নিঃসীম বসু
আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে।
বলে শুধু, বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে।
— রবীন্দ্রনাথ
প্রিয় শ্রীমতী নিঃসঙ্গ হৃদয়
আমার এখন ষোলো বছর। আর এখন আমি কী করব জানি না। তাই তুমি যদি একটা কিছু বলে দাও তবে আমি সেটার কদর করব। আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন কিন্তু খুব খারাপ ছিলাম না — কারণ ছোটোদের সাথে ব্লক দিয়ে মজার জিনিস বানিয়ে খেলতাম। কিন্তু অন্য মেয়েদের মতো আমারও ছেলে-বন্ধু করতে ভালো লাগে। কোনও ছেলেই আমাকে সঙ্গে নিতে চায় না, কারণ জন্ম থেকেই আমার নাক নেই। আমি কিন্তু ভালো নাচতে পারি ও আমার শরীরের গড়নও খুব সুন্দর; আমার বাবা আমাকে সুন্দর পোশাকও কিনে দেন।
সারা দিন বসে বসে আমি নিজেকে দেখি আর কাঁদি। আমার মুখের মাঝে একটা বড়ো গর্ত। এটা দেখে অন্যেরা ভয় পায়, আমিও ভয় পেয়ে যাই। তাই ওরা আমাকে সঙ্গে নেয় না বলে ওদের আমি দোষ দিই না। আমার মা আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু আমার দিকে তাকালেই ভয়ানক কাঁদতে শুরু করে।
আমার দুর্ভাগ্যের জন্য নিজেকে দায়ী করতে পারি এমন কীই বা আমি করেছি? যদি কিছু করেও থাকি তখন আমার বয়স এক বছরের হয়নি বা আমার জন্মের আগে। আমি আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছেন তিনি জানেন না, বা হতে পারে আমার জন্মের আগে কোথাও তিনি এমন কিছু করে ছিলেন যার পাপের শাস্তি আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে। কিন্তু এটা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না, কারণ তিনি খুব ভালো মানুষ। তাহলে কি আমার আত্মহত্যা করা উচিত?
— বিনীত এক মরিয়া
[Nathaniel West-এর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘Miss Lonelyhearts, Expressionist black comedy’, 1933, ভাবনুবাদ — লেখক।]
এখন প্রশ্ন এই মেয়েটির আত্মহত্যার কথা মাথায় এল কেন? তার এই জন্মগত ত্রুটির জন্যে তো সে দায়ী নয় — তাহলে কে? সমাজ — মেইন স্ট্রিম সোসাইটির কাছে সে কী ভাবে খাপছাড়া, বেমানান অপাংক্তেয়, পরিত্যক্ত, অনভিপ্রেত হয়ে উঠল?
এবার তবে বিদিশার কথায় আসি — চেঁচনিয়ার এক স্কুলে কয়েকজন শিশুকে আটকে রেখে সন্ত্রাসবাদীরা মেরে ফেলেছিলেন। বাইরে সমস্ত মানুষের মধ্যে, কাগজে, টিভিতে যখন এ-নিয়ে ছিঃ ছিঃ চলছে, ঘাতকদের নৃশংস মনে করে তীব্র ঘৃণা করা হচ্ছে তখন ঘরের মধ্যে বিদিশা ঘাতকদের ধন্যবাদ জানাচ্ছে, আনন্দে নাচছে। ভার্জিনিয়ায় যে কোরীয় ছাত্রটি কয়েকজনকে গুলি করে মারল তাতেও বিদিশার আনন্দ হয়েছিল। ডাক্তারের কাছে এসব বলতে বলতে বিদিশার জলে ভেজা চোখের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল আগুন। বিদিশার সিজোফ্রেনিয়া নয়। তাঁর কথায় ‘পৃথিবীর যে কোনও দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু ও বিপদে আমার ভেতরটা যেন জুড়িয়ে যায়। আমার ভেতরের এই ব্যাপারটা কি বলবার মতো? লোকে কি ছি ছি করবে না?… খুব ছোটোবেলা থেকেই বড়োদের পৃথিবী আমাকে বিশেষভাবে বুঝিয়ে দেয় আমি সুন্দর নই, তাই অবাঞ্ছিত। প্রায় সময়ই এরকম ঘটত, কয়েকজন বাচ্চার মধ্যে আমি বাদে আর সবাইকেই বড়োরা আদর করছে, কথা বলছে, নাম জিজ্ঞাসা করছে মজা করছে। আমি এককোণে থেকে যেতাম, কারোর মনেই হত না আমি আছি। বড়ো হয়ে যা সুন্দর তাই সহ্য হয় না। মনে হয় এসব তো কোনও কিছুই আমার জন্য নয়। এতো আমার বাইরের অন্য এক পৃথিবী। … সারা পৃথিবীটাকেই মাঝে মাঝে নরক মনে হয়। শুধু চেনা আর আপন লাগে রাস্তার ফুটপাতের রুগ্ন ভিখিরি আর জরাগ্রস্ত বুড়োবুড়িদের দেখলে। ওর ওপর আমার কোনও রাগ নেই।… মাঝরাতে ঘুমন্ত মা-বাবার মুখ দেখে মনে হয়েছে ওরাই তো আমার রূপের জন্মদাতা। মনে হয়েছে দিই না এই সময় দু-জনকে গলাটিপে শেষ করে।’ [ডা: গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘মনোচিত্রকের ডাইরি’, ২০০৯]
প্রথমটায় Miss Lonlyherts-এ চিঠির শেষে মেয়েটির মনে প্রশ্ন তার আত্মহত্যা করা উচিত কিনা? আর বিদিশার অনেক কিছু মনে হয়েছে। মনে হয়েছে মানুষের মৃত্যু ও বিপদে তার আনন্দ হওয়াটা লোককে বলবার মতো নয় — লোকে ছিঃ ছিঃ করতে পারে। আবার সারা পৃথিবীটাকে নরকসম মনে হয়েছে। মনে হয়েছে — দিই না এই সময় দু-জনকে গলা টিপে হত্যা করে। এখন প্রশ্ন, বিদিশার মনের অবস্থা আজ এমন হওয়ার জন্য কী বিদিশা দেখতে সুন্দর নয়, এটাই দায়ী? আবারও ঐ একই কথা, এটাতে তো বিদিশার কোনও হাত ছিল না; তাহলে সবাই বিদিশাকে অবাঞ্ছিত করে রাখল কেন? বিদিশাই বা নিজেকে এর থেকে বের করতে পারল না কেন? বিদিশাকে মেইনস্টিম সোসাইটি থেকে দলছুট করে দেওয়া হল — এর জন্য কে দায়ী? বিদিশার এই ধরনের আচরণকে সমাজের মনে হয়েছে অস্বাভাবিক, বিপজ্জনকও বটে। আর সেই জন্যই কি তারা বিদিশাকে মেনে নিতে পারল না, নিজেদের বলে ভাবতে পারল না? বিদিশার এই Agitative Depression সমাজের চোখে মানসিক অসুস্থতা অপেক্ষা অনেক বেশি অস্বাভাবিকতা হয়ে উঠেছিল। তার কথাগুলির মধ্যে অন্যেরা স্বাভাবিকতা খুঁজে পাচ্ছিল না। এমনকি বিদিশার মনেও এমন একটা দ্বন্দ্ব জন্ম নিয়েছিল।
এবার তবে লক্ষ্মী মুর্মুর কথা বলি — (সংবাদপত্র থেকে সংগৃহীত) মেয়েরা ধর্ষিত হবার পর খবর থেকে হারিয়ে গিয়ে কোথায় যায়, কেমন থাকে এসবের খবর নিতে দিল্লির এক সাংবাদিক দেশের নানা রাজ্য হয়ে পশ্চিমবঙ্গেও এসেছিলেন। কিন্তু এমন বেশ কিছু মেয়ের তিনি খবর পাননি। বলেছিলেন, কেবল পশ্চিমবঙ্গেই দেখলাম যে মেয়ে ধর্ষিত হয়েছেন সে আর গ্রামে থাকে না। অনেক পরিবারও নিরুদ্দেশ। কোথায় আছে তাও কেউ বলতে পারে না।… এ রাজ্যে ধর্ষণের মোকাবিলা মানে, মেয়েটাকে সরিয়ে দেওয়া। তাকে মুছে দিলেই যেন সমস্যা ঘুচে গেল।
বাঁকুড়ার এক দরিদ্র ব্লক ছাতনা, তার অতি দরিদ্র আদিবাসী গ্রাম ছাপনপুর। সরকারি খাতায় গ্রামও নয়…। লক্ষ্মী মুর্মু এই ছাপনপুরের মেয়ে নয়। তার বাড়ি ছিল শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে হাপানিয়া গ্রামে। বাবা ফরেস্ট গার্ড। যখন ষষ্ঠ শ্রেণি, ছুটিতে হস্টেল থেকে বাড়ি এসেছিল মেয়ে। ভিডিয়ো শো দেখে ফিরছিল দুই সঙ্গীর সঙ্গে। সে যাত্রায় আর ঘরে ফেরা হল না। লক্ষ্মীর সংজ্ঞাহীন দেহ নিয়ে যেতে হয়েছিল হাসপাতালে। গণধর্ষণে অভিযুক্ত হয়েছিল ষোলো জন। লক্ষ্মীর বয়স তখন তেরো।
তারপর যা-যা হল, সবই ছকে বাঁধা। এলাকার নেতা দাঁড়ালেন অভিযুক্তদের পাশে, মেয়ে গ্রামে ফিরতে পারল না। আলাদা এইটুকু, বাবা কেস তুলে নিতে চাইলেও মেয়ে রাজি হয়নি। মাধ্যমিকের পর লক্ষ্মী কাজ নিয়েছিল বেসরকারি সংস্থায়। কৃষির প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ। কিন্তু যাদের খেতে কাজ তাদের মধ্যেও রয়েছে ধর্ষকদের ভাই — ভেজ। লক্ষ্মীকে সরানোর চাপ দিতে থাকল তারা। সংস্থার কর্তা পড়ল ফাঁপরে। একদিন সংস্থার কর্তা স্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠকে ঢুকতে দিলেন না লক্ষ্মীকে। সে দিন যে মেয়েটি রুখে দাঁড়িয়েছিল সে রেবা মুর্মু। বলেছিল, ‘কেন লক্ষ্মী থাকবে না মিটিংয়ে ?…. দলের মিটিংয়ে লক্ষ্মী বাদ পড়বে কেন?’ জবাবে সংস্থার কর্তা বলেছিলেন, ‘এক ফোটা কেরোসিনের জন্য এক বালতি দুধ নষ্ট করব?’ … কপর্দকহীন দুই তরুণী লক্ষ্মী ও রেবা কাজ ছেড়ে দিলেন। দুজনে ফিরলেন ছাপনপুরে। রেবার বাড়িতে থেকে কোর্টে হাজিরা দিতে বাঁকুড়া যেত লক্ষ্মী। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে একটা চাকরি জুটল। যাতায়াতে ৪০ কিলোমিটার।
মামলার রায় বেরোল। ষোলো জন অভিযুক্তর দুজন ফেরার, বাকি চোদ্দো জন অভিযুক্ত। জেলা গোটা তল্লাট বাক্রুদ্ধ। এতগুলো পুরুষ, দামি উকিল, নামী নেতার বিরুদ্ধে একা একটা মেয়ে কিছু করতে পারবে, কেউ ভাবেনি। ফের শুরু হল ধমক-চমক। রেবার বাবা ভয় পেলেন। বাইরের মেয়ের জন্য কি নিজের সর্বনাশ করব?
ফের ঘর ছাড়তে হল। … সামান্য টাকায় কিছু জমি কিনে দুই মেয়ে নিজেরাই ইট গাঁথলেন, টিন ছাইলেন। … ঘর ঘর থেকে শিশুদের হাত ধরে এনে সেখানে সকাল বিকাল পড়াতে শুরু করল লক্ষ্মী। রেবা শুরু করল ‘ছাপনপুর মহিলা কল্যাণ সমিতি’ গড়ে তোলার কাজ। দু-একজন করে শিশু থাকতে শুরু করল রেবা-লক্ষ্মীদের বাড়িতে। ২০১৪ সালে লক্ষ্মীর ক্যানসারের চিকিৎসা করতে যখন দুজন রওনা দিলেন কলকাতায়, তখন বাইশজন শিশুকে বাড়ি পাঠাতে হয়েছিল। ছ-মাস পরে ফিরলেন। রেবা একা। … লক্ষ্মী মুর্মু স্মৃতি শিশুবিদ্যালয় (প্রতিষ্ঠা ২০১৫) সরকারি নথিতে এখনও ‘স্কুল’ হয়নি। [ আ বা প, (‘আরও অনেক কথা ছিল — থাক্’)]
এখন তবে অনেক প্রশ্ন। লক্ষ্মী মুর্মুর লড়াই এর কাহিনি শুনলাম। সমাজ, ‘সুশীল সমাজ’ লক্ষ্মীর গায়ে পরিচয়ে ও আত্ম মর্যাদায় কালি লেপে দেওয়ার প্রবল চেষ্টা করেছে। সতীত্ব নষ্টের ছাপ, ধর্ষিতার অপমান জনক তকমা লক্ষ্মীকে, রেবাকে প্রতিহত করতে পারেনি। এমনকি পরিবারের থেকেও তারা সহযোগিতা পায়নি। তবু পরিবার, প্রতিবেশী কর্মক্ষেত্রে প্রবল বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে ন্যায় আদায় করতে পেরেছে। অন্যকে অক্ষর দান করে লড়াই করার ক্ষমতা জুগিয়েছে— সেটাই আমাদের শিক্ষা। প্রথম মেয়েটি ও বিদিশাকে যেমন মেইন স্ট্রিম সোসাইটি অপাংক্তেয় করতে চেয়েছে তেমনি লক্ষ্মীর মতো শত-শত মেয়েকে তাই হতে হয়। নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও মুখ লুকাতে হয় গ্রাম বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। সমাজ পরিত্যক্ত, প্রত্যখ্যাত হয়ে যখন কেউ আর নিজের পরিচয়টুকু নিয়ে বাঁচতে পারে না, তখন অসংখ্য আত্মহত্যার ঘটনা আমরা জানি। তার পর সংবাদমাধ্যম মুভিগুলিও যেমনভাবে জনমানসে এগুলি তুলে ধরে তাতে অনেক ক্ষেত্রেই সংবাদমাধ্যমে ‘সাধু পুরুষদের’ অনেকেই চিনতে পারেন না। সে সব অনেক কথা। যদি বলেন তারা শাস্তি পেল, অপরাধ প্রমাণ হল, তবে বলতে হয় তাদের ক্ষেত্রে অপরাধীর তকমা বা ধর্ষকের তকমা ভোটের কালির মতো নখ থেকে দু-দিনেই উঠে যায়।
আরও হাজার হাজার ঘটনা উপস্থিত করা যায়। তবে এই তিনটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠে এল তার উত্তর পেতে কিছু মত অভিমত, একপেশে ধারণার বিচারমূলক আলোচনা দরকার।
ইতিহাসের আর বিবর্তনের ধারায় ব্যক্তিমানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ থেকে সামাজিক মানুষ হয়ে উঠল। আবার সেই সামাজিক বিবর্তনও থেমে থাকল না। এবার একটা মানুষের গোটা সত্তার দুটো ভিন্ন দিকের মিল ও অমিল জটিলতার সৃষ্টি করল। ব্যক্তিসত্তার একটি দিক হল personal identity বা ব্যক্তি সত্তা ও অন্যটিকে social identity বা সমাজ সত্তা। এই দুটোর কোনোটিই তার সামগ্রিক সত্তা নয় — সত্তার অংশ। Personal identity-র ক্ষেত্রে সত্তাগত দিকটি তার জন্মেরও আগে থেকে শুরু করে কবরে চিতায় যাওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে। চেতনাশূন্য বা অজ্ঞান অবস্থায়ও এই সত্তার পরিবর্তন ঘটে না। অন্যদিকে সামাজিক সত্তার ধারণা থেকে তকমার ব্যাপারটা আমরা দেখে থাকি। এখন সমাজের চোখে যেটা স্বাভাবিক বা সাধারণ তেমনটা যারা হয়ে উঠতে পারে না সমাজ তাদের ওপর ‘অস্বাভাবিক?’ ‘অন্যরকম’ ‘খাপছাড়া’ ‘উদ্ভট’ ‘বেমানান’ ইত্যাদি ইত্যাদি তকমা সেঁটে দেন। এমন কালিমা লিপ্ত ছাপ, ক্ষতের চিহ্ন ব্যক্তির সামাজিক মান মর্যাদা, আত্মসম্মান কেড়ে নিয়ে তাকে নিঃস্ব অসহায় করে দেয়। কখনও ব্যথার ওপর ব্যথা দিয়ে ব্যথা বাড়িয়ে দেয়। সমাজের কাছে এরা পূর্ণ সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তাই তারা অপমানজনক দুর্গতির শিকার হয়। এরা কারা? এদের মধ্যে অনেকেই আছে শারীরিক দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ মানুষ, আগে কখনো মানসিক রোগী ছিল এখন ভালো হয়ে গেছে এমন কেউ, নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি, দেহোপজীবী, সমকামী (LGBTQ ইত্যাদি) অথবা কোনও কারণে সমাজ যাদের একঘরে করে দিয়েছে। জাতপাতের বিষয়ে যারা অন্ত্যজ প্রান্তিক, এমন অনেক অনেক। সমাজের দেগে দেওয়ার পরিচয়ের সাথে এরা প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে খাপ খাইয়ে মানিয়ে চলতে, সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে গুটিশুটি হয়ে বেঁচে থাকার পরিবর্তে টিকে থাকতে চেষ্টা করে।
এসবের মধ্যে যারা মানসিক অসুস্থ, তাদের দুর্ভোগের সীমা পরিসীমা নেই। প্রেসার, সুগার থাইরয়েডের সমস্যায় ভুগলে সেটা তার কাছে লজ্জার নয়। তবে কেউ অবসাদ, স্নায়ুচাপ, উদ্বেগ, বাতিক বা সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগলেই সেটা অন্য রোগের থেকে বাড়তি কিছু হয়ে দাঁড়ায়। তখন সেটা তাকে আড়াল করতে হয়। যদি-বা কেউ রোগের কারণে বিধ্বস্ত হয়ে একবার ক্লিনিকে এল, তবু দ্বিতীয়বার আসা চাপের হয়ে যায়। মাঝে মাঝেই শুনতে হয়ে, সোদপুরে আসব না এখানে তো ও পড়তে আসে। বা এখানে আমাদের অনেকে চেনে — আপনার অন্য কোথাও চেম্বার আছে? কখনও শুনি, ওর বাবাকে না জানিয়ে এসেছি, জানলে উনি আসতেই দেবেন না। এমন অনেক কথা, অ-নে-ক কথা। সমাজ সংস্কৃতি প্রগতি বিজ্ঞান চিন্তা যতই বলুন না এই ধরনের অসুস্থতাকে সোজাভাবে দেখার অভ্যাস আমাদের এখনও যথেষ্ট কম। তাইতো মাঝে মাঝেই prescription-এ লিখতে হয় psychoeducation given । অর্থাৎ কাউন্সিলং-এর কিছুটা সময় ওই সচেতন করতেই চলে যায়। পরিতাপের হলেও এটা সত্যি যে মানসিক stigma সৃষ্টিতে চিকিৎসকদের একটা ভূমিকা থাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুভাবেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরা মানসিক রোগীর চিকিৎসা যতটা সময় দিয়ে করেন তাঁর বাড়ির লোকের ‘সাইকো এডুকেশন’ অর্থাৎ অসুখ সংক্রান্ত বিষয়ে বোঝানোর জন্য ততটা সময় দেন না। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত/ উচ্চশিক্ষিত ইত্যাদির অনেকেই মানসিক রোগকে পারিবারিক বা বংশগত পাপ, কুকর্ম, পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফল এসব বলে এখনও ভেবে থাকেন। আরও ভাবেন এসব চিকিৎসায় সারার নয়। মনকে কি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা যায়। কাউন্সেলিং মানে কথা-টথা বলে কি এসব সারে? যা হোক এসবের সঙ্গে মোকাবিলা করতেই তো আমি-আপনি চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে এত নেতিবাচক কথার মধ্যে আশারও দিক আছে। ঐ যে বলছিলাম না সমাজ বিবর্তনটা চলছে। তার সদর্থক ও নঞর্থক গতির মধ্যে সংঘাতটা কিন্তু থেমে নেই।
আর কে স্বভাবিক আর কে অ্যাবনর্মাল — এর মধ্যে একটা তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আছে বটে, তবে তার কোনও শক্ত ভিত্তি নেই। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিক জগৎ’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেন :
প্রকৃতিস্থ এবং অপ্রকৃতিস্থ এই দুই শ্রেণীর মধ্যে কোনর রূপ line of demarcation বা সীমারেখা টানা চলে না। প্রকৃতপক্ষে সেই কল্পিত Mean Man, যিনি পৃথিবীর যাবতীয় মানুষের কাল্পনিক average, তিনিই প্রকৃতিস্থ; — আর সমুদায় জীবন্ত মানুষই তাহার তুলনায় কিছু-না- কিছু অপ্রকৃতিস্থ। সেই মাঝারি মানুষ হইতে কেহ অল্প দূরে, কেহ বেশি দূরে। যে যতটা দূরে সে ততটা অপ্রকৃতিস্থ।
তিনি আরও বলেছেন এটা cultural relativism নয়, মেলাবেন তিনি মেলাবেন জাতীয় syncretism-ও নয়। তবু সচেতন মানুষরা হয়তো তাদের অজান্তেই এই মানসিক অসুস্থতার একটা বিকৃত মানসমূর্তি, ভাবচিত্র গড়ে তুলছেন। এমনটা কথায় বার্তায় সসোশ্যাল মিডিয়ায় মাঝে মধ্যে ঘুরে ফিরে আসে। শুনতে পাই ওর একটু ব্রেন শর্ট আছে, ও মেন্টাল, সাইকো ইত্যাদি। Whatapp-এ একটা পোস্ট পেলাম। হয়তো কোথাও থেকে পেয়ে তিনি forward করেছেন। যাই হোক এখানে মানসিক রোগ ও চিকিৎসকদের নিয়ে যে ধরনের কৌতুক তৈরি হচ্ছে তার গভীরে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে তাদের মনোভাবটি কিন্তু স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দেখুন এক জায়গায় Psycho The Rapist কথাটা বোর্ডে লেখা দেখাচ্ছেন একটি কার্টুন চরিত্র। অন্য কার্টুন চরিত্র বলছে — ullu ke pathe! Psychotherapist is one word! আবার আর একটি পোস্ট দেখুন— The relationship between husband & wife is very psychological. One is Psycho and the other is Logical. Now please don’t try to figure out who is who। বুঝলাম ভীষণ talent, তুখোর বুদ্ধি। তবে এরা সব বুদ্ধি এসব বিষয়েই খরচ করে ফেলছেন। এখানেই আমাদের নিজেদের একবার ভেবে দেখা উচিত আমরা তাদের প্রতি কতটা sensitive। কখনও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বই-এর প্রচ্ছদে ও ভেতরের ইলাসট্রেশনে কার্টুনের ব্যবহার এমন হয়েছে,যার ফলে মানসিক বিষয়ের ভার ও গুরুত্ব অনেকটাই কমে গেছে বলে আমার মনে হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের আর একবার ভেবে দেখার আছে। অনেকটা নেগেটিভ বলা হয়ে গেল। মানসিক বিষয় চলচ্চিত্র যেমন কিছু সদর্থক বার্তা বয়ে এনেছে আবার কিছু নেতিবাচক বার্তা তুলে ধরেছে। দেশি বিদেশি এমন অনেক ছবির নাম করা যায়। তবে সাম্প্রতিক কয়েকটি মাত্র বাংলা ছবির নাম করছি যেখানে মানসিক অসুস্থতা বা সামাজিক কলঙ্ক বিষয়ে একটা পক্ষপাতহীন ইতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এমন কয়েকটি ছবির মধ্যে ‘বেলাশেষে’, ‘মুখার্জীদার বৌ’, ‘নগর কীর্তন’, ‘ভিঞ্চিদা’, ‘কণ্ঠ’-র নাম মনে আসছে। ‘কণ্ঠ’ ছবিটির বিষয়ে দু-এক কথা বলব। ল্যারিঞ্জেকটমি হওয়ার পর বাচিক শিল্পীর নিজের পেশা তথা নেশায় ফিরে আসার গল্পই বলে কণ্ঠ। কেরিয়ার তথা জনপ্রিয়তার শীর্ষে টিকে থাকার লড়াইটা এখানে একটা বাধা গতের বাইরে। ক্যানসারে শব্দযন্ত্র/ ভোকাল কর্ড বাদ যাওয়া অর্জুন মল্লিকের মার্কার পেনের আঁচড়ে সাদাবোর্ডে কখনও ভেসে উঠেছে একরোখা উচ্চারণ ‘লিভ মি অ্যালোন’, ‘একা থাকতে চাই’ ইত্যাদি। অস্তিত্বের সংকট/ আইডেনটিটি ক্রাইসিসের কথা, পৃথার প্রতি প্রতিহিংসার মনোভাব, হেরে যাওয়ার ভয়, কখনও লড়াই থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা। তার সাথে দেখানো হল ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি কাটিয়ে নতুনভাবে কোনও কিছু শুরু করা যায়। আর স্পিচ থেরাপিস্ট রোমিলা চৌধুরী চরিত্রটি এসেছে। অনেক মানসিক জট জটিলতা টানাপোড়েন বা বাস্তবতাকে তুলে ধরার সাথে সবশেষে যে বার্তাটি দেওয়া হল তা আলোর দিশারী। শেষ পর্যন্ত হেরে যাওয়ার মানসিকতাকে অতিক্রম করে ‘আলোয় ফেরা’-র গল্প বলতে চেয়েছে ‘কণ্ঠ’। এখন অনেক প্রচেষ্টায় মানসিক বিষয়ে একটা পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি সমাজমনে গড়ে উঠছে। এই দেখে পুরোটা হতাশ হবার কিছু নেই।
এবার একটু অন্যদিকে ফেরা যাক। যদিও অধিকাংশ সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা বা অন্বেষণ শারীরিক বা দৈহিক অসুস্থার প্রতি লক্ষ রেখেই করা হয়েছে, তবু মানসিক অসুস্থতা বিষয়ে লেখালেখির কিন্তু একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। সমাজতাত্ত্বিক এই সব লেখালেখির বেশিরভাগের লক্ষ্য ঐতিহ্যানুসারী। এর সঙ্গে বলার হল, তা অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক অসুস্থার অ-সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রাধান্য দিয়ে অনুসরণ করা হয়েছে। সমাজতত্ত্বের দিকটা বুঝে নেবার আগে মনস্তত্ত্বের সাধারণ কিছু কথা বলে নিতে চাই। আমরা প্রায় ক্ষণেই ভুলে যাই কারও অসুস্থতা নয় দৃঢ়তা, সততা, সাহসই একজন ব্যক্তির পরিচয়। মানসিক সমস্যা আমাদের ব্যক্তিত্বেরই দুর্বলতা — এই ভুল ধারণা আমাদের স্টিগমার একটা বড়ো উৎস। আর মানসিক সমস্যা ব্যক্তির একতরফা সমস্যা তো নয়, ব্যক্তির সাথে পরিবেশের দ্বন্দ্বের পরিণতি। এই দ্বন্দ্বের ফলে ব্যক্তির মস্তিষ্কের জৈব রাসায়নিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হতে পারে। ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরান — দেখবেন মপাসাঁ বোদলের মানসিক চিকিৎসার জন্য তখনকার অ্যাসাইলামে ভর্তি হয়েও পৃথিবীর সাহিত্যকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বহু যুগ এগিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই যার কথা জানেন সেই জন ন্যাস সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে গেম থিয়োরির ওপর অর্থনীতিতে জন হার্সান্ইয়ি এবং রাইনহার্ড সেল্টেনের সাথে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০০১ সালে হলিউডের মুভি ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’ (‘A Beautiful Mind’) তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা হয়। মায়াকভস্কি, সার্গেই এসেনিন, ভার্জিনিয়া উল্ফ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিলেন। এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যায়। আত্মহত্যা করেছিলেন বলেই কি তারা দুর্বল? ডাঃ গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন — ‘যদি কেউ কোনোরকম বাড়তি খরচ না করে টাকা পয়সা ব্যাংকে রেখে দেন, খাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে জল খান না, রাস্তার একসিডেন্টে নিজেকে জড়ান না, রাত দশটা বাজলেই দুনিয়া রসাতলে গেলেও বিছানায় চলে যান… তিনি কি ভারসাম্যযুক্ত স্বাস্থ্যকর ব্যক্তিত্ব?’ তিনি মানুষের মানসিক সমস্যা দেখলে নিশ্চই হাসাহাসি করতে পারেন। কি বলেন এরকম মানুষ তো আমরা সবাই দেখেছি। এদের কিছুতেই কিছু যায় আসে না। আবার কিছু আঁতেল আছে যাদের জীবন আহ্নিক গতির মতন ছন্দে চলে, আর মাঝে মাঝে আঁতলামিতেই দিন কেটে যায়।তারা মানসিক সংকট বলে কিছু হয় এমনটা বিশ্বাস করেন না শুধু তাই নয় অট্টহাস্যও করে থাকেন। আবার কারও কারও বিজ্ঞ মন্তব্য আসলে অসুখটা একেবারে সমাজের গভীরে। আরও অনেক কথা। সাইকোলজির স্টুডেন্টদের, ডাক্তার বা মানসিক রোগের চিকিৎসকদের কখনও মানসিক রোগ হতে নেই — এমন ধারণা নিয়ে অনেকে শেষ যাত্রায় পর্যন্ত চলে যান। তাই হোক যিনি প্রতিবেশীর অসুস্থতায় ছুটে যান, করোনা রুগির বাড়িতে বাজার, অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেন অথচ মাঝে মধ্যে ডিপ্রেশনে ভোগেন তিনি সমাজের অধিকাংশের চোখে ভারসাম্যহীন, সাইকো…।
এবার সমাজতত্ত্বের দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক। মানসিক চিকিৎসার জন্য এমনকি সমাজতত্ত্বের নিজ পরিসরের মধ্যেও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এইসব দৃষ্টিভঙ্গিগুলি মানসিক অসুস্থতার প্রকৃতি ও গুরুত্ব বিষয়েও ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে।
একদল চিন্তকের অভিমতের মূল ভিত্তিগুলি হল — interactionist তথা অন্যোন্য ক্রিয়াবাদীদের লেখালেখি, মানসিক অসুস্থতা বিষয় সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব মীমাংসা, কেনই বা বিশেষ ধরনের কিছু আচরণকে মানসিক অসুস্থতা বলে চিহ্নিত করা হয় তার কারণ অনুসন্ধান, ইত্যাদি। ফুকোর কথাটা কিছুটা ভিন্ন ধরনের। তাঁর যুক্তি হল, মানসিক অসুস্থতা একটি নির্মিত বিষয়/constructed। যদিও সুনির্দিষ্ট অন্যোন্য ক্রিয়াবাদীদের সাথে তিনি একমত নন। ফুকোর মতে এ বিষয়ে আপত্তির কথা পরে প্রসঙ্গক্রমে বলব।
অন্য আর একটি দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা গঠনবাদী বা অবয়ববাদী (structuralist) দৃষ্টিভঙ্গি বলতে পারি। এঁরা কিন্তু মানসিক অসুস্থতার ধারণাকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছেন, interactionist-দের মতো উড়িয়ে দেননি। তবে সমাজের বিভিন্ন দলের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার ধারণাটা কীভাবে স্বতন্ত্ররূপে রয়েছে সে বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। Thomas Scheff (১৯৬৬)-এর যুক্তি হল মানসিক অসুস্থতা বলে কিছু নেই বা হয় না। প্রকৃতপক্ষে সকলপ্রকার ব্যতিক্রমী ও বিশৃঙ্খল আচরণ যা অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না (যেমন : সুরাসক্তি, মাদকাসক্তি) এদের সবগুলিকে একই শিরোনামে নিয়ে আসা উচিত। Scheff বলছেন, যে-সব মানুষ বিশৃঙ্খল ও এলোমেলো আচরণ করে তারা সবাই কিন্তু মানসিক অসুস্থ নয়; বরং এদের আচরণ অন্যদের ক্ষেত্রে বোধগম্য হয়ে ওঠে না।
তিনি দাবি করলেন, অধিকাংশ মানুষের জীবনে কখনও এমন অবস্থা আসে যখন তারা অবধারিত ভাবে অদ্ভুত রকম আচরণ করে। এইসব আচরণকে তা বলে devient বা বিপথগামী আচরণ বলা যায় না। এধরনের আচরণের পরিণাম তেমন কোনোভাবে ধর্তব্যের মধ্যে আনা উচিত নয়। তবে কেবল অল্প সংখ্যক মানুষের আচরণকে মানসিক অসুস্থতার প্রমাণস্বরূপ ধরা যায়।
Scheff বললেন একেবারে ছোটো বয়স থেকে প্রত্যেকেই মানসিক অসুস্থতার একটা চলতি বাঁধা গতে ধরন শিখে নেয়। তারপর সেটা বারবার আকার পেতে থাকে। শৈশবের ব্যাপক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। যেমন দেখি কেউ পাগল হয়ে যাচ্ছে বা গেল (going mad)। আবার কাউকে উন্মাদের মতো আচরণ (acting like a lunatic) করতে দেখি। এরপর মানসিক অসুস্থতা বিষয়ে মিডিয়ার গড়া ভাবমূর্তির প্রভাবে সেগুলি জোরদার হয়। এসব ভাবমূর্তির একটা বড়ো অংশ মূলত সিনেমা বা মিডিয়াতে মানসিক অসুস্থ ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত অপরাধের সংবাদ নির্মাণের ধরন ধারণ থেকে তৈরি হয়।
Scheff-এর মতে শুধু যে অধিকাংশ মানুষ মানসিক অসুস্থতাকে এই ধরনের steriotype-এর মাধ্যমে চেনে জানে বা বোঝে তাই নয়, এমনকি যাদের ওপর মানসিক অসুস্থতার লেবেল পরে গেছে তারাও এই ধরনের গতে বাঁধা ধারণার
প্রভাবমুক্ত নয়। মানসিক অসুস্থ রোগীদের আচরণও এসব চলতি ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়।
Scheff-এর অনুসন্ধান থেকে মানসিক অসুস্থতার বাস্তবতা এবং কীভাবে একে সংজ্ঞায়িত করা যায় সে বিষয়ে একগুচ্ছ প্রশ্ন উঠে এল। তার মধ্যে দুটি প্রশ্ন বরবারই থেকে গেল — ১) অন্যদের বাদ দিয়ে কাউকে কাউকে কেন মানসিক অসুস্থতার লেবেল আটকে দেওয়া হচ্ছে। ২) কাউকে মানসিক অসুস্থতার লেবেল লাগিয়ে দেওয়ার ফল কী হতে পারে?
Erving Goffman-এর অভিমত, অন্যেরা নিজেদের স্বার্থেই কাউকে মানসিক অসুস্থতার তকমা এঁটে দেয়। এটা বোঝাতে তিনি একটা দৃষ্টান্ত দিলেন। ১৯৬৪ নাগাদ Laing এবং Esterson সিজোফ্রেনিয়া বিষয়ে অন্বেষণ করছিলেন। এই স্টাডিতে তিনি কয়েকজন সিজোফ্রেনিয়া রোগীর পারিবারিক জীবনের খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। একটি কেস স্টাডিতে Maya Abbot নামে একজনের বিষয় উল্লেখ করেছেন। Leing ও Erterson-এর স্টাডি শুরুরও দশ বছর আগে প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়ার রোগিণী Maya হাসপাতালে এসেছিলেন। Maya-র বাবা-মা সমাজসেবামূলক বিভাগের কাছে অনুনয়ের সঙ্গে জানিয়েছিলেন যে তাঁদের মেয়ে সামাজিক মেলামেশা থেকে অনেকটা সরে আসছে, গুটিয়ে নিচ্ছে; আবার মাঝে মাঝে এও বলেছে যে, বাবা-মাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে। পরিবারের এই উদ্যোগের জন্যই হয়তো Maya-র হাসপাতালে আসা হয়ে উঠেছিল।
দেখুন তবে Leing ও Esterson যখন পরিবারের খবরাখবর নিচ্ছেন তখন তারা জানালেন Maya যেভাবে বড়ো হচ্ছে সেটা পরিবার সোজাসুজি মেনে নিচ্ছিল না। মানতে পারছিল না। বাবা-মা মেয়ের সাথে উলটো পালটা আচরণ করছিল, তার পেছনে এটা-ওটা ফিসফিস করছিল। পেছনে গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছিল। বাবা মায়ের মতে তাদের মনে হচ্ছিল মেয়ে এমনসব আচরণ করছে যেটা মেয়ের একেবারে নিজস্ব উদ্ভাবন। মেয়ের আচার আচরণ হাবভাবের ওপর মানসিক অসুস্থতার সংজ্ঞার্থটা চাপিয়ে দিয়ে তারা সফলভাবে মেয়ের স্বাধীনতা হরণ করতে পেরেছিল। এই ঘটনাটা Sheff-এর যুক্তির পক্ষে যায়। তিনি বলেছিলেন, কাউকে তকমা এঁটে দেওয়া হয় এই স্বার্থে যাতে যে বা যারা তকমাটা আরোপ করে তাদের স্বার্থসিদ্ধি ঘটে। এখানে Maya-র বাবা-মার যেমন স্বার্থসিদ্ধি ঘটেছিল।
Goffman-এর মতে একবার কারও গায়ে মানসিক অসুস্থতার লেবেল পরে গেলে অন্যরা তার সাথে ভিন্নরকম ব্যবহার করে। মানসিক অসুস্থ ব্যক্তিটি যা কিছু বলে বা করে অন্যেরা তার নতুন রকম, অন্য রকম বা বিচিত্র রকম ব্যাখ্যা করে (এক্ষেত্রে নিজ উদ্ভাবনী শক্তি ব্যবহার করতে এতটুকুও কার্পণ্য করে না)। Goffman একে আবোলতাবোল, খাপছাড়া এলোমেলো অন্যোন্যক্রিয়া (spurious interaction) বলেছেন। মানসিক অসুস্থ মানুষটি যে কাজ করুক-না-কেন বা চেষ্টা চালাক না কেন, তার মূল্য বিচার হয় ঐ এক দিক থেকে — কিনা মানুষটি মানসিকভাবে অসুস্থ। তাই তারা যাই করুক বা বলুক না কেন কখনোই সেটাকে ভালোভাবে বা খোলামনে নেওয়া হয় না।
এক্ষেত্রে সামাজিক যোগসাধনের ব্যাপারটা মেকি বা মিথ্যা, এক্ষেত্রে যোগাযোগ বজায় রাখাটাই সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ মানসিকভাবে অসুস্থদের মতামত ‘স্বাভাবিক লোকজন’-এর মতামতের কাছে কোনও রকম পাত্তাই পায় না। এদের বাচ্চা ও বুড়োদের মতই উপেক্ষা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্যই করা হয়।
১৯৬৮ সালে Goffman তাঁর Asylums নামক বইতে যারা মানসিক অসুস্থতার তকমা নিয়ে নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানসিক হাসপাতালে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিল তাদের জীবনযন্ত্রণার অনুপুঙ্খ অনুসন্ধান করেছেন। অনুসন্ধানের পর Goffman সিদ্ধান্তে এলেন আলোচনার জন্য যে-সব সাক্ষাৎকারে তিনি নিয়েছিলেন তার ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রেই আলোচনায় রাজী না-হওয়ার জন্য কোনও আইনি উপায় তাদের কাছে ছিল না। আবার যেখানে কোনও ক্ষেত্রে আলোচনায় রাজি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে তখনও Psychiatrist মনে করছেন তাদের ছেড়ে দেওয়াই ভালো। কারণ অন্যকে বা নিজেকে আঘাত করার ঝুঁকি না-নিয়ে বরং তাদের নিজের অসুস্থতা স্বীকার করে নেওয়া ভালো। Goffman হাস্যকর এক সংলাপের চমৎকার দৃষ্টান্ত রাখলেন — মাত্র আট মিনিট কথাবার্তা চালবার পরই psychiatrist বলে ফেললেন ওদের আর আমার কিছু জিজ্ঞাসা করার নেই (সিজোফ্রেনিক), কারণ তারা কী বলবে আমি জানি [I don’t bother asking them (schizophrenic) more questions… because I know what they are going to say.] এবার Rosenhon- এর স্টাডির একটা বিখ্যাত দৃষ্টান্তের কথা শোনাব। সালটা ১৯৭৩। বেশ কিছু গবেষক আমেরিকার মানসিক হাসপাতালগুলিতে গিয়ে বলছেন যে সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন বলে তাঁরা নিজের ইচ্ছায় হাসপাতালে ভর্তি হতে চান (গবেষকদের কারোরই আগে কখনও মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ ছিল না)। গবেষকরা যেইমাত্র ভর্তি হয়েছেন অমনি তারা স্বাভাবিকদের মতো ঠিকঠাক আচরণ করতে শুরু করল। মজার ব্যাপার হল এই স্বাভাবিক আচরণকেই সিজোফ্রেনিয়ার প্রামাণিক লক্ষণ হিসাবে দেখতে শুরু করা হল। উদাহরণ হিসাবে Rosenhan একজন গবেষকের চিকিৎসার প্রমাণপত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলেন একজন সাইকিয়াট্রিস্ট নার্স এই গবেষকের সম্বন্ধে মেডিক্যাল নোটে লিখছেন — ‘রোগীর মধ্যে লেখালেখি করার আচরণ দেখা দিচ্ছে (Patient manifest writing behaviour.)।’ এমনকি ডাক্তার অথবা নার্সের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গবেষকরা দেখলেন তাঁরা যা-যা বলেছিলেন সেগুলি নার্স বা ডাক্তাররা নিয়মিতভাবে এড়িয়ে গেছেন, অথবা আসলে তাঁরা যে সব কথা বলেছিলেন সেগুলিকে মেডিক্যাল স্টাফরা যেমন শুনে অভ্যস্ত সেইমতো বদলে নিয়ে লিখেছেন। Goffman বললেন একজন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে ওঠার মধ্যে যে বিষয়টা যুক্ত, সেটা হল যখন কেউ মানসিক হাসপাতালে আসে বা ভর্তি হয় তখন যে সাংস্কৃতিক মনোভাব নিয়ে আসে সেই মনোভাব থেকে তাদের আলাদা করে দেওয়া হয়। নিজের সংস্কৃতি তুলে ধরা বলতে Goffman বোঝাতে চেয়েছেন, যেভাবে কেউ ভাষার মাধ্যমে বলার ধরনধারণ, জামাকাপড়ও চুলের স্টাইল — এসবরে মাধ্যমে নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরে বা ধরতে চায়। আসলে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীদের নিজস্ব ভাবমূর্তি কেড়ে নেওয়া হয় এবং ইনস্টিটিউশনের বিধিনিষেধ নিয়মকানুন মেনে নিতে না-পারলেই সে যে মানসিক অসুস্থ সেটা পাকাপাকি রূপে ঠিক হয়ে গেল। এবার তার ওষুধপত্রের মাধ্যমে চিকিৎসা হওয়া দরকার।
এখন এই ধারণাগুলির একপেশে দিক থেকে একটু বেরিয়ে আসা যাক। ১৯৮২-তে Water Gove যুক্তি দিয়ে Goffman-এর লেবেলিং তত্ত্বের বিরোধিতা করলেন। তিনি বললেন লেবেলিং তত্ত্ব যেমন অতিরঞ্জিত (oustated), তেমনি অনেকাংশে বেঠিকও বটে। Gove বলছেন এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে রোগী psychiatric treatment পেয়েছে ও তাদের সাংঘাতিক রকমের মানসিক সমস্যা ছিল। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসা অবশ্যই দরকার ছিল। এই অসুস্থতাটা তাঁর লেবেল চাপিয়ে দেওয়ার অনেক আগেই ঘটেছে।
ধরা যাক, যাদের সামাজিক পটভূমি, পারিবারিক ইতিহাস, জীবনশৈলী প্রায় একই রকম, তাদের মধ্যে কারও মানসিক অসুস্থতা দেখা দিচ্ছে; আবার কারও দেখা দিচ্ছে না, এমন ঘটনা লেবেলিং থিয়োরি কিন্তু সন্তোষজনক ভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারে না। Gove কিন্তু মানছেন না যে বেশিরভাগ লোকই মানসিক অসুস্থদের প্রতি নির্দয় আচরণ করে, নীচু চোখে দেখে।
মানসিক অসুস্থদের সাথে অনেক মানুষই রয়েছে। এই যুক্তিটি ১৯৮১ সালে Miles-এর কাজ থেকে সমর্থিত হয়। তাঁর অন্বেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের লোকেরা যখন মরিয়া হয়ে অন্য কোনও ব্যবস্থা খুঁজে পাচ্ছেন না তখনই তারা মেনটাল ইলনেস-এর ‘লেবেল’-টি দিচ্ছেন। তবে আর ফুকো বাদ যান কেন। একটু ছুঁয়ে যাই। অন্যোন্য ক্রিয়াবাদ (interactionism) ও গঠনবাদের (structralism) থেকে একেবারে ভিন্ন ভাবে ফুকো মানসিক অসুস্থতা ধারণা উদ্ভবের কথা শোনালেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে rational / যুক্তিসম্মত ও disciplined action/ শৃঙ্খলাবদ্ধ কাজকর্ম বিষয়ে সমাজে ক্রমশ গুরুত্ব বাড়তে থাকার জন্যই madness বা পাগলামোর আধুনিক ধারণার উদ্ভব। এই ব্যাপারটাকে হাইলাইট করতে গেলে বিপরীতধর্মী একটি আচরণ মানা দরকার। কারণ যৌক্তিকতা ও শৃঙ্খলা-র অস্তিত্বের জন্য দরকার অযৌক্তিক (irrationality) ও অনিশ্চয়তার (unpredictability) ধারণা। এই প্রসঙ্গে ফুকো বলছেন আঠারো শতকে ধর্ম ও বিশ্বাসের বিপরীতে যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির ক্ষমতা ক্রমশ প্রাধান্য পেতে শুরু করেছিল। আর ঐ অষ্টাদশ শতাব্দীতেই (১৯৭১) মানসিক অসুস্থতার জন্য অ্যাসাইলামের আবির্ভাব ঘটে। অষ্টাদশ শতাব্দীতেই ধনতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তির প্রাধান্য ও বিকশিত হতে লাগল। যুক্তি সম্মত, শৃঙ্খলাবদ্ধ আচরণের প্রতি গুরুত্ব বাড়ার সাথে সাথে বিশৃঙ্খল অযৌক্তিক আচরণকে পাগলামো বলতে শুরু করা হল। যারা এই ধরনের আচরণ করছিল তাদের আটকে রাখা, আয়ত্তে রাখা আর দাবিয়ে রাখার পালা শুরু হল। পূর্বে ফ্রান্সে কুষ্ঠরোগীকে মূলধারা সমাজ থেকে আলাদা করে রাখার জন্য কিছু ইনস্টিটিউশন তৈরি হয়েছিল। ঐসব ইনস্টিটিউশনগুলিতে কুষ্ঠরোগীদের রাখা হত। ফুকো বলছেন এই সব মানসিকভাবে অসুস্থ লোকরা যেন আক্ষরিক অর্থে ঐসব কুষ্ঠরোগীদের মতোই সমাজের থেকে আচরণ পায়। ফুকোর ব্যাখ্যায় ঐতিহাসিক দার্শনিক তাৎপর্য আছে ঠিকই তবু তার খর্বতাও রয়েছে। কারণ তাঁর কাছে শরীর হল জৈব-রাজনৈতিক বাস্তব আর ঔষধি জৈব-রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি। এই সব জটিল তাত্ত্বিক আলোচনার ভারে বিষয় সরে যেতে পারে বলে এর বিস্তৃত আলোচনা সমালোচনা এখানে স্থগিত রাখা হল।
স্টিগমার প্রসঙ্গে আবার একটু Goffman-এ ফিরে আসা যাক। স্টিগমার উৎস নির্ণয়ে Goffman-এর আগ্রহ খুব কমই ছিল। ওনার বরং আগ্রহ ছিল সমাজে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পারস্পরিক সম্পর্কে এর প্রভাব কীরকম এবং stigma লাঞ্ছিত ব্যক্তিরা এটাকে কেমনভাবে দেখছে সেটার তত্ত্ব তালাশ করা। যখন কারও প্রকৃত সত্তা বা পরিচয়ের সাথে ভার্চুয়াল সত্তার গুরুত্বপূর্ণ ফারাক থাকে তখনই এর কুফলগুলি লক্ষ করা যায়। যেমন, Goffman discrediting এবং discreditable stigma-র মধ্যে পার্থক্য করেছেন। Discrediting stigma-র ক্ষেত্রে বাইরে থেকে বোঝা যায় এরকম শারীরিক ত্রুটি বা অক্ষমতা থাকে। আর discreditable stigma-র ক্ষেত্রে ব্যক্তি ইচ্ছা করলে নিজের অক্ষমতাটুকু অন্যের কাছ থেকে গোপন রাখতে পারে।
Goffman বলছেন, কিছু মানুষ আছে যাদের গর্ব করার মতো বা জাহির করার মতো তেমন কিছু নেই। এরা প্রতিদিন নিজেদের ব্যাপারে এটা-ওটা টুকিটাকি অনেক কিছু গোপন করে সামনে না এনে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করে। এতে কিন্তু অনেকক্ষেত্রে ওরা অপদস্থ, অপমানিত, অবহেলিত হওয়া থেকে বেঁচে যায়। আর একটি বিশেষ কৌশল হল, covering বা আড়াল করে রাখা। এইভাবে নিজের অনেক কিছু আড়াল করে সে স্বাভাবিক কাজকর্মের অনেকটাই চালিয়ে যেতে পারে। সমাজচলতি আচরণ যতটা সম্ভব মেনে চলে স্টিগমার প্রভাব কমানোর চেষ্টা করে। অন্যদিকে কিছু লোক আছে যাদের জীবনে লজ্জিত হওয়ার মতো কিছু ঘটে গেছে (discreditable attribute)। এরা কিন্তু স্টিগমা বা কলঙ্ক এড়াতে নিজেদের লজ্জার দিকটা গোপন করতে চায়। অথবা তাদের লজ্জা করার মতো ঘটনাকে তারা অন্যদের কতটুকু বলবে বা কীভাবে বলবে সেটা নিজের মতো করে ঠিক করে নেয়। ধরা যাক ডাক্তারি পড়তে থাকা ছেলেকে নেশা ছাড়াবার জন্য কোনও রিহ্যাবে দিয়ে চিকিৎসা করানো হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাবা-মা আত্মীয় পরিজন বা ছেলের বন্ধুবান্ধবদের বলল — সুদীপের শরীরটা ভালো নেই, তাই ওকে কিছু দিনের জন্য চেঞ্জে পাঠিয়েছি। এসব মানুষরা তাদের সবকিছু ঠিকঠাক চলছে এমন হাবভাব করে। কিন্তু এর জন্য তাদের যথেষ্ট সমস্যার মধ্যে দিয়ে চলতে হয়। কারণ এই বুঝি তাদের সবকিছু ফাঁস হয়ে গেল বা জানাজানি, কানাকানি হয়ে গেল। যেন লজ্জিত হওয়ার যোগ্য (discreditable) এসব লোকেরা এড়িয়ে যাওয়া ও গুটিয়ে নেওয়া — এই দুটি কৌশল নিয়ে থাকে। এড়াতে গিয়ে লজ্জাজনক ঘটনাটাকে আড়াল করতে হয় আর গুটিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সামাজিক সম্পর্কগুলি থেকে সরে আসতে হয়।
Scamber ও Hopkin, Goffman-এর ধারণার ওপর ভিত্তি করেই মৃগী রোগীদের নিয়ে অনুসন্ধান চালালেন। তিনি Stigma-র ধারণায় আবার একটা পার্থক্য আনলেন। তিনি অন্য দু-ধরনের স্টিগমার কথা বললেন। একটি enacted stigma বা দেগে দেওয়া তকমা আর অন্যটি felt stigma অনুভূত বা আত্মীকৃত তকমা। এখন মৃগী রোগীদের দিক থেকেই ব্যাপার দুটি প্রথমে দেখা হয়েছিল। মৃগী রোগীদের খিঁচুনি, মুখে গ্যাঁজানো, অজ্ঞান হওয়া দেখে মানুষ তাদেরকে ‘স্বাভাবিক’ অন্য পাঁচজনের থেকে ভিন্ন করে দিতে শুরু করে। আলাদা করে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে এবং এদেরকে অন্যদের থেকে কিছুটা গুরুত্বহীন মনে করে। মৃগী রোগীদের প্রতি সমাজমনে এই ধারণা বাঁধাগতে চলতে শুরু করে। শেষমেশ তাদের পরিচয়ে নিম্নমানের মানুষের ছ্যাঁকা দাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়। এটাই হল দেগে দেওয়া স্টিগমা বা enacted stigma। সমাজের চোখে এরা উপেক্ষিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাঞ্ছিত নীচ, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবার আসি felt বা আত্মীকৃত তকমার প্রসঙ্গে। এখানে কেউ সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে — এই বুঝি তার ওপর একটা তকমা সেঁটে দেওয়া হল। আবার মৃগীরোগী হওয়ার জন্য লজ্জার অনুভূতিটাও তার সঙ্গে থাকে। (Scamber এবং Hopkins 1986-কে অনুসরণ করে) মৃগী রোগীদের লোকেরা হীন বা নীচ বা হেয় দৃষ্টিতে দেখে থাকে (দেগে দেওয়ার স্টিগমা) বলে মৃগী রোগীরা এই স্টিগমার আঘাত সামলাতে পথ খুঁজে বেড়ায় (আত্মীকৃত স্টিগমা)।
আত্মীকৃত বা Felt stigma -য় বিদ্ধ/ বিদ্ধস্ত মানুষ অন্তত চারভাবে এর মোকাবিলা করে। (১) বিশেষ বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে সংবৃত বা নিরস্ত রাখা। কাজের জায়গায় বা অবসর যাপনের ক্ষেত্রে কাউকে যাদের সঙ্গে চলতে হয় বা মিশতে হয় তাদের বেশিরভাগ মানুষকেই তারা এসব জানায় না। কেবলমাত্র ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসী বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের মাত্র কয়েকজনকে বলে। সাধারণত এরা বলার জন্য বা প্রকাশ করার জন্য একটা পরিকল্পনা করে। তারা ঠিক করে নেয় কোন পরিস্থিতিতে তারা তাদের অসুস্থতার কথা গোপন রাখতে পারবে আর কখনই বা তারা অন্যকে জানতে দিতে পারে। যেমন ধরা যাক, কারও মৃগীর ব্যাপারটা চিন্তাভাবনা করে বুঝেশুনে সময়মতো তোলা হল বা বুঝিয়ে বলা হল। আবার হয়তো দূরে কোথাও বেড়াতে গিয়ে বা বন্ধুর সাথে অনেকটা সময় কাটানোর পর মৃগীর ব্যাপারটা উত্থাপন করা হল। (২) লজ্জা বা অপমানের যোগ্য (discreditible) অবস্থাকে আড়াল করে বা গোপন রেখে লোকে স্টিগমা অনুভব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এর মধ্যে আবার জানাজানি হয়ে যাবার ঝুঁকিটা থেকে যায়, Goffman-ও একই কথা বলেছিলেন। (৩) রোগের চিকিৎসা চলছে বলে মানুষের মধ্যে সমানুভূতির উদ্রেক ঘটানো। (৪) দেগে দেওয়া স্টিগমার চ্যালেঞ্জ জানাতে নিন্দুকদের নিন্দা করা ও কখনও-বা রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েও স্টিগমা আটকানো হয়।
যদিও Scamber ও Hopkins তাদের বিশ্লেষণটি সুনির্দিষ্টভাবে মৃগী রোগীদের ওপর প্রয়াগ করেছিলেন। এই একই প্রতিক্রিয়া আরও অন্যসব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। যারা স্টিগমার মোকাবিলা করছে তাদের মধ্যে অক্ষম মানুষদের সংখ্যাই বেশি। অক্ষমতা বা disability-র সঙ্গে যুক্ত যে স্টিগমা তার সঙ্গে লড়তে এরা একটা শক্তিশালী লবি গড়ে তোলে। অক্ষম মানুষদের শুভ কামনায় একটা ছোটো গ্রুপ থেকেই ১৯৮১-তে British Council of Organisation of Disabled-এর প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর ১৯৮৬ সালে এ-বিষয়ে প্রথম অ্যাকাডেমিক জার্নাল Disability and Society প্রকাশিত হয়। মূল লক্ষ্য ছিল disability বিষয়ে রাজনৈতিক চিকিৎসাগত ও পারস্পরিক ক্রিয়ার মুখপত্র হয়ে ওঠা।
১৯৯৩-এ Hall এবং তাঁর সহযোগীরা প্রাপ্তবয়স্কদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন মানসিক অসুস্থদের সাথে কথা বললে তাদের কীরকম প্রতিক্রিয়া হবে। যদিও একটা বড় অংশ রাজি ছিল যে তারা মানসিক অসুস্থদের সাথে কথা বলতেই পারে, তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ মানসিক অসুস্থদের সাথে যতটা সম্ভব কম সামাজিক মেলামেশা করতে চায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ মানসিক অসুস্থরা থাকবে এমন পার্টিতে ২৫ শতাংশের বেশি লোক তাদের বাচ্চাদের পাঠাবেন না। ৩৫ শতাংশ লোক কোনও প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া রোগীর নিকট প্রতিবেশীরূপে বসবাস করতে চান না। গবেষণা কিন্তু Scheffs-এর দাবিকে সমর্থন করছে। মানসিক অসুস্থতার প্রতিরূপ মিডিয়ার মাধ্যমেই গড়ে ওঠে। যেমন ধরা যাক, যারা কাউকে মানসিক অসুস্থরূপে চেনে-জানে, তারা কিন্তু সাধারণত ওদের প্রতি তেমন নীচু মনোভাব প্রকাশ করে না। মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে যারা গণমাধ্যমের থেকে জানে বোঝে, তাদের মধ্যে মানসিক রোগ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি নেতিমূলক বা হীনমনোভাব দেখা যায়।
Philo ও তার সহযোগীরা (১৯৯৬) টানা এক মাস ধরে সংবাদ মাধ্যমে সম্প্রচারিত fiction ও non-fiction বিষয়ের কনটেন্ট অ্যানালাইসিস করছেন। বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে মিডিয়ায় এইসব সম্প্রচারের ৬৬ ভাগেরও বেশি ক্ষেত্রে মানসিক রোগীরা অন্যদের প্রতি আক্রমণাত্মক বা violent এমনটাই দেখানো হয়েছে। আবার এটাও দেখানো হয়েছে মানসিক রোগীদের ১৮ শতাংশ নিজেদের প্রতি ভায়োলেন্ট বা হিংসাত্মক। মিডিয়া সম্প্রচারিত সংবাদের মাত্র ৪ শতাংশ ক্ষেত্রে মানসিক অসুস্থতাকে যথাযথ বা যথাকাঙ্ক্ষিতভাবে দেখানো হয়েছে।
Philo এবং সহযোগীরা অনুসন্ধানের দ্বিতীয় পর্বে দেখানোর চেষ্টা করলেন, গণমাধ্যমের ভাবমূর্তিতে কোনও এক sample বা নমুনার লোকেরা কেমনভাবে প্রতিক্রিয়া করে। Philo ও তার সহযোগীদের সিদ্ধান্ত কিন্তু Hall ও তার সহযোগীরা যা পেয়েছিলেন তাকেই সমর্থন করল। অধিকাংশ মানুষ মিডিয়া থেকেই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ধারণা করে থাকে। লোকজন এমন অনেক মানসিক অসুস্থদের দেখেছেন যারা কখনোই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে না। তবু সাধারণ মানুষ প্রায়ই মানসিক অসুস্থতার সাথে হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক আচরণকে গুলিয়ে ফেলে।
James Lortton (১৯৯৮) স্টিগমাকে দেখার এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিকে কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিশেষত যখন সেটি disability বা অক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। বাস্তব জগতে এর প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে Carlton প্রশ্ন তুলছেন। Carlton মনে করেন সারা পৃথিবীতে অক্ষম মানুষদের বাস্তব দিকটা সত্যি দুৰ্বল হওয়ার কারণ হল ভালো চাকরি বা নিয়োগের সুযোগ থেকে যেমন তারা বঞ্চিত, তেমনি আর একটি দিক হল তাদের পরিচয়ের সাথে নীচ, ছোটো, দুর্বল— এসব অপমানজনক তকমা সেঁটে দেওয়ার মনোভাব। Charlton আত্মীকৃত স্টিগমা বা felt stigma-র ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন— এটাই জীবনযাপনের ন্যায্য গুণমান থেকে আমাদের মনোযোগকে সরিয়ে দেয়। স্টিগমার মতো সমাজতাত্ত্বিক ধারণা মুখোশের আড়ালে দুর্বল অক্ষম disabled-দের প্রতি নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়ে যেতে সাহায্য করে। Charlton-এর মতে দীর্ঘকালীন অসুস্থতা ও অক্ষমতাকে বোঝার একমাত্র কার্যকর উপায় হল একে অবয়ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা। কারণ এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই তাদের দুর্বলতা বা অসহায়তার কারণগুলির প্রতি যথাযথ অভিনিবেশ নিবন্ধ করা হয়েছে।
সমাজের মধ্যে সেই কবে থেকে যে মানসিক রোগীদের নিয়ে বাঁধা গতে চলে আসা নেতিমূলক ধারণা-মূল্যবোধ ও বিবেকবিরোধী মনোভাব চলে আসছে, তার উৎস অনুসন্ধান করা কঠিন। তবে এই অবমাননামূলক লেবেল সেঁটে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে হীনবল করতে সমাজের মানুষকেই অনেক বেশি তৎপর ও সক্রিয় হতে হবে। নির্যাতিতদের নিজের কথা তাদেরই বলতে দেওয়া উচিত। তাই Stigma -র সাথে সত্যি সত্যি লড়তে হলে সমাজতাত্ত্বিক, মনোবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা যথেষ্ট নয়। সাথে ও পাশে নিতে হবে এগিয়ে দিতে হবে প্রতিবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যারা Stigma-র কারণে মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন অপাংক্তেয় বা বিচ্ছিন্ন হয়ে বা হতে চলেছে।
পাগল যে তুই, কণ্ঠ ভরে
জানিয়ে দে তাই সাহস করে
— রবীন্দ্রনাথ