সুস্মিতা পাল
আমরা যারা এখন চল্লিশ পেরিয়ে, বলার মতো তাদের একটা শৈশব আছে। সঙ্গে জুড়ে আছে স্মৃতির আলিম্পন না-ভোলা ছবি, কথা, মুখ, স্পর্শ। বোঝা না-বোঝার কত গল্পকথা। চাঁদমালা, শুকতারা, বিক্রমবেতালে ঘোর লাগা নিস্তব্ধ দুপুর। লুকোচুরি, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্দা, ব্রতচারী সংগীতে একে অপরকে জড়িয়ে থাকা। আত্মজন, স্বজনের স্নেহ বাৎসল্য রাগ অনুরাগ, মান অভিমান মিলে মিশে বেড়ে উঠেছে আমাদের শৈশব। কৈশোরক অনুভূতি উপলব্ধির সহায় ছিল একাত্মের অনুরণন। অর্থের দৈন্য ছাপিয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল একান্নবর্তী সংস্কৃতির সহযোগী অন্তরের টান। আমাদের শৈশব যতখানি না একক ‘আমি’-র, অনেক বেশি আমাদের। ব্যক্তির অতীতযাত্রায় সেখানে ভিড় জমে সমগ্রের। শিবের থানের বুড়ো বট, আলাপ জমানো চড়ুই, ষষ্ঠীতলায় রান্নাবাটি খেলা, মামার বাড়িতে বিনিদ্র দুপুরের নিস্তব্ধতায় লিচুপাড়া, স্কুল থেকে ফেরার পথে পুচ্ছনাচা তুচ্ছনেড়ির সাদর অভ্যর্থনা, ওই বুঝি গাঙ্গুলিদের দীঘিতে তারার খসে পড়া, ঝুলনের নকল গুহার ছমছমানির পাশে রাধামাধবের দোলদোলানি — সবটা ঘিরে আমাদের শৈশব। আর শৈশব তো সর্বার্থেই স্মৃতির জিম্মায় গচ্ছিত থাকে। কখনও সখনও আমরা সেখানে ফিরে যাই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, স্মৃতির পক্ষীরাজ ঘোড়া তেপান্তরে পৌঁছে যায়। নিষেধ জানে না। আমাদের এখনও কিছু বৃষ্টিভেজা স্মৃতি বাকি আছে।
আজকের শৈশব থেকে বয়ঃসন্ধি, বলা ভালো মানুষিক জীবনের প্রতি পরতে, প্রত্যেক মানুষের জীবন পর্বে বর্তমানের দাবি প্রবল। প্রকট তার আধিপত্যে সবাই বেঁচে চলেছে মুহূর্তে, ক্ষণ-দণ্ড-পলে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে। স্মৃতির কাতরতা নেই। কেননা, স্মৃতির জন্য প্রয়োজন ধূসরতা, অস্পষ্টতা, বিস্মৃতির জড়িমা। কিন্তু, এখন তো আমরা সব কিছু করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। হাতছাড়া করা যাবে না কিছুই। বেবিবাম্পের ছবি দিয়ে সূচিত হয় প্রাক্শৈশবের যাত্রাপথ। ভূমিষ্ঠের তৎক্ষণাৎ উষালগ্নে শিশুর আগমনের সংবাদ প্রচারিত হয়ে যায় অন্তর্জালে। হাসা কাঁদা মা বলা, হামাগুড়ি পেরিয়ে হাঁটাহাঁটি — ভ্লগে ভ্লগে জমতে থাকে শৈশবের সাতকাহন। তুচ্ছাতিতুচ্ছ বাদ যায় না কিছুই। প্রবাসী শিশু দেশি ঠাকুমা দাদুকে ‘হ্যালো’ বলে অন্তর্জালের তরঙ্গ স্রোতে, ক্রেশ-কিডজি থেকে বুট-টাই পরে প্রথম স্কুলেপ্রবেশ — রিলে স্টোরিতে ধরে রাখে সমাজমানস। স্মৃতি বিদায়। ফসকে যাবে না কিছুই। ক্রপ করে ধরে রাখা হচ্ছে কাঙ্ক্ষিতটুকু। অবান্তর যা বাদ যাক। সুতরাং শৈশব ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পিক্সেলের সংখ্যা বাড়াও, নিজের পদচারণাকে সবচেয়ে চকচকে করে তোলো। ঝকমকে হতে হবে, অন্যদের ম্লান করে দাও। ব্লার্ব অপশন আছে। ভরন্ত স্টোরেজে ভরপুর শৈশব। সকলের থেকে নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার শৈশব ক্রমাগত তার আগ্রাসী মনোভাব কৈশোরে, বয়ঃসন্ধিতে বজায় রাখে। মেমরি কার্ড উপচে পড়লে ডুপ্লিকেট বা বাতিল সম্পর্কের কিছু ক্ষণছবি ডিলিট করে দিলেই হল।
আজকের কিশোর কিশোরী, তরুণ তরুণী প্রবলমাত্রায় নিঃসঙ্গ সামাজিক। ভার্চুয়াল বাস্তবে সে সবসময় ওতপ্রোত থাকতে চায়। বুড়ো বটগাছের শিকড়যাত্রা অথবা নক্ষত্রস্নিগ্ধ রাত্রির মায়াময় হাতছানি তাকে টানে না। ‘তুতো’ সম্পর্ক কী তারা জানে না। মা-বাবা ছাড়া সবাই অচল পয়সার মতো বাতিল তাদের কাছে। দোষ তাদের নয়। অভিভাবকরাও যে নিজেরা ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা। মন মাথা চোখ দিয়ে তারা পণ্যসভ্যতার বিলাসে নিজেদের রঙিন করে রাঙিয়ে নিতে চায়। কখনও তারা ক্রেতা, কখনও বিক্রেতা, কখনও লালায়িত দর্শক। জগৎ সংসার সম্পর্কের বাঁধন ভুলে বড়োরা যখন পণ্যমোহ সঞ্চারিত করে ছোটোদের মাঝে, তখন চিত্তচঞ্চল ছোটোরা তো ঝাঁপাবেই পণ্যসাগর ছেঁচে আত্মরতির মুক্তো খুঁজে আনতে। সব থেকে সেরা হতে হবে। ওই যে আশীর্বচন পালটে গেছে— ‘মানুষ হও’ বদলে ‘ডাক্তার হও’ ‘ইঞ্জিনিয়ার হও’ নিদেন পক্ষে মাস্টার — এসবই সবার মাঝে পয়লা হতে চাওয়ার পিপাসা। তাই তো এত অস্থিরতা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। স্বপ্নকল্প জগৎ থেকে হারিয়ে যেন না যাই। প্রতিমুহূর্তে আপডেট করো স্টেটাস। আড়চোখে দেখে নাও অন্যের স্ট্যাটাস। তারপর তো তুমিই ট্রেন্ড। মাংসধোয়ার রান্না ঘর থেকে লাইভ। ল্যাবরেডর রোমিও-র রোজনামচা, ফুচকা থেকে কাঁচাবাদাম। মাম্মি-বাপি-বেবি খায় ব্রিটানিয়া বিস্কিট। আট আঠারো চল্লিশ এক দেহে হয়েছে লীন। ঘুচেছে সীমারেখা, স্বাতন্ত্র্যের প্রভেদ। সার্ফিং ঢেউ আছড়ে পড়ছে শৈশবে, কৈশোরে, প্রাপ্তবয়স্কের প্রতিক্ষণের অবিশ্রান্ত জীবনে। খুঁজে চলার মোহাসক্তিতে বিনিদ্র সবাই। ঘুম নেই। নীল আলোয় জাগছে সন্ততি। মা-বাপের বলিরেখা তার শুষ্ক মুখে ছায়া ফেলেছে।
আয়োজন আড়ম্বর বহুল হলে থাকে সর্বনাশের ভ্রুকুটি। কেননা, সেখানে তো প্রাণের সাড়া থাকে না। শুধু বাইরের বাহারি সাজে চোখ ধাঁধানোর কৌশল। দুর্নিবার সাফল্যের খিদেতে মনের যোগ ততটা থাকে না, যতটা অর্থতন্ত্রের। কিন্তু অসফলই যে হয় বেশিরভাগ। পুরাতনী বয়ঃসন্ধিতে এই সাফল্য অসাফল্যে সামাজিক গ্রহণ ক্ষমতা ছিল অপার। প্রকৃতির আপন ছন্দের মতো ছিল তা সাবলীল, বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিজ্ঞান শাখার ছাত্র সব ছেড়ে ছুড়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। বড়ো ডাক্তার ছোটোগল্প লিখে সাহিত্য পরিপুষ্ট করেছেন। মেধাবী ছাত্র সমাজ পরিবর্তনের জন্য জেলের ভাত থেকে পুলিশের গুলি খেয়েছেন। না-খেতে পেয়েও কেউ নাটক করেছেন, ছবি এঁকেছেন কেউ কেউ নিরন্তর। সে-সময় যশ, অর্থ নয় সমাজ, পরিবার, শিল্পের প্রতি দাম ছিল বড়ো। এখন তো আমরা ছোটোবেলা থেকে কম সময়ে কীভাবে যোগ-বিয়োগ গুণ-ভাগ করতে পারবে তার ‘ট্রিক্স’ শেখাই। জীবন এখন প্রতিযোগিতা, তার অঙ্ক দৌড়ে শুধু নির্ভুল হলেই চলবে না, সকলের থেকে দ্রুত হতে হবে। তাই এখনকার শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ইঁদুর দৌড়ের অনুষঙ্গ। চারপাশ ভুলে ছোটো। এক নম্বর হও। জগতের বিলাস যজ্ঞে তোমার তখনই আমন্ত্রণ যখন তুমি অন্যদের টপকে এসেছো। পিছিয়ে পড়ার দল দূর হটো। অবসন্ন হও। আত্মহত্যা করো। প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে তোমার হিংসায় শিউরে তোলো সমাজকে। অভিভাবক, সমাজ কেউ তো বলে দেয়নি — ‘মন চলো নিজ নিকেতনে’, আপন গতিতে। প্রতিযোগিতায় ক্লান্ত, ভয়ার্ত, পলায়নবাদী মন তখন বেছে নেয় আপন ভার্চুয়াল রিয়ালিটি। অষ্টাদশী প্রেমিকের মন পেতে প্রোফাইল পিকচারে বসানো হয় অপর সুদর্শন তরুণের মুখ অথবা হাত কাটার রক্তাক্ত ছবি আপলোড করা হয় স্টেটাসে, ইন্টারনেট গেমের নকল রণক্ষেত্রে সমাজ পরিবারের অস্তিত্ব গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় ব্যর্থ কিশোরটি। মাঠে যায়নি কোনোদিন সে। বলহীন ক্ষীণদেহ মোবাইলের বোতাম কন্ট্রোলে পেশিশক্তির আস্ফালন দেখায়। আর্ন্তজালিক বিশ্বে নিজের নাম বিশেষ ভাবে মুদ্রিত করতে অন্তহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় আজকের বয়ঃসন্ধি। পরিবার তাদের মনের কথার পরোয়া করেনি, তারাও ফিরিয়ে দিচ্ছে তাদের বেপরোয়া মনোভাব। অশ্রুত, প্রত্যাখ্যাত হয়ে আজকের বয়ঃসন্ধি সোশ্যাল মিডিয়ার মায়াজালে আশ্রয় নিয়েছে। অন্তত ভার্চুয়াল স্বীকৃতিটুকু লাভ করবে বলে। ন্যূনতম কয়েকটা লাইক তো জোটে এখানে।
ফটিক, দুর্গা, মৃন্ময়ী, ইন্দ্রনাথদের নিয়ে হাহুতাশ করে কী লাভ! ওদের বেলা তো আর ফিজিক্সওয়ালা ছিল না, ছিল এক বীরপুরুষ বালক। মাকে ঘিরে তার দুঃসাহসিক অভিযানে সঙ্গী হয়েছি আমরাও —
মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ’পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
চলুন আজকের বীরপুরুষের মনের কথা মন দিয়ে শুনি। ওদের পাশে থাকি। ওরা আমরা কেউ-ই ভালো নেই।