ড্যান গার্ডনার
(অনুবাদ : মানস মুখোপাধ্যায়)
বেশ কিছু বছর আগে সংবাদপত্রের এক কাজের বরাত নিয়ে নাইজেরিয়ার লাগোসে এসেছিলাম। সেখানে একদিন গভীর রাতে এক বস্তিতে গিয়ে পৌঁছলাম। আফ্রিকান বস্তিতে রাত-বিরেতে যাবার বিষয়ে গাইডবুকের পরামর্শ নিলে তারা আমাকে অবশ্যই বিরত করত। আমি তো আদতে বিদেশী, আর আফ্রিকার বস্তিতে বিদেশীদের মোটের ওপর ধনী বলেই মনে করা হয়। সেখানে মানুষের ধারণা, বিদেশীরা প্রচুর নগদ টাকা সঙ্গে রাখে। লাগোসের মতো শহরে যেখানে মানুষজন গরীব, পথঘাট নিতান্তই গোলমেলে এবং কাঠিন্যে ভরা পরিবেশ, সেখানে টাকাপয়সা কিছু বেশি থাকলে ছিনতাই বা খুন কিংবা দুটোই ঘটে যাওয়া অসম্ভব নয়।
রাস্তার পাশে একটা ধাবায় ঢোকার পথে আমার মানিব্যাগটি, আমি কিছু বোঝার আগেই নিপুণ হাতে কেউ একজন তুলে নিয়েছিল। অবশ্য, এসব কিছু হবার আগেই আমি সেখানকার একজন মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। ছিনতাইয়ের ঘটনার পর, কথায় কথায় সে আমায় বলল যে অপরাধীকে সে ঠাওর করতে পেরেছে ও তার হদিশও সে আমায় দিতে পারে।
এরপর, আমরা একসঙ্গে ভুট্টা খেতের মাঝ দিয়ে নোংরা পথ ধরে এক গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়লাম। সেখানে ঠান্ডায় কিছু মানুষ জ্বলন্ত চুল্লির ধারে শরীর সেঁকছিল আর ঝুপড়ির ভেতরের কেরোসিনের ডিবের আবছা আলো রাস্তায় এসে পড়ছিল। অন্যদিকে কিছু যুবক দিশি মদের নেশায় বুঁদ হয়ে আমাদের দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিল। আমার নবতম সেরা বন্ধুবর চোরের সন্ধান জানতে নানা মানুষের কাছে খোঁজ চালিয়ে গেল, কিন্তু সবই ছিল ব্যর্থ প্রচেষ্টা। আমি তখন নিরুপায়; অবশেষে একজন অপরিচিত মুরুব্বির সঙ্গে কুয়াশা ভেজা কালো রাতের আঁধারে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। আমার অস্তিত্বের ধারণা তখন লোপ পেয়েছে, আমার পেটের ভেতরটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠছে, আমি বোধশূণ্য হয়ে পড়েছিলাম; শুধু ভেতর থেকে কে যেন বলছিল, আমি খুব খারাপ পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছি।
আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেছি, ঘামে জবজব করছে গোটা শরীর, কিন্তু আমার এগিয়ে চলা বন্ধ হয়নি। আমার ব্যাগে যে ক’টা টাকা ছিল, আমি জানতাম আমার পত্রিকা তা পুষিয়ে দেবে, কিন্তু মনের ভেতরে খচখচ করছিল অন্য একটা বিষয়, যা আমি কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। ঐ ব্যাগের ভেতরে ছিল আমার দুই বাচ্চার একটা ফটোগ্রাফ, যেটা এক মনোরম বড়দিনের সময় কোনও একটা স্টুডিওতে তোলা হয়েছিল। ছবির পশ্চাদপটে আঁকা জানলার বাইরে তুষারঝরা রাতের আকাশে সান্তার শ্লেজ উড়ে চলেছে, সামনে দাঁড়ানো আমার বাচ্চাদুটোর মুখে চওড়া অবোধ হাসি। কী নিবেদিত প্রজ্ঞায় ফটোগ্রাফার ছবিটায় ভারসাম্য রাখতে একটা রাবারের হাঁসকে ওদের বোকা বোকা মুখের ঠিক ওপরেই ঝুলিয়ে দিয়েছিল — ঐ অবস্থাতেও ফটোগ্রাফারকে মনে মনে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না।
আমি কিন্তু জানতাম, আমার বাড়িতে এই একই ছবি প্রায় আধ ডজন পড়ে আছে। আরও জানতাম, ওটা ছিল নিছকই একটা ছবি, তবুও আমি নিজেকে দমাতে পারিনি। আমি ওদের সেই উজ্জ্বল হাসি দেখেছিলাম এবং মনে মনে ভাবছিলাম, মানি ব্যাগের টাকাগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে আর নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে খালি ব্যাগটাকে। আমার মনে হচ্ছিল, নর্দমার পাঁকে পড়ে ছবিটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। আমি অসুস্থ বোধ করছিলাম — মনে হচ্ছিল, এই জগৎ সংসারে আমি নিতান্তই একা! প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে খোঁজ চলল। শেষ পর্যন্ত কেউ যেন বলে উঠল, “কী বোকা তুমি! যে কেউ তো তোমার গলাটা কেটে এখানে খুন করতে পারে”। শেষ পর্যন্ত, আমার সঙ্গীটির সঙ্গে কিছু টাকায় রফা করে আমি হোটেলে ফিরলাম।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি বিস্ময়ে কেবল মাথা নাড়িয়ে যাচ্ছিলাম। আমাকে এখনও সেই একই চিন্তা উত্তক্ত করছে যে আমার বাচ্চাদের ছবিটা হারিয়ে গেছে। তবে সেই উদ্বেগ এখন আর তত তীব্র নয়। ভাবছিলাম, কী রীতিমত বোকার মতো কাজ আমি করে ফেলেছি — কেন এমনটা করলাম! কালকের সেই ক্লান্তিকর রাতে উদ্বেগের কারণটা আমি কিছুতেই খুঁজে পাইনি। একঘেয়ে চিন্তা আমাকে ক্লান্ত করে ফেলেছিল। আমার ঘরে যে কয়েকটা বিয়ারের বোতল ছিল সেগুলো একে একে নিঃশেষ করেও আমার মনের অবস্থা বদলাতে পারিনি। কী কারনে এমনটা ঘটল, তা আমি তখনও বুঝতে পারছিলাম না। আসলে, এই ঘটনার সঙ্গে অন্য কিছু একটা কারণ জড়িয়ে ছিল, যা আমি অনেক পরে আবিষ্কার করেছিলাম। সেটা ছিল আমার ভেতরে থাকা আদিম গুহা মানব! আমার মগজের ঘেরাটোপে (wiring) আটকে থাকা অচেতন মনের ধ্যান-ধারণাই আমাকে বিভ্রান্ত করেছিল।
আমরা আধুনিক ধনী দেশের মানুষেরা নিজেদের উন্নত হিসাবে ভাবতে পছন্দ করি। আমরা লিখতে পড়তে পারি। আমরা জানি, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, অন্যভাবে নয়। আমরা পরিষ্কার, পরিপাটি এবং সুবাসিত থাকতে ভালবাসি। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে দীর্ঘদেহী, স্বাস্থ্যকর ও দীর্ঘজীবী। আজ যখন আমরা হাসি বা আমাদের দাঁতের ক্রিয়াকলাপ যেভাবে প্রকাশ করি, তা আমাদের পূর্বপুরুষেরা কল্পনাও করতে পারত না। তবুও যা আমাদের আজকের মানুষ হিসাবে পরিচিতি দিয়েছে তা হল, সেই উজ্জ্বল ঝলমলে দাঁত। বলতে দ্বিধা নেই, তার গঠনের বিবর্তনের তুলনায় আজও আমরা ততটা আধুনিক হয়ে উঠতে পারিনি।
পাঁচ থেকে সাত মিলিয়ন বছরের মধ্যে শিম্পাঞ্জি আর মানুষের পূর্বপুরুষেরা প্রাইমেট পরিবারের শাখার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। প্রায় দুই থেকে আড়াই মিলিয়ন বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের মস্তিষ্ক ৪০০ ঘন সেন্টিমিটার থেকে বেড়ে ৬৫০ ঘন সেন্টিমিটারে পরিনত হল। এটি একজন গড় আধুনিক মানুষের ১৪০০ ঘন সেন্টিমিটারের মস্তিষ্কের যদিও একটা ভগ্নাংশ মাত্র, তবুও এটা মনুষ্য প্রজাতির প্রকৃত সূচনা চিহ্নিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল — আসলে হোমো প্রজাতির জন্ম হল।
প্রায় ৫০০০০০ বছর আগে, মানুষের পূর্বপুরুষদের মস্তিষ্ক আরও একটা বড়ো লাফ দিয়েছিল — ১২০০ ঘন সেন্টিমিটারে। চূড়ান্ত পদক্ষেপটা এল ১৫০০০০ থেকে ২০০০০০ বছর আগে, যখন হোমো সেপিয়েন্সরা আফ্রিকার সমভূমিতে প্রথম হাঁটতে শুরু করল। ডিএনএ বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, আজকের জীবিত প্রতিটি ব্যক্তি কোনও এক সাধারণ পূর্বপুরুষেরই অংশ বিশেষ, যার সূচনা ১০০০০০ বছর আগে হয়েছিল।
জিনগত পরিবর্তনই প্রধান দুটো চালিকা শক্তির কারণ— প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং পরিবর্তন (Mutation)। প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই বৈশিষ্ট্যগুলির আনুকূল্য পায় যা একটা জীবকে বেঁচে থাকতে এবং নতুন প্রজন্ম গড়তে সাহায্য করে, যখন আবার বেঁচে থাকা এবং প্রজনন বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন তারাই সেই আগাছাদের বিনষ্ট করে। অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি সমান হলেও প্যালিওলিথিক মানুষের দৃষ্টি শক্তি যতটা তীক্ষ্ণ ছিল বা তার বাহু যতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, তার পূর্বসূরীদের তেমনটা ছিল না। তাই আরও ভালোভাবে বেঁচে থাকার, আরও ভালো খাওয়ার বা একজন উপযুক্ত সঙ্গী পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তার সন্তানদের আরও প্রখর দৃষ্টি শক্তি ও যথেষ্ট শক্তিশালী বাহু উপহার দেবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। অন্যথায় চর্মসার সম্পন্ন লোকটাকে সিংহের আহারের সম্ভাবনায় দিন কাটাতে হত! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিকভাবে মানব জনগোষ্ঠীর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল, তাদের বাহু হল বলশালী।
যাইহোক, জিনগত পরিবর্তনই সত্যিকারের পালাবদলের উৎস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবশ্য এর কোনও সুস্পষ্ট প্রভাব থাকে না বা তার প্রভাব কোনও সুবিধা বা অসুবিধা সৃষ্টি করে না। এই পরিবর্তন মানুষের বেঁচে থাকা এবং নতুন প্রজন্ম গড়তে যে স্বাভাবিক বাধা তা দূর করতে অপারগ; আর সে কারণেই প্রাকৃতিক নির্বাচন তার বিস্তার ঘটাতে বা দমন করতে সাড়া দেয় না। মাঝে মাঝে একটা পরিবর্তন (Mutation) মারাত্মক রোগ বয়ে এনে বিপর্যয় ঘটিয়ে দেয়। এটা আক্রান্ত ব্যক্তির সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট কমিয়ে দেয়। আবার একইভাবে একেকটা পরিবর্তন দু-এক প্রজন্মের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু তারপর ঘটে এক বিরল ঘটনা, যেখানে সেই পরিবর্তন এক নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে যা তার সংস্পর্শে আসা ভাগ্যবান লোকটাকে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে মস্ত একটা সুবিধা করে দেয়। ফলে সেই সুফল সে তার সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে সক্ষম হয়। একটু সময় পেলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সেই সৌভাগ্যের ফসল অন্য অনেকের কাছে পৌঁছে যায়; এমনকি গোটা প্রজাতি তার লাভ গ্রহণে সক্ষম হয়।
যদিও ইতিবাচক এবং নেতিবাচক পরিবর্তনের (Mutation) মধ্যে সীমারেখা সব সময় পরিষ্কার করে বোঝা যায় না। কিছু মিউটেশন আছে, যারা মানুষের ভয়ানক ক্ষতি সাধন করে। তবুও কিছু দিন গেলে তারা এর থেকেই অনেক উপকার পেয়ে থাকে। তখন ক্ষতির চেয়ে লাভের অংকই হয় বেশি। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ পাওয়া যায় পশ্চিম আফ্রিকায়, যেখানে জনসংখ্যার দশ শতাংশ জিনগত মিউটেশন বহন করে চলে এবং এর ফলে সিকেলসেল অ্যানিমিয়ার মতো ভয়ানক মারণ রোগ সৃষ্টি হয়। এটি এমন এক রোগ যা শিশুদের বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় আর পৌঁছতে দেয় না। সাধারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন এই মিউটেশনের অবলুপ্তি ঘটাবে। মিউটেশন যে সবসময়ই মারাত্মক হবে, এমনটাও নয়। যেমন এক্ষেত্রে, সিকেলসেল অ্যানিমিয়া এমন এক রোগ যখন পিতা বা মাতা উভয়ই এর দ্বারা আক্রান্ত থাকে, তখনই সন্তানের মধ্যে এর সংক্রমণ ঘটে। যদি এমন হয় যে পিতামাতার মধ্যে কেবলমাত্র একজন এই রোগে আক্রান্ত, সেক্ষেত্রে তার শিশু সন্তানের মধ্যে এক স্বাভাবিক প্রতিরোধ সৃষ্টি হয় এবং এই রোগ তাকে ছুঁতে পারে না। সমগ্র পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে এই রোগ নিয়মিতভাবে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের হত্যা করে চলেছে। কিন্তু, এই মিউটেশন যেমন প্রাণ নেয় তেমনি বহু ক্ষেত্রে জীবনকে লড়াই করতেও সাহায্য করে। এর ফলে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত এই প্রাকৃতিক নির্বাচন পশ্চিম আফ্রিকায় জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশে মিউটেশনের সুফল ছড়িয়ে দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করেছে।
শারীরিক বৈশিষ্ট্যের গতিপথেই অধিকাংশ মানুষ অনুগামী হয়। হাতের চারটি আঙুলের বিপরীতে যে অঙ্গুষ্ট (Opposable Thumb) তা আমাদের শক্ত করে ধরতে ও তুলতে শিখিয়েছে — এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের কথা উল্লেখ করতেই হবে। অন্যান্য প্রজাতির মস্তিষ্ক ও আচার-ধারা একই সূত্রে বাঁধা রয়েছে। আমরা দেখতে পাই, শিম্পাঞ্জি মায়েরা তাদের সন্তানদের লালন-পালন ও রক্ষা করে চলে। কারণ, প্রাকৃতিক নির্বাচন এই আচরণের পক্ষে ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আচরণগত অভ্যাস বা অভিজ্ঞতা মা শিম্পাঞ্জির মগজের নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপে (Hard Wiring) লালিত হয়েছে।
মানুষের মগজে থাকা অভ্যাস বা অভিজ্ঞতার দ্বারাই তার কর্ম নির্ধারিত হয, এই বিচারধারা অবশ্য সকলে সমর্থন করেন না। তাঁদের মতে, মানুষের চিন্তার সূত্র নিহিত রয়েছে অচেতনতার মধ্যে; মগজের বিবর্তনের নিশ্চিদ্র ঘেরাটোপে (hard wiring) যে মানুষের চিন্তার সূত্র আবদ্ধ, এমনটা তারা মেনে নিতে চান না। নিউইয়র্ক টাইমস-এর কলামিস্ট ডেভিড ব্রুকস এই বিরোধী মতের তীব্র প্রতিবাদ করে লিখছেন, “আমি মানতে রাজি নই যে মানুষের মস্তিষ্ক কম্পিউটারের মতো। এটা কী করে সম্ভব? সেই ব্যাক স্টেজ অর্থাৎ মানুষের মস্তিষ্কের পিছনের অংশ হল তার অচেতন চিন্তার ক্ষেত্র! এটা ভুল। মানুষের অসামান্য ব্যক্তিত্ব আর তার অনন্য কর্মকান্ডকে এভাবে অপ্রযুক্তিগত সারবত্তার (non technological essence) প্রকাশ ভেবে সামান্যীকরণ করা ক্লিপবোর্ড হাতে সাদা কোট পরা বিজ্ঞানীর পক্ষে সম্ভব নয়”। এখানে ব্রুকস যা বলতে চাইছেন তা অনেকেই আমরা অস্পষ্ট ভাবে অনুভব করে থাকি। মস্তিষ্ক এক বড় জটিল শারীরিক অঙ্গ যার মধ্যে এমন কিছু অনির্ধারিত বস্তু বা সত্তা রয়েছে যা আসলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং আদেশ জারি করে — একে বোঝা সাধারণ বিজ্ঞানীর পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়।
এই কারণে আমরা রেনে দেকার্তকে স্মরণে আনতে পারি। এমনকি যারা এই ফরাসি দার্শনিকের কথা শোনেননি, তাঁরাও মনে মনে বিশ্বাস করেন যে শরীর ও মন আলাদা। আমাদের কাঁধের ওপর এটা নিছক কোনও ধূসর পিন্ড নয়। এর মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যাকে নানাজন তাঁদের মনগড়া বিশেষণে বিভূষিত করেছেন; যেমন অশরীরী শক্তি বা আত্মা, এছাড়া ব্রুকসের সেই বিস্ময়কর শব্দ চয়ন — ‘অপ্রযুক্তিগত সারবত্তার প্রকাশ’! ১৯৪৯ সালে, দেকার্তের তিন শতাব্দীর পর, দার্শনিক গিলবার্ট রাইল ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘যন্ত্র মধ্যে ভূত’। তারপর থেকে প্রায় ছয় দশকে বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের শিখিয়েছে, মানুষ কীভাবে চিন্তা করে আর কেনই বা আমরা রাইলের বক্তব্যকে সমর্থন করি। আমরা জেনেছি, কোনও ভূত নেই, কোনও আত্মা নেই বা কোনও অপ্রযুক্তিগত সারবত্তার প্রকাশ নেই; যা আছে তা হল মস্তিষ্ক এবং তা পুরোপুরি শারীরিক। এটা হল প্রাকৃতিক নির্বাচনের সেই শক্তির প্রভাব যা বিপরীত অঙ্গুষ্ঠ (Opposable Thumb) আমাদের দিয়েছে, আর দিয়েছে সিকেলসেল অ্যানিমিয়া। এই বিবর্তনই আমাদের অস্তিত্ব গড়েছে — যা নিয়ে আমরা বেঁচে আছি।
তবে, আজ আমরা মস্তিষ্ককে নিন্দেমন্দ করতে আসিনি বরং বিপরীতে সোচ্চারে বলতে চাই — মানুষের মস্তিষ্ক দুর্দান্ত, অসাধারণ। আমাদের প্রজাতির সব কিছুর জন্যই একে কৃতিত্ব দিতে হবে; বেঁচে থাকা, সংখ্যা বৃদ্ধি করা থেকে শুরু করে মানুষের চাঁদে পৌঁছে যাওয়া বা মহাজাগতিক সূত্র উন্মোচন করা — সবকিছুর পেছনেই রয়েছে মস্তিষ্ক। আমাদের দৃষ্টিশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, শ্রবণশক্তি এমনকি আমাদের যাবতীয় অস্তিত্বের প্রখরতাকে ত্বরান্বিত করেছে মস্তিষ্ক। সে একাই আমাদের প্রকৃতির ব্যর্থতা (Nature’s Edsel > ব্যর্থতার প্রতীক) মেনে নিতে বাধা দিয়েছে। সে আমাদের পারগতাকে অক্ষমতার বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলেছে এবং এর ক্রমবর্ধমানতা চলতেই থেকেছে। আমাদের আদিম হোমনিড পূর্বপুরুষদের সময় থেকে আধুনিক মানুষের প্রথম আবির্ভাবের সময় পর্যন্ত তার শক্তি বৃদ্ধির পরিমাণ চতুর্গুন।
আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে মস্তিষ্কের আয়তন যথেষ্ট বেড়ে যাওয়া, কিছু সমস্যারও সৃষ্টি করল। মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি প্রসবকালে মা ও তার সন্তানের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছিল। শিম্পাঞ্জি এবং অন্যান্য প্রাইমেটদের তুলনায় মানুষের মাথা ভারী হয়ে ওঠায় তার ঘাড় ভেঙ্গে পড়ার ঝুঁকি বেড়ে গেল। তবে এই ত্রুটিগুলো যতটা গুরুতর ছিল, তার থেকে অনেক বেশি সুবিধাজনক ছিল মানুষের অন-বোর্ড- সুপারকম্পিউটার বা বুদ্ধির অসামান্য নৈপুণ্য ও গতি। এজন্যই প্রকৃতি বড় মস্তিষ্ক নির্বাচন করেছিল এবং প্রজাতিটা৷ শেষমেশ টিকে রইল।
মানুষের মস্তিষ্কের আধুনিক গঠনের রূপান্তর সম্পূর্ণরূপে পুরানো প্রস্তর যুগ যা প্রায় দুই মিলিয়ন বছর আগে থেকে প্রায় বারো হাজার বছর আগে অর্থাৎ কৃষি প্রবর্তন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। এমন নয় যে, কৃষির আবির্ভাব হঠাৎ করেই বেশিরভাগ মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। আসলে নতুন জীবনধারা ছড়িয়ে পড়তে হাজার হাজার বছর লেগেছিল। বলা যায়, মাত্র ৪৬০০ বছর আগে প্রথম যে শহর গড়ে উঠেছিল সেটা আধুনিক মান অনুসারে আজকের শহরের চেয়ে আহামরি কিছু নয়। আমাদের প্রজাতির ইতিহাস যদি তার ক্রমবিকাশের ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিটা পর্যায়ে বেঁচে থাকার হিসেব আনুপাতিকভাবে লেখা হয়, তবে ২০০ পৃষ্ঠা উৎসর্গীকৃত হবে যাযাবর শিকারী সংগ্রাহকদের জীবনের জন্য; এক পৃষ্ঠা বিবৃত হবে কৃষিভিত্তিক সমাজকে নিয়ে আর গত দুই শতাব্দীর বিশ্ব, যাকে আধুনিক বিশ্ব বলা হয়, তা মাত্র সব শেষে একটা অনুচ্ছেদে স্থান পাবে।
আজ আমরা জেনেছি, এই পৃথিবীতে আমাদের বুদ্ধির বিকাশের ধারাবাহিকতা মস্তিষ্কের আকারগত গঠনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছে। কৃষি বিকাশের সূচনা পর্বের বহু পূর্বেই তার উন্মেষ ঘটেছে। তার স্বাতন্ত্র এসেছে প্রাচীন প্রস্তর যুগে। মস্তিষ্কের গঠনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আমাদের আজকের অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে — সেই বক্তব্যের উপসংহার টেনে তাকে অনিবার্য আখ্যা দিলে, অবশ্য তা হবে কিছুটা দ্বন্দ্বমূলক। আজকের আমরা যারা কাঁচ, ইস্পাত কিংবা ফাইবার অপটিক্সের জগতে বসবাস করি, সেই আধুনিকরা কিন্তু গুহাবাসী বা গুহামানবদের থেকে ততটা আধুনিক হতে পারিনি। হ্যাঁ, পরিবর্তন এসেছে — বাইসনের চামড়ার দেহাবরণ আজ রূপান্তরিত হয়েছে কেতাদুরস্ত ব্রান্ডেড পোশাকে — অতটুকুই।
এই হল বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় অন্তর্দৃষ্টি, যে ক্ষেত্রটি শুধুমাত্র গত ৩০ বছরে প্রাধান্য পেয়েছে; যদিও ডারউইন নিজেই মানুষের চিন্তাভাবনা আর কাজের তৎপরতায় বিবর্তনের প্রভাব দেখেছিলেন। আমাদের মন, যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, ‘বিবর্তনীয় অভিযোজনগত পরিবেশ’ (‘Environment of Evolutionary Adaptation’) বলা হয়, তার সঙ্গে মানিয়ে নেবার জন্য বিবর্তিত হয়ে চলেছে। আমরা যদি আজ মনের কর্মকান্ডের হদিশ পেতে চাই আমাদের প্রথমে আফ্রিকার সাভানার প্রাচীন মানুষের জীবনচর্যাকে নিরীক্ষণ করতে হবে।
অবশ্যই সম্পূর্ণ সত্য এর চেয়ে একটু বেশি জটিল। এর অন্যতম কারণ হল, আমাদের প্রাচীনতম পূর্বপুরুষেরা এসেছিল পূর্বতন প্রজাতির থেকে, যাকে আমরা এককথায় হাত বদল (Hand-me-down) বলতে পারি। মানুষ তার অভিজ্ঞতা পেয়েছে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে এবং তার সাথে যুক্ত করেছে তাদের নবলব্ধ আঙ্গিক। তবুও, সেই আদি প্রাক্মানব গোষ্ঠীর মস্তিষ্কের অভিজ্ঞতার বেশির ভাগই আজও ফল্গুধারার মতো রয়ে গেছে। আমরা আজ নানা কৌতুকপ্রদক বা চিত্তাকর্ষক (amigdala) বা ভিন্ন কাঠামোর প্রজাতির মস্তিষ্কের কথা যদি ভাবি, যেমন সরীসৃপ জাতীয় বা সাধারণ টিকটিকির, তাদের মস্তিষ্কের মধ্যেও সেই অভিজ্ঞতার প্রাচীন রসদ গেঁথে রয়েছে।
এটা সত্য যে প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষ আফ্রিকার সোনালি সমভূমিতে মৃগজাতীয় প্রাণীর শিকার আর সিংহদের সাথে লুকোচুরি করে জীবন কাটাত। তারা ছিল পরিভ্রমণকারী, যারা এক দেশ থেকে অন্য অজানা দেশে পাড়ি দিত। তাই একমাত্রিক ‘বিবর্তনীয় অভিযোজনগত পরিবেশ’ ছিল না, ছিল বহুমাত্রিকতা। অর্থাৎ এই বিবিধতার মধ্যে থেকেই সে তার দৈত্যকার মস্তিষ্কে সবকিছু অধিগত করেছিল। এই নমনীয়তাই মানুষের সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য। সেই একই মস্তিষ্ক, তবু মানুষ শিখে নিল, কীভাবে তীরের সামনের ভাগে পাথরের ফলা আটকে দিতে হয়, কীভাবে পশুর চামড়া ব্যবহার করে শীতে নিজেকে উষ্ণ রাখতে হয় বা রাতের আঁধারে নিশ্ছিদ্র গুহার অন্দরে কীভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়।
পরিবর্তনশীল পরিবেশের নানা অভিজ্ঞতায় যত পুষ্ট হল মস্তিষ্ক, ততই তার আকার বৃদ্ধি পেল। সেটা চলতেই থাকল। আমরা শিকার করে একত্র হতাম, আর ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত থাকতাম। আমরা সঙ্গম করেছি এবং সন্তানদের বড় করে তুলেছি। এই সামগ্রিকতা আমাদের মস্তিষ্কের শুধু সঠিক রূপ দিল না, করে তুলল আরও উন্নত।
আমরা সাপের উপস্থিতিতে অস্বস্তি বোধ করি। এটা থেকে প্রমাণ হয়, প্রাচীন অভিজ্ঞতা আমাদের প্রভাবিত করে। আমাদের প্রজাতির দীর্ঘ প্রাগৈতিহাসিক অভিজ্ঞতায় সাপ ছিল এক মারাত্মক হুমকি। তাই আমরা সাপ থেকে সাবধান হতে শিখেছি। সর্বত্র এই আবহ। এমনকি আর্কটিকের মতো জায়গায় যেখানে সাপ নেই, সেখানেও সাপের আতঙ্ক রয়েছে। আমাদের প্রাইমেট তুতো ভাইয়েরাও আমাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার শরিক হয়েছে। গবেষণাগারে বেড়ে ওঠা বানর যারা কখনো সাপ দেখেনি, তারাও তা দেখে পিছু হটে।
অবশ্য সবাই যে সাপে ভয় পান এমন নয়, কিছু মানুষ বেসমেন্টে ১২ ফুট পাইথনও পুষে রাখেন। প্রিয় কুকুরকে দেখেও আমাদের কেউ কেউ ভয় পান। আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের শখ মেটাতে বেছে বেছে অন্য প্রাণীর সঙ্গে নেকড়ের প্রজননও ঘটিয়েছিলেন। মনস্তাত্ত্বিকেরা দেখেছেন, যদি কোনও প্রাণীর সঙ্গে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা থাকে তাতে আর সেটায় ভয় থাকে না, অন্যদিকে নেতিবাচক অভিজ্ঞতায় ভয় সৃষ্টি হয়। তাই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা কুকুরের প্রতি ভয় পেতে শেখায়। দুটি ভয়ের মধ্যে অবশ্য পার্থক্য রয়েছে। মনোবিজ্ঞানীরা পজিটিভ কন্ডিশনিং (রোগীর যে প্রাণীকে ভয় তার সঙ্গে একই মনোরম পরিবেশে একত্রিত করার) পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে সেই ভয় দূর করেন এবং রোগী দ্রুত সুস্থ হয়, তার ভয় কেটে যায়। কিন্তু সাপের ভয়কে মুছে ফেলা অসম্ভব। কয়েক শত সহস্র বছর আগের প্রকৃতির পাঠশালার শিক্ষাকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই।
আমাদের মগজের ঘেরাটোপে থাকা নানা সূত্রের একটি হল ‘সাদৃশ্য স্বরূপ আইন’ (‘Law of Similarity’)। উনিশ শতকের শেষ ভাগে নৃতত্ত্ববিদরা লক্ষ করেছিলেন যে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির আচারগুলির সঙ্গে কার্য-কারণ সম্পর্ক মিশে থাকে। উদাহরণ টেনে বলা যায়, আফ্রিকার মানুষের বিশ্বাস ছিল দাদ রোগ মোরগের বিষ্ঠা থেকে আসে, কারণ সেটা দেখতে দাদের মতো। শিয়ালের ফুসফুসের দুর্দান্ত শক্তি প্রত্যক্ষ করে ইউরোপীয়রা হাঁপানির ওষুধ হিসাবে শিয়ালের ফুসফুস ব্যবহার করত। আবার চিনারা বাদুড়ের প্রখর দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করে চোখের রোগের চিকিৎসায় তা ব্যবহার করত। এই সূত্র আবার নানা ক্ষেত্রে মৌলিকতা পেয়েছে; সিংহের মতো দেখতে হলে সিংহ, হাঁসের মতো চলন-ধরন দেখলে হাঁস। এই ধারণা জনপ্রিয় হলেও বুদ্ধিদীপ্ত নয়। এভাবেই ‘সাদৃশ্য স্বরূপ আইন’ সারা পৃথিবী জুড়ে জনজাতির সংস্কৃতিতে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে।
মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, শিক্ষার্থীর হাতে কুকুরের মলের মতো (fudge) আকৃতির এক টুকরো আইসক্রিম যখন দেওয়া হয়, তখন তা তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। আবার বমির মতো দেখতে মিষ্টি নিতেও তাদের অনীহা। পটাশিয়াম সায়ানাইডের স্টিকার লাগিয়ে খালি শিশিতে শিক্ষার্থীরা নিজেরা চিনি ভরলেও, পরে আবার তারাই সেটা নিতে অস্বীকার করে। মনোবিজ্ঞানী রোজিন ও ক্যারল নেমেরফ্ লিখলেন, এই গবেষণা থেকে বোঝা যায় যে, সাদৃশ্যগত সূত্রের নেতিবাচক ধারণাজনিত ভয় তাদের মনে গেঁথে গেছে, সেটা অমূলক জেনেও তারা তা থেকে বেরোতে পারছে না।
এবার অন্য সূত্র; ‘চেহারা-সদৃশ-বাস্তবতা’ (Appearance – equals – reality) নিয়ম, যা প্রায়ই জাদুকরি বিশ্বাসের মধ্যে দেখা যায়। শত্রুকে আঘাত করতে ভুডুকে (voodo > voodum — আফ্রিকার পুতুল যাকে অশরীরী আত্মার মাধ্যম বলে মনে করা হয়) যন্ত্রণা দেওয়া হয়। বিভিন্ন উপজাতিরা প্রথম ফটোগ্রাফ দেখে মনে করেছিল, এটা তাদের আত্মাকে ক্যামেরা-বন্দি করে ফেলেছে, তারা আতঙ্কিত হয়েছিল।
আমি নিশ্চিত ভাবে জানতাম, আমার হারিয়ে যাওয়া মানি ব্যাগে থাকা ছবি আমার বাচ্চাদের ফটোগ্রাফই ছিল, সেটা কখনোই আমার সন্তান নয়। সাধারণ বুদ্ধি এতেই সায় দেয়। তবুও তা খুঁজতে আমি দীর্ঘক্ষণ বস্তির চারপাশে হোঁচট খেয়ে ফিরেছি। কারণ, আমার ভেতরের আদিম গুহা মানব তা বুঝতে পারেনি। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সে আর তার পূর্বপুরুষেরা চেহারা-সদৃশ-বাস্তবতা নিয়ম অনুসরণ করে গেছে। সে জানত, সিংহের মতো দেখতে কিছু হলে তা সিংহ, দৌড়োও, নতুবা দুপুরে তাদের আহার হয়ে ওঠো! প্রতিটা মানুষের মগজের ঘেরাটোপে সেটা আজও রয়ে গেছে।
আধুনিক মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে তা অযৌক্তিক হলেও প্যালিওলিথিক মানুষের কাছে সেটা নির্ভরযোগ্য ছিল। সে সন্তানের ফটোগ্রাফকে নিজের সন্তান ভাবতে সামান্যতম দ্বিধা করত না। আজ প্রায় ১৮০ বছর আগে ফটোগ্রাফির উদ্ভাবনে সেই দৃষ্টিভঙ্গির বদল হয়েছে। পাঠক আপনি উপসংহার টানলে নিশ্চিত বুঝবেন, মগজের প্রাচীন ঘেরাটোপে থাকা এই ত্রুটি শুধু অন্যদের গ্রাস করে না, আপনাকেও তার শিকার বানাতে পারে।
এটা ঠিক না ভুল, সেটা বুঝতে আমাদের পূর্ব আলোচিত দুটি পদ্ধতির সূত্রে ফিরে যেতে হবে।
প্রথম পদ্ধতি — বহু প্রাচীন, নিজ ধারণা প্রসূত, বেগবান ও আবেগপ্রবণ। দ্বিতীয় পদ্ধতি — বিবেচক ধীর-স্থির ও যুক্তিনিষ্ঠ। আমি এই দুটি পদ্ধতিকে Gut (অন্ত্র > অন্তর, অনুভূতি, আত্মা, হৃদয়, দেহ, শরীর) এবং Head (মস্তিষ্ক, মাথা, মগজ, বুদ্ধি) বলব। এই দুটো বিষয় নিয়েই এখন আমরা আলোচনা করব।
প্রথম পদ্ধতি বা অন্তর হল অচেতন চিন্তা আর এর সংজ্ঞায়িত গুণ হল গতি। যখন আমি বলি, ‘আমি অন্তরের সাড়া পাচ্ছি’, তখন আমি সে কথাটার প্রকৃত অর্থ ব্যাখ্যা করতে পারি না এবং এখানে ধারণাটাও অস্পষ্ট। কিন্তু কথাটা অসম্ভব বেগবান। সেজন্যই যখন ঘাস নড়ে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে দামামা বাজতে শুরু করে, পেটটা খামচে ওঠে আর চকিতে চোখটা বন্ধ হয়ে যায়, তখন বিশ্বকোষীয় পরামর্শের কথা মনেই আসেনা। (তবে মনে রাখবেন এটা রূপক মাত্র। কবিরা বলতে পারেন, হৃদয় বা অন্তর থেকে এলেও মস্তিষ্কের সকল চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।)
দ্বিতীয় পদ্ধতি বা মস্তিষ্ক হল সচেতন চিন্তা আর এর সংজ্ঞায়িত গুণ হল যুক্তি। যখন আপনার বন্ধু আপনাকে বলেন, ‘তোমার মাথা কাজে লাগাও’, তখন বোঝা যায়, আমার ভাবনা সত্য নয়, আমাকে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে হবে। সঠিক ফলাফলের জন্য মস্তিষ্কই হল সেরা বাজি, তবুও এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মস্তিষ্ককে শিক্ষিত করতে হয়। আমরা এখন যে জটিল তথ্যের জগতে বাস করি সেখানে যদি কেউ গণিত, পরিসংখ্যান এবং যুক্তিবিদ্যার মূল বিষয়গুলি বুঝতে বা জানতে অপারগ হয়, যদি পাঁচ শতাংশ এবং দশমিক পাঁচ শতাংশের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পারে, কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে ভুল হওয়া হবে খুবই স্বাভাবিক। আর, মাথা ধীরে ধীরে কাজ করে। আপনি সকালে চায়ের টেবিলে সংবাদপত্র পড়ার সময় এটা সমস্যা নাও হতে পারে, তবে আপনি যখন বাদাড়ের লম্বা ঘাসের আড়ালে কোনও কিছু নড়াচড়া করতে দেখেন তখন অবশ্যই একটা বিভ্রান্তি আসে — তখন তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়।
ব্লেইস প্যাস্কেল তিন শতাব্দীরও বেশি আগে লিখেছিলেন, “হৃদয়ের কারণ আছে, কিন্তু কী সেই কারণ তা সে জানে না”। তাই এটা অচেতন ও সচেতন মনের টানাপোড়েন। মস্তিষ্ক অন্তরের দিকে তাকাতে পারেনা, তাই তার ধারণা নেই কীভাবে অন্তর তার বিচারকে একত্রিত করে — যার কারণে মনোবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, একটা গাড়ির বিপণনকারীরা নতুন পণ্যের গুনাগুন নিয়ে ক্রেতাদের মতামত নিতে যখন সভা (Focus Group) ডাকেন, সেখানে দেখা যায়, সম্ভাব্য ক্রেতাদের অন্তর্দৃষ্টি আর মতামতে ফারাক অনেক বেশি। বিপণনকারীরা তাদের বাণিজ্যিক ব্যাপার স্যাপার বুঝিয়ে ক্রেতাদের অনুভবের কথা জানতে চাইলে উত্তর পান, ‘আমি এটা নিয়ে ভাবিনি’, অন্যজন ব্যঙ্গ করে বলে ওঠেন, ‘ফাইন’ বা ‘ইস্, সামনের স্টাইলটা কুৎসিত’। অথচ এটা তো ঠিক, বিক্রেতা কখনোই তার পণ্যের ডিজাইন বা যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি এমন কিছু করবে না, যা বিপণন করতে অসুবিধা হয়। বিপণনকারী যুক্তি (Head) দিয়ে সবকিছু বোঝালেও তার মাথায় আসছে না কেন ক্রেতার অন্তর (Gut) বলছে, গাড়িটা পছন্দের নয়। শেষমেশ দুটি মতামতের ব্যাখ্যা দিতে গেলে বলতে হবে, উভয়ই যুক্তিসঙ্গত এবং সম্ভবত ভুল।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কার্যত দুটি মন একে অপরের থেকে আংশিক স্বাধীনভাবে সদা সর্বদা কাজ করে চলেছে। আমাদের চিন্তাকে জটিল করে তুলছে একদিকে গেঁথে থাকা ধ্যান ধারণা আর অন্যদিকে যুক্তির টানাপোড়েন, অর্থাৎ অচেতন ও সচেতন মনের সংঘাত। একটা উদাহরণে আসা যাক — বুদ্ধি দিয়ে শেখা আর ব্যবহার করা জ্ঞান কীরকম বিপত্তি ঘটায় — প্রত্যেক প্রবীণ গল্ফার এটা খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করবেন। একজন নবীন গল্ফার ক্রীড়া ব্যাকরণের প্রতিটা নির্দেশ মেনে চলতে চান। তবু তারা ‘টি’-এ রাখা প্রথম শটটা মারতে বা সুইং করাতে ব্যর্থ হন, অবশ্য বারবারের অনুশীলনে সবকিছুই সহজ হয়ে ওঠে। আসলে, একবার মনের মধ্যে কোনও কিছু গেঁথে গেলে তখন আর নির্দেশাবলীর দিকে মাথা ঘামাবার, অর্থাৎ সচেতন চিন্তার প্রয়োজন নেই; বরং সেটা করলেই খেলোয়াড়টি মানসিক দিক থেকে বাধাগ্রস্ত হবে। সেজন্য পেশাদার ক্রীড়াবিদদের স্পোর্টস সাইকোলজিস্টদের পরামর্শ হল, আগে যা হাজারবার করেছ, তা নিয়ে আর নতুন করে চিন্তা কোরো না।
এমনকি অনেক সময় দেখা যায় মস্তিষ্ক তার বুদ্ধিমত্তা দ্বারা অন্তরের অনুভবের জায়গা দখল করে নেয়। নব্য চিকিৎসকেরা যখন একটা সাধারণ রোগের মুখোমুখি হন তখন তাঁরা সচেতন ভাবে এবং সতর্কতার সঙ্গে রোগ নির্ণয়ের আগে সব কিছু রিপোর্ট ঠিকঠাক দেখে থাকেন। অথচ প্রবীণ প্রাজ্ঞ চিকিৎসকেরা তাৎক্ষণিকভাবে রোগের নিদান দিয়ে দেন। শিল্প-ইতিহাসবিদ যাদের কাজ পুরাকীর্তি প্রমাণিকরণ তাঁরাও একইভাবে কাজ করে থাকেন। ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ব্লিংক’-এ দেখা যায়, একটি গ্রিক মূর্তিকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষকের দল ঠিক বলে শংসায়িত করলেও শিল্প-ইতিহাসবিদদের খালি চোখে সেটি ভুয়ো প্রতিপন্ন হয়। এটাকে শিল্প-ইতিহাসবিদদের ‘স্বজ্ঞাত বিকর্ষণ’ (Intutive Repulsion) বা ‘নিজ অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি’ বলা যেতে পারে। অবশ্য পরে পরীক্ষা করে জানা গেল যে, মূর্তিটা আস্ত এক জালিয়াতি ছিল। এখানে শিল্প ইতিহাসবিদরা তাৎক্ষণিকভাবে যা অনুভব করেছিলেন তা তাঁদের জ্ঞান, দক্ষতা ও অন্তরের অচেতন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে ছিল।
Heuristics and Biases হল সেই অস্বচ্ছতার নাম যা মনের গোপন চিন্তাগুলোকে উত্তেজনায় উত্তক্ত করে, প্রকাশ করে দেবার ফলে পক্ষপাতের সম্ভাবনা তৈরি করে। এই পক্ষপাতকে আমরা দোষী বলে অভিযুক্ত করব না, এটা একটা প্রবণতা, এর বেশি কিছু নয়। আপনি যদি একটা কেনাকাটার ফর্দে কোনও একটা বস্তুর নাম ব্যতিক্রমী কালিতে লিখে নেন, দেখবেন, সেটা আপনার মনে উজ্জ্বল থাকবে। স্বাভাবিকভাবে মনে রাখার পক্ষে এটা পক্ষপাত। মনোবিজ্ঞানীদের কাছে থাকা দীর্ঘ তালিকায় আরও অজস্র উদাহরণ রয়েছে, যাতে ভন রেস্টর্ফ-এর প্রভাব বা অস্বাভাবিককে মনে রাখার পক্ষপাত বলা হয়।
Heuristics-এর ক্ষেত্রে এগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের চলতি নিয়ম (Thumb Law)। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি সিংহ বা বিড়ালের মতো দেখতে হলে আমাদের ভাবনায় সেটা হয়ে ওঠে সিংহ বা বিড়াল। এটা সহজে ও তাৎক্ষণিকভাবে আপনাকে সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়। এরকম দ্রুত চিন্তাভাবনা আপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে! তবে দুর্ভাগ্যবশত, এই নিয়মের বলেই সেদিন সেই মানি ব্যাগের ভেতরে থাকা ফটোগ্রাফটাকে একটা কাগজের টুকরোর থেকে আরও বেশি কিছু মনে করেছিলাম; আর তার সুবাদেই মধ্যরাতের পরে আফ্রিকার বস্তির চারপাশে হোঁচট খেয়েছিলাম। এটা এমন এক ধারণা যা আপনাকে হত্যাও করতে পারে! তাই এরকম মনের ভাবনা অনেক সময় ভাল হলেও, নিখুঁত নয়।
সৌভাগ্যক্রমে, সিদ্ধান্ত সর্বদা অন্তরের ভাবনার অনুগামী হয় না, মস্তিষ্ককেও তার নজরে আনে। অন্তরের সিদ্ধান্ত ভুল হলে মস্তিষ্ক কমপক্ষে তা সামঞ্জস্য বা বাতিল করার প্রয়াস করে। অন্তর সিদ্ধান্ত নেয়, মস্তিষ্ক পর্যালোচনা করে — এই প্রক্রিয়ায় কীভাবে বেশিরভাগ চিন্তাভাবনা সিদ্ধান্তে পরিনতি পায়, সে সম্পর্কে হাভার্ডের মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গিলবার্ট লিখেছেন, “মনোবিজ্ঞানের মৌলিক অন্তর্দৃষ্টির মধ্যে একটা সাধারণ সিদ্ধান্ত হল মানুষের অচেতন অন্তর দ্রুততায় তথা অনুমান ও স্বল্প প্রমাণের ভিত্তিতে যা প্রকাশ করে তা সে ধারাবাহিকভাবে চেতনার (মস্তিস্কের) কাছে পৌঁছে দেয় এবং সে ধীরে ধীরে ও স্বেচ্ছায় সমন্বয় সাধন করে”।
ড্যানিয়েল কাহনেম্যান এপ্রসঙ্গে একটা সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরেছেন। একটা প্রশস্ত সমভূমিতে দাঁড়িয়ে দূরে পাহাড়ের দিকে তাকালে আপনি পাহাড়টা কত দূরে তার একটা স্বজ্ঞাত ধারণা পেতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই অন্তর্দৃষ্টি কোথা থেকে আসে বা কার উপর ভিত্তি করে আপনি তা জানতে পারেন। আপনি শুধু এটুকুই বলতে পারবেন যে এ বিষয়ে আপনার ধারণা ছিলই এবং সেই ধারণাই আপনাকে উত্তরটা জানিয়েছে। যতক্ষণ না আপনার কাছে অন্য কোনও তথ্য এসে পৌঁছচ্ছে যা দিয়ে বুঝবেন যে আপনার ধারণা বিভ্রান্তিকর নয়, আপনি সেটাকেই বাস্তবতার সঠিক পরিমাপ হিসাবে গ্রহণ করবেন।
আপনার সঠিক জানা নেই, তবু অন্তরের অচেতন ধ্যান-ধারণা থেকে অনুমান আপনাকে পথ দেখিয়েছে। এক্ষেত্রে একটা সাধারণ নিয়ম হল, বস্তুগুলি যত দূরে থাকে তত ঝাপসা দেখায়। এই নিয়মটি তাৎক্ষণিকভাবে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে থাকে। যদি তা না হত, প্রাকৃতিক নির্বাচন আমাদের মস্তিষ্কে তা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করত না। তবু এটাও ভুল হতে পারে; বিশেষ করে গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় — যখন বাতাস ধোঁয়াটে হবে এবং পরিষ্কার দিনের চেয়ে ঝাপসা লাগবে। দূরত্বের সঠিক অনুমান পেতে আমাদের এটার জন্য সামঞ্জস্য প্রয়োজন। কিন্তু অন্তর একা সামঞ্জস্য করে না, সে ক্ষেত্রে ত্রুটি থেকে যাবে। তাই মস্তিষ্কের প্রবেশ প্রয়োজন এবং এই অবস্থায় অনুমানের পরিবর্তন প্রয়োজন হবে। কিন্তু সেটাও কি সঠিক হবে? দুর্ভাগ্যবশত, সেটা না হবার সম্ভাবনাই বেশি।
নীচের প্রশ্নটা নিয়ে বিবেচনা করুন। একটা ব্যাট ও একটা বলের দাম ১.১০ ডলার। বলের চেয়ে ব্যাটের দাম এক ডলার বেশি। বলটার দাম কত?
এই প্রশ্নটা পড়া মাত্রই প্রায় প্রত্যেকের ১০ সেন্ট উত্তর দেবার তাৎক্ষণিক আবেগ থাকবে। এটা দেখলে সঠিক মনে হয়, কিন্তু তবুও এটা ভুল। যদি আপনি সাবধানে চিন্তা করেন, তবুও এই পরীক্ষায় হোঁচট খাওয়া খুবই স্বাভাবিক। মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কাহনেম্যান এবং শেন ফ্রেডরিক লিখেছেন, “আমরা প্রায় যাদেরকেই প্রশ্ন করছি তাদের ১০ সেন্ট উত্তর দেবার প্রাথমিক প্রবণতা দেখা গেছে — অনেক মানুষই তাৎক্ষণিক প্রবৃত্তির কাছে হার মেনেছে। এই সহজ সমস্যাটা আশ্চর্যজনকভাবে স্পষ্ট করে দেয় যে কীভাবে হালকা চালে মস্তিষ্ক (Head) অন্তরের (Gut) দেওয়া ফলাফল নিরীক্ষণ করে। আসলে মানুষ কঠোরভাবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত নয়, ফলে প্রায়শই তারা মনোমত বিধানকে বিশ্বাস করে সন্তুষ্ট থাকে, যা দ্রুত তাদের মনে আসে”।
মস্তিষ্ক আশ্চর্যজনকভাবে শিথিল হতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা বারবার দেখিয়েছেন যখন মানুষকে তাদের নিজস্ব সুস্থতার অনুভূতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন আবহাওয়া একটা বড় পার্থক্য এনে দেয়। রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া মনের সুস্থতার অনুভূতিকে প্রাণোচ্ছল করে, যখন বৃষ্টি নামে তখন মনের উদ্দীপনা ম্লান হয়ে যায়। অর্থাৎ অন্তর (Gut) এখানে কথা বলে। সবাই জানি আবহাওয়া মেজাজকে প্রভাবিত করে তবে স্বাভাবিক আবহাওয়াতেও প্রায়শই মেজাজের তারতম্য ঘটে। শারীরিক সুস্থতার প্রশ্নে আরও অনেক কিছু বক্তব্য সামনে নিয়ে আসে। মস্তিষ্ককে (Head) এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী অন্তরের (Gut) সিদ্ধান্তে সামঞ্জস্য বিধান করা আশু প্রয়োজন। তা সত্ত্বেও, এটা প্রায়ই সম্ভব হয় না। অসংখ্য গবেষণায় পাওয়া গেছে যে স্টক মার্কেটে লাভ বা ক্ষতির সঙ্গে আবহাওয়া দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। এটা ভাবতে বেশ মজা লাগে যে, ওয়াল স্ট্রিট স্টক ব্রোকারদের আর্থিক হিসেবের উপর সূর্যের আলোর কী নিদারুণ প্রভাব! তবুও এটা স্পষ্ট ভাবে অনুভব করা যায়। মগজের দীপ্তি অশেষ, তবে সে অলস কিশোরের মতো, যদি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় তবে দুর্দান্ত কাজ করতে পারে।
মনোবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, যখন মানুষ তাড়াহুড়ো করে তখন অন্তরের কার্যকলাপে মাথার পর্যবেক্ষণ শিথিল হয়ে যায় এবং আরও ভুল হতে থাকে। দিনের প্রাণীরা সন্ধ্যায় ঝিমিয়ে পড়ে আর রাতের প্রাণীরা প্রত্যুষে নিশ্চুপ হয়ে যায়। বিক্ষিপ্ততা আর ক্লান্তি মনের কর্মোদ্যমকে ম্লান করে, মানসিক ভারগ্রস্ত হলে একই অবস্থার প্রকাশ ঘটে। একটি বা তিনটি বিয়ার পান করার পরে কী ঘটতে পারে তা সহজেই বোঝা যায়! এখন আপনি যদি মধ্যরাতের পরে আফ্রিকার বস্তির মধ্যে কোনও উদ্বেগজনক জায়গায় থাকেন, সারাদিনের কাজের ক্লান্তি চেপে বসে, আর কয়েক পাঁইট গিনেস পান করার ফলে আচ্ছন্ন হন এবং আপনার মানি ব্যাগে রাখা ছবি চুরির কারণে বিরক্তি আসে, সে ক্ষেত্রে ভালো মাথা তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবে না।
মস্তিষ্ক আর অন্তরের মধ্যে পারস্পরিক যে এক্কা-দোক্কা খেলা সে সম্পর্কে ড্যানিয়েল কাহনেম্যান তাঁর প্রবন্ধের সারমর্ম টেনে লিখলেন, “তারা উভয়ই নিজস্ব প্রকাশ্য অভিব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিযোগিতা করতে থাকে”। কেউ হয়তো বলবেন, স্পর্শে নির্ভুলতার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম, আবার অন্যজন বলবেন, দৃষ্টিগ্রাহ্যতায় সাফল্যের হার বেশি। আসলে আমরা প্রত্যেকেই এক নির্জন পথে গাড়ি রেস করছি এবং প্রতিটা গাড়ির মধ্যে আমাদের সেই পুরাকালীন গুহামানব ঢুকে গাড়িটা চালাতে চাইছে। অথচ গাড়ির মধ্যে থাকা উজ্জ্বল কিন্তু অলস কিশোর, যে ভালভাবেই জানে যে স্টিয়ারিং-এর চাকায় তার হাতটাই রাখা উচিত; কিন্তু গাড়ি চালানোটা আজ আর তার পছন্দের নয়, বরং তার অনেক ভালো লাগা হল, আইপডে গান শুনতে শুনতে জানলার বাইরের দৃশ্য উপভোগ করা।
নাইজেরিয়ায় সেই রাতে গুহামানবটাই গাড়ি চালিয়েছিল, আর সেই কিশোর তখন পিছনের সিটে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি ভাগ্যবান, আমি আজ বেঁচে আছি।
(ড্যান গার্ডনারের ‘Of Two Minds’ প্রবন্ধের অনুবাদ।)