিটির শরীর স্ফীত হয়ে উঠত।” ম্যারি আলাকক (Marie Alacoque) যিশুর পবিত্র রক্তাক্ত হৃদয় আপন হৃদয়ের সঙ্গে বিনিময় করার কথা বলে ‘পবিত্র হৃদয়’ (Sacred Heart) রহস্যের এক বাস্তব প্রকাশরূপ দিয়েছেন। কিছু সন্তু আবার বেশ স্পষ্টই যৌনমনোভাবাপন্ন; তাঁরা তাদের ঈশ্বরের লিঙ্গত্বক লাভের চিন্তায় ব্যাকুল। এইসব সুপরিচিত স্নায়বিক রোগে অধিক গুরুত্ব দেওয়া নিষ্প্রয়োজন, আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে এগুলি এক প্রগাঢ় ও সেইসঙ্গে সুগভীর অবদমিত যৌন-আকাঙ্ক্ষা থেকে জাত।
আধুনিক শারীরবিজ্ঞান স্বীকার করে যে যৌন-আবেগ ও ধর্মীয় আবেগের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য আছে। মনোবিশ্লেষকগণ আরও প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে অবদমনের চাপের ফলে ধর্মীয় আবেগ যৌন-আবেগের বিকল্প রূপে কাজ করে। এর থেকেই বোঝা যায়, কেন অধিকাংশ অতি কামাভাবাপন্ন ব্যক্তিরা ধর্মকর্মের দিকে কম ঝোঁকেন; দুটি আবেগই একই ধরনের হওয়ার ফলে একটি দিকে যদি সকল উৎসাহ ঢেলে দেওয়া হয়, তবে অপরটির জন্য প্রায় কিছুই পড়ে থাকে না। আবার এর বিপরীতও ঘটে; ধর্মীয় আবেগের প্রাবল্যের ফলে যৌনকামনা লোপ পায়, অবশ্য তখন তা নৈতিকতাকে মহিমান্বিত করার ছদ্মরূপে প্রকাশ পায় এবং এক একাগ্র প্রেম প্রায়শই সুস্পষ্ট যৌনভাবে প্রকাশ পেয়ে স্বয়ং ঈশ্বরের অভিমুখে ধাবিত হয় [যেমন সেন্ট টেরেসার (Theresa)]।
সাধারণ মানুষের মনেও যে এ জাতীয় প্রকাশ দেখা যায় না, তা নয়, কিন্তু সেক্ষেত্রে তেমন ঘন-ঘন নয়, বা তেমন তীব্রও নয়, কারণ এসব ক্ষেত্রে সাধারণত সরাসরি তৃপ্তির নানা উপায়ের অভাব হয় না। তাহলেও, যে সব অবিবাহিতা বয়স্ক মহিলা যৌন অতৃপ্তিতে ভোগেন তাঁদের মধ্যে অশ্লীলতায় ভরা বেনামি চিঠি লেখার প্রবণতা প্রায়ই লক্ষ করা যায়। লিয়োন-এর টেকনিক্যাল পুলিশ ল্যাবোরেটরির ডিরেক্টর ড. লোকার্ড (Dr. Locard) আমাদের জানান যে, ‘নিজেকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে ছাপার হরফের মতো করে লেখা’ এই বেনামি চিঠিগুলিকে কামুকপ্রবৃত্তির মনুমেন্ট বলা যেতে পারে। কিন্তু কৌতূহলজনক ব্যাপার হল, যখন হঠাৎ এইসব চিঠির রচয়িতারা ধরা পড়ে যান, দেখা যায় এঁরা অনেকেই কঠোর নীতিপরায়ণ পরিবারের মানুষ, যাদের মধ্যে ওই ধরনের চিঠি লেখার মতলব থাকতে পারে বলে ভাবাই যায় না। এই প্রসঙ্গে ড. লোকার্ড আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন এক প্রেমকাহিনি (Mile de Morell, ‘affaire’ of La Ronciere le Noury)। তিনি বলেন, “বয়স ও সামাজিক চাপে তিক্ত-বিরক্ত বয়স্কা কুমারীরা এবং নীতি ও ভীরুতার কারণে যৌনসংযমে বাধ্য যন্ত্রণাক্লিষ্ট যুবকেরা এই জাতীয় বেনামি চিঠির মাধ্যমেই (কারণ তাদের ধারণা এতে ধরা পড়ার ভয় নেই) নিজেদের কঠোরভাবে অবদমিত যৌনকামনার সুতীব্র গোপন অনুভূতিকে প্রকাশ করে। এই ধরনের চিঠি কোনো বেশ্যা, লম্পট বা এমনকী স্বাভাবিক যৌনজীবনসম্পন্ন কোনও পুরুষ বা নারী লিখেছে বলে কখনও দেখা যায়নি।”
আমাদের বিশ্বাস, এখানে আমরা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের একটি শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত পাচ্ছি। অদম্য ও তৃপ্তিহীন যৌনতৃষ্ণার প্রকৃতি কেমন হতে পারে, এ ঘটনা তারই এক বিস্ময়কর উদাহরণ। এই ঘটনা থেকে দেখা যায় যে, অবদমন মনের ভিতরকার চাপে বা বাইরের চাপে যেভাবেই ঘটুক না কেন, তা শুধু অসুখী ও চিকিৎসাযোগ্য কিছু মানুষ সৃষ্টি করে, যারা তাদের আপন মিথ্যা ‘সচ্চরিত্রতা’-কে ঘৃণা করে এবং যখনই তারা সমাজের ভণ্ড প্রথাকে না ভেঙেও এই মিথ্যা চরিত্রগুণকে বর্জন করার সুযোগ পায় তখনই তা বর্জন করে। তখন তারা প্রকৃতই অস্বাভাবিক ও সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে কারণ সমাজই তাদের স্বাভাবিক ও নিরাপদ জীবনযাপনে বাধা দিয়ে এসেছে।
এই অবদমিত যৌনচিন্তা কীভাবে গোপনে অথচ অবিরাম কাজ করে চলে তার আরও উদাহরণ আমরা দিতে পারি। প্রত্যেক ব্যক্তিরই কিছু-না-কিছু যৌনশব্দের, যৌনকল্পনার ও যৌনপছন্দের লুকোনো ভাণ্ডার থাকে; এইসব গোপন জিনিস সে অন্যদের কাছ থেকে সাবধানে লুকিয়ে রাখে। যে সমাজে মানুষ নানাবিধ কষ্টকর প্রথার ক্রীতদাস, যে সমাজে মানুষ ওই প্রথাগুলিকে, শুধু অন্যেরা মানে বলেই, বিশ্বাস না করেও মেনে চলে ও রক্ষা করে, সেই সমাজে সেই পরিবেশে ওইসব গোপন যৌনশব্দ, কল্পনা ও পছন্দগুলিই মানুষের যৌনকামনা থেকে মুক্তির পথ। ব্যক্তির অগোচরেই কখনো কখনো তার এই গোপন সংরক্ষিত এলাকায় আলোকপাত ঘটে যায় (অর্থাৎ প্রকাশিত হয়ে পড়ে)। বিকারের প্রলাপ থেকে আমরা এ বিষয়ে জানতে পারি। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবন থেকেও অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় : এক জায়গায় বেশ কিছু লোকের সমাগমের মধ্যে ‘একটি নির্দোষ মজার খেলা’ চলছিল খেলাটি এই রকম — উপস্থিত ব্যক্তিদের প্রত্যেকেই একটুকরো কাগজে বেনামে একটা করে শব্দ লিখবে। যতবারই খেলা ঘুরছিল ততবারই একটা না একটা নতুন শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল, যা ‘অশ্লীল’। পরে হাতের লেখার ধরন দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল, ওই সবকটি শব্দই পার্টিতে উপস্থিত একমাত্র তরুণী মেয়েটির লেখা, সামাজিক প্রথার বিচারে যা শালীনতা, মেয়েটির মানসিকতায় তা মানা সম্ভব হয়নি। প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কের মধ্যেও দেখতে পাই, তাদের অবদমিত অনুভূতি সমাজের বিরুদ্ধে যেন এইভাবে তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে; সত্যিকারের আলিঙ্গনের সময় কিংবা চিঠিপত্রে তারা ‘অশ্লীল’, ‘কামোত্তেজক’ ও ‘নোংরা’ শব্দের বন্যা বইয়ে দেয়; অধিকাংশ প্রেমিক-প্রেমিকাই এই জাতীয় শব্দ ব্যবহার না করে পূর্ণ ও তীব্র যৌনতৃপ্তি লাভ করতে পারে না। দুজন মুক্ত মনের নরনারী যে-প্রেমে পরস্পরের একাত্ম হয়, সেই গোপন সম্পর্কের একটা দিক হল এইভাবে উভয়ে মিলে সামাজিক অবদমনকে ভেঙে ফেলা। মেরুপ্রদেশের নাবিক বরফ ভেঙে আবার উন্মুক্ত সমুদ্রে ফিরে আসতে পেরে যেমন মুক্তির স্বাদ পায়, এরাও তেমনি শালীন ভাষার বাধা ভেঙে প্রকৃতির কাছে ফিরে আসতে পেরে অনুরূপ মুক্তির স্বাদ অনুভব করে ।….
কখনও বা এই যৌন স্নায়বিক রোগ সাহিত্যের রূপে প্রকাশ পায়। প্রেমের কবিতা সংখ্যায় অগণন। তার কিছু হয়তো গভীর ধর্মীয় ভাবাপন্ন, যেমন সাদি-র (Sadi) কবিতা, তীব্র আবেগময়, দেহমন একাকার হয়ে গেছে বারেবারেই। সাদি-র খাদ্যাসক্তি ছিল প্রবল, তাই পবিত্র প্রেমের মধ্যেও দেহজ কামনার প্রবেশ ঘটিয়েছেন, দৈহিক আকুলতাকে আধ্যাত্মিক প্রেমের রূপ দিয়েছেন : “আমার সমগ্র প্রাণ নিমগ্ন হয়ে আছে তোমার মধ্যে, আমাদের হৃদয়ে বয়ে চলেছে যে শোণিতস্রোত সে তো তোমারই প্রাণ …।” বোসুয়েত (Bossuet) তাঁর আত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের মিলনকে যে বিস্ময়কর ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন, অতীন্দ্রিয় প্রেমে তা প্রায়শই দেখা যায়।
এই ধরনের সাহিত্য-সংশ্লিষ্ট স্নায়বিক রোগে যে পূজার মনোভাব নিহিত থাকে, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় মধ্যযুগের নিষ্কাম প্রেমের কথা। বহু ব্যক্তি অভিনেতা-অভিনেত্রীকে শুধু ছবিতে দেখেই তাদের প্রেমে পড়ে যান। চলচ্চিত্র অভিনেতা রুডল্ফ্ ভ্যালেন্টিনোর অকাল মৃত্যুতে আমেরিকানদের মধ্যে সমষ্টিগত স্নায়বিক রোগের সর্ববিধ লক্ষণ দেখা গেছিল। “পৃথিবীর সুন্দরতম এই পুরুষ”-টির শায়িত অবস্থায়, তাঁর চতুর্পার্শ্বের নারীভক্তরা বারেবারেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। এইসব স্নায়বিক রোগীরা ব্যঙ্গবিদ্রূপেরও ভয় পায় না। শোকযাত্রার মিছিলে অনেকেই তাঁদের রুমালে পেঁয়াজ লুকিয়ে রেখেছিলেন চোখে জল আনার জন্য। অপরের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য এই ধরনের মিথ্যা আড়ম্বর ও প্ররোচনামূলক আচরণ আলোচ্য স্নায়বিক রোগীদের চারিত্রিক লক্ষণ। সে সকল স্নায়বিক রোগ সাহিত্য ও অতীন্দ্রিয়বাদের পথ গ্রহণ করে, সেগুলির মূলে যে যৌনতা আছে তা যত সহজে প্রকাশ পায়, তেমন আর কোনো স্নায়বিক রোগে নয়। শব্দ ও লেখনীই তার সবচেয়ে সেরা সাক্ষী। “আমার জীবনে স্নেহ-প্রেমের এত অভাব যে আমার বড়ো ভয় করে। আমার এই ছোট্ট সুন্দর শরীরটার মধ্যে যে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে, তাতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এ-সব আমি কাকে দেব? কে চায়?” তরুণ ডুমা (Dumas) -কে এই চিঠি লিখেছিলেন এমিয়ে দেসক্লিয়ে (Aimie Desclie); তৎকালীন মঠের সন্ন্যাসিনী জীবনের নিঃসঙ্গতাকে মহিমান্বিত করার বিরুদ্ধে এ চিঠি এক যোগ্য জবাব। কিন্তু এ-সবই অতৃপ্ত অবদমিত মনের যন্ত্রণাকাতর ক্রন্দন ছাড়া আর কী? এই কান্না শুনে বিরাগী সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীও তার নির্জনবাসে কেঁপে উঠবে, স্বর্গেও হয়তো পৌঁছবে এর আবেদন।
কিছু মানুষ আবার এতদূর পর্যন্ত বিশ্বাস করেন যে, অবদমিত যৌনচাহিদা যখন অন্য কোনোভাবে বহিঃপ্রকাশের পথ খুঁজতে বাধ্য হয়, তখন তা হয়তো যুদ্ধের মতো ভয়ংকর বিস্ফোরণের মধ্যে সেই ‘পরমোল্লাস’ লাভ করে। বস্তুত একথা অস্বীকার করা যায় না যে, কখনো কখনো সত্যিই এমন দেখা গেছে যে অসহ্য সামাজিক পীড়ন ও অস্থিরতাই কোনো না কোনো ভাবে যুদ্ধের অনিবার্য কারণ হয়ে উঠেছে। ১৯১৪ সালের বিশ্বযুদ্ধ অনেকের কাছেই একধরনের মুক্তির অনুভব এনে দিয়েছিল — অথচ এই যুদ্ধের ফলে ভবিষ্যতে তাদের ভাগ্যে কী বিপর্যয় লেখা আছে তা কেউই জানত না। সামাজিক অবস্থায় সঠিক ভারসাম্যের অভাবে যে-স্নায়ুচাপের সৃষ্টি হয়, তার অবসান ঘটেছিল এই যুদ্ধে, আর তাদের এতদিনকার ব্যর্থ হতাশ কর্মশক্তির সামনে মেলে ধরেছিল ‘পরমানন্দ’ লাভের এক প্রশস্ত পথ। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আমরা একটি মন্তব্য করতে চাই। যাদের এই ধরনের ভয়ংকর পথে পরমানন্দ লাভের প্রয়োজন হয়, তাদের নিশ্চয় কোনো বিশেষ অভাববোধ থাকে। তারা এমন কিছু চায় যেদিকে তারা তাদের স্নায়ুশক্তি পরিচালিত করতে পারে; কারণ অবদমন তাদের জীবনকে ক্লেশময় করে তুলেছে; নিষেধাজ্ঞার কাছে তারা নিজেদের বলি দিয়েছে; এই সর্বগ্রাসী শয়তানদের হাত থেকে তারা মুক্তির উপায় খুঁজে পাচ্ছে না; তারা আমাদের এই আত্মবিনাশী যৌনতাবিরোধী সামাজিক প্রথার ক্রীতদাস। এই সমস্ত লোকেরাই ওই ধরনের ঘৃণ্য ও ধ্বংসাত্মক পরমোল্লাসে মেতে ওঠে। এরাই সর্বনাশের বাঁধন খুলে দেয়। এই যদি ঘটনা হয়, তাহলে এইসব ব্যক্তিকে বিপজ্জনক বলে বিবেচনা করতে হবে — বিপজ্জনক, আদ্যিকালের বাতিল হয়ে যাওয়া নিষেধাজ্ঞাগুলির প্রতি তাদের জেদি আনুগত্যের জন্য; বিপজ্জনক, স্বাভাবিক যৌনক্রিয়ার এই রকম অদ্ভুত ভয়ংকর বিকল্প পথ গ্রহণ করার প্রবণতার জন্য। অন্যদিকে, যারা আপনার জীবনযাপনের পরিবেশেই সন্তুষ্ট, যারা আপন চেষ্টায় পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েও নিষেধাজ্ঞার পীড়ন এড়িয়ে যেতে পেরেছে আর তাই এক পূর্ণ ও সুখী জীবনযাপনে সক্ষম, তাদের কিন্তু যৌনকামনার বহিঃপ্রকাশের এইরকম কোনো সুদূরকল্পিত বিকল্প পথের প্রয়োজন হয় না। যৌন অবদমনের বিপদ হল এই যে, যৌনকামনা নির্গমনের নিরাপদ পথ না থাকলে, কোনো না কোনো পথে তার বিস্ফোরণ ঘটবেই।
(ঘ) অ্যাংলো-স্যাকসন স্নায়বিক রোগ :
মনোবিশ্লেষকগণ পাশ্চাত্য দেশসমূহের অধিবাসীদের ওপর বেশ কিছু আগ্রহজনক সমীক্ষা করেছেন। বিশেষ করে মেডার (Maeder) অ্যাংলো-স্যাকসনদের স্নায়বিক রোগ নিয়ে গবেষণা করেছেন। বস্তুত, লমোনিয়ার (Laumonier) যেমন বলেছেন, “সকল জাতির মানুষের মধ্যে কেবলমাত্র ইংরেজরাই সর্বপ্রথম মনোবিশ্লেষকদের কৌতূহল জাগায়, তাদের রক্ষণশীলতা ও অবিমিশ্রতাই এর কারণ।” ইংরেজদের মধ্যেই আমরা শালীনতার বা, বলা ভালো, কপট শালীনতার বিস্ময়কর বিকাশ দেখতে পাই, এবং সম্ভবত ভিক্টোরীয় যুগেই তার চূড়ান্ত রূপ লক্ষিত হয়। সামাজিক ও ব্যক্তিগত উভয় ক্ষেত্রেই কামের অবদমনের চেহারা কীরকম তা নিয়ে গবেষণার প্রচুর মালমশলা আছে আমাদের হাতে। আর এল স্টিভেনসন দুঃখের সঙ্গে মন্তব্য করেছেন, এমন বহু বিষয় আছে যা একজন ইংরেজ লেখক বলতে পারেন না। এ ব্যাপারে ফরাসি লেখকের যে স্বাধীনতা আছে ইংরেজ লেখকের তা নেই। কিন্তু সুতীব্র অবদমনমূলক শিক্ষার ফলে ইংরেজদের মধ্যে যে সকল স্নায়বিক রোগ দেখা যায় তার বিস্তারিত আলোচনার স্থান এই প্রবন্ধ নয়। আমরা শুধু সামান্য একটু মন্তব্য করেই এ প্রসঙ্গ থেকে সরে যাব — কপট প্রেম বা নারীর অধিকার নিয়ে বাড়াবাড়ি, এই জাতীয় কিছু কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য যে কিছু ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়, কোনো কোনো দিক থেকে বিচার করলে সেগুলি নারীকে নিয়ে খেলার উন্মত্ত প্রবণতার ফল। মনোবিশ্লেষকেরা এসব বিষয় নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছেন। কৌতূহলী পাঠককে আমরা তাঁদের লেখা পড়ে দেখতে অনুরোধ করব।
অবশ্য এই একই বিষয়ে আমেরিকানদের সম্পর্কে দু-চার কথা বলা প্রয়োজন। উত্তর আমেরিকার সমাজের যৌনতাবিরোধী নীতি সম্ভবত প্রাচীন অ্যাংলো-স্যাকসনদের নীতির চেয়ে অনেক বেশি অনমনীয়, এবং যদিও এই নতুন জাতিটি প্রাচীন ব্রিটিশদের মতো অবিমিশ্র জাতি নয়, তবু যৌনতা বিষয়ে এদের মনোভাব বিচার করে দেখা মনোবিশ্লেষণের দিক দিয়ে খুবই লাভজনক।
আমরা দেখেছি, জুডীয়-খ্রিস্টান মতবাদের প্রভাবে ওখানে বিবাহ-বহির্ভূত সকল প্রকার যৌনসম্পর্ক সাধারণভাবে নিষিদ্ধ। একথা না বললেও চলে যে, যে-সামাজিক অবস্থায় কামপ্রবৃত্তির সঙ্গে আইনবিধানের চিরস্থায়ী বিরোধ বর্তমান থাকে সেখানে যৌন-অবদমনজনিত স্নায়বিক রোগবৃদ্ধির সুযোগ সবচেয়ে বেশি। এর একমাত্র প্রতিকার, যা সমাজের ওপর একরকম জোর করেই চাপিয়ে দেওয়া হয় বলা চলে, তা হল বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদের বর্ধিত সুযোগ, অর্থাৎ এক ধরনের অস্থায়ী মিলনের আইনসম্মত সুযোগ।
লিয়েন্ডার ভেলাট (Leandre Vaillat) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করে লিখেছিলেন, “এখানে হোটেলঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর যে জিনিসটি প্রথম চোখে পড়বে, তা হল একটি খোলা বাইবেল, আর দ্বিতীয়টি হল একটি স্নানের পোশাক। প্রথমটি আমাদের যেন বাইবেলের বাণী ধ্যান করতে বলছে, আর দ্বিতীয়টির ইঙ্গিত, আমরা যেন ‘টয়লেটের’ কাজ করতে গিয়েও আমাদের শালীনতাবোধ বিস্মৃত না হই। আমরা অবশ্য বাইবেলটিকে বন্ধ করে দিলাম আর স্নানের পোশাকটিকে কাগজ-ফেলার ঝুড়িতে নিক্ষেপ করলাম…।” এইসব ফরাসিদের আর শোধরানো গেল না! সে যাই হোক, এই পর্যটক ওইসব ছোটোখাটো কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপারগুলি লিখে রেখে যথার্থ কাজই করেছেন; অন্যেরা হয়তো এগুলিকে গুরুত্বহীন ভেবে কোনো উল্লেখই করতেন না। যে মনোবিশ্লেষক আমেরিকানদের অদ্ভুত নৈতিক বিকাশ ও বিশেষ ধরনের মনোভাবকে ভালোভাবে বুঝতে চান, তাঁর কাছে ওইসব তুচ্ছ জিনিসই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পবিত্র বাইবেল ও স্নানের পোশাক — এই দুটি জিনিস এভাবে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা থেকে মনোবিশ্লেষক দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যৌন-স্নায়বিকরোগের প্রকৃতি সম্পর্কে। প্রথমত, আধ্যাত্মিক নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে ব্যক্তিগতজীবনে যৌন-নিষেধাজ্ঞার যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে তার প্রমাণ মেলে; দ্বিতীয়ত, যারা সর্বদাই যৌনতৃপ্তি পেতে চায় তাদের মন যেমন সর্বদাই যৌনচিন্তায় আবিষ্ট, তেমনি নিষেধবাদীদের মনও সর্বদাই যৌনচিন্তায় সমভাবে আবিষ্ট — এতদূর আবিষ্ট যে তারা মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার মধ্যেও নাক গলায়, এবং এদের মনে যে যৌনতার চিন্তা আরও গভীর ও অবিরাম, তার প্রমাণ মেলে। জর্জ লিন্ডসে (Judge Lindsey) মনে করেন, যৌনতায় সম্পূর্ণ আবিষ্ট মনোভাবই আমেরিকান সভ্যতার এক প্রবল শত্রু।
যে সমাজে মানুষকে, একমাত্র অর্থনৈতিক কাজকর্মের নিরাপদ ক্ষেত্রটি বাদ দিয়ে বাকি সকল ক্ষেত্রে, আজীবন নাবালক করে রেখে অভিভাবকত্ব ফলানো হয়, সেখানকার মানুষের জীবন কি সুখী, সুস্থ বা দীর্ঘতর হতে পারে? যদি তা হয়, তবে সেই ব্যবস্থা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু স্নায়বিক রোগের অনমনীয় নিয়মকে যে কিছুতেই এড়ানো যায় না, সমষ্টিগত বা ব্যক্তিগত পরিবেশের প্রতিটি ঘটনাতেই, সুযোগ পেলে, আমরা এই সত্যের দৃষ্টান্ত দেখতে পাব, যেমনটি পেয়েছিলাম অভিনেতা রুডলফ্ ভ্যালেন্টিনোর মৃত্যুতে। উত্তর আমেরিকার বিষণ্ণ নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বিস্মিত-ব্যথিত করে; বৃথাই তারা কৃত্রিম আমোদপ্রমোদের মাঝে মুক্তি খোঁজে। য়ুরোপে কিন্তু সকল প্রকার যৌননিষেধ সত্ত্বেও ব্যক্তিস্বাধীনতার দাবি কিছুটা মেনে নেওয়া হয়। আমেরিকানরা স্বীকার করে যে, আমাদের দেশের (লেখকের দেশের) মানুষের হাসিখুশি ও প্রাণোচ্ছল ভাবটি তাদের খুব মনে ধরে এই তুলনামূলকভাবে অধিকতর যৌনস্বাধীনতা একজন স্টেন্ডাল (stendal) বা একজন ক্যাসানোভার (Casanova) জন্ম দিয়েছে।
একথা সত্য যে, যেসব দেশে যৌন নিষেধের প্রভাব বেশি, সেখানে খেলাধূলার বিপুল উন্নতি ঘটিয়ে, যৌনক্রিয়াকলাপের অভাব পূরণের চতুর প্রয়াস দেখা যায় — যৌন স্নায়বিকরোগই ওইসব দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই প্রয়োজন চাপিয়ে দিয়েছে।
এইভাবে উনিশ শতক ও বিশ শতক আমাদের কাছে নতুন এক বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে গবেষণার সুযোগ এনে দিয়েছে — এই নতুন বিকল্প পদ্ধতি মানুষের চিন্তাশক্তিরই সমবয়স্ক, শিল্পকলা ও অতীন্দ্রিয়বাদের মতো প্রাচীন পদ্ধতিগুলির সম্পূর্ণ বিপরীত। এই নব পদ্ধতি এতই আকর্ষণীয় যে একে সঠিকভাবে বিবেচনা করে দেখার জন্য, আমাদের একটু থামতে হবে।
ধর্মীয় অতীন্দ্রিয়তা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাশ্চাত্য দেশগুলিতে সারা মধ্যযুগ জুড়ে এবং তার পরবর্তীকালেও রাজত্ব করে গেছে। বিজয়ী খ্রিস্টধর্মের মধ্যে তার প্রকাশ ঘটেছে। তারপরে মানুষের মনে সন্দেহ জাগতে শুরু করে; ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ‘মুক্ত চিন্তাবিদ’-দের মনে এ সন্দেহ আগেই দেখা দিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত অষ্টাদশ শতাব্দীতে তা জয়ী হয়। চিন্তার স্বাধীনতা বিশ্বাসের এক প্রবল বিরোধী শক্তি বলে পরিগণিত হয়। যুক্তিবাদ ও বস্তুবাদ (নাস্তিকতার কথা ছেড়ে দিয়েও) মানুষের প্রায় সব চিন্তাকেই পোশাকের মতো আবৃত করে ফেলে। এই পদ্ধতিতে প্রথম যে সংস্কার সাধিত হয়, তার লক্ষ্য হল মুক্তচিন্তার প্রতি সহনশীলতা; এইভাবে যুক্তিবাদ, বস্তুবাদ উন্মুক্ত সূর্যালোকে তাদের আপন স্থান সুনিশ্চিত করে নিতে পারে — এমন স্থান যা নিয়ে আর কোনো তর্ক উঠবে না, এমনকী ধর্মান্তরবাদীরাও যে জায়গাটুকু ছেড়ে দিতে বস্তুত বাধ্য হয়েছে।
কিন্তু অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে পরাভব স্বীকার করলেও এই ধর্মান্তরবাদ কিন্তু নৈতিকতার ক্ষেত্রে তাদের দাবি পরিত্যাগ করেনি। যেসব ব্যক্তি জুডীয়-খ্রিস্টান অধিবিদ্যাকে পরিত্যাগ করেছে, তারাই আবার অন্য একটি নৈতিক ব্যবস্থার দাসত্ব মেনে নিয়েছে আর সেই নৈতিকতারও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যৌনতার বিরোধিতা। ফ্রয়েডীয় বিপ্লবের সময়কাল পর্যন্ত এইসব নৈতিকতার বিষয়গুলিকে পূর্বেকার অধিবিদ্যাসম্পর্কিত বিষয়গুলির মতোই ছোঁয়ার জো ছিল না। ওগুলির যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠত না কখনও। যৌনতা যে নীতিবিগর্হিত তা তখন, এবং আজও অনেকের কাছে এক বদ্ধমূল ধারণা, যা কোনো যুক্তি-প্রমাণের ধার ধারে না। এই ধারণা যে ভুল, অন্তত বহুক্ষেত্রে ভুল, তা প্রমাণ করে দেখানোর মৌলিক অধিকার থেকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিল বিজ্ঞান ও যুক্তিশাস্ত্র। প্রতিক্রিয়াশীলরা সমালোচনামূলক মানসিকতাকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য ও সেই সঙ্গে পাপের তত্ত্বকে, অন্ততপক্ষে পাপের পরিণামের তত্ত্বকে বজায় রাখার জন্য তাদের প্রয়াস দ্বিগুণিত করল। এক্ষেত্রে সাফল্যের অর্থ হল মানুষের জীবনের সামাজিক দিকগুলোকে জুডীয়-খ্রিস্টান নীতিশিক্ষা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত করা এবং যারা অধিবিদ্যার দর্শনকে অস্বীকার করেছে, তাদের ওপরও এই নীতিশিক্ষার নির্দেশ জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। গত একশো/দুশো বছরের যাবতীয় আইন সংস্কার, যাবতীয় নৈতিক প্রচার, সবকিছুর জন্যই দায়ী তাদের সুদক্ষ কুশলী প্রয়াস, আর এই প্রয়াসের ফলেই মুক্তমনের মানুষদের বিস্মিত, উদ্বিগ্ন করে বেড়ে চলেছে শালীনতার ভানে-ভরা ব্যক্তিদের আর নীতিবাগীশ সংঘ-সমিতি-সমূহের কর্তাগিরি।
যে প্রতিকল্পের প্রশ্নটি আমরা তুলেছিলাম তাও এই প্রসঙ্গে আলোচ্য বিষয়। প্রেমের ওস্তাদ, ক্যাসানোভা সম্ভবত ফুটবল খেলে নষ্ট করার মতো সময় পেত না, খেলাধূলায় সেরা রেকর্ড করার আগ্রহও তার ছিল বলে মনে হয় না। অপরপক্ষে, যেসব দেশে যৌনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি করেছে তাদের কাছে এই জাতীয় প্রতিকল্প ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। তারা খেলাধূলার বিস্ময়কর উন্নতির মধ্যে এই প্রতিকল্প খুঁজে পেয়েছে, কারণ খেলাধূলা পেশির ক্লান্তি আনে, মন ফাঁকা হয়, খেলাধুলায় সময় কাটে বেশ এবং এক ধরনের বাহ্যিক উৎসাহ-উদ্দীপনাও জাগায়।
দেখা যায় যেসব অ্যাংলো-স্যাকসন সমাজে যৌনতাবিরোধী প্রথাগুলিকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে সেইসব সমাজেই খেলাধূলা সাফল্যলাভ করেছে সবচেয়ে বেশি। তাদের নারীরাও বাদ যায়নি। খেলাধুলা না-হোক অন্তত অন্য কোনো নতুন দিকেও তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে, যেমন — রাজনীতি, ব্যাবসা, চিকিৎসা, ঔষধ, আইন ইত্যাদি। যেসব দেশে নারীদের অন্তত কিছু পরিমাণে কামচর্চার স্বাধীনতা আছে, সেখানে নারীদের কোনো প্রতিকল্পের/বিকল্পের প্রয়োজন হয় না, তারা সেই প্রাচীন ঐতিহ্যেই বিশ্বস্ত থাকে যখন প্রেমই ছিল জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। নিঃসন্দেহে এই কারণেই ফ্রান্সে, যেখানে নারীদের আজও যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে, যেখানে শালীনতার ভান অনেক কম, আমরা দেখতে পাই যে, সামান্য কিছু আগ্রহী নারীবাদের সমর্থন ছাড়া (অবশ্যই তারা অত্যুৎসাহী নয়), বাকি সব নারীই নারীবাদী আন্দোলনের প্রতি খুব একটা আগ্রহ দেখায় না; নিষেধবাদী সমাজগুলিতেই এই আন্দোলন বিস্ময়কর উন্নতি লাভ করেছে।
কিন্তু এইসব প্রয়াসের ফল হয়েছে ভারী অদ্ভুত। সত্য যে, খেলাধূলা বিষয়ক উৎসাহদায়ী ও যুক্তিবাদী শিক্ষার ফলে আমেরিকানরা আশা করে যে আর কয়েক পুরুষেই তারা সবচেয়ে শক্তিমান ও স্বাস্থ্যবান জাতি গড়ে তুলতে পারবে। তা সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই যে, তাদেরই বিখ্যাত শারীরতত্ত্ববিদগণ (যেমন — বোস্টন মেডিক্যাল স্কুলের নিউরোলজি বিভাগের প্রধান ড. আব্রাহাম মায়ারসন, নিউইয়র্কের ড. এল পি ক্লার্ক ইত্যাদি) তাঁদের দেশবাসীর দেহগঠনগত দুর্বলতা ও বর্তমান সভ্যতা-সৃষ্ট অবস্থাকে সহ্য করার অক্ষমতা নিয়ে দুঃখ করেছেন। ড. মায়ারসন এর জন্য দায়ী কারণসমূহের একটি তালিকা রচনার চেষ্টা করেছেন : “সন্দেহ নেই, আমাদের জীবন এতই ব্যস্ততায় ভরা যে আমরা প্রকৃত সুখ বা প্রকৃত সংস্কৃতি উপভোগ করতে পারি না; আমরা অতিরিক্ত উত্তেজিত; আমাদের রুচি বড়ো বেশি বিলাসবহুল; আমাদের বছরকমের ভান ভড়ৎ আছে…।” আমরা এইসঙ্গে একথাও যোগ করতে চাই যে, আমরা বহুপ্রকার স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত যার কারণ হল, অত্যধিক নিষেধাজ্ঞা : এই নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তির জীবনকে তার নিজের বিরুদ্ধে বা তার সমাজের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ সংগ্রামে পরিণত করেছে। একজন আমেরিকান মঁসিয়ে পল রেনো-র কাছে স্নায়বিক অবসাদ ও তা সারানোর জন্য কতরকমের যে সর্বরোগহর ওষুধের বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে সে বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে জানান যে, নিউ অর্লিন্স-এর একজন ডাক্তার সম্প্রতি তাঁকে বলেছেন, “চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সি কী বিপুল সংখ্যক পুরুষ যৌনশক্তিহীন হয়ে পড়েছে তা দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি।” কঠোর নিষেধের পরিণামও প্রতিকল্প ধর্ম অনুসারী : কিছু বিকল্প পন্থা খুঁজে পেতেই হবে। খেলাধূলা কোনো জাতির শুধুমাত্র বুদ্ধিবিকাশের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে, কিন্তু অন্যান্য বিকল্প পথগুলি জাতির শারীরবৃত্তীয় ভারসাম্য পর্যন্ত বিপন্ন করতে পারে। ১৯২৭ সালে নিউইয়র্কের পুলিশ-প্রধান ম্যাক অ্যাডু-র নির্দেশে ওই পুলিশ বিভাগ যে রিপোর্ট প্রস্তুত করে, তাতে উপসংহারে লেখা হয়েছে যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ড্রাগ সরবরাহ অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। কৌমার্য ও যৌনসংযমের ওপর সরকারিভাবে জোর দেওয়া ও তার ফলস্বরূপ স্নায়বিক রোগের প্রকোপের গভীর উদ্বেগজনক অর্ধোন্মাদ বিস্ফোরণ মাঝেমাঝেই ঘটতে দেখা যায় আর সেক্ষেত্রে স্যাডিজম-এরও যথাযোগ্য ভূমিকা থাকে — যেমন সেই বিখ্যাত মামলার ‘গরিলা নেলসন’ যে লোকটা কমপক্ষে আঠারোটি মেয়েকে ধর্ষণ ও তারপর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে; অথবা লস এঞ্জেলস-এ ম্যারিয়ান পার্কার নামে এক তরুণী হত্যার জটিল মামলা। মানুষের হিংস্র প্রকৃতির যাবতীয় রহস্যের এটাই কি চাবিকাঠি নয়। ক্যাসানোভা নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচেছিল…।
নিরন্তর নিষেধ, নিন্দা, অভিযোগ, ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ, বিরোধিতা, সরকারি তদন্ত — এ সবই আমেরিকানদের যৌনতা সম্পর্কে ধারণার চরিত্র বৈশিষ্ট্য; এই অবস্থায় আপনা থেকেই এক অতি বিশেষ ধরনের স্নায়বিক রোগ জন্ম নেয়; এই রোগে মন সর্বদাই যৌনচিন্তায় আচ্ছন্ন (ob-sessed) হয়ে থাকে, আর এই চিন্তা কাটিয়ে ওঠার নানাবিধ উম্মাদ প্রয়াস থেকেই বোঝা যায়, এই চিন্তা কত সর্বশক্তিমান। আমরা তো জানি যে আক্রমণ যত গুরুতর হয়, প্রতিরোধও হয় ততই তীব্র। পরিমাণগতভাবে কামপ্রবৃত্তি প্রকাশক স্নায়বিক রোগ আর প্রতিরোধ-স্নায়বিক রোগ উভয়ই একই প্রকার গভীর তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ।
(ঙ) নিষেধজনিত স্নায়বিক রোগ :
যৌননিষেধ সমষ্টিগত রূপ নিলে মাঝেমাঝে অপ্রত্যাশিত ফল দেখা যায়। নিষেধবাদী মানসিকতার প্রভাবের ফলে কোনো কোনো ইউরোপীয় দেশের কর্তৃপক্ষ দূর প্রাচ্যের বহু বন্দরে দেহ-ব্যবসায় বন্ধ করার অনেক চেষ্টা করেছেন এবং ওইসব জায়গায় দেশীয় নারীদের সঙ্গে বিদেশীদের যৌনসম্পর্ক স্থাপনে বাধাসৃষ্টির যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন। এ ব্যাপারে যতটা সাফল্যলাভ সম্ভব ততটাই ঘটেছে। কিন্তু এর ফল হয়েছে এই যে, কোনও-কোনও বন্দরে দালালরা ‘খরিদ্দার’-দের কাছে ‘মেয়ে’-র বদলে ‘ছেলে’ এনে দিচ্ছে, কারণ ‘মেয়ে’ আনা নিষেধ !… দূর প্রাচ্যের দেশগুলিতে যৌন-স্বাধীনতা অনেক খর্বিত হওয়ার ফলে মদ্যপানাসক্তি (কোকেন-আসক্তির কথা না ধরেও) যৌনসুখের স্থান দখল করেছে — তাতে কোনো সামাজিক লাভ হয়নি। এইসব দেশে সাধারণের মধ্যে এমন এক বিষণ্ণ একঘেয়ে নিরানন্দ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। এই পরিবেশ ওখানকার অধিবাসীদের ওপর ভীষণভাবে চেপে বসেছে, খেলাধূলার উত্তেজনা বা হুইস্কির নেশা দিয়ে তা কমানো যাচ্ছে না। এই রকমটা কিন্তু চিনে বা জাপানে দেখা যায় না।
এইসব সমষ্টিগত স্নায়বিক রোগ মাঝেমাঝে এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে যে তা একটা জাতিকে সত্যসত্যই অবলুপ্তির পথে নিয়ে যায়। এর একটা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে শ্বেতাঙ্গ-অধিকার ও বসতিস্থাপনের পর থেকে ওখানকার পলিনেশিয়ানদের মধ্যে। ওখানকার কোন্ অঞ্চলটা কোন্ জাতির প্রকৃত দখলে (ইংরেজ, না আমেরিকান, না ফরাসি) তাতে কিছু ইতরবিশেষ হয়নি, কারণ সর্বত্রই একই কারণে একই রকম ফল ফলেছে। পলিনেশীয় জনসংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। আমরা এখানে নিজেদের কোনো মন্তব্য না রেখে কয়েকটিমাত্র বক্তব্য উদ্ধৃত করব।
আর এল স্টিভেনসন-এর প্রদত্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুসারে ওসেনিয়ার (Oceania) অধিবাসীদের জীবনযাত্রা ও অভ্যাসের বিরুদ্ধে ১৫০ বছর ধরে যে-আইন ও প্রচার চালানো হয়েছে তা ওখানকার আদি অধিবাসীদের দ্রুত অবলুপ্তি ঘটাতে একটা সৈন্যবাহিনীর চেয়েও অধিক কার্যকরী হয়েছে। অবশ্য একথা সত্য যে, শ্বেতাঙ্গ আগমনের পূর্বেও এইসব দ্বীপবাসীরা তাদের নিজস্ব সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধের কবলিত ছিল এবং সেগুলিও পাশ্চাত্য কুসংস্কারের চেয়ে কম অবাস্তব বা কম যন্ত্রণাদায়ক ছিল না, তবুও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা অন্তত নৈতিক ব্যাপারে অধিকতর স্বাধীনতা ভোগ করত। এই একটা জায়গাতেই তারা জীবনের প্রকৃত আনন্দ খুঁজে পেত, আর তা প্রকাশ পেত তাদের পোশাক-পরিচ্ছদে, তাদের নাচে-গানে, আর তাদের যৌনসুখে। শ্বেতাঙ্গরা এসে এইসবকিছু নিষিদ্ধ করে দিল। স্টিভেনসন লিখেছেন, “পলিনেশিয়ানরা সহজেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে : বিচ্ছেদ, আশাভঙ্গ, অজানা অশরীরীর আবির্ভাবের ভয়, ক্ষয়, আগেকার সুখগুলির নির্বাসন, সহজেই তাদের বিষাদগ্রস্ত করে, আর এই বিষাদ তাদের জীবনবিমুখ করে তোলে। হাওয়াই দ্বীপের অধিবাসীর নতুন ধরনের জীবনের নৈরাশ্য ও শূন্যতা আমাদের বিস্ময়াহত করে; এই মন্তব্য আরও বেশি প্রযোজ্য মার্কুয়েসাস (Marquesas) সম্পর্কে …। কিন্তু লোটাস দ্বীপপুঞ্জে সুখের অবসানের সঙ্গে জীবনেরও অবলুপ্তি ঘটেছে…।
সামগ্রিকভাবে সমস্যাটা আমার কাছে এইরকম : পরিবর্তন, তা সে গুরুত্বপূর্ণই হোক বা তুচ্ছই হোক, উপকারই হোক বা ক্ষতিকারকই হোক, যেখানে খুব কম ঘটেছে সেখানেই জাতি টিকে থাকে, আর পরিবর্তনের সংখ্যা যেখানে অনেক বেশি সেখানে জাতি ধ্বংস হয়। … ‘পচা তাড়ি’ থেকে ‘বাজে জিন’-এ পরিবর্তন এবং দ্বীপবাসীর ঝোলা-পোশাক থেকে য়ুরোপীয় ট্রাউজার্স-এ পরিবর্তনের মধ্যে বাহ্যত কোনো তুলনা হয় না বলে মনে হতে পারে। তবু একটি পরিবর্তনের চেয়ে আরেকটি কম ক্ষতিকর বলে আমি বিশ্বাস করতে রাজি নই; এবং অনভ্যস্ত জাতি হয়তো কখনও বা পিনের খোঁচাতেও মারা যেতে পারে, আমরা এখানে ধর্মপ্রচারকদের একটি অসুবিধা প্রত্যক্ষ করতে পারছি। পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে ধর্মপ্রচারক অনায়াসেই প্রধান কর্তৃত্ব লাভ করেন; তিনি রাজপ্রাসাদে সর্বপ্রধান ব্যক্তি; তাঁর আদেশ করার ক্ষমতা আছে; কাজেই তাঁর পক্ষে লোভ সামলানো বড়ো কঠিন। (নানা বিবরণ থেকে জেনেছি) এইভাবে ম্যানগারাভায় ক্যাথলিকরা এবং (আপন অভিজ্ঞতায় জেনেছি) এইভাবেই হাওয়াই দ্বীপে প্রোটেস্ট্যান্টরা ওইসব অঞ্চলের ধর্মান্তরিত অধিবাসীদের জীবন অসহ্য করে তুলেছেন। আর ওইসব নম্র, নিরীহ, প্রতিবাদহীন মানুষগুলি (কারাগারে বন্দি শিশুদের মতো) দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করে। অভিজ্ঞতাই ক্রমে আমাদের দেখিয়ে দেয় (অন্তত পলিনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে) যে, অভ্যাসের পরিবর্তন বোমার আক্রমণের চেয়েও অধিকতর প্রাণঘাতী।…”
অন্যত্র স্টিভেনসন বলেছেন, “মহিলা ধর্মপ্রচারক সারাক্ষণই পোশাক নিয়ে ব্যস্ত। তাঁকে বোঝানো অসম্ভব যে, তাঁর অভ্যস্ত ধর্মীয় পোশাক ছাড়া অন্য কোনো পোশাকও সুন্দর এবং শোভন হতে পারে।” এমনকী দ্বীপবাসীদের জীবনে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই তামাক-সেবন বা উল্কি আঁকাও নিষিদ্ধ। এইসব ধর্মপ্রচারকের মন শুধু বাইবেলের গল্প দিয়ে ঠাসা; প্রকৃত অ্যাংলো-স্যাকসন কায়দায় তারা যেন ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্টে বর্ণিত সেই ইসরায়েলিদের সঙ্গে বসবাস করেন; বিরোধী সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়, আর পমোটাস দ্বীপপুঞ্জ ক্যাথলিক ও মর্মন-দের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। পূর্বপুরুষদের প্রচলিত ট্যাবুর স্থান নেয় পাশ্চাত্য ট্যাবু, সংকীর্ণতা ও যুক্তিহীনতায় তা একতিলও কম নয়। গিলবার্ট দ্বীপপুঞ্জের রাজা সাবাথ (Sabbath) দিবস পালন করতেন, ওইদিন তিনি কাউকে তাঁর ছবি তুলতে দিতেন না। নব ধর্মান্তরিতরা সহজবোধ্য কারণেই তাদের প্রভুদের চেয়ে আরও কঠোরভাবে ধর্মীয় নির্দেশ পালন করত; যেমন, মাকা (Maka) এসেছিলেন হাওয়াই দ্বীপ থেকে, গিলবার্ট দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের ধর্মশিক্ষা দিতে; স্টিভেনসন-এর লেখা অনুযায়ী তিনি “মানুষের নির্দোষ আনন্দকে অবদমিত করে রাখতে অনেক বেশি কঠোরতা প্রদর্শন করেন।”
গগাঁ-র (Ganguin) বিবরণে দেখা যায় যে, গোড়ার দিকে তাহিতি দ্বীপের মিশনারিরা কোনো-কোনো নারীকে ‘কলঙ্কিতা’ বলে চিহ্নিত করে দিত নরকের ভয় দেখানোর জন্য, তাদের চিবুকে একটি ল্যাটিন অক্ষরের উল্কি এঁকে দিত। আমাদের মনে পড়ে যায় সেই প্রথম নাবিকদের কথা, যারা নিউ সিথেরা-র (new Sythera) অধিবাসীদের বন্ধনহীন জীবনযাত্রা দেখে উপলব্ধি করেছিল, কী বিপুল সামাজিক বিপ্লবই না এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বিংশ শতাব্দীতেও একজন ফরাসি লেখক লিখতে পারেন, “মার্কুয়েসাস-এর অধিবাসীদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ১৮৫০ সালেও এই দেশের জনসংখ্যা ছিল তিরিশ হাজার, বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় তা এসে ঠেকেছে দু-তিন হাজারে। এখানকার আদিবাসীরা মারা যাচ্ছে টিউবারকুলোসিস, সিফিলিস প্রভৃতি রোগে এবং জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে, ফরাসি শাসন যার মূল কারণ।” ১৯২৭ সালে একটি প্রোটেস্ট্যান্ট মিশন তাঁদের সিডনিতে আহুত সম্মেলনে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, এই বর্তমান মৃত্যুর হার যদি বজায় থাকে (যদিও তারা পাশ্চাত্য স্বাস্থ্যবিধির সকল সুবিধাই পায়) তাহলে আগামী বিশ বছরের মধ্যেই এই জাতিটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।…
শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা ওসেনিয়া অধিকৃত হওয়ার ফলে কিন্তু সেখানকার অধিবাসীদের কোনো মঙ্গলই সাধিত হয়নি, বরং অনিবার্য স্নায়বিক রোগের ফলে তাদের জীবন হয়ে উঠেছে যন্ত্রণাময় এবং এই জাতিটি অকালে লুপ্ত হতে বসেছে — তাদের স্বাভাবিক যৌনজীবনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারের এই হল ফল। শ্বেতাঙ্গদের অবস্থা অবশ্য বিষের নেশায় অভ্যস্ত মানুষের মতো। যে পরিমাণ বিষ অন্যদের পক্ষে মারাত্মক তা এদের মারার পক্ষে যথেষ্ট নয়। কিন্তু যেসব জাতি অধিকতর স্বাভাবিক জীবনযাপন করত তাদের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংস্পর্শ আমাদের হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়, পাশ্চাত্যের এই রকম মারাত্মক মাত্রার বিষ সহ্য করতে হলে তার আগে কী পরিমাণ অভ্যাস ও রোধশক্তি (resistance) থাকা প্রয়োজন।
(চ) যৌনশক্তিহীনদের স্নায়বিক রোগ :
যৌনশক্তিহীনতা এমনই এক অক্ষমতা যে ব্যাপারে পুরুষেরা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এর ক্ষতিকর প্রভাব দুদিকেই : অক্ষম পুরুষ একে অত্যন্ত লজ্জাজনক বলে মনে করে, এবং তার স্ত্রী পরোক্ষে কষ্টভোগ করে ও একে অপমানকর বলে মনে করে।
খোজারা, যদিও প্রকৃতপক্ষে তারা কেবলমাত্র সন্তানোৎপাদনে অক্ষম, রাগমোচনে (চরম তৃপ্তিতে) অক্ষম নয় তবু, বিশ্বের সকলের কাছেই কৌতুকের পাত্র। প্রাচ্যদেশীয়রা খোলাখুলিই বলে যৌনশক্তিহীনতার চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়। বিবাহিত জীবনে যৌন-অক্ষমতা, পূর্ণ অক্ষমতাই হোক অথবা, মাঝেমাঝে যেমন দেখা যায়, শুধুমাত্র স্ত্রীর সঙ্গে শয্যায় অক্ষমতাই হোক, চিরকালই বিবাহিত দম্পতির জীবনে অন্তহীন অশান্তি ও মতানৈক্যের কারণ; এর ফল বহু চতুরালি ছলনা অথবা বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। সুতরাং সহজেই বোঝা যায় যে, যৌনশক্তিহীন ব্যক্তিরা, (বিশেষত যারা ইতিপূর্বে বিচিত্র ও সফল যৌনজীবনের সুখভোগের পর যৌনশক্তিহীন) কেন স্নায়বিক রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং বিষাদ ও হতাশায় ভুগতে থাকে। উচ্চমাত্রায় যৌনতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা যখন জীবনের শেষভাগে এসে পৌঁছোয়, তখন হ্রাসপ্রাপ্ত যৌনক্ষমতা তাদের মনে সুগভীর বিষণ্নতাবোধের সৃষ্টি করে। অনুরূপ মনমরা ভাব ও উদ্বিগ্ন অবস্থা রজঃবন্ধ হওয়ার বয়সে নারীদের মধ্যেও লক্ষ করা যায়। যৌনতা বিষয়ে আধুনিক সভ্যতার যে ধারণা বর্তমান তাতে যেসব বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রজনন ক্ষমতা হারিয়েছে তাদের যৌনকামনা পূরণের জন্য সঙ্গী পাওয়া কঠিন। এই যৌন ধারণা যেন সুনিশ্চিতভাবে ক্রণিক আতঙ্কগ্রস্ত স্নায়বিক রোগীর সৃষ্টির জন্যই পরিকল্পিত, অথচ, চিকিৎসকের দৃষ্টিতে, এই জাতীয় রোগী কেবলমাত্র একজন তরুণ যৌনসঙ্গীর সঙ্গে যথাযথ যৌনউত্তেজনালাভেই আরোগ্য হতে পারে। আনাতোলে ফ্রাঁ বিষয়টিকে এইভাবে বর্ণনা করেছেন : “মানুষের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ঋতু হল তার কামনা ও সুখের সময়টুকু। বুদ্ধিমান মানুষ এই সময়টুকুকে দীর্ঘতর করার জন্য সর্বপ্রকার চেষ্টা করে ।… আমার দিক থেকে বলতে গেলে, আমি তো ডেসকার্টেজের ফর্মুলা (Descartes’s formule) অনুসরণ করব : আমি ভালোবাসি, তাই আমি আছি; যখন আমি ভালোবাসি না, তখন আর আমার কোনো অস্তিত্বই নেই।” এবং এই বিখ্যাত লোক এই উক্তিটিকে একটি গল্পের সারমর্ম করেছেন; গল্পটির নাম ‘Le Roi Des Elixirs’। আমরা পাঠককে গল্পটি পড়ে দেখতে বলি।
যৌন-অক্ষমতাকে যে অগৌরবের ব্যাপার বলে মনে করা হয় — এই সত্য আমাদের সামাজিক প্রথার অসংলগ্নতাকেই আরও একবার স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়, কিংবা বলা উচিত যে যৌন-নৈতিকতা অবাস্তবতার বিরুদ্ধে মানুষের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের এ এক ধরনের বিদ্রোহ। সুতরাং যৌননিষেধের ধ্বজাধারীরা যে বিশ্বাস করেন — মানুষ শালীনতাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে এবং নারী যৌনসম্পর্কের যে-কোনো প্রস্তাবেই অপমানিত বোধ করে — সেই বিশ্বাসের যে-কোনো ভিত্তি নেই, যৌনশক্তিহীনতার বিরুদ্ধে মানুষের এই চূড়ান্ত আপত্তিই তা প্রমাণ করে।
যৌন-স্নায়বিক রোগহীনদের কিছু স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য :
আগের উদাহরণ থেকে স্বভাবতই আমাদের মনে সন্দেহ জাগতে পারে যে কোথাও-না-কোথাও আমরা এই চিত্রের বিপরীত কিছু দেখতে পাব। বস্তুত পর্যটকগণ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি লিপিবদ্ধ করতে ভুলে যাননি, যে-কোনো অনিসন্ধিৎসু ব্যক্তিরই তা চোখে পড়বে।
যাঁরাই মধ্য ও পূর্ব-এশিয়া, ওসেনিয়া ও আফ্রিকা ভ্রমণ করে সেখানকার অধিবাসীদের পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁরাই এদের ও পাশ্চাত্যবাসীদের ‘স্নায়বিক’ অবস্থার মধ্যে বিস্ময়কর পার্থক্য বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। পাশ্চাত্যবাসীদের মধ্যে যেন এক জ্বরগ্রস্ত অস্থিরতা, উদ্বেগ ও উত্তেজনা দেখা যায়। একজন তীক্ষ্ণদৃষ্টি ইন্দোচিন পর্যবেক্ষকের চোখে ‘তারা সর্বদাই যেন এক ছায়ার পিছনে দৌড়োচ্ছে।’ প্রাচ্যদেশীয়রা নিজেরাই স্বীকার করে যে, তারা দূর পাশ্চাত্য জাতিগুলির সম্পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্ট্য নিজেদের মধ্যে লক্ষ করে অবাক হয় (য়ুরোপীয়রা বলতে ভালোবাসে যে “পীতজাতির স্নায়ু বলে কোনো বস্তু নেই”; বাস্তবিকই, ‘সিফিলিস’ রোগের স্নায়বিক লক্ষণগুলি এদের কাছে প্রায় অজানা)। প্রাচ্যদেশীয়দের মধ্যে স্নায়ুচাঞ্চল্য অনুপস্থিত, তাদের মধ্যে এক প্রশান্তি, এক অনুদ্বেগ লক্ষ করা যায়; এবং য়ুরোপীয়রা যেমন কোনো গোলমাল বা আওয়াজ শুনেই চমকে ওঠে, অন্তত ঘুমোতে পারে না, এরা কিন্তু তাতে অবিচলিত থাকে, ফলে অল্প কিছুক্ষণ ঘুমিয়েও নিতে পারে একটু সুযোগ পেলেই। সর্বশেষ কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল, এদের মধ্যে জীবন সম্পর্কে এক নিশ্চিন্ত সন্তোষবোধ পরিলক্ষিত হয়, আমরা যেন তাকে হতাশায় হাল ছেড়ে দেওয়া বলে ভুল না করি।
যেসব নারী পুরুষদের সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত যৌনসম্পর্ক স্থাপন করে তাদের আচরণেও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একই রকম পার্থক্য লক্ষ করা যেতে পারে। পাশ্চাত্য দেশে জুডীয়-খ্রিস্টান দৃষ্টিভঙ্গিতে এই জাতীয় যৌনসম্পর্ক হল পাপের মূল; এমনকী যারা খ্রিস্টান দর্শনের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, তাদের মধ্যেও এক ধরনের পুরুষানুক্রমে অর্জিত-নৈতিকতা পাপের এই ধারণাকে আজও কিছু পরিমাণে বজায় রেখেছে। পাশ্চাত্যের নারী, সে যাকে বলে ‘পতন’, তা রোধ করতে চায়। সৌজন্যবোধের খাতিরে সে এ জাতীয় আচরণকে লজ্জাকর মনে করবে; হতবুদ্ধির মতো সে তার সদ্যপ্রেমিক পুরুষকে বলবে, “তুমি নিশ্চয় আমাকে খুব খারাপ ভাবছ।” অন্যান্য জাতির নারীর মধ্যে কিন্তু এ-সব দেখা যায় না, অবশ্য যদি-না তার স্বাভাবিক যুক্তিবোধ এই অদ্ভুত নৈতিকতার ফলে বিকৃত হয়ে গিয়ে থাকে। তার কাছে দেহদান সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর কাজ; অসংকোচে সে এই কাজটি সমাধা করে, এর জন্যে সে কোনো অনুতাপও করে না বা লজ্জায় লাল হয়েও ওঠে না; বরং সুখলাভের পর সে নিজেকে তার সঙ্গীর সমকক্ষ বলে মনে করে, এক আনন্দ ভাগ করে নিতে পেরে তারা দুজনেই আনন্দিত ও গর্বিত। এ এমনই সুন্দর মানসিকতা ছিল তাহিতি দ্বীপে। কোনো কোনো দেশে আজও তা বর্তমান। শারীরতাত্ত্বিক সত্যের প্রতি সুস্থ মনোভাব বজায় রাখলে আমরা যে কী পেতে পরি উক্ত মানসিকতা তার এক মূল্যবান দিক্নির্দেশক। এখানে মনকে বিচলিত করার মতো কোনো স্নায়ুগত সমস্যা নেই; বস্তুত এ রকম একটা অবস্থার কথা ভাবলেই আমরা এক অদ্ভুত সুখ ও স্বস্তি অনুভব করি।
এইসব স্বাভাবিক ও সুখী মানুষদের কাছে উদার পাশ্চাত্য জাতিসমূহ এনে দিয়েছে দুটি মূল্যবান উপহার-সিফিলিস, যা তাদের এতদিন অপরিচিত ছিল, আর যৌন স্নায়বিক রোগ। অথচ প্রাচীন পর্যটকগণ এইসব মানুষের চমৎকার জীবনযাত্রা আবিষ্কার করে পুলকিত হয়েছিলেন : “কুক (cook) তাহিতি দ্বীপ ছেড়ে চলে আসার সময় জাহাজের ডেকে বসে কেঁদেছিলেন।” কিন্তু তারপর এলেন পাশ্চাত্যের নৈতিকতার শ্রেষ্ঠত্বের গর্বে অন্ধ শিক্ষাদাতারা; দুরকমের নৈতিকতার তুলনামূলক বিচারের কথা তাদের একবারও মনে হয়নি, কারণ তাদের বিবেচনায় তাঁদের নিজস্ব নৈতিকবিধি ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত ‘জ্ঞানালোক’। শুধুমাত্র প্রকৃতির বিধান মেনে চললে যে সহজ আনন্দ লাভ করা যায়, তার বদলে এইসব শিক্ষকরা আমদানি করলেও জুডিয়-খ্রিস্টান পাপতত্ত্ব ও তজ্জনিত স্নায়বিক অসুস্থতা সমেত পাশ্চাত্যের যাবতীয় নৈতিক বিধি-নিষেধ — হয় বলপ্রয়োগ করে অথবা ক্রমাগত মন্ত্রণা দিয়ে-দিয়ে। কিন্তু এইসব দেশের সুসংগঠিত সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁরা কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারলেন না, ফলে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটল খুব সামান্য — যেমন চিনে, যেমন জাপানে। কিন্তু পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের মতো ছোটো ছোটো অসহায় গোষ্ঠীগুলি প্রায় পুরোপুরিই তাদের কৃপানির্ভর হয়ে রইল, এবং আমরা জানি যে তার ফল যা হয়েছে তা যেমন স্পষ্ট তেমনই নিন্দনীয়।
যেসব দেশ যৌন স্বাধীনতা ভোগ করে সেখানে যৌন স্নায়ুরোগ নেই, এমনকী বলা যায় যে পাশ্চাত্যের অতি পরিচিত যৌনআবেগপ্রসূত অপরাধও ওইসব দেশে ঘটে না; কিন্তু এ বিষয়ে আমরা অন্যত্র আলোচনা করব। আমরা আগেই বলেছি, পর্যটকরা এইসব দেশের আনন্দময় জীবন দেখে একদা বিস্মিত হয়েছিলেন। অনায়াসে যৌনক্রিয়া সম্পাদন করার সুবিধা ও তার সঙ্গে ন্যায়-নীতির যোগ না-থাকাই হল সুখী জীবনের ভিত্তি। আমরা বিষয়টিকে একটি সাধারণ সূত্রের আকারে এইভাবে বলতে পারি — একটি সমাজের সুখ ওই সমাজের অধিবাসীদের যৌনক্রিয়া সম্পাদনের অধিকারের সমানুপাতিক; আমরা যদি মানবজীবনের প্রকৃত অর্থ কী তা বুঝতে চাই, তবে এই সূত্রটি মনে রাখলে ভালো করব।
স্ববিবেচনায় অবদমনকে অস্বীকার করার ফলে যারা যৌন স্নায়বিক রোগের কবলমুক্ত তাদের প্রকৃতি :
ন্যায়নীতি বলতে যদি বোঝায় এমন নিয়মাবলি যা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, তবে ‘বিবেক’ নামক মনস্তাত্ত্বিক অংশটি বাদ দিলে ন্যায়নীতির কোনো অর্থই হয় না। মানুষের স্বাভাবিক অভ্যাসের স্পষ্ট বিরোধী আইনগুলি যেমন অবাস্তব, অযৌক্তিক, বিবেকহীন ন্যায়নীতিও তেমনই অবাস্তব, অযৌক্তিক। কিন্তু ‘বিবেক’ বস্তুটি কী? ফ্রয়েড-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, “আমাদের সকলের মধ্যেই এমন কিছুকিছু আকাঙ্ক্ষা আছে যার বিরুদ্ধে আমাদের নিজেদের অন্তরের গভীর থেকেই এক প্রতিবাদ জেগে ওঠে — এই প্রতিবাদের গভীর উপলব্ধিই হল বিবেক। কিন্তু এর গুরুত্ব এই যে, এই প্রতিবাদের উপলব্ধি ও আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তন অন্য কোনো কিছুর ওপর নির্ভর করে না, এ নিজের সম্পর্কে নিজেই সুনিশ্চিত।” এ সংজ্ঞা থেকে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পাচ্ছি যে, এই বিবেকের প্রভুত্ব বজায় রাখতে হলে, অথবা আরও সঠিকভাবে বলা যায়, এর অস্তিত্ব আদৌ বাঁচিয়ে রাখতে হলে, বিবেকের উচিত হবে কেন কোন্ -কোন্ আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করা প্রয়োজন সে বিষয়ে কোনো আলোচনা করতে অস্বীকার করা। বিবেককে জোর দিয়ে বলতে হবে, ট্যাবুর মূলের কারণগুলি যেমন তর্কাতীত ও প্রশ্নাতীত ছিল এবং বহু ক্ষেত্রে বোধাতীত হওয়া সত্ত্বেও বাধ্যতামূলক ছিল, তেমনি বিবেকের প্রতিবাদ ও বর্জনের কারণগুলি যখন বোঝা যাবে না তখনও তা বাধ্যতামূলক বলে মনে করতে হবে।
সুতরাং নৈতিক আদর্শ কেবলমাত্র সকলের মতৈক্যের জোরেই বেঁচে থাকতে পারে। কোথায় পাওয়া যাবে এই জোর, এই শক্তি? মাত্র দুটি উৎস থেকে : যদি সামাজিক অবস্থা এমন হয় যে কেউই এই আদর্শগুলিকে নিয়ে চিন্তা বা আলোচনা করতে সাহস করে না, সেক্ষেত্রে আদর্শগুলি যুক্তিযুক্ত কিনা তাতে কিছু আসে যায় না (যেমন ট্যাবুর ক্ষেত্রে); অথবা আদর্শগুলিকেই এমন যুক্তিপূর্ণ-সংগত হতে হয় যে প্রত্যেকেই সেগুলি মেনে নেবে, এমনকি যে-সমাজ এমন এক মানসিক উন্নতির স্তরে পৌঁছেছে যে সেখানে প্রতিটি বিষয়ই আলোচনা করে স্থির হয় বা হতে পারে, সেই সমাজেও। কিন্তু এইসব শর্তের একটিরও যদি অভাব ঘটে, উদাহরণ স্বরূপ ধরা যাক, যদি কোনো একটি কারণহীন, যুক্তিহীন বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন নৈতিক আদর্শ এমন এক সমাজে এসে পড়ে যে-সমাজ ওই আদর্শটির মূল্য যাচাই করতে পরীক্ষা করে দেখতে চায়, সেখানে এই আদর্শ দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারবে না। আদিম মানুষেরা যে-সব ট্যাবুকে তর্কাতীত বলে মনে করেছিল সেগুলি আজ আমাদের চোখে যেমন ছেলেমানুষি বলে মনে হয় ও আমরা যেমন মুহুর্তের জন্যও দ্বিধান্বিত হই না, তেমনি নৈতিক আদর্শটিও মানুষের চোখে একই রকম ছেলেমানুষি ও পরিত্যাজ্য বলে মনে হবে।
যৌনতা সংক্রান্ত নৈতিক আদর্শগুলির ক্ষেত্রেও বেশ কিছুদিন ধরে তেমনই ঘটে চলেছে। সেগুলিকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, এর এই নির্মম পরীক্ষার সামনে ওই নৈতিক আদর্শগুলির প্রতিরোধ হয়ে পড়ছে দুর্বল। আমরা যখন প্রশ্ন করি, এগুলির অস্তিত্বের পিছনে কোনো যুক্তি বা বিজ্ঞান আছে কিনা, তখন শুধু উত্তর আসে, এগুলি অলঙ্ঘনীয় — ট্যাবু — আধুনিক জগতে বড়ো দুর্বল এই আত্মরক্ষার প্রয়াস। তাদের চারপাশে ক্রমেই যুক্তিবাদী চিন্তাশীলদের সৈন্যবাহিনী ঘিরে দাঁড়াবে, এই আদর্শগুলির যে কোনো মূল্য আছে তা তারা মানবে না, অন্তত কোন্ ভিত্তিতে এগুলি দাঁড়িয়ে আছে তা আনুপূর্বিক পরীক্ষা করে দেখার দাবি জানাবে।
এখন থেকে নৈতিক আদর্শগুলিকে এক বিশাল নতুন শ্রেণির ব্যক্তিবর্গের মুখোমুখি হতে হবে, যারা তীক্ষ্ণবুদ্ধি, যারা স্নায়ুরোগগ্রস্ত নয়, যারা স্বীয় উদ্যোগে যৌন নৈতিকতার ঐতিহ্যকে কঠিন নির্দিষ্ট পরীক্ষা করে দেখেছে এবং ‘অলঙ্ঘনীয়’-এই সরল উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে, যুক্তিভিত্তিক বিজ্ঞানভিত্তিক কারণ জানতে চায়। আর যদি কোনো যুক্তিসংগত কারণ দিতে না পারা যায়, তবে তারা মনে করবে, ইতিপূর্বেই পরিত্যক্ত ট্যাবুগুলির মতোই এই নৈতিক আদর্শগুলিও বাতিলযোগ্য। তাদের নিজস্ব যুক্তিগ্রাহ্য আদর্শের জোরেই তারা প্রাচীন বিধিনিষেধ ও দমনগুলির প্রতি বিরূপ, অন্ততপক্ষে উদাসীন হয়ে উঠবে; একবার যদি তারা সুনিশ্চিতভাবে বুঝতে পারে, তাহলে হয়তো তারা অবদমনের সকল বাধা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করবে; কারণ ওই বাধাগুলি তখন তাদের কাছে মিথ্যা ছলনা ছাড়া আর কিছু নয়। তারা এই কৃত্রিম বাধাবন্ধনমুক্ত এক নতুন জীবন যাপন করবে; তাদের নীতি, তাদের আচরণ সব কিছুই হবে বর্তমান যৌন রীতিনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত, স্নায়ুরোগের ফলে নয়, সুস্থচিন্তার স্পষ্ট প্রতিফলনের ফলে। আর যে বহুসংখ্যক মানুষ সমকামিতা, স্বমোহন প্রভৃতিতে অভ্যস্ত তারা যে স্নায়ুরোগগ্রস্ত নয়, সে বিষয়ে সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার আরও একটি যুক্তি পাবেন মনোবিশ্লেষক; তারা আরও ভালো করে বুঝতে পারবেন, কেন উচ্চবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই এই নব-নৈতিকতার স্বাধীনতাকে সমর্থন জানাচ্ছেন — কারণ তাঁরা প্রচলিত নৈতিক আদর্শের ভ্রান্তিগুলিকে বুঝতে পেরেছেন; নিষ্ক্রিয় মনের মানুষেরা এগুলিকেই সত্য বলে ধরে নিয়েছে, তাই মেনে চলেছে। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটি কিন্তু খুবই সরল। এ যুগে অনুরূপ ঘটনার সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। আজকের যুগে এমন বহু মানুষ আছেন যাঁরা কোনো একটি বিশেষ ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে বড়ো হয়েছেন, কিন্তু পরবর্তীকালে ওই ধর্মবিশ্বাসকে পরীক্ষা করে দেখে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেছেন, এবং বাকি জীবনে তার আর কোনো প্রভাবই পড়েনি।
[Rene’ Guyon রচিত Sex Life and Sex Ethics গ্রন্থের অন্তর্গত ‘The Neuroses due to Sexual Repression’ প্রবন্ধের অনুবাদ। কৃতজ্ঞতা : পুনশ্চ।]