দেবনারায়ণ মোদক
মানব মন নিয়েই যে সাহিত্যের পথ চলা — সেকথা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। মনের গহনের সুলুক-সন্ধান সাধারণভাবে মনোবিদের কাজ বলে ধরে নেওয়া হলেও সাহিত্যিকেরাও এক অর্থে মনোজগতেরই কারবারি সেকথা তাই অস্বীকার করি কীভাবে! কবিকুলের ক্ষেত্রে আবার এ-সব নিয়ে প্রশ্ন তোলাই কার্যত অসম্ভব সেকথাও আমরা মানি। কবিরা যে বিশেষভাবে অনুভূতি-প্রবণ এবং তাঁরা যে আপন অনুভবে অনেক কিছুই আগাম বুঝে নিতে পারেন — তা বোধ করি কম বেশি স্বীকৃত। সাহিত্যকর্মে মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাতকে তাই লঘু করে দেখানো চলে না। রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ এসে পড়লে তো এ-বিষয়ে কথাই নেই! অন্যভাবে বলি যে, সাহিত্য জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। জীবন মানেই তো নানাবিধ সম্পর্কের গ্রন্থিবন্ধন ও টানাপোড়েন। জীবনের কোনও ঘটনাবিশেষের বিচ্ছিন্ন অনুসন্ধান বা বিশ্লেষণ আমাদের সামগ্রিক উপলব্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে না। তার জন্য চাই সার্বিক দৃষ্টিকোণ। মনোবীক্ষণের আলোকে জীবনকে এক সামগ্রিক দৃষ্টিতে ধরে ফেলার সুযোগ ঘটে। জীবনশিল্পীরা তাই আগ্রহী হয়ে ওঠেন মনঃসমীক্ষণে। একেবারে নিজেদের মতো করে তাঁরাও পৌছে যেতে চান মানব চৈতন্যের অন্দর মহলে — খুঁজে পেতে চান তার যথার্থ স্বরূপটিকে। সাহিত্যিকের কাজ তাই কেবলমাত্র ‘ঘটনা-পরম্পরার বিবরণ’-এর মধ্যে নিজেদের সীমায়িত রাখা নয়; মানব-মনের সুগভীর বিশ্লেষণে তাদের ‘আঁতের কথা’ বের করে দেখানো। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের ভূমিকায় সাহিত্যকর্মের ‘নব পর্যায়ের পদ্ধতি’ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের তেমনভাবে এগোনোরই পরামর্শ দিয়েছেন; নিজেও কমবেশি সেই পথেই হেঁটেছেন। সেই পরামর্শকে শিরোধার্য করেই রবীন্দ্রবীক্ষণে মন নিয়ে দু-চার কথা বলার অভিপ্রায়ে আমাদের এই বিনম্র কলম-চালনা।
।।এক।।
আমরা সকলেই জানি যে, ‘মনস্তত্ত্ব’ একটি আধুনিক চর্চার বিষয়। উনিশ শতকে জার্মান তাত্ত্বিক ‘গুস্তাভ ফেকনার’ (১৮০১-১৮৮৭) একে বিজ্ঞানের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে, উনিশ শতকে তা একটি বিষয় হিসেবে তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে না পারলেও বিশ শতকের সূচনায় সিগমুণ্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯)-এর হাত ধরে জ্ঞানের একটি পৃথক শাখা হিসেবে তা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ফ্রয়েডের দু’খানি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Interpretation of Dreams’ (1900) এবং ‘Psychopathology of Everyday Life’ (1901) দিকনির্দেশক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকে। ফ্রয়েড তাঁর গ্রন্থে জানান যে, মানুষ সবসময় তাঁর মনের কারখানা ঘরের মালিকও নন, মানুষের মনের চেতন অংশটি হল তাঁর সমগ্র মনোজগতের এক ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই, কেবলমাত্র চেতন-স্তরের বিচার-বিশ্লেষণে ব্যক্তি মনের সামগ্রিক পরিচয় কার্যত অধরাই থেকে যায়। ফ্রয়েড তাঁর মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে মানবমনের আরও দু’টি স্তর — প্রাক্সচেতন (Pre-Conscious) অথবা অবচেতন (Sub-Conscious) এবং অচেতন (Unconscious) বা নির্জ্ঞান স্তরের উল্লেখ করেছেন। তিনি সুনির্দিষ্টভাবেই বলেছেন যে, মানবমনের এই দুটি স্তরের অস্তিত্ব অস্বীকার করলে ব্যক্তির আচার আচরণ বা তার অসঙ্গতির কারণ ব্যাখ্যা করা একান্ত অসম্ভব। এই প্রসঙ্গে তিনি মানুষের অবদমিত ইচ্ছা ও তার নানা ধরনের প্রকাশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এভাবেই ফ্রয়েড হয়ে উঠেছেন মনঃবিশ্লেষণ বা সাইকো-অ্যানালিসিস (Psycho-Analysis)-এর প্রতিষ্ঠাতা। লক্ষণীয় যে, ফ্রয়েড তাঁর বইটির নামকরণ করেছিলেন ‘স্বপ্নের ব্যাখ্যা’ (‘The Interpretation of Dreams’), যা মনের বিভিন্ন স্তরের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে কীভাবে সম্পৃক্ত তা তিনি দেখাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে এটিই তাঁর ‘ইদিপাস কমপ্লেক্স’ (Oedipus Complex) তত্ত্বে নানাভাবে ব্যাখ্যাত হয়।
বিশ শতকের চিন্তাজগতে ফ্রয়েডিয় এই তত্ত্ব প্রবলভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞান অনুশীলন থেকে চিকিৎসাশাস্ত্র সহ নানা আলাপ-আলোচনায় তা সীমায়িত থাকলেও কালপ্রবাহে শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরাও আগ্রহী হয়ে ওঠেন মানব মনের গহনে গোপনে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনা প্রবাহ নিয়ে। এর ফলে, শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও উন্মোচিত হয় নবদিগন্ত; চৈতন্যের গভীরে থেকে যাওয়া বিষয়সমূহ নতুনভাবে সামনে আসতে শুরু করে; সাহিত্যের অঙ্গনে ‘আধুনিকতা’ সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনা নতুনতর মাত্রা অর্জন করে। সত্যি কথা বলতে, মনঃসমীক্ষণের যুগান্তকারী উদ্ভাবক ফ্রয়েডের উত্থান ছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর। তাঁর একেকটি চিন্তা প্রকরণ যেন এক-একটি বিস্ফোরণ। সে-সব নিয়ে বিতর্ক বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি জগতের নানা ক্ষেত্রে যেমন তীব্র হয়ে উঠেছিল, শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তার অভিঘাত ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এক কথায় বলি যে, উনিশ-শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত মানুষের সাহিত্য ও শিল্প-চেতনায় যে ধারাবাহিকতা লক্ষণীয় ছিল, ফ্রয়েডের ভাবনা সেখানে যেন একটা ভেদ-রেখা টেনে দিল; নতুন প্রজন্মের শিল্পী-সাহিত্যিকদের সামনে তা যেন এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত করে দিল। সেটা যে কেবল ইওরোপীয় সাহিত্যের জগৎ সম্পর্কে প্রযোজ্য শুধু তাই নয়; বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা এবং বিশেষত বাংলা ভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তা যেন অবধারিত হয়ে উঠল। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, বিশ্ব-সাহিত্যের প্রথিতযশা অনেক চিন্তাবিদ যেমন ফ্রয়েডের নবতর উদ্ভাবনে নানাভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে ফ্রয়েডের নিজস্ব লেখাপত্রও বড়ো কম ছিল না। সেগুলির মধ্যে ‘Delusions and Dreams in Jensen’s Gradiva’ (1907), ‘Psychopathic Characters on the Stage’ (1905-06), ‘Creative Writers and Day-Dreaming’ (1908), ‘Leonardo Da Vinci and A Memory of His Childhood’ (1910), ‘On Transience’ (1916), ‘Some Character Types Met with in Psychoanalytic Work’ (1916), ‘Dostoevsky and Parricide’ (1928) ইত্যাদি লেখাপত্র বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। সব মিলিয়ে বলা চলে যে, ফ্রয়েড নিজে একজন মনঃসমীক্ষক তথা মনোবিজ্ঞানী হিসাবে গভীরভাবে অভিনিবেশ করেছিলেন মানব মন নিয়ে; মনঃসমীক্ষণের দৃষ্টিতে তিনি দেখেছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকৃতি ও শিল্পকর্মগুলিকে।[১] স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বসাহিত্যের দিক্পাল মানুষেরাও এ-বিষয়ে কমবেশি তাঁদের অবস্থান প্রকটিত করেছেন। সবমিলিয়ে একথাটা যেন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, সাহিত্যকর্মের বিস্তৃত পরিসরে যে সৃষ্টিসম্ভার আমাদের অধিগত তার শিকড়ের সন্ধান করতে হয় আমাদের মনোভূমিতেই। সেখানে যদি স্বপ্নের কথা এসেই পড়ে, তাকে ব্যাপকতর দৃষ্টিতেই বিচার করাটা জরুরি।
প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথের কথায় এসে বলি যে, তিনি ও সিগমুণ্ড ফ্রয়েড ছিলেন বয়সের বিচারে প্রায় সমসাময়িক। রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) এবং ফ্রয়েড (১৮৬৫-১৯৩৯) উভয়েই আবার এক এক অর্থে বিশ্ববন্দিত দুই প্রবাদ পুরুষ। এতদ্সত্ত্বেও প্রথম দিকে তাঁরা একে-অপরের সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন বলে মনে হয় না। ১৯২০-তে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ভিয়েনা সফরের সময়েও ফ্রয়েডের সঙ্গে সাক্ষাতের কোনও পরিকল্পনা করেননি; ইতিপূর্বে তাঁদের মধ্যে কোনও পত্র-বিনিময় হয়েছে বলেও জানা যায় নি। তবে, রবীন্দ্রনাথ অন্ততপক্ষে ১৯১৫ সালের আগেই ফ্রয়েড সম্পর্কে কম-বেশি অবগত হয়েছিলেন, এরকম ধারণা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ‘চতুরঙ্গ’ প্রসঙ্গে কালিদাস নাগের প্রশ্নের উত্তরে বিভিন্ন চরিত্রের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে কবির ব্যাখ্যার সূত্র ধরেই এরকম অনুমান করা হয়ে থাকে। তবে, এই ব্যাখ্যায় কখনোই ফ্রয়েডের নাম উল্লেখিত হয়নি। আবার, রবীন্দ্রনাথ ও ফ্রয়েডের বন্ধুদের তালিকায় একাধিক নামের সাযুজ্য (Common friend) সত্ত্বেও তেমন যোগাযোগ গড়ে ওঠে নি। এই প্রসঙ্গে অবশ্য একটি ‘কাকতালীয়’ যোগসূত্রের কথা বলা যেতে পারে ফ্রয়েডের ‘স্বপ্নের ব্যাখ্যা’ (‘Interpretation of Dreams’) প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০১ সালে (ইংরাজি সংস্করণ)। ওই বছরেই প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাস। এটি প্রথমে ১৯০১-০২ সালে নবপর্যায় “বঙ্গদর্শন” পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং পরে তা বই-আকারে প্রকাশ পায়। এক কথায় উপন্যাসটির বিষয় হল ‘সমাজ ও যুগযুগান্তরাগত সংস্কারের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের বিরোধ’।
মনোবিশ্লেষণ প্রসঙ্গে ‘চোখের বালি’-র উল্লেখের প্রাসঙ্গিকতা এখানেই যে, তা ছিল রবীন্দ্র-দৃষ্টিতে মানুষের ‘মনের ঠিকানা’ উদ্ঘাটনের এক যুগান্তকারী প্রয়াস। স্বাভাবিক কারণেই সাহিত্যের জগতে তা রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। উপন্যাসের ‘সূচনা’ অংশটি— যদিও তা মূল উপন্যাসের অংশ নয় এবং অনেক পরের লেখা — এই প্রসঙ্গে সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। সেখানে প্রথম বাক্যেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন — “আমার সাহিত্যের পথযাত্রা পূর্বাপর অনুসরণ করলে ধরা পড়বে যে, ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটা আকস্মিক, কেবল আমার মধ্যে নয়, সেদিনকার বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে”। তিনি নিজেই জানিয়েছেন যে, “বাইরে থেকে কোন ইশারা এসেছিল আমার মনে, সে প্রশ্নটা দুরূহ”। তাৎপর্যপূর্ণভাবে শেষ দুটি বাক্যে তিনি লিখেছেন — “সাহিত্যের নবপর্যায়ের পদ্ধতি হচ্ছে ঘটনা পরম্পরার বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাদের আঁতের কথা বের করে দেখানো। সেই পদ্ধতিই দেখা দিল ‘চোখের বালি’-তে”।[২]
উল্লেখ্য যে, ঘটনা পরম্পরা থেকে একথা মনে করার কারণ আছে যে, ‘চোখের বালি’ লেখার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ফ্রয়েড পড়েননি। ‘সূচনা’ অংশটি লেখার আগে অবশ্য তিনি ফ্রয়েডের লেখাপত্র পড়ে থাকতে পারেন। সেক্ষেত্রেও মনে রাখা দরকার যে, পরবর্তী সময়ে ফ্রয়েড পড়লেও তিনি নানা কারণে ফ্রয়েডের তত্ত্ব সর্বাংশে মেনে নিতে পারেননি। এতদ্সত্ত্বেও মনঃসমীক্ষণের প্রশ্নে রবীন্দ্র উপন্যাস আলোচনায় — বিশেষত ‘চোখের বালি’-র বিশ্লেষণে — অনেকেই ফ্রয়েডকে টেনে এনেছেন। এ ধরনের আলোচনার যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে অর্ঘদীপ ব্যানার্জী লিখেছেন যে, শতাব্দী-প্রাচীন এই মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের বিচার এই আধুনিক যুগে করতে বসে ফ্রয়েডকে এড়িয়ে যাওয়া মোটেই সম্ভব নয়। এ-বিষয়ে দ্বিতীয় যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছেন যে, বইটির ভূমিকাংশটি অনেক পরের লেখা যখন এটি সংকলন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে (বৈশাখ, ১৩৪৭)। এটি লেখার সময়ে রবীন্দ্রনাথ যে ফ্রয়েডের তত্ত্ব পড়ে ফেলেছেন তা স্পষ্ট। এছাড়াও সমসাময়িক কালে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রান্তিক’ ‘রোগশয্যায়’ ইত্যাদি কাব্যেও এক নিশ্চেতনার কথন লক্ষণীয়।[৩]
।।দুই।।
প্রসঙ্গত বলি যে, প্রথম দিকে ফ্রয়েডের তত্ত্ব প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ আগ্রহী না হলেও পরবর্তী সময়ে তিনি যে এ-বিষয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে শুরু করেন সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। শুধু ফ্রয়েড নন, সে-সময়ে তিনি এডলার, য়ুং প্রমুখ চিন্তাবিদদের রচনাও পাঠ করেন। এ-বিষয়ে কবি অমিয় চক্রবর্তীর সবিশেষ ভূমিকা ছিল বলে জানা যায়। শান্তনু বিশ্বাস এই প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ শেষ দিকে মনস্তত্ত্ববাদের বিষয়ে তাঁর ঔদাসীন্যের জায়গা থেকে সরে এসেছিলেন। নন্দগোপাল সেনগুপ্ত এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে লিখেছেন যে, শেষ দিকে কবি মনস্তত্ত্ববাদের ওপর কিছু কবিতা লেখার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠে নি। কবির মনঃসমীক্ষণ বিষয়ে আগ্রহ তথা ফ্রয়েড-পাঠ বিষয়ক পরির্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গিটি আরও স্পষ্ট হয় ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে কবির মনোভাবে। প্রথমবার ভিয়েনা সফরে ফ্রয়েড সন্দর্শনে আগ্রহ না দেখালেও দ্বিতীয়বার ভিয়েনা পৌঁছে কবি ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করেন। এবারে অবশ্য এই সাক্ষাৎকার আয়োজনে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও রাণী মহলানবিশের দৌত্যকর্ম সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।[৪]
দ্বিতীয়বারের ভিয়েনা সফরে রবীন্দ্রনাথ ফ্রয়েড-সন্দর্শনে মনস্থ করলেও ফ্রয়েড যদি দেখা করতে সম্মত না হন — এরকম আশঙ্কা থেকে কলকাতার বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গিরীন্দ্রশেখর বসুর কাছ থেকে একটি পরিচয়পত্র লিখিয়ে নেওয়া হয়েছিল। গিরীন্দ্রশেখর সম্পর্কে রাজশেখর বসুর ভাই। তিনি রসায়নের ছাত্র ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনা করে তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে শুরু করেন। ইতিমধ্যে বিবাহের সম্বন্ধ এসে পড়ায় তাঁর ডাক্তারি পাঠ ব্যাহত হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি অবশ্য ডাক্তার হয়েছিলেন, তবে শরীরের নয়, মনের— এদেশের প্রথম মানসিক চিকিৎসক — মনোবিশ্লেষণের অন্যতম পথিকৃৎ — সেই সূত্রেই ফ্রয়েডের কাছেও তিনি স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন এবং হয়ে উঠেছিলেন তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু। তাই, গিরীন্দ্রশেখরের পরিচয়পত্র নিয়েই রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন ফ্রয়েড সন্দর্শনে। প্রশান্ত ও রাণী মহলানবিশ রচনা করেছিলেন এই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারের প্রেক্ষিতটি। তাঁদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনায় ফ্রয়েড কবির সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কবি ফ্রয়েডকে চায়ে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ফ্রয়েড কবির কাছে এসেছিলেন, অনেকটা সময় তাঁরা একসঙ্গে কাটিয়ে ছিলেন; নানা বিষয়ে মত বিনিময়ও করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, তখন কবির যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার রেকর্ড রাখার দস্তুর চালু হলেও এই সাক্ষাৎকারের রেকর্ড রাখা হয়নি। হয়তো দু-জনের কাছেই এটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি বলেই তেমন উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। অবশ্য পরে এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে ফ্রয়েড ১৯২৬-এর ১৪ নভেম্বর লেখেন —
Tagore invited us to pay him a visit on 25th October. We found him ailing and tired, but he is a wonderful sight, he really looks like we imagined the Lord God looks, but only about 10,000 years older than the way Michelangelo painted him in the Sistine. [৫]
উল্লেখ্য যে, ১৯২৬-এ ফ্রয়েডের সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারের বহু আগেই রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ফ্রয়েডের লেখাপত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত জানিয়েছেন ‘Tagore was one of the first Indian readers of Frued’s Interpretation of Dreams in 1915.’ তারপর থেকে বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ ফ্রয়েডের বই পড়েছেন বলে জানা যায়। বলা হয় যে, ১৯৩৮-৩৯ সালের মধ্যে ফ্রয়েডের যেসব বই বেরিয়েছিল সেসব কবির পড়া হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিক থেকে বলা যায় যে, ফ্রয়েডও কম-বেশি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। জানা যায় যে, ফ্রয়েডের লন্ডনের বাড়িতে বইয়ের আলমারির তাকে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি প্রবন্ধের সংকলন ‘সাধনা’ শেলির ‘প্রমিথিউস্ আনবাউন্ড’ এর পাশে স্থান করে নিয়েছিল।[৬]
এ-ভাবে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংযোগের একাধিক উদাহরণ দেওয়া গেলেও এ-কথা স্বীকার করতে হয় যে, কালপ্রবাহে রবীন্দ্রনাথ মনস্তত্ত্ব বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে উঠলেও ফ্রয়েডিয় তত্ত্বের উপর তাঁর বিশেষ আস্থা ছিল বলে মনে হয় না। তিনি অবশ্য ফ্রয়েডের তত্ত্বের সামগ্রিক প্রভাবকেই কখনই অস্বীকার করেননি। অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন যে, ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব প্রচার হওয়ার পর পাশ্চাত্য জগতে অবচেতন মনের যেন একটি খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। সাহিত্যে এর বেগ আর রোধ করা যায় না। অর্থাৎ ‘স্বপ্নের বাস্তবতা’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল না। তিনি নিজেও স্বপ্ন দেখতেন এবং সেগুলিকে তাঁর সাহিত্যকর্মে রূপ দিতেন। বিশেষত নিজের কবিতা প্রসঙ্গে বন্ধু এণ্ড্রুজকে ১৮ এপ্রিল, ১৯২১-এ লেখা চিঠিতে তিনি স্পষ্টতই বলেন ‘All my poems have their roots in my dreams…’ কিন্তু স্বপ্ন বিশ্লেষণের ফ্রয়েডিয় তত্ত্ব যে তার মনঃপুত ছিল না— একথাও তিনি বিভিন্নভাবে জানিয়েছেন। এ-প্রসঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছেন যে, ‘…রবীন্দ্রনাথের সময়ে অল্পস্বল্প ফ্রয়েডীয় সাইকোলজির চর্চা হয়েছিল, কিন্তু আমার যতদূর মনে পড়ে, তার উপর তাঁর আস্থা কমই ছিল’।[৭]
।।তিন।।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকৃতির মনঃসমীক্ষণ-মূলক আলোচনা মোটেই সাম্প্রতিক নয়। বস্তুতপক্ষে, ১৯২৪ সাল থেকেই এ-বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ আলাপ-আলোচনা সামনে আসতে থাকে। সেগুলির মধ্যে ‘শনিবারের চিঠি’-তে প্রকাশিত রঙ্গীন হালদার রচিত ‘আর্ট ও মনোবিকলন’ শীর্ষক রচনাটি বোধ করি পথিকৃতের মর্যাদা পেতে পারে। পরবর্তী সময়ে হালদারের রচনার বিভিন্ন সংস্করণ আমরা বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই পেয়েছি।[৮]
১৯২৮-এ পাটনায় অনুষ্ঠিত Indian Science Congress এর Psychology Section-এ অধ্যাপক হালদার তাঁর সুদীর্ঘ প্রবন্ধ ‘The Working of an Unconscious Within the Creation of Poetry and Drama’-তে দ্ব্যর্থহীন ভাষাতেই লেখেন —
Freud was the first to show that an unfulfilled wish suppressed in the unconscious is at the root of artistic creation. Rabindranath too senses the existence of the unconscious in some of his poetic expressions. [৯]
এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। কবিতাটিকে ব্যবহৃত বিশেষ বিশেষ শব্দের বিশ্লেষণে ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণের আলোকে অধ্যাপক হালদার সেগুলির নিহিতার্থ উদ্ঘাটনে প্রয়াসী হয়েছেন। [১০]
অনুরূপভাবে, ১৯২৮-এ প্রকাশিত সরসীলাল সরকারের অমূল্য রচনা ‘A Peculiarity in the Imagery in Dr. Rabindranath Tagore’s Poems’ আমাদের সম্পদ। সরকারের রচনাটির একাধিক ইংরেজি ও বাংলা সংস্করণগুলি এক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য যে, ১৯২৬-এ বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত বিজ্ঞান সম্মিলনী (All India Science Congress)-এ শ্রী সরকার প্রথম তাঁর মূল নিবন্ধটি পাঠ করেন। সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কাব্যরাজি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে সেগুলির মধ্যে একটি বিশেষ পরিকল্পনা লক্ষ করে তার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। [১১]
বোম্বাইতে All India Science Congress-এ উপস্থাপিত সরসীলাল সরকারের এই নিবন্ধটি যে রবীন্দ্র কাব্যকে নতুন দিক থেকে বোঝার একটি প্রয়াস, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। অধ্যাপক অনিলকুমার বসু এ-প্রসঙ্গে যথার্থই লিখেছেন —
কোনও কবির কাব্যকে এরূপভাবে বুঝবার চেষ্টা য়ুরোপে পরিচিত হইলেও আমাদের এদেশে নতুন; এবং এই নতুন ধারায় সমালোচনার প্রথম পথ-প্রদর্শক হইলেন ডাক্তার সরসীলাল সরকার।[১২]
সরসীবাবু-র এ-হেন অবদানের গুরুত্ব বিবেচনায় অধ্যাপক বসু অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেন, যার শিরোনাম ছিল “রবীন্দ্রকাব্যে পরিকল্পনার একটি বিশেষত্ব”। এই নিবন্ধের ভূমিকায় তিনি জানিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলির মধ্যে এমন একটি বিশেষ পরিকল্পনার পরিচয় তিনি পেয়েছেন, যা আর কোথাও তিনি পাননি। উদাহরণ হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথের একাধিক কবিতা ও গানের উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রকাব্যে ‘স্বপ্ন সম্বিৎ’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন যে, কবি নিজেই নাকি এক সময়ে তাঁকে বলেছিলেন যে, তাঁর অধিকাংশ কবিতাই হল ‘সুপ্ত মনের সৃষ্টি’ । যেখানেই তিনি মনকে বেশি মাত্রায় সজাগ করে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন, সেখানেই তাঁর লেখা নাকি তেমন উৎকর্ষ লাভ করতে পারে নি। ফ্রয়েডের কথা উদ্ধৃত করে তাই তিনি জানিয়েছেন যে, “মনের যে স্তর থেকে স্বপ্নের উৎপত্তি, কবিতারও উৎপত্তি সেই স্তর থেকে”। অধ্যাপক বসু’র সুচিন্তিত অভিমত এই যে, “এই ‘স্বপ্ন সম্বিৎ’-এর প্রকাশ অন্য কবি অপেক্ষা রবীন্দ্রনাথেই বেশি আছে।”[১৩]
উল্লেখ্য যে, সরসীবাবু’র মূল নিবন্ধ A Peculiarity in the Imagery in Dr. Rabindranath Tagore অবলম্বনে অধ্যাপক বসু-র লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ ও মনোবিশ্লেষণ’ ‘প্রবাসী’-তে (আষাঢ়, ১৩৩৫) প্রকাশিত হয়। এ-বিষয়ে কবির মতামত জানার আগ্রহে তাঁরা দু-জনেই রবীন্দ্র-সমীপে উপস্থিত হন। এক্ষেত্রে, বিশেষত সরসীবাবু ও রবীন্দ্রনাথের কথোপকথনের সারাংশ অনিলবাবু-র নিবন্ধে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেখানে লক্ষণীয় এই যে, কবি একদিকে যেমন এই আলোচনায় তাঁর অস্বস্তি গোপন করেননি; তেমনই আবার “ফ্রয়েড-পন্থী”-দের ‘স্বাধীন চিন্তার দৈন্য’-এর কথাও উত্থাপন করেছেন। কবির ভাষায় —
তোমরা আমায় Psycho-analysis -এর মধ্যে টেনে এনে মহা মুশকিলে ফেলেছো, আমি তো ওর কিছু বুঝতে পারিনে। তা ছাড়া তোমরা তোমাদের নিজেদের অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে বুঝি কিছু দেখতে শেখোনি? যা ফ্রয়েড বলছে, তাই একেবারে শিরোধার্য করে চলেছো? আমরা যে স্বাধীনভাবে চিন্তা করবার শক্তি হারিয়ে বসেছি সে কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। [১৪]
কবির এ-ধরনের মন্তব্যের মূল প্রেরণা এটাই যে, ফ্রয়েডের সব কথা নির্বিচারে মেনে নেওয়াটা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। প্রধানত Sex-instinct বিশ্লেষণ ধরেই মানুষকে বোঝার চেষ্টা প্রসঙ্গে তাঁর সুনির্দিষ্ট বক্তব্য এই যে, “Freud-এর School এর সঙ্গে এইখানেই আমার প্রধান ঝগড়া। তাঁর মতে, Sex-instinct একেবারে গোড়ার কথা নয়। আরও গোঁড়ার কথা হচ্ছে self-assertion, যা এই শেষোক্ত self assertion sex-instinct অপেক্ষা বেশী পুরাতন এবং তা ওতপ্রোতভাবে আমাদের জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে”। বলা বাহুল্য যে, তাঁদের আলোচনায় আনুষঙ্গিক নানা কথাই এসেছে এবং তার মাধ্যমে ফ্রয়েডের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কবির অবস্থানগত পার্থক্যটিই প্রকটিত হয়েছে।[১৫]
স্বাভাবিকভাবেই ‘প্রবাসী’-র আষাঢ় ১৩৩৫ সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশিত হলে তার প্রতিক্রিয়া একমুখী ছিল না। এক্ষেত্রে Indian Psycho-analytical Society-র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা. গিরীন্দ্রশেখর বসু-র কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। বস্তুতপক্ষে, অধ্যাপক বসুর প্রবন্ধ এবং বিশেষত রবীন্দ্রনাথের অবস্থান জেনে তিনি যারপরনাই ক্ষুব্ধ হন এবং ‘প্রবাসী’-র ঠিক পরের সংখ্যা (শ্রাবণ, ১৩৩৫)-য় এ-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানের সমালোচনা করেন।[১৬] এখানেই শেষ নয়। এরপরে সরসীবাবু কবির প্রিয় পাত্র ও ফ্রয়েড অনুরাগী কবি অমিয় চক্রবতীর কাছে চিঠি লিখে এ-বিষয়ে আরও সুনির্দিষ্টভাবে রবীন্দ্রনাথের অভিমত জানতে চান। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তাঁর মতামত ব্যক্তিগতভাবে সরসীবাবুকে না-জানিয়ে ১৯৩১-এর ডিসেম্বর সংখ্যা ‘বিচিত্রা’-য় “সাইকো এনালিসিস” শিরোনামে তা প্রকাশ করেন। চিঠিতে মুদ্রিত তারিখ ছিল ২৪শে আশ্বিন, ১৩৩৮। তদনুসারে এটিকে ইংরেজি অক্টোবর মাসে লিখিত বলেই মনে করা হয়। বলা বাহুল্য যে, এই চিঠিতে মনোবিশ্লেষণ সম্পর্কে কবির অবস্থান কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়েছে, এবং ফ্রয়েডীয় দৃষ্টিকোণের তুলনায় তাঁর ভাবনাগত স্বাতন্ত্র্যও বেশ পরিস্ফুট হয়েছে। কবি লিখেছেন —
‘মিষ্টিক উপলব্ধি’ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা চলে না। ইন্দ্রিয়বোধের মতোই সেটা অনির্বচনীয়। … চৈতন্যের নানা দিক আছে, এক আলো থেকেই নানা রঙের বোধ যেমন এও তেমনি।… মিষ্টিক উপলব্ধিও এক রকমের নয়, নিশ্চয় তার বৈচিত্র্য আছে। সে বৈচিত্র্য ঠিক বর্ণনা করা যায় না, কেন না সে তো চোখে দেখবার জিনিস নয়। কবিদের উপলব্ধিকে যদি মিষ্টিক বল, তবে সেই উপলব্ধি প্রকাশের ভাষা তাদের আছে, এখানেই কবিত্ব।… ভাষা মানে কেবল শব্দের ভাষা নয়, সংকেতের ভাষা, যুক্তির ভাষা, রেখার ভাষা, কর্মের ভাষা, চরিত্রের ভাষা এমন কত কি। [১৭]
।।চার।।
মনঃসমীক্ষণ বিষয়ে সমকালীন আলাপ-আলোচনার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনাশৈলী বেশ কিছুটা পরিস্ফুট হয়েছে— একথা মেনে নিয়েও বলি যে, স্বাভাবিক কারণেই স্বপ্ন-সন্ধানী কবির পক্ষে মনের চেতন ও অবচেতন স্তর সম্পর্কে না বোঝার বা না মানার কোনও কারণ ছিল না। এক্ষেত্রে তিনি অবশ্য বিশেষ কোনও মতের অনুসারী না হয়ে আপন বিচারবোধে চালিত হওয়াকেই শ্রেয় বিবেচনা করতেন। তাঁর অসংখ্য লেখাপত্র ও চিঠিপত্রে এ-বিষয়টি স্পষ্ট হয়। অমিয় চক্রবর্তী-র কাব্য-আলোচনায় এ-ভাবেই সচেতন ও অবচেতন মন সম্পর্কে তিনি তাঁর ভাবনাকে ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন—“আমাদের সকল অভিজ্ঞতার সঙ্গে এমন অনেক কিছু মিশতে থাকে, যাকে আমরা ইচ্ছে করে সরিয়ে রেখে দিই, কিন্তু আমাদের অবচেতন মন তাকে গ্রহণ করে। সব জড়িয়ে নিয়েই আমাদের উপলব্ধির বাস্তবতা”। [১৮]
বস্তুতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-বিষয়ক কিছু প্রবন্ধে এ-বিষয়ে তাঁর অবস্থান বেশ প্রকটিত হয়েছে বলেই মনে হয়। ‘সাহিত্য বিচার’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন —
আজকাল সাইকো-আ্যানালিসিসের বুলি অনেকের মনকে পেয়ে বসে। সৃষ্টিতে অবিশ্লেষ্য সমগ্রতার গৌরব খর্ব করার মনোভাব জেগে উঠেছে। মানুষের চিত্তের উপকরণে নানা প্রকার প্রবৃত্তি আছে, কাম-ক্রোধ অহঙ্কার ইত্যাদি। ছিন্ন করে দেখলে যে বস্তু পরিচয় পাওয়া যায় সম্মিলিত আকারে তা পাওয়া যায় না। প্রবৃত্তিগুলির গূঢ় অস্তিত্ব দ্বারা নয়, সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অভাবনীয় যোগ সাধনের দ্বারাই চরিত্রের বিকাশ। সেই যোগের রহস্যকে আজকাল অংশের বিশ্লেষণ লঙ্ঘন করার উপক্রম করছে। [১৯]
সাহিত্যের বিচারধারায় রবীন্দ্রনাথ তাই অংশ-বিশেষের পরিবর্তে সামগ্রিক উপলব্ধির উপরই অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, “প্রকৃত সাহিত্যে আমরা আমাদের কল্পনাকে, আমাদের সুখ-দুঃখকে, শুদ্ধ বর্তমান কালে নহে, চিরন্তন কালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহি”। তাঁর মতে, “অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।” তাই তিনি নিশ্চিত যে, “জগতের সহিত মনের যে সন্বন্ধ, মনের সহিত সাহিত্যকারের প্রতিভার সেই সম্বন্ধ”। তিনি দেখিয়েছেন যে, “জগতের উপর মনের কারখানা বসিয়াছে এবং মনের উপরে বিশ্বমনের কারখানা — সেই উপরের তলা হইতে সাহিত্যের উৎপত্তি”। সেকারণে মনের গতি-প্রকৃতি অনুধাবন সাহিত্যকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যকর্ম। তবে, কাজটা যে মোটেই সহজ নয়, একথাও তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন। তাঁর কথায় —
মন আমাদের সহজগোচর নয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া দেখিলে অবিশ্রাম গতির মধ্যে তাহার নিত্য নিত্য সংগ্রহ করিয়া লওয়া আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়। এই জন্য সুবিপুল কালের পরিদর্শন মধ্যেই মানুষের মানসিক বস্তুর পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হয়; ইহা ছাড়া নিশ্চয় অবধারণের চূড়ান্ত উপায় নাই। [২০]
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধগুলি অনুসরণ করলে একথা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, তাঁর মতে, মনঃসমীক্ষণের প্রশ্নটি সাহিত্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ-সম্পর্কে খণ্ডিত দৃষ্টিকোণ নানা দিক থেকে বিভ্রাট সৃষ্টি করতে পারে। স্বপ্নের মধ্যেই সৃষ্টির শিকড়ের সন্ধান উপলব্ধি হলেও জীবন সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব আমাদের বিপথগামী করে তুলতে পারে। এখানেই বোধ করি ফ্রয়েডের ভাবনা সম্পর্কে কবির আপত্তি অত্যন্ত গুরুতর।[২১] প্রত্যক্ষভাবে সেই আলোচনায় না গিয়েও সাহিত্য সম্পর্কে আপন অভিজ্ঞান ব্যক্ত করতে গিয়ে প্রকারান্তরে তা তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন —
সাহিত্যের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে মানব-জীবনের সম্পর্ক। মানুষের মানসিক জীবনটা কোনখানে? যেখানে আমাদের বুদ্ধি এবং হৃদয়, বাসনা এবং অভিজ্ঞতা সবগুলি গলে গিয়ে মিশে গিয়ে একটি সম্পূর্ন ঐক্যলাভ করেছে। যেখানে আমাদের বুদ্ধি, প্রবৃত্তি এবং রুচি সম্মিলিত ভাবে কাজ করে। এক কথায়, যেখানে আদত মানুষটি আছে, সেইখানে সাহিত্যের জন্মলাভ হয়। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় খণ্ড খণ্ড ভাবে প্রকাশ পায়। সেই খণ্ড অংশগুলি বিজ্ঞান দর্শন প্রভৃতি রচনা করে। পর্যবেক্ষনকারী মানুষ বিজ্ঞান রচনা করে, চিন্তাশীল মানুষ দর্শন রচনা করে, এবং সমগ্র মানুষটি সাহিত্য রচনা করে। [২২]
বলা বাহুল্য যে, সাহিত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই অভিজ্ঞান নিয়ে অনেক কথা বলার থাকতে পারে। বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ক আলোচনাও তার উপজীব্য হতে পারে। কিন্ত সে-সব আলোচনায় না গিয়ে মনঃসমীক্ষণ বিষয়ে তাঁর অবস্থান সম্পর্কিত প্রশ্নে নিজেদের সীমায়িত রেখে বলি যে, ‘সাহিত্য ধর্ম’ সম্পর্কিত আলোচনায় ‘সাধারণ সত্য’ ও ‘সার্থক সত্য’-এর ভেদরেখা টানতে গিয়ে এক্ষেত্রে তিনি বোধ করি নিজেকে সুস্পষ্ট ভাবেই মেলে ধরেছেন। প্রসঙ্গত জীবধর্মের সঙ্গে মানবধর্মের পার্থক্যকে সামনে এনে তিনি তাঁর অবস্থানকে আরও বেশি করে প্রকটিত করেছেন। সেই আলোচনায় বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, সাহিত্যিকের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কথাও উঠে এসেছে। সুনির্দিষ্টভাবে সাইকো-অ্যানালিসিসের প্রশ্নে এসে তিনি বলেছেন —
সম্প্রতি আমাদের সাহিত্যে বিদেশের আমদানি যে একটা বে-আব্রুতা এসেছে সেটাকেও এখানকার কেউ কেউ মনে করছেন নিত্য পদার্থ, ভূলে যান, যা নিত্য তা অতীতকে সম্পূর্ণ প্রতিবাদ করে না। মানুষের রসবোধে যে আব্রু আছে সেইটেই নিত্য; যে আভিজাত্য আছে রসের ক্ষেত্রে সেইটেই নিত্য। এখনকার বিজ্ঞান মদমত্ত ডিমোক্রেসি তাল ঠুকে বলছে, এ আব্রুটাই দৌর্বল্য, নির্বিচার অলজ্জতাই আর্টের পৌরুষ। [২৩]
এসব কথার অর্থ অবশ্যই এই নয় যে, রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের আসরে মনঃসমীক্ষণের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেছেন বা সামগ্রিকভাবে তার বিরোধিতা করেছেন। ‘হোলি-উৎসব’-কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ‘পাগলামী’-র উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন যে, “মাঝে মাঝে এই অবারিত মালিন্যের উন্মত্ততা মানুষের মনস্তত্বে মেলে না, এমন কথা বলি নে। অতএব সাইকো-অ্যানালিসিসে এর কার্যকরণ বহু যত্নে বিচার্য”। এতদ্সত্ত্বেও তাঁর সুচিন্তিত অভিমত এটাই যে, ‘সেই বর্বরতার মনস্তত্বকে এক্ষেত্রে অসঙ্গত বলেই আপত্তি করব, অসত্য বলে নয়’। [২৪]
কেবল সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধমালাই নয়, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সৃষ্টিসম্ভারে তার মনঃসমীক্ষণ-বিষয়ক অভিজ্ঞান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গেছে। ইতিপূর্বেই আমরা ‘চোখের বালি’ ও ‘বীরপুরুষ’-এর উল্লেখ করেছি। তার ‘নৌকাডুবি’ প্রসঙ্গেও এধরনের আলাপ-আলোচনা আমাদের নজরে এসেছে। সেখানেও উপন্যাসের ‘সৃষ্টি রহস্য’ ব্যক্ত করতে গিয়ে একেবারে নিজের মতো করে তিনি সময়কে ধরে ফেলতে চেয়েছেন। তিনি লিখেছেন — “সময়ের দাবি বদলে গেছে। একালে গল্পের কৌতূহলটা হয়ে উঠেছে মনোবিকলন মুলক। ঘটনা-গ্রন্থন হয়ে পড়েছে গৌন”। কবির মতে, এর ফলে যে-সব প্রশ্নগুলি সামনে এসে পড়েছে, সে-সবের সর্বজনীন উত্তর অসম্ভব। এখানেও তিনি যেন এক সামগ্রিক উপলব্ধি লক্ষ্যে অবিচল। [২৫]
প্রসঙ্গত বলি যে, সরসীলাল সরকারের উল্লিখিত রচনাটি রবীন্দ্রনাথের মনঃসমীক্ষণ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ক আলোচনার সূচনাবিন্দু হিসেবে গৃহীত হতে পারে। বিশেষত রবীন্দ্র কবিতায় রূপকল্পের ব্যবহার সম্পর্কিত আলোচনায় তিনি কবির মধ্যে এমন একটি ‘বিশেষ পরিকল্পনা’-র পরিচয় পেয়েছেন, যা আর কোথাও পাননি বলে তাঁর মনে হয়েছে। বেশ কিছু উদাহরণ সহযোগে তিনি তা ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হয়েছেন। সেগুলির মধ্যে একেবারে শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের বহুচর্চিত একটি কবিতার কয়েকটি ছত্র —
ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর
ওরে আজ কি গান গেয়েছে পাখী
এসেছে রবির কর।
ব্যাখ্যা করে সরকার লিখেছেন যে, এখানে ‘ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্’ শব্দ ঠিক বাজনার আওয়াজের মতো মনে হয় এবং একটা তালের ইঙ্গিত নিয়ে আসে। ‘কি গান গেয়েছে পাখী’-এই চরণের সঙ্গে গানের কথা রয়েছে; আর তার পরই ‘রবির কিরণধারা’ একটি গতির আভাস দেয়। এভাবেই এসে পড়ে তিনটি পৃথক রূপকল্প বা কল্পনাচিত্র যেগুলির প্রথমটি তাল, দ্বিতীয়টি গান এবং তৃতীয়টি গতি। লেখকের মতে, এই মৌলিক বিশেষত্ব আমরা রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ লেখার মধ্যেই পাই। এ-রকম অসংখ্য উদাহরণ লেখক তাঁর রচনার মধ্যেও সন্নিবেশিত করেছেন। উল্লেখ্য যে, কবির সঙ্গে আলাপচারিতাতেও লেখক এগুলির কথা টেনে এনে কবিকে প্রশ্ন করেছেন যে, তিনি তাঁর লেখার মধ্যে এরূপ ‘ত্রি-তল পরিকল্পনা’ লক্ষ করেছেন কিনা। উত্তরে কবি জানিয়েছেন যে, এতগুলি উদাহরণ তুলে ধরলে তার অস্তিত্ব তিনি অস্বীকার করতে পারবেন না। তবে, প্রত্যেকেরই নিজেকে প্রকাশ করার বিশেষ ভঙ্গি থাকে এবং এটিকে তার বিশিষ্টতা হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কবি অবশ্য এ-কথাও একই সঙ্গে বলেন যে, মনের ‘মগ্ন’ এবং ‘সুপ্ত’ স্তর থেকে যে সকল পরিকল্পনা আসে, তার একাধিক ব্যাখ্যা থাকা সম্ভব। এ-সব আলোচনায় পর্ব থেকে পর্বান্তরে এসেছে ‘অচলায়তন’-এর কথা ‘গুপ্তধন’-এর কথা, ‘গোরা’-র কথা, ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ‘বলাকা’-র কথা, ‘রথের রশি’-র কথা আরও কতকিছু। তৎপ্রেক্ষিতে সরকার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সঙ্গে ফ্রয়েডের যোগসূত্র নির্ণয়ের— রবীন্দ্রভাবনায় মনঃসমীক্ষণের প্রবণতা আবিষ্কারের। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তাতে কিছুটা হলেও বিব্রত বোধ করেছেন এবং ফ্রয়েডের সঙ্গে আপন-ভাবনার দূরত্বের কথা তাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন — যে কথা আমরা আগেই বলেছি।[২৬]
এতদ্সত্ত্বেও বলি যে, রবীন্দ্র-ভাবনায় মনঃসমীক্ষণ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভে সরসীবাবু-র এই প্রয়াস আমাদের কাছে অমূল্য বলেই বিবেচিত হয়। এরপরেই এসে পড়ে অধ্যাপক অনিল কুমার বসুর কথা, যিনি সরসীবাবু-র লেখাটি অনুবাদ করেছেন শুধু তাই নয়, এ-বিষয়ে আলাপ-আলোচনাকে অনেক দূর এগিয়েও নিয়ে গেছেন। উল্লেখ্য যে, কবির সঙ্গে সরসীবাবুর যে আলাপচারিতা, তাতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। এর পরেই এসে পড়ে কবি অমিয় চক্রবর্তীর কথা, যিনি ফ্রয়েডের চিন্তাধারার উপলব্ধি ও বিশ্লেষণে কবির অন্যতম সহযোগী ছিলেন। উল্লেখ্য যে, তিনি একাধারে কবির প্রিয়পাত্র ও ফ্রয়েডের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তাঁর অনেক কবিতাতেই অবচেতন মনের কথা রয়েছে। তাঁর এরকম একটি কবিতার বই রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করতে তাঁর অনুমতি চাইলে সেখানেও কবি সৃষ্টির পশ্চাতে ক্রিয়াশীল চেতন ও অবচেতনের সংশ্লেষের কথা উল্লেখ করেন। সব মিলিয়ে কবি যেন ক্রমান্বয়েই মনস্তত্ত্বের নানা দিক সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন বলেই মনে হয়। নন্দগোপাল সেনগুপ্তের বই ‘কাছের মানুষ রবীন্দ্রনাথ’ (১৯৪৪) থেকেও জানা যায় যে, জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি বিজ্ঞান চর্চায় মনোনিবেশ করতে সচেষ্ট ছিলেন। খুব আগ্রহ নিয়ে তিনি নিরীক্ষামূলক মনস্তত্ত্বের বই পড়তেন। ১৯৩৮-৩৯ সালের মধ্যে ফ্রয়েডের যে সব বই বেরিয়েছিল, তাও নাকি তাঁর পড়া হয়ে গিয়েছিল। [২৭] এতদ্সত্ত্বেও ফ্রয়েডীয় ভাবনার প্রতি কবির ব্যক্তিগত সমর্থন সূচক মতামত তেমন দৃষ্টিগোচর হয় না। তবে, সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথ যে মনোবিশ্লেষণের গুরুত্ব অস্বীকার করেননি, তা তাঁর বিভিন্ন রচনা বা বক্তব্যে তা সবিশেষ পরিস্ফুট সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
।।পাঁচ।।
উপরের আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, রবীন্দ্রনাথ ও ফ্রয়েড প্রায় সমসাময়িক হলেও কার্যত তাঁরা ছিলেন ‘দুই পৃথিবীর অধীশ্বর’ এবং প্রথম দিকে তাঁরা একে অপরকে জানলেও তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক দেখাসাক্ষাৎ বা মত বিনিময়ের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। ১৯২০-তে প্রথমবার ভিয়েনা সফরে কবি ফ্রয়েডের সঙ্গে সাক্ষাতের কোনও পরিকল্পনা করেননি। কালপ্রবাহে ১৯২৬-এ একে অপরের মুখোমুখি হলেও তাঁদের সম্পর্কে বা চিন্তা-প্রণালীতে তার কোনও স্থায়ী প্রভাব লক্ষণীয় হয়নি। তবে, প্রথমাবধিই রবীন্দ্রনাথের ভাবনা-শৈলীতে চেতন ও অবচেতন মনের নানা দিক নিয়ে আগ্রহটা বোধ করি জারি ছিল। এমন কি ‘স্বপ্নের বাস্তবতা’ নিয়েও তাঁর মধ্যে কোনও সংশয় ছিল না। তিনি নিজেও ছিলেন কমবেশি ‘স্বপ্নচারী’ — তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর সৃষ্টিকর্মের শিকড় তাঁর স্বপ্নের মধ্যেই নিহিত ছিল। অবশ্য স্বপ্ন বিশ্লেষণের ‘ফ্রয়েডিয় তত্ত্ব’-এ তাঁর বিশ্বাস ছিল না। ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ এবং ফ্রয়েডের ‘The Interpretation of Dreams’ প্রায় একই সময়ের লেখা এবং এখানেই তিনি নিজের মতো করে ‘ঘটনার ঘনঘটা’ পেরিয়ে ‘আঁতের কথা’ বের করে আনার প্রয়াসে সে-ভাবে উদ্যোগী হয়েছেন। সে-সময়ে তাঁর ফ্রয়েড পড়ার কোনও কথাই উঠতে পারে না — সে কথা আমরা ইতিমধ্যেই বিস্তারিত বলেছি। অবশ্য ‘চোখের বালি’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার সময় যখন তিনি তার ‘ভূমিকা’ লেখেন, তখন হয়তো তিনি তা পড়ে ফেলেছেন। ঘটনা পরম্পরায় সমকালের ও পরবর্তী কালের নানাজনের লেখাপত্র অনুসরণে একথা বোধ করি নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, তাদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে উঠলেও একে অপরের উপর তেমন কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেন নি। ‘সাইকো-আ্যানালিসিস’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নানা কথা লক্ষণীয় হলেও ব্যক্তি ফ্রয়েড সম্পর্কে তাঁর বিশেষ কোনও বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায় না। এক কথায় বলা যায় যে, ফ্রয়েডিয় তত্ত্বে কবির বিশেষ আস্থা কখনোই গড়ে ওঠেনি।
ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন তত্ত্বে রবীন্দ্রনাথের তেমন কোনও আস্থা না থাকলেও সামগ্রিক বিচারে মানব-মন নিয়েই তো সাহিত্যের পথ চলা। তাই সাহিত্যিকেরা তো এক অর্থে মনোজগতেরই কারবারি। সাহিত্যকর্মে মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাতকে তাই লঘু করে দেখার প্রশ্নই ওঠে না। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে একথা যেন অনেক বেশি করে প্রযোজ্য। সে কারণে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন তত্ত্ব নিয়ে নানাসময়ে পরিহাস করলেও একেবারে নিজের মতো করে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি মনঃসমীক্ষণে প্রবৃত্ত হয়েছেন এবং সেক্ষেত্রে মানুষের অবচেতনের কল্পনা, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে কল্পনার অসংলগ্নতার নানা দিকে আপন দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছেন। এমনকি ‘ছেলে ভোলানোর ছড়া’ থেকে ‘তত্ত্বকথার কচকচানি’ সর্বত্রই রবীন্দ্রভাবনায় মন যেন পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। রূপকের আবরণে বা প্রতীকের ব্যবহারে কবি-চেতনায় মনস্তত্ত্বের খুঁটিনাটি যেন আগ্রহী পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। Mystification সম্পর্কে কবির যে অবস্থান, তা হয়তো বিস্তারিত আলোচনায় এক্ষেত্রে নতুনতর মাত্রা সংযোজন করতে পারে।
পরিশেষে বলি যে, মনঃসমীক্ষকেরা মনের অজ্ঞাত প্রদেশে যে সব ক্রিয়াকলাপ সংঘটিত হয়, তারই আলাপ-আলোচনায় নিমগ্ন থাকেন। মানুষের ‘মগ্নচৈতন্য’-এর স্বরূপ সন্ধান এবং তার বিবিধ বহিঃপ্রকাশের ‘বিজ্ঞানসম্মত’ বিশ্লেষণই তাঁদের মূল উপজীব্য। সাধারণভাবে এ-সব কিছুই মনোবিদ্যার অন্তর্গত। কিন্তু সাহিত্যিকেরাও যেহেতু এক অর্থে ‘মনোজগতেরই কারবারি’, তাই মানব-মনের সুগভীর বিশ্লেষণের পথ বেয়েই তাঁদের সৃজনকর্ম বিকশিত হয়ে ওঠে। এই কাজে রবীন্দ্রনাথ যে অগ্রণী ছিলেন, সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনিও তাই স্বপ্ন দেখতেন; নিজের স্বপ্নগুলিকে তাঁর কবিতা এবং বিবিধ সৃষ্টি সম্ভারে রূপায়িত করতেন। স্বপ্ন-বিশ্লেষণের ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব তাঁর মনঃপুত ছিল না। মানব-মনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণই তাঁর অভিপ্রেত ছিল। সাহিত্য-তত্ত্বের বিবিধ আলোচনায় সেই ভাবনাকেই তিনি প্রকটিত করেছেন এবং কবিতায়, নাটকে, গল্পে, উপন্যাসে তা যেন পত্রে-পল্পবে-পুষ্পে বিকশিত হয়ে উঠেছে।
সূত্রনির্দেশ :
[১] দ্রষ্টব্য : আসরাফ জুয়েল, ‘ফ্রয়েডের সাহিত্য চিন্তা : দূরতম পাঠ’, কালের খেয়া, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, (http://samakar.com/todays_print_edition/tp_kaler_kheya/article/1609238409) accessed on 26 November 2022.
[২] ‘সূচনা’ – অংশ, ‘চোখের বালি’ উপন্যাস। উল্লেখ্য যে, সূচনা অংশের নীচে মুদ্রিত সময়কালটি হল ‘বৈশাখ, ১৩৪৭’। এর থেকে এ-কথা স্পষ্ট যে, এই অংশটি মূল উপন্যাসটি রচনার অনেক পরে এটি সংকলন হিসেবে প্রকাশের সময় লেখা। স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হয় যে, উপন্যাসটি রচনার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ফ্রয়েড না পড়লেও ভূমিকা লেখার সময় এবিষয়ে তিনি অবহিত ছিলেন।
[৩] অর্ঘদীপ ব্যানার্জী, ‘গূঢ়ৈষা-সাহিত্য সমালোচনায়, অপরজন’, জুলাই ২০২১
(http://aparjan.com/2021/07/31/July2021-arbaar/) accessed on 26 November 2022.
[৪] হিরন্ময় সাহা, ‘সৃষ্টির শিকড় থাকে স্বপ্নের ভিতর’, DRBS02K Hironmay.pdf; আরও দেখুন, লেখকের অন্যান্য রচনা, ‘অসীম মানসলোকে একাকী এক কবি’, শ্রী ভারতী প্রেস, কলকাতা ২০১৯; ‘বিষণ্ণ মনের আঁধারে আলোর দিশারী’, বুকমার্ক, কলকাতা, ২০১৯
[৫] Santanu Biswas, ‘Rabindranath Tagore and Freudian Thought’, International Journal of Psychoanalysis, 2003, Institute of Psychoanalysis, p.-718
[৬] হিরন্ময় সাহা, প্রাগুক্ত
[৭] পূর্বোক্ত (উল্লেখ্য যে, ডা. সাহা তাঁর নিবন্ধে বিস্তারিতভাবে সংশ্লিষ্ট অভিমত সমূহ উপস্থাপিত করেছেন। বিশদ আলোচনার জন্য মূল নিবন্ধ দ্রষ্টব্য।)
[৮] ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ‘ইদিপাস কমপ্লেক্স’’ বিষয়ক রঙ্গীন হালদার-এর মূল নিবন্ধটি ১৯২৪-এর ১ নভেম্বর সর্বপ্রথম Indian Psychoanalytical Society অধিবেশনে পঠিত হয়। ১৯২৮-এ Indian Science Congress Association-এ এই গবেষণার ভিত্তিতে আর একটি নিবন্ধও উপস্থাপিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৩১-এ তাঁর তৃতীয় উপস্থাপনের কথাও জানা যায়। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য : Santanu Biswas, op.cit. pp. 717 & 732
[৯] উদ্ধৃত : Rangin Halder, ‘The Working of an Unconscious Wish in the Creation of Poetry and Drama’, as quoted in হিরন্ময় সাহা, প্রাগুক্ত
[১০] পূর্বোক্ত
[১১] পূর্বোক্ত
[১২] পূর্বোক্ত; বিস্তারিত আলোচনার জন্য সরসীলাল সরকারের মূল রচনা দ্রষ্টব্য: ‘A Peculiarity in the Imagery in Dr. Rabindranath Tagore’s Poems’, n.p. 1928; আরও দেখুন Santanu Biswas, op.cit. pp. 719 – 720
[১৩] হিরন্ময় সাহা, প্রাগুক্ত; Santanu Biswas, op.cit. p. 720
[১৪] হিরন্ময় সাহা, প্রাগুক্ত; Santanu Biswas, op.cit. p. 720
[১৫] হিরন্ময় সাহা, পূর্বোক্ত
[১৬] পূর্বোক্ত; অধ্যাপক অনিলকুমার বসুর মূল লেখাটি এবং ডাঃ গিরীন্দ্রশেখর বসুর প্রতিক্রিয়ার বিশদ আলোচনা প্রবাসী-র আষাঢ় ও শ্রাবণ ১৩৪৪ সংখ্যা দুটিতে প্রাপ্তব্য। তবে, হিরন্ময় সাহা ও শান্তনু বিশ্বাস-এর প্রবন্ধদুটিতেও দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে তাদের মূল বক্তব্য পরিস্ফুট হয়েছে।
[১৭] রবীন্দ্রনাথের লেখা এই চিঠিটি হিরন্ময় সাহার উল্লিখিত প্রবন্ধে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
[১৮] উদ্ধৃত : হিরন্ময় সাহার প্রবন্ধ, প্রাগুক্ত (চিঠিপত্র ১১, পৃ. ৩৭০)
[১৯] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘সাহিত্য বিচার’, রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা, মার্চ ১৯৮৯, পৃ. ৪৯৬-৯৭
[২০] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘সাহিত্যের বিচারক’, রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা, মার্চ ১৯৮৯, পৃ. ৩০৯-৩১৩
[২১] উদ্ধৃত : হিরন্ময় সাহা, প্রাগুক্ত
[২২] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘সাহিত্য’, রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কলকাতা, মার্চ ১৯৮৯, পৃ. ৩৯৪
[২৩] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘সাহিত্যের ধর্ম’, রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা, মার্চ ১৯৮৯, পৃ. ৪৮০
[২৪] পূর্বোক্ত
[২৫] হিরন্ময় সাহা, প্রাগুক্ত
[২৬] সরসীলাল সরকার; প্রাগুক্ত পৃ.১-৩
[২৭] নন্দগোপাল সেনগুপ্ত, ‘কাছের মানুষ রবীন্দ্রনাথ’, বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৪৪ (উল্লেখ্য যে, ‘যুগান্তর সাময়িকী’-তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রসঙ্গে লেখকের ধারাবাহিক রচনাগুলি সংশোধিত ও পরিবর্ধিত আকারে এই বইতে সন্নিবেশিত হয়েছে।)