তিথি বন্দ্যোপাধ্যায়
একাকিত্ব এক অনুভূতি। জীবনের কোনও-না-কোনও সময়ে এই অনুভূতি স্পর্শ করে যায়নি এমন মানুষের সংখ্যা বিরল। একাকিত্বের কি কোনও সংজ্ঞা হওয়া সম্ভব? যদি হয়, সেটা বোধহয় অনেকটা এরকম হবে— একাকিত্ব এমন এক অনুভূতি, যখন একজন মানুষ তার পছন্দমতো সামাজিক যোগাযোগ বা নির্ভরতার জায়গা খুঁজে পায় না। ‘The fact of being without companion.’ একাকিত্ব মানে দৈহিক ভাবে একা থাকা নয়, অনেকের মাঝে থেকেও ভীষণভাবে নিজেকে একা অনুভব করা, ফাঁকা অনুভব করা। কেউ কোলাহলেও একা, কেউ সবার থেকে দূরে থেকে একা। কেউবা হাজার লোকের ভিড়ে একা। একাকিত্ব মানে, ভেতর থেকে নিজেকে একা মনে হওয়া। একাকিত্ব বোধ আসে সাহচর্যের অভাবে।
আচরণগত কিছু বহিঃপ্রকাশ থেকেও অনেক সময় বোঝা যায় মানুষটি একাকিত্বে ভুগছেন। যেমন — আত্মবিশ্বাসের অভাব, জীবনের প্রতি অসন্তোষ বেড়ে যাওয়া, উৎকণ্ঠা ও বিষণ্ণতা বোধ। দিন শেষে কি সবাই আমরা একা? মনে প্রশ্ন জাগে, আসলে কেন এই একাকিত্ববোধ বা নিঃসঙ্গতা? অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, নিঃসঙ্গতা মানে একা হয়ে যাওয়া নয়। বরং এটি মনের এমন এক উপলব্ধি যা আমাদের মনকে বাইরের সমস্ত যোগাযোগ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যেমন, বন্ধুদের মাঝে বা ভাইবোন কিংবা প্রিয় মানুষটির পাশে বসেও একাকী বা নিঃসঙ্গ বোধ করা। মন হয়তো তখন একা থাকতে চাইছে। আবার কখনও হতাশ হয়েও একাকী বোধ করা — এই ভেবে যে মন যা চাইছে, তা খুঁজে পাচ্ছে না।
আমাদের আর্দশ বা বিশ্বাস এবং অনুভূত সামাজিক সম্পর্কের মাঝে তৈরি হওয়া দ্বন্দ্বের ফলে যে মানসিক চাপ তৈরি হয়, সেটাই তো নিঃসঙ্গতাবোধ। অনেক সমাজবিদরা তো মনে করেন নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক বিধিনিষেধ অনুসরণ করে যাওয়ার মধ্যেও থাকে নিঃসঙ্গতার উৎপত্তি। আবার কিছু সংখ্যক মনোবিদ মনে করেন ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থতা, নিজের অনুভূতির যথার্থ প্রকাশ না-করতে পারা ইত্যাদি থেকেই নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্বের অনুভূতি চরম আকার ধারণ করে। আবার অন্য একটি তত্ত্ব বর্ণনা করে যে, সামাজিক দক্ষতার ঘাটতি এবং ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য দুটি মিলে যখন সামাজিক সম্পর্ক গঠন এবং তা রক্ষা করতে মানুষ ব্যর্থ হয়, তখনই তারা নিঃসঙ্গতা অনুভব করে। তখনই একাকিত্ব অনুভূত হয়। জার্মান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ফ্রম রিচম্যানের মতে, নিঃসঙ্গতা হল আবেগের একটি অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে মানুষের মনের সাধারণ অসন্তোষের সাথে নিঃসঙ্গতার একটা সংযোগ আছে, যেমন — বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, শূন্যতা ও একঘেয়েমির অনুভূতি। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী এবং নিঃসঙ্গতা বিশেষজ্ঞ জন কেসিয়াপ্পোর গবেষণা অনুযায়ী, নিঃসঙ্গতা দৃঢ়ভাবে জেনেটিক্স সম্পৃক্ত।
পৃথিবীতে ১৮টি দেশের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখা গেছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো কিছু দেশে একাকিত্বের হার সাধারণের থেকে অনেক বেশী। ব্রিটেনে ১০ জন মানুষের মধ্যে ১ জনের কোনও বন্ধু নেই, ৫ জন মানুষের মধ্যে ১ জন মনে করেন তাকে কেউ ভালবাসে না। এ চিত্রটা থেকে এটা বলাই যায় যে টেকনোলজিতে উন্নত দেশগুলির মানুষ বেশি একাকিত্বে ভোগেন।
একাকিত্ব মানে কি তাহলে ভালবাসাহীনতা নাকি নিঃসঙ্গতা? শুধুমাত্র আমাকে কেউ চায় না বা আমাকে কেউ ভালবাসেনা এই অনুভব থেকেও তো মানুষ নিজেকে একা অনুভব করে। আমাদের রোজকার জীবনে একাকিত্ব নানাভাবে কড়া নেড়ে যায়। আমরা ভেঙে পড়ি। একাকিত্ব অনেক ধরনের হয়। কিছু কারণ আলোচনা করা যাক।
আত্মকেন্দ্রিক নিঃসঙ্গতা
কিছু মানুষ ছোটোবেলা থেকেই নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। হাজার কোলাহলে থেকেও, অনেকের মাঝে আনন্দে থেকেও এরা যেন সবার থেকে আলাদা। একা থাকতে এদের ভালো লাগে। এধরনের মানুষেরা মূলত আত্মকেন্দ্রিক হয়, খানিকটা দুঃখ বিলাসীও।
সামাজিক নিঃসঙ্গতা
এই ধরনের মানুষেরা বরাবরই কিছুটা অ-সামাজিক হয়। এদের মধ্যে সবসময় ভয়, লজ্জা, বিতৃষ্ণা ও সংকোচ কাজ করে। এরা নিজেকে সামাজিক সম্পর্ক, আতিথেয়তা, আনন্দ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। অনেক ক্ষেত্রে বেশি ওজন, শারীরিক অসৌন্দর্য, আর্থিক সচ্ছলতার অভাব, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ও দুর্বল মনোবল ইত্যাদিই এর অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়।
বুদ্ধিবৃত্তিক নিঃসঙ্গতা
বুদ্ধিজীবী ও অতিমাত্রায় অহং (ইগো) দ্বারা পরিচালিত ব্যক্তিদের মধ্যে এ ধরনের একাকিত্ব লক্ষ করা যায়। এদের চিন্তা ভাবনা ভিন্ন ধারার হয় বলে এদের ব্যক্তিত্ব অনেকের সাথে মেলে না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই এরা এক ধরনের নিঃসঙ্গতায় ভোগেন।
মানসিক একাকিত্ব
অনেকেই একাকিত্বকে মানসিক রোগ ভেবে থাকেন। কিছু মানুষ একা থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নিজেকে কেবলই একা মনে করেন। এই ধরনের মানুষেরা এক ধরনের মানসিক যাতনায় ও অনিশ্চয়তায় ভোগেন বলে কারও সঙ্গে কোনও কিছু ভাগাভাগি করতে পারেন না।
দার্শনিক নিঃসঙ্গতা
এই ধরনের নিঃসঙ্গতায় যাঁরা ভোগেন, তাঁরা ভিন্ন ধরনের মানুষ হন। সাধারণত দার্শনিক চিন্তাভাবনা করে থাকেন। কিছুটা উদাসীনও হন। ‘এসেছি একা, যাব একা, পৃথিবীতে কেউ, কারও নয়’ — এই ধরনের ভাবনায় বিশ্বাসী বলে এরা কোনও সম্পর্কে জড়াতে চান না। একাই জীবন উপভোগ করতে চান। তাই এঁদের মধ্যে অনেকেই নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। অথবা মহাকালের বুকে একদিন তো চলে যেতেই হবে, তাহলে এ-জীবনের অর্থ কী? কসমিক বিচ্ছিন্নতা থেকে চলে আসে একাকিত্ব।
এছাড়াও একাকিত্বে বা নিঃসঙ্গতায় ভোগার আরও কিছু ধরন আছে। যেমন— মা-বাবা এবং সন্তান যখন উভয় পক্ষই একে অপরকে বোঝে না, তখন উভয়ই একাকিত্বে ভোগে। পরিবেশ পরিবর্তন হলে— যেমন, নতুন স্কুল বা বাড়ি বদল কিংবা নতুন পাড়া, নতুন চাকরিস্থল সাময়িক ভাবে একাকিত্ব বাড়ায় বই-কি। মা-বাবার অস্বাস্থ্যকর দাম্পত্য সন্তানকে একা করে দেয়। বিবাহ বিচ্ছেদ কিংবা সম্পর্কে ভাঙন বা শিথিলতা মানুষকে নিঃসঙ্গ করে দেয়। এছাড়াও সমাজের সেই বিরাট সংখ্যক মানুষ, যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, তারাও এক ধরনের একাকিত্বের শিকার।
কারণ যাই হোক, নিঃসঙ্গতা বোধ বা একাকিত্বের অনুভূতি কাটিয়ে উঠতেই হবে। দীর্ঘস্থায়ী একাকিত্ব মানুষের অনেকখানি ক্ষতি করে দেয়। এক মার্কিন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব মানুষের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়। সহজেই অবসাদ কিংবা ডিমেনশিয়ার (স্মৃতিভ্রংশ) শিকার হতে পারেন নিঃসঙ্গ মানুষটি। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাকেও বাড়িয়ে দেয় একাকিত্ব, হতে পারে ডায়াবেটিস। নিঃসঙ্গতা মানুষকে শুধু অসুখীই করে না, মৃত্যুকেও ত্বরান্বিত করে। দীর্ঘস্থায়ী একাকিত্বের সাথে বিষণ্ণতার এক গভীর সম্পর্ক আছে। কোনও কোনও সময় তো এটাও বলা হয়ে থাকে Depression is a disease of loneliness। তবুও একথা মনে রাখা দরকার যে কোনও মানুষ একা মানেই, সে বিষণ্ণ — তা কিন্তু নয়। একা থাকা আর একাকিত্ব কিন্তু এক না। তবে দীর্ঘমেয়াদি একাকিত্ব কোনোভাবেই কাম্য নয়। নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব দূর করতে উচিত জীবনে নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য তৈরি করে সেদিকে এগোনো। পাশাপাশি, পরিবার ও বন্ধুদের এগিয়ে আসতে হবে। একাকিত্ববোধ কোনও মানসিক অসুস্থতা না হলেও, যদি এই বোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়, তখন মানুষ মারাত্মক মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তাই উচিত মেলামেশার পরিধি বাড়ানো। বিভিন্ন পছন্দের কাজে নিজেকে যুক্ত রাখা ও পছন্দের মানুষদের সাথে সময় কাটানো। বিভিন্ন সামাজিক কাজে যুক্ত থাকা। পোষ্যদের সাথে সময় কাটানো। নিজেকে ও অন্যকে ভালোবাসা। গল্প করা অর্থাৎ সংযোগ স্থাপন করা। পরিবারের বা কাছের মানুষের সাথে গল্প করা, নিজের সমস্যার কথা আলোচনা করা।
একাকিত্ব কাটানোর সর্বশেষ বা সর্বপ্রধান পথ সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে যুক্ত রাখা। লেখার অভ্যাস কিংবা ছবি আঁকা বা গান অথবা নাচ, আবৃত্তি … এরকম যে-কোনও কিছুই হতে পারে। অনেক বড়ো বড়ো লেখক তাঁদের জীবনে কোনও এক সময় নিঃসঙ্গতা অনুভব করেছিলেন। একাকিত্বের শেষ প্রান্তে কিন্তু সবসময় বিষণ্ণতাই নেই, আছে সৃষ্টিশীলতাও। সৃজনশীল বহু মানুষই একাকিত্বকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি করেছেন বিখ্যাত সব লেখা, ছবি। রবীন্দ্রগানে আমরা পাই ‘আমি মানব একাকি ভ্রমি বিস্ময়ে।’ — একাকিত্ব এক বিস্ময়বোধের জন্ম দেয়। যে বিস্ময়বোধ আমাদের গভীরে এক অস্থিরতা তৈরি করে, সে অস্থিরতার পথ হেঁটে আমরা পৌঁছে যাই সৃষ্টিশীলতার কাছে। এখানেই একাকিত্ব মহান। একাকিত্বের সাথে মানুষের যে লড়াই, তা যুগ যুগ ধরে চলছে। যে কোনও সংবেদনশীল মানুষের জীবনে একাকিত্ব কড়া নাড়বেই। যেখানেই একাকিত্ব, সেখানেই তা অতিক্রম করে যাওয়ার এক অদম্য ইচ্ছে। কখনও তা সাহচর্যের হাত ধরে, কখনও বা সৃষ্টিশীলতার পথে হাঁটায়। যে একাকিত্ব বোধের অভিমুখ সৃষ্টিশীলতার দিকে থাকে না, সেই একাকিত্ব ডেকে আনে বিষণ্ণতা — অবসাদের বৃত্ত ঘিরে ফেলে মানুষকে। জীবনকে মনে হয় অর্থহীন। আবার উলটো দিকে ছোটো ছোটো চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে গিয়ে কখনও একাকিত্ব আমাদের হাত ধরে পৌঁছে দেয় সৃষ্টির তাগিদের কাছে। শেষ পর্যন্ত ‘বিচ্ছিন্ন বৃষ্টির ফোঁটার মতো’ নিঃসঙ্গ একাকিত্বের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সৃষ্টিশীলতা। এখানেই একাকিত্বকে হারিয়ে দিয়েছি আমরা। প্রত্যেকটি নির্জন নিঃসঙ্গতার চারপাশে থাকে এক অপার বিস্তৃতি অথবা শূন্যতা। সেই অপার শূন্যতায় আমরা হারিয়ে যাব, নাকি নিজেদের আরও বেশি করে খুঁজে পাব তা ঠিক করতে হবে আমাদেরই।