পৌলমী ভড়
বর্তমান সময়ে শিশু মনস্তত্ত্ব বহুল চর্চিত এক বিষয়। ঘরে ঘরে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে শৈশব যেন কোথাও হারিয়ে ফেলছে তার নির্যাস। তবুও এই বিভ্রান্তিময় পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রসাহিত্য মানসিক শান্তি এনে দেয়। বহু বছর পূর্বেই যা তিনি লিখে গেছেন তা আজকের ইঁদুর দৌড়ের যুগেও যে বড়ো প্রাসঙ্গিক। আর এখানেই তার সৃষ্টির সার্থকতা।
দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের রচনায় মনস্তত্ত্ব বিষয়টি খুব প্রচ্ছন্নভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। বহু জটিল মনস্তাত্ত্বিক বিষয়কে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন সহজভাবে। এত বহুমুখী তার উপস্থাপন — বোধ করি আর কেউ-ই এমন সমগ্রতায় ছোটোদের মনের কাছাকাছি পৌঁছোতে পারেননি আজ পর্যন্ত।
‘ছুটি’ কবিতায় শিশুটি যা-যা চিত্রকল্প আঁকছে তার নিজের মনে, যেমন — ‘মনে করো না উঠল সাঁঝের তারা; মনে করো না সন্ধ্যে হল যেন’, এগুলো কোথাও যেন imaginary play বা তার কাল্পনিক খেলাকে ব্যাখ্যা করে, যা কিনা শিশুর বিকাশমূলক মনস্তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। দুপুরবেলা তার পড়তে ইচ্ছে করছে না, তাই সে ছুটি চায়। এই ছুটি চাওয়া শিশু মনের এক চিরন্তন আকুতি। তার স্বপক্ষে শিশুটির নিজস্ব যুক্তিও রয়েছে যে, ‘রাতের বেলা দুপুর যদি হয়, দুপুরবেলা রাত হবে না কেন’ (যেহেতু আমরা বলি রাত দুপুর — এখানে তার ভাষা অর্জন করার দক্ষতা ও প্রকাশ পায় যা কিনা আবারও বিকাশমূলক মনস্তত্ত্বকে প্রকাশ করে)। আবার কানাই মাস্টার কবিতায় বিড়ালকে পড়ানো সেও কিন্তু এক ধরনের imaginary play অথবা Role play বটে, যেহেতু সে স্কুলে শিক্ষকদের দেখছে তাই তারও ইচ্ছে শিক্ষক হওয়ার।
হবুচন্দ্র রাজার পায়ে লাগছে ধুলো, রাজার তা একান্তই অপছন্দ। অনেকে এসে অনেক বড়ো বড়ো সমাধান দিল — পৃথিবীকে চামড়া দিয়ে ঢেকে ফেলা পর্যন্ত ভাবা হল, শেষকালে মুচি বলল পা ঢাকলেই হয় — সেই হল ‘জুতা আবিষ্কার’। এই কবিতা শিশুদের শেখায়, জীবনের সমস্যার সমাধান যে সব সময় অত্যন্ত জটিল তা নয়, অনেক বড়ো সমস্যারও অনেক ছোটো সমাধান হতে পারে। শিশু মনস্তত্ত্বে এই ভাবনা প্রতিষেধকের মতো — যা তাদের রক্ষা করতে পারে অনেক হতাশা থেকে।
আবার শিশুর সাথে পরিবেশের পরিচয় ঘটানো তার দৈহিক মানসিক বিকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। রবীন্দ্রনাথের সহজ সরল লিখন শৈলীতে কবিতাগুলি প্রাণ পায়। শিশুরাও নিজেদের উচ্ছলতা যেন খুঁজে পায় সেই কবিতায়। যেমন — ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর/ নদেয় এলো বান’ বা ‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’ — একান্তই সাদামাটা এক জীবনের চিত্রকল্প যার সাথে শিশুরা একাত্ম হতে পারে সহজেই।
দায়িত্ববোধের শিক্ষা, যা দেওয়া হয় শৈশব ও বাল্যকালে, তা গভীরভাবে প্রভাব ফেলে শিশুদের মনে। বড়োদের তারা পর্যবেক্ষণ করে ও তাদের মতো দায়িত্বশীল হতে চায়। শিশু মনের এই বড়ো হয়ে ওঠার ইচ্ছে ধরা পড়েছে তাঁর ‘বীরপুরুষ’ কবিতায়— ‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে’ এবং মাকে নিজের দায়িত্বে একা নিয়ে যাওয়ার সময় বিপদও ঘনিয়ে আসে। ডাকাত দল আক্রমণ করে তাদের। ভীষণই এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে খোকা কিন্তু রক্ষা করতে সক্ষম হয় তার মাকে। দাদা বিশ্বাস করতে চায় না এহেন বীরত্ব, কিন্তু শেষে সবাই স্বীকার করে যে খোকা সত্যিই বড়ো দায়িত্বশীল হয়েছে — ‘পাড়ার লোকে বলতো সবাই শুনে/ ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে’। প্রতিটি শিশুর বড়ো হয়ে ওঠার স্বপ্ন পূরণের ছবি যেন দেখিয়েছেন তিনি এখানে। ছোটোদের অন্তরমহলে এতই অবাধ ছিল তার যাতায়াত। বিদ্যালয় জীবন শুরু হলে শিক্ষককে আদর্শ হিসাবে দেখে শিশুরও ইচ্ছা হয় তার মতো হতে, তাই কানাই মাস্টার কবিতায় সে শিক্ষক — ‘আমি আজ কানাই মাস্টার/ পড়ো মোর বেড়ালছানাটি’।
এই অনেক কিছু হতে চাওয়ার মধ্যে, বড়োদের মতো হতে চাওয়ার মধ্যেই শিশু মনের আনন্দ আর এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে তার ব্যক্তিত্ব, প্রকাশ পায় তার স্বাধীন চিন্তাধারা। তাই তো ‘বিজ্ঞ’ কবিতায় একটু বড়ো দাদা, তার মাকে বলে ‘খুকি তোমার কিচ্ছু বোঝে না মা/ খুকি তোমার ভারী ছেলেমানুষ’।
শুধু ছড়া বা কবিতা নয় ছোটোদের জন্য তিনি রচনা করেছেন অনেক নাটক, গল্প, নৃত্যনাট্য। ডাকঘরের অমল বা ছুটির ফটিককে আমরা কেউ-ই বড়ো হয়েও ভুলতে পারিনি — ফটিক যখন বলে ‘মা, আমার ছুটি হয়েছে মা’ — কারোর চোখের জল বাঁধ মানে না এখানে।
রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের দিকে যদি তাকাই দেখতে পাই চিত্রাঙ্গদাকে। মণিপুররাজ ছেলের মতো বড়ো করেছিলেন তাকে কারণ তার পুত্রসন্তানের আশা ছিল। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা অর্জুনকে দেখার পর অনুভব করল যে সে আসলে মেয়ে। শিশুরা যখন শৈশবের গণ্ডি পেরিয়ে বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় পৌঁছোয় তখন তৈরি হয় তার Gender Role Identity, যদিও এই প্রক্রিয়া বহু পূর্বেই শৈশবেই শুরু হয়ে যায় পারিপার্শ্বিক শিখনের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ শেখালেন যে — প্রথমত, যে-কোনো দক্ষতা লিঙ্গ নিরপেক্ষ; চিত্রাঙ্গদা সেই সমস্ত কিছুই করতে পারত যা একজন পুরুষ পারে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক মানুষের অধিকার রয়েছে তার লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণ করার। চিত্রাঙ্গদা যখন চাইল নারী হতে তখনই সে পরিপূর্ণ নারী হল। বর্তমান সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে আমরা নারী পুরুষের অনেক Unique Gender Roles দেখতে পাই, রূপান্তরকামীরা আজ যখন সামাজিক স্বীকৃতি পাচ্ছেন, সেই পরিস্থিতিতে আমরা যদি শিশুদের শেখাতে পারি যে তার লিঙ্গ নির্ধারণ ও লিঙ্গ একাত্মতা একান্তই তার নিজস্ব অধিকার, তবে তার বিকাশ প্রকৃত অর্থেই যথার্থ হয় — আজ থেকে বহু বছর আগে রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন তা।
‘শোক’ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ — আনন্দের মতোই চিরন্তন তার উপস্থিতি। ডাকঘরের অমলকে দেখি, কঠিন অসুখের মধ্যেও তার চোখে কত স্বপ্ন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছে তার কল্পনাশক্তি, তার মনের বিচরণ সর্বত্র। অমল আশাবাদী। জীবনের বড়ো কঠিন সময় দাঁড়িয়েও যে আশা ধরে রাখা যায় অমলের মতো — এ বোধহয় শুধু শিশু নয় বড়োদেরও শেখার।
আবার ‘তাসের দেশ’ শিশুদের নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে না-থেকে মুক্তভাবে বাঁচতে শেখায়, প্রশ্ন করতে শেখায়। আমরা যদি শিশুকে একটা মুক্ত মানসিক পরিবেশ দিতে পারি তাহলে তার সর্বাঙ্গীণ মানসিক পরিপূর্ণতা লাভ সম্ভব হয়। শিশুটির ভালো লাগা, খারাপ লাগা, প্রশ্ন কল্পনাশক্তি, উদারতাকে মূল্য দিয়ে আমরা যেন খোলা মনে তাকে বড়ো হওয়ার সুযোগ করে দিই — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো এটাই শেখাতে চেয়েছেন তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে। ছোটোদের জন্য রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বদা নিয়োজিত। তিনি শুধু নোবেল জয়ী বিশ্ববিখ্যাত কবি নন, তিনি শিশুদেরও রবি ঠাকুর। একথা অস্বীকারের কোনো জায়গা নেই যে, বর্তমান যুগের জটিল সামাজিক অবক্ষয়ের মুখে দাঁড়িয়েও শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশের সমস্ত অপরিহার্য উপাদানই আমরা পাই তাঁর রচনা থেকে। আর এখানেই তিনি বিশ্বকবি।