বাসুদেব মুখোপাধ্যায়
O, beware, my lord, of jealousy!
It is the green-eyed monster, which doth mock
The meat it feeds on.
— Othello, Shakespeare.
বিগত ০৭.১২.২০২২ নাগাদ জার্মানির ভূতপূর্ব চ্যান্সেলার অ্যাঞ্জলি মার্কেল, ‘জি জিয়েট’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দেন। এই সাক্ষাৎকারে তিনি একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে বেলারুশ-এর রাজধানী মিনস্ক-এ ফ্রান্স, জার্মানি, ইউক্রেন ও রাশিয়া এই চারটি দেশের মধ্যে রুশ-ইউক্রেন আন্তঃসম্পর্কে দুটি চুক্তি হয়। এই দুটি চুক্তির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল, রুশরা যাতে ঐ সময় ইউক্রেন না আক্রমণ করে, তাহলে ইউক্রেন রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য অনেক সময় পাবে। দেখা যাবে ঐ চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ইউক্রেনে বসবাস করে এমন রুশ মানুষজন অধ্যুষিত দনবস অঞ্চলকে স্বয়ংশাসিত অঞ্চল হিসাবে মেনে নেওয়া হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে পরবর্তীকালে প্রধানত আমেরিকা ও ব্রিটেনের প্ররোচনায় ইউক্রেন এই চুক্তি নাকচ করে দেয়, যদিও রুশরা এই চুক্তিকে মেনে নিয়ে আশা করেছিল ইউক্রেন দনবস অঞ্চলকে স্বয়ংশাসিত ভূখণ্ড হিসাবে মেনে নেবে। মার্কেল মন্তব্য করেন, এইভাবে রুশদের ঠকানো হয়, ধোঁকা দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর ফ্রান্সের ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি হালান্ডে, মার্কেলের এই মতকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন। গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে রুশরা ইউক্রেন আক্রমণ করেছে এইভাবে রুশদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর, বিষাক্ত প্রচার চালিয়ে যাওয়া হয়; কিন্তু মার্কেল-হালান্ডের এই মত প্রকাশিত হওয়ার একদিনের মধ্যে মার্কেলের সাক্ষাৎকারের এই সংবাদটি উধাও হয়ে যায় কারণ এই সংবাদ ইউক্রেন ও পাশ্চাত্যের বিপক্ষে প্রচার হবে, পাশ্চাত্য গণমাধ্যমে এমনই ধরে নেওয়া হয়।
এই পাশ্চাত্য গণমাধ্যম হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইওরোপের জনগোষ্ঠীর সর্বস্তরের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগরক্ষাকারী সজীব মাধ্যম এবং ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বিংশ শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালীন একে প্রতিরোধের পর্বে এই গণমাধ্যম অভূতপূর্বরূপে বিকশিত হয়েছিল এবং এক বিশেষ, ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। ক্রমশ আজ এগুলি বিভিন্ন শক্তিশালী, মজবুত, যথেষ্ট প্রভাববিস্তারকারী প্রতিষ্ঠানের চেহারা নিয়েছে। কালক্রমে এরা এমনই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে, তাদের সুসংগঠিত পরিচালনায় ক্রমাগত চোখ-ধাঁধানো নেতিবাচক প্রচার চালিয়ে কোনও রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকারকে, প্রতিনিধিদের অনায়াসে জনরোষের মুখে নাস্তানাবুদ করে হটিয়ে দিতে পারে। যেমন আমেরিকার সপক্ষে সৌদি আরবের রাজাদের সংবাদপত্র আল রুবা লিবিয়ার জেনারেল গদ্দাফির বিরুদ্ধে প্রচার করে তাঁকে হত্যা (২০১১) ও সেই দেশটিকে তছনছ করে দিতে সমর্থ হয়েছিল। এইভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এরা স্বনামে বা বেনামে নিজেদের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। অসংখ্য ব্যক্তি সচেতন বা অসচেতনভাবে এই গণমাধ্যমের জন্য কাজ করে থাকেন এবং ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’-এর প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেন।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো হওয়ার ব্যাপারে এই গণমাধ্যমের ক্রমাগত, ভয়ঙ্কর, বিষাক্ত, বিরুদ্ধপ্রচার অন্যতম কারণ ছিল। এর আধুনিককালের যাবতীয় বৃদ্ধি-বিকাশ ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’-এর সময় থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে, ‘কমিউনিজম’কে বিরুদ্ধতা করার মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে এই গণমাধ্যম আজকের দিনের এই বিশেষ চেহারা নিয়েছে এবং অনুন্নত দেশগুলিতে পুঁজি ও সামরিক ব্যবস্থার বিস্তারের সঙ্গে ‘পাশ্চাত্যের ভাবধারা’র আধিপত্য বিস্তার বা দখল নেওয়ার জন্য বিষক্রিয়া ঘটিয়ে চলেছে। আক্ষেপ করে বলতে হয়, প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কাল থেকে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যের খবর আদান-প্রদান এবং ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখার জন্য পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের বিশেষত পশ্চিম ইওরোপের অর্থাৎ ব্রিটেন-আমেরিকা, ইওরোপের রাজনীতির উচ্চকোটি বিত্তবান, শিক্ষিত, উন্নত, কালচারড মানুষজনরা আজকের এই গণমাধ্যম তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ করেছে (১৬৪১), বিশেষত ছাপাখানার আবিষ্কারের পর। আর পরবর্তীকালে আমরা প্রধানত ঔপনিবেশিক দক্ষিণ গোলার্ধের ‘নেটিভ’রা তাদের এই গণমাধ্যম নির্দ্বিধায় গলাধঃকরণ করে এসেছি, এর পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছি এবং সর্বক্ষণ এই গণমাধ্যমকে গ্লুকোজ বা অক্সিজেনের মতো ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও ভুল নেই যে এই গণমাধ্যম ধনতান্ত্রিক সভ্যতার পৃষ্ঠপোষকদের শ্রেণীস্বার্থে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, ক্রমশ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রয়োগে তা ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়েছে, ক্ষমতাশালী হয়েছে এবং তাদের প্রয়োজনে তারা বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত উপাদান ক্রমাগত প্রচার করে আমাদের মনকে বিষিয়ে চলেছে, দেশ-সমাজকে ধ্বংস করে চলেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের পর্যায়ে দেখা যায় প্রচারের প্রয়োজনে শুধুমাত্র ব্রিটেনে প্রায় এক কোটি সংবাদপত্রর সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিশ্বজনীন, এমনই প্রচার করা হয় এবং এই অর্থে বলা হয় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কোনও পৃথক দেশ বা সমাজে খণ্ড, ক্ষুদ্র করে রাখা নেই, এর আবিষ্কারের সুফল সকলে সমানভাবে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু কেউ যদি প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জেডি বার্নালের জগদ্বিখ্যাত বই ‘Social Functions of Science’ পড়েন তাহলে তিনি জানতে পারবেন বিষয়টি এই পরিমাণ সহজ-সরল নয়। কারণ একমাত্র রাষ্ট্র বা সমাজের উচ্চকোটিরা বিজ্ঞানের ঐ বিশেষ সুফল বা সুবিধা সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সমস্ত জটিল, দুর্বোধ্য নিরন্তর চর্চার বিষয়গুলি হাতের কাছে পেতে হলে, একে জ্ঞান ও চর্চার মধ্যে নিরন্তর প্রয়োগ করতে হলে সমস্ত দিক থেকে বিশেষ অধিকারভোগী (privileged) হতে হয়। গরিবমানুষজনদের জন্য রাষ্ট্র-এর স্বার্থে এই বিশেষ অধিকার ভোগ করার সুযোগ করে দেয়, প্রচুর অর্থের বিনিময়ে এই ধরনের কিছু বিজ্ঞান-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। অথবা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যূনতম বিজ্ঞান-শিক্ষার পরিকাঠামো দিয়ে সুযোগ করে দেওয়া হয়। যদিও পাশ্চাত্যের শিক্ষা-দীক্ষা ও এদেশে তাদের অনুগত তল্পিবাহকরা এমন প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালনা করে থাকেন এবং অন্য কোনও মত বা পথকে এখানে সাধারণত প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় না। বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠানগুলিতেও ধর্মযাজকের মতো কিছু কায়েমী স্বার্থান্বেষী মানুষ জাঁকিয়ে বসে রাজত্ব করেন।
যাই হোক, সোভিয়েতের সঙ্গে ঠাণ্ডাযুদ্ধ চলাকালীন প্রধানত রেডিওর মারফত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের দেশে ও ইওরোপে তথাকথিত কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘ভয়েস অব আমেরিকা’, ‘রেডিও ফ্রি ইওরোপ’ ইত্যাদি সংস্থার উদ্ভব ঘটে। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, পূর্ব ইওরোপের দেশগুলিতে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে প্রচার অব্যাহত রাখা। এরপর এই সংস্থাগুলি উপগ্রহের ব্যবহার আবিষ্কারের পর সোশ্যাল মিডিয়া এবং টেলিভিশনের সুবিধা নেয়, যাতে তারা এর মাধ্যমে অনর্গল নিজেদের ভাবাদর্শের প্রচার করতে পারে, পূর্বদিকের দেশগুলির সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে। এসব এমনই শক্তিশালী ছিল যে সেই সময় থেকে সব শিক্ষিত মানুষজন মেনে নিতে শুরু করে কমিউনিস্টরা হল সমস্ত দিক থেকে এই পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্ট ধরনের ক্ষতিকারক মানুষ এবং কমিউনিস্টদের যাবতীয় প্রচার হল মিথ্যা প্রোপাগান্ডা এবং এর বিপরীতে পাশ্চাত্যই একমাত্র খাঁটি সংবাদ ও তথ্য সরবরাহ করে চলেছে। এর জন্য অত্যাধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া ছাড়াও এই ‘মিডিয়া হাউস’-এর মালিকরা বেছে বেছে সমাজের প্রভাববিস্তারকারী, ক্ষমতাশালী, গুণী মানুষজনদের প্রচুর অর্থ দিয়ে নিয়োজিত করে থাকে। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে পাশ্চাত্যের বিশেষত আমেরিকার ভাবাদর্শ-প্রচার সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় থেকেই গণমাধ্যমের মালিকানা বিভাজিত হতে শুরু করে। কিছু সংখ্যক গণমাধ্যম সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে, কিছু সংখ্যক গণমাধ্যমের প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত মালিকানায় যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয় এবং বাকি গণমাধ্যমগুলি সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালিত হয়।
অবশ্য সমস্ত সামাজিক ঘটনা ও উপাদানের কিছু ইতিবাচক দিক থাকে এবং এই গণমাধ্যমের প্রচারের কারণে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, এই গ্রহের দূর দূর অংশের প্রান্তীয়, পিছিয়ে পড়া মানুষজন শিক্ষিত ও সমাজ-সচেতন হয়ে উঠতে থাকে। যুদ্ধ-সংক্রান্ত যাবতীয় প্রচারের একটা বড় অংশ মিথ্যা প্রচার হলেও দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং নানা ধরনের বড় বড় সামাজিক ঘটনার অভিঘাত পৃথিবীব্যাপি ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এই গণমাধ্যমগুলি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই বিষয়ে কিছু উদাহরণ দেওয়ার পূর্বে আমাদের বলতেই হবে সমাজ-মনস্তত্ত্বে এই গণমাধ্যম কেমন করে কাজ করে চলে। কারণ আমাদের জানতেই হবে কেন গণমাধ্যম এই পরিমাণ শক্তিশালী। কেন আমরা বিষয়টি নিয়ে এই পরিমাণ চিন্তিত। তবে সামাজিক দ্বান্দ্বিকতার ইতিবাচক দিক এটাই যে বুর্জোয়ারা যেমন তাদের শ্রেণীস্বার্থে গণমাধ্যম তৈরি করে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দ্বারা এর উন্নতি সাধন করে, একে ব্যবহার করে নিজেদের মুনাফার স্বার্থসিদ্ধি করে এবং এর ফলে সার্বিকভাবে মানবজাতির সমস্ত সমাজের যে পরিমাণ লাভ হয়, সেই পরিমাণ ক্ষতি হয়। আবার আমরা অর্থাৎ যারা পৃথিবীব্যাপি একটা সর্বসমতাবাদী (egalitarian) সমাজ-সভ্যতা গড়ে তুলতে চাই তারা এই সুযোগে এই গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে গরিব, নিপীড়িত মানুষজনের কাছে আমাদের বার্তা পৌঁছে দিতে পারি, তাদের সচেতন করতে পারি। অন্য মানুষজনদের শিক্ষিত করে তুলতে পারি। মার্কিনদের এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে আসা কিছু চমৎকার মানুষজনকেও আমরা এই সুযোগে পেয়ে যাই যার জ্বলন্ত উদাহরণ ইদানীংকালে দীর্ঘদিন ব্রিটেনের কারাগারে বন্দী অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিক জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ প্রমুখ।
কারণ আমরা যারা পৃথিবীর সকল মানুষের শুভ কামনা করি তাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল, দার্শনিক অরিস্ততলের ভাষায় ‘Actualisation of innate endowments’ অর্থাৎ আমাদের সকলের সমস্ত অন্তর্জাত ক্ষমতার বাস্তবায়ন ঘটানো। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? যেখানে এখনও পৃথিবীর ২৭০ কোটি মানুষ প্রতিদিন রাত্রে পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়! তাদের অন্তর্জাত ক্ষমতার বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, তারা পশুর মতো জীবনযাপন করে, মানুষের মতো বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপাদানও এই পৃথিবী-সমাজ তাদের দেয় না। তাই পৃথিবীব্যাপি সর্বসমতাবাদী সমাজ গড়ে তুলতে হলে আমাদের সকলকে একযোগে ঐ স্বার্থান্বেষী মানুষদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, যাতে প্রতিটি মানুষের অন্তর্জাত ক্ষমতার বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি। এর জন্য জানতে হবে কেন আমরা আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের হাতের পুতুল তৈরি হই এবং কেন তারা যেভাবে আমাদের নাচায় পৃথিবীতে তেমনই পুতুল নাচের ইতিকথা তৈরি হয়। আমাদের শ্রেণীস্বার্থ কেন তাদের মুনাফা ও নিয়ন্ত্রণের স্বার্থর সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়।
খুব সংক্ষেপে বললে, আমরা স্বীকার করতে বাধ্য যে পাশ্চাত্যের বুর্জোয়া কালচার বা শিক্ষা-দীক্ষা ব্যতীত আমাদের নিজস্ব কোনও শিক্ষা-দীক্ষা বা কালচার নেই। আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষা বলতে পাশ্চাত্যের শিক্ষা-দীক্ষা কালচারকেই বোঝায়। মনে রাখতে হবে, আধুনিককালে বাংলার বড় মাপের মানুষজনদের অধিকাংশই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর এম.এ অর্থাৎ খারাপ অর্থে সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা ও কালচারের তল্পিবাহক। যদি তাঁরা জীবনাদর্শে অন্য কিছু করে থাকেন তাহলে নিজের ও বাইরের সমাজ-পরিবেশের সঙ্গে তাঁদের যথেষ্ট লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু অস্বীকার করা যায় না তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও কালচারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে পাশ্চাত্যের শিক্ষা। ভালো ইংরেজী জানার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় তাঁদের উপলব্ধির জগৎ, সমগ্র পৃথিবী অনায়াসে তাঁদের হাতের মুঠোয় চলে আসে। এই সঙ্গে তাঁরা সমস্ত দিক থেকে সুবিধাভোগী শ্রেণীতে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা বা গুণ অর্জন করে থাকেন। অনেক দ্রুততার সঙ্গে ও মজবুতভাবে তাঁরা এই জগৎ-জীবন-সংসারকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। ফলে তাঁদের এবং তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের পাশ্চাত্যের কালচারে খুব সহজে মিশে যেতে কোনও অসুবিধা হয় না। তখন আর নিজের দেশ-সমাজ, সেই সমাজের পিছিয়ে পড়া নিপীড়িত মানুষ — কারো কথাই তাদের স্মরণে থাকে না। কখনো তাদের দেখলে মনে হয় তারা যেন সচেতন বা অসচেতনভাবে পাশ্চাত্যের বিশ্বস্ত ‘এজেন্ট’ হয়ে কাজ করে চলেছেন। যেমন ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলার অনেক নামী বুদ্ধিজীবী সিআইএ-র এজেন্ট হয়ে কাজ করেছিলেন। সার্বিকভাবে সমগ্র পৃথিবীর ক্ষেত্রে এই কথা সত্য। তাই আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে অসংখ্য প্রত্নখচিত মহামূল্যবান প্রাচীন সভ্যতা খুঁড়ে বার করতে পারলেও, তা সর্বদা হবে ইতিহাসের বিষয়, বর্তমান সমাজ-সভ্যতার বিষয় নয় এবং এই জ্ঞান বা চর্চা আমাদের কী কাজে লাগবে এটা উপলব্ধি করতে গিয়ে বার বার আমরা বিভ্রান্ত হয়ে থাকি।
কারণ এই সময়ের জন্য কঠিন সত্য হল সমগ্র পৃথিবীতে অক্টোপাসের মতো বিছিয়ে থাকা মার্কিন সামরিক ব্যবস্থা (পৃথিবীজুড়ে ৮৪০টি ঘাঁটি), আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক ইত্যাদি মার্কিন অর্থব্যবস্থা থেকে ঋণ করা এবং The New York Times, The Washington Post, The Wall Street Journal, সিএনএন ইত্যাদি মার্কিন গণমাধ্যম, তাদের কালচার, শিক্ষাদীক্ষা ইত্যাদির মধ্যে অবগাহন করা — বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে (American Exceptionalism, Aran Good & The Washington Bullet, Vijoy Prashad)। এই ব্যবস্থা থেকে কেউই আমরা এড়িয়ে থাকতে পারব না। এই কথাটা ভীষণভাবে সত্য এই কারণে যে আমরা চাইলেও আমাদের সন্তান-সন্ততিদের এর বাতাবরণের বাইরে নিয়ে যেতে পারব না। অর্থাৎ আমরা যদি দেখি আমাদের সন্তানরা পাশ্চাত্য কালচার ও শিক্ষাদীক্ষার জন্য সামাজিক দিক থেকে, মানবসভ্যতার ইতিবাচক দিকের বিপরীতে নেতিবাচক কিছু শিখছে ও প্রয়োগ করছে, আমরা তাদের এই ব্যাপারে কোনরকম প্রতিরোধ করতে পারব না। তাই শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের বিছিয়ে রাখা এই জালের মধ্যে ধরা পড়ে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকে না। ফলে সমস্ত বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আমাদের মেনে নিতে হবে।
আমরা এখানে একটু বিস্তৃত অর্থে গণমাধ্যমের কথাই বলব, কারণ এটি গণতন্ত্রর চতুর্থ স্তম্ভ। এর ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে মানুষজনকে সমস্ত দিক থেকে প্রভাবিত করার ঘটনা কঠিনভাবে সত্য। আমরা শিক্ষা-দীক্ষা ও কালচারকে এই গণমাধ্যমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করছি। আজকে যে গণমাধ্যম আমরা দেখি — আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষার সঙ্গে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, খবরের কাগজ ইত্যাদি সমস্ত কিছু তৈরি করেছে পাশ্চাত্য এবং ক্রমাগত এর ওপর বিজ্ঞান-প্রযুক্তি প্রয়োগ করে তারা একে উন্নত থেকে উন্নততর করে চলেছে। এ ছাড়া মুনাফার জন্য তারা তাদের বিপুল অর্থ এতে লগ্নি করেছে। স্বভাবতই এই সমস্ত গণমাধ্যমের মালিকানা স্বত্ব তাদের। অর্থাৎ তারা তাদের ইচ্ছামতো-খুশিমতো এই গণমাধ্যমকে ব্যবহার করবে, বলবে সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে এমন জঘন্যতম কাজ তারা করে চলেছে — এটাই স্বাভাবিক। তা তারা করুক এতে আমাদের বলার কিছু নেই। কিন্তু তারা এরই মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রয়োগ করে আমাদের সমস্ত মানুষজনদের নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে ব্যবহার করে চলেছে। আমাদের সামগ্রিকভাবে আপত্তি এই ক্ষেত্রে; তবু আমরা অসহায় কারণ আমাদের নিজস্ব কোনও শিক্ষাপদ্ধতি বা গণমাধ্যম নেই। এমন সামরিক ব্যবস্থা তৈরি করতে ব্যর্থ যা দিয়ে আমেরিকা ও পাশ্চাত্যকে ভীতি-উদ্রেককারী শাসানি দেওয়া যায়। অন্য দিকে প্রতি ক্ষেত্রে আমাদের বুর্জোয়াদের শিক্ষাপদ্ধতি, কালচার ও গণমাধ্যমকে গলাধঃকরণ করে বড় হতে হয়, টিকে থাকতে হয়।
কেমন করে একটি শিশুর ছেলেবেলা থেকে এই পাশ্চাত্য শিক্ষা ও কালচারে অভ্যস্তীকরণ ঘটে? কেমন করে সে মনে-প্রাণে কোনও সমাজের প্রতিষ্ঠিত সিভিল সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠে? মনে রাখতে হবে নিম্নবর্গীয় পরিশ্রমজীবী মানুষজন এই শিক্ষা ও কালচার নিয়ে কোনদিনই মাথা ঘামায় না। উদরপূর্তির জন্য তাদের উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং প্রত্যক্ষভাবে দেশের বা সমাজের উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে ঠিকমতো মজুরি সংগ্রহ করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। নিজের জীবনের ও পরিবারের অস্তিত্বরক্ষা করার জন্য ন্যূনতম উপাদানগুলি পেয়ে গেলে তারা অন্য কোনও বিষয়ে মাথা ঘামায় না। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন অনেক ছোটো মাপের হয়ে থাকে। তুলনায় সমাজের উচ্চ ও মধ্যবর্তী স্তরের মানুষজনরা সমাজে বিশেষ অধিকারভোগী হওয়ার কারণে শিশুকাল থেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে। অল্পবয়স থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার আদবকায়দায় অভ্যস্তীকরণ হওয়ার জন্য পৃথিবীর উন্নত সমাজের সর্বময়, সর্বব্যপ্ত কালচারে তাদের সারাজীবন অবগাহন করে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভবের সুযোগ করে দেয়। তাদের মনের প্রকৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য গণমাধ্যমের ক্রমাগত, নিরন্তর ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। তাই তারা পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষা ও কালচারের কাছে সচেতন বা অসচেতনভাবে আত্মসমর্পণ করে থাকে। ফলে তারা নিজের পরিবার, সমাজ, বিশ্বপ্রকৃতিকে খুব সহজেই অগ্রাহ্য করতে পারে। এই সুযোগে পাশ্চাত্য গণমাধ্যম তাদের উন্নত চোখ ধাঁধানো শিক্ষা ও কালচার দিয়ে এই সমস্ত স্তরের মানুষজনকে অভিভূত করে ফেলে। কারণ আমরা নিজস্ব দেশজ কোনও শিক্ষা, গণমাধ্যম, কালচার তৈরি করতে পারিনি যা আমাদের সর্বক্ষণ অবগাহনের সুযোগ করে দিতে পারে৷ কেননা তুলনায় পাশ্চাত্যের এই গণমাধ্যম, শিক্ষা, কালচার দীর্ঘদিন নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাবার কারণে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র পাশ্চাত্যের এই শিক্ষাকে সার্বিকভাবে অবলীলাক্রমে প্রয়োগ করে চলে। সাধারণত বিদেশে শিক্ষিত রাষ্ট্রের আমলা ও অমত্যবর্গরা, যারা এদেশে সিভিল সোসাইটি তৈরি করে, তারা আমাদের শেখায় যে এটাই হল আধুনিককালের একমাত্র শিক্ষা-দীক্ষা ও কালচার। ফলে আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত স্তরের মানুষজনরা পাশ্চাত্যের এই শিক্ষা-দীক্ষা, কালচার ও গণমাধ্যমের কাছে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একপ্রকার নীরব বা উচ্চকিত সম্মতি প্রদান করে থাকি। ফলে পাশ্চাত্য গণমাধ্যমের যে কোনও বক্তব্য, মতামত আমাদের কাছে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য, সত্য ও ‘গসপেল’ মনে হয়। অথচ পাশ্চাত্য কখনো আমাদের মতো গরিব, পিছিয়ে পড়া দেশের স্বার্থের কথা ভেবে কোনও প্রকল্পে হাত দেয় না, তারা শুধু নিজেদের স্বার্থের কথাই ভাবে। তারা শুধু ভাবে কেমন করে তাদের কালচার ও গণমাধ্যম দিয়ে আমাদের শোষণ করতে পারে, নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং কখনো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমাদের শাসিয়ে চলে। কখনো অস্ত্র দিয়ে আমাদের ধ্বংস করার চেষ্টা করে যেমন করেছে লিবিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাক, আফগানিস্তান এমন অসংখ্য দেশে।
পাশ্চাত্যের গণমাধ্যম কেমন করে তাদের গণমাধ্যমগুলিকে আরও আকর্ষণীয় ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায় এই বিষয়ে নিরন্তর গবেষণা ও চর্চা করে চলে, এর জন্য অনেক অর্থলগ্নী করে। এই চর্চার ফলে তারা আরও নতুন নতুন ধরনের আকার-প্রকার আবিষ্কার করে চলে যা নতুন নতুন ফ্যাশনের মতো, আমাদের কাছে নতুনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে। এ ছাড়া পৃথিবীব্যাপি সংবাদ-তথ্য ইত্যাদি সংগ্রহের জন্য উৎকৃষ্ট জনবল, অর্থবল ইত্যাদি প্রয়োজন হয় যা তাদের রয়েছে। ফলে এই সংবাদ সংগ্রহ করার পর তারা এটাকে নিজেদের প্রয়োজনমতো, সুবিধামতো সাজিয়ে যখন তা গণমাধ্যমে প্রচার করে তখন তা আমাদের কাছে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। বিশেষত অশিক্ষিত, পিছিয়ে পড়া মানুষজনের ক্ষেত্রে এই ঘটনা সর্বতোভাবে সত্য। কারণ শিক্ষিত, এগিয়ে থাকা মানুষ তার যুক্তিবিচারবুদ্ধি ও জ্ঞানাত্মক প্রক্রিয়ার সাহায্যে যে কোনও বস্তু ও ঘটনাকে প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণ করে থাকেন; কিন্তু অশিক্ষিত, পিছিয়ে পড়া মানুষের মনের মধ্যে এই ধরনের ‘ক্রিটিক্যাল ফ্যাকালটি’ (বিশ্লেষণ-মুখী মন) বিকশিত হয় না। ফলে শিশুদের মতো তারা নির্বিচারে এই সমস্ত সংবাদ-তথ্য গলাধঃকরণ করে থাকেন। শুধু নিজেরা গলাধঃকরণ করেন তাই-ই নয়, গণমাধ্যমে পাওয়া এই সমস্ত সংবাদ-তথ্যগুলি দিয়ে তারা পাশাপাশি মানুষজনদের একে অপরকে প্রভাবিত করে চলেন। কখনো এর মধ্যে নিজেদের কল্পনার রঙ চড়িয়ে একে আরও ভারি করে তোলেন, যা সকল প্রকার গুজবের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। ক্রমশ জলের ঢেউ-এর মতো তা চারপাশে বহুদূর ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণে দেখা যাবে এক বিপুল জনগোষ্ঠীর মানুষ এই সংবাদগুলি দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং এই প্রভাব নিরন্তর প্রচারের ফলে পুনঃশক্তিসঞ্চারিত হয়, যাকে আমরা অভ্যস্তীকরণ প্রক্রিয়াও বলে থাকি।
যে সকল মানুষ শিশুকাল থেকে এমন পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষা ও কালচারে অভিস্নাত তারাও কিন্তু প্রাপ্তবয়সকালে পরিণত মন থাকা সত্ত্বেও এই গণমাধ্যমের প্রভাবে, এই ‘কালচারাল হেজিমনি’-র (hegemony) প্রভাবে অতি সহজেই ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ ধারণা পোষণ করে থাকেন। তাদের এই দৃঢ়প্রোথিত, ত্রুটিপূর্ণ ধারণাগুলি মানবিক উপাদানের পটপ্রেক্ষিতে বহু ক্ষেত্রে বিষাক্ত হয়ে থাকে, কারণ এই ধারণাগুলির মধ্যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের অগ্রাহ্য করা, অবহেলা করা এমনকি ঘৃণা করা ইত্যাদি স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক উপাদানগুলি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে সমাজের এইসব মানুষজন শিক্ষিত, কেষ্টবিষ্টু বা গণ্যমান্য হওয়ার সুবাদে তাদের ধারণা বা মতামত খুব সহজে এক বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। আর এইসব কতিপয় ‘সেলিব্রিটি’কে ক্রয় করতে পারলে এই গণমাধ্যমগুলির প্রভূত লাভ হয়। এদের দিয়ে তারা তাদের ভাবাদর্শগুলির প্রচারক হিসাবে নিপুণভাবে কাজে লাগাতে পারে। তারা সর্বদা এমন কাজই করে থাকে যেমন করে তারা জনগোষ্ঠীর খুব অল্পবয়সের মানুষজন থেকে ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ করে থাকে। ‘ট্যালেন্ট’রা যেমন নিজেদের নানাবিধ ক্ষমতা দেখিয়ে মানুষদের চমক দিয়ে থাকে, তেমনি তারা মানুষের কাছে এই ভুল বা বিষাক্ত ধারণা প্রচার করে এর গ্রহণযোগ্যতা বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে তোলে।
সাম্প্রতিককালের একটি ঘটনার উল্লেখ করব যা থেকে গণমাধ্যমের প্রভাব কত ভয়াবহ হতে পারে তা অনুমান করা যাবে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পটপ্রেক্ষিতে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রচার করে। এই প্রেস পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণমাধ্যমগুলির মধ্যে একটি। তারা ১৫ই নভেম্বর, ২০২২ একটি সংবাদ প্রকাশ করে, যাতে বলা হয়, রাশিয়া পোলান্ডের সীমান্তের কাছে একটি মিসাইল নিক্ষেপ করেছে যাতে সীমান্তবর্তী দু’জন আলুচাষি মারা গেছে। তখন ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি-২০-এর সম্মেলন চলছে এবং সেখানে উপস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও সচিব এই খবরে যথেষ্ট চঞ্চল হয়ে পড়েন, বিশেষত যখন এই সংবাদ তাদের দেশের বিখ্যাত সংবাদ-মাধ্যমের দ্বারা প্রচারিত হয়েছে। কারণ এই খবর যদি সত্য হয় তাহলে এরই সূত্র ধরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। কারণ পোলান্ড ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশ এবং পোলান্ড আক্রান্ত হওয়ার অর্থ ন্যাটো আক্রান্ত হওয়া অর্থাৎ আমেরিকা আক্রান্ত হওয়া। সুতরাং ধরে নিতে হবে এবার আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হবে। এবং এর পরিণতি হল ভয়ংকর পারমাণবিক যুদ্ধ। তাহলে আমরা ভেবে দেখতে পারি, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের একটি খবর পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার জন্য যথেষ্ট।
বাস্তবিক রাশিয়া পোলান্ডে ক্ষেপনাস্ত্র নিঃক্ষেপ করেনি এবং খবরটি অসত্য। তাহলে প্রেস এমন খবর ছাপল কেন। এই খবর ছাপার পেছনে রয়েছে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি। এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি সাংবাদিকদের জানালেন, সম্ভবত এই খবর সত্য নয়। তখন উত্তেজনা অনেক পরিমাণে প্রশমিত হল এবং এরপর অনুসন্ধান করে জানা গেল ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ন্যাটোকে এই যুদ্ধে অংশীদার করার জন্য নিজেরাই পোলান্ডে ক্ষেপনাস্ত্র ছুঁড়েছে এবং ক্রমাগত প্রচার করেছে এটা রাশিয়ার কাজ। অন্যদিকে অ্যাসিয়েটেড প্রেস যথাযথ অনুসন্ধান না করে এমন খবর ছাপিয়েছে যে রাশিয়া পোলান্ডে ক্ষেপনাস্ত্র ছুঁড়েছে। এর ফল যে কত মারাত্মক, ভয়ংকর হতে পারে তা তারা ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। তাৎক্ষণিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা এমন বিপজ্জনক কাজ, মানবজাতির জন্য ভয়ঙ্কর কাজ করতেও পিছুপা হয়নি। এটা একটা ছোটো উদাহরণ যে পাশ্চাত্যের বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কি ধরনের ভূমিকা পালন করে চলেছে।
গণমাধ্যমকে গণতন্ত্রর চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় এবং আমরা জানি ক্রমাগত প্রচারের মাধ্যমে এই গণমাধ্যমগুলি বিশেষত পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলি পৃথিবীর মানুষজনকে বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের মানুষজন ও গণমাধ্যমকে কী পরিমাণে প্রভাবিত করে চলেছে। এর কারণ অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে পাশ্চাত্য প্রাচ্যের তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী এবং পাশ্চাত্য যা চাইবে প্রাচ্যকে তাই-ই করতে হবে। যদি তারা তা না করার ঔদ্ধত্য দেখায় তাহলে অর্থনীতির বিধি-নিষেধ এবং সমরাস্ত্র প্রয়োগ করে এইসব দেশগুলিকে প্রয়োজনে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে, এমন হুমকি তারা সর্বদা দিয়ে থাকে। এখন পৃথিবীর ৩৬টি দেশ আমেরিকার এমন ‘sanctions’-এর দ্বারা আক্রান্ত।
কিছুদিন আগে ইওরোপের ইউনিয়নের উপ-প্রধান যোসেফ ব্যারেল সর্বসমক্ষে বললেন, ইওরোপ হচ্ছে এক চমৎকার বাগান আর বাকি পৃথিবী হচ্ছে জঙ্গল। আমাদের এই বাগানকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করতে হবে নইলে ঐ জঙ্গল এই বাগানকে ধ্বংস করে ফেলবে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী মানবপ্রজাতির এই সমস্ত অবমাননাকর অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য আমি পাঠক-পাঠিকাদের বিশেষত নতুন প্রজন্মকে রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি আর একবার পড়ে দেখার জন্য, ভাবার জন্য অনুরোধ করছি। রবীন্দ্রনাথ এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি এই সমস্যাটি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং ভারতবর্ষ তথা এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার মানুষজনের কাছে এই বার্তা দিয়ে গেছেন — পাশ্চাত্যের নিষ্পেষন করা বর্ণবিদ্বেষী, মনুষ্যত্বের এই অপমানজনক গণমাধ্যমের প্রচারের বিরুদ্ধে থেকে প্রাচ্যকে একযোগে উঠে দাঁড়াতে হবে।