সাহানাজ রেজা ও ইমরোজ নাওয়াজ রেজা
একেক সময় মনে হয় ফিরেই যাই; আবার মনে হয় দাঁতে দাঁত চেপে এই অসহ্য সময়টাকে নিশ্চয়ই পেরিয়ে যেতে পারব একদিন। আবার মনে হয়, পেরিয়ে যাবার পর? অপার শান্তি? নাকি এক সমুদ্র থেকে আর-এক সমুদ্রের উপকণ্ঠে কেবল অনিশ্চিত আমাদের এই যাপন?
গোড়ার কথা
ভারতের বিদেশমন্ত্রকের প্রাক্-কোভিড পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩.২১ কোটি ভারতীয় দেশের বাইরে বসবাস করেন। তারমধ্যে ১.৪৭ কোটি ইতিমধ্যে সেই সব দেশে পাকাপাকিই বাস করেন (People of Indian Origin – PIO); তাঁদের কেউ কেউ হয়তো শিকড়ের টান ছিঁড়েছেন, কেউ কেউ আবার হয়তো Overseas Citizenship of India (OCI)-আওতাভুক্ত। বাকি ১.৩৫ কোটি পাসপোর্টধারী পৃথিবীর নানান দেশে ছড়িয়ে আছেন অনাবাসী ভারতীয় হিসেবে, সাদা বাংলায় যাদেরকে বলা হয় — NRI – Non Residential Indian। শতকরা হিসেবে যেটা ১ শতাংশ এই ১৪০ কোটির দেশে; এবং সংখ্যাটা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, বিশেষত এই বিগত কয়েক বছরে। বিদেশমন্ত্রক জানাচ্ছেন প্রতিবছর ২৫ লাখ মানুষ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন এখন (অবশ্যই অনেকে ফিরেও আসছেন) এবং সারা পৃথিবীর যে-কোনও দেশের প্রেক্ষিতে এটাই সর্বোচ্চ।
পরিসংখ্যান ঘাঁটতে বসলে আরও অনেক চমকপ্রদ তথ্যই উঠে আসছে, কিছু চিন্তা উদ্রেককারী, কিছু স্বস্তিদায়ক হয়তো — কিন্তু এই পরিসংখ্যানের বাইরে চোখ মেলে তাকালে — কিংবা বলা যায় — এই ছক্কা-পাঞ্জার হিসেবের কচুরিপানার সরের আড়াল ঠেলে মানুষগুলোর দিকে যদি তাকাই — যদি সংকোচ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলি — ‘কেমন আছো হে প্রবাসী, হে প্রবাসিনী’? বলে ফেলবেন তাঁরা তাঁদের সুখ-দুঃখের সাতকাহন? বলে ফেলবেন আলো অন্ধকারের দোলাচলে ঠিক কেমন সুরেলা তাঁদের এই পরিব্রাজন?
কেমন আছো হে?…
চিত্র-১: তরুণ নবদম্পতি বিয়ের কিছুদিন পরপরই নতুন সংসার আর নতুন কর্মজীবনের স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন ভিন্নদেশে। দু-চোখে নতুন জীবনের অহংকার, পাশে মনের মানুষ। কিন্তু কী যে নেই; কী যে নেই সেটাই সবসময় বোঝা যায় না। চেনা মুখ? বন্ধুরা? চেনা ভাষা? চেনা আলো-চেনা অন্ধকার? চেনা রুটি, বিস্কুট, চেনা চেনা চায়ের গেলাস? শরীর খারাপ হয় মাঝে মাঝেই- পেটে ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা। সকাল বিকেল ডাক্তারের কাছে যাওয়া যেন পরিণত হয় প্রাত্যহিক অভ্যাসে। মনে হয় যেন আবহাওয়ার দোষ, কখনো দোষারোপের আঙুল ওঠে খাবারের দিকে — এমনি করে কাটতে থাকে দিন।
চিত্র-২: ‘জানো ৩৫ বছর আগে আমি যখন এই দেশে এসেছিলাম, তখন খুব কান্না পেত। শুরুতে কোনও বাঙালির মুখ দেখিনি গত ৫ বছর। তারপর একদিন ভারতীয় দূতাবাসে এক বাঙালিকে পেয়ে; অচেনা সেই মানুষকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদেছিলাম’ — এই গল্প শুনিয়েছিলেন আমাদের প্রবাসীজীবনের এক বয়োজ্যেষ্ঠ দিদি।
এমনই নানান গল্প দেশে-বিদেশের প্রবাস জীবনের মনের কোণে কোণে। সেই গল্পগুলোর স্তরবিন্যাস করতে গিয়ে নানা মনের নানা রঙের দ্বন্দ্বের চালচিত্র খুঁজে পাই আমাদেরই ব্যক্তিগত জীবনের নানান অভিজ্ঞতায়।
প্রবাসীর মন-চিত্র
মানুষের আদিপুরুষের সন্ধান পাওয়া যায় ২৫ লাখ বছর আগে আফ্রিকায়। তারও প্রায় ২০ লাখ বছর পর আসে আমাদের পূর্ব-পুরুষ Homo Sapience। সেই সেপিয়েন্স তারপর ২ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীময় ঘুরেই বেড়াল — তাদের নিজস্ব আবাস কিছু ছিল বলে মনে হয় না। তাদের সত্যিকারের আবাস তৈরি হল মাত্র ১২ হাজার বছর আগে কৃষির সূত্রপাত থেকে। শিকারী মানুষ, জঙ্গলাচারী মানুষ নিজস্ব জমি ব্যবহার করতে শিখল, মানুষ থিতু হল।
তবু সেই রক্ত বুকে নিয়ে মনমোহন মিত্রের মতো কেউ কেউ ঘুরে বেড়ান সারা পৃথিবী, সত্যজিৎ তাঁর ছবি এঁকেছেন আগন্তুক-এ। তাঁদেরকে কখনো ঠিক প্রবাসী বলা যায় কি? স্বদেশ-প্রবাসের পাটিগণিত থেকে তাঁদেরকে বাদ দেওয়াই যাই। তাঁরা বিশ্ব-নাগরিক, বিশ্ব-পথিক; এবং সংখ্যায় নিশ্চিত ভাবেই কম। সংখ্যায় বরং ভারী, যাঁরা অল্পসময়ের জন্য বিদেশ যাচ্ছেন — কাজ সেরে বা বেড়িয়ে ফিরেও আসছেন। মনের টানাপোড়েন তাঁদের কম, নেই বলাই চলে — কেননা ফিরে আসার নিশ্চিত দ্যোতনা নিয়েই তাঁরা ঘর ছাড়ছেন।
তৃতীয় ভাগে যদি রাখি ফিরে না-আসার কঠোর প্রতিজ্ঞাধারী ভীষ্মদের? প্রবাসকেই তাঁরা আবাস বানাচ্ছেন। সে পথ কখনো আপাত সহজ — কখনো অনেক চড়াই-উতরাই-এর নুড়িবেছানো। তবু সে মন লক্ষ্যে স্থির।
চতুর্থভাগে আমাদের NRI বন্ধুরা। হয়তো দীর্ঘদিনের প্রবাসী — তবু মনের মধ্যে পুষে রাখেন ঘরে ফেরার গান। তাঁদের উত্তরসূরিরা হয়তো বড়ো হচ্ছে নতুন পরিবেশে। এদিকে তাঁরা? শ্যাম রাখবেন না কুল? তাঁরা হয়তো প্রতিনিয়ত সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিতে চান নিজেদের শিকড়ের সাথে — ফেলে আসা এক সংস্কৃতির সাথে — সেই খাদ্যাভ্যাস, আচার, রীতিনীতি। এদিকে নতুন প্রজন্ম, তারা তো ওদেশি-ই, তরতরিয়ে বেড়ে উঠছে প্রবাসী জলহাওয়ায়। সেইটাই তাদের আপন। বর্তমানটাই তাদের কাছে নিজস্ব বাস্তব — reality; বাবামায়ের ফেলে আসা কাল তাদের কাছে অলীক fantasy। এই দুই জগতের টানাপোড়েন সমানভাবে মানসিক যন্ত্রণায় ফেলে হয়তো এই দুই প্রজন্মকেই। তৈরি কি হয় না মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব? সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব? প্রথম প্রজন্ম যখন তীরে তরি লাগানোয় ব্যস্ত, পরের প্রজন্ম কি বেশি ঝুঁকে পড়ছে নেশায়? পরিসংখ্যানের ঈঙ্গিত সে দিকেই। সন্তানের মেজাজ-মর্জির তল পাচ্ছেন না অভিভাবকরাও। আগের বা পরের প্রজন্ম কি কখনো ভাগ করে নিতে পারছেন এই দোলাচল তাদের আপনজনের কাছে, বন্ধুদের কাছে, আত্মীয়দের কাছে? না হলে বারবার, সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়?!
এখন সময়
প্রবাস জীবনের মানসিক নানা সমস্যার আর-এক কারণ চোখে পড়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে। অনেকেই বছরের পর বছর দেশে বা পরিচিত, বন্ধু-বান্ধবের কাছে ফিরতে পারেন না, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণেই। ঘন ঘন যাতায়াতের খরচ বা ছুটির সমস্যা — অনেকেই সেটা সচেতন ভাবেই কমাতে চান। তাই দাঁতে দাঁত চেপে তাঁদের একলা ঘরে এই একলা চলার অভ্যেস।
এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অনেক কোম্পানিই ‘resource’ পাঠায় ‘onsite’-এ। তাঁদের অনেকেই যান সপরিবারে, অনেকেই হয়তো একা। তাঁরা প্রাথমিক থিতু হবার সময়টুকু ছাড়া কি ভুগতে থাকেন কিছুটা মানসিক অবসাদে, তাঁদের সেই হঠাৎ একা হয়ে যাবার প্রস্তুতিকালে? কেউ কি হয়ে যাচ্ছেন অতিরিক্ত পানাসক্ত, অথবা চলে যাচ্ছেন শারীরিক কোনও সম্পর্কের দিকে — সাময়িক মুক্তির সন্ধানে? হাতে অর্থ আছে (আমেরিকার সরকারি নথি অনুযায়ী ২০২১ সালে আমেরিকায় বসবাসকারী ভারতীয়রা অন্যান্য দেশীয় প্রবাসীদের তুলনায় দ্বিগুণ আয় করেন!), ছুটিও আছে কিঞ্চিৎ, শুধু — ছাতের মাদুর নেই, চপ-মুড়ি নিয়ে আসা ছোটোবেলার বন্ধুটি নেই। কেউ কেউ তারই মধ্যে মনের মানুষ খুঁজেও নেন, ঘর বাঁধেন, নিদেন পক্ষে Live Together। শিকড়ের টান ক্ষীণ হতে থাকে, কিন্তু মনের মধ্যে জীবন্ত আসা-যাওয়ার মাঝে প্রবাসী মনের টানাপোড়েন।
অথবা যারা student visa-তে পড়তে যান, সেই সব ছাত্র-ছাত্রীরা? নতুন জায়গা, নতুন বন্ধুরা, পড়াশোনার চাপ, খরচের চাপ, উপরি পাওনা career-এর দুশ্চিন্তা। হিসেব করে খরচ, হিসেব করে পা ফেলা। বিনোদন নেই, কিংবা থেকেও নেই — অনেকেই কি ডুবে যাচ্ছে না হতাশায়? কখনো কি নিয়ে ফেলছে না চরম কোনো সিদ্ধান্ত? International Student Barometer (ISB)-র ২০২২-এর সার্ভে অনুযায়ী এক-তৃতীয়াংশ বিদেশি ছাত্র মনে করে যে তারা stressed, ৪২ শতাংশ এটাও মনে করে যে তারা তাদের পড়াশোনা শেষ করতে পারবে না। দুঃখের কথা, এদের মধ্যে মাত্র ১৬ শতাংশ কাউন্সিলিং-এর সাহায্য নিচ্ছে। আনন্দের কথা তবু এই, তাদের মধ্যে আবার ৮৯ শতাংশই তাতে উপকার পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
শেষের কথা
আবহমান এই চলাচলের হিসেব-নিকেশের মধ্যেই মানুষ ঘর থেকে পথে নামেন— গৃহী হন পথিক — পথিক খুঁজে নেন নিজস্ব ঘর। গ্রামীণ খোলা হাওয়ায় বড়ো হওয়া মানুষ শহুরে চাকরিতে হয়ে পড়েন প্রবাসী — নিজের দেশেই। কিংবা জীবন সায়াহ্নের একাকিত্বে নিজের গড়া ঘরই কারোর কারোর কাছে পরবাস হয়ে ওঠে। ভালোবেসে বিয়ে করে ঘর ছাড়া নারীর সারাজীবন কখনো আবার একটি নিজস্ব ঘরের অন্বেষণ। কিংবা নিজের দেশই কখনো আবার নাগরিকদের বিদেশি তকমায় ক্রুশবিদ্ধ করে। নিজস্ব একটু মাটির জন্য — নিজস্ব একটা দেশের জন্য— নিজস্ব আবাসের জন্য তাই মানুষের আবহমান এই যাত্রা।
অন্যদিকে শুধুই সীমানা নির্দেশিকা। দেশের সীমানা, জাতের সীমানা, বর্ণের সীমানা, লিঙ্গের সীমানা, একাকিত্বের সীমানা। নানা সীমানার ওড়না জড়িয়ে চারদেওয়ালের ঘেরাটোপে ছোটো ছোটো মানুষ বেঁচে থাকেন ছোটো ছোটো মানসিক টানাপোড়েনে।
পৃথিবী কি সে-সব মনে রাখে? নতুন মানুষের নতুন যাত্রা শুরু হয় — দেশ, কাল, মনের সীমানা ছাড়িয়ে।
তথ্যসহায়িকা :
1. Ministry of External Affairs (Govt of India) — https://mea.gov.in
2. US Citizenship and Immigration Services — https://uscis.gov
3. International Consultants for Education and Fairs — https://monitor.icef.com
4. https://psychologytoday.com
5. U.S. Census data for social, economic and health research — https://us.ipums.org/usa
6. International Student Barometer — https://www.i-graduate.org/international-student-barometer
7. Substance use and Immigrant Youth — https://kidsnewtocanada.ca/mental-health/substance-use
8. Addiction And Refugees And Immigrants — https://www.addictioncenter.com/addiction/refugees-immigrants/
9. ‘Sapiens : A Brief History of Humankind’ book written by Dr. Yuval Noah Harari