প্রবীণ মনের সুখ-অসুখ

রক্তিম ঘোষ

কথায় বলে — বার্ধক্যের বারাণসী, ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আমাদের শিখিয়েছে প্রবীণ মানুষকে শ্রদ্ধা করতে। কিন্তু বর্তমান সময় চারপাশে তাকিয়ে দেখলে সেই শ্রদ্ধা, সেই সম্মান কোনোখানেই দৃশ্যমান নয়। সংসারে অবাঞ্ছিত ও লাঞ্ছিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বৃদ্ধাশ্রমের চার দেওয়ালে বন্দি অথবা সন্তানদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন — এ এক অতি পরিচিত চিত্র। কিন্তু কেন এমন হল? তবে কি বাজারি অর্থনীতির নাগপাশে প্রবীণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত? নাকি সেই চরম অনৈতিক অর্থনীতির শর্তগুলি মানতে না-পেরে বয়স্ক মানুষ আজ সমাজে ও সংসারে ব্রাত্য? ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ রামকানাইয়ের চরিত্র চিত্রণের মধ্যে দিয়ে প্রবীণ মানুষের যে অসহায়তার বর্ণনা দিয়েছেন তাই কি আজ সমাজের প্রতিটি স্তরে পল্লবিত হয়ে বিষবৃক্ষের আকার নিয়েছে? চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের জীবনকাল বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই এখন বয়স্ক মানুষকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে —

ক) Young-old অর্থাৎ তুলনামূলক ভাবে কমবয়স্ক বৃদ্ধ যাঁদের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৭৪ বছর। 

খ) Old-old অর্থাৎ তুলনামূলক ভাবে অধিক বয়স্ক বৃদ্ধ যাঁদের বয়সসীমা ৭৫ বছরের বেশি।

গ) Oldest-old অর্থাৎ অত্যন্ত বেশি বযস্ক যাঁরা ৮৫ বছরের বেশি বয়স। অনেকে আবার বয়স্ক মানুষকে সুস্থ প্রবীণ এবং অসুস্থ প্রবীণ — এই দুটি ভাগে বিভক্ত করেন।

বয়স্ক মানুষ ও মস্তিষ্ক 

  • বয়সের সাথে সাথে মস্তিষ্কের পরিবর্তন ঘটে যেমন — মস্তিষ্কের ওজন কমে আসে।
  • মস্তিষ্কের খাঁজগুলি গভীরতর হয়, উঁচু জায়গাগুলি হ্রাস পায়, ভেণ্টিকেলগুলি বড়ো হয়ে ওঠে।
  • মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন হ্রাসপাপ্ত হয়।
  • স্নায়ু রাসায়নিক ক্ষেত্রেও বিভিন্ন তারতম্য ঘটে।

কম বয়েসির দৃষ্টিভঙ্গি

এ-সময় নতুন কিছু শিখতে বেশি সময় লাগে, কিন্তু তা অসম্ভব নয়, বুদ্ধাঙ্ক (IQ) ৮০ বছর অবধি অপরিবর্তিত থাকে; বাচিক ক্ষমতারও ঘাটতি হয় না; কিন্তু কাজকর্ম করবার দ্রুততা কমে আসে; পুরানো কথা মনে করতে অসুবিধা হয়; যেসব কাজে মনোযোগ বারবার একটি বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে নিয়ে যেতে হয় সেই সব কাজে অসুবিধা হতে পারে; মস্তিষ্কের কোশগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং যদি তা অত্যন্ত বেশি পরিমাণে হয় তখন চিত্তভ্রংশতা বা Dementia দেখা যায়। ‘Ageism’ — এই শব্দটির স্রষ্টা রবার্ট বাটলার। তিনি এই শব্দটির নঞর্থক প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। বয়স্ক মানুষের প্রতি তরুণ প্রজন্মের যে বৈষম্যমূলক ব্যবহার এবং নঞর্থক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তা সর্বকালে, সর্বদেশে বিদ্যমান। স্বাস্থ্যের অবনতি, সাধারণ ভুলত্রুটি, নিঃসঙ্গতা, দুর্বলতা প্রভৃতির প্রতি সাধারণ সক্ষম সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা অত্যন্ত নেতিবাচক এবং তা এই বয়স্ক, জ্ঞানী মানুষগুলির বেদনার কারণ হয়ে পড়ে। আসলে কোন মানুষ ঠিক বৃদ্ধ হয়েছেন তার ধারণা করা অত্যন্ত কঠিন কারণ বহু বয়স্ক মানুষ সমান কর্মক্ষম ও সৃষ্টিশীল। তাঁদের অভিজ্ঞতা যা আপাত-তরুণ প্রজন্মকে ঋদ্ধ করতে পারত, তাকে অবজ্ঞা করে বহুক্ষেত্রে আমরা ভুল করে ফেলি।

শারীরিক ভাবে সুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সচরাচর পূর্বেকার সামাজিক সংযোগ ও কর্মব্যস্ততা বজায় রাখেন। এই বয়সে মননশীলতা অক্ষুণ্ণ থাকে, আবেগ ও মনস্তত্ত্বের দিকটিও অটুট থাকে। শারীরিক অসুস্থতা বা প্রিয়জন ও প্রিয়সঙ্গী ও সঙ্গিনীর মৃত্যু এক অভাববোধ সৃষ্টি করে, কিন্তু মন সেই অপ্রাপ্তিকে মেনেও নেয়। কখনও কখনও নিঃসঙ্গতা অবসাদের জন্ম দিতে পারে, তাই সামাজিক সংযোগ, মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখা বিশেষ প্রয়োজন। তরুণ প্রজন্মের সাথে যোগাযোগটিও একান্ত প্রয়োজন। উভয়েই উভয়ের ভ্রান্তি অপনয়ন করতে পারে, নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বৃদ্ধ বয়সের অসাড়তা থেকে মুক্তি দেয়, আবার তরুণ প্রজন্মও বয়স্ক মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের ঋদ্ধ করে। তাই এই বয়সের সম্ভাবনা অনেক, প্রয়োজন গুরুতর এবং পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এঁদের অবদান অনস্বীকার্য।

আসুন এরপর আমরা দেখি এই বয়সের মানসিক সমস্যাগুলি কেমন।

এগুলি হল —

  • Dementia বা চিত্তভ্রংশতা।
  • Depression বা অবসাদ ও আত্মহননেন প্রবণতা।
  • Schizophrenia ও ভ্রান্ত চিন্তার সমস্যা।
  • উদ্‌বেগ/ উৎকন্ঠা ও অমূলক ভীতি।
  • বাতিকের রোগ বা Obsessive Compulsive Disorder।
  • শারীরবৃত্তীয় সমস্যা বা Somatic Symptom Disorder।
  • মদ এবং অন্যান্য মাদকের আসক্তি।
  • নিদ্রাজনিত সমস্যা।

এর মধ্যে যে সমস্যাটি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার প্রয়োজন তা হল চিত্তভ্রংশতা, যা নিয়ে আমরা সবশেষে আলোচনা করব।

অবসাদ বা বিষণ্ণতা 

সব বয়সের মতো প্রবীণ মানুষের ক্ষেত্রে বিষণ্ণতা অতি গুরুত্বপূর্ণ এক মানসিক সমস্যা। স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যু, একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা, দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যা যেমন উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যা, ডায়াবিটিস, হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা প্রভৃতির কারণে এ বয়সে বিষণ্ণতা দেখা যায়। সন্তান-সন্ততিরা ভিন দেশে বা দূরদেশে বসবাস করলে বাড়ি খালি হয়ে যায় তাকে বলে Empty Nest Syndrome। এই বয়সের অবসাদ বারংবার ফিরে আসে। প্রবীণ মানুষের অবসাদের লক্ষণগুলি হল — মন খারাপ লাগা, সমস্ত কাজে অনীহা, চোখে জল এসে যাওয়া, অনিদ্রা বিশেষত ভোররাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া, ভীষণ অরুচি ও অখিদে, ওজনের ঘাটতি, কর্মক্ষমতার অভাব, মনোসংযোগের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, বারবার একই ভাবে রোগের কথা বলা যা বাড়ির লোকের কাছে অত্যন্ত বিরক্তির কারণ হয়; শারীরিক ও শারীরবৃত্তীয় সমস্যার উপর অহেতুক গুরুত্ব দেওয়া, হীনম্মন্যতাবোধ, অক্ষমতা ও আশাহীনতা, নিজেকে অনর্থক দোষারোপ করা ও আত্মহত্যার প্রবণতা ও চিন্তা। চিন্তনের স্তরে অনেকক্ষেত্রে বিষণ্ণ মানুষের মধ্যে স্মৃতিভ্রংশতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু তা আসলে Pseudodementia বা ছদ্মচিত্তভ্রংশতার যা অবসাদনাশী ওষুধের সাহায্যে কমানো যায়। বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। একাকিত্ব, আর্থিক অনটন, শারীরিক বোগব্যাধি ইত্যাদি আত্মহত্যার প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে।  বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী আত্মহত্যার প্রয়াসে একমাসের মধ্যে কোনও ডাক্তারের কাছে যান কিন্তু অনেকক্ষেত্রে বাড়ির লোকজন এমনকি ডাক্তারবাবুও আত্মহত্যার প্রবণতাটি চিনে নিতে ব্যর্থ হন। সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলি যেমন কোনও ঘটনা বা চাপ, বারবার একই শারীরিক সমস্যা ও ব্যথাবেদনার দীর্ঘস্থায়িত্ব, উইল করার ইচ্ছা, ঘুমের ওষুধ সংগ্রহ করার প্রবণতা, অত্যন্ত আশাহত কথাবার্তা, তীব্র অপরাধবোধ, জীবন থেকে আর কিছুই পাওয়ার নেই — এই ধরনের লক্ষণগুলি দেখা গেলে অবশ্যই সাবধান হওয়া দরকার। আসলে এটা এমন একটা বয়স যখন মানুষ শরীরে ও মনে অনেকটা একা হয়ে পড়েন, বহির্বিশ্বের থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত ও বিপন্ন। অবসাদনাশী ওষুধগুলি খুবই সাহায্য করে অবসাদের চিকিৎসায় তবে সাথে সাথে একটু সহানুভূতি বা সমানুভূতির প্রয়োজন আছে বই-কি। দেখা গেছে দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক অসুখে যাঁরা আক্রান্ত তাঁদের মানসিক অবসাদের পরিমাণও বেশি। রক্তচাপের সমস্যা, হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা, শ্বাসকষ্টের অসুখ, স্ট্রোক, ক্যানসার, ডায়াবিটিস বা আর্থ্রাইটিস রোগীদের বেশ বড়ো সংখ্যক অবসাদেরও শিকার। আবার যেমন, হার্ট-অ্যাটাক থেকে অবসাদ দেখা যায়, মানসিক অবসাদ থেকেও হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা হতে পারে। একই কথা সম্ভবত ডায়াবিটিস সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। সেরিব্রাল স্ট্রোকের রোগীদের বিষণ্ণতা বেশি দেখা যায় — আজকাল তাই Vascular Depression শব্দবন্ধটি চালু হয়েছে। Parkinson Disease-এর ক্ষেত্রেও মানসিক অবসাদ অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত। এ-সময় দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি হ্রাস পায় আর তার থেকেই আসতে পারে অবসাদ ও সন্দেহের প্রবণতা। কিছু কিছু ওষুধপত্র যা এ-বয়সে নিত্য ব্যবহার্য, ক্যানসার থেরাপি বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধও অবসাদ ডেকে আনতে পারে। তাই অবসাদের মোকাবিলায় শুধুমাত্র ওষুধ নয়, সাইকোথেরাপি ও সর্বাঙ্গীণ চিকিৎসার প্রয়োজন। দ্বিমেরু আবেগের রোগ বা Bipolar Disorder-এর একদিকে যেমন অবসাদ, উলটোপিঠে Mania। এসময়ে রোগীর মধ্যে অনাবশ্যক অস্বাভাবিক প্রফুল্লতা, উত্তেজনা ও অনিয়ন্ত্রিত উল্লাস দেখা যায়। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগটির শুরু কম বয়সে, কিছু ক্ষেত্রে বেশি বয়সেও আরম্ভ হতে পারে Bipolar Disorder। অতিরিক্ত ও অতিরঞ্জিত কথা বলা, নিদ্রার প্রয়োজন অনুভব না-করা, অত্যধিক ক্ষুধাবোধ, জিনিসপত্র বিলিয়ে দেওয়া ইত্যাদি দেখা যায়। এছাড়াও চটজলদি বিরক্তিভাব, সন্দেহ প্রবণতা, কখনও কখনও আচ্ছন্ন ভাব ও উত্তেজনা মিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি আসতে পারে। অবসাদনাশী ওষুধ, পারকিনসন রোগের ডোপামিন বৃদ্ধিকারী ওষুধ, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ, রেচনতন্ত্রের সমস্যা, কিডনির ডায়ালিসিস, বড়ো অস্ত্রোপচার, স্নায়ুতন্ত্রের কোনও বড়ো ধরনের অসুখ ইত্যাদির পরও অল্প প্রকাশিত ম্যানিক দশা বা Hypomania দেখা যেতে পারে।

সিজোফ্রেনিয়া প্রধানত তরুণ বয়সের সমস্যা। শতকরা ৯০%-এর পঁয়তাল্লিশ বছরের নীচেই শুরু হয়, কিন্তু অন্তত ১০%-এর আরম্ভ বেশি বয়সে। তুলনামূলক ভাবে মহিলাদের মধ্যেই এই সময় সিজোফ্রেনিয়া আরম্ভ হতে দেখা যায়। সন্দেহ প্রবণতাই এর প্রধান লক্ষণ, অনেকে তাঁর ক্ষতি করতে চাইছে, তাঁকে নিয়ে অচেনা লোকে আলোচনা করছে, খাবার বা জলে কিছু মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে এইসব লক্ষণ দেখা যায়। কম বয়সি রোগীরা যখন বেশি বয়সে পৌঁছান তখন তারা আবেগ শূন্য হয়ে পড়েন অর্থাৎ একটা ভোঁতাভাব দেখা যায়, সামাজিকভাবে গুটিয়ে যেতে থাকেন, অদ্ভুত ব্যবহার করেন এবং অবাস্তব চিন্তা করেন। সাধারণত যেসব ওষুধের সাহায্যে স্কিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা হয় এক্ষেত্রেও সেগুলিই উপকারী, যদিও ওষুধের পরিমাণ কম রাখতে হয়। প্রবীণ মানুষের মধ্যে একধরনের ভ্রান্ত চিন্তা যা Delusional Disorder দেখা যেতে পারে যাকে Paraphrenia বলা হয়। এক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে সন্দেহপ্রবণতা দেখা যায় যে, চারপাশের সকলে তার ক্ষতি করতে উদ্যত। কেউ কেউ আবার মনে করেন যে এই রোগটি আসলে স্কিজোফ্রেনিয়ার একটি বিশেষ ধরন যার প্রথম প্রকাশ ঘটে ৬০ বছরের পর।

মানসিক উদ্‌বেগ, উৎকণ্ঠা বা আতঙ্কের অসুখ যদিও কম বয়সেই বেশি দেখা যায় তবুও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও যথেষ্ট পরিমাণে আক্রান্ত হন। মহিলাদের মধ্যেই এর প্রকোপ বেশি এবং যদিও ফোবিয়া বা অমূলক ভীতির লক্ষণগুলি কম পরিমাণে দেখা যায় তবুও বয়স্ক মানুষরা কিন্তু এতে যথেষ্ট অসুস্থ হয়ে পড়েন। বযস্ক মানুষকে মৃত্যুচিন্তার সম্মুখীন হতে হয় এবং কখনও কখনও এই চিন্তার ফল হিসাবেও উদ্‌বেগ, উৎকন্ঠা ও  হতাশা দেখা যায়। PSTD বা Post Traumatic Stress Disorder হল এমন এক রোগ যেখানে অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও ভীতিপ্রদ ঘটনার স্মৃতি বহুদিন পরে স্বপ্নে ও বাস্তবে বারংবার তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি করে— বন্যা, যুদ্ধ, ভূমিকম্প বা দুর্ঘটনার স্মৃতি সুদূর প্রসারী ফলাফল তৈরি করে। শারীরিক অক্ষমতার কারণে বয়স্ক মানুষ কমবয়সিদের থেকে বেশি পরিমাণে প্রভাবিত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়। বাতিকের অসুখ বা Obsessive Compulsive Disorder-ও অনেক সময় কম বয়সে শুরু হয়ে প্রবীণ বয়সেও চলতে থাকে। আবার বয়স্ক মানুষের মধ্যেও প্রাথমিক ভাবে লক্ষণগুলি দেখা যায়। শুচিবায়ুগ্রস্ততা, একই কাজ বারবার করতে থাকা, নির্দিষ্ট নিয়মাবলি মেনে চলা, নিয়মকানুনের ব্যাপারে একেবারে একগুঁয়ে হয়ে থাকা— এমন সব লক্ষণ দেখা যায়। শুচিবায়ুগ্রস্ত বিধবা মহিলাদের অমর করে রেখেছেন বিমল মিত্র তাঁর ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর বড়বৌয়ের মধ্যে এবং আশাপূর্ণা দেবী তাঁর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’-র মোক্ষদার মধ্যে। নিদ্রাজনিত সমস্যাও এই বয়সের বৈশিষ্ট্য। ঘুমের অভাব, দিবানিদ্রা, দিনের মধ্যে ঝিমুনিভাব এবং ঘুমের ওষুধের অত্যধিক ব্যবহার এই সময় দেখা যায়। নিদ্রাজনিত সমস্যার বৃদ্ধি ঘটায় বিভিন্ন ব্যথা বেদনা, শ্বাসকষ্ট, অম্বলের ভাব বা রাতে বারবার প্রস্রাব পাওয়া। খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে ঘুমের ওষুধের অপরিকল্পিত ব্যবহার না-ঘটে যায়। সুরা বা অন্যান্য মাদকাসক্তিও এই বয়সে লক্ষণীয়, সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন শারীরিক রোগব্যাধি।

চিত্তভ্রংশতা (Dementia)

চিত্তভ্রংশতা (Dementia) নিশ্চিতভাবেই বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মানসিক সমস্যা। মানুষের মস্তিষ্কে Cortex এবং তার নীচে Subcortex আছে। এর মধ্যে কোথায় সমস্যার সূত্রপাত তার ভিত্তিতে নির্ণীত হয় Dementia।

Subcortical Dementia দেখা যায় Parkinson’s Disease, Huntington’s Disease এবং Vascular Dementia-র ক্ষেত্রে। Cortical Dementia দেখা যায় Alzheimer’s Disease-এর ক্ষেত্রে।

অন্তত ১০-১৫% ক্ষেত্রে Dementia এমন সব কারণে হয় যা চিকিৎসার সাহায্যে নিরাময় সম্ভব। হার্টের অসুখ, কিডনির অসুখ, থাইরয়েডের স্বল্প নিঃসরণ, বিভিন্ন ভিটামিনের অভাব, বেশকিছু ওষুধের প্রভাব, অবসাদ ইত্যাদির কারণে স্মৃতিভ্রংশতা ঘটতে পারে। তবে আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় Alzheimer’s Dementia বা চিত্তভ্রংশতা। চিত্তভ্রংশতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলি হল —

ক)  Alzheimer’s Disease

খ)  Vascular Dementia

এছাড়াও Lewy Body Dementia, Pick’s Diseases, Frontotemporal Dementia, Normal Pressure hydrocephalus, Parkinson’s Disease প্রভৃতিও দেখা যায়।

অ্যালজাইমার’স ডিমেনশিয়া

১৯০৭ সালে আলোইস অ্যালজাইমার একজন ৫১ বছর বয়সি মহিলার মৃত্যুর পর তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে এমন সব পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন যা তাঁকে প্রবৃত্ত করল আরও গবেষণা করতে আর তা থেকেই এই অ্যালজাইমার রোগ।

মস্তিষ্কে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে অ্যালজাইমার রোগে? দেখা যায় সমস্ত Cortex জুড়ে নার্ভকোশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে তার ফলে Sulci বা খাঁজগুলি গভীর হয়, Ventricles বা মস্তিষ্কের পুকুরগুলি গভীর হয় এবং রোগটি বৃদ্ধি পেতে থাকে। মস্তিষ্ক জুড়ে নার্ভের সাথে সম্পৃক্ত থাকে অ্যামাইলয়েড প্রিকারসর প্রোটিন (APP) যা থেকে তৈরি হয় অ্যামাইলয়েড প্রোটিন। যদি কোনও কারণবশত বিটা অ্যামাইলয়েড (B/A4) তৈরি হয়ে যায় তবে নার্ভকোশগুলির ক্ষতি হয় ও ক্ষয় প্রাপ্তি ঘটে। এদের সাথে লিউকোসাইট আর মাইক্রোগ্লিয়াল কোশ মিলে তৈরি করে সেনাইল প্লাক (Senile Plaque)। এছাড়াও তৈরি হয় neurofibrilliary tangles যার মধ্যে থাকে Cytoskeletal elements, প্রধানত phosphorylated tan protein। ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবেই রোগী এগোতে থাকে চিত্তভ্রংশতার দিকে। স্মৃতিভ্রংশতা এ-রোগের প্রধান লক্ষণ। প্রাথমিক স্তরে চেনা লোকের নাম ভুলে যাওয়া, ঠিকঠাক শব্দ খুঁজে না পাওয়া, নতুন কিছু শিখতে না পারা, সাধারণ কাজকর্মের ক্ষেত্রে সমস্যা, যেমন গাড়ি চালানো, বিরক্তিভাব, সন্দেহপ্রবণতা বা মনের আবেগের আকস্মিক ও তীব্র তারতম্য দেখা যায়। পরবর্তীকালে হারিয়ে যেতে থাকে সবরকমের স্মৃতি, কথাবার্তা বা দৈনন্দিন কাজকর্মের সমস্যা দেখা যায়, পুরোনো স্মৃতিও অবলুপ্ত হতে থাকে এবং সবশেষে বৌদ্ধিক ক্ষমতার সম্পূর্ণ অবনতি ঘটে। অনেক সময় রোগীর ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে যায় যা পরিবারের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশেষত যেসব ক্ষেত্রে Frontal এবং Temporal অংশের সমস্যা দেখা যায়, সেখানে রোগী বিরক্ত ও উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে। ভ্রান্ত চিন্তা (Delusion) দেখা যায় প্রায় ৩০-৪০% মধ্যে আর Hallucination দেখা যায় ২০-৩০%-র মধ্যে। প্রধানত সন্দেহ প্রবণতা এবং কখনও কখনও উত্তেজনা দেখা দিতে পারে। অবসাদ ও উদ্‌বেগ উৎকণ্ঠাও বাদ যায় না, প্রায় ৪০-৫০%-র মধ্যেই থাকতে পারে। ধীর গতিতে মস্তিষ্কের বিভিন্ন কাজের ক্ষমতা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়— চিন্তা করা, কোনও সমস্যার সমাধান, হিসাব করা, বিচার বিবেচনা, কথাবার্তা গুছিয়ে বলতে পারা— এসবই বিলুপ্ত হয়। রোগ যত বাড়তে থাকে ব্যক্তিগত কাজকর্ম, যেমন স্নান, খাওয়া, জামাকাপড় পরা, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। শেষ অবস্থায় শুধুমাত্র মানুষটির খোলসটুকু পড়ে থাকে, নিজের নাম ঠিকানা সমস্তই সে বিস্মৃত হয়ে গেছে।

চিকিৎসা

কিন্তু এমন রোগের চিকিৎসার ধাপগুলি কী কী? কিছু কিছু ওষুধ যেমন ডোনেপেজিল, রিভাস্টিগমিন, গ্যালানটামিন, মেমানটিন ইত্যাদির সাহায্যে প্রাথমিক স্তরে প্রয়াস করা যায় — এই ওষুধগুলি acetylcholine নামক স্নায়ুরাসায়নিকের উপর কাজ করে। কিন্তু প্রধান চিকিৎসার জায়গাটি রোগীর বাড়ির লোকের ব্যবহার, চিন্তা ও প্রয়াসের পরিবর্তনসাধন। এইসব রোগীর নিয়মিত সেবা করা অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য কাজ। কাজেই বাড়ির লোককে জানতে হবে রোগটির হাল-হকিকত — রোগটি কী, এর পরের ধাপগুলিই বা কী আর করণীয় কী কী আছে? এই রোগেও যে যথাযথ চিকিৎসা সম্ভব এবং রোগীর অনেকটা ক্ষমতায়ণ ঘটানো যায় তাও জানা প্রয়োজন। চোখে চোখ রেখে কথা বলা, হাসি, সহজ সরল একমাত্রিক নির্দেশ দেওয়া, অকারণ চ্যালেঞ্জ না করা, বিরক্তি বোধ আটকানো ইত্যাদি — অর্থাৎ একটা সহজ যোগাযোগ যা আত্মিক তথা যথার্থ পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা। রোগীর পরিবেশ যতটা সম্ভব অপরিবর্তিত রাখা এবং দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য বস্তু ও কর্মগুলির পরিবেশ সুরক্ষিত করা। একসাথে ছোটো ছোটো কিছু কাজ করা — পুরোনো অ্যালবাম দেখা, বাগানে হাঁটা, হাতে হাত দিয়ে ধরে রাখা, পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করা, বিশেষত তার সাথে যদি আবেগ জড়িয়ে থাকে। হালকা ব্যায়াম ও রোগীকে সচল রাখার প্রচেষ্টাও জরুরি। মনে রাখা দরকার caregiver যিনি, তার শরীর ও মনের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয় এমন রোগীর দেখভাল করতে, তাই মাঝে মাঝে তারও বিশ্রাম, আনন্দের প্রয়োজন — তাতে অন্যায় কিছু নেই।

সমস্ত পৃথিবী জুড়ে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। বিশ্বের কোনও কোনও উন্নত দেশে শুনেছি অবসরের বয়সটা ক্রমেই পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ, এই মানুষগুলির মনন, অভিজ্ঞতা ও মেধাকে সমাজ কাজে লাগাতে চাইছে — এঁরাও পাচ্ছেন এক সুন্দর, পরিপূর্ণ জীবন। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথেও মানুষ সৃষ্টিশীল ও উদ্যমী থাকেন। যিনি পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন তিনি কোনোদিন জরাগ্রস্ত হবেন না। মনে পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কথা — ৬০ বছর বয়সে তিনি প্রথম চিত্রাঙ্কন শুরু করলেন এবং পরবর্তী সময়ে সৃষ্টি করলেন এক অমূল্য ভান্ডার। শেষ জীবনে কবি রামকিঙ্কর বেইজকে বলেছিলেন মাটি এনে দিতে, তিনি সৃষ্টি করতে চান নতুন স্থাপত্য। পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী নিষেধ করলেন রামকিঙ্কর বেইজকে, বললেন ঠাণ্ডা লেগে কবি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। রামকিঙ্কর নিয়ে গেলেন প্লাস্টিসিন, কবি বিরক্ত হলেন। জানি না সত্যি মাটির তাল পেলে কী সৃষ্টি করতেন তিনি। বয়স্ক মানুষের প্রতি রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিগত স্তরে যদি শ্রদ্ধা ও সম্মান না-ধরে রাখা যায়, তবে নিজের পূর্ব-প্রজন্মের প্রতি, নিজের অতীতের প্রতি, নিজের শিকড়ের প্রতি কোনও আনুগত্য, কোনও ভালোবাসা থাকে না। তখন মানুষের মনুষ্যত্ব কী অবশিষ্ট থাকে? 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান