সম্মোহন থেকে হিস্টিরিয়া ও গুরুবাদ

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

(মনোরোগ চিকিৎসক, পাভলভ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল) 

সম্মোহন

আমাদের প্রায় অনেকেই বোধহয় ছোটোবেলা থেকেই সম্মোহন কথাটায় সম্মোহিত হয়ে আছি, বড়ো হয়েও তার ধোঁয়াশা কাটেনি। এর পেছনের বিজ্ঞানটার ঠিকঠিক প্রচার না হওয়াটাই হয়তো এর মূল কারণ। জাদুকরের সম্মোহনের রোমাঞ্চকর গল্প, আফ্রিকার জঙ্গলে পাইথন সাপের তীক্ষ্ণদৃষ্টি দিয়ে সম্মোহিত করে গিলে ফেলার রোমহর্ষক কাহিনি— সেই শৈশব থেকেই আমাদের বিস্ময়বোধকে অধিকার করে রেখেছে। এক বন্ধু একবার জামার আস্তিন গুটিয়ে বলেছিল — করুক দেখি আমাকে কেউ হিপনোটাইজড্। যেন হিপনোটাইজড্ হওয়াটা মানসিক দুর্বলতা, আর না-হওয়াই বলিষ্ঠতা। কিন্তু না, একেবারেই না। সম্মোহনের ক্ষেত্রটা আদৌ কোনও যুদ্ধক্ষেত্র নয়। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাউকে সম্মোহিত করা যায় না। সম্মোহন প্রবণতা ব্যক্তির এক বিশেষ গুণ — দুর্বলতা বা বলিষ্ঠতা কোনোটাই নয়।

সম্মোহন কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিনই ঘটে চলেছে। সে নামহীন হয়ে প্রকৃতির ঘটনা প্রবাহের মধ্যেই ছিল প্রকৃতিরই নিয়ম হয়ে। আমরা তার নাম দিয়েছি মাত্র। আর ছিল বলেই সে মানুষের অনুমানে ধরা দিতে শুরু করে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। সেই অনুমান তীব্রতর হয়ে ওঠে জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রাঞ্জ মেসমার-এর হাতে প্রায় ২৫০ বছর আগে। 

প্রাচীন যুগে বিশ্বপ্রকৃতি তার নানা ঘটনা নিয়ে মানুষের কাছে ছিল এক অনালোচিত অজানা জগৎ। তাই তা ছিল ভয়ের। প্রাণ বা আত্মা এক রহস্যময় বিষয়। পেছনের বিস্তৃত অজানা অন্ধকার রহস্যের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে প্রাচীনযুগের জাদুকর চিকিৎসক আর ধর্মীয় গুরু ও পুরোহিতদের ক্ষমতা হয়ে উঠেছিল অপরিসীম। সাধারণ মানুষের এই অন্ধবিশ্বাস আর নিঃশর্ত আত্মসমর্পন ধর্মীয় গুরুদের সম্মোহনের কাজকে আরও সহজ করে তোলে। মহাভারতে সম্মোহন বাণ-এর কথা আমরা শুনেছি। প্রাচীন ইউরোপে ‘মিরাকল অব লুর্ডস’-এ এসে মানুষ সম্মোহনের প্রভাবে নানা সংকট থেকে মুক্তি পেত। সঠিক বিজ্ঞান না-জেনেও আমরা অনেক সময় শুধু পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিজ্ঞানসম্মত আচরণ করে থাকি। প্রাচীনযুগে সম্মোহনের প্রয়োগে রোগের চিকিৎসা সেভাবেই হত। কিন্তু মধ্যযুগে এসে সম্মোহনের অপপ্রয়োগ এত বেড়ে গেল যে এ  বিদ্যা ডাকিনী-যোগিনী বিদ্যা আর ইউরোপে ব্ল্যাক ম্যাজিক নামে আখ্যায়িত হয়ে গেল।

আধুনিক যুগে এসে ‘সম্মোহন’ এক বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা পদ্ধতির স্বীকৃতি পেল মেসমারের হাতে ১৭৮৪ সালে। পরে যা মেসমারিজম নামে খ্যাত। মেসমার শরীরে চুম্বক স্পর্শ করিয়ে অজস্র রোগীকে নিরাময় করে ইউরোপে সাড়া ফেলে দেন। তাঁর তত্ত্ব ছিল — সারা পৃথিবীতে চুম্বকধর্মী এক ধরনের পদার্থ পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। প্রাণী ও মানুষের শরীরে, বিশেষত মস্তিষ্ক সহ স্নায়ুতন্ত্রে এই পদার্থ প্রচুর পরিমাণে আছে। বাইরের চুম্বকদণ্ডের স্পর্শে এই পদার্থ সক্রিয় হয়ে রোগীর নিরাময় করে (অ্যানিম্যাল ম্যাগনেটিজম তত্ত্ব)। তাঁর পদ্ধতিতে আরোগ্যের সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তাঁর জানা না-থাকায় তিনি তা দিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁর পদ্ধতিতে প্রয়োগ নিপুণ হওয়ায় বহু রোগীর নিরাময় হত।

এরপর বিপুল গতিতে এগিয়ে চলল সম্মোহনের প্রয়োগ ও গবেষণা। স্কটিশ চিকিৎসক জেমস ব্রেইড ১৮৪৩ সালে প্রথম সম্মোহনের পেছনে শারীর বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় মেসমারিজমকে রহস্যময়তার বাইরে নিয়ে এলেন। মেসমারিজমে যে ঘুম আসে তাকেই তিনি বললেন হিপনোসিস। গ্রিক ‘Hypnos’ কথার অর্থ ‘ঘুম’। ‘Hypnosis’ শব্দটি তাঁরই প্রবর্তিত। মেসমারের চুম্বকত্বের তত্ত্বকে বাতিল করে তিনি জানালেন — ব্যক্তি কোনও বস্তুর প্রতি গভীর মনোযোগ দিলে স্নায়ুতন্ত্রে কিছু পরিবর্তনের ফলে ঘুম আসে। কিন্তু সম্মোহনে সম্মোহকের পরামর্শ গৃহীত হচ্ছে কীভাবে, সম্মোহকের নির্দেশ পালিত হচ্ছে কীভাবে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। 

১৮৭৮ সালে নিউরোলজিস্ট জাঁ মার্টিন শার্কো প্যারিসে হিস্টিরিয়া রোগীর সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পেলেন সম্মোহিত ব্যক্তির। ফরাসি মনোবিদ পিয়ারে জ্যানের বিষঙ্গ বা Dissociation তত্ত্ব বলল — সম্মোহিত অবস্থায় মানুষের চেতন বা সজ্ঞান স্তর চাপা পড়ে যায়। অবচেতন স্তর চেতন স্তর থেকে আলাদা হয়ে (Dissociation) নিষ্ক্রিয় থাকে বা সক্রিয় হয়ে ব্যক্তিকে পরিচালিত করে। ভিয়েনার চিকিৎসক ডাঃ ব্রুয়্যার সম্মোহিত অবস্থায় হিস্টিরিয়া রোগীকে পশ্চাদগমনের (Regression) মধ্যে দিয়ে অসুস্থতার উৎপত্তিস্থলের স্মৃতিতে রোগীকে নিয়ে যেতেন।

এরপরই আবির্ভাব সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের। ব্রুয়্যারের হিস্টিরিয়া রোগী দেখে মনের অবচেতন স্তরের প্রতি আকৃষ্ট ও ব্রুয়্যারের regression তত্ত্বের সাথে একমত হয়ে জানালেন ব্যক্তির শৈশবের স্মৃতির জগতে regression ঘটে। আমাদের মনের নির্জ্ঞান স্তরটি (unconscious) চেতন স্তরের (conscious) কার্যকলাপের গোপন নিয়ন্ত্রক।

শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানী পাভলভের গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে উঠল ঘুম, সম্মোহন আর স্বপ্নের সম্পর্ক। বিশ্বপ্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ ও সমাজ পরিবেশের সঙ্গে মানব চেতনার সম্পর্ক গড়ে ওঠে কোন পথ ধরে, তার স্পষ্ট উত্তর পাওয়া গেল পাভলভের শর্তাধীন পরাবর্ত তত্ত্বে। শর্তহীন পরাবর্ত (unconditioned reflex) হল মানবপ্রকৃতির জন্মগত প্রবৃত্তি বা Instinct। যেমন ভয়ের জিনিসে চমকে ওঠা, খাবার দেখলে খেতে ইচ্ছে হওয়া। কিন্তু পরিবেশ পরিবর্তনশীল, তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য প্রয়োজন পরিবর্তনশীল পরাবর্তের। তাই জন্মগত প্রবৃত্তির সাথে যুক্ত হয়ে নতুন নতুন শর্তাধীন পরাবর্ত (Conditioned reflex) তৈরি হয়, আর প্রয়োজন ফুরোলে ব্যবহারের অভাবে তা বিলীন হয়ে যায়। এমন লক্ষকোটি অগণিত সতত পরিবর্তনশীল শর্তাধীন পরাবর্তের উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের চেতনা, আচরণ, অভ্যাস, কৃষ্টি, সংস্কৃতি।

সম্মোহন তাহলে কী? বুঝতে গেলে পাভলভের উত্তেজনা-নিস্তেজনা তত্ত্বে এসে দাঁড়াতে হবে। মস্তিষ্কের বিশেষ অঞ্চলে উদ্দীপকের প্রভাবে যে উত্তেজনা তৈরি হয়, তা যদি মস্তিষ্কে অবাধ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে মস্তিষ্কের ক্ষতি হবে, সামান্য ভয়েই প্রাণ বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই সংরক্ষণের প্রয়োজনে উত্তেজনাকে সীমাবদ্ধ রাখতে প্রতিরোধী নিস্তেজনা অঞ্চল ঘিরে ফেলে উত্তেজনা অঞ্চলকে। নিস্তেজনা না থাকলে শর্তাধীন পরাবর্তর পুরোনো উদ্দীপ্ত অঞ্চল বা অভ্যাস অনড় হয়ে টিকে থাকত চিরকাল। কোনও অভ্যাস কোনোদিন পরিবর্তন করা যেত না। উত্তেজনা-নিস্তেজনার দৌলতেই প্রাণী নিজেকে নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়, সভ্যতা এগিয়ে চলে।

বিজ্ঞানী পাভলভ পরীক্ষাগারে দেখালেন — বৈচিত্র্য হীন কোনও মৃদু উদ্দীপক মস্তিষ্কে ক্রমাগত উদ্দীপনা তৈরি করে চললে প্রাণীটি ঘুমিয়ে পড়ে। দৈনন্দিন জীবনেও যেমন একটানা বৃষ্টির শব্দে অথবা চলন্ত ট্রেনের দুলুনিতে ঘুম এসে যায়। মস্তিষ্কের একই অঞ্চলে একই উদ্দীপনা ওঠানামাহীন ভাবে চলতে থাকলে সেই অঞ্চলে আবিষ্ট উত্তেজনাকে ঘিরে চারপাশে ছড়াতে থাকে নিস্তেজনা বা ঘুমের আবেশ। নিস্তেজনা পরিবেষ্টিত উদ্দীপনার অংশটি চারপাশের চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বন্দি হয়ে পড়ে। প্রাণীটি এক আচ্ছন্ন অবস্থায় (trance) চলে যায়। এটিই সম্মোহন। অর্থাৎ বিশেষ কোনও উদ্দীপক, সে বস্তু, দৃশ্য বা ভাবনা যাই হোক, তার প্রতি নিরবচ্ছিন্ন গভীর মনঃসংযোগ ঘটলে ওই উদ্দীপকের প্রভাবে চারপাশের সংলগ্ন নিস্তেজনা অঞ্চলে অন্যান্য বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে উপলব্ধি, অনুভূতি, আবেগ চেতনার বাইরে ক্রমশ চলে যেতে থাকে। বিরোধী ভাবনা, যুক্তি তলিয়ে যায়। মন সরে এসে ক্রমশ কেন্দ্রীভূত হয় উদ্দীপিত অঞ্চলে। ব্যক্তি তখন ঐ নির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় ভাবনা বা আবেগে যুক্তিহীন ভাবেই প্রভাবিত হয়ে পড়তে থাকে। অন্যান্য বিরোধী যুক্তি আর কাজ করতে পারে না। ব্যক্তি তখন একতরফাভাবে ঐ উদ্দীপক বা ভাবনার অন্ধ অনুগামী হয়ে পড়তে থাকে। এটিই সম্মোহন।

ঘুম নয়, জাগরণও নয়, ঘুম আর জাগরণের মাঝে চেতনার এই Trans অবস্থাই সম্মোহন। যে উদ্দীপককে কেন্দ্র করে সম্মোহন, তার প্রতি তীব্র ও গভীর সীমায়িত মনঃসংযোগ আর তার বাইরের জগৎ সম্পর্কে তন্দ্রাচ্ছন্নতা — এ দুয়ের মিলিত অবস্থাই trance-এর পূর্ব প্রস্তুতি গড়ে তোলে।

হিস্টিরিয়া

সম্মোহনের স্পষ্ট সীমারেখা টানা যথেষ্ট মুশকিল। কখন বলব সম্মোহন, আর কখন নয়, তা বেশ বিভ্রান্তিকর। দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়তই আমরা সম্মোহন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছি, আচরণও করছি। তবে মোটামুটি ভাবে বলা যায় যখন অনুভূতি, উপলব্ধি বা ধারণা আনুষঙ্গিক অন্যান্য দ্বন্দ্ব, প্রশ্ন ও বিরোধী ভাবনাকে নিস্তেজনায় পাঠিয়ে একতরফা প্রভাব বিস্তার করে চলে, সামান্য হলেও তাকে সম্মোহন বলা যাবে। যেমন অনেক কিছু আমরা নির্বিচারে গ্রহণ করি যার বাস্তব ভিত্তি নেই। সমগ্র মস্তিষ্ক যুক্তি-তর্ক, সামগ্রিক বিচার পদ্ধতি মেনে চলতে পারে না। চলা সম্ভবও নয়, কারণ মানুষকে কাজ করতে হলে, এগিয়ে যেতে হলে সাময়িক একমুখী একটি দিকে ধাবিত হতে হয়। অর্থাৎ মস্তিষ্ক সবসময় সামগ্রিকভাবে কাজ করে না। খণ্ডিত, আধাঘুমন্ত অংশ সমগ্র থেকে আলাদ হয়ে আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা নিজেদের যুক্তি ও পরামর্শ দিয়ে চলি নিজেদেরই অজান্তে এবং সেই যুক্তি আবেশে সম্মোহিত ভাবে কাজও করে চলি — যাকে স্বসম্মোহন বলে। শিক্ষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শ, দলানুগত্য, উন্মাদনা — এসবের পেছনে যুক্তিহীন স্বসম্মোহনের প্রভাব বিপুলভাবে কাজ করে। হিস্টিরিয়া সেই স্বসম্মোহনেরই এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। হিস্টিরিয়াই বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল স্নায়ু বিজ্ঞানী ফ্রয়েডকে — সম্পূর্ণ অচেতন নয়, চেতন ও অচেতনের মধ্যে দিয়ে সামান্তরাল তৃতীয় এক বিকল্প বিষঙ্গ চেতনা (Dissociation) যা রোগীর আংশিক নিয়ন্ত্রণে থাকে ও পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে ভীষণভাবে সম্পর্কিত ও তার দ্বারা প্রভাবিত। একেবারেই নিউরোলজিক্যাল নয়, সম্পূর্ণভাবে মানসিক। ফ্রয়েড জানালেন, অবচেতন মনের নানা অবদমিত ইচ্ছা, কামনা-বাসনা যা অপূর্ণ অথচ বাস্তবে সামাজিক ভাবে স্বীকৃত নয়, তারাই প্রতীকী ভাবে হিস্টিরিয়ায় পূর্ণ হতে চায়। একই সাথে অবাঞ্ছিত বাস্তবকে পরিহার করতে পারে, বিপরীতে বাস্তবকে অস্বীকার করার অপরাধবোধ থেকে অব্যাহতি পায়। ফ্রয়েড ক্লিনিকে কৃত্রিমভাবে হিস্টিরিয়া আবিষ্ট করতে সক্ষম হয়ে নিশ্চিত হন — হিস্টিরিয়া একটি স্বসম্মোহন ছাড়া আর কিছু নয়।

বিজ্ঞানী পাভলভ হিস্টিরিয়ার ক্ষেত্রে স্বসম্মোহনের তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা করলেও ফ্রয়েডের শুধুমাত্র যৌনতার ভিত্তিকে সমর্থন করেননি। তিনি বললেন — ব্যক্তির মস্তিষ্ক টাইপে উত্তেজনা-নিস্তেজনার মধ্যে ভারসাম্য যখন দুর্বল, অনেক বেশি আবেগপ্রবণ আর অন্যের ওপর বেশি নির্ভরশীল, ফলে অন্যের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকবার প্রবণতা বেশি আর দ্রুত অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়, তারা দ্বন্দ্বে ও মানসিক সংকটে হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যখন মনের কোনও যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি সামাজিক স্বীকৃতি বা গ্রহণযোগ্যতা না-থাকায় প্রকাশ্যে আসতে পারে না, তখন তাকে অস্বীকার করতে সমগ্র বাস্তবকেই অস্বীকার করে চেতনা থেকে অন্য এক বিষঙ্গ চেতনায় চলে যায়, যন্ত্রণাদায়ক বিষয়টি চলে যায় নিস্তেজনায়। আর আকাঙ্ক্ষিত বিষয়টি উদ্দীপনা অঞ্চলে চারপাশের বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জেগে থাকে বিষঙ্গ চেতনায়। ইচ্ছাপূরণও হয়, সামাজিক স্বীকৃতিতেও বাধা থাকে না অসুস্থ আচরণের অজুহাতে। হিস্টিরিয়ার চেতনাস্তর এভাবেই সম্মোহনের চেতনাস্তরের সমতুল্য। শুধু সম্মোহক সেখানে সে নিজে।

বুঝতে সুবিধার জন্য হিস্টিরিয়ার এক উদাহরণে আসা যাক — শহর থেকে দূরে বর্ধিষ্ণু গ্রাম গোবিন্দপুরের শিববটতলায় এক সময়ের সমৃদ্ধিশালী ভট্টাচার্যদের অবস্থা পড়তির দিকে। মধ্যবিত্তের টানাটানি এখন সঙ্গী। একমাত্র ছেলে বাবার ব্যবসায় আছে। স্বাধীন উপার্জন না-থাকায় মা-বাবার উপর কথা বলার সাহস হয় না। বউ শ্যামলী সারা বাড়ির হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও শাশুড়ির কুকথা শুনে শুনে ভয়ে কাঠ হয়ে থাকে। স্বামী বলে মা-র সাথে একটু মানিয়ে চলো, বোঝোই তো! স্বামীকে দুর্বল, কাপুরুষ মনে হলেও তার আর কোনও পথ ছিল না। শাশুড়ি একদিন তার মা-বাবাকে খেতে না-পাওয়া ভিখিরি বলে গালি দিলে শ্যামলী বাড়ির চাতালে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। হাত পা বেঁকে যায়। তার অসংলগ্ন কথায় বোঝা যায় তার ভেতরে শিবঠাকুর প্রবেশ করেছে। হৈ-চৈ পড়ে যায়, কেউ বাতাস করে কেউ জল দেয়। কেউ আবার দূর থেকে প্রণাম করে। শ্যামলীর ভেতর থেকে শিব আদেশ দেয়— যেখানে সে পড়ে আছে, সেখানেই মন্দির গড়তে। চাতালের এক প্রান্তে শিবমন্দির গড়ে উঠল। সেদিনটা মঙ্গলবার ছিল, তাই প্রতি মঙ্গলবার ভড় ওঠে শ্যামলীর। সকালে স্নান সেরে পুজোয় বসলে ঠিক দশটায় ভড় ওঠে। সকাল থেকে মানুষের ভিড় জমে দেবতার আশীর্বাদ পেতে। বটতলা হয়ে যায় শিববটতলা। বাদাম ভাজা, চানাচুর, খাবারের দোকান বসে যায়। ভড়ে পড়া শ্যামলীর ভেতর শিবঠাকুর সবার প্রশ্নের উত্তর দেয়। প্রণামী জমে পাহাড় হয়ে ওঠে। সংসারের চেহারা ফিরে যায়। এবাড়িতে শ্যামলীর খাতির বেড়ে যায়। শ্বশুর, শাশুড়ি সমীহ করে কথা বলে। ভড় অবস্থায় শিব যখন শাশুড়িকে ধমক দেয় অনাচার হলে, শাশুড়ি জড়সড় হয়ে গলায় আঁচল দিয়ে শ্যামলীর পায়ে যে শিব, তাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে।

এবারে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় আসি। শ্যামলীর জীবনে মুক্তির কোনও পথ বাস্তবে সম্ভব ছিল না। শ্যামলীর প্রধান তিন বাসনা, যারা অতৃপ্ত বা অবরুদ্ধ হয়েছিল, যেমন পৌরুষপূর্ণ স্বামীর অভাববোধ, শ্বশুর-শাশুড়ির অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ আর আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে ওঠা — এই তিনটি বাসনা সম্মিলিত ভাবে দীর্ঘকাল ব্যাপী মস্তিষ্কে এক উদ্দীপনার আবেশ তৈরি করে রেখেছিল। যাদের প্রকাশ সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। একদিন শ্বাশুড়ির তীব্র অপমানে বোধগুলির সেই আবেশ আরও তীব্র হয়ে উঠে সংলগ্ন মস্তিষ্কে ব্যাপক নিস্তেজনা ছড়িয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় প্রতীকীভাবে বাসনাগুলো চরিতার্থ হল, অথচ সামাজিক স্বীকৃতিতেও সমস্যা হল না। নিজের শরীরে শিবের উপস্থিতি স্বামীর সাহচর্যের প্রতীক। শাশুড়ি তাকে প্রণাম ও দেবতাজ্ঞানে সমীহ করায় শাশুড়ির বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল। আর্থিক রোজগার তাকে পরিবারে সসম্মানে প্রতিষ্ঠা দিল। এই পাওয়াগুলিও প্রতি মঙ্গলবার তার স্বসম্মোহিত ভর (হিস্টিরিয়া) ওঠার ক্ষেত্রে reinforcement হিসেবে কাজ করল। শ্যামলীর এই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়া কিন্তু ঠান্ডা মাথার কৌশল নয়, অবচেতন মনের আকাঙ্ক্ষার আচ্ছন্নতায় ঘটে যায়। ঘটনাটি তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন যেমন নয়, নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরেও নয়।

যোগ, ধ্যান, সমাধি

ধ্যান, উপাসনা, সমাধি প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ধ্যানে বসে সিদ্ধিলাভ, দেবতার দর্শন ও বাণী শুনতে পাওয়া সবই স্বসম্মোহনেরই নানা স্তর। বুদ্ধ ধ্যানে বসেই মহানির্বাণের পথ খুঁজে পান। হজরত মহম্মদ পাহাড়ের গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় আল্লার বাণী শোনেন, তা থেকেই পবিত্র কোরান, মনু ব্রহ্মার নির্দেশ নিজের কানে শুনে মনুসংহিতা রচনা করেন। মুনি-ঋষি ও সাধকদের সিদ্ধি লাভের পরিমাপক ছিল— ধ্যানে কে কতখানি ঈশ্বরকে পেয়েছেন। কেউ পরমব্রহ্মকে লাভ করেছেন, কেউ অপার্থিব তুরীয় অবস্থায় চলে গেছেন। আচার্য শঙ্কর কেদারনাথ শিবলিঙ্গের সাথে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণের ভাবসমাধি, ভক্ত রামপ্রসাদের মা কালীকে নিয়ে সলিল সমাধির কথা আমরা জানি। জীবনকে উপলব্ধির জন্য গান্ধি, রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত উপাসনায় বসতেন। সম্মোহনের গভীরতা ভেদে ধ্যান, বিভূতি, সমাধি— সবেরই ভিত্তি হল মস্তিষ্কের স্বসম্মোহনের বিজ্ঞান।

বারবার কোনও একটি উচ্চারণ, কোনও একটি মূর্তি বা বস্তু কিংবা বিষয়ে মনকে স্থির করবার নাম ধ্যান। ধ্যানের উদ্দীপকটিকে ঘিরে মস্তিষ্কে যে উত্তেজনা, তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে নিস্তেজনা অঞ্চল, ধ্যান যত গভীরতর প্রদেশে পৌঁছায়, নিস্তেজনা অঞ্চল ততই বিস্তৃত হয়ে সংলগ্ন চেতনাকে ঘুমের মধ্যে নিয়ে যায়। জেগে থাকে শুধু ঐ উদ্দীপক ও তার সংলগ্ন অনুভূতি। একেই শাস্ত্র বলছে পরম চেতনা, অন্যান্য বিক্ষেপকারী অনুভূতি, উপলব্ধি তলিয়ে যাবার ফলে। এরপর নিস্তেজনা আরও ব্যাপক হলে উদ্দীপকের সীমানা ভেঙে মনের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। এখানেই ধ্যানের সমাপ্তি আর সমাধির সূচনা।

এই সমাধি সবীজ বা সবিকল্প সমাধি, যেখানে উদ্দীপকের উত্তেজনা আরও বিস্তৃত হয়ে মন উদ্দীপকের কাল্পনিক শক্তির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। ফলে আত্মবিশ্বাস ও ইচ্ছাশক্তি বেড়ে যায়। কামনা-বাসনা তখনও থাকে। তবে তা সম্পূর্ণ নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন। আসলে যে বিশ্বাসগুলি আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে দেয়, তারা তখন নিস্তেজনায় তলিয়ে গিয়ে গন্তব্য বাধাহীন, বিরোধহীন হয়ে পড়ে। সবীজ সমাধি থেকে ধ্যান আরও গভীর স্তরে গেলে নির্বীজ বা নির্বিকল্প সমাধিতে পৌঁছে যায়। সম্মোহিত অবস্থায় নিজের অস্তিত্বের অনুভূতি অসীম অনন্তের অনুভূতিতে বিলীন হয়ে যায় বলে মনের বিলয় ঘটে— মন থাকে না, থাকে শুধু আত্মা। এটা ভারতীয় শাস্ত্রের ব্যাখ্যা। আর অসীমের অনুভূতিকে বলা হয় ব্রহ্মলাভ বা পরমাত্মায় বিলীন। তবে বিজ্ঞান কিন্তু মন ও আত্মাকে আলাদা করে না। বলা ভালো আত্মার কোনও অস্তিত্বই স্বীকার করে না। বাস্তবজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন মনের জেগে থাকা এক অতিক্ষুদ্র দ্বীপের মতো অংশকেই আত্মা বলে। নির্বিকল্প সমাধিতে বর্হিজগতের সাথে শেষ সুতোটিও যখন কেটে যায়, জেগে থাকে শুধু অসীমের অনুভূতি নিয়ে এক বির্মূত চেতনা। যাকে ঈশ্বরলাভ বলে মনে করে ভারতীয় শাস্ত্র।

বিজ্ঞান বলছে মস্তিষ্কের বিন্দুবৎ উদ্দীপনা অঞ্চলটিও যখন সর্বব্যাপী নিস্তেজনার সমুদ্রে ডুবে যায়, তখন বর্হিজগত চেতনাহীন প্রাণটুকু শুধু থাকে। একেই ঈশ্বর লাভ বলে। নির্বিকল্প সমাধি বলে। এ অবস্থা থেকে ফিরে আসা না-আসা ব্যক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে না। ফিরে আসার বাসনা যদি পূর্বর্শত হিসেবে থাকে, তবে ফিরে আসার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আর যদি ফিরে না আসার বাসনা দিয়েই শুরু হয় ধ্যান, তাহলে মস্তিষ্ক নিস্তেজনায় সম্পূর্ণ ডুবে গিয়ে যতদিন প্রাণশক্তি থাকে, চেতনাহীন হয়ে বেঁচে থাকে। তারপর মৃত্যু হলে বলা হয় তিনি ফিরতে চাননি, তাই সমাধিতেই মৃত্যু বরণ করে নিলেন। যেমন ঘটেছে বালক ব্রহ্মচারীর।

শাস্ত্র বলে নির্বিকল্প সমাধিতে অহং বিলুপ্ত হয়। ঈশ্বরে বিলীন হয়। মন পৌঁছে যায় পরম চৈতন্যে। মনের বিলুপ্তি ঘটে। আত্মার জন্ম হয়। আত্মা যখন শরীর ত্যাগ করে ঈশ্বরে মিশে যায়, তখনই সমাধিতে  মৃত্যু নয়; দেহ রেখে চলে যায় আত্মা। আসলে সমগ্র মস্তিষ্ক যখন ঘুমের চেয়েও গভীর এক নিস্তেজনায় চলে যায়, প্রায় সংজ্ঞাহীন বলা চলে মস্তিষ্কের বিজ্ঞান অনুযায়ী, তখন কীসেরই বা অহং, কীসেরই বা ঈশ্বর! এ চেতনাহীন এক প্রাণের স্পন্দনমাত্র। নির্বিকল্প সমাধি মস্তিষ্কের বিশেষ এক স্নায়ুবৃত্তীয় অবস্থা মাত্র। যাঁরা এ অবস্থা থেকে ফিরে আসেন, তখন নিজেদের অনুভূতির বিশেষ অবস্থাকে ‘ঈশ্বর লাভ’ ছাড়া আর কীই বা বলার আছে! যে ঈশ্বর লাভের সাথে মানুষ বা সমাজের কল্যাণ-অকল্যাণের কোনও সম্পর্কই নেই। প্রাচীন ভারতীয় মুনিঋষিরা যে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতেন সে তাহলে কী? বুদ্ধের বোধি বা জ্ঞান লাভ তাহলে কী? আসলে ধ্যান বা সাধনায় মন যখন স্বসম্মোহিত অবস্থায় চলে যায়, তখন যা কিছু আকাঙ্ক্ষিত, সে বিষয়ের অনুভূতি মস্তিষ্কে ঘনীভূত হয়, আর বিরোধী ভাবনা বা অবাঞ্ছিত ভাবনার বিক্ষেপগুলো নিস্তেজনায় তলিয়ে যায়। দ্বন্দ্বে দীর্ণ মন ধীরে ধীরে একমুখী একাগ্রতায় মগ্ন হয়ে দ্বন্দ্বহীন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। তখনই উদ্দিষ্টের মনে হয় বোধিলাভ বা সিদ্ধিলাভ।

গুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার যে গল্পগুলি আমরা শুনি, তা নিছকই ভক্তদের গুরুর প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য ও অন্ধভক্তির ফল। প্রশ্নহীন আনুগত্য তো নিজেই এক মৃদু স্বসম্মোহিত অবস্থা। গুরুকে অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন মনে করার মধ্যে নিজেদেরই নিরাপত্তাবোধ জড়িয়ে থাকে। তাই ধ্যানস্থ গুরুকে মাটি থেকে শূন্যে ভেসে ওঠা দেখি সম্মোহিত অবস্থায় দৃষ্টিভ্রমের (Visual Illusion) মাধ্যমে। গুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার জন্ম ভক্তের অন্ধভক্তিতে আচ্ছন্নতা, আর গুরুদেরও একে ব্যবহার করার চাতুর্যে। গুরুরা যে দৈববাণী শোনেন তা হয় সম্মোহিত অবস্থায় শ্রবণভ্রম (Auditory Illussion) অথবা মিথ্যাচারের চাতুর্য।

ভারতের গুরুবাদ এমনই সম্মোহন আর চাতুর্যের মিশেলে পার করে এসেছে যুগযুগান্তরের পথ। নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম বুদ্ধের মতো ব্যক্তি, যাঁরা নিজেদের দ্বান্দ্বিক অবস্থা থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে অর্থাৎ সিদ্ধিলাভ করতে ধ্যানের স্বসম্মোহন প্রক্রিয়ার পথে এগিয়ে বোধি লাভ করেছিলেন।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান