অবিন দত্ত
সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ আজ পর্যন্ত যা কিছু হয়ে উঠেছে, যা কিছু অর্জন করেছে, এমনকি এই সমগ্র সভ্যতাই ছিল সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা হয়ে মানব প্রজাতির আদিম গভীরে। সেই আকাঙ্ক্ষাগুলিই পাপড়ি মেলে বিকশিত হয়েছে, যারা পরিবেশ থেকে পেয়েছে স্বীকৃতি, সমর্থন আর পরিচর্যা। ক্ষমতা-আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জেগে উঠেছে শাসক, আবার সকলের সাথে একাত্ম হবার বাসনা নিয়ে মাথা তুলেছে হৃদয়বান, স্নেহপরায়ণ পরোপকারী। এই আকাঙ্ক্ষাগুলির উৎস তাহলে কোন্ চিরন্তনতা?
প্রাণীর মতোই মানব প্রজাতির আদি আকাঙ্ক্ষা হল — অস্তিত্ব, পাভলভের ভাষায় Reflex of Existence, ফ্রয়েডের ভাষায় Life-instinct বা Eros। আর দ্বিতীয় হল — আনন্দ, ফ্রয়েডের ভাষায় Pleasure Principle। প্রজাতি তথা সভ্যতা, এই দুটি দিকেই ধাবিত সমান্তরাল ভাবে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে প্রকৃতি পরিবেশের সাথে গড়ে ওঠে এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। গড়ে ওঠে সমাজ, তখন অস্তিত্ব আর শুধুই বেঁচে থাকা নয়। ক্ষমতা, স্বীকৃতি, সম্মান, মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকা হয়ে ওঠে অপরিহার্য। বিপরীতে প্রজাতির সংরক্ষণের মধ্যেই যে অস্তিত্বের সুরক্ষা, সেই প্রয়োজনে প্রজাতির সাথে একাত্মতার তাগিদে গড়ে ওঠে ভালোবাসা, মমতা, স্নেহ, পরোপকার ও মানবিকতা। এই দুয়ের দ্বন্দ্বে গড়ে ওঠা পথেই পা-ফেলে চলেছি আমরা। এই দুই instinct-এর কোনদিকে কে বেশি ঝুঁকে পড়ব, অথবা আনন্দ বা Pleasure Principle প্রধানত কোন্ পথে তৃপ্ত হবে — আধিপত্য নাকি মানবিকতা, তা নির্ধারিত হয় সমাজ-পরিবেশের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়।
অস্তিত্বের তাগিদ আবার প্রকাশিত হয় দুই পরস্পর বিরোধী পথে। এক দিকে সমগ্রের সাথে একাত্মতায় মানুষ ও সমাজের প্রতি ভালোবাসা আর কল্যাণকামী ভূমিকায়। আবার সমগ্রের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে অস্তিত্বের সংকটে সমগ্রকে অতিক্রম করে একক ভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠার বাসনায়। এখানেই পিছনে পিছনে চলে আসে ক্ষমতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা। প্রতিপক্ষের সাথে প্রতিযোগিতা, আক্রমণ, আগ্রাসন — আমাদের গহন আকাঙ্ক্ষার এক প্রান্তে। অন্য প্রান্তে গড়ে ওঠে শুশ্রূষা আর মানবিকতার আবেগ।
সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পথে সেই আদিমতম ক্ষমতার বাসনা থেকে জন্ম নেয় শাসকের মন। যার মূল আনন্দ আধিপত্যের তৃপ্তি। সমগ্রকে অতিক্রম করে জনতার মনোযোগের শিখরে আসীন নিজের উজ্জ্বল ছবি — ‘ওই যে তিনি চলেছেন’ — এ হল শাসকের অন্তিম তৃপ্তি। কিন্তু তৃপ্তি যে কোনোদিন সীমানা মানে না, তাই ক্ষমতাও সীমানাকে স্বীকার করতে রাজি নয়। শাসকের তাই কোনোদিন থেমে যাওয়া সম্ভব নয়, তার ক্লান্তিহীন যাত্রা প্রতিবেশী আর প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রকে পদানত করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, অন্য রাষ্ট্রকে আক্রমণ, দখল আর গণহত্যার পথে সাম্রাজ্য বিস্তার। এভাবেই জন্ম নেয় সাম্রাজ্যবাদী শাসক।
শাসক মনের সব সময়ের সঙ্গী হল ভয়, ভয় প্রতিপক্ষকে। কখন সে ক্ষমতায় অতিক্রম করে যায় তাকে। ভয় পরাজয়কে, ভয় ক্ষমতা হারাবার, জনপ্রিয়তা হারাবার। এই ভয় তার শিয়রে সদা জাগ্রত। নিরাপত্তাহীনতায় শাসক ক্ষমতাকে ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত করতে করতে হয়ে ওঠে একনায়ক, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট। যে কোনও প্রশ্ন, প্রতিবাদ বা সমালোচনা তার কাছে ভয়ের সংকেত। সে চায় শুধুই প্রশ্নহীন আনুগত্য। সমস্ত বিরোধিতাকে সমূলে বিনাশ করতে নামিয়ে আনে নির্যাতন, নিপীড়ন, কালা আইন, হত্যা থেকে গণহত্যা। ক্ষমতা যে কখনও নিশ্ছিদ্র হতে পারে না। তাই তার শান্তি নেই। যুদ্ধ, হত্যা, জয়-পরাজয়ের উত্তেজনায় বন্দি হয়ে পড়ে শাসক। চাইলেই সে আর থামতে পারে না, এগিয়ে তাকে যেতেই হবে। সামনে পরাজয়, সামনে মৃত্যু জেনেও। যেমন ভাবে হিটলারকে তাঁর জার্নি শেষ করতে হয় আত্মহত্যায়। যে শাসকের মনের গভীরে যত ভয়, সে তত হিংস্র, নৃশংস। শত্রুকে হত্যা করে নিজের আত্মবিশ্বাসকে জাগিয়ে রাখতে চায়। মোগল সম্রাট চেঙ্গিস খান দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে অজস্র দেশ ও জনপদ দখল করে বসতি, শস্য, সম্পদে আগুন জ্বালিয়ে নৃশংস গণহত্যা ঘটিয়ে দেশে ফিরতেন। পেছনে পড়ে থাকত লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের শ্মশান। নৃশংস হত্যায় জড়িয়ে থাকত নিজের ক্ষমতার তৃপ্তি শুধু নয়, শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করবার নিরাপত্তাবোধ। ইতিহাসের পথে এভাবেই তো দেখে এসেছি আমরা— মানবমন কতখানি হিংস্র ও নৃশংস হয়ে উঠত পারে শাসকের ভেতরে। লক্ষ লক্ষ মানুষের শিরশ্ছেদ করে মানুষের এই উল্লাস— কীভাবে সম্ভব! সমগ্র বিংশ শতাব্দী জুড়ে যখন পৃথিবীতে গণহত্যা ঘটে যায় প্রায় দশ কোটি মানুষের, তখন বুঝতে বাকি থাকে না — পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ভেতরে জেগে বা ঘুমিয়ে থাকে এক শাসক।
জার্মান জাত্যভিমান হিটলারের নেতৃত্বে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হয়ে উঠবার ঘোরে ইহুদি, পোল, কমিউনিস্ট মিশিয়ে প্রায় দেড় কোটি মানুষকে হত্যা করে— শুধুমাত্র শত্রুহীন পৃথিবী গড়ে তুলতে। সেদিন পৃথিবীর প্রতিটি জার্মানের ভেতরে জেগে উঠেছিল এক একটি শাসক, অজস্র ছোটো ছোটো হিটলার। অন্যদিকে কমিউনিস্ট নেতা স্তালিনের হাতে প্রায় এক কোটি এবং পলপটের হাতে তিরিশ লক্ষ মানুষের গণহত্যা ঘটেছে বলে শোনা যায়। কমিউনিস্ট নেতার হত্যাকারীতে রূপান্তর আমাদের আশ্চর্য করে দেয়। কিন্তু মানব প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়মেই এই আশ্চর্য রূপান্তর ঘটে যায়। অনাহার, দারিদ্র্য আর পরাধীনতার যন্ত্রণা থেকে মানুষকে, সমাজকে মুক্তি দিতে যাঁদের জীবন একসময় ছিল উৎসর্গীকৃত, সময়ের পরিবর্তনে একসময়ের সেই কল্যাণকামী নেতৃত্বই নেতৃত্বের আধিপত্যে বসবাস করতে করতে এমন এক দুরূহ মনোজাগতিক কোণে পৌঁছে যায়, সেখানে সমগ্রের কল্যাণ আর নিজের নেতৃত্বের সুরক্ষা পরস্পর বিরোধী হয়ে পড়ে। নেতৃত্বের ভেতরে নিজের ক্ষমতা, ক্ষমতার ভেতরে নিজের অস্তিত্ব — ব্যক্তিগত অস্তিত্বের বিপন্নতায় সমগ্রের কল্যাণকে অতিক্রম করে যায় ব্যক্তিগত অস্তিত্ব। মহান নেতৃত্বের ভেতরেই জন্ম নেয় নৃশংস ঘাতক। দেশ ও জাতির কল্যাণকে তখন সে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে নিজস্ব অস্তিত্বের অনুকূলে থাকা রাজনৈতিক বিশ্লেষণের পথ ধরে। মহৎ কল্যাণের প্রয়োজনে ছোটোখাটো অন্যায় এক চিরকালীন অকাট্য যুক্তি ফ্যাসিস্টদের। এখনও ক্ষমতান্ধ ঘাতক শাসক গুপ্ত গহ্বর থেকে বেরিয়ে পড়েছে প্রকাশ্যে। তারাও ক্রমশ হয়ে উঠতে চাইছে একনায়ক।
তবু শাসক সর্বোপরি এক মানব হৃদয় যেহেতু — স্নেহ, বাৎসল্য, মানবিকতা অনেকের হৃদয়েই অম্লান থাকে। সম্রাট আকবর, শের শাহ প্রজার কল্যাণ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেননি। দানবীর রাজা হর্ষবর্ধন প্রজার দারিদ্র্যকে উপেক্ষা করতে পারেননি। তাঁদের হৃদয় শাসক নয়, পিতৃহৃদয় হয়ে উঠেছিল চিরন্তন বাৎসল্যে। তাঁদের তৃপ্তি ছিল শাসকের নয়, আধিপত্যের নয়, পিতৃত্বের আর অভিভাবকত্বের।
শাসক শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে যে ক্ষমতা ও আধিপত্যের রঙ — তারই অনুসারী হয়ে শাসক-শাসিতের সম্পর্ক প্রভু-ভৃত্যেরই একটা আদল বহন করে চলেছে ইতিহাসের পথে। গণতন্ত্রহীন রাজা-বাদশা বা Emperor-এর যুগ অতিক্রম করে গণতন্ত্রের পৃথিবীতে নির্বাচিত সরকারকেও কেন আজও শাসকদল বলি? শাসকগোষ্ঠী বলি? সকলেই তো সাধারণ মানুষের ক্ষমতায় নির্বাচিত, সাধারণ মানুষের ইচ্ছা ও ভাবনা বহনকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি মাত্র। শাসক শব্দটি শাসকের বড়ো প্রিয় হতেই পারে, শাসিতের কেন পছন্দ!