পণ্য আসক্তি : ব্যাখ্যা এবং মনোসমীক্ষক দৃষ্টিকোণ

শ্রীপর্ণা কর

মানুষের চাহিদা অপরিসীম, সীমাহীন, যখনই একটি চাহিদা আমাদের মনে নাড়া দেয় সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সর্ব মনোযোগ চলে যায় সেটিকে পরিতৃপ্তি করার জন্য। কিন্তু একবার যখনই সেটি পরিতৃপ্ত হয়, সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী চাহিদা সামনে এসে দাঁড়ায়। এটাই মানুষের প্রকৃতি। মানুষের চাহিদার ধরন কখনও একই রকম হতে পারে বা সেটি অনেক সময় আবার সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু যদি এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হয়, যে একটি চাহিদার পর অন্য একটি চাহিদার উদ্ভব ঘটে, তাহলে যদি ব্যক্তির চাহিদার বস্তু একই থাকে তাহলে খুব সহজেই সে সেটার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বে। সুতরাং চাহিদার পরিতৃপ্তি এবং আসক্তির মধ্যে ঠিক তফাতটা কোথায়?

এই বিষয়ে অগ্রসর হবার আগে ‘আসক্তি’ কথাটার অর্থ জেনে নেওয়া প্রয়োজন। আসক্তি আমাদের মস্তিষ্কের একটি দীর্ঘস্থায়ী কর্মহীনতা, যেটির মধ্যে স্মৃতি, প্রেষণা এবং পুরস্কৃত বা তৃপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়া জড়িত থাকে, এবং ব্যক্তি ক্রমে আচরণের ফলাফলের ওপর কম গুরুত্ব দিতে থাকে, যেহেতু সেটি একটি অত্যন্ত সুখদায়ক অনুভূতি সৃষ্টি করে, শরীর তখন বার বার সেই পদার্থ বা আচরণের জন্য কামনা করতে থাকে। এই আচরণ বেশিদিন চলতে থাকলে, আসক্তি আমাদের সাধারণ জীবনযাপনকে ব্যাহত করতে পারে এবং এই আসক্তি বার বার ঘুরে আসতে পারে তার জীবনে। সুতরাং আসক্তি আমাদের শরীর ও মনকে সমস্তভাবে গ্রাস করে নেয়। পণ্য আসক্তির ক্ষেত্রে ব্যক্তি হতে পারে কোনো নির্দিষ্ট পণ্য বা দ্রব্যের প্রতি আসক্ত বা শুধুমাত্র যে কোনো পণ্য ক্রয় করা বা ভোগ করার ব্যাপারে আসক্ত। 

কিন্তু পণ্য আসক্তি বা বস্তুবাদের একটি অন্য দিকও আছে। বস্তুবাদী বা বস্তু আসক্ত ব্যক্তিরা তাদের গৃহীত বস্তু বা পদার্থকে শুধুমাত্র তাদের প্রয়োজন বা চাহিদা নিবারণের জন্য ব্যবহার করে না, বরং তাদের সামাজিক অবস্থা বা মর্যাদা প্রদর্শনের জন্যও করে এবং বহুক্ষেত্রে ব্যক্তি সচেতনভাবে বা অজান্তেই এই পণ্য বা দ্রব্যগুলিকে তার নিজের বা স্ব-র একটি বিস্তারিত অংশ হিসেবে রূপান্তরিত করে। যেমন একজন ব্যক্তি কোনো ব্র্যাণ্ডের সুগন্ধি ব্যবহার করে বা কোনো ব্র্যাণ্ডের গাড়ী চালায় এটি তার ব্যক্তিত্বের একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এখন এই ক্রমাগত সংগ্রহ বা ক্রয় করে যাওয়ার সংস্কৃতি একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতির দিকে রূপান্তরিত হয়েছে। নিজের বা স্ব(self)-এর গুরুত্ব বা মর্যাদা বোঝানোর জন্য এই পণ্য বা দ্রব্যের সমষ্টিকে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন রয়েই যায় যে কীভাবে এই দ্রব্য আমাদের স্ব-এর একটি বিস্তারিত অংশ হিসেবে কাজ করে। 

Self বা ‘স্ব’-এর ধারণা এবং সামাজিক উদ্দীপনা হিসেবে পণ্যের ভূমিকা :

Self বা ‘স্ব’ হল আমাদের নিজেদের সম্পর্কে প্রাথমিক এবং সর্বপ্রথম বিশ্বাস আর ধারণার সমষ্টি। 

সাংকেতিক মিথস্ক্রিয়াবাদ তত্ত্ব অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির ‘স্ব’ ধারণা তার নিজের প্রতি প্রত্যক্ষণ এবং অন্যদের তার প্রতি প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে (Solomon 1983, Grubb & Grathwohl, 1967) Self বা ‘স্ব’ ধারণার সংজ্ঞাকে ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় সেটি বহু উপাদান দ্বারা গঠিত, তার মধ্যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল (Jamal & Goodo, 2001; Achomi & Bouslama, 2010, Sirgy, 1997) :

  • বাস্তব ‘স্ব’ (Actual Self) : একজন ব্যক্তি নিজেকে কীভাবে দেখে।
  • আদর্শ ‘স্ব’ ( Ideal Self) : একজন ব্যক্তি নিজেকে কীভাবে দেখতে চায়। 
  • স্বামাজিক ‘স্ব’ (Social Self) : একজন ব্যক্তি কী মনে করে অন্যান্যরা তাকে কীভাবে দেখে।
  • আদর্শ সামাজিক ‘স্ব’ (Ideal Social Self) : একজন ব্যক্তি কী রকম চায় যে অন্যেরা তাকে দেখুক। 

সাংকেতিক মিথস্ক্রিয়াবাদ তত্ত্ব অনুযায়ী পণ্য ক্রয় বা ভোগের মাধ্যে নিজের ‘স্ব’ ধারণাকে বজার রাখার পিছনে যে প্রধান বক্তব্য আছে সেটি হল যে পণ্য কেবলমাত্র তার কার্যকারী উপযোগিতার জন্য ক্রয় বা ব্যবহৃত হয় না, এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে Solomon (1983) প্রস্তাব রেখেছেন যে পণ্য বেশিরভাগ সময় সামাজিক উদ্দীপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি এটাও বলেছেন যে পণ্যের ব্যবহারিতা কেবলমাত্র তার প্রয়োজনীয়তা বা কার্যকারীতা নয় বরং সেটি কীরকম সামাজিক অর্থবহন করে তার ওপরও নির্ভর করে। একটি পণ্যের অর্থ হল তার মূল্যের উৎস (Richins, 1994)। ‘সাঙ্কেতিক ক্রয় আচরণ’ এই কথাটি ব্যবহার করা হয় যখন কোনো ব্যক্তি কোন্ পণ্য ব্যবহার করবে সেটা নির্ভর করে সমাজ সেই পণ্যের ওপর কী অর্থ আরোপণ করছে তার ওপর (Leigh & Tessance, 1992)। 

এই আলোচনা থেকে এটি খুবই পরিষ্কার যে কীভাবে সচেতনভাবে বা অসচেতনভাবে আমরা পণ্য বা দ্রব্যকে আমাদের নিজেদের ‘স্ব’-এর সাথে একাত্ম করে ফেলি। কিন্তু অনেক সময়ই এরকম দেখা যায় যে এই আসক্তি বা পণ্য ক্রয়ে বাধা পড়লে, ব্যক্তির মধ্যে সেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আসক্তি বা বস্তুবাদের গ্রাস থেকে কাটিযে বেড়িয়ে আসা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়ে পড়ে। দুটি তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে এই আচরণের মনোসমীক্ষক ব্যাখ্যা প্রয়োজন। 

বস্তুবাদ বা আসক্তির মনোসমীক্ষক ব্যাখ্যা : 

Object Relations তত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করা হয় যে, ব্যক্তিরা পণ্যের মাধ্যমে তাদের পারিপার্শ্বিকের বিকাশ ঘটায় বা পরিচালনা করে, এবং আবার নিজের Self বা স্ব-এর সাথে পারিপার্শ্বিক অন্যান্যদের সঙ্গে মধ্যস্থতা করে (Gomex, 1997, Starrakakis, 2006)। Freud এর মনোসমীক্ষক তত্ত্ব অনুযায়ী, শক্তি সেই পণ্যের ওপর তার মনোযোগ এবং psychosextual উত্তেজনা স্থাপন করে রাখে এবং সেই পণ্যের মধ্যে ব্যক্তি তা সহজাত প্রবৃত্তি নিবারণ করে। লাকার মতে, সেই বহুমূল্যবান পণ্য যেটি ব্যক্তিকে প্রথমে পরিতৃপ্তি দেয়, কিন্তু পরবর্তীকালে সেই পণ্যই ‘হারিযে যাওয়া দ্রব্য’ বা  ‘Object of loss’-এ পরিণত হয়। পরবর্তীকালে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির পরিতৃপ্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতিক্রিয়া তার সেই পূর্ববর্তী পণ্য বা দ্রব্যের ওপর নির্ভর করে। Object Relations তত্ত্ব সর্বদা এই তথ্যের ওপর জোর দিয়েছে যে ব্যক্তিরা পণ্য বা দ্রব্য ব্যবহার করে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য (Wlnnicott, 1968)। ব্যক্তিরা এরকমই পণ্য বা দ্রব্য নির্বাচন করে যেটি তাদের প্রাক্ষোভিক, মানসিক এবং বিকল্পমূলক চাহিদা পূরণ করে, এবং তাদের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক জগতের সাথে একটি সেতু বন্ধন তৈরি করে। 

বস্তুবাদ সম্পর্কিত লাকার তত্ত্ব : 

মনোসমীক্ষক তত্ত্বের একটি প্রধান ধারণা হল ব্যক্তির ‘আদর্শ স্ব’ বা ‘Ideal Self’ এবং এখানে ভোক্তার আচরণকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে নিজের স্ব-এর আদর্শায়ন করা বা ‘আমি’র পরিচয় হয় তৈরী করা বা অনুকরণ করার মাধ্যমে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী পণ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত সঙ্কেতের অর্থ অনেক অংশে সাংস্কৃতিমূলক এবং সেটি ব্যক্তি বা ক্রেতা সম্পর্কে সামাজিক তথা সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কিত তথ্য বহন করে। প্রতিফলনের মূল্যায়নের (Reflective Evaluation) তত্ত্বে, সোলোম্যান বলেছেন যে ব্যক্তিরা সাঙ্কেতিক পণ্য ব্যবহার করে তাদের সামাজিক ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এবং কোনো অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সেটি নিজের আচরণেও প্রকাশ করে থাকে। 

এই ধারণা এখন আমাদের কাছে পরিষ্কার যে পণ্য তার সামাজিক অর্থ বা ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তার জন্য শুধুমাত্র ব্যবহার করা হয় না। সোলোম্যান (1983) বলেছেন ব্যক্তিরা পণ্যের সামাজিক সংকেতের অর্থ ছাড়াই সেটিকে ব্যবহার করে নিজেদের পদমর্যাদা বা ক্ষমতাকে বর্ধিত করার জন্য এবং অন্যান্যদের সামনে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য। বেল্ক (1988) (Belk, 1988)  বলেছেন যে আমরা প্রত্যক্ষ করি, ব্যাখ্যা করি এবং নিজেদর স্ব-এর অর্থ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি আমাদের স়ংগৃহীত পণ্য সমষ্টির ওপর নির্ভর করে। 

ও’ কেস এবং ম্যাক ইভেন (2006) এর মতে, ব্যক্তি কেবলমাত্র নিজেকেই পণ্য সমষ্টির ওপর নির্ভর করে ব্যাখ্যা করে না বরং অন্যদেরও ব্যাখ্যা করে তাদের পণ্য সম্পত্তির ওপর নির্ভর করে। এছাড়া পণ্য ক্রয় বা অর্থাজন করা যেমন ব্যক্তির বা অন্যান্যদের কাছে স্ব-বর্ণনা হিসেবে কাজ করে, পণ্যের ব্যবহার বা তাকে ক্রয় করা ব্যক্তির স্ব-ধারণাকেও প্রকাশ করে (Self-Concept)  (Souiden, M’ Saad & Rons, 2011; Sirgy, 1982)। গ্রব এবং গ্রাবওল (1967)-এর মতে, যখন একজন ব্যক্তি কোনো পণ্য ক্রয় করে যেটি সে মনে করে তা স্ব-ভাবমূর্তির সঙ্গে মেলে এবং অন্যেরা সেটিকে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দেয়, সেটা তাদের স্ব-ধারণাকে বর্ধিত করে। 

সুতরাং এই পণ্য ক্রয় তখন আর ব্যক্তির কেবলমাত্র প্রয়োজনীয়তার কারণে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা ব্যক্তিত্বের একটি অংশ হয়ে জড়িয়ে যায় তার সাথে, আর ক্রমে এই আচরণ আসক্তির দিকে চলে যায়। একটি পণ্য বা দ্রব্য ক্রয় করার পর সেটি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যক্তিকে পরিতৃপ্তি বা মর্যাদা প্রদান করে, তারপর সেটির মূল্য কমতে থাকে, ফলে ব্যক্তি যে পুরস্কৃত বা তৃপ্ত হওয়ার অনুভূতি সেই পণ্য থেকে পেয়েছিল সেটা কমে যাচ্ছে ফলে তখন তাকে নতুন কোনও পণ্য ক্রয় করতে হবে সেই পরিতৃপ্তি পাওয়া জন্য, ফলে এই আসক্তির চক্র চলতেই থাকে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান