মনোরোগের বর্তমান চিত্র

শর্মিষ্ঠা মিত্র 

‘মনোরোগ’ শব্দটির মধ্যে আরও দুটি শব্দের অস্তিত্ব বর্তমান, এক হচ্ছে মন এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে রোগ। রোগের অর্থ হল অসুস্থতা তা আমরা সবাই জানি, কিন্তু ‘মন’ এই শব্দটির অর্থ আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মানুষদের কাছে কি খুব স্পষ্ট? হয়তো অনেকেই বলবেন, হ্যাঁ, কিন্তু কিছু মানুষের কাছে এখনও এই মন জিনিসটা স্পষ্ট নয়। তাই তারা সকলের সামনে বলতে পারেন যে ‘আমার আজ জ্বর হয়েছে’ বা ‘আমার সুগার লেভেল বেড়েছে তাই আমার শরীরটা ভালো না’, কিন্তু নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে শুধু তারা বলতে পারেন যে ‘আজ আমার মনটা খুবই খারাপ’ বা ‘আমার না আর আসতে ইচ্ছে করছে না’। এর কারণ একটাই যে হয়তো মানুষের মধ্যে এখনও ধারণা আছে ‘মন’ আর ‘শরীর’ আলাদা। কিন্তু মানুষ এটা ভুলে যান যে যখন আমাদের খুব জ্বর হয় তখন আমাদের প্রিয় খাবারগুলোও আমাদের খেতে ইচ্ছে করে না, আবার কোনও ছাত্রী যদি তার পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত না-হতে পারে তাহলে পরীক্ষার আগের দিন রাতে তার ঘুম আসতে চায় না। অর্থাৎ আমাদের মন আর শরীর এক সূত্রে গাথা মালার মতো পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে গভীর সম্পর্কে যুক্ত।

এবার আসা যাক মনোরোগ মনের অসুখ আসলে কী? শরীরের অসুখ হল শরীর-স্বাস্থ্য যখন কোনও বিশেষ কারণে তার কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যক্তির যে-কোনও কারণবশত মন দুর্বল হতে থাকে, নিজের সম্পর্কে তার নেতিবাচক ভাবনা তৈরি হতে থাকে, নিজের কর্মশক্তি বা চিন্তা ভাবনার উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় সে, অর্থাৎ ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব পড়ে; উপরোক্ত কারণগুলির জন্য কোনও ব্যক্তির যখন ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবন ব্যাহত হয় তখনই তাকে আমরা বলে থাকি মনোরোগ। 

লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে মনোরোগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগগুলি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং আমেরিকার সাইক্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন গবেষণার মাধ্যমে করে থাকে। ১৯৫২ সালে আমেরিকান সাইক্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা মনের রোগ ও তার লক্ষণগুলিকে নিয়ে প্রথম সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ প্রকাশ পায় যা আমাদের কাছে Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorder (DSM) নামে পরিচিত। এই গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী প্রায় বেশিরভাগ মনোরোগ বিশেষজ্ঞই ব্যবহার করে থাকেন। এবং গবেষণার দ্বারা এই ম্যানুয়ালটির নিয়মিতভাবে সংস্করণ প্রকাশ পায়।

শিশু থেকে বয়স্ক সবার যেমন শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে, ঠিক তেমনি মানসিক অসুস্থতা বা মনোরোগও একটি সাধারণ ঘটনার মধ্যে পড়ে, হয়তো শারীরিক অসুস্থতার বহিঃপ্রকাশ আলাদা কিন্তু শরীর থাকলে বয়সভেদে শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থতা দুই-ই স্বাভাবিক। DSM-এর বর্তমান সংস্করণ অনুযায়ী শিশুদের মধ্যে কিছু ডিসঅর্ডার দেখা যায়, তার মধ্যে একটি প্রধান ভাগ হল নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার। এক্ষেত্রে বিকাশের প্রাথমিক কালে, সাধারণত বিদ্যালয়ে প্রবেশের আগেই শিশুদের বৌদ্ধিক, সামাজিক এছাড়া আরও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিকাশের ঘাটতি উল্লেখযোগ্য ভাবে লক্ষ করা যায়। যার ফলস্বরূপ পরবর্তীকালে এই শিশুর মধ্যে শিক্ষাগত, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত কার্যকলাপগুলি একই বয়সী অন্যান্য শিশুদের তুলনায় ব্যাহত হতে থাকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায় শিশুটির মধ্যে বৌদ্ধিক কার্যকারিতা অর্থাৎ কোনও সাধারণ সমস্যার সমাধান করা, যুক্তির সাথে কথা বলা, কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হওয়া ইত্যাদির সাথে এক বা একাধিক দৈনন্দিন জীবনের কর্মসূচি পালনে অসমর্থতা দেখা যেতে পারে; যেমন — ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় না- রাখা, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে না-পারা, স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে না-পারা ইত্যাদি। বাড়ি এবং পরবর্তীকালে স্কুলের মধ্যেও এ দেখা যেতে পারে। এই লক্ষণগুলি দেখা যায় Intellectual Development Disorder-এর ক্ষেত্রে, যেটি নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাগ। এই disorder-টির তীব্রতা নির্ণয় করা হয় Intellectual Quotient (IQ) বা বুদ্ধাঙ্ক পরিমাপের দ্বারা। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এখনও পর্যন্ত এরকম কোনও ওষুধ তৈরি হয়নি যা বুদ্ধাঙ্ক বা IQ-এর বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। Intellectual disability-র প্রধান কারণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — শিশুদের উপর রুবেলা, এনসেফ্যালাইটিস, মেনিনজাইটিস নামক রোগের তীব্র সংক্রমণ হওয়া, বা জন্মের পূর্ববর্তী সময় অথবা জন্ম মুহূর্তে শারীরিক আঘাত, ক্ষত বা মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি, ক্রোমোজোমগত অস্বাভাবিকতা ইত্যাদি। এই সকল কারণগুলিকে প্রতিরোধ করা যেতে পারে, যাতে শিশুর প্রতিবন্ধকতাগুলি মারাত্মক আকার ধারণ না-করতে পারে। সেগুলি হতে পারে genetic counselling-এর দ্বারা এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ বা শিক্ষার দ্বারা প্রতিবন্ধকতাগুলিকে হ্রাস করার চেষ্টা করা, বা সেই ব্যক্তির অক্ষমতাজনিত অসুবিধাগুলিকে মোকাবিলা করার জন্য নতুন পন্থার সাথে তার পরিচিতি গড়ে তোলা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় শিশুরা তার বয়স অনুযায়ী ভাষার ব্যবহার করতে সমর্থ হয় না, তাদের বক্তব্যের মধ্যে সাবলীলতার অভাব স্পষ্ট দেখা যায়, তাদের শব্দভান্ডারের পরিমাণও সীমিত থাকে, বা বাক্য গঠনে অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকে। আবার অনেক সময় শব্দভান্ডার, সাবলীল ভাবে বাক্য গঠন ইত্যাদি সব সাধারণ শিশুদের মতো থাকলেও, কোনও সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে Verbal এবং Nonverbal Communication করতে শিশুরা প্রচণ্ড পরিমাণে অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকে, তাকে আমরা বলে থাকি Communication Disorder। এছাড়া শিশুদের মধ্যে Autism Spectrum Disorder নামক মনোরোগ দেখা যায়, যেখানে শিশুদের Social Communication এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার ঘাটতির সাথে, আবেগ শূন্যতাও পরিলক্ষিত হয়, আবার কখনও কখনও কোনও নির্দিষ্ট কিছুর উপর অস্বাভাবিক রকমের তীব্র প্রতিক্রিয়া করতে থাকে; তারা সমবয়সী শিশুদের সাথে খেলাধুলা করতে বেশি ভালোবাসে না। উপরন্তু তারা নিজেরা stereotyped বা পুনরাবৃত্তিমূলক খেলা, অস্বাভাবিক রূপে কোনও বস্তুর ব্যবহার এবং একই কথা বা আচরণ উদ্দেশ্যহীনভাবে বারবার করতে দেখা যায়। এই সকল বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে শিশুরা তার সমবয়সী অন্যান্য শিশুদের তুলনায় সামাজিক, কার্যকরী বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় পিছিয়ে পড়ে। তীব্রতা অনুসারে Autism Spectrum Disorder তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যেখানে শুধুমাত্র তীব্র লক্ষণ সম্পন্ন শিশুরাই সম্পূর্ণরূপে বাহ্যিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। এই Autism Spectrum Disorder হল মূলত বংশগত ব্যাধি। প্রাথমিক স্কুল স্তরের শিশুদের মধ্যে অনেক সময় দেখা যায় যে তারা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম, স্কুলের পড়াশোনা, বা একটি সময় কোনও একটি খেলার প্রতি বা ক্লাস চলার সময় বেশিক্ষণ ধরে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না, তার সমবয়সী অন্যান্য শিশুদের তুলনায় সহজেই অমনোযোগী হয়ে পড়ে, সাধারণ সব তথ্য সহজেই ভুলে যায় এবং এর সাথে দেখা যায় শিশুরা প্রচণ্ড চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ — স্কুলের মধ্যে ক্লাস চলাকালীন নিজের জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না, সারা ক্লাস ঘুরে বেড়ায়, যে কোনও পরিস্থিতিতে তার অস্থিরতা স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়, প্রায়শই তাদের অসুবিধা হয় যখন কোনও কাজে তাদের নিজেদের পালা না-আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে অন্যান্য লোকেদের কথা শেষ হওয়ার আগেই অধৈর্য হয়ে তারা নিজেদের বক্তব্য শুরু করে দেয়। এই মনোরোগটি Attention Deficit Hyperactive Disorder (ADHD)  নামে পরিচিত। ADHD মূলত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বছরগুলিতে শনাক্ত করা বেশি সহজ হয়, কারণ বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি কর্মসূচি সে ক্লাসে পড়াশোনা করা হোক বা খেলার ক্লাসে খেলাধুলা করা— প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ধৈর্য ও মনোযোগের প্রয়োজন হয়, যেগুলি ADHD শিশুদের আচার-আচরণের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। সাধারণত ADHD মেয়ে শিশুদের তুলনায় ছেলে শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। ADHD-র মূল কারণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জিনগত এবং পরিবেশগত কারণ। এছাড়াও স্কুল জীবনে আরও একটি উল্লেখযোগ্য অসঙ্গতি দেখা যায় সেটি হল — Specific Learning Disorder, যেখানে শিশুর কোনও কিছু শিখতে বা জ্ঞানঅর্জন করতে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন, কোনও শব্দকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করে পড়তে অসুবিধা, কোনও গদ্যাংশকে সাবলীলভাবে পড়ার অক্ষমতা, বা কোনও পড়া বোঝার ক্ষেত্রে তার সমবয়সী অন্যান্য শিশুদের তুলনায় দক্ষতার অভাব, শব্দের বানানে বারবার একই ভুল করা, লিখিত অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব, সঠিকভাবে ব্যাকরণ প্রয়োগের অভাব, বা গণিত বোঝার এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে অক্ষমতা ইত্যাদি। এক্ষেত্রেও মূলত বংশগত অথবা পরিবেশগত উপাদানগুলির প্রভাব বেশি থাকে। উপরিউক্ত সব disorder গুলি প্রধানত Neurodevelopmental Disorder-এর মধ্যে পড়ে। এছাড়া শিশুদের মধ্যে Oppositional Defiant Disorder দেখা যায়, যেখানে শিশু পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্যের, (তার ভাই বা বোন বাদে) যারা মূলত তার অভিভাবক বা অভিভাবকস্থানীয় স্থানীয় হয়ে থাকে, তাদের উপর প্রচণ্ড রাগ পোষণ করে, প্রায় প্রত্যেক বিষয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে তর্ক করে থাকে, বয়স্করা কোনও কিছু অনুরোধ করলেও সে কাজটি করে না, অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের রাগাতে ভালোবাসে, এবং নিজের দোষের জন্য সব সময় অপরকে দায়ী করে। এইরকম অবস্থা যদি ছয় মাস বা তার বেশিদিন ধরে চলে তখন আমরা তাকে Oppositional Defiant Disorder বলে থাকি। এর জন্য জিনগত কারণের সাথে আমাদের গুরুমস্তিষ্কেরও কিছু অস্বাভাবিক আচরণ দায়ী, এবং পরিবেশগত উপাদানও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এছাড়া আরও একটি মনোরোগ আছে যেখানে শিশুরা সামাজিক নিয়মগুলিকে লঙ্ঘন করে আনন্দ পেয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ — প্রায়ই অন্যান্যদের সাথে নিষ্ঠুর ভাবে মারামারি করে, (ছুরি, ভাঙা কাচের বোতল, ইট ইত্যাদির দ্বারা) যার ফলে অন্যের কোনও মারাত্মক ক্ষতি যেন হয়ে যায়, অবলা জীবজন্তুদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে, জিনিসপত্র চুরি করে, কোথাও ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগিয়ে দেয় ইত্যাদি। এই সকল কার্যকলাপগুলির মধ্যে কিছু যদি ১৩ বছর বয়সের আগে শিশুটি করে থাকে ন্যূনতম ১২ মাস ধরে তাহলে তাকে আমরা Conduct Disorder বলে থাকি। এই সকল আচরণগুলির দ্বারা শিশুর সামাজিক, শিক্ষাগত এবং অন্যান্য কার্যক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এক্ষেত্রে শিশুর মধ্যে সহানুভূতির অভাব, অনুশোচনা বা অপরাধবোধের অভাব অধিক পরিমাণে লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে জিনগত এবং পরিবেশগত উপাদান প্রত্যক্ষভাবে দায়ী থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সকল disorder-এ শিশুদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সাইক্রিয়াটিস্টরা ওষুধের প্রয়োগ করেন। এর সাথে ছোটো শিশুদের ক্ষেত্রে প্রধানত Play Therapy এবং Behavioural Therapy ইত্যাদি চিকিৎসা পদ্ধতি থেরাপিস্টরা ব্যবহার করে থাকেন। অভিভাবকদেরও কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুসারে কাউন্সেলিং করা হয়। আর একটু বড়ো বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এগুলি ছাড়া Cognitive Behavioural Therapy (CBT) প্রয়োগ করা হয়। 

অনেক সময় দেখা যায়, কিছু কিছু ব্যক্তি দাবি করেন তারা এমন কিছু অতিরিক্ত জিনিস দেখছেন, শুনছেন বা অনুভব করছেন যাদের অস্তিত্ব বাস্তবে কোনও মানুষদের কাছে থাকে না, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যক্তির মধ্যে দৃঢ় ভ্রান্ত বিশ্বাস, যেমন — কোনও ব্যক্তি নিজেকে কোনও দৈবশক্তির অবতার হিসেবে বিশ্বাস করে, নিজের পরিবারের লোকেদের উপর সন্দেহ করা এবং এই বিশ্বাস রাখা যে পরিবার সহ বিশ্বের সমস্ত ব্যক্তিরা তাকে খুন করে দিতে চায় ইত্যাদি, এছাড়াও কথার মধ্যে মারাত্মক অসঙ্গতি ইত্যাদি — এই সকল লক্ষণ কৈশোর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক এমনকি প্রবীণদের মধ্যেও দেখা যায়। এই লক্ষণগুলি মূলত Schizophrenia Spectrum Disorder-এর মধ্যে অবস্থিত সমস্ত disorder-তে দেখা যায়। এছাড়াও ব্যক্তির মধ্যে পারিপার্শ্বিক জ্ঞানের অভাব, অস্বাভাবিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন, আবেগ শূন্যতা, অনুপ্রেরণার অভাব, কথোপকথনের পরিমাণ হ্রাস পাওয়া এবং সমাজের সাথে সংহতিসাধনের পরিমাণ হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি প্রকট হয়। বংশগত কারণ ছাড়াও এই ধরনের মনোরোগগুলির জন্য মস্তিষ্কের ventricles-এর অস্বাভাবিক আকৃতি এবং শরীরের মধ্যে বিভিন্ন জৈবরাসায়নিক উপাদানের পরিবর্তনশীলতা দায়ী। বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী শিশুর সাথে মূলত তার মা বা মাতৃস্থানীয় ব্যক্তির বিভ্রান্তিকর সম্পর্ক, আক্রান্ত ব্যক্তির চিন্তাভাবনার মধ্যে অসংগতি, দৈনন্দিন জীবনের অতিরিক্ত চাপ ইত্যাদিকেও কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই সকল মনোরোগের ক্ষেত্রে antipsychotic জাতীয় ওষুধের সঙ্গে psychological therapy খুবই সহায়ক হয় রোগ নিরাময়ের জন্য। এছাড়া একবিংশ শতকে প্রায় বেশিরভাগ ব্যক্তি ‘Depression’ শব্দটির সাথে খুবই পরিচিত। কিন্তু ‘ওই আমার মোবাইল ফোন হারিয়ে গেছে তাই আমি ডিপ্রেশনে আছি’ বা ‘আমার বন্ধু আজ আমাকে ছাড়া কফি খেতে চলে গেছে তাই আমি ডিপ্রেশনে আছি’ বা ‘পরের সপ্তাহে আমার পরীক্ষা আমার পড়া হয়নি আমি ফেসবুকে স্টেটাস দিচ্ছি যে আমি ডিপ্রেশনে আছি’ — এইগুলি মন খারাপের কারণ হতে পারে, কিন্তু এগুলি depression পর্যায়ে পৌঁছেছে কিনা তা কোনও পরীক্ষা ছাড়া সুনিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়।Depression হল জীবনের এমন দুঃখজনক অবস্থা যেখানে ব্যক্তির নিজের জীবনের সমস্ত চ্যালেঞ্জগুলিকে অপ্রতিরোধ্য মনে করে, এক্ষেত্রে ব্যক্তির চিন্তন প্রক্রিয়াগুলি এতটাই ত্রুটিপূর্ণ হয় যে ব্যক্তি নিজের ভবিষ্যৎ আশাহীন রূপে, নিজেকে অসহায় রূপে, এবং নিজের সমস্ত পারদর্শিতাগুলিকে মূল্যহীন রূপে প্রত্যক্ষ করে। এর ফলে ব্যক্তি দিনের বেশিরভাগ সময় বিষণ্ন মেজাজে থাকে, কোনও কিছুতেই আনন্দ খুঁজতে বা কোনও বিষয়ের প্রতি আগ্রহ তাৎপর্যপূর্ণরূপে কমে যায়। উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যক্তির খাওয়ার পরিমাণ এবং ওজনও কমে যায়, নিদ্রাহীনতা দেখা যেতে পারে, সারাদিনই ব্যক্তি ক্লান্তি অনুভব করতে পারে, ব্যক্তি অকারণে প্রচণ্ড পরিমাণে অপরাধবোধে ভোগে, এমনকি ব্যক্তি আত্মহত্যার পরিকল্পনা বা আত্মহত্যার চেষ্টাও করে থাকে। এই সকল লক্ষণগুলি যদি দু-সপ্তাহ ধরে দেখা যায়, তাহলে আমরা তাকে Major Depressive Disorder বলি। এক্ষেত্রে সময় নষ্ট না-করে অবশ্যই কোনও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা উচিত। এখানে একটি কথা একটু বলার দরকার Depression এবং Sadness-এর মধ্যে পার্থক্য অনেকটাই। Depression হল একটি ক্লিনিকাল ডিসঅর্ডার, যেখানে ব্যক্তির কষ্টের পরিমাণ অনেকটাই তীব্র যা তার মধ্যে উপরিউক্ত উপসর্গগুলিকে তীব্রভাবে ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু, Sadness হল স্বল্পস্থায়ী নেতিবাচক আবেগ, এটি মূলত হয় ব্যক্তির যখন আসন্ন বা বাস্তবে ঘটে যাওয়া বিপদের পরিপ্রেক্ষিতে মন খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু এই সব উপসর্গের তীব্রতা depression-এর থেকে অনেককম হয় এবং স্বল্পস্থায়ী হয়ে থাকে। অপরদিকে Anxiety হল ভবিষ্যৎ বিপদের প্রত্যাশা করে নেতিবাচক আবেগের উৎপত্তি, যেখানে ভবিষ্যৎ বিপদের ধারণাগুলি সম্পূর্ণরূপে অবাস্তব হয়, এবং এই অতিরিক্ত নেতিবাচক আবেগের কারণে ব্যক্তির কার্যক্ষেত্রে, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের উপরও খারাপ প্রভাব পড়ে। এই ধরনের অসুখকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় Anxiety Disorder। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ডিসঅর্ডার হল Separation Anxiety Disorder, যেখানে ব্যক্তি এবং বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে প্রচণ্ড পরিমাণে distress দেখা যায়। এর মূল কারণ তাদের মধ্যে থাকে তাদের প্রিয় মানুষ, প্রিয় জায়গা ইত্যাদির থেকে বিচ্ছেদ হওয়ার ভাবনা বা বিচ্ছেদ হওয়া। এছাড়া Obsessive Compulsive Disorder (OCD)- এর ক্ষেত্রে ব্যক্তির মস্তিষ্কে জোর করে ক্রমাগত বিভিন্ন ধরনের আসতে থাকা চিন্তা গলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সে বারবার কিছু আচরণ বা মানসিক ক্রিয়া করে যেগুলি যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ এবং যার ফলে ব্যক্তির ব্যক্তিগত, কর্মক্ষেত্রে এবং সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়া বর্তমান প্রজন্মের ইঁদুর দৌড়ের যুগে প্রাপ্তবয়স্করা বিভিন্ন ধরনের আসক্তি বা নেশার শিকার হয়ে থাকে। যার মধ্যে দশটি পৃথক শ্রেণির দ্রব্য বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য, যেমন— অ্যালকোহল, ক্যাফিন, গাঁজা, কোকেন, তামাক, মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার, জুয়া খেলা ইত্যাদি। এই সমস্ত ডিসঅর্ডার-এর ক্ষেত্রে ব্যক্তির অসুস্থতার প্রকৃতি হিসেবে Medication-এর সাথে Counselling, Cognitive Behavioural Therapy, Mindful Based Cognitive Therapy, Rational Emotive Behavioural Therapy, Person Centred Therapy, Music Therapy, Art Therapy, Family Therapy সহ আরও বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই প্রবীণ বয়সেও মানসিক সমস্যা নতুন করে শুরু হতে পারে, পূর্ববর্তী কোনও কেসহিস্ট্রি ছাড়াই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — কোনও ব্যক্তি যখন তার চাকরি জীবন থেকে অবসর নেন তখন সে তার কর্মজীবনের জীবনশৈলীগুলির অভাব বোধ করে এবং অনেক সময় তারা নিজেদের অথর্ব ভাবতে থাকেন, শারীরিকভাবে তাঁরা আগের মতো আর সক্ষম থাকে না এবং শারীরিক অসুস্থতার জন্য যেহেতু তাদের অনেক ওষুধের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়, নিজেদেরকে অনেক সময় পরিবারের উপর বোঝা মনে করতে থাকেন, বা অনেক সময় দেখা যায় যদি তাঁরা সন্তানের সঙ্গে একসাথে থাকেন না। কোনও কারণে সন্তানদের বা পরিবারের সাথে সম্পর্ক শিথিল হতে থাকলে সেই সব সময় তাঁরা প্রচণ্ড একাকিত্বে ভোগেন এবং অবসাদ তাঁদের গ্রাস করে; এইরকম ক্ষেত্রে জীবনে বাঁচার ইচ্ছেটুকুই চলে যায়, নির্জীব বস্তুর ন্যায় জীবন অতিবাহিত করতে দেখা যায়। এমনকি প্রবীণদের আত্মহত্যার মতো ঘটনা আমরা প্রায় শুনে থাকি। এছাড়াও বার্ধক্যে ব্যক্তিদের মধ্যে Anxiety-র পরিমাণও অনেক সময় বাড়তে থাকে, এর মূল কয়েকটি কারণ হল — জীবন সম্পর্কে অনিশ্চয়তা, সমবয়সী আত্মীয় পরিজন বা বন্ধু-বান্ধবদেরকে হারানো ইত্যাদি। অনেক সময় Anxiety Disorder-ও Obsessive Compulsive Disorder-এর মতো মনোযোগের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া Alzheimer’s বা স্মৃতিভ্রংশতা, নিদ্রাহীনতা, অতিরিক্ত রাগ বা বিরক্তি ইত্যাদিও দেখা যায় প্রবীণদের মধ্যে। এই বয়সের ব্যক্তিদের সাথে ছোটো শিশুদের যেন অনেক মিল পাওয়া যায়। ছোটো শিশুরা যেমন কোনও বিষয় জেদ বা বিরক্তি প্রকাশ করে থাকে বিভিন্নভাবে, বার্ধক্যেও একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহবাতিকতা সহ বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্তবিশ্বাস, Delirium (আশেপাশে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যসাধনে অসুবিধা সহ সংঘটিত পদ্ধতিতে পরিকল্পনার ব্যর্থতাও দেখা যায়।) এবং স্নায়ুতন্ত্রের নার্ভগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে শরীরের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা এবং চলাফেরার মধ্যে মন্থরতা দেখা যায়। এ-সময় Medication-এর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের থেরাপি এবং সর্বোপরি পরিবারের সহায়তা ব্যক্তির সুস্থতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তি যখন শারীরিক অসুখের সঙ্গে মানসিক অসুস্থতাকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিতে শিখবে, তখন হয়তো প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন যাপন সুন্দর ও সহজ হয়ে উঠবে। সমাজের কোনও ব্যক্তিকে যদি কোনও কারণবশত ভেঙে পড়তে দেখা যায় বা কোনও শিশু যদি মানসিক রোগের শিকার হয়, তাদেরকে অবহেলা বা করুণার চোখে না-দেখে তাদের দিকে যদি একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে সেই সমানুভূতি, স্নেহের পরশ পাশের মানুষদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে পারবে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান