অতীশ নন্দী
একবার খেয়াল করি।
আমাদের চারপাশে তো, কত কথা হয়।
সব কথা কি আমরা শুনতে পাই!
সব কথা শুনতে,
আমাদের কি ভালো লাগে!
এমন যদি হয়,
শুনতে ভালো লাগছে,
পছন্দের কথা হচ্ছে — আমরা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করি।
এই আগ্রহ প্রকাশের লক্ষণ হিসাবে, কতকগুলি জিনিসকে, আপাতত চিহ্নিত করা যেতে পারে।
আগ্রহ প্রকাশের কয়েকটি লক্ষণ,
- আমরা তাঁর দিকে, প্রায় চোখের পলক না-ফেলে, তাকিয়ে থাকি।
- একটু হলেও, তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ি।
- কখনও কখনও মাথা নাড়ি।
এছাড়াও,
- চারদিকে কত কী ঘটছে, কে আসছে/ কে যাচ্ছে, তার দিকে কোনো নজর নেই। বরং কেউ যদি সে সময় ডাকেন বা যিনি বলছেন এবং যিনি শুনছেন, তার মাঝখানে এসে পড়েন; দেখা যাবে অতিরিক্ত মাত্রায় বিরক্তির বোধ। প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিরক্তির প্রকাশও ঘটছে।
বক্তা-শ্রোতা সে সময় গভীর মনোযোগে, অদৃশ্য বন্ধনীতে আবিষ্ট। উদাহরণ — কবিগান, যাত্রাপালা, থিয়েটার, সিনেমা বা নাটক ইত্যাদি চলাকালীন এসব ঘটে। যা হয়তো আমাদের চোখে পড়ে, আমরা মনে করতে পারি।
এবার একটু অন্যরকম দৃশ্যে যাওয়া যাক।
বিকেলের Visiting Hours-এ হাসপাতালে। বাড়ির লোকেরা এসেছেন। রোগীদের সাথে দেখা করতে। হঠাৎ-ই Ward-এ প্রবল চিৎকার, চ্যাঁচামেচি। সবাই একজায়গায় জড়ো হয়ে, একসাথে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন। সিকিউরিটির লোকেরাও হাজির। এসেছেন, সিনিয়ার নার্স এবং অন্যান্য ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকরা। খানিক বাদে, চিৎকার দুর্বল হতেই, সবাই Ward-এর বাইরে এলেন। সিনিয়ার নার্স মন দিয়ে শুনছেন, একে একে সবার কথা। ধীরে সবাই শান্ত হলেন।
এখানে, দেখা গেল, পরিস্থিতির ভিতরে থেকেই, শোনার অবিরাম প্রচেষ্টা এবং পরিস্থিতিকে সঙ্গী করে, পরিস্থিতিকে শোনা, তাকে বোঝা। কিছু একটা অসুবিধা ঘটছে, তাকে মান্যতা দেওয়া। পরিস্থিতি থেকে সরে না গিয়ে, পরিস্থিতির সঙ্গে, পথ হাঁটা।
এখানেই তৈরি হল, যাঁরা শুনতে এলেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। সেই উত্তপ্ত জনতা, ধীরে ধীরে, একে একে, নিজেদের কথা বলতে পারলেন। শ্রোতারা ধৈর্য ধরে, তাঁদের সব কথা শুনলেন। বললেন, Ward-এর ভিতরে, এত চিৎকার, চ্যাঁচামেচি — রোগীদের স্বার্থ সুরক্ষার পরিবর্তে অসুবিধার কারণ হতে পারে। বক্তা এবং শ্রোতা — উভয়েই শান্ত মনে, খুশি হয়ে, সমস্যার দিকে নজর দিতে পারলেন।
আমরা সমস্যার দিকে নজর দিলে, তার সমাধানও আমাদের আয়ত্তে চলে আসার সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে — যা আমাদের ঈপ্সিত এবং লক্ষ্য। তাহলে, সবার আগে, শুধুমাত্র সমস্যাকে দেখতে পেতে হবে। তবে না তার, চিহ্নিত করণ। সমস্যাকে যখন দেখব বা খুঁজব, তা যথাসম্ভব, ব্যক্তি বিবর্জিত হলে, বাড়তি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।
যে-কোনো সমস্যা উত্থাপিত হবে, কোনো না কোনো আলাপচারিতায় বা পরিস্থিতিতে। আলাপচারিতা নিজের সাথে, নিজের হতে পারে বা নিজের সাথে অন্যের হতে পারে বা পরিস্থিতির সাথে হতে পারে।
নিজের সাথে, নিজের আলাপচারিতায়; কোনো মানুষ, নিজের সাথে নিজে, কথা বলে চলেছেন। কিছু না কিছু ভাবনা বা পরিকল্পনা করেছেন। এই প্রক্রিয়ায়, একাই নিজের সাথে নিজের, নানা ভাবনা কাজ করছে। তার মধ্য থেকে বেছে নেওয়া হচ্ছে, কোনটা বেশি জরুরি, এই মুহূর্তে। যেমন ভাবা হচ্ছে, তেমনটাই যে মান্যতা পাচ্ছে — তা নয়। যে সব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য খবর, উপস্থিত হচ্ছে, সেটা আবার কাটাছেঁড়া হয়ে Screened বা পরিশুদ্ধ হচ্ছে। সবই ঘটছে, স্বনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায়, অনেকটাই অচেতনে। অর্থাৎ পরিকল্পনা করেই নিজের প্রয়োজনের উপাদান সংগৃহীত হচ্ছে, মনের গভীর থেকে এবং মনের গভীর থেকেই, এই প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতিও তৈরি হচ্ছে। দরকার হয়ে পড়ছে, মনোযোগ, ধৈর্য, সমস্যার প্রতি নিবিড় পর্যবেক্ষণ, একাগ্রতা। তাঁর নিজস্ব পরিস্থিতি অনুসারে বোঝা এবং তা মান্যতা দেওয়া। এ সবই, তিনি মনের অন্দর থেকে শুনতে পাচ্ছেন। ফলে, শুনতে পাওয়ার জন্য, মনের মনোনিবেশ, কতই না গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
যখন অন্য কারোর কথা শুনতে হয়, সেখানে পরিস্থিতির মধ্যে গুণগত কিছু বিষয় যুক্ত হয়। দেখা যাবে হয়তো কথা শুনতে শুনতে অচেতন ভাবে, নিজের ভিতরে বিরক্তি, খারাপ লাগার বোধ, অনীহা, অনিচ্ছা, উৎসাহহীনতা— এসব আবেগ তৈরি হচ্ছে, স্বতঃস্ফূর্ততায়।
শ্রোতার খেয়ালে আসবে না সহজে, যে, তিনি কিছুই ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছেন না। এমনও হতে পারে, শ্রোতার খেয়ালে এল, ঠিকমতো শুনতে পাননি। আবার হয়তো নতুন করে শুনতে চাইলেনও; তবে অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হল না। অর্থাৎ সবটা শুনতে পেলেন না।
আমরা নজর করলে দেখব, শ্রোতার নিজের ভিতরের আবেগগুলিকে (বিরক্তি, খারাপ লাগার বোধ, অনীহা, অনিচ্ছা, উৎসাহহীনতা) চেনার ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি, হয়তো থেকে গেছে। ফলত শুনতে গিয়ে, অচেনা আবেগগুলি দ্বারা তাড়িত হয়ে, বাস্তবতার বোধ তেমন কার্যকরী হয়ে উঠতে পারছে না।
সুতরাং, অন্যকে শুনতে গেলে, নিজেকে চেনা, নিজের আবেগকে চেনা, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজস্ব আবেগ সম্পর্কে সচেতনতা, অন্যকে শুনতে পাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দরকারি। নিজের আবেগকে চেনা; Inner listening বলতে পারি। বাইরে থেকে যা শুনছি; তা Outer listening। Active listening গড়ে উঠছে Inner listening এবং Outer listening সমন্বয়ে।
সুতরাং, একই সাথে আমরা বাইরের শব্দ বা বাক্যের ভিতরের আবেগ এবং সেই মুহূর্তে, নিজের অভ্যন্তরে, গড়ে ওঠা, নিজস্ব আবেগকে চিহ্নিত করতে পারব। আমরা সচেতন হতে পারব, কোনটা আমার, আর কোনটা এই নতুন প্রেক্ষিতের। যদিও, এসব একদিনে বা এক লহমায় গড়ে উঠবে, এমনটা নয়। বলা যেতে পারে, এ এক সচেতন প্রয়াস এবং চর্চা। এতে যেমন ধৈর্য লাগে, মনোযোগ লাগে, নিজের আবেগ সম্পর্কে সচেতন হতে হয় এবং একই সাথে নতুন পরিস্থিতি, নতুন শব্দ, নতুন বাক্য বা বাক্যের বিন্যাসের প্রতি সহিষ্ণু হতে পারলে, সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।
Active listening বা প্রত্যক্ষ শোনা; সম্পূর্ণ এক Intellectual বা Cognitive part বা ভাবনার দ্বারা সংগঠিত বা পরিচালিত অংশ। নিজের আবেগকে জানা, চেনা, বোঝার মধ্য দিয়ে, মনকে স্থির করে, প্রস্তুতি নিতে হয়। প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে, নিরপেক্ষতা জরুরি। নিরপেক্ষতা, নিজের নিজস্ব আবেগ এবং পরিস্থিতিতে উৎপন্ন আবেগ— এই দুই আবেগকে চিহ্নিত করতে পারে, যা খুব প্রয়োজন। ফলত নিরপেক্ষতা Active listening-কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
সুতরাং আবেগ তাড়িত হয়ে শোনা এবং Active listening-কে হাতিয়ার করে শোনার মধ্যে যে পার্থক্য থাকবে, তাতে আর সন্দেহ কি !
এতকিছু সামলে শুনতে হলে, শোনার জন্য বেশ কিছু শক্তিক্ষয় হয়। চর্চারও প্রয়োজন।
অতএব, শোনার মন, জীবন যাত্রায়, এক নতুন মাত্রা।