তটিনী দত্ত
সেই কোন প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন নেশার দ্রব্যের প্রতি মানুষের নির্ভরতার কথা ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায়। অতীতের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ ব্যথা বেদনা কমানোর জন্য এবং চেতনার আচ্ছন্নতা ঘটানোর, এমনকি স্ফূর্তি পাওয়ার জন্য বিকল্প ভেষজের সন্ধান করেছে। পাশাপাশি মানুষ কিছু কিছু নেশা জাতীয় পদার্থ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল— সেগুলো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যাবলিকে প্রভাবিত করে, শারীরিক ও মানসিক যাতনা লাঘবে সক্ষম হয় ও মনে ফুর্তি বা উল্লাসের ভাব সৃষ্টি করে। এসব দ্রব্য গ্রহণের পরিণতি শেষ পর্যন্ত মারাত্মক হলেও প্রাথমিকভাবে এগুলো আনন্দদায়ক অনুভূতি সৃষ্টি করে। এই প্রাথমিক আনন্দের অনুভূতিগুলো বারবার পাওয়ার জন্য মানুষ এই দ্রব্যগুলোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে এবং এগুলির অপব্যবহার করে।
নেশা হল এমন কিছু দ্রব্যের (Substance) উপর নির্ভরশীলতা, যেগুলি নিলে একজন ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয় এবং ঐ নেশার দ্রব্যটি না-পেলে তীব্র শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়। প্রাচীনকাল থেকে যে সমস্ত নেশা চলে আসছে, যেমন— মদ, গাঁজা বা আফিম, তার সাথে যুক্ত হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরে নতুন নতুন আরও কিছু নেশা, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের আসক্তি। পৃথিবীতে আজও মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ অ্যালকোহল। তা সত্ত্বেও আজকের মধ্যবিত্ত সমাজে অ্যালকোহল হয়ে উঠেছে ফ্যাশন ও স্মার্টনেসের প্রতীক। দ্রুত বেড়ে চলেছে অকেশনাল ড্রিঙ্কারের সংখ্যা। পৃথিবীর সকল নেশাগ্রস্ত মানুষই কোনও একসময় ছিল অকেশনাল ড্রিঙ্কার। সেখান থেকে অ্যাডিক্ট হয়ে ওঠার রাস্তাটা খুব সহজ।
কোন ধরনের মানুষ সচরাচর মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে? যারা খুব ইম্পালসিভ বা অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ হয়, কোনও ব্যাপারেই ধৈর্য ধরতে পারে না, সহ্যক্ষমতা অত্যন্ত কম এবং ব্যর্থতাকে মানতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষেরাই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি না-পেলে এরা সহজেই ভেঙে পড়ে, হতাশ হয় এবং সেই হতাশা ভোলার জন্য মাদক ব্যবহার করে। অন্যান্য নেশার তুলনায় অ্যালকোহল গুণগত ভাবে একেবারেই আলাদা। শারীরিক ক্ষতি ছাড়াও মানুষের মনটিকেও নষ্ট করে দেয় অ্যালকোহল। অ্যালকোহল নেওয়ার ফলে গুরু বা উচ্চমস্তিষ্কের কাজ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়ে। ফলে গুরু মস্তিষ্কের যে গুণ — সূক্ষ্ম অনুভূতি, ভাবনা-চিন্তা করার ক্ষমতা, সুকুমার বৃত্তি ইত্যাদি সবই সাময়িক ভাবে ঝিমিয়ে পড়ে। পাশাপাশি লঘু মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে ওঠে। যা নিয়ন্ত্রণহীন আবেগের জন্ম দেয়। সংবেদনশীলতা ভোঁতা হয়ে যায় আর বাঁধনছাড়া উল্লাসে ক্রমশ মেতে ওঠে মানুষ। অ্যালকোহল আসক্তি এভাবেই মানুষটির ক্রমশ ক্ষতি করে চলে।
সমাজ বিরোধী বা Psychopath-দের আচরণের সঙ্গে মাদকের অপব্যবহারের সম্পর্ক রয়েছে। শৈশবে যাদের ADHD (Attention deficit hyperactivity) বা আচরণগত সমস্যা (Conduct Disorder) থাকে, ভবিষ্যতে তারা ধূমপান ও গাঁজা সেবনে আক্রান্ত হয় বেশি। নেশা নিজেই একটি মানসিক সমস্যা। তাই নেশায় আক্রান্তদের ব্যক্তিত্বে বহু আগে থেকেই কিছু অসংগতি লক্ষ করা যায়। যেমন —
• ধৈর্য ও সহ্য ক্ষমতা কম।
• অন্যের সাথে মানিয়ে না-চলতে পারা।
• নীতিবোধ বা আদর্শের ব্যাপারে উদাসীন।
• সিদ্ধান্ত নিতে অপারগতা।
• এরা নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য কখনোই নয়।
• নিজের খারাপ অনুভূতিগুলো স্বীকার করতে না চাওয়া।
• আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বোধ কম।
• ঘন ঘন আবেগের পরিবর্তন ঘটা।
• অমনোযোগিতা।
• সমবয়েসিদের তুলনায় বেশি জেদি।
• কোনও গভীর বা সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে না-পারা।
নেশা করার ফলে মস্তিষ্কের রাসায়নিক অবস্থায় কিছু পরিবর্তন হয়, যার ফলস্বরূপ একজন ব্যক্তির আচার আচরণ, চিন্তাভাবনায় আমুল পরিবর্তন দেখা যায়। অর্থাৎ ব্যক্তি মানুষটির সম্পূর্ণ বদল ঘটে। ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যও বিঘ্নিত হয়।
যে-কোনও নেশার ক্ষেত্রেই নেশার বস্তুটি ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিক আনন্দ দেয়, রিলিফ বা মুক্তি দেয়। এই মুক্তি বা রিলিফ কীসের থেকে? নিজস্ব কিছু দ্বন্দ্ব, দায়িত্ববোধ, সংবেদনশীলতার চাপ ইত্যাদি থেকে। যেগুলির মোকাবিলা নিজস্ব মেধা ও ক্ষমতা দিয়েই করা যেত। কিন্তু মোকাবিলা করতে গেলে চারিত্রিক দৃঢ়তা লাগে আর পাশাপাশি থাকে ব্যর্থতার ভয়। তাই মোকাবিলা করার বদলে নেশার দ্রব্যগুলি নিয়ে সাময়িক ভাবে দ্বন্দ্ব, দায়িত্ববোধ ইত্যাদি মানবিক সূক্ষ্ম বোধগুলিকে অবশ করে রাখাই শ্রেয় বলে মনে করে নেশাসক্ত মানুষেরা। বিবেককে অবশ করে রাখতে পারলে নিজের কোনও কাজের জন্যই অপরাধবোধ হয় না, তাই জবাবও দিতে হয় না। এই মুক্তি বা রিলিফ বড্ড লোভনীয় দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষের কাছে। যারা দ্বন্দ্ব, দায়িত্ব কিংবা অপরাধবোধ কোনও কিছুই বহন করতে পারে না, সামান্য না-পাওয়া বা আশাভঙ্গও তাদের কাছে অসহনীয় বলে মনে হয়। তাই কখনও অ্যালকোহল নিয়ে, কখনো গাঁজা বা হেরোইন নিয়ে সাময়িক রিলিফ খোঁজার চেষ্টা। এই সাময়িক চেষ্টাটাই যেন নিজের অজান্তে সারাজীবনের আসক্তি হয়ে দাঁড়ায়। ফলাফল মানুষের মস্তিষ্কের অবনমন হয়ে পশুর মস্তিষ্কের স্তরে এসে দাঁড়ানো। তাই আশেপাশে যত অপরাধ মূলক কাজ ঘটে, যেমন খুন বা ধর্ষণ ইত্যাদি, দেখা যায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই অপরাধী নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিল। অ্যালকোহল শুধু শরীরের নয়, চারিত্রিক ক্ষতিও করে ভয়াবহ ভাবে।
আরেকটি ভয়ংকর নেশা হল হেরোইন। মরফিন (আফিম) থেকে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি এই দ্রব্যটি যে-কোনও নেশার বস্তু থেকে বহুগুণ বেশি শক্তিশালী। দুটি প্রাকৃতিক রাসায়নিক এনডরফিন ও এনকেফালিন, যা আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত নির্গত হয় এবং আমাদের জীবনে তৈরি হওয়া নানা শারীরিক ও মানসিক অস্বস্তি ও যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি দিতে সাহায্য করে। হিরোইন ও মরফিন স্নায়ুতন্ত্রে এনডরফিন ও এনকেফালিনের পথ ধরেই বহুগুণ বেশি আনন্দ, উৎফুল্লতা ও স্বস্তি দেয়। হেরোইনজাত এই মাত্রাতিরিক্ত আনন্দ, উৎফুল্লতা ও আরাম নেশাগ্রস্তদের কাছে লোভনীয় হয়ে পড়ে। প্রতিদিন পেতে চাওয়া এই উৎফুল্লতার কাছে হার মানে মন ও শরীর। ফলে গড়ে ওঠে হেরোইন আসক্তি। নেশাগ্রস্তদের স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে ঘটে যায় এক স্থায়ী পরিবর্তন। যা অনেকসময় ব্যক্তিত্বের মধ্যেও নিয়ে আসে এক স্থায়ী অবনতি। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত হেরোইন এসেছে একবিংশ শতাব্দীতে আফগানিস্তান থেকে। মায়ানমারে যে আফিম ও হেরোইন তৈরি হয়, তাকে ঘোড়া ও গাধার পিঠে করে পৌঁছে দেওয়া হয় থাইল্যান্ড ও বার্মার রিফাইনারিতে। সেখান থেকে ব্যাংকক ঘুরে Drug Trafficker-রা তা পৌঁছে দেয় মার্কিন মুলুক ও উন্নত দেশগুলিতে। হেরোইনের সহজলভ্যতাকে ধ্বংস করতে না-পারলে মানুষের রোজকার জীবনের যন্ত্রনা ও অস্বস্তি একে খুঁজে নেবেই।
যে-কোনও নেশাই হোক না কেন, মাদকদ্রব্য বা চুরির নেশা কিংবা যৌনতা বা অপরাধমূলক কাজের নেশা — তা মিটলে মস্তিষ্কে একটা আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে, যা Reward অঞ্চলকে উদ্দীপিত করে। তাই আজ থেকে প্রায় তিন, সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ওপিয়ম বা মরফিন ছিল চিকিৎসার একটি বড়ো অস্ত্র। চিনে ক্যানাবিস বা ভাং ছিল উল্লেখযোগ্য চিকিৎসা মাধ্যম। মাদকের নেশা তাই একাধিক কারণের ফলাফল, যেমন— মাদকের সহজলভ্যতা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, সংস্কৃতি, সমগোত্রীয়দের চাপ, ব্যক্তিত্বের ধরন, ব্যক্তিগত স্নায়ুবৈশিষ্ট্য ইত্যাদি।
মানুষকে সম্পূর্ণ নেশামুক্ত করা কখনোই সম্ভব নয়। মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা, অস্বস্তি, সমস্যা যেমন চিরকালীন তেমন তা থেকে সহজে নিষ্কৃতি পাওয়ার ইচ্ছে বা তাগিদও চিরকালীন। নেশার দ্রব্যগুলি যেমন সহজে নিষ্কৃতির পথ দেখিয়ে দেয়, তেমনি নিজের ভেতরের মানুষটাকে হত্যা করার আয়োজনটাও সম্পূর্ণ করে তোলে। আমাদের চেষ্টা যেন থাকে নিজের ভেতরের ক্ষমতাগুলি দিয়ে আত্মমর্যাদার সঙ্গে দৃঢ়ভাবে নিজেদের যন্ত্রণাগুলির সঙ্গে লড়ার। সেই ক্ষমতা এনে দেয় সৃষ্টিশীল কাজ। তাই দরকার শৈশব থেকে বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে যুক্ত রাখা। একজন লেখক বা কবি, অথবা শিল্পী নিজস্ব যন্ত্রণা ভুলতে যখন তুলে নেয় কলম কিংবা তুলি — সৃষ্টি হয় অসামান্য সব লেখা বা ছবি, যন্ত্রণা ভুলতে দরকার হয় না পৃথিবীর কোনও নেশার বস্তুর। জানি — ‘মদ খেয়ে তো মাতাল হত সবাই, কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল।’