কঙ্ক ঘোষ
মহাভারতের দ্রোণ পর্বের এক মোড় ঘোরানো অধ্যায়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দ্রোণাচার্যের হাত থেকে নিস্তার পাবার তাগিদে পাণ্ডবরা নানা যুদ্ধকৌশল বিবেচনা করছেন। কৃষ্ণের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভীম যুদ্ধক্ষেত্রে অশ্বত্থামা নামক এক হাতিকে হত্যা করলেন। প্রসঙ্গত, দ্রোণাচার্যের পুত্রের নামও অশ্বত্থামা। ত্রিলোকের রাজত্বের বিনিময়েও কখনো মিথ্যা না বলা যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণের অনুরোধে দ্রোণাচার্যকে দিলেন তাঁর পুত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে ‘মিথ্যে’ মৃত্যুর খবর। কিন্তু কেমন সে মিথ্যা? যুধিষ্ঠির দ্রোণকে উচ্চচঃস্বরে জানালেন ‘অশ্বত্থামা হত।’ তারপর, গলার স্বর নামিয়ে নিখুঁত ভঙ্গিতে বললেন ‘আমি জানি না সে মানুষ না হস্তী (ইতি নারোভা কুঞ্জারোভা)’। দ্রোণাচার্য পুত্রশোকে বিহ্বল হয়ে ধ্যানে বসলেন, তাঁর শরীর থেকে ‘আত্মা’ ছুটে চলল ‘মৃত’ অশ্বত্থামার কাছে। ধৃষ্টদ্যুম্ন হত্যা করলেন দ্রোণাচার্যকে।
যথেষ্ট ব্যাকফুটে থাকা পাণ্ডবদের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অক্সিজেন জুগিয়েছিল এই রণকৌশল। অশ্বত্থামার মৃত্যুর ‘পোস্ট-ট্রুথ’ পাণ্ডবদের সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দিয়েছিল। মহাভারতে যুদ্ধের নিছক কূটনীতি মাইথোলজি পেরিয়ে আজ প্রবেশ করেছে আমাদের যাপনে; অনেক ব্যাপ্ত, বিস্তৃত আকার ধারণ করেছে আমাদের বর্তমান সমাজবাস্তবতায়। দৈনন্দিন জনজীবনে পোস্ট-ট্রুথ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রকে ছলে-বলে-কৌশলে প্রভাবিত করছে। প্রভাবিত হচ্ছে প্রতিটা ছোটো ছোটো চিন্তা। দখল নিচ্ছে মন, চেতনার। আয়ত্ত করছে আমাদের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়া। সকালে হোয়াটস্যাপের ফরোয়ার্ডেড মেসেজ দেখতে দেখতে চোখ খোলা আর রাত্রে ফেসবুকের কোনো মনোগ্রাহী স্বচ্ছন্দপূর্ণ পোস্ট শেয়ার করার মাঝে রোজ একটু একটু করে পোস্ট-ট্রুথ, অল্টারনেট সত্যের অলি-গলি চোরাপথে বাসা বাঁধছে আমাদের মনন।সেই অল্টার-ফ্যাক্টস মানুষ-পুঁজি-যন্ত্র-বশ্যতা-অ্যালগোরিদমের তাড়নায় দুর্বার গতিতে ভ্রমণ করছে, বৈজ্ঞানিক সত্য, যুক্তিবাদের বিশ্লেষণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, মন থেকে মনান্তরে, এক সমাজ থেকে অপর-সমাজে, এক ভাবনা থেকে অপর-ভাবনায়, এক শ্রেণি থেকে আর-এক শ্রেণিতে।
এই জায়গায় কীভাবে পৌঁছালাম আমরা? কীভাবে ভারাক্রান্ত হল আমাদের মন? সময়ের অনিবার্যতায় নিছকই স্বতঃস্ফূর্ত অবগাহন? নাকি আজকের পোস্ট-ট্রুথ কবলিত মন কোনো ম্যানিপুলেটেড, সুসংগত অভিপ্রায়ের শিকার?
পোস্ট-ট্রুথ কী ও কেন?
প্রথমেই এই সতর্কীকরণ দিয়ে রাখা দরকার, যে পোস্ট-ট্রুথ শুধুমাত্র সত্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মিথ্যা নয়। পোস্ট-ট্রুথের অন্যতম মূল আঙ্গিক হল শ্রোতার আবেগপ্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে শ্রোতার স্বাচ্ছন্দ্যবোধের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা খবর, যা কিছুটা সত্যি, কিছুটা মিথ্যে, কিছু অল্টারনেট সত্যি, কিছু প্রেক্ষিতবিহীন সত্যি এসবের সংমিশ্রণ : বস্তুগত সত্য এবং বদলিকৃত সত্যের মধ্যে চক্রাকার আসা-যাওয়া (circuitous slippage between facts and alt-facts)। অক্সফোর্ড অভিধানের সংজ্ঞা অনুযায়ী — ‘denoting circumstances in which objective facts are less influential in shaping public opinion than appeals to emotion and personal belief’। ব্রিটিশ সাংবাদিক ম্যাথিউ ড্যা’নকোনা তাঁর ২০১৭ সালে প্রকাশিত বই ‘Post-Truth : The New War on Truth and How to Fight Back’-এ পোস্ট-ট্রুথ সম্পর্কে বলছেন — ‘it depends less on liar, more on our response to lies’। অর্থাৎ শ্রোতার আবেগপ্রবণতার ম্যানিপুলেশন একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য এই পোস্ট-ট্রুথের। আর-একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে ম্যাথিউ বলছেন, ‘chosen reality that suits your emotional needs’। পোস্ট-ট্রুথ শব্দবন্ধটির ব্যবচ্ছেদ করলে প্রথমে পাই ‘পোস্ট’। এখানে ‘পোস্ট’ কথাটি সময়-অর্থে সত্য বা ‘ট্রুথ’-কে অতিক্রম করেছে এমন নয় (উদাহরণস্বরূপ ভাবা যেতে পারে ‘পোস্ট-ওয়ার’ শব্দবন্ধটিকে যা যুদ্ধপরবর্তী সময় বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে)। বরং ‘পোস্ট-ট্রুথ’-এর পোস্ট বলতে সাধারণভাবে এমন এক অবস্থা বোঝায় যেখানে আবেগ সত্যকে আপেক্ষিকভাবে ‘অতিক্রম’ করে এক নতুন ‘অপর-সত্যের’ জন্ম দিচ্ছে। এক এবং নির্দিষ্ট সত্যের যুগ অতিক্রান্ত হয়ে তৈরি হচ্ছে সুবিধেমতো কন্সিউমেরাবেল অজস্র ‘সত্যের’।
ফিরে আসা যাক শব্দবন্ধের দ্বিতীয় ব্যবচ্ছেদিত অংশে। এখানে উল্লেখ্য আংশিক মিথ্যের উপর গড়ে ওঠা এই কাঠামোয় ‘truth’ কথাটি যুক্ত যেখানে মিথ্যা-তথ্য কিংবা ‘ফেক নিউজ’ শব্দবন্ধে যুক্ত থাকে ‘ফেক’ বা নকল শব্দটি। এখানেই ফেক-নিউজ এবং পোস্ট-ট্রুথের মধ্যে মিল, অমিল এবং যোগসূত্রগুলি বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। ফেক-নিউজ শব্দবন্ধের মূল নির্যাস লুকিয়ে থাকে একটি খবরের বা ঘটনার মধ্যে কতটা সত্য অধিগম্য তার প্রেক্ষিতে। অন্যদিকে পোস্ট-ট্রুথ গড়ে ওঠে একটি প্রদত্ত সত্যের প্রসঙ্গে সাধারণ জনমানসের মধ্যে কী ধরনের মনোভাব ব্যক্ত হচ্ছে তার পরিসরে। সেক্ষেত্রে পোস্ট-ট্রুথের কাঠামো গড়ে তুলতে শ্রোতার আবেগপ্রবণতার কম্পাস মাপার পাশাপাশি প্রয়োজন ‘ফেক-নিউজের’ তথ্যবিকৃতি। প্রয়োজন বিকৃততথ্যের সহায়তায় পোস্ট-ট্রুথের পটভূমি নির্মাণ।একটু তলিয়ে ভাবা যাক। সাধারণত একটা ঘটনাকে মিথ্যা বলা হয় যখন তার সংশ্লিষ্ট সত্যের নিরিখে ওই ঘটনায় তথ্যগত, যুক্তিগত, ন্যায়গত (সমাজের সেই সময়ের সমষ্টিগত নৈতিকতার প্রেক্ষিতে) অন্তঃসারশূন্যতা ফুটে ওঠে যা পর্যায়ক্রমে সেই ঘটনার অস্তিত্বকে সংশয়িত ও অবিশ্বাস্য করে তোলে। এখন এই ‘মিথ্যা’-কে যদি নির্মাণ (construct) করা যায় একদম গোড়া থেকে, অর্থাৎ তার আপাত অন্তঃসারশূন্যতা ও অবিশ্বাসযোগ্য elements গুলোকে ঢাকার জন্য, এবং তা ক্রমাগত আমাদের মননে প্রক্ষেপ করা হয়, তাহলে? সোজা ভাবে ভাবুন। ধরুন, একটা সিনেমা দেখছেন। শুরুতেই দেখানো হল এক যুবক, রোগাপাতলা চেহারা, আর-এক অতিকায়, প্রচণ্ড শক্তিশালী একজনকে খুন করল। শুধু এই দৃশ্য দেখিয়ে সিনেমা শেষ হলে, না-ওই দৃশ্য, না-ওই ঘটনাটা আপনার, আমার মনে রেখাপাত করবে। কিন্তু বাকি সিনেমার চিত্রনাট্য যদি এমনভাবে বোনা যায় যাতে প্রতিটা ধাপে দেখানো হয় যে কীভাবে ওই আপাতভাবে দুর্বল ছেলেটি এই প্রবল-শক্তিধারী আর-এজনকে ধরাশায়ী করে ফেলল, তখন আমাদের শুরুতে দেখা অবিশ্বাসের অনেকটা দূর হয়, বা বলা ভালো শুরুর ওই ক্রিয়ার এক লজিক্যাল, সুসঙ্গত প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।পোস্ট-ট্রুথের ব্যাপারটাও খানিকটা এরকম। ‘মিথ্যা’-র সুসংগত নির্মাণ। ‘মিথ্যা’-র ক্রনোলজিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড গঠন। যা আগে ছিল ‘মিথ্যা’ তা এই নির্মাণ, base-স্ট্রাকচার পেয়ে হয়ে উঠল ‘alternate-facts’ বা ‘অল্টার-ট্রুথ’। আর অল্টার-ট্রুথকে ট্রুথ বানানোর এখন অজস্র মাধ্যম। মনোপলি-মিডিয়া-খবর-সোশ্যালমিডিয়া-অ্যালগরিদম-বিজ্ঞাপন-আপনি-আমি-আমরা-পরিবার-পাড়া-পড়শি-চেনা-অচেনা-রাজ্য-দেশ-পৃথিবী-স্যাটেলাইট-টেকনোলজি-পুঁজিবাদ-প্রফিট-লস-কোম্পানি-মনোপলি……….. ক্রোনোলজি সমঝিয়ে আপ!
পোস্ট-ট্রুথ ভারাক্রান্ত মন
মন কি চিনতে পারে না পোস্ট-ট্রুথ? নাকি আমাদের মনের মধ্যেই রয়েছে এমন অনেক অপেক্ষাকৃত ‘দুর্বল’ নক্সা যা বস্তুনিষ্ঠ সত্যের উপর আবেগের আধিপত্য তৈরিতে সাহায্য করে? মনের সঙ্গে পোস্ট-ট্রুথের আলাপ-সংলাপের সূত্রে উঠে আসবে মনোবিজ্ঞানীদের জ্ঞানীয়-পক্ষপাত বা কগ্নিটিভ বায়াসের ধারণা। উঠে আসবে মানব মনের ‘ইগো ডিফেন্স’ বা ‘সাইকিক ডিস্কম্ফট’ এড়িয়ে চলার প্রবণতা। মন সেই পথেই চলতে স্বচ্ছন্দ যেখানে মানসিক টানাপোড়েন কম। তাই কোনও নির্দিষ্ট সত্যের সঙ্গে অভ্যেসজনিত বিশ্বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে উপদ্রুত মন অস্বস্তির মাঝে খুঁজে বেড়ায় স্বস্তির স্থবিরতা। পোলিশ-আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী সলোমন অ্যাসচ “Opinions and Social Pressure” নামক তাঁর ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে সামাজিক আধিপত্যের সঙ্গে আমাদের বিশ্বাসপ্রবণতার সূত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন আমাদের মন অধিকাংশ সময়েই আমাদের চারপাশের গোষ্ঠীগত বিশ্বাস এবং চিন্তাভাবনার সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে ভালোবাসে। জ্ঞানীয় অসঙ্গতি, সামাজিক অনুক্রম এবং জ্ঞানীয় পক্ষপাত- মনের মধ্যে নিহিত এই তিন এলিমেন্টই ধীরে ধীরে তৈরি করে পোস্ট-ট্রুথ প্রবণ মনের কাঠামো। ক্রমে অস্বস্তি এড়িয়ে চলা মনের উপর ঘটে তথ্যের মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ। কগ্নিটিভ ফাংশন ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। ক্রমাগত তথ্যের বিস্ফোরণে কমতে থাকে বিশ্লেষণের, সত্যি-মিথ্যে ফারাক করার ক্ষমতা। আমরা ক্লান্ত হই। ভারাক্রান্ত হই। মনের উপর তখন পোস্ট-ট্রুথের একাধিপত্য।
মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এবং পোস্ট-ট্রুথের বিবর্তন
শব্দবন্ধ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ না-হলেও পোস্ট-ট্রুথের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন উদাহরণ ছড়িয়ে আছে মানব-ইতিহাসের পরতে পরতে। কেউ কেউ মনে করেন মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার, ভাব আদান-প্রদানের আদি পর্ব থেকেই এর উৎস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে নাৎসি জার্মানির ‘রাইখ মিনিস্টার অফ প্রোপাগ্যান্ডা’ জোসেফ গোয়েবলসের সুপরিচিত তত্ত্ব : ‘একবার বলা মিথ্যা মিথ্যাই থেকে যায়, কিন্তু হাজারবার বলা মিথ্যা ধীরে ধীরে সত্যে পরিণত হয়’, কিংবা গণধ্বংসকারী অস্ত্রের ‘ভুয়ো’ অস্তিত্বের উপর ভর করে আমেরিকার ২০০৩-এর ইরাকে যুদ্ধ, বা ২০১১-য় ন্যাটোর হস্তক্ষেপে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ— অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এবং বহুলাংশে এই মিথ্যা বা বাছাই করা সত্যি-মিথ্যার ককটেলে ইন্ধন জুগিয়েছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া।
আমেরিকার বিদেশনীতি সংক্রান্ত খবর অনেকাংশেই সেখানকার মেইনস্ট্রিম মিডিয়া প্রচার করেছে অর্ধ সত্য/ মিথ্যার উপর ভর করে সরকার পক্ষের জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে। আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ-র ডি-ক্লাসিফায়েড নথিতে উঠে এসেছে এমনই সব তথ্য যা পোস্ট-ট্রুথের উর্বর জমি রোপণ করে আসছে বহু বছর ধরে। আদর্শগত প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে দেখতে ক্রমশ ধাপে ধাপে পুঁজিবাদের স্বার্থে কমিউনিজমকে ডেমোনাইজের মাধ্যমে সাধারণ জনমানসের কাছে তুলে ধরা হল এক নতুন জাতীয় সুরক্ষার সমস্যা হিসেবে। ১৯৫১ সালে মধ্য-আমেরিকার গুয়েতেমালায় বিপ্লবের মাধ্যমে একনায়ক উবিকোকে সরিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন জ্যাকোবো আরবেনজ। তিনি ক্ষমতায় আসার আগে গুয়েতেমালার ৪২ শতাংশ জমি ছিল The United Fruit Company (UFCO) নামক এক আমেরিকান ফল কোম্পানির অধীনে যারা গুয়েতেমালায় কলা চাষ করে আমেরিকা এবং ইউরোপে বিক্রি করত। আরবেনজ ক্ষমতায় আসার সময়ে গুয়েতেমালার ২ শতাংশ জমিদারের কাছে ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ জমির মালিকানা। কৃষকের অনিবার্য পরিণতি ছিল ক্রীতদাসত্ব। আরবেনজ এই সূত্রে গুয়েতেমালার জমির পুনর্বন্টনের সিদ্ধান্ত নিলে সি আই এ নামিয়ে আনে ‘ক্যু দে’তা’, অপারেশন PBSUCCESS। গুয়েতেমালার গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাত করার পিছনে ‘গুয়েতেমালায় কমিউনিস্ট মতাদর্শের বাড়বাড়ন্তের ফলে আমেরিকার সম্ভাব্য জাতীয় নিরাপত্তার সমস্যা’-র ন্যারেটিভ পেশ করে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া। পরবর্তীকালে এভাবেই বিভিন্ন সময়ে কল্পিত ‘জাতীয় নিরাপত্তা’-র স্বার্থে মিডিয়ার সাহায্যে ১৯৮০-র রেগান প্রশাসনের ভাষ্য কখনো সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘ইভিল এম্পায়ার’, লিবিয়ার মুয়াম্মার গদ্দাফিকে ‘সন্ত্রাসবাদী’, গ্রেনাডা, কিউবা, নিকারাগুয়ার মতো ছোটো ছোটো দেশকে ‘আমেরিকার জাতীয় সুরক্ষার বিপদ’, চিলির সাল্ভাদোর আলেন্দেকে ‘খতরনাক’ কিংবা পানামার জাতীয় নেতা ম্যানুয়েল নরিয়েগাকে ‘ড্রাগ-ডিলার’ হিসেবে উপস্থাপিত করে। পুঁজিগতভাবে শক্তিশালী আমেরিকার মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার ফরম্যাটে অচিরেই ঠিক, ভুল, সত্যি-মিথ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় আদর্শগত আবেগপ্রবণতা। সত্যকে পেরিয়ে যেতে জাতীয় আবেগকে উস্কে দেওয়ার এই পদ্ধতি আসলে অল্টারনেট সত্যের দরজা খোলার মেকানিজম। পোস্ট-ট্রুথের দরজা খোলার মেকানিজম।
ব্রেক্সিট, ২০১৬ আমেরিকা প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন : নিউ-এজ পোস্ট-ট্রুথ
২০১৬ থেকে পোস্ট-ট্রুথ গোটা পৃথিবী জুড়ে এক নতুন গতি পায় ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা (ব্রেক্সিট) এবং আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে। এই বছরই অক্সফোর্ড ডিকশনারি ‘পোস্ট-ট্রুথ’-কে ‘word of the year’ আখ্যা দেয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয় ব্রিটেনের ব্রেক্সিট সংক্রান্ত গণভোট ও আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আবহে সার্বিকভাবে এই বিশেষণের ব্যবহারের আকস্মিক উত্থানের প্রসঙ্গ। ২০১৩ সাল। পা রাখল কেমব্রিজ এনালিটিকা। বা বলা ভালো কান পাতল। সোশ্যাল মিডিয়ার অজস্র তথ্য অনৈতিক ভাবে নেওয়া ও সেখান থেকে মানুষের আচরণগত প্যাটার্ন চিহ্নিতকরণ (Facebook-Cambridge Analytica data scandal) এবং সবশেষে ভোটের প্রেক্ষিতে তাকে প্রভাবিত করা — পৃথিবী প্রবেশ করল এক নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর ওপিনিয়ন তৈরির, তাকে ভেঙে চুরে ইচ্ছেমতো ছাঁচে তৈরির কারখানায়। সেই কারখানায় লগ্নি হতে শুরু হল ব্যাপক মাত্রায়। তৈরি হল ‘ফেক নিউজ’-এর আঁতুরঘর। ইতি-উতি বিচ্ছিন্ন মিথ্যে, অর্ধসত্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগলবন্দিতে সংঘবদ্ধ, সম্মিলিত, ঘনীভূত হল। হল সুসংগত, সামঞ্জস্যপূর্ণ, দৃঢ়বদ্ধ। বাহক, গ্রাহক পাওয়া গেল ready-made। এই আমার আপনার মতো অজস্র সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী। ক্রমে সেই ‘ইচ্ছেমতো ম্যানুফ্যাকচার্ড’ মতামত ছড়িয়ে পড়ল সমাজে, এই সভ্যতায়। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন হয়ে উঠল তার ব্যাবহারিক ক্ষেত্র। ২০০৮-এর অর্থনৈতিক মন্দা ও তার প্রভাবে আমেরিকার সামাজিকক্ষেত্রে হতাশা, অস্থায়িত্ব ও ভালনারেবিলিটির সুযোগে ‘ফেক নিউজ’ নিজেই হয়ে উঠল প্রতিষ্ঠান। আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনে পরিবেশিত হল সেইসব ‘খবর’ — কখনও ‘Pope Francis Shocks World, Endorses Donald Trump For President’ হয়ে কিংবা ‘WikiLeaks confirms Hillary sold weapons to ISIS’ রূপে। ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা র টেকনো-সোশিওলজিস্ট প্রফেসর জেনিপ টুফেকচি তাঁর ‘টুইটার এন্ড টিয়ার গ্যাস’ বইয়ে আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা বৈশিষ্ট্যই হল ক্রমাগত তথ্যের প্রাচুর্যে সাধারণ জনমানসকে আচ্ছন্ন করে রাখা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ভাবে বিভ্রান্তি, ভয় ও সন্দিহান করে তোলা। আবার মজার ব্যাপার হল এই ভয়, বিভ্রান্তির চোরাগলি-ই পোস্ট-ট্রুথ অনুপ্রবেশের আদর্শ ক্ষেত্র।
ম্যাসিডোনিয়ার তারুণ্য : পোস্ট-ট্রুথ ও আউটসোর্সিং
নিউ-এজ পোস্ট-ট্রুথ, আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের আবহে চলুন আপনাদের দিমিত্রির গল্প শোনাই। বছর ১৮-র দিমিত্রির (নাম পরিবর্তিত) বাড়ি নর্থ ম্যাসিডোনিয়া; বুলগেরিয়া, গ্রিস, সার্বিয়া, আলবেনিয়া দিয়ে ঘেরা পূর্ব ইউরোপের এক ছোট্ট দেশ, যার জনসংখ্যা ২ মিলিয়নের আশেপাশে। ২০১৬-য় পাওয়া তথ্যানুসারে, ২০১৬ অবধি ম্যাসিডোনিয়ার জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ কর্মহীন এবং এই বেকারত্বের হার আমেরিকার তুলনায় প্রায় ৫ গুণ। কিন্তু দিমিত্রি ২০১৬-র শেষ ৬ মাসে উপর্জন করেছে প্রায় ৬০০০০ ইউ এস ডলার। শুধু দিমিত্রি নয়, ওর বয়সি অনেকেই একইরকম উপার্জন শুরু করেছিল সেই সময়। দিমিত্রিদের কাজ ছিল আমেরিকার নির্বাচনের আগে ফেক নিউজ তৈরি করা। ফেক নিউজের এক বিশাল আউটসোর্সিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠে ম্যাসিডোনিয়ার ছোট্ট শহর ভেল্সকে কেন্দ্র করে। আমেরিকার নির্বাচনের আগে জনমত অনুযায়ী ফেসবুক, টুইটার বা ফেক ওয়েবসাইট বানিয়ে সেখানে প্রকাশ করা হত ‘ফেক নিউজ’। এই সব আকর্ষক ‘ফেক নিউজ’ লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যেত, এবং এই প্রবল ভিউয়ারশিপ ডেকে আনত অজস্র বিজ্ঞাপন। আর বিজ্ঞাপনের pay per click মডেল থেকে দিমিত্রিদের যাবতীয় উপার্জন। Pay-per-click (PPC) হল এমন এক বিজ্ঞাপন মডেল যেখানে বিজ্ঞাপনদাতা কোনো খবরের ওয়েবসাইটের প্রকাশক বা লেখককে ওই বিজ্ঞাপনে প্রতি ক্লিক পিছু একটা নির্দিষ্ট অর্থ দেন। ফেক নিউজের ব্যাপক, বিস্তৃত ‘reach’ দিমিত্রিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টেনে আনে লক্ষ লক্ষ ইউ এস ডলার।
কিন্তু ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বিপুল মানুষের অংশগ্রহণের রহস্য কী?
একটি ফেক-নিউজের ব্যবচ্ছেদ : প্রথম ধাপ হল ইন্টারনেটে ট্রেন্ডিং কোনো বিষয় বাছাই করা। এবার ওই খবরের কিছু অংশ অন্য ফেক নিউজ ওয়েবসাইট বা বিভিন্ন মিডিয়ার থেকে সংগ্রহ করা। কখনো সরাসরি বিভিন্ন ফেক ওয়েবসাইট তৈরি করা যেগুলো আপাতভাবে কোনো পরিচিত নিউজ পোর্টালের সদৃশ। এরপরের ধাপ হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। পোস্ট-ট্রুথ নির্মাণের ধাপ। খবরগুলোর খুঁটিনাটি ঘটনা ম্যানুফ্যাকচার করা ও তাকে সুসংগত রূপ দেওয়া। ক্রিয়েটিভিটির অসীম ক্ষেত্র। সর্বশেষ পর্যায় হল এক আকর্ষণীয় শিরোনাম। যেমন ক্যাপ্স-লক সহকারে OMG! বা BREAKING NEWS! কিংবা নিদেনপক্ষে একটা WOW! সব মশলা পড়ে গেছে। রান্না তৈরি। এবার গরম গরম পরিবেশন। দরজায় কড়া নাড়ছে আমেরিকান ডলার। স্বপ্ন। স্বপ্ন ছুঁতে পারার স্বপ্ন।
২০১৬-র আমেরিকার ইলেকশন ও সংশ্লিষ্ট ফেক নিউজের বিপুল আউটসোর্স, যুবকদের কর্মসংস্থানের দরুন ম্যাসিডোনিয়ার অর্থনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ জোরালো প্রভাব নজরে আসে। আমেরিকান ডলারের অন্তঃপ্রবাহ ভেলস্-এর মতো ছোটো শহরে গড়ে তুলেছে এক ক্রমবর্ধনশীল ‘নাইট-লাইফ’ ও ‘পার্টি-কালচার’। ১৬-১৭ বছরের টিন-এজারদের অনেকের কাছেই আজ শোভা পাচ্ছে BMW গাড়ি। স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক সম্পর্ক পুনর্গঠিত, পুনর্বিন্যস্ত এবং অভিযোজিত হয়েছে এই পরিবর্তিত অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। ভেলস্-এর বছর ৪০-এর ট্যাক্সি ড্রাইভার টোনির কথায় ‘কমবয়সি মেয়েরা মাচো ছেলেদের চাইতে কম্পিউটার গিকদের বেশি পছন্দ করছে’। টোনির মতো ভেলস্-এর অনেকের কাছেই ফেক নিউজের বাহক হবার সঙ্গে পারিপার্শ্বিক স্থানীয় সমাজের নৈতিকতার কোনো বিরোধ নেই। তাঁদের কাছে টিন-এজার দের ড্রাগ বা অন্য কোনো চক্রে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে ঢের ভালো ফেক নিউজের কারবারি হওয়া। এ যেন এক অনন্ত স্পাইরাল পোস্ট-ট্রুথ সমাজের বেড়ে ওঠা। যেখানে পোস্ট-ট্রুথ তৈরির পদ্ধতি পারিপার্শ্বিক সমাজে মান্যতা পেয়ে যায় আরও কোনো গ্র্যান্ড-পোস্ট-ট্রুথের কবলে পড়ে।
মানুষকে কি তবে ‘doodlebug’-এ কামড়াল?
বিজ্ঞান ও পোস্ট-ট্রুথ
এতক্ষণের আলোচনায় প্যাটার্ন দেখে এটা বুঝতে খুব অসুবিধে হয় না যে পোস্ট-ট্রুথের সঙ্গে অবজেকটিভ-ট্রুথের সংঘর্ষ, সংঘাত অনিবার্য। বিজ্ঞান হয়তো আমাদের হাতের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র যা পোস্ট-ট্রুথের বিরুদ্ধে এক নির্দিষ্ট সত্যের পথ দিতে পারে। কিন্তু উলটে বিজ্ঞান এবং তার সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিকেই ব্যবহার করে নির্মিত, সরবরাহ হতে থাকে পোস্ট-ট্রুথ। কারণ বিজ্ঞানের সামনে এক বিশাল অন্তরায়। বিজ্ঞান-মনন থেকে আমজনতার মননের অন্তরায়। একথা আজ অস্বীকার করার জায়গা নেই যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি সমস্ত মানুষের কাছে সমভাবে পৌঁছায়নি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মূলত ব্যবহৃত হয়েছে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থে।শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাইভেটাইজেশন, অবৈতনিক শিক্ষার পরিকল্পনার অভাব পিছিয়ে পড়া, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিজ্ঞানকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। সাধারণের কাছে বিজ্ঞানের ক্রিয়াকলাপ হয়ে উঠেছে দুরূহ। বিভিন্ন পুঁজিবাদী শক্তির বা বলা ভালো প্রতিষ্ঠানের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট শুধু তৃতীয় বিশ্ব নয়, আমেরিকার মতো প্রযুক্তিগতভাবে আধুনিক দেশেও তৈরি করেছে এই বিজ্ঞান বিচ্ছিন্নতা। বিজ্ঞান-সংক্রান্ত পোস্ট-ট্রুথ, সিউডোসায়েন্স, ভুল তথ্য, গুজব তৈরি করেছে প্রায় দু-দশক ধরে আমেরিকায় চলা ‘anti-vaccine movement’-এর। অনুঘটকের কাজ করছে আমেরিকা সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে আসা একের পর এক অবৈজ্ঞানিক বিবৃতি। চিলড্রেন্স হসপিটাল অফ ফিলাডেলফিয়ার সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ পল ওফিট-এর জবানবন্দি — ‘Science has become just another voice in the room’। তাঁর গলায় একরাশ আক্ষেপ আর হতাশা, ‘It has lost its platform. Now, you simply declare your own truth’।
প্রথম বিশ্বে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির শিখরে পৌঁছানো আমেরিকার সাধারণ জনমানসের বিজ্ঞান বিচ্ছিন্নতা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে ভয়াবহ রূপ নেবে সেটাই স্বাভাবিক। বিগত কয়েক বছরে আমাদের দেশের রাজনীতির সর্বোচ্চ স্তর থেকে, শিক্ষা-নীতি প্রণয়নের সর্বোচ্চ স্তর থেকে একের পর এক অবৈজ্ঞানিক, সিউডো সায়েন্টিফিক বিবৃতি, ব্যাখ্যা এক নতুন মাত্রা ছুঁয়েছে। গণেশের শল্যচিকিৎসা, রাহু-কেতু-সূর্যগ্রহণ, ডারউইনের মতবাদকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া, সম্পূর্ণ প্রেক্ষিতহীন ভাবে কোয়ান্টাম শব্দকে ঘর-বাড়ি-ভূত-ভবিষ্যতের সাথে মিশিয়ে এক কিম্ভূতকিমাকার বিজ্ঞান-বিকৃতি, পুরাণ-ইতিহাস-বিজ্ঞান মিশিয়ে পুষ্পক রথের আদি-এরোডায়নামিক বিচিত্র ক্রিয়াকলাপ থেকে হালফিলের এন-সি-ই-আর টি-র সিলেবাস থেকে মুঘলদের ইতিহাস বাদ দেওয়া— লিস্ট বড়ো লম্বা। যথাযথ সংগত দিয়ে চলেছেন বিভিন্ন ‘মোটিভেশনাল আধ্যাত্মিক মনন’-রা। তাঁদের কারও কারও পোস্ট-ট্রুথ খুব সূক্ষ্ম, সাথে চোস্ত ইংরেজি, এক চামচ অপ্রাসঙ্গিক বৈজ্ঞানিক টার্মিনোলজি, দু-চামচ মাইথোলজি, আর ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা অজস্র মিথ্যা, ভুল তথ্যের স্বেচ্ছাকৃত নিরন্তর প্রক্ষেপণ — সিউডোসায়েন্স ও পোস্ট-ট্রুথের এক কমপ্লিট প্যাকেজ।
ভারতবর্ষ, সমসাময়িক রাজনীতি ও পোস্ট-ট্রুথ
অর্থনৈতিক মাপকাঠির নিরিখে দেখলে ভারতবর্ষের মাথাপিছু গড় আয় আমেরিকার এবং ব্রিটেনের মাথাপিছু গড় আয়ের যথাক্রমে ৩ ও ৪ শতাংশের চেয়েও কম। এই অর্থনৈতিক ভগ্নাবশেষ ও ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পোস্ট-ট্রুথের চরিত্র ও অভিমুখ স্বাভাবিকভাবেই অনেক আলাদা। বিবিসি নিউজের রিসার্চ উইং-এর এক সমীক্ষাপত্রে উঠে এসেছে আরও কিছু তথ্য। উগ্র জাতীয়তাবাদ উঠে আসছে ভারতবর্ষে ‘ফেক নিউজ’-এর মূল চালিকা শক্তি হিসেবে। এবং প্রথম বিশ্বের মতো শুধুমাত্র মানুষকে ভুল, বিকৃত তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো নয়, এই উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রান্তিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতি হিংস্র আক্রমণের জন্য সংগঠিত জনমত গঠন করেছে, করে চলেছে। ২০১৮-র ওই সমীক্ষা অনুযায়ী অন্তত ৩০ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে শুধুমাত্র ফেক নিউজ প্রভাবিত ভায়োলেন্সকে কেন্দ্র করে। মাইক্রোসফ্ট্-এর আর-এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ভারতবর্ষে জনসংখ্যার অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষ এই অনলাইন ‘ফেক নিউজ’-এর সাথে সরাসরি সংস্পর্শে এসেছেন, যা গ্লোবাল এভারেজের (৫৭%) চেয়েও বেশি। পরিস্থিতির চাপে হোয়াটস্যাপ-কে নতুন রেগুলেশন করে ফরোয়ার্ডেড মেসেজের প্রেরকের সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে হয়েছে সম্প্রতি।
পোস্ট-ট্রুথের দর্শন
ঐতিহাসিকভাবে সত্যি, মিথ্যে, অর্ধসত্য, আপেক্ষিক সত্য থেকে অল্টার-ফ্যাক্ট ও পোস্ট-ট্রুথের ক্রমবিবর্তন ধারা উপলব্ধি করতে প্রয়োজন পোস্ট-ট্রুথের দার্শনিক উৎস সন্ধান। অনেক গবেষক এই আপেক্ষিক সত্যের দার্শনিক উৎপত্তির কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন পোস্ট-মডার্ন তত্ত্বকে। পোস্ট-মডার্ন তত্ত্ব অবজেকটিভ রিয়েলিটির একরকম বিপরীত অবস্থান নিয়েই ব্যাখ্যা করে যে রাজনীতি এবং জনমত গঠনের ক্ষেত্রে মূল্যবোধ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও ভবিষ্যতের সামাজিক বিন্যাসের খতিয়ান ছাড়া শুধু অবজেকটিভ রিয়েলিটির ধারণা অনেকাংশে বিভ্রান্তিকর। এই প্রসঙ্গে ফ্রেডরিক নিত্চা (Nietzsche)-র চরমসত্য বা absolute truth সম্পর্কে সমালোচনার কথা উল্লেখ্য। তাঁর মতে, ‘there are no facts without interpretation, i.e. without selection, valuation, adoption, contextualisation, simplification, reduction of complexity, etc’। তবে interpretation বা বিশদ ব্যাখ্যা আর subjectivism বা আপেক্ষিকতার মধ্যে ফারাক সম্পর্কে তিনি সতর্ক করেছেন। এ গেল সত্যকে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখার, অনুভব করার দর্শন। অন্যদিকে আধুনিক পোস্ট-ট্রুথ মূলগতভাবেই শ্রোতা-নির্ভরশীল বা নির্দিষ্টভাবে শ্রোতার আবেগপ্রবণতা নির্ভর একটা phenomena। কমিউনিকেশন থিয়োরিস্ট ওয়াল্টার ফিশারের মতে, ‘we are predisposed to the emotional appeal of stories because we are ‘innate story-tellers’: Stories are the human way of making sense of things. Narrative structures are a device the human being uses to slot information into a meaningful form’. অর্থাৎ জাগতিক সমস্তকিছুর অর্থ অনুধাবন করতে আমরা সাধারণভাবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই গল্পের বা একটি ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারের আশ্রয় নিই। তাই কোনো সুবিন্যস্ত ন্যারেটিভ দেখে সংবেদনশীলভাবে আকর্ষিত হবার ঘটনাও আমাদের ক্ষেত্রে সহজাত। আর যেখানেই আবেগপ্রবণতার বাড়বাড়ন্ত সেখানেই ক্রিটিক্যাল থিংকিং ব্যাকসিট নিতে বাধ্য। ফরাসি দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী জঁ বদ্রিয়ার ‘hyperrealism’-এর কথা এ-প্রসঙ্গে উঠে আসবে। রিয়েলিটি এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, হিউম্যান ও আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর মধ্যে দোদুল্যমান এই হাইপাররিয়েলিজমে মানুষ তার বাস্তব এবং simulated বাস্তবের মধ্যে তফাত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তৈরি হয় ‘simulated reality’ বা অল্টারনেটিভ রিয়েলিটি। এর উদাহরণ তো আমার আপনার চারপাশে অজস্র। আমরা অনেকেই ভীষণ একা অথচ ভার্চুয়াল জগতে আমাদের অগুনতি বন্ধু।
সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের প্রান্তিক অবস্থানে থাকা মানুষদেরও পোস্ট-ট্রুথ গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। মার্কসবাদী ব্যাখ্যায় এই ঘটনাকে ‘false consciousness’ (প্রথম প্রয়োগ : György Lukács) বলে অভিহিত করা হয়। দার্শনিক, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস তাঁর ‘Economic and Philosophic Manuscripts of 1844’-এ এই ধাঁচের প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করেছেন প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার জন্য তার শ্রম বিক্রি ও শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হবার প্রেক্ষিতে। প্রান্তিক শ্রমিক শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে নিজের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য এবং নিজের শ্রমজাত বস্তু (product)-র মালিকানা কখনোই ভোগ করতে পারে না। ফলস্বরূপ নিজের সৃষ্ট বস্তু এবং স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্কগুলো থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে (alienation)।নিজের শ্রমজাত বস্তু যা বাজারে পণ্যে পরিণত হয় তা তার কাছে থেকে যায় অধরা, বিমূর্ত। এই বিচ্ছিন্নতা তার মধ্যে তৈরি করে সত্য মিথ্যার বিভ্রান্তি। সামাজিক সম্পর্ক, শোষণ সম্পর্কে তার মধ্যে তৈরি হয় ধোঁয়াশা। সামাজিক-অর্থনৈতিক-মানসিক প্রেক্ষিতে সে বিভ্রান্তি, মিথ্যে, অর্ধ-সত্যের সঙ্গে লড়াই করার সামর্থ্য হারায়। তার সমাজবাস্তবতা উলটে তাকে বিভিন্ন বিভ্রান্তি আঁকড়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য করে। ‘False consciousness’ তাকে ঠেলে দেয় পোস্ট-ট্রুথের অনন্ত গহ্বরে।
প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়া
পোস্ট-ট্রুথকে কাউন্টার করার পন্থা কী? হয়তো একটাই পন্থা, সত্যিকে প্রতিমুহূর্তে এবং বারংবার মানুষের সামনে তুলে ধরা। কোনো মিথ্যা যদি হাজারবার নিয়মিত প্রক্ষেপণে ‘অল্টার-ট্রুথ’-এর আকার ধারণ করে, তাহলে অবজেকটিভ ট্রুথকে তার চেয়েও বেশিবার নিয়মিত মানুষের কাছে পৌঁছানোর দায় এসে বর্তায় আমাদের কাছে।
তাই পোস্ট-ট্রুথের দুর্বার গতিকে রুখে দেবার লড়াইও থেমে নেই। লড়াই জারি আছে। এক ক্রমবর্ধনশীল ফ্যাক্ট-চেক ইন্ডাস্ট্রি ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে গোটা পৃথিবী জুড়ে। তৈরি হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট-চেকিং নেটওয়ার্ক (IFCN), যে প্রতিষ্ঠান উপদেশক এবং নিরীক্ষকের ভূমিকা পালন করছে গোটা পৃথিবীর সমস্ত ফ্যাক্ট-চেক নিউজ পোর্টাল ও ওয়েবসাইট সমূহের। আমাদের দেশে IFCN স্বীকৃত কিছু উল্লেখযোগ্য নিউজ পোর্টালের মধ্যে নাম আসবে Alt-News, Web-Qoof (The Quint) সহ আরও অনেক পোর্টালের। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৯-এ OpIndia নামক পোর্টাল IFCN দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
অপরদিকে ইউরোপে ‘ফেক নিউজ’-এর প্রভাব রুখতে জার্মানি এবং ফ্রান্সের মধ্যে ২০১৯-এর জানুয়ারিতে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তারও আগে জার্মানিতে ২০১৭-য় নেটওয়ার্ক এনফোর্সমেন্ট অ্যাক্ট নামে এক আইন প্রণয়ন হয় যার উদ্দেশ্য ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার ফেক নিউজ নিয়ন্ত্রণ। একইপথে ২০১৮-র ২০ নভেম্বর ফ্রান্সের ন্যাশনাল এসেম্বলিতে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হল ‘the law against the manipulation of information’। ২০১৮-য় ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন এক সাধারণ গাইডলাইন প্রকাশ করে ফেক নিউজের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে। তবে শুধু ফ্যাক্ট-চেক বা আইন প্রণয়ন হয়তো যথেষ্ট নয় এই ফেক-নিউজের বিপদ থেকে মুক্ত হবার জন্য। এ-এক বিষাক্ত ছোঁয়াচে রোগ। প্রবল গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের সামাজিক বাস্তুতন্ত্রে। নতুন প্রজন্ম কি তাহলে আর অবজেকটিভ ট্রুথ শুনবে না, জানবে না? বিজ্ঞানভিত্তিক সত্য কি ফুরিয়ে যাবে? তাদের বড়ো হয়ে ওঠা জুড়ে কি ঘিরে থাকবে আপেক্ষিক সত্যের মোহ? ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’?
তবু মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। লড়াই চলে সত্যিকে চেনানোর, জানানোর। ২০১৮-য় কেরালার কন্নুর জেলায় ১৫০টি সরকারি স্কুলের অষ্টম থেকে একাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে শুরু হয়েছিল এক ‘ফেক নিউজ’ শনাক্তকরণ ও সচতনতা বিষয়ক শিক্ষাদান। দেশে দেশে শুরু হোক এই সচেতনতার পাঠশালা। দিকে দিকে গড়ে উঠুক বৈজ্ঞানিক সত্যের ব্যারিকেড।
‘ক্যাটালগটা দেখো বরং, বলো পছন্দ কোন গড়ন’
অ্যালগরিদমের দৌরাত্ম্যে ওষ্ঠাগত মন। পোস্ট-ট্রুথের কবলে ভারাক্রান্ত মন। তবু শত ভারাক্রান্ত হয়েও এখনও ক্লান্ত হৃদয়ে প্রেম আসে। পরিচিতি অতিক্রম করে মানুষ আবার ভালবাসতে শেখে। বিভেদের সীমারেখা পেরিয়ে জীবনের উদযাপন করে কখনও। কিন্তু মনের মানুষ মেলে না সহজে। অস্থির মন চ্যাট-জিপিটিতে নিজের সমস্যার কথা লেখে। চ্যাট-জিপিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় খুঁজে চলে বাজারি তথ্যের ভান্ডার। খোলা বাজার অপেক্ষায় থাকে। ক্ষুধার্ত মনকে সরবরাহ করে কাস্টমাইজড পোস্ট-ট্রুথ। ক্ষুধার্ত মন ক্যাটালগে মনোনিবেশ করে। ফেসবুক, হোয়াটস্যাপের গ্রুপ মেসেজ, স্ট্যাটাসে নজর রাখে। জ্ঞানের দৈন্যতা ঢাকতে ডেটার বিস্ফোরণ ঘটানো হয় মগজে। তাই মন কখনও খতরে মে, কখনও দুর্বল, কখনও প্রতিবেশীকে লিঞ্চ করে আসা ধর্মযোদ্ধা, আবার এই মনই দিনের শেষে পোস্ট-ট্রুথের বাহক। মন একইসাথে খাদ্য এবং খাদক। অসহায় এবং প্রতিক্রিয়াশীল। শিকার এবং শিকারি। এই ডায়ালেক্টিক্সের মধ্যে থেকেই আমাদের অল্টারনেট ‘সত্যের’ গহ্বরে অনন্ত অভিসার।
এই চক্রব্যূহ ভাঙতে প্রয়োজন বস্তুনিষ্ঠ সত্যের চর্চা এবং তার সংঘবদ্ধ প্রয়োগ।মনে রাখা প্রয়োজন, ‘Passivity is not a neutral act, it’s a conscious decision to allow the state’s judgement — DEMAND THE TRUTH’। অটোমেশনের দুর্বার ম্যানিপুলেশন আটকাতে প্রয়োজন সামাজিক প্রত্যাঘাত। প্রয়োজন এক মন থেকে আর-এক মনের সরাসরি যূথবদ্ধতা। সত্যনিষ্ঠ মনের সহজ, সামাজিক ব্যাপ্তি কন্ট্রোল করুক অ্যালগরিদমের গতিবেগ। অ্যালগরিদম নয়, মনই খুঁজে পাক মনের মিছিল, মনের মানুষ।
তথ্যসূত্র :
১. https://www.amazon.com/Post-Truth-New-Truth…/dp/1785036874
২. https://www.youtube.com/watch?v=LceVAOiVGgg
৩. https://www.nbcnews.com/…/fake-news-how-partying…
৪. http://downloads.bbc.co.uk/…/duty-identity-credibility.pdf
৫. Marx, K. (1932/2009). ‘Economic and Philosophic Manuscripts of 1844’. (http://www.marxists.org)
৬. Larsson, J.. ‘False consciousness revisited : On Rousseau, Marx and the positive side of negative education’. (2011)
৭. Heit, H. (2018). “there are no facts. . . ”: ‘Nietzsche as Predecessor of Post-Truth?’. Studia Philosophica Estonica, 11, 44-63
৮. Jayson Harsin, ‘Post-Truth and Critical Communication’, 10.1093/acrefore/9780190228613.013.757 Oxford Research Encyclopedia of Communication
৯. Reinhoud, E.L., ‘The Post-Truth Era : Crises of Truth in (Post-)Postmodern Literature’ (2019) (Master thesis), https://dspace.library.uu.nl/handle/1874/384022
১০. https://www.twitterandteargas.org/
১১. Festinger, L. (1957). ‘A theory of cognitive dissonance’. Stanford University Press