‘সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া’ : শিল্পসত্তা

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

একটি বিপ্লবী তার সোনা রুপো ভালোবেসেছিল। এসব এখন গল্পকথা। এখন দেখছি সব জ্ঞানপাপী পাখি ফিরে গেছে নীড়ে। আমাদের খাদ্য আন্দোলন থেকে আমাদের নন্দীগ্রাম বাঙালি মধ্যবিত্তের আর কোনও কিছুতেই ভরসা আছে বলে মনে হয় না। শেষ গতি ফেসবুক। অন্তহীন অপেক্ষা কবে রামকৃষ্ণদেব কল্পতরু হবেন। সুতরাং রামকৃষ্ণে বিশ্বাস থাকুক না থাকুক রামকৃষ্ণ মিশনে একটা ভরসা রাখা যেতে পারে। আসলে আজকের বাঙালিকে দেখে অবাক লাগে খানিকটা স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয় বা বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। একশো বছর আগে সে দেখেছে মোটামুটি সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’ প্রকাশিত হচ্ছে, নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ লেখা হচ্ছে বাংলা ভাষার দিগন্ত কত বেড়ে যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ লিখবেন, কমিউনিস্ট পার্টির যাত্রা শুরু হবে। তখন সত্যিই একটা দিন ছিল যাকে এখন মনে হয় গার্সিয়া মার্কেজের জাদু বাস্তবতার থেকেও অলীক। আর আজকে বিসর্জনের পরের দিন যে কোনও পুজো প্যান্ডেল দেখে মনে হয় একুশ শতকের মধ্যবিত্ত ডেকাডেন্সের আভিজাত্য হারিয়েছে। তার ন্যাকা নস্টালজিয়ার অতীত আছে, খানিকটা নির্বুদ্ধিতার সত্তা হিসেবে ভবিষ্যৎ-ও আছে কিন্তু যা প্রকৃতই অনুপস্থিত তা হল বর্তমান। খবরের কাগজের তৃতীয় পাতায় কঙ্কালের অনির্বচনীয় হাসি মধ্যবিত্তের উচ্চাশা আর নিজেকে কোথাও চিহ্নিত করতে পারে না। চাঁদ উঠলেই সে ফেসবুক করে অথবা মেসেঞ্জার, অশনি পথখাদ্য, বসনে হাফপ্যান্ট, উচ্চারণে টিভি সিরিয়ালের ইংরেজি। উত্থান বাদ দিলে উনিশ শতকের যে খণ্ড চেহারাটা পাওয়া যায় উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে উপগলিতে, আজ কলকাতা ও তার বাসিন্দারা প্রায় তাই। প্রতিমা নেই, তো মণ্ডপ পড়ে আছে। যেন এক গতযৌবনা রক্ষিতা এই শহর, এই মধ্যবিত্ত, এই ভদ্রলোক একদা অনেক গীতমালা ও প্রুস্ফুল্ল কুসুম দেখেছে। ব্যবসা চলে গেছে পশ্চিম ভারতে, লক্ষ্মী পাট গুটিয়েছেন — এদেশে আলামোহন দাশ, রামগোপাল সরকার, বীরেন মুখার্জিদের বসত ভিটেয় বটের ঝুড়ি! আর সরস্বতী— এত সাধের গ্লানি ও মাস্টার মন্দিরতা সরস্বতী! সেও তো কেচ্ছায় দেশ ছেড়েছেন। উচ্চশিক্ষার মন্দিরগুলি আজ বাংলার বাইরে। আজ কলকাতার কলতলায় ক্লান্ত গলিতে তারা কোলাহল করে আর সেই কোলাহল টকশো, ডিবেট, পেজ থ্রি ভেদ করে সর্বভারতীয় আঙিনায় পৌঁছায়ও না। জীবন প্রভাতে যে মধ্যবিত্ত বাঙালি রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত দেখেছিল, এমনকি অমর্ত্য সেন বা সত্যজিৎ রায়ের নামও করা যেতে পারে আজ সে খোকাবাবুদের দেখা মেলে মেলায় অথবা কবিতার প্যারেডে। আজ জীবন সন্ধ্যা। আজ বাঙালির সৌরভ গাঙ্গুলি চলে গেলে এমন নামই নেই যা হাজারিবাগের পরে চালু।  

আমাদের কিশোর বয়সে জানতাম সেই সত্তর দশকে বিপ্লব হচ্ছে জনগণের উৎসব। আজ বিপ্লবের নাম মাধবীলতা, মতান্তরে দুর্গোৎসব অথবা যে কোনও একটা ফিকিরে আলার মোড়ের মেলার প্রতি জনগণের বিপ্লব। প্রতিমা দর্শনের প্রবল কুচকাওয়াজকে মৃতদের মাথার মিছিল মনে হয়। হা, পোড়া কপাল! কেন যে আমাদের উনিশ শতক ছিল?

একসময় মধ্যবিত্ত যুবকের আদর্শ ছিল চতুরঙ্গের সতীশ অথবা শ্রীকান্তর ইন্দ্রনাথ। এরা যে আমাদের ভাই বা আত্মীয় অথবা প্রতিবেশী ছিল সব সময়, তা নয় কিন্তু সম্পূর্ণ নীরবয়বী নয়; তাই দেখা যায়, এমন ডানপিটে পরিসর ছিল, যৌবনের। বস্তুত বাঙালির এই যৌবনায়ন শুরু হয় ডিরোজিও-র ইয়ং বেঙ্গল প্রজন্ম থেকে। এই যুবক তাত্ত্বিক ও অবাধ্য ছিল সাধারণত। সে নিয়ম ভাঙত। নিষিদ্ধ মাংস ও মদ্যপান করত পরে বিধবা বিবাহে সে-ই সোচ্চারে সমর্থন জানায়। কিয়ৎ পরে সে-ই যুক্তির জাল শুনতে ও বুনতে শেখে। তাকে দেখা যেত কেশব সেনের বক্তৃতা সভায়। সে জানত — ‘নায়মাত্তা বলহীনেন লভ্য’ ও এই জেনে অনুশীলন সমিতি জাতীয় সংগঠনের প্রতি শ্রদ্ধাসহ ব্যায়াম চর্চা ও বহ্মচর্যে মনোযোগী হতো।’ ‘একবার সাধ আছে মা মনে গঙ্গা বলে প্রাণ ত্যাগিব জাহ্নবী জীবনে’ — এই সংকল্প নিয়ে আহিরীটোলা ঘাটে পারাপার করত।

এই যুবক হিন্দু। নজরুল ইসলাম তখনো এই মুসলিম যুবকের আত্মপরিচয় নয়। মোজাফ্ফর আহমেদ প্রমুখের সঙ্গে তার দেখা হলেও খিলাফত আন্দোলনের ফলে তার স্বাভিমান জাগ্রত হওয়ার পরে হলেও ‘লাঙ্গল’ ও ‘গণবাণী’-তে লেখা সত্ত্বেও, মুসলমান যুবক আধুনিকতার সাধ পাবে আরও অনেকদিন পরে। যা বলছিলাম উক্ত হিন্দু যুবকই চল্লিশ দশকের সাম্যবাদীতে পরিণত হয়। এই সেদিনও বাঙালি কথাশিল্পী একে নকশালপন্থী হিসেবে ভজনা করেছেন। অর্থাৎ শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবক, উচ্চবর্গীয় ব্রাহ্ম যুবক একধরনের সামাজিকতা ও প্রগতি সংরক্ষতার মধ্যে মুক্তি খুঁজে নিত। ও হ্যাঁ বলার কথা, সম্ভবত রামকৃষ্ণ প্রমুখে সংস্কারক মুক্তবুদ্ধির ফলেই ধর্মীয় প্রথা পালনতা তাঁর নিত্য কর্ম পদ্ধতির অঙ্গ ছিল না যদিও তাকে নাস্তিক হতে আমরা কমই দেখেছি। এমনকি পঞ্চাশ-ষাট দশকেও হয় হেমন্ত কণ্ঠে নয় উত্তম কুমারের অবুঝ চাহনিতে ভগ্নহৃদয় যুবকের একটি হৃদয় আসন ছিল। সে যখন ভিয়েতনাম থেকে খালাসিটোলায় এমনকি লিটিল ম্যাগাজিনে, তখনো তার ভিত ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার পলকা আবেগ যাতে মনে হত পৃথিবীর কোনও সুন্দরীই আর দশ জন মূর্খের বৃক্ষলিপিত হবে না। এখন এই বাঙালি যুবকই দুর্গাপুজো সংগঠনে ব্যস্ত অথবা গণেশ পুজোয় অথবা হনুমান সেবায়। শহরে ব্যস্ত অবস্থায় বারমুডা ও মোবাইল সহযোগে কর্পোরেট স্পন্সরসিপে তাকে উদ্যত দেখলে কালীঘাট, কসবা এমনকি তপসিয়াতেও বোঝা যায় না সে হিন্দু না মুসলমান। যা ছিল ব্যক্তিগত অন্দরমহলের বিষয়, তা এখন নির্ভয়, প্রকাশ্যে জনপরিসরে এসে গেছে। ঘাটে ঘাটে গঙ্গারতি হচ্ছে, মসজিদে মাইকের শঙ্খধ্বনি, মাইকে পবিত্র গ্রন্থপাঠ একটি আধুনিকতাপূর্ব সামন্ততান্ত্রিক আচারকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে উত্তর আধুনিক জীবনশৈলীর সঙ্গে। একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে প্রাক্ ও উত্তর রূপান্তরের এই পদ্ধতির সূত্রে আধুনিকতার যাবতীয় অবদানই অস্বীকৃত হচ্ছে।

ইতিহাসের পরিপন্থী বলেই মিডিয়া ও কিছু শিকড়সৈন্য সংস্কৃতি সেবক দুর্গাপুজোর মণ্ডপ শয্যা থেকে ঢাকের বাদ্যি সবেতেই জনগণের সৃজন কর্মের উৎসাহ দিচ্ছেন। সবই স্পেকটাকেল। এই স্পেকটাকেলের কুচকাওয়াজে প্রতিমা দর্শন যত জনশ্রুতকে তাদের মনে হচ্ছে অন্য স্তরের জীবন চর্চা। আসলে জনসাধারণও তাদের মুখপাত্র হিসেবে মধ্যবিত্ত বুঝতেই পারে না জাতির জীবন ইতিহাসে গ্রেট মাদার বা মহীয়সী মায়ের ভূমিকা এক রকম আর অন্তত এই শারদীয়া রূপে দেবী বন্দনায় রাজাদের যুদ্ধজয়ের অন্যরকম পরিচ্ছেদ। পলাশির যুদ্ধের পরে হিন্দু গোস্বামীরা সম্পত্তি দর্শনের জন্য দুর্গোৎসবের আড়ম্বরের মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন — সঙ্গে থাকত সাহেব আমলাদের ভজনা — এ তো আর এক প্রসঙ্গ। বড়োলোকের দেবী ভাবনায় যতটা শক্তি দলনের চিন্তায়ন ততটা কিন্তু আয় গো উমা করলেন গরিবের এই কন্যাস্নেহ কাজ করে না।

খেয়াল করলে দেখা যাবে এই বারোয়ারি সমাজ সংযোগ টিভি ও এপ বাস্তবতার মতই বিমুক্ত নিরাকার। পুজোর সংগঠনে পাড়ার সমর্থন না পেলেও চলে। এটাই কৌতুক যে বিশ্রামের পরে দক্ষিণী সুজয়কান্তকে সমর্থন করে বহুজাতিক সংস্থা। অদূর ভবিষ্যতে শারদ উৎসবকে নিতে হবে অটাম হেরিটেজ ফেস্টিভাল নাম, বস্তুত হয়েই গেছে জনগণ জানবেই না দেবতা তাকে পুতুলে পরিণত করেছে আর যুবক? আজ ছোটো পত্রিকায় লিখতে বসেছি বলেই বলি ধর্ম উনিশ শতকীয় সংস্কারের জন্যই এত ডালপালা ছড়িয়ে দেয়নি আগে, কয়েক বছর আগেও অষ্টমীর অঞ্জলিতে গোড়ালি পর্যন্ত ঝুল ও হাতে লাল সুতোর কব্জিবন্ধ ও টকটকে সিঁথির এত ভিড় ছিল না। আবারও বলি ধর্মের ব্যক্তিগত ‘মুক্তরেখ চিহ্নসমূহ’ এখন সংগঠিত হিঁদুয়ানি মারির প্রথা হয়ে জড়িয়ে ধরেছে আমাদের যুব জনতাকে। ভয় যে সে ‘গোরা’-র একশত বছর পরে জন্মেছে অর্থাৎ সে হাবা। সব অর্থেই ঠিকানাহীন। যথার্থ মধ্যবিত্ত।

এই মধ্যবিত্ত দাঙ্গা দেখেনি হয়তো দেখবে দেশভাগ দেখেনি হয়তো দেখবে। এরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা জীবনানন্দ দাশকে রাস্তায় পায়চারি করতে দেখেনি, এদের সত্যজিৎ-ঋত্বিক নেই যা আছে তা সফ্টপর্নো, হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় ও বং কানেকশন। আসলে চল্লিশ দশক মন্বন্তর, দাঙ্গা ও দেশ বিভাগ বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘাড় মটকে দিয়েছে। এই হীনম্মন্যতার গোবর থেকে পদ্মফুল জন্মায়? কাগজের বাঘ চতুষ্পদ প্রাণী হতে পারে কিন্তু শার্দূল নয়। আমাদের বাঙালিবাবু জানেন না সময় আত্মসাৎ করেছে তার কুষ্ঠি ঠিকুজি। যদিও ‘সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে’ বলে সে অনেক সময় নষ্ট করেছে ‘এখন রাত কত হইলো’ এই প্রশ্নের উত্তর আর সে দিতে পারবে না।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান